অধ্যায় একুশ – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ
খণ্ডালের গুহা, রামু, চট্টগ্রাম
নৌকা থেকে মাটিতে পা রাখার সময় নিজের শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে না পেরে পড়ে গেল কিরান। তাতে অবশ্য ভালোই হলো। একের পর এক শারীরিক আর মানসিক চাপে একেবারে কাবু হয়ে গেছিল ও। তার ওপরে দীর্ঘ সময় নৌকায় বসে থেকে শরীর একেবারে জমে গিয়েছিল। তাই মাটিতে পা রাখতেই শরীর আর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। পড়ে গেছে সমুদ্রপারের আধভেজা বালিতে
মাটিতে পড়ে যেতেই রাতের আকাশে চাঁদ আর নক্ষত্রের অবস্থান পরিষ্কার দেখতে পেল সে। সন্ধেবেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সময়টা পরিষ্কার বুঝতে না পারলেও এবার রাতের আকাশে নক্ষত্রের অবস্থানের দিকে তাকিয়ে এটা বুঝতে পারল নৌকায় আসতে আসতে যতটা সময় পার হয়ে গেছে বলে ও ভেবেছিল সময় আসলে ততোটা পার হয়নি। ভোরের জোয়ার ধরতে হলে এখনো আরো আট দশ- ঘণ্টা সময় আছে। কাজেই এ-পর্যন্ত যেহেতু পৌঁছে গেছে ও তাতে করে আর সমস্যা হবে না।
‘ওস্তাদ, তুমি ঠিক আছ?’ চাঁদের হালকা আলোতে একটা ছায়া পড়ল ওর ওপরে। কিরান চোখ মেলে দেখল বেদু তাকিয়ে আছে ওর দিকে। বেদুর কোলে বানরটাকে এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন কোনো ঘুমন্ত মানবশিশু। অন্যদিকে দস্তানা পরা অন্য হাতটাতে ইগলটা বসে ছিল। ওটাকে মৃদু ঝাঁকি দিতেই শূন্যে উড়াল দিল ওটা। বেদু হাতটা বাড়িয়ে দিল কিরানের দিকে।
মাটিতে শুয়ে কিরানের এত আরাম লাগছিল ক্লান্তির চোটে মনে হচ্ছিল আধভেজা মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু বেদু হাত বাড়াতেই সে শক্ত করে বেদুর হাতটা ধরল। বেদু এক টানে দাঁড় করিয়ে ফেলল তাকে। উঠে দাঁড়িয়ে কিরানের দৃষ্টি গেল নৌকোটার দিকে।
গোমেজ ওটাতে চড়ে মাটিতে টেনে তুলে নৌকা থেকে ধরে মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিল হালকা পাতলা আকৃতির মানুষটাকে। তারপর ঝুঁকে পড়ে নৌকোর পাটাতন থেকে তুলে নিল একটা ভারী বোঝা। বোঝাটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে সে দাঁড় করানো মানুষটার কাঁধে ধরে এগিয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে। কিরানকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সে সামান্য হেসে উঠল। কাঁধের বিশালাকায় ফিরিঙ্গিটাকে এমনভাবে ধরে রেখেছে যেনে মানুষটা তুলোর চেয়ে হালকা।
কিরানও তার দিকে তাকিয়ে শুষ্ক একটা হাসি দিয়ে গোলন্দাজের কাছে জানতে চাইল, সে ঠিক আছে কি না। গোলন্দাজ কোনো কথা না বলে সামান্য মাথা নেড়ে জবাব দিল, সে ঠিক আছে। যদিও তার চেহারা আর অবস্থা দেখে যে- কেউ বুঝতে পারবে আসলে কিছুই ঠিক নেই। কিরান একবার ফিরে তাকাল দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। ওরা সৈকতের যেই প্রান্তে আছে সেখান থেকে খণ্ডালের গুহা কয়েক মাইল দূরে হবে। এই শরীরে কয়েক মাইল হাঁটতে কষ্ট হবে কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় কী? যত দ্রুত হাঁটতে শুরু করবে ততো দ্রুত পৌঁছাতে পারবে। সবাইকে এগোনোর জন্য ইশারা করে কিরান হাঁটতে শুরু করল।
খণ্ডালের গুহার কাছাকাছি পৌঁছাতে পৌছাতে কিরানের মনে হলো পা আর চলছে না। কয়েক মন সিসে বেঁধে দেওয়া হয়েছে পায়ের সঙ্গে। আরেকটু এগোলে হয়তো হোঁচট খেয়ে পড়েই যেত হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ শব্দের সঙ্গে সবাই থেমে গেল। আঁধারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক সারি লাঠিয়াল। সবার অগ্রভাগে তুলারামকে দেখে মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল কিরানের। তার দিকে তাকিয়ে একটা হাত তুলে সে বলে উঠল, ‘কুনোদিন ভাবি নাই তরে দেইখা এত খুশি হবো,’ বলে সে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে গেল তুলারামের গায়ের ওপরে।
***
জ্ঞান ফিরে আসতেই চট করে উঠে বসল কিরান। মুহূর্তের জন্য ওর মনে হতে লাগল ও শত্রুশিবিরে বন্দি আছে। পরমুহূর্তে যেই মনে পড়ল সে কোথায় আছে সেই মুহূর্তে পলকের জন্য মনে হলো ওকে ফেলে জাহাজসহ সবাই চলে গেছে। কিন্তু ওর সামনে উপবিষ্ট মানুষটার দিকে চোখ পড়তে আরো অনেক বেশি অবাক হলো কিরান।
‘শান্ত অও কিরান, সব ঠিক আছে,’ মানুষটা তার মুখের সামনে থাকা গড়গড়ার ধোঁয়া হাত দিয়ে তাড়ানোর মতো করে বলে উঠল। কিরান অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আকরাম চাচা, আপনে?
আকরাম বেগকে এই সময়ে এখানে দেখে খুবই অবাক হয়েছে কিরান। তার চেয়ে বড়ো যে প্রশ্নটা ওর মনে জেগেছে সেটা হলো, এই লোক এখানে কী করছে। ‘আপনি এই সময়ে এখানে…!’ নিজের বিস্ময়ভাবটা আসলেই লুকাতে পারল না কিরান। অথবা বলা চলে, সে চাইলও না।
কিরানের কথা শুনে হেসে উঠল আকরাম বেগ। ‘তুমি খুশি হও নাই আমারে দেইখা?’ প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে কথাটা বলে সে নিজেই হেসে উঠল তারপর অনেকটা মজা করার মতো করে বলে উঠল, ‘এত বড়ো একটা কামে যাইতাছো তুমগোরে আশীর্বাদ করতে আইলাম। তুমি খুশি অও নাই?’ জানতে চেয়ে সে আবারও হেসে উঠল।
কিরান হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘ঠিক আছে।’
‘ঠিক নাই,’ বলে আকরাম বেগ ওর দিকে এগিয়ে এলো খানিকটা। কিরান একটু অস্বস্তির সঙ্গে অনুভব করল আকরাম বেগ ওর কপালে হাত রেখে বলে উঠল, ‘তুমি ঠিক আছ তো?’
‘জি, আসলে—’ কিরান গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে উঠে বসল। ওভাবে বোকার মতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলাতে কিরানের নিজের কাছেই এখন লজ্জা লাগছে খানিকটা। ‘চাচা, আসলে তেমন কিছু না। অতিরিক্ত ক্লান্তিতে…’
‘কিরান,’ দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে আকরাম বেগ বলে উঠল। ‘যে কামে তুমি যাইতাছো এর জন্য সবাই যখন তুমার নাম প্রস্তাব করল আমি প্রথমে মানা করছিলাম। সত্যি কথা অইলো তুমারে আমার এই কামের যোগ্য মনে অয় নাই। বিশেষ কইরা আগের তুমি অইলে কথা ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধইরা, সারাক্ষণ মদ, তামাক আর অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন তুমারে শেষ কইরা দিছে, ‘ কিরান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আকরাম বেগ হাত তোলায় সে তাকে থামিয়ে দিল। কিন্তু গত কাইল কামে নামার পর থেইকা তুমি যা দেহাইছো আমি হতবাক। আমার বন্ধু তালেব তৈমূর ক্যান সবসময় তুমারেই তার সত্যিকারের সন্তান মনে করত আমি খানিকটা অনুভব করতে পারতাছি। বিরাট সাহসের কাম করছ তুমি, বিশেষ কইরা আইজ বিকেলে ওই ফিরিঙ্গিটারে ধইরা আনা তারপরে আবার নুনের ভিটায় গিয়া গোলন্দাজরে উদ্ধার কইরা আনা, খালি তুমার সাহস কিংবা সামর্থ্যের না বরং তুমার বুদ্ধিমত্তারও পরিচয় পাইছি আমি। আমার বিশ্বাস তুমার বাপে…’ কিরান খুব অবাক হয়ে দেখল পাথরের মতো মানুষটার চোখে পানি।
আবারও কিরান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আকরাম বেগ উঠে দাঁড়াল নিজর গড়গড়া আর পাঞ্জাবি সামলে নিয়ে সে কিরানের দিকে হাত তুলে বলে উঠল, ‘কিরান, খুব বেশি সময় পার অয় নাই। এহনো জোয়ার ধরার লাইগ্গা অনেক সময় আছে কিন্তু অনেক কামও আছে। তুমি পরিষ্কায় অয়া,’ বলে সে জায়গাটার কোনায় পানির একটা ঘরা দেখাল। ‘ওই নতুন কাপড় পইড়া লও,’ বলে সে খাটিয়াটার কিনারায় রাখা কাপড় দেখাল। কিরান কিছু না বলে মাথা নাড়ল।
আকরাম বেগ বেরিয়ে যেতেই চট করে উঠে দাঁড়াল কিরান। তারপর প্রথমেই আকরাম বেগের গড়গড়াটার কাছে গিয়ে ওটার নলটা মুখে নিয়ে টানতে লাগল। টানা বেশ কয়েক টান দিয়ে ধোঁয়া টেনে নিয়ে পরম তৃপ্তি পেল ও।
‘মানুষ মইরা গেলেও সিধা অয় না,’ ছোটো কামরাটার কিনারা থেকে একটা ভারী গলা বলে উঠল। কিরান ধোঁয়া টানতে টানতেই সেদিকে ফিরে তাকাল। ‘কিছু করার নাই, যম্মিন দেশে যদাচার,’ বলে কিরানও হেসে উঠল পট্টবর্ধনের কথা শুনে। ‘আমার অবস্থায় পড়লে বুঝতা।’
গড়গড়ার নলটা রেখে কিরান শুধু কোমরবন্ধনী বাদে গায়ের বাকি পরিধেয় খুলে ফেলে পানির ঘরাটার কাছে গেল। গায়ে হাতে, মুখে পানি দিতে দিতে ফিরে তাকাল পট্টবর্ধনের দিকে। পট্টবর্ধন কিরানের শুয়ে থাকা খাটিয়ার কিনারায় বসে ওর দিকে এক চোখে তাকিয়ে প্রশংসার সুরে বলে উঠল। ‘বিরাট খেইল নাহি দেখাইলা আইজ?’ তার গলায় নিখাদ প্রশংসা।
গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে কিরান বলে উঠল। ‘শোন কাপ্তান, প্রস্তুতি যতই শক্ত হোক সেটাতে প্রশংসার কিছু নাই, যদি না তুমি কামে সফল অইতে পার, বলে কিরান তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘এহন পর্যন্ত যা অইছে সেটাকে কপাল ভালো আছিল, আমার লগে সাহসী লোক আছিল তাই পারছি। কিন্তু এই পারার দাম নাই যদি আসল কামে সফল না অইতে পারি। তুমগো কী অবস্থা, এহন পর্যন্ত?’ কিরান পানি ঢালা শেষ করে গা মুছতে মুছতে জানতে চাইল। ‘জোয়ার ধরা যাইব সকালের?’
‘সব ঠিকঠাক থাকলে আমগো প্রস্তুতি একেবারে শেষ দিকে,’ বলে পট্টপৰ্ধন নিজের সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠল, ‘তোমরা আলোচনা কইরা কর্তব্য ঠিক করতে পারলে আগামী তিন থেইকা চাইর ঘণ্টার ভেতরে আমরা জাহাজ ভাসাইতে পারব।’
‘ঠিক আছে,’ কিরানের পোশাক পরা শেষ হতেই সে দেখতে পেল ওর জোড়া ড্যাগার আর পিস্তলজোড়াও বিছানার কিনারায় রাখা আছে। ‘গোলন্দাজের লগে দেহা অইছে?’ অস্ত্রগুলোকে কোমরবন্ধনীর সঙ্গে আটকাতে আটকাতে জানতে চাইল কিরান। জবাব না পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল পট্টবর্ধনের ভালো চোখটা যেন জ্বলছে। কিরান তার দিকে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকাতেই হেসে ফেলল সে। ‘না, এহনো অয় নাই।’
‘বেচারা আইজ সব হারাইছে,’ কথা নয় যেন পট্টবর্ধনের কাছে আবেদন। ‘শুনলাম,’ মৃদু স্বরে বলে উঠল পট্টবর্ধন। ‘এহন চলো।’
পট্টবর্ধনকে নিয়ে কিরান পা রাখল কামরার বাইরে। ওরা ছোটো জলা মতো জায়গাটা পার হয়ে প্রবেশ করল মূল গুহায়। সেখানে প্রবেশ করেই কিরান দেখতে পেল তিনটে জাহাজই একেবারে প্রস্তুত অবস্থায় সারি দিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটাতে সাজানো কামানগুলো দেখে কিরানের বুকো বল যেন তিন গুণ হয়ে গেল। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখা গোঁফে তা দিল একবার।
‘দারুণ না?’ পট্টবর্ধন বলে উঠল। ‘কিরান কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল জাহাজগুলোর দিকে। ‘আমার লোকেরা সবাই প্রস্তুত?’ সে জানতে চাইল।
‘একেবারে ওস্তাদ?’ কিরান ফিরে তাকিয়ে দেখল একেবারে সমর সাজে সজ্জিত হয়ে কাঁধে বানর আর হাতে ইগলটাকে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো বেদু। কাছে এসে হুপ করে শব্দ করতেই ইগলটা শূন্যে উঠে পাক খেতে লাগল।
‘তোর বাঘটা কই?’ কিরান জানতে চাইল।
‘ওইটা আছে। মতিরেসহ ওইটারে এইহানের মন্দার বাজারেই রাহার ব্যবস্থা করছে আকরাম বেগ।’
কিরান সন্তুষ্টির সঙ্গে মাথা নাড়ল। ডানে তাকিয়ে দেখতে পেল বৈঠা আর বিল্লাল শেঠ জাহাজে কোষা নৌকা তুলতে সাহায্য করছে। সেদিকে তাকিয়ে সামান্য হাত নাড়ল কিরান।
‘অস্ত্রসস্ত্র সব সাজানো অইছে?’ পট্টবর্ধনের দিকে দেখে জানতে চাইল কিরান।
‘সব তোলা আছে গত দিনে যা যা দেখছিলা,’ বলে সে মাথা নাড়ল। ‘তুমগো সবার লগে রাইতের আহারের আয়োজন করা অইছে। সেখানেই সব আলোচনা অইবে। চলো,’ বলে সে কিরানের পিঠে হাত রেখে গুহার একপাশে চলে এলো। সেখানে এসে দেখল পাহারাদারদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা আকরাম বেগের সঙ্গে কথা বলছে বাবুর্চি রহমত চাচা। তার সঙ্গেই একেবারে আপাদমস্তক কালো পোশাক পরা একজন মানুষ। লোকটা আকরাম বেগকে কিছু একটা বলছিল, কিরানকে দেখে থেমে গেল। রহমত চাচা তাকে নিয়ে রওয়ানা দিল জাহাজের ভেতরের দিকে।
কিরানকে দেখে আকরাম বেগ হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। কিরান সেদিকে এগিয়ে যেতেই আকরাম বেগের কাছে জানতে চাইল, ‘ওই লোকটা কে,
ওরকম পোশাক পরে আছে কেন?’
আকরাম বেগ একটু অবাক হয়ে ফিরে তাকাল কিরানের দিকে, ‘তুমি জানো না?’ সে যেন একটু অবাক হয়েছে। কিরান মাথা নেড়ে মানা করল। আকরাম বেগ মাথা নাড়ল আফসোসের সঙ্গে। ‘এরা এক অদ্ভুত প্রজাতির মানুষ। এগো কোনো ধর্ম নাই, সমাজে অবস্থান নাই। এইডা আমাগো সমাজেরই খুব অদ্ভুত এক প্ৰথা। জীবন থেইকা সব হারায়ে, সব শেষ হয়ে গেলে এরা যখন সর্বস্ব হারায় নিজে থেকেই ওগোরে কিছু অর্থ দিয়া ঋণমুক্ত কইরা দেওয়া হয়। বিনিময়ে এরা চিরতরে চুপ হইয়া যায়, এগোর কথা বলা নিষেধ, এদের নিজের চেহারা কাউকে দেখানো নিষেধ। এগোরে কী বলে জানো?’ বলে আকরাম বেগ কিরানের দিকে তাকিয়ে দুঃখের হাসি হেসে উঠল। ‘এগোরে বলে ‘পতিত’,’ বলে সে কিরানের পিঠে জোরে চাপড় মারল।
কিরান একটু অদ্ভুত দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল লোকটার খোঁজে। কিন্তু দেখতে পেল না। এই বিশেষ গোত্রের লোকদের কথা ওর জানা ছিল, কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখেনি। আকরাম বেগ ওর পিঠে চাপড় মেরে বলে উঠল, ‘তুমি তো মনে হয় সেই দুপুরের পর থেইকা আর কিছু খাও নাই। আমরাও খাই নাই। চলো খাইতে খাইতে কথা হবে,’ বলে সে কিরানকে গুহার এক প্রান্তে নিয়ে গিয়ে দেখতে পেল সেখানে লম্বা করে দস্তরখানা বিছানো হয়েছে খাবার জন্য।
আকরাম বেগ কিরানকে নিয়ে বসে পড়ল। কিরান বসে দেখল ওরা যেখানে বসেছে সেখানে গোল হয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাই বসে যেতেই খাবার পরিবেশন করা হলো, সেই সঙ্গে চলল আলোচনা। খাওয়া শেষ হতেই প্রথমেই পট্টবর্ধন উঠে দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
সে আকরাম বেগের অনুমতি নিয়ে বলতে শুরু করল। ‘আমি পট্টবর্ধন চাঁটগাওয়ের কায়স্থ বর্ধন পরিবারের সন্তান। আমি এখানকার সর্বাগ্রে থাকা বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের অনুমতি নিয়া শুরু করতাছি। এহানে ধর্ম-কর্ম, জাত-পাত সব কিছু নির্বিশেষে আমরা জড়ো হয়ছি একটা মহৎ উদ্দেশ্য মাথায় নিয়া। আমগোর নিয়োগকর্তা,’ সে একটু বলতেই আকরাম বেগ মাথা নেড়ে মানা করল।
পট্টবর্ধন বলতে লাগল, ‘আমি প্রথমেই আমগো প্রস্তুতির ব্যাপারে কয়া নেই। আমগো তিনটা জাহাজ আছে, দুইটা জালিয়া, একটা বড়ো যুদ্ধজাহাজ। বড়ো অস্ত্রের মধ্যে বড়ো জাহাজে আছে চাইরটা কামান, পরের দুইটাতে তিনটা কইরা কামান। তিন জাহাজ মিলায়া বন্দুক আছে প্রায় তিরিশটার বেশি। আর লাঠি, বর্শা, কোচ, বেইদ, তলোয়ার, ছুরি এইগুলার বহুত আছে,’ সে এই পর্যন্ত বলতেই তালি দিয়ে উঠল সবাই।
‘আমগো তিন জাহাজে মোট মানুষ আছে প্রায় চল্লিশজনের মতোন। এর বাইরে প্রত্যেক জাহাজে দাঁড়ি আছে আরো বিশ জন কইরা। যদিও আমরা পালের ওপরেই বেশি নির্ভর করব। এর পাশাপাশি আমাগো আছে,’ বলে সে থেমে গেল। ‘সবার সেরা যুদ্ধ জাহাজি তালেব কিরান,’ কিরানের নাম নিতেই সবাই জোরে শব্দ করে উঠল মুখ দিয়ে।
কিরান উঠে দাঁড়াল। ‘পট্টবর্ধন আমার বড়ো ভাইয়ের মতোন। সে অনেক কথাই বলছে কিন্তু একটা কথা আমি বলতে চাই। এই যে আমরা এত মানুষ। এত প্রস্তুতি সব কীসের লাইগ্গা। আমরা আইজ নিজ ভূমে পরবাসী, দানবের থাবায় আমগো উপকূল খালি অইযাইতাছে, আমগো মানুষগো গরু-ছাগলের মতোন কেনাবেচা করতাছে হুগলির হাটে, রোসাঙ্গের বাজারে। কারা করতাছে?’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘বিদেশিরা। যারা বাইরের মানুষ তারা আমগো উচ্ছেদ করতাছে, আর আমরা নিজের ভূমিতে ভয়ে কাঁপতাছি। সময় আসছে দানবের মোকাবেলা করার। আমগো সুবাদার যে কি না এই বাঙ্গাল মুলুকের জন্য সবচে বেশি কষ্ট করছে সেই শাহ সুজারে পরিবারসহ হত্যা করা অইছে। আমার বাবা তারে সাহায্য করতে গিয়া প্রাণ লয়া ভাগতাছে। তারে সাহায্য করতেই আমগো এই অভিযান। তুমরা কি সবাই আছ আমার সঙ্গে?’ শেষ শব্দগুলো কিরান উচ্চারণ করল গলার সর্বোচ্চ জোর নিয়ে।
সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। কিরান আকরাম বেগদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘তাইলে কাজে নামব এখন, সকালের জোয়ারের প্রথম প্রহরেই আমগো জাহাজ পানিতে নামব। বোঝা গেছে?’
সবাই কাজে নেমে যেতেই কিরান পট্টবর্ধনকে কাছে ডেকে সব কাজ তদারকির নির্দেশ দিল। তারপর আকরাম বেগে দিকে ফিরে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই দেখতে পেল গোলন্দাজ এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। সে খাওয়াতেও ছিল না ওদের সঙ্গে।
‘গোলন্দাজ, তুমি খাইছো?’ গোলন্দাজ জবাব না দিয়ে কিরানের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব হালকা স্বরে জানতে চাইল, ‘কিরান, তুমি সব কইলা কিন্তু সিলভেরার নাম নিলা না? কারণ কী?’ সে হাতের হুঁকোতে দুটো টান দিল। ‘এহনো ভয় পাও?’
কিরান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গোলন্দাজের দিকে। ‘আমি ভয় পাই, আর এই কারণেই আমি এই ভয়েরে শেষও করতে চাই,’ বলে সে তাকিয়ে রইল গোলন্দাজের দিকে। ‘আর আমি জানি তুমিও ভয় পাও। আর তুমারেও এই ভয় কাটাইতে হবে। আমি তো স্রেফ নিজেরে হারাইছি। তুমি তো সব হারাইছো। কাজেই যদি পার সব দিয়া আমারে সাহায্য করো।’
কিরান আর গোলন্দাজ কথা বলছে দূর থেকে পট্টবর্ধন তাকিয়েছিল ওদের দিকে। গোলন্দাজও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। পট্টবর্ধনই নিজে এগিয়ে এলো প্রথমে। ‘গোলন্দাজ, কেমন আছো?’ তার ভালো চোখটাতে কোনো ভাব নেই।
গোলন্দাজ কিছু না বলে মাথা নাড়ল।
‘আইজ সন্ধ্যার সব কথা আমি শুনছি, খারাপ লাগছে,’ বলে সে দম নিয়ে একবার কিরানকে দেখল। গোলন্দাজ মাথা নিচু করে আছে। ‘তুমারে আমগো দরকার, গোলন্দাজ,’ চট করে মুখ তুলে তাকাল গোলন্দাজ। যেন পট্টবর্ধনের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। যে মানুষটা এক সময় দাবি করত গোলন্দাজের কারণেই তাদের পরাজয় হয়েছে। যে মানুষটা একটা চোখ হারিয়েছে তার কারণে। সে কিনা… গোলন্দাজ এক এগিয়ে আবেগী গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই কথা বলে উঠল অন্য কেউ।
‘এই জাহাজি, এইদিকে আহো,’ কিরান ফিরে তাকিয়ে দেখল লাঠিয়াল তুলারাম ওকে ইশারায় গুহার এক প্রান্তের দিক ডাক দিচ্ছে। কিরান এগিয়ে যেতেই সে বলে উঠল, ‘তুমি যে ফিরিঙ্গিটারে ধইরা আনছিলা ওরে গত দুই ঘণ্টা ধইরা জেরা কইরা একটা ব্যাপার জানা গেছে।’
কিরান তাকিয়ে আছে তুলারামের দিকে।
‘হেয় জানাইলো হেগোরো কাপসের বাজার আর গোলন্দাজের বাড়ি থেইক্কা সোজা সন্দ্বীপে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া অইছিল।’
‘তারমানে কি সিলভেরারে সন্দ্বীপে পাওয়া যাবে?’ কিরান আপন মনে বলে উঠল।
হইতেও পারে আবার নাও পারে,’ আকরাম বেগ বলে উঠল। ‘মনে রাইখো সন্দ্বীপ এহন দস্যুগোর মূল আস্তানা। সিলভেরা অইহানে না থাকলেও হের খবর ঠিকই পাওয়া যাবে ওইহানে। কিন্তু সন্দ্বীপ মানে বিপদের আখড়া-’
কিরান তাকিয়ে আছে বেদু গোমেজ আর আকরাম বেগের দিকে। আমগো সন্দ্বীপেই যাইতে হবে। আমার বিশ্বাস অইহানে গেলেই পাওয়া যাবে সিলভেরার খবর। সে কোনো দিকে রওনা দিছে অথবা বাপুর পিছু নিতে কোনো দিকে যাইতে পারে, সেইটার খবরও জানা যাবে ওইখান থেইকাই। কাজেই অমগো প্রথম গন্তব্য সন্দ্বীপ,’ বলে সে বেদুকে ইশারা করল সিদ্ধান্তটা পট্টবর্ধনকে জানিয়ে দিতে।
কিরান, কাজের পরিকল্পনা কী?’ আকরাম বেগ জানতে চাইল।
‘আমি এহনো জানি না,’ কিরান খানিকটা হেসে উঠল। ‘জাহাজ তিনটাই লইয়া রওয়ানা দিব, সন্দ্বীপ যাব সিলভেরা আর বাপুর খবর বাইর করব। তারপর দেখব সিলভেরার কত তেল আছে,’ কিরান চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল।
‘আমারও মনে হয় এখন সেটাই ঠিক হবে,’ বলে সে কিরানের হাতে একটা চামড়ার থলি ধরিয়ে দিল। ‘এটা এহন খুলবা না। এখানে সন্দ্বীপে আমার নিজের লোকের নাম আছে। লোকটা কে, তারে কেমনে পাইবা সব এহানে লেখা আছে। অর শোন জাহাজ সন্দ্বীপ থেইকা এট্টু দূরে রাখবা। সন্দ্বীপে এক দল যাবা না। কয়েক দলে ভাগ হয়া যাবা। খবর পাওয়া মাত্রই রওয়ানা দিবা, বোঝা গেছে?’
‘জি, চাচা,’ কিরান মাথা নিচু করে বলে উঠল।
তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘বৈঠার পোলা, বেদুর সহকারী মতি আর ওর প্রাণিগুলা, তোমার আম্মা, আর এই ফিরিঙ্গিটারে নিয়া চিন্তা করিও না। ওগোরে আমি দেখবো। তুমি কামে নামো, কিরান বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ আকরাম বেগ পেছনে থেকে তাকে ডাক দিল। ‘কিরান, মনে রাইখো তোমার আব্বা তোমার সঙ্গেই আছে, মানে তার আশীর্বাদ আছে তোমার সঙ্গে। সে তোমার ওপরে নির্ভর কইরা আছে,’ তার মুখে মৃদু হাসি। তারপর মুখটাকে শক্ত করে বলে উঠল, ‘মনে রাখবা, জয়ের আনন্দ সেই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতে পারে যে পরাজয়ের তিতা স্বাদ পাইছে। কাজেই,’ বাক্যটা অসমাপ্ত রেখে সে ঘুরে দাঁড়াল। কিরানও আনমনে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে এলো গুহাতে। সেখানে দুর্দান্ত হাঁকডাকের সঙ্গে শেষ মুহূর্তের প্রস্ততি চলছে জাহাজ জলে ভাসানোর।
পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা ওরা চরম ব্যস্ততায় পার করল। ভোরের প্রথম আলোর সঙ্গে সঙ্গে ফেঁপে উঠল পানি। জাহাজ নামানো হলো সেই পানিতে। বহুদিন পর কিরান জাহাজের সঙ্গে লাগোয়া নিজের কামরার ছোটো বারান্দায় এসে দাঁড়াল। জাহাজ এখনো সমুদ্রের পানিতে নামেনি। সেটা মোহনা ঘিরে চক্কর দিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চলে এলো খোলা সমুদ্রে।
কিরান বুক ভরে টেনে নিল সমুদ্রের নোনা বাতাস। বহু বছর পরে নিজেকে জীবিত মনে হচ্ছে ওর। পট্টবর্ধন ওর দিকে তাকাতেই হাতের ইশারায় দাঁড় টানা বন্ধ করে পাল খুলে দিতে ইশারা করল কিরান। পাল খুলে যেতেই তড়তড়িয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করল জাহাজ।
‘ওস্তাদ, সেই গানটা গাও,’ বেদু পেছন থেকে বলে উঠল। কিরান দেখল পট্টবর্ধনে মুখেও প্রশ্রয়ের হাসি। আসার পর থেকে গম্ভীর মুখে থাকলেও এই প্রথমবারের মতো সামান্য হেসে উঠল গোলন্দাজ। কিরান মাথা নেড়ে মানা করল। কিন্তু গোলন্দাজই প্রথম হাতের ছোটো লাঠি দিয়ে বাড়ি মারল জাহাজের রেলিংয়ে। তারপর পট্টবর্ধন, তারপর তুলারামের বাহিনীর লোকেরা। একে একে পুরো জাহাজের সবাই যে যেখানে আছে সেখান থেকে হাতের তালে বাড়ি মারতে লাগল জাহাজের খোলে বা রেলিংয়ে।
কিরান পট্টবর্ধনের দিকে ইশারা করতেই সেই প্রথম গেয়ে উঠল,
শূন্য থেইকা আসে মানুষ, শূন্যে মিলাই যায়’,
চিৎকার করে গেয়ে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে পুরো জাহাজের মাল্লা থেকে শুরু করে সবাই গেয়ে উঠল,
‘শূন্য থেইকা আসে মানুষ, শূন্যে মিলাই যায়’
‘শূন্য থেইকা আসে মানুষ, শূন্যে মিলাই যায়’
পট্টবর্ধন এর সঙ্গে যোগ করল,
‘নাওয়ের মাঝি হাল ধইরাছে, খবর কে-বা পায়’
‘ঘরের ছেলে ঘর ছাইড়াছে নোনা পানির টানে’
‘জীবন থাইকা জীবন হারাইছে পানির নেশার টানে’
পেছন থেকে সবাই আবারও বলে উঠল,
শূন্য থেইকা আসে মানুষ, শূন্যে মিলাই যায়’
‘শূন্য থেইকা আসে মানুষ, শূন্যে মিলাই যায়’
কিরান আবারও বুক ভরে টেনে নিল নোনা বাতাস, আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে তার জীবিত মনে হচ্ছে বহুদিন পরে।
শূন্য থেইকা আসে মানুষ শূন্যে মিলাই যায়,’ বিড়বিড় করে কথাটা বলে সে বুকের সঙ্গে ঝুলতে থাকা তার বাবার দেওয়া দোলকটা চেপে ধরল। ‘বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল, বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল, চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে যেতে লাগল সে।