অধ্যায় আঠারো – বর্তমান সময়
পতেঙ্গা রোড, চট্টগ্রাম
আর্মির ট্রেনিং থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা ধরনের ট্রেনিংসহ মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা শারিয়ারের একেবারে কম নয়।
কিছু ক্ষেত্রে মাথা গরম করে একাধিক ভুলভাল করা বাদ দিলে মাঠ পর্যায়ে তার পারফরমেন্স বেশ ভালো। কিন্তু নিজের কর্মক্ষেত্রের পরিধি খুব দীর্ঘ না হলেও এই স্বল্প সময়ে একটা ব্যাপার শারিয়ার অনুধাবন করেছে-ট্রেনিং হোক আর অভিজ্ঞতা হোক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপারগুলো আসলে একজন ফিল্ড অপারেটিভকে স্রেফ তার কাজে সহায়তা করতে পারে। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। মাঠ পর্যায়ে যখন কাজে নামতে হয় সূত্র জোড়া লাগিয়ে কোনো একটা রহস্যের সমাধান হোক, নিজের ইনফর্মারদের মাঠে নামিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা হোক কিংবা কেউ যখন আপনার দিকে পিস্তল তাক করে আছে সেখানে নিজেকে বাঁচানোই হোক, বেলা শেষে এই সবকিছুই নির্ভর করে একজন মানুষের নিজের বুদ্ধিমত্তার ওপরে। আর সেই বুদ্ধিমত্তাকে ধারালো করে তোলে যে ব্যাপারটা সেটা হলো, নিজের ইন্সটিঙ্কট।
অন্ধকার বাড়ির বেইজমেন্টে দাঁড়ানো অবস্থায় যে মুহূর্তে এসআই মোর্শেদ আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেল সেই মুহূর্তে শারিয়ারের মনে হলো যে ভীষণ পরিস্থিতে সে পড়েছে সেটা থেকে উদ্ধার পাবার একমাত্র উপায় হলো তার নিজের ইন্সটিঙ্কট। তাই এক সেকেন্ডের মধ্যে সে হাতের টর্চটাকে বন্ধ করে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শারিয়ার যেখানটাতে আছে সেই জায়গাটাতে তেমন কোনো আড়াল নেই। শত্রুর নজর অন্যদিকে সরাতে হবে। কাজেই মাটিতে শুয়ে পড়তে পড়তে সে পিস্তল থেকে সম্ভাব্য আক্রমণকারীর উদ্দেশে একটা গুলি ছুড়ে দিল। বদ্ধ বেইজমেন্টে শব্দ হলো প্রায় বাজ পড়ার মতো।
মাটিতে শুয়ে শারিয়ার প্রথমেই দ্রুত মোর্শেদকে পরীক্ষা করে নিল। ছেলেটার জ্ঞান নেই। ওকে সরাতে হবে। শোয়া অবস্থাতেই ছেলেটাকে জাপটে ধরে একপাশে দেয়ালের দিকে সরে এলো। যেহেতু মাটিতে শুয়ে পড়ার সময়ে শারিয়ার গুলি ছুড়েছে কাজেই আক্রমণকারী ওর অবস্থান খুব ভালোভাবেই জানে। এই সুবিধা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে হবে। তা-না হলে বিপদে পড়তে হবে শারিয়ারকে।
মোর্শেদকে দেয়ালের কাছে সরিয়ে এনে দেয়ালের সঙ্গে লম্বালম্বি শুইয়ে দিল ও। এতে করে ছেলেটা নিরাপদ থাকবে, গুলি লাগার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যাবে, সেই সঙ্গে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে এলেও ছেলেটার বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। মোর্শেদকে শুইয়ে দিয়েই দ্রুত বেগে ছেলেটার দেহ পরীক্ষা করে ফেলল ও। পিস্তল আর ওয়াকিটকিটা নিয়ে নিল ওর থেকে। পিস্তলটা পরীক্ষা করে কোমরে রেখে দিল। আর ওয়াকিটকিটা বন্ধ করে কোমরে বেল্টের সঙ্গে আটকে দিল। কারণ ওটা শব্দ করে উঠলে বিপদ হতে পারে। মোটামুটি মিনিট খানেকের ভেতরে দ্রুত কাজগুলো সেরেই নিজের পিস্তলটাকে বাগিয়ে ধরে এবার আশপাশে ফিরে তাকাল শারিয়ার। এবার তাকে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।
অবস্থানগত দিক থেকে সে খুবই বাজে জায়গায় আছে। কারণ যেখানে সে আছে সেই জায়গাটা একে তো অন্ধকার তার ওপরে অচেনা। তার ওপরে শত্রু কে ওর জানা নেই। কিন্তু ওর ব্যাপারে শত্রুর পরিষ্কার ধারণা আছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে একটা ব্যাপার তাকে খানিকটা অবাক এবং খুশি করেছে, মোর্শেদকে আঘাত করা হয়েছে কিছু একটা দিয়ে কিন্তু তাকে গুলি করা হয়নি। এর মানে শত্রু যে বা যারাই হোক অন্তত ওদেরকে মেরে ফেলতে চাইছে না। পিস্তল বাগিয়ে ধরে শারিয়ার দেয়ালের ধার ঘেঁষে এগোল। যে-বাঁকটার কাছ ঘেঁষে ওরা ভেতরের দিকে ছিল সেটা ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো ও। পিস্তল আর টর্চ দুটোই প্রস্তুত আছে।
বাঁকটা ঘুরে সরে আসতেই শারিয়ার দেখল বেইজমেন্টের এই অংশটা একটু হলেও আলোকিত। বাইরে কোথাও থেকে খুব আবছা আলো আসছে। সেই আবছা আলোতে পরিষ্কার দেখতে পেল দ্রুত গতিতে একটা ছায়া সরে গেল বেইজমেন্টের অন্যদিকে। ওদিকে এগোতে যাবে তার আগেই হুঁশহুঁশ শব্দে কিছু একটা চলে গেল ওর মাথা আর কানের পাশ দিয়ে। জিনিসটা কি বুঝে ওঠার আগেই কানের ওপরে জ্বালা ধরা তীব্র আঘাতে মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল ওর। না চাইতেই আপনাতেও উফফ করে শব্দ করে উঠল শারিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু একইরকম জিনিস ছুটে এলো ওর দিকে। হাতে আর পায়ে শক্ত আঘাত খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল ও। এখান থেকে এই মুহূর্তে না সরতে পারলে খবর আছে ওর। শোয়া অবস্থাতেই মাটিতে এক গড়ান দিয়ে সরে গেল পার্ক করে রাখা একটা গাড়ির আড়ালে। টর্চটাকে মাটির ওপরে রেখে আঘাত লাগা জায়গাটা খানিকটা ডলে নিল ও। তীব্র জ্বালাধরা এক ধরনের ব্যথা করছে ওর, তবে গুরুতর কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না।
চট করে বিপরীত দিক থেকে একটা ছায়া নড়তে দেখল ও। টর্চ তুলে নিয়ে শরীরটাকে সামান্য ঘুরিয়ে সেদিকে তাক করে আলো জ্বেলে দিল। সেই সঙ্গে পিস্তল তুলল গুলি করার উদ্দেশে। কিন্তু গুলি করা আগেই সে দেখতে পেল ঝড়ের বেগে কেউ একজন বাউলি কেটে ভেতরে সরে গেল। সরে যাওয়ার আগে আবারও হুঁশহুঁশ করে ছুটে এলো সেই অদ্ভুত জিনিসগুলো। অদ্ভুত সেই জিনিসগুলোর আঘাতে তীব্র বাড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল টর্চটা সেই সঙ্গে অন্যহাতের তালুর উলটো দিকে আঘাত খেয়ে আরেকটু হলে ওর হাত থেকে পিস্তলটা ছুটে যাচ্ছিল কিন্তু কোনোমতে ওটাকে সামলে নিয়ে আবারও গাড়ির আড়ালে বসে পড়ল সে।
পিস্তলটাকে মাটিতে রেখে ব্যথা পাওয়া হাতটা চেপে ধরল অন্যহাতে। তীব্র ব্যথায় মনে হচ্ছে ওর হাতের হাড় ফেটে গেছে। হচ্ছেটা কী এখানে, সেটাই বুঝতে পারছে না ও। রাগে আর ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল শারিয়ার। সেটার জবাব হিসেবে বেইজমেন্টের অপর দিকে থেকে ভেসে এলো হাসির শব্দ। রাগে আরো গায়ে জ্বালা ধরে গেল শারিয়ারের। সে পরিষ্কার অনুধাবন করতে পারল তাকে নিয়ে রীতিমতো খেলছে ওর শত্রু।
ব্যথা পাওয়া হাতটা চেপে ধরে রেখেই আশপাশে দেখে নিল আরেকবার। কিছুক্ষণ ধরে অন্ধকারে থাকার কারণে এতক্ষণে অন্ধকার খানিকটা সয়ে আসতে শুরু করেছে ওর চোখে। মাথাটাকে গাড়ির এক পাশ থেকে উঁচু করে পুরো বেইজমেন্টে আবছাভাবে চোখ বুলিয়ে নিল ও।
বিরাট বাড়িটার প্রায় পুরো নিচের অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে বেইজমেন্টটা। আকৃতি খানিকটা ইংরেজি অক্ষর এল শেইপের। ও আর মোর্শেদ যেদিক থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেদিক দিয়ে আরেকটু বামে গেলে ওখানে একটা কোয়ার্টারের মতো আছে। ওটার বিপরীত দিকেই মোর্শেদকে শুইয়ে রেখে এসেছে। কিন্তু ওর শত্রু লোকটা কোনদিকে আছে এটা বুঝতে পারছে না। তবে অনুমান করতে পারে যেদিকে বেশ কয়েকটা গাড়ি রাখা আছে, সম্ভবত সেদিকেই আছে লোকটা। আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মনে মনে একটা পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলল ও। এখানে বসে থাকলে কিছুই হবে না। তার চেয়ে দেখা যাক কাজ হয় কি না।
হঠাৎ গাড়ির আড়াল ছেড়ে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এলো ও। সেখান থেকে এক গড়ান দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পিস্তল তুলল সম্ভাব্য শত্রুর উদ্দেশে। কিন্তু কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ল না। আর এই সুযোগে সে উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে শুরু করল লোকটার সম্ভাব্য অবস্থানের দিকে। দুই পা এগোনোর আগেই হাঁটুতে তীব্র আঘাতে মাটিতে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ও। নাক আর চোয়াল ভীষণভাবে ঠুকে গেল বেইজমেন্টের মেঝের সঙ্গে, হাত থেকে ছুটে গেল পিস্তলটা।
এত ব্যথা পেয়েছে যে, ক্ষণিকের জন্য শারিয়ারের মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে। কিন্তু পিস্তলটা হাত থেকে ছুটে গেছে সেটা ভাবতেই মাথা ঝাড়া দিয়ে বাউলি কেটে ওটার দিকে এগোনোর চেষ্টা করল ও। কিন্তু পিস্তলটা পর্যন্ত ওর হাত পৌঁছানোর আগেই দেখতে পেল: একটা ছায়া ছুটে আসছে ওটার দিকে। সমস্ত সামর্থ্য এক করে শোয়া অবস্থা থেকেই ডাইভ দিল শারিয়ার। সে আর লোকটা দুজনারই হাত একসঙ্গে পড়ল পিস্তলটার ওপরে। দুজনেই দুজনকে ধরে ফেলল।
পলকের জন্য শারিয়ারের দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল লোকটার ওপরে। আবছা অন্ধকারে সেই মঙ্গলয়েড ধাঁচের চেহারাটার ওপরে খানিকক্ষণের জন্য স্থির হয়ে রইতেই রাগে চিড়বিড় করে উঠল শারিয়ার। ‘শালা ভুয়া,’ বলে রাগের সঙ্গে খোলা বাঁ হাতে ঘুসি মারল সে লোকটার চোয়ালে। ঘুসিটা লেগে পিছলে গেল একদিকে কিন্তু লোকটা ওর হাত কিংবা পিস্তল ছাড়ল না। বরং ভীষণ শক্তিতে সেটাকে আরো জোরে চেপে ধরল। পিস্তল আর হাতের ওপরে জোরে টান পড়তেই দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে। কিন্তু কেউ কারো হাত ছাড়েনি। এবার পা চালাল শারিয়ার। লোকটার পায়ের সঙ্গে পা লেগে তীব্র ব্যথায় চোখে আবারও আঁধার দেখল।
দুজনেরই হাত ছুটে গেল পিস্তলটা থেকে। দুজনেই খানিকটা তফাতে সরে গেল। খটখট শব্দ তুলে পিস্তলটা সরে গেল খানিকটা। শারিয়ার গড়ান দিয়ে সরে যাবে কিন্তু তার আগেই লোকটা তার হাত নাড়ল সেই সঙ্গে কিছু এসে বাড়ি মারল শারিয়ারের নাকে-মুখে। তীব্র ব্যথায় উঁবু হয়ে গেল ও। এই সুযোগে লোকটা এগিয়ে এসে মাটি থেকে দ্রুত বেগে তুলে নিল পিস্তলটা। ওটাকে ওর দিকে তাক করে চিৎকার বলে উঠল, ‘হল্ট,’ বলে এগিয়ে এলো শারিয়ারের দিকে। পেছন থেকে জোর পায়ে লাথি মারল ওকে, তারপর রাগের সঙ্গে বলে উঠল, শালা, আমি ভুয়া, তবে তুই কী?’
ব্যথা আর রাগের সঙ্গে শারিয়ার এমনিতেই চোখে অন্ধকার দেখছিল লোকটার লাথি খেয়ে একেবারে কুঁকড়ে যেতেই ওর হাতে বেরিয়ে এসেছে মোর্শেদের পিস্তলটা।
একদিকে ওকে পড়ে যেতে দেখে অন্যদিকে ওর পিস্তলটা হাতিয়ে নিয়ে লোকটা খুব খুশি হয়ে উঠেছিল কিন্তু শারিয়ারকে পিস্তল হাতে ঘুরতে দেখে এতটাই অবাক হলো যে, হাতের পিস্তলটা তুলতেই ভুলে গেল।
পিস্তল হাতে সামান্য ঘুরে গেলেও শারিয়ার মুহূর্তের জন্য দ্বিধান্বিত বোধ করল গুলি করবে কি করবে না সেটা নিয়ে। অন্য দিকে লোকটাও একটু দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছিল কিন্তু শারিয়ারকে পিস্তল তুলতে দেখে সেও ট্রিগার টিপে দিল।
বলতে গেলে প্রায় একই সময়ে দুটো পিস্তল থেকে গুলি বেরিয়ে এলো। দুই অস্ত্র থেকেই বুলেট ছুটে গেল লক্ষ্যের দিকে। দুজনেই পড়ে গেল গুলি খেয়ে। শারিয়ারের মনে হতে লাগল বুকের ওপরে একটা লম্বা পেরেক দিয়ে কেউ মেঝের সঙ্গে গেঁথে ফেলেছে ওকে। বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের ওপরে আঘাত করা বুলেট চেপে বসেছে ফুসফুসের ওপরে। কয়েক মিনিট নীরবে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করল, তারপর কোনোমতে উঠে বসল।
অন্য লোকটাকে গুলি খেয়ে পড়ে যেতে দেখেছে ও। তাই সেদিক থেকে কোনো বিপদের আশঙ্কা করছে না ও, তবুও কোনো ঝুঁকির ভেতরে যাওয়া যাবে না। কোনোমতে উঠে বসে আগে পিস্তলের খোঁজ করল। মোর্শেদের পিস্তলটা ওর কাছেই পড়ে আছে। সেটাকে তুলে নিয়ে ধোঁয়া বেরুতে থাকা বুকের ফুটোতে হাত বুলাল। ভেস্টের ওপরে আটকে থাকা বুলেটটা হাতে লাগল। পাটোয়ারির ভেস্ট কাজে দিয়েছে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে পড়ে থাকা দেহটার কাছে গিয়ে হাতে ধরে মানুষটাকে সোজা করে দিল।
পিস্তল তাক করে পরীক্ষা করতে যাবে তার আগেই লোকটার বুট পরা পায়ের লাথিতে ওর হাতের পিস্তলটা উড়ে গেল। তাজ্জব হয়ে শারিয়ার দেখল একটু আগে গুলি খাওয়া লোকটা স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আরেকটা দুই মণ ওজনের লাথি ছুড়ে দিল ওর বুকের ওপরে। লাথিটা খেয়ে শারিয়ারের মনে হলো, আঘাত পাওয়া বুকের সব বাতাস বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। শরীরটা বাঁকা হয়ে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো তীব্র চিৎকার।
ওকে বাঁকা হয়ে যেতে দেখে লোকটা এগিয়ে এসে কলার চেপে ধরে সোজা করে গলায় বলে উঠল, ‘গুলি খেয়ে কেউ এভাবে…’
শারিয়ার লোকটার কবজি ধরে ফেলল। তারপর শরীরটাকে বলের মতো ঘুরিয়ে কবজি ধরা হাতটাকে নিয়ে এলো নিজের শরীরের নিচের অংশে। সেটাতে জোরে চাপ দিতেই তীব্র আর্তনাদ করে লোকটা বসে পড়ল মাটিতে। হাসি ফুটে উঠল শারিয়ারের মুখে। কিন্তু তার হাসি মুছে গেল মুহূর্তের ভেতরেই। লোকটা খোলা হাত দিয়ে ওর পায়ের কবজি চেপে ধরে টান মারল। সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে।
শারিয়ার উঠে দাঁড়াল চট করে। লোকটাও উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে দুই প্রতিপক্ষ মুখোমুখি।
‘স্বীকার করছি,’ লোকটার বাংলা কথায় কেমন জানি অদ্ভুত একটা টান। ‘গত কয়েক বছরে এরকম ত্যাদড় কারো সঙ্গে লড়াই করিনি আমি।’
‘আমিও না,’ মাথাটা সামান্য নেড়ে স্বীকার করার ভঙ্গিতে নেড়েই আক্রমণ চালায় শারিয়ার। এই লোকের সঙ্গে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে আগ্রহী না ও। বাঁ- পাটাকে সামান্য নেড়ে ডান পায়ে ডাবল কিক চালাল ও। প্রথমটা লোকটার কোমরে, আর দ্বিতীয়টা তার কানের ওপরে লাগল। আঘাত খেয়েও খুব সহজেই শারিয়ারের পা ধরে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে ধরে ফেলল ওর একটা হাত। কিন্তু এটাই ছিল শারিয়ারের ট্র্যাপ। লোকটা ওর হাত ধরতেই অপর হাতে লোকটার হাতটা ধরে ফেলল শারিয়ার, ফলে ওর দুই হাতের ভেতরে বন্দি হয়ে গেল মানুষটার হাত। শরীরেটাকে ঘুরিয়ে সামান্য মোচড় দিয়েই লোকটাও ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে মাটিতে পড়তে শুরু করল। কিন্তু পড়ার সময়ে সেও দক্ষতার সঙ্গে খপ করে ধরে ফেলল শারিয়ারের কলার ফলে দুজনেই প্রায় একই সময়ে একই গতিতে মাটির দিকে রওয়ানা দিল।
লোকটা মাটিতে পড়ল সোজা। তার মুখের একপাশ বাড়ি খেল বেইজমেন্ট। আর শারিয়ারের শরীরটা বাড়ি খেল একটা গাড়ির বনেটের ওপরে তারপর আছড়ে পড়ল মাটিতে।
দুজনেই পাশাপাশি মাটিতে পড়ে আছে। কারো ওঠার শক্তি নেই।
জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে লোকটা বলে উঠল, ‘দুনিয়ার যে ক্রিমিনাল অথরিটি এই কমব্যাট ট্রেনিং দেয় তাদের সঙ্গে কাজ করব আমি। দুনিয়ার সেরা কমান্ডো ট্রেনিংয়েও এই জিনিস শিখতে পারিনি আমি,’ দম হারিয়ে হাঁপাতে লাগল সে।
শারিয়ারের মনে হচ্ছে সমস্ত শরীর একসঙ্গে ব্যথা করছে। কোনোমতে সে বলে উঠল। ‘ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর জার্মান পুলিশের একটা স্পেশাল ট্রেনিংয়ে শেখানো হয় এই জিনিস। আরো দুটো লাগলে বলতে পার,’ একটা ধারণা মাথার ভেতরে পাকিয়ে উঠতে শুরু করেছে ওর। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আবারও লোকটা কথা বলে উঠল।
‘আপনি… আপনি বাই এনি চান্স, শারিয়ার স্যার নন তো?’ বলে সে উঠে বসতে বসতে যোগ করল, ‘হায় খোদা আপনি আমাকে আক্রমণ করতে গেলেন কেন…’
মুখ দিয়ে ফুঁ নিয়ে ধুলো উড়িয়ে শারিয়ার উঠে বসতে গিয়ে ওপরে গেল। ‘শালা মাদারটোস্ট, কে রে তুই?’ ও উঠে বসতে গিয়ে আবারও পড়ে গেল।
বসা অবস্থাতেই ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটা। ‘স্যার, আমি ভুবন। আজ সন্ধে থেকে আপনাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি,’ বলে সে শারিয়ারকে টেনে বসিয়ে দিল। ‘স্যার, আমি কি পাসকোড বলব?’
‘ধুর তোর বালের পাসকোড, শারিয়ার উঠে বসেছে। ‘ওই বালের কোড এখন সবাই জানে। ‘আচ্ছা, আমি বুঝলাম আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কিন্তু বাইরে গার্ডদেরকে মেরেছ কেন?’
যদিও অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না তবুও শারিয়ারের মনে হলো ছেলেটা খুবই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ‘স্যার, আমি ওদের কিছু করিনি। আমি যখন এখানে আসি দেখি ওরা ইতিমধ্যে কেউ মেরে অজ্ঞান করে রেখেছে। তাই তো আমি… আমি কিন্তু আপনাদের ওপরে আগে…’
বেইজমেন্টর অন্যদিকে যেদিকে মোর্শেদকে রেখে এসেছিল সেদিক থেকে কারো আওয়াজ ভেসে এলো। ‘মোর্শেদ, ও আমার সঙ্গে এসেছিল, নিশ্চয়ই…’ শারিয়ার হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল। কাছেই পিস্তল পড়ে ছিল সেটা তুলে নিয়ে ভুবনকে উঠে আসতে ইশারা করল। ভুবন উঠে দাঁড়িয়ে ওর একটা হাত চেপে ধরল।
শারিয়ার অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল। সে অস্ত্র হাতে শারিয়ারকে ইশারায় বলে উঠল, ‘স্যার, আমিও গার্ডদের মারিনি, আপনিও না। তাহলে কে করল কাজটা? কেউ না কেউ আজ রাতে আমাদের ট্র্যাপ…’ ভুবন কথা শেষ করার আগেই আবার কেউ একজন চিৎকার করে উঠল।
দুজনেই যার যার অস্ত্র বাগিয়ে রওনা দিল সেদিকে। যদিও তেমন আলো নেই কিন্তু এখন আলো জ্বালাটা ঝুঁকিপূর্ণ। ওরা দুজনেই বেইজমেন্টের কোয়ার্টারের দিকে এগিয়ে দেখতে পেল মোর্শেদ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে হাঁপাচ্ছে।
‘মোর্শেদ, তুমি ঠিক আছ?’ শারিয়ার জানতে চাইল।
মোর্শেদ মাথা নাড়ল। তার হাতে মোবাইল আর সেটাকে টর্চের আলো জ্বলছে। ‘স্যার, আপনি ঠিক?’ বলে সে বিধ্বস্ত চেহারার শারিয়ার আর তার সঙ্গের ভুবনকে দেখছে। সে প্রশ্নটা করে জবাবের অপেক্ষায় না থেকে বেইজমেন্টের কোয়ার্টারের দরজাটা দেখাল। ‘স্যার, ওইটার ভেতরে কেউ আছে,’ তার দৃষ্টিতে ভয়।
‘মানে?’ শারিয়ার খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল।
স্যার, আমার যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি কেউ একজন পা টিপে টিপে এদিকে এসে ওইখানে ঢুকল। একবার ভাবলাম আপনারে ডাকব তারপর যে আওয়াজ পাইলাম ওই দিকে সাহস হলো না। তাই লোকটা ভেতরে ঢুকতেই ওই দরজাটা বাইরে থেইকা লাগায় দিসি। ভেতরে যে আছে, সে এখন আটকা পড়ছে।’
‘সাব্বাস, মনে মনে খুশি হয়ে উঠল শারিয়ার। অপচয়ের এই দিনে এবার মনে হচ্ছে কাজের মতো একটা কাজ হয়েছে। সে মোর্শেদকে আলোটা ধরতে বলে ভুবনকে ইশারায় সেদিকে এগোতে বলল। দুজনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে। স্টিলের একটা দরজা, বাইরে থেকে স্টিলের ছিটকানি লাগানো।
শারিয়ার ভুবনকে কভার করতে বলে নিজে হাত দিল ছিটকানিতে। সাবধানে প্রায় নিঃশব্দে খুলে ফেলল ওটাকে। ভেবেছিল ওটাকে খুলতেই ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে কেউ। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। ভুবনকে ইশারা করে এক দুই তিন বলে দরজাটাকে হাতের ইশারায় খুলে দিল শারিয়ার। দুজনেই একে অপরকে কভার করে সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে একটা টেবিল ল্যাম্পের মতো ল্যাম্পে মৃদু আলো জ্বলছে। সেই আলোতে ওরা দেখতে পেল কোয়ার্টারটা বেশ বড়োই। অনেকটা স্টুডিয়োর মতো।
শুরুতে ঢুকতেই একপাশে কাপড় রাখার আর খাবার জন্য ডাইনিংয়ের মতো ব্যবস্থা। তারপরেই শুরু হয়েছে বিরাট আকারের একটা স্টাডির মতো। দেয়ালজোড়া সারি সারি বইয়ের তাক। আর তারপরেই একটা বিরাট টেবিল। একেবারে শেষ মাথায় একটা কট, আর ওটার সঙ্গে ওয়ার্ডরোব। কিন্তু এসবের দিকে কারো নজর নেই।
দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে আছে বিরাট টেবিলটার ওপরে লাগানো দুই পাশের দেয়ালজোড়া বিরাট বিরাট আকারের বোর্ড দুটোর ওপরে। ও দুটোর ওপরে অসংখ্য ছবি, ম্যানুস্ক্রিপ্ট, পেপার কাটিং, ম্যাপ, গ্রাফ আর জ্যামিতিক প্যাটার্নসহ আরো কতো কী যে আটকানো।
‘সর্বনাশ, আইনস্টাইন থাকত নাকি এখানে?’ শারিয়ারের পেছন থেকে অবাক হয়ে জানতে চাইল ভুবন। শারিয়ারও অবাক হয়ে বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ওদের পেছনে ফপ করে শব্দ হয়ে কিছু একটা জ্বলে উঠল। ভুবনকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে শারিয়ার যখন অস্ত্র তাক করল সেদিকে পরিষ্কার দেখতে পেল সন্ধের সেই সাদা শার্ট পরা নকল ভুবন কিছু একটায় আগুন ধরিয়ে ছুড়ে দিল এদিকে। চিন্তা না করেই গুলি চালাল শারিয়ার।
স্পিরিটে জ্বলা ল্যাম্পটা শূন্যে থাকতে বিস্ফোরিত হলো মলোটভ ককটেলের মতো। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে গেল বই আর কাগজপত্রের মধ্যে। আগুনের ভাপ সামলাতে মুখ চেপে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়ল শারিয়ার। তারপর পিস্তল তুলে সাদা শার্টকে আর দেখতে পেল না। কিন্তু আবারও ওর চোখ গেল মাটিতে ওখানে একটা ছোটো কেরোসিন স্টোভের একপাশে লাগানো একটা সলতেতে আগুন দেখতে পেয়ে যা বোঝার বুঝে গেল ও। ভুবনকে একটা টানে তুলে ধরে লাফ দিল দরজার দিকে।
প্রায় একই সঙ্গে দুজনে লাফিয়ে পড়ল কামরাটা থেকে। বিস্ফোরণে ধাক্কায় কেঁপে উঠল পুরো বেইজমেন্ট।
মাটিতে শুয়ে নিজেকে আগুনের হলকা থেকে বাঁচাতে বাঁচাতে শারিয়ারের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘পুরাই টোস্ট বানায়া দিল।’