অধ্যায় দুই – বর্তমান সময়
পতেঙ্গা রোড এলাকা, চট্টগ্রাম
যে যাই বলুক না কেন, প্রচলিত একটা ধারণা হলো পুরুষের জন্য নারী দেহের চেয়ে বড়ো নেশা নাকি এই ধরাধামে আর নেই। কথাটা এই মুহূর্তে খুব গভীরভাবে অনুভব করতে পারছে আবীর। আড়চোখে একবার পাশে বসা মেয়েটার দিকে তাকিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে নিল বাইরের দিকে। চলন্ত গাড়ির জানালার কাচটা একবার নামিয়ে দিল সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার জন্য।
মালিহা মেয়েটাকে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না আবীর। যে মেয়ে প্রায় সর্বক্ষণই কোনো না কোনো ড্রাগ সেবন করেই চলছে সেই মেয়ের সিগারেটের ধোঁয়ায় সমস্যা হয় কীভাবে! ভাবতে ভাবতেই আবীর জানালার কাচটা একটু নামিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাইটাও ফেলে দিল। যদিও কাজটা বেশ দ্রুত সেরেই সে আবার জানালার কাচ উঠিয়ে দিল কিন্তু এরই মধ্যে বৃষ্টির ছিটে জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে ভেতরে।
আবীর ভেবেছিল বৃষ্টির ছিটে ভেতরে এসে লাগাতে মালিহা বিরক্ত হবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না বরং বৃষ্টির ছিটে ভেতরে এসে লাগতেই মালিহা খিলখিল করে হেসে উঠে ফিরে তাকাল আবীরের দিকে। নিশ্চয় একটু আগে সেবন করা জিনিসের প্রভাব। তবে আবীরের কাছে সেরকম কিছু মনে হলো না। বরং তার মনে হলো, মালিহার হাসির সঙ্গে সঙ্গে বাইরে তুমুল বৃষ্টি হলেও গাড়ির ভেতরটায় যেন ঝলমলিয়ে উঠল সকালের মিষ্টি রোদে। মালিহা হেসে উঠে কিছু বলতে গিয়েও কেন জানি থেমে গেল। তার দৃষ্টি চলে গেল গাড়ির ভিউ মিররে। মালিহার দৃষ্টি অনুসরণ করে আবারও ফিরে তাকাল সেদিকে।
যদিও বাইরে ঝুমবৃষ্টি কিন্তু সেই বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই শব্দটা ভেসে আসছিল ওদের গাড়ির পেছনের সিট থেকে। আর যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই শব্দটা বুঝতে পারবে। একটা মাত্র মাধ্যমেই এই শব্দটা সৃষ্টি হতে পারে। দুজন মানুষের চুম্বন। পেছনের সিটে বসা আবীর আর মালিহার বন্ধু শাবাব আর জিতু নামের মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরেই মেতে উঠেছে আদিম লীলায়। অবশ্য তাদের বর্তমান অবস্থাটাকে ঠিক পুরোপুরি আদিম লীলা বলা যায় কিনা সেটা একটা আলোচনার বিষয় হতে পারে।
দুনিয়ার আর কোনোদিকে শাবাবের খেয়াল নেই। জাগতিক নেশা আর নারীদেহের স্বাদ তাকে পাগল করে তুলেছে। কিন্তু জিতু এখনো মনে হয় খানিকটা হুঁশে আছে। যে কারণে ওদের দুজনকেই ভিউ মিররে পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে একটু অস্বস্তির সঙ্গে নড়ে উঠল। নিজের ঠোঁট দুটো শাবাবের কবল থেকে খানিকটা মুক্ত করেই সে এমনভাবে হেসে উঠল, লেখকদের ভাষায় যে হাসিকে বলা হয় অপ্রকৃতস্থ হাসি। হাসতে হাসতেই সে গাড়ির মেঝে থেকে নিজের পার্সটা তুলে নিয়ে ছুড়ে মারল ওদের দিকে। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে গেল নিজের কাজে।
জিতু ব্যাগটা ছুড়ে দিতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠেছে মালিহা। ব্যাগটা ওদের দিকে ছুটে না এসে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে বাড়ি খেয়ে হারিয়ে গেল মালিহার পায়ের কাছে, আর সে ফিরে তাকাল আবীরের দিকে। আবীরও মৃদু হাসছে। দুজনেই তাকিয়ে আছে দুজনার দিকে। আবীরের দিকে তাকিয়ে মালিহা এবার যে হাসিটা দিল সেটার মাত্রা আগের চেয়ে অনেক ছোটো কিন্তু এই হাসিটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো রহস্য হিসেবে উল্লেখ করা সম্ভব। মালিহার রহস্যময় হাসির জবাবে আবীরেরও সম্ভবত একইরকম একটা প্রতিউত্তর দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে সে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিল রাস্তার সামনের দিকে। পৃথিবীতে কিছু সৌন্দর্য আছে যেগুলোকে সহ্য করা যায় না। মালিহার হাসিটাও অনেকটা সেরকম।
বৃষ্টির চোটে মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে নামবে। এরকম শীতের রাতে এমন বৃষ্টি হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক, তবে এই বৃষ্টিই আজকে ওদের অভিযানে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে। তুমুল বৃষ্টির ভেতরে ততোধিক তুমুল বেগে ছুটে চলা গাড়িটার ঘোলা কাচের ভেতর দিয়ে নিজের দৃষ্টি আর কল্পনা দুটোই পাখা মেলে ছুটতে দিল নেশায় চুর আবীর। জীবনটাকে অনেক বেশি সুখের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। যদিও এই মুহূর্তে তাকে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সত্যি কথা হলো আবীরের জীবনটা এই মুহূর্তের মতো চরম সুখী না হলেও কখনোই দুঃখী ছিল না। অন্তত টাকা-পয়সার দিক থেকে তো একেবারেই নয়। বিরাট শিল্পপতি বাবার দ্বিতীয় সন্তান সে। অঢেল টাকা-পয়সা তার বাবার। আসলে এই গাড়িতে উপস্থিত চারজনই তাই। আবীর, মালিহা. জিতু আর শাবাব চারজনেই ধনীর দুলাল ও দুলালি। অভাব কাকে বলে এরা কখনো দেখেনি জীবনে। টাকা- পয়সার চিন্তা এদের কাউকেই কখনো করতে হয়নি। বরং প্রাচুর্যকে কীভাবে আরো বেশি কাজে লাগিয়ে জীবনটাকে আরেকটু উপভোগ্য করা যায় সেটাই এদের প্রত্যেকের জীবনের প্রাত্যহিক দুঃশ্চিন্তার বিষয়।
তবে আবীর নিজেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান মনে করে। কারণ শুধু তারা বিত্তশালী নয়, তার পরিবার বেশ সুখীও বটে। অন্য ধনীদের মতো তার বাবা পরিবারকে কখনো বেখেয়ালিভাবে ছেড়ে দেননি। বরং সবসময় ব্যবসার পাশাপাশি তার প্রাধান্য পরিবার।
কিন্তু অতি অর্থের মধ্যে আপনা থেকেই একটা অনর্থ ব্যাপার চলে আসে। যেখানে অনেক বেশি অর্থের ছড়াছড়ি সেখানে খানিকটা অনর্থ ঘটবেই। ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে আবীরের ক্ষেত্রে। ছোটোবেলা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের ভেতরে বড়ো হলেও এইচএসসি পর্যন্ত আবীরের গন্তব্য ছিল স্কুল-বাসা আর বড়োজোর অত্মীয়স্বজনের বাড়ি পর্যন্ত। এছাড়া বছরে একবার পরিবারসহ তারা ঘুরতে যেত নানা জায়গায়। আবীরের জগৎটা যেমন ছিল ছোটো, তেমনি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল কম। কিন্তু একটা সময় পরে এই চিত্রটা বদলে যায়। এইচএসসি পাস করার পর আবীরের বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে ভর্তি করাবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র হিসেবে আবীর খারাপ ছিল না, কিন্তু চান্স পায়নি সে। আর তাই বাধ্য হয়েই সে ভর্তি হয় চট্টগ্রামেরই এক নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর আবীরের খারাপ হওয়ার গল্পটাও শুরু হয় সেখান থেকেই।
বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষই মনে করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বড়োলোকের বখে যাওয়া পোলাপাইনের হ্যাংআউটের জায়গা। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষাপট এখন অনেক ভিন্ন। প্রচুর মধ্যবিত্ত তো বটেই এমনকি অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। শুধু পড়েই না, অনেকেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই এমনকি বিদেশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা টেনে বেশ ভালোভাবেই গড়ে নিচ্ছে নিজের ক্যারিয়ার। তো যাই হোক, ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর আবারও তেমনই ছিল কিন্তু নিজের পারিবারিক অর্থের প্রকোপ থেকে সে পালাবে কোথায়?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম বছরের মাথায় তার জুটে যায় একদল বড়োলোকের দুলাল আর দুলালিদের ফ্রেন্ডসার্কেল। তাদের সঙ্গে সঙ্গেই স্রোতের মতো তার জীবনে ভেসে আসতে থাকে মাদক আর যৌনতার প্লাবন। আর ছোটোবেলা থেকে খুবই সীমিত পরিসরে বিচরণ করা আবীর মাদক আর যৌনতার মাঝে খুঁজে পায় এক ভিন্ন জীবন। আরো এক বছর পর তার পরিচয় হয় মালিহার সঙ্গে। আবীরের ভেসে যাওয়ার প্লাবনে যোগ হয় এক নতুন স্রোত।
মালিহা মেয়েটা পুরোপুরি বড়োলোকের বখে যাওয়া মেয়ে হলেও ওর মধ্যে অন্যরকম একটা ব্যাপার খুঁজে পায় আবীর। একসঙ্গে তারা অনেক জায়গায় ঘুরেছে। প্রচুর নেশা করেছে কিন্তু এর বাইরে কখনো কিছু হয়নি। যে কারণে এই মেয়েটার প্রতি তার অন্যরকম একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। পতেঙ্গার কাছেই মালিহার বাবার একটা বাংলোবাড়ি আছে। মাঝে মধ্যেই তারা বন্ধুবান্ধব মিলে সেখানে গিয়ে বারবিকিউ পার্টি করে। আর সঙ্গে নেশা তো আছেই। ওদের সার্কেলে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ইয়াবা। যদিও বাংলাদেশে এই জিনিসটা বাবা নামে বেশি পরিচিত কিন্ত ওদের ক্লোজ সার্কেলে ওরা এটাকে গাড্ডু নামে ডাকে। এই নামের উৎস কী, বা কারণ কী, কেউই জানে না। কিন্তু ওরা এটাকে এই নামেই ডাকে।
ইয়াবা সেবনের প্রক্রিয়াটা খুব গ্ল্যামারাস মনে হয় আবীরের কাছে। আয়োজন করে জিহ্বার নিচে কয়েন দিয়ে এটা সেটা করে সেবন করতে বেশ মজা। কিন্তু এক অদ্ভুত কারণে এই জিনিসটার যে নেশা হয়, খাস বাংলায় বলতে গেলে যে পিনিক হয় সেটা আবীরের ভালো লাগে না। তার কাছে সব নেশার বড়ো হলো গাঁজা। গাঁজার প্রতি তার মোহ-ভালোলাগা আর ভালোবাসা সবই অন্য রকম। আর এ কারণে ফ্রেন্ড সার্কেলে তাকে মাঝে মাঝে পচানিও খেতে হয়। কিন্তু সে পরোয়া করে না। পৃথিবীর আদিমতম এই জিনিসটার প্রতি তার মায়া অন্যরকম।
ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে একটা জয়েন্ট বের করে আগুন লাগাল সে। বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নিয়ে আবারও কাচ একটু নামিয়ে বাইরে ছেড়ে দিল সেটা। অন্যদিনের মতো আজও তারা সন্ধে হতেই মালিহার বাবার বাংলোর ছাদে দল বেঁধে গিয়ে মাল টেনেছে প্রথমে। তারপরে বাকিরা ইচ্ছেমতো গাড্ডু সেবন করলেও সে করেনি। আজ তার পরিকল্পনা ছিল একটু ভিন্ন। আজ সে মালিহাকে পেতে চায়। আর তাই তার ইচ্ছে ছিল সেবনের পর মালিহার সঙ্গে একান্তে আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু তার পরিকল্পনায় বাদ সাধে এই বালের বৃষ্টি। সন্ধের নামতেই ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। আর মালিহাও প্রস্তাব দেয় সে লং ড্রাইভে যেতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও হই হই করে ওঠে নেশার ঘোরে। কিন্তু বের হওয়ার সময়ে দেখা যায় শুধু আবীরই তার সঙ্গী। আবীর অবশ্য এতে খুশিই ছিল। গাড়ি বের করার ঠিক আগমুহূর্তে কোথা থেকে এসে জুটে যায় জিতু আর শাবাব। হুট করে গাড়ির পেছনে উঠে বসেই শুরু করে চুম্মাচাটি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির বেগ যেন বাড়ছে আর সেই সঙ্গে বাড়ছে মালিহার ড্রাইভ করার স্পিড। জয়েন্ট টানতে টানতেই আবীর একবার ভাবল মেয়েটাকে গাড়ির স্পিড কমাতে বলবে কি না। কিন্তু মালিহার দিকে তাকিয়ে সে চুপ মেরে গেল। মেয়েটা মুখে অদ্ভুত এক হাসি লটকে রেখে দুই হাতে প্রাণপণে হুইল ধরে আছে যেন রোলার কোস্টার রাইডে উঠেছে। ‘উহু,’ বলে সে খুশিতে চিৎকার করে উঠেই আবীরকে দেখল, সেই সঙ্গে তার হাতে ধরা জয়েন্টটাও। ‘আবীর, তুমি কি যে মজা পাও এই বালের জিনিসটা টেনে…’ বলে সে জোরে জোরে হেসে উঠল।
আবীর কড়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল, আজ শান্ত থাকতে হবে তাকে। তবে জবাব দেওয়ার দরকার ছিল না। মালিহা হঠাৎই নিজের মুখটা বাড়িয়ে দিল ওর দিকে। ‘দাও তো দেখি একটা টান দিই…’
আবীর বেশ অবাক হয়েই জয়েন্টটা বাড়িয়ে দিল মালিহার দিকে। মালিহা এক হাতে হুইল চেপে ধরে জয়েন্টে থেকে ধোঁয়া টেনে নিল নিজের ফুসফুসে। মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মৃদু কাশি দিয়ে সে বলল, ‘নট ব্যাড,’ তার দৃষ্টি এখন আবীরের দিকে। ‘আবীর, আজকে আমার স্পেশাল পরিকল্পনা আছে,’ সে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে সামনে। মেয়েটার কথা শুনে আবীর একটু চমকে উঠল।
ওর মতো কি মেয়েটারও তবে একই ইচ্ছে নাকি!
‘তাই নাকি?’ কোনোমতো বলল সে। মুখ চেপে আবারও জয়েন্ট থেকে ধোঁয়া টেনে নিয়ে জানালার কাচ গলে ওটাকে ফেলে দিল বাইরে।
‘ইয়েস, স্পেশাল প্ল্যান ফর স্পেশাল ম্যান,’ অতিরিক্ত নেশা করায় মালিহার গলায় কোনো ব্যালেন্স নেই, এই ফিসফিসে হয়ে যাচ্ছে কথা আবার আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে।
মালিহার শেষ কথাটা শুনে আবীরের বুক ধুকপুক করতে শুরু করেছে। তবে এবারও সে কিছু বলার আগেই মালিহা গাড়ির ড্যাশবোর্ডের দিকে ইশারা করল। ‘ওখানে দেখো একটা মার্লবোরো অ্যাডভান্সের প্যাকেট আছে।
‘তুমি সিগারেট খাবে?’ আবীরের নিখাদ বিস্ময় কারণ সিগারেট মেয়েটার দু চোখের বিষ।
‘আরে বোকা ওটা আগে বের করে ওটার ভেতরে দেখো একটা জিনিস আছে,’ মালিহার কথামতোই আবীর ড্যাশবোর্ড হাতড়ে প্যাকেটটা বের করে ওটার মুখ খুলেই দেখতে পেল ভেতরে হোমিওপ্যাথির শিশির মতো ছোটো একটা শিশি। ভেতরে সাদা গুঁড়ো। আবীরের হাতে জিনিসটা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল মালিহা।
‘বলেছিলাম স্পেশাল জিনিস ফর স্পেশাল ম্যান। আমার কাজিন থাইল্যান্ড থেকে এনেছে জিনিসটা,’ বলে গাড়ি চলাতে চালাতে মালিহা একটু সরে এলো আবীরের দিকে। ‘দে কল ইট কোক,’ বলেই সে আবারও সরে গিয়ে রীতিমতো চিৎকার করে উঠল, ‘দ্য ফাকিং কোক।’
কোক? মনে মনে শব্দটা উচ্চারণ করেই আবীরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মনে পড়ে গেছে জিনিসটা আসলে কী। ‘কোকেন?’
‘ইয়েস ফাকিং কোকেন,’ বলে সে এক হাতে হুইল ধরে অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল ওর দিকে। ‘হাতের উলটো পিঠে একটু ঢেলে দাও,’ আবীর তাই করতেই মেয়েটা বলে উঠল, ‘এবার টেনে নাও নাক দিয়ে।’ এটা না বললেও চলত—কখনো কোকেন সেবন না করলেও হলিউডি সিনেমাতে সে বহুবার দেখেছে কীভাবে কোকেন টানতে হয়। ঠিক সিনেমার স্টাইলেই টেনে নিল সে জিনিসটা। সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতরে একটা ঝটকা টের পেল সে। বড়ো বড়ো করে দুবার দম নিতেই তার মনে হতে লাগল তার চারপাশে সব হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎ করেই যেন সবকিছু অনেক বেশি পরিষ্কার লাগছে। মালিহার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গাড়ির ব্যাকসিটে চুম্মাচাটির শব্দ এতক্ষণে হুটোপুটির শব্দে রূপ নিয়েছে। ওদের গাড়ি পতেঙ্গা রোড ধরে তুমুল বৃষ্টির ভেতরে ততোধিক তুমুল বেগে ধেয়ে চলেছে সামনের দিকে।
মালিহা একটা হাত বাড়িয়ে দিল আবীরের দিকে। ‘আবার দাও, এবার আমি নেব।’
‘নাহ,’ বলেই আবীর হেসে উঠল। ‘তুমি এবার আমার হাত থেকে নেবে,’ বলে সে নিজের হাতের উলটো পিঠে কোকেন ঢেলে সেটা বাড়িয়ে দিল মালিহার দিকে। মালিহা সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবীরের হাতের দিকে নিয়ে আসছে নিজের মুখটা হঠাৎই পেছনের সিট থেকে শাবাব মুখ তুলে বলে উঠল, ‘এই কী করছ তোমরা?’ মালিহা জিনিসটা টেনে নিয়ে পেছনে তাকাল আবীরের চোখে যেন সামনে থেকে আলোর একটা ঝটকা এসে লাগল। সেই আলোতে সে পলকের জন্য দেখতে পেল রাস্তার ওপরে একজন মানুষ। ‘মালিহা,’ প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল সে। মালিহা ও ঝট করে সামনে তাকিয়ে লোকটাকে দেখে প্রাণপণে ব্রেক চাপল। কিন্তু একটু আগে পেছন থেকে ছুড়ে দেওয়া হ্যান্ডব্যাগটায় চাপ লেগে আটকে গেছে ব্রেকটা।
ওদের গাড়িটা প্রায় শত মাইল বেগে সেকেন্ডেরও ভগ্নাবশেষের মধ্যে গিয়ে বাড়ি মারল রাস্তার ওপরে থাকা মানুষটাকে। মানুষটার হাতে ধরা টর্চটা ছিটকে পড়ল, সেই সঙ্গে তীব্র বেগে বাম্পারের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে সে উড়ে এলো উইন্ডশিল্ডের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে শত টুকরো হয়ে গেল সেটা। লোকটা ছিটকে পড়ল রাস্তায় আর গাড়িটা ওলটাতে ওলটাতে কোনোমতে স্কিড করে থেমে গেল রাস্তার উলটো পাশে।
গাড়িতে অবস্থানরত তিনটে প্রাণির ভেতরে আবীরই প্রথম নিজেকে সামলে নিল। বড়ো বড়ো নিশ্বাস পড়ছে ওর, গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করার সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরটা একপাশে গিয়ে তীব্র বেগে ধাক্কা খায় সামনের ড্যাশবোর্ডের সঙ্গে। পাঁজরের একপাশে তীব্র ব্যথা টের পেলেও শরীরে হাত বুলিয়ে মনে হলো না কিছু ভেঙেছে। পাঁজরের একপাশ চেপে ধরে গাড়ির দরজায় হাত রাখতেই ওটা খুলে আবীরের শরীরের অর্ধেকটা গড়িয়ে পড়ে গেল রাস্তার ওপরে। কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তার ওপরে নেমে এলো সে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ভেতরেই গাড়ির হেড লাইটের আলোয় সে অবছাভাবে দেখতে পেল রাস্তার অন্যপাশে পড়ে আছে একটু আগে অ্যাক্সিডেন্ট করা মানুষটা।
উঠে বসার চেষ্টা করতেই বুকের একপাশের পাঁজরে খচ করে উঠল। বুকের একপাশ চেপে ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল সে। একটু এগিয়ে দেখল অ্যাক্সিডেন্ট করা মানুষটা রাস্তার একপাশে উলটে পড়ে আছে। একটু দূরেই পড়ে আছে তার হাতের টর্চটা। কাচ ফেটে ওটা থেকে খুবই অদ্ভুত এক আলো বেরিয়ে আসছে। বুকের একপাশ চেপে ধরেই খানিকটা ঝুঁকে মানুষটাকে ডাকল। ‘এই যে, এই যে,’ আর কী বলবে ভেবে পেল না সে।
‘লোকটা… লোকটা কি বেঁচে আছে?’ পেছন থেকে ভাঙা গলা শুনতেই একটু চমকে উঠে পেছনে ফিরে সে দেখল মালিহা বেরিয়ে এসেছে গাড়ি থেকে। খুব একটা আহত না হলেও ভ্রুর ওপরে বেশ ভালোই কেটে গেছে তার। বৃষ্টির পানির সঙ্গে ক্ষত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে মুখের একপাশ লালচে দেখাচ্ছে তার। ‘বুঝতে পারছি না,’ বলে আবীর খানিকটা ঝুঁকে মানুষটাকে সোজা করে দিল একহাতে।
বয়স্ক একজন পুরুষ মানুষ। তীব্র বৃষ্টির ভেতরে মানুষটার নাক-মুখ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ‘বেঁচে আছে? বেঁচে আছে মানুষটা?’ মালিহার গলায় তীব্র আতঙ্ক। আবীর কিছু না বলে আরেকটু ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল। মানুষটার ঘাড় ও মেরুসন্ধি এমনভাবে বেঁকে আছে যেন ধনুকের ছিলা টান টান করে ধরা হয়েছে। এভাবে ঘাড় বেঁকে যাওয়ার পরও কারো পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। ‘আ…আমার মনে হয়…’
আবীর তার কথা শেষ করার আগেই পেছন থেকে আতঙ্কিত গলা ভেসে এলো। ‘ওহ মাই গড, এখানে কীভাবে…। ওহ শিট,’ শাবাবের গলায় ভয় আর আতঙ্কের স্রোত। আবীর পেছন ফিরে দেখল শাবাব আর জিতু বেরিয়ে এসেছে গাড়ি থেকে। পেছনের সিটে থাকায় তেমন কোনো গুরুতর আঘাত পায়নি তারা। ‘মালিহা, ইউ বিচ! ইউ কিলড হিম,’ শাবাবের পাশ থেকে জিতু বলে
উঠল কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মালিহা ঝট করে পেছন ফিরল তার দিকে। ‘আ-আমি তাকে খুন করতে যাব কেন…ইট ওয়াজ জাস্ট এন অ্যাক্সিডেন্ট। আই ডোন্ট ইভেন নো হু দ্য ফাক দ্যাট ইজ।’
‘সব দোষ তোর। ওহ গড,’ শাবাবকে দেখে মনে হচ্ছে তার প্যানিক অ্যাটাক হয়ে যাবে। ‘এভাবে বৃষ্টির ভেতরে আজ না বেরোলেই তো… ড্যাম বিচ মালিহা, এইসব দায়িত্ব তোর।’
মালিহা অসহায়ের মতো ফিরে তাকাল আবীরের দিকে। আবীর একটা হাত তুলে তাকে শান্ত থাকতে বলল। শাবাব আর জিতু তড়বড়িয়ে আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আবীর ধমকে উঠল। ‘চুপ করো দুজনেই। যা হয়েছে হয়েছে। একা মালিহাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই’ তীব্র শব্দে বাজ পড়াতে থেমে গেল সে। যা ঘটেছে আমাদের সবাইকে মিলেই সেটার মোকাবেলা করতে হবে,’ ভেতরে ভেতরে তীব্র আতঙ্ক থাকলেও হঠাৎ কেন জানি আবীরের মাথাটা একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কে জানে, কোকেনের প্রভাব কি না। ‘এখানে এক সেকেন্ডও থাকা উচিত না আমাদের। এক্ষুণি সরে পড়া উচিত। বৃষ্টির কারণে লোকজন কম হলেও এটা একটা ব্যস্ত রাস্তা। যেকোনো সময় কোনো গাড়ি চলে এলেই আমরা ফেঁসে যাব।’
‘একদম ঠিক… লেটস,’ জিতুর কথা শেষ হওয়ার আগেই মালিহা বলে উঠল। ‘এটাকে সরাতে হবে,’ তাকে কেমন জানি অপ্রকৃতস্থ মনে হচ্ছে। ‘এই লোকটাকে রাস্তায় রেখে সরে পড়া ঠিক হবে না।’
‘মালিহা তুই কি পাগল নাকি?’ শাবাব বলে উঠল।
‘না…’ জিতু কিছু বলতে যাচ্ছিল আবারও মালিহা কথা বলে উঠল।
‘দেখে মনে হচ্ছে লোকটা বেঁচে নেই। কিন্তু এভাবে রাস্তার ওপরে তাকে রেখে গেলে আবারও কোনো গাড়ি পিষে দেবে। বা ধাক্কা খেয়ে থেমে যাবে। এতে আমাদের পালাবার সময় কমে যাবে…’
‘ও ঠিকই বলেছে,’ আবীর মালিহাকে সমর্থন দিল। মালিহা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল তার দিকে। ‘সবাই হাত লাগাও। মানুষটাকে রাস্তার পাশের খাদে ফেলে দিলেই হবে। কেউ তাকে খুঁজে পেতে পেতে আমরা…’ আবীর এগিয়ে গিয়ে মানুষটার দুটো হাত ধরেছে। কিন্তু অন্যরা সবাই যার যার জায়গায় স্থির। সে মানুষটার দুই হাত ধরে ধমকে উঠল, ‘কী হলো সবার?’
আবীরের ধমকে কাজ হলো। সবাই এগিয়ে এসে হাত লাগাল। মালিহা ধরল লোকটার এক পা জিতু আরেকটা। পাশ থেকে শাবাব কোমরের কাছটায় ধরতেই আবীর ‘এক…দুই…তিন’ গুণলো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে উঁচু করে ধরল দেহটা। কিন্তু এক পা নড়ার আগেই নতুন একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল।
তীব্র হেডলাইটের আলোয় ভেসে গেল মৃতদেহটাকে আলগে রাখা সবাই। সাদা রঙের একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে আসতে থেমে গেল ওদের থেকে গজ দশেক দূরে। সবাই জমে আছে যার যার জায়গায়। সাদা গাড়িটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লম্বা রেইনকোট পরা একটা অবয়ব। এক টর্চ ধরা হাতের ঠিক নিচেই একটা কালো নল হেডলাইটের আলোয় চকচক করে উঠল। বৃষ্টির তীব্র নিনাদ ভেদ করে কর্কশ একটা গলা ভেসে এলো। ‘পুলিশ, সবাই হাত তুলে…’
শেষ শব্দটা তীব্র বাজ পড়ার শব্দে হারিয়ে গেল। মালিহার আতঙ্কে বড়ো বড়ো হয়ে যাওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে আবীর ফিসফিসে গলায় বলে উঠল। ‘সর্বনাশ!
আমরা শেষ।