মগরাজ – ১৭

অধ্যায় সতেরো – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

কাপসের হাট, চট্টগ্রাম

প্রবৃত্তি শব্দটার ওপরে কিরানের সবসময়ই অন্যরকম একটা ভরসা আছে।

একজন মানুষ গড়ে ওঠে তার শারীরিক সামর্থ্য আর বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে। কিন্তু যেকোনো মানুষের সর্বোচ্চ বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার প্রবৃত্তি আসলে কতটা প্রখর সেটার ওপরে। কিরানের বাবার মতে প্রবৃত্তি হলো মানুষের সেসব সত্তাগুলোর একটি যা মানুষ একেবারে সৃষ্টির আদি থেকে নিজের ভেতরে লালন করে আসছে। কিরান নিজেও দেখেছে যুদ্ধের ময়দান থেকে শুরু করে বহু ক্ষেত্রে নিজের প্রবৃত্তি তাকে রক্ষা করছে বহুবার। ঠিক যে প্রবৃত্তির বলে আজ কাপসের হাটে প্রবেশ করার সময়ে প্রায় কোনো কারণ ছাড়াই কিরানের মনে হচ্ছিল, যদি কোনো কারণে এখান থেকে পালাতে হয় তবে পেছন দিক থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখাই ভালো। আর ঠিক একারণেই বেদুর লোকদেরকেও বাজারের পেছন দিকে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিল ও।

হার্মাদ শব্দটা কানে যেতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে দুজনেই। যেকোনো জায়গায় হার্মাদের আক্রমণ হলে কী হয় দুজনের কারোই অজানা নয়। হার্মাদরা প্রথমেই গণহারে চারপাশে লুটপাট চালায়, তারপর সবকিছুতে আগুন লাগায়, এরপরেই শুরু হয় সবচেয়ে বীভৎস ব্যাপার মানুষ শিকার। যাকে সামনে পাবে তাকেই ধরতে শুরু করবে ওরা। একটু বেশি বয়স্ক কিংবা দুর্বল যারা তাদেরকে গুলি করে মারবে আর না হয় তলোয়ার কিংবা লম্বা ছুরির খোঁচায় মেরে ফেলবে। কিশোর, তরুণ, যুবক-যুবতীরা হলো এদের মূল শিকার। ছেলে-মেয়ে সবাইকে পাইকারি হারে ধরতে শুরু করবে। কাউকে মেরে, কাউকে ধরে কাউকে চাবুক মেরে সবাইকে ধরে এনে এনে লাইনে দাঁড় করানো হবে গরু-ছাগলের মতো। ছেলেদের ওপরে চলতে থাকবে প্রকোপ মার, মেয়েদেরকে গণহারে ধর্ষণ। হার্মাদদের জন্য এদেশীয় কারো কোনো মায়া-দয়া নেই। নিজ দেশ থেকে বিতারিত, গুন্ডা-বদমাশ-চোর-বাটপার অপরাধী সব জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে জাঁকিয়ে বসেছে এইদেশের মানুষের ওপরে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল কিন্তু সম্পদে ভরপুর বাঙ্গাল মুলুক হলো এদের জন্য স্বর্গরাজ্য। ছেলে, মেয়ে সবার ওপরে দস্যুদের প্রাথমিক খায়েশ মেটানোর পর সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে লোহার শিক আগুনে গরম করে সবার হাতের পাঞ্জাতে ফুটো করে দেওয়া হবে। সেই ফুটোতে প্রবেশ করানো হবে নলখাগড়ার কঞ্চি। একেকটা কঞ্চিতে পাঁচজন থেকে শুরু করে দশজন পর্যন্ত ঢোকানো হবে। ঠিক যেভাবে এক দড়িতে আট-দশটা ছাগলের পাশ বেঁধে তাড়িয়ে নেওয়া হয় ঠিক তেমনি মানুষদেরকে পশুর পালের মতোই তাড়িয়ে নিয়ে ঢোকানো হবে নৌকা কিংবা জাহাজের খোলে। সেই জাহাজ চলে যাবে রোসাঙ্গ কিংবা হুগলির বাজারে, আবার কখনো কখনো জাভা কিংবা গোয়া পর্যন্ত। সেখানে মানুষ বেচাকেনার হাটে বিক্রি হবে এরা।

কিরান কিংবা বেদু দুজনেই নিজেদের ঘাত-প্রতিঘাতের জীবনে বহুবার দেখেছে এসব। কখনো প্রতিহত করেছে আবার কখনো প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিজেরাই বিকোতে বসেছে। তো দুজনেই জানে ঠিক ঠিক কী হবে। হার্মাদ শব্দটা কানে যেতেই দুজন সচকিত হয়ে উঠেছে অভ্যাসবশত। বেদু কিরানের হাত ধরে বলে উঠল, ‘চলো ওস্তাদ।’

দুজনেই দৌড় দিল হাটের পেছনের দিকে। সেদিকেও ওদের লোকজন সব থাকার কথা। কিন্তু পথ চলতে গিয়ে দুজনেই পড়ল বিপদে। প্রথমেই একটানে চলে এলো বটগাছটার কাছে। সেখানকার প্রধান ঘাটেই হার্মাদদের মূল আক্রমণটা হয়েছে। কাজেই সেদিকে খানিকটা এগোতেই দেখতে পেল দুটো বড়ো বড়ো জালিয়া নৌকা ভেড়ানো হয়েছে বাজারের ঘাটে। আর সেটা থেকে টালে টালে বন্দুক, বর্শা আর তলোয়ার নিয়ে দস্যুরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে লোকজনের ওপরে। সেই সঙ্গে চলছে আগুন লাগানো। মানুষের আর্তনাদ, আগুনের উত্তাপ, আহত মানুষের আহাজারি আর মুহুর্মুহু গুলির শব্দে একটু আগের শান্ত, স্নিগ্ধ আর উত্তাপবিহীন জায়গাটাতে যেন নরক নেমে এসেছে।

কিরান আর বেদু দৌড়াতে দৌড়াতে কিরান হঠাৎ থেমে গেল। ও হার্মাদের নৌকা দুটো আর ওদের লোকজনের সংখ্যা নিরূপণ করার চেষ্টা করছে।

‘ওস্তাদ, কী অইলো? থামলা ক্যান?’ কিরানকে থেমে যেতে দেখে বেদু দৌড়াতে দৌড়াতে থেমে গেছে। বেদুর ডাক শুনে কিরান আবারও দৌড়াতে শুরু করল। বেদু কাপসের হাটের সঙ্গে খুব ভালোভাবে পরিচিত। তাই একের পর এক গলি ঘুপচি পার হয়ে ওরা চলে এলো বাজারের পেছন দিকের খালপাড়ে।

সেখানে পৌঁছেই দেখতে পেল বৈঠা তার ছেলেকে কোলে তুলে উদগ্রীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাজারের দিকে। তার ঠিক পাশেই বিল্লাল আর গোমেজ। কিরানকে দেখতে পেয়ে তিনজেনই হাত তুলে ডাকাডাকি শুরু করে দিল।

‘ওস্তাদ, তুমি ঠিক আছ?’ বৈঠার এগিয়ে এলো ওদের দিকে। ‘বাজারে হাম্মাদ বলে আইছে?’

‘আমি ঠিক আছি,’ কিরানের কথা শুনে ঘোঁৎ করে খুশির একটা শব্দ করল গোমেজ। ওর একটা হাত ধরে টেনে নিতে লাগল নৌকার দিকে।

‘একটু অপেক্ষা কর,’ বলে ও বেদুকে দেখল বেদু তখন উদগ্রীব হয়ে তার নৌকা আর প্রাণিগুলোকে খুঁজছে। কিরান দেখল ওরা পেছনের ঘাটের কাছে একটা নৌকায় বসে আছে। মুখের ভেতরে আঙুল পুরে দিয়ে বেদুকে ইশারায় দেখাল ওরা কোনদিকে আছে। বেদু সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে রওয়ানা দিল ওদের দিকে। কিরান ওর লোকদেরকে নিয়ে সেদিকেই চলল।

‘ওস্তাদ তুমি করতাছো ডা কী?’ বৈঠা নিজের ছেলেকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে কিরানের পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে।

‘একটু অপেক্ষা কর,’ কিরান ওদের নিয়ে বেদুর নৌকার কাছে গিয়ে হাতের ইশারায় বেদুকে ডাকল। ‘বেদু, তোর জিনিসপত্র ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে, ওস্তাদ।’

‘তাইলে এদিকে আয়,’ আমার একটা পরিকল্পনা আছে,’ যদিও হাটের যেদিকটায় ওরা আছে সেদিকে হই-হট্টগোল কম কিন্তু কোনোভাবেই পরিস্থিতি শান্ত বলার উপায় নেই। কিরান দেখল ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ওর সঙ্গীরা। বুক ভরে দম নিল ও। এখন যা বলতে যাচ্ছে সে এবং যা করতে যাচ্ছে সেটাকে সফল করতে হলে ওর নিজের লোকদের সহায়তা দরকার হবে। তবে তার চেয়ে বেশি দরকার হলো নিজের লোকদের ভেতরে সেই সাহসিকতাটুকু জন্মানো যেটা ওর পরিকল্পনাকে সফল করতে হলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

‘সবাই মন দিয়া শুনবি,’ বলে ও একে একে ওদেরকে দেখল। তারপর নিজের দৃষ্টি বেদুর ওপরে স্থির করে বলে উঠল, ‘তুমরা এহানে যারা আছ সবাই আমার নিজের মানুষ। যে বড়ো কাম আমি, মানে আমরা মিলা করতে যাইতেছি সেটার জন্য আমাগো সব আছে কিন্তু একটা জিনিস নাই,’ একথা বলে সে নিজের একটা হাত তুলল। ‘তথ্য।’

ওর লোকেরা সবাই এখনো দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওরা এখনো বুঝতে পারছে না, এই মুহূর্তে এখান থেকে যখন পালানো দরকার সেখানে কিরান ওদেরকে দাঁড়িয়ে গল্প করছে কেন

‘আর আমার যে তথ্য দরকার সেই তথ্য একজন মাত্র মানুষই দিতে পারব, ‘ বলে নিজেকে খানিকটা শুধরে নিয়ে বলে উঠল, মানে, একটা মাত্র গোত্রের লোকেরাই দিতে পারব,’ বলে সে একটু থেমে বোমাটা ফাটাল, ‘হার্মাদ। আর এই কারণেই আমি একজন হার্মাদরে ধইরা আনতে চাই,’ ওর দলের সবাই চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।

এমন কথা বাঙ্গাল মুলুকে এর আগে কেউ শুনেছে কিনা সেটাও ওদের জানা নেই। কারণ হার্মাদ, দস্যু, মগ এই শব্দগুলো এদের মাথার ভেতরে এমন ভীতিকরভাবে বসে গেছে যে, হার্মাদ মানেই জীবনের ভীতি, মগ মানেই পলায়ন। আর কিরান কিনা সেই হার্মাদদের একজনকে ধরে আনতে চাইছে। সেটা কীভাবে সম্ভব!

কিরান বুকের ওপরে থাকা ওর বাবার দেওয়া দোলকটা চেপে ধরে বিড় বিড় করে বলে উঠল, ‘বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল,’ বিড় বিড় করে কথাটা বলেই সে বাকিদের উদ্দেশ্যে জোরে বলে উঠল, ‘সবাই মন দিয়া শোন, আমি কী বলি।’

***

বেদুর পায়ের নিচে পড়ে ছোটো একটা ডাল ভেঙে মট করে সামান্য একটু শব্দ হতেই পাথরের মতো জমে গেল কিরান। হাতের ইশারায় তাকে সাবধানে এগোতে বলে আবারও ধীর পায়ে এগোল সামনের দিকে।

কিরানের গায়ের পোশাকের ভেজা জায়গাটা জলকাদায় মিশে কালো রং ধারণ করেছে। একইরকম আধভেজা কাপড় দিয়ে ওর মুখও বাঁধা। এক হাতে ছোটো একটা গাদা পিস্তল, অন্য হাতটা কোমরে রাখা ড্যাগারের বাঁটের ওপরে। দুটো জিনিসই এমনভাবে রাখা যেকোনো মুহূর্তে প্রয়োজন হলেই যেন বের করে আনতে পারে খুব সহজেই।

আরেকটু এগিয়ে সামনের দিকে এসে একটা গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিল কিরান। ওর পেছন পেছন এগোতে থাকা বেদু আর গোমেজকে হাতের ইশারায় থামতে বলল ও। বেদুর একটু কাছাকাছি মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জানতে চাইল, এই তোর কিচাক আর শায়ক হতাশ করব না তো?’ কিরান বেদু বানর আর ইগলটার কথা জানতে চাইল।

জবাবে বেদু কিছু না বলে গাছের ওপরের দিকে ইশারা করল কিরানকে। ওপরের তাকিয়ে কিরান দেখতে পেল মাথা ওপরে ওদেরকে কেন্দ্র করে চক্কর দিচ্ছে ইগলটা। আর গাছের ডাল ধরে ঝুলছে বানরটা।

মনে মনে খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কিরান। কারণ অজানা জিনিসের ওপরে বাজি ধরার অভ্যাস নয় ওর। কিন্তু আজ হুট করে হার্মাদ ধরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে ঠিক এই কাজটাই করতে হয়েছে ওকে। কিন্তু এখন এই দুটোকে দেখে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক ভুল করেনি ও। বেদুর দিকে তাকিয়ে চোখে সন্তুষ্টির দৃষ্টি হেনে বুক ভরে দম নিল কিরান। ও যুদ্ধের ময়দান ছেড়েছে আজ বহু বছর। কাজেই সেই উত্তেজনা এখন আর আগের মতো বুকের ভেতরে লালন করা হয় না আগের মতো। অনেকদিন পর কিরান যেন সেই যুদ্ধের উত্তেজনা বোধ করতে শুরু করেছে।

প্রথমে কাপসের হাটের পেছন দিকে কিরান যখন সবাইকে জানাল ও একজন হার্মাদ দস্যুকে অপহরণ করতে চায় এক সময় প্রথমে সবাই চমকে যায় তারপরে সবাই একযোগে প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে দিতে থাকে ওর দিকে শুধু বেদুর চোখে সে পুরনো সেই উত্তেজনা দেখতে পায় ও। আর অন্যদিকে গোমেজ দাঁড়িয়ে ছিল পাথরের মতো স্থির হয়ে। তার কোনো বিকার নেই, কিরান যদি ওকে বলে পাহাড় ভেঙে নিয়ে আসতে ও সেটাও চেষ্টা করে দেখবে, কোনো সন্দেহ নেই।

সবাই যখন তড়বড় করে প্রশ্ন করতে শুরু করে তখন কিরান প্রথমেই জানায় এই পরিকল্পনায় সবাইকে সে নিতে চায় না। শুধু বেদু গোমেজ আর বেদুর বানর আর ইগলটাকে লাগবে ওর। বৈঠা, বিল্লাল শেঠ, বেদুর সহচর মতি, বৈঠার ছেলে আর বাকিরা বেদুর বাঘটাকে নিয়ে এই মুহূর্তে রওয়ানা হয়ে যাক খণ্ডালের গুহার দিকে। কিরান রাতের বেলা জাহাজ ছাড়ার আগে ওখানেই দেখা করবে ওদের সঙ্গে।

কিরানের কথা শুনে বিল্লাল শেঠ খুশিই হয়। কারণ এসব ঝামেলায় তার পড়ার কোনো আগ্রহ নেই। অন্য দিকে বৈঠা একটু দনোমনো করলেও নিজের ছেলের কথা ভেবে সে রাজি হয় চলে যেতে। ওদেরকে বিদায় দিয়ে বেদু আর গোমেজকে কিরান পরিকল্পনার কথা খুলে বলে। ওর পরিকল্পনা খুবই সহজ। কিন্তু সময় আর পরিস্থিতির ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করছে। ওর পরিকল্পনাটা অনেকটা এমন; এখান থেকে ওদের নৌকোটা নিয়ে ওরা চলে যাবে বাজারের ঘাটের কাছাকাছি। সেখান যেকোনো এক পাড়ে নৌকাটাকে লুকিয়ে রেখে ওরা পানি থেকে বাজারের ঘাটে লুকিয়ে উঠে পড়বে। সেখানে উঠে হার্মাদের কার্যক্রম অবলোকন করবে। যদি ওখানে কোনো হার্মাদকে একা পেয়ে যায় তো তিনজনে মিলে ওটাকে কাবু করে নিজেদের নৌকায় তুলে চম্পট দিবে। আর যদি সেটা না হয় তবে হার্মাদদের লক্ষ করে ওখান থেকে ওরা হার্মাদদের যেকোনো নৌকা বা জাহাজে ওঠার চেষ্টা করবে।

লুটপাটের সময়ে সাধারণত হার্মাদরা নিজেদের মূল জাহাজে খুব বেশি মানুষ রাখে না। কাজেই ওখান থেকে কাউকে ধরে ওরা পানিতে নামবে অথবা কাউকে নিয়ে নৌকোতে করে চম্পট দেবে। কিন্তু দ্বিতীয় পরিকল্পনা সফল করতে হলে বেদুর বানরটার সাহায্য লাগবে ওর।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা প্রথমেই নিজেদের নৌকা নিয়ে ঘাটের পেছন দিক থেকে চলে আসে কাপসের হাটের মূল ঘাটের কাছাকাছি। সেখান থেকে হাটে উঠে আশপাশে অবলোকন করে একটা হার্মাদকেও দেখতে পায় না। কিরান আবারও অনুধাবন করল এরা যতই অসভ্য আর জংলি হোক না কেন কঠিনভাবে নিয়ম মেনে চলে। এমনকি লুটপাটের সময়ও এরা কেউ একা হয় না, দলের সঙ্গে থাকে। এখানে কাজ হবে না, বুঝতে পেরে কিরান ওদের দুজনকে বুঝিয়ে দেয় ও হার্মাদের জাহাজে যাচ্ছে।

বড়ো করে নেওয়া দমটা ছেড়ে দিয়ে কিরান বেদুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমি পানিতে নামব, পানিতে লাফ দিতেই তোরা নাও নিয়া রওনা দিবি ওদিকে,’ বলে সে হার্মাদদের জালিয়া দুটোকে দেখাল। ওগুলোর পেছনে কোনো একদিকে লুকিয়ে থাকবি তোরা। আমি যদি কোনো হার্মাদরে ধরতে পারি তবে তারে নিয়া পানিতে নামলেই তোরা উঠায়া নিবি আমগোরে,’ বলে কিরান পানিতে নামার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল, কিন্তু বেদু ওর একটা হাত চেপে ধরতেই অবাক দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল সে বেদুর দিকে।

‘কী ব্যাপার?’

‘ওস্তাদ বেশি ঝুঁকি অয়া যাইতাছে না, তুমি তো জানো না জাহাজে কয়জন আছে?’ কিরান কিছু না বলে হাতটা ধরে আশ্বাসের ভঙ্গিতে জোরে চাপ দিল। ‘আগুনে ঝাঁপ দিতে অইলে তাপের ভয় কইরা লাভ নাই,’ বলে সে বেদুর বানরটার দিকে তাকিয়ে বিশেষ একটা শব্দ করল মুখ দিয়ে। শব্দটা বেদুই ওকে শিখিয়ে দিয়েছে ওটাকে ডাকার জন্য। কিরান ইশারা করতেই ওটা নেমে এলো একেবারে ওদের কাছের ডালে। কিরান, বেদু আর গোমেজের দিকে তাকিয়ে বড়ো করে দম নিয়ে দক্ষ সাঁতারুর ভঙ্গিতে পাড়ের মাটি থেকে লাফ দিল পানিতে।

ঠান্ডা নোনা পানি ওকে গিলে নিতেই হাত-পা নেড়ে ডুবসাঁতার দিতে শুরু করল সে। এক টানে প্রায় সত্তর-আশি গজ পানি নিচ দিয়ে এসে মাথা তুলে দেখল অনেকটাই সরে এসেছে ঘাট থেকে। ওর কাছেই সাঁতরাচ্ছে বেদুর বানরটা। মনে- মনে খুশি হয়ে উঠল ও, প্রাণিটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। বড়ো করে দম নিয়ে আবারও ডুব দিল ও। এবার লক্ষ্য, হার্মাদদের জাহাজের কাছে পৌঁছানো।

আরেকবার লম্বা ডুব দিয়ে এবার স্বাভাবিকভাবে সাঁতার কাটতে লাগল। হাত- পা পানিতে চললেও কিরানের মাথা চলছে একেবারেই ভিন্ন দিকে। অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়েছে ও। প্রথমত, পর্তুগিজরা অসাধারণ জাহাজি হলেও পানিতে সাঁতারের ব্যাপারে ওরা একেবারেই অদক্ষ, বিশেষ করে একবার পানিতে পড়ে গেলে ওরা শেষ। কাজেই কোনো দস্যুকে একবার কুপোকাত করে পানিতে ফেলে দিতে পারলে, কেল্লা ফতে। অন্যদিকে, আরেকটা বড়ো ব্যাপার হলো, হার্মাদরা যখন কোথাও লুটপাট চালাতে যায় তখন সাধারণত জাহাজে তেমন কাউকে রেখে যায় না। কারণ লুটপাটে অংশ নিতে চায় সবাই। আর একারণেই ওদের জাহাজে পাহারাদার কিংবা রাঁধুনি ছাড়া তেমন কেউ থাকে না। আর কিরানেরও উদ্দেশ্য তেমন কাউকে কাবু করে ধরে নিয়ে যাওয়া। কারণ ওর যে-তথ্য দরকার সেটা পেতে বড়ো কোনো দস্যুর দরকার নেই। তবে ওর পরিকল্পনায় বিরাট একটা ফাঁক হলো, কোনো দস্যুকে ধরতে গেলে সে যদি একবার বন্দুক চালিয়ে দিতে পারে মানে তার সঙ্গীদেরকে খবর দিয়ে দিতে পারে তবেই খবর আছে; পুরো দল তখন ওদের পিছু লাগবে।

কিরান বেশি ভাবার সময় পেল না। হার্মাদদের জালিয়ার কাছাকাছি এসে আবারও ডুব দিল ও পানিতে। এক সাঁতারে একেবারে জাহাজের গোড়ায় গিয়ে মুখ তুলল ও। কোমর থেকে ছুরি বের করে দাঁতে কামড়ে ধরল। কারণ একবার জাহাজের পাটাতনে উঠলে কী অবস্থায় পড়বে সে নিজেও জানে না। জাহাজের কাছাকাছি এসে ওটাকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করল কিরান। এক জায়গায় একটা দড়ির দঙ্গল ঝুলতে দেখে প্রথমে বানরটাকে ইশারা করল ও। ওর ইশারা পেয়েই তড়তড়িয়ে উঠতে শুরু করল ওটা। কিরান মনে মনে বেদুর প্রশংসা না করে পারল না। প্রাণিগুলোকে এমন প্রশিক্ষণ দিয়েছে, ইশারায় অনেক কিছু বুঝে ফেলে এরা। এবার ওকে উঠতে হবে। ওপরে কী পরিস্থিতি কে জানে।

***

কিরান পানিতে নেমে যেতেই বেদু একবার ইশারা করল গোমেজের দিকে। এখন ওদেরকে একটা বড়ো ভূমিকা পালন করতে হবে। কিরান যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে সেভাবে যদি ওরা কাজ করতে না পারে তবে পুরো ব্যাপারটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। জলার দিকে এগোতে এগোতে আড়চোখে একবার গোমেজকে দেখে নিল বেদু। এই লোকটার সঙ্গে তার কোনোদিনই সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। এমনকি যখন কিরানের সঙ্গে জাহাজে কাজ করত তখনো গোমেজকে এড়িয়েই চলত ও। এর পেছনে একটা বড়ো কারণ গোমেজের সাদা চামড়া। বেদু আজ ও বুঝতে পারেনি একটা সাদা চামড়ার মানুষ কীভাবে কালো মানুষদের সঙ্গে এভাবে ভিড়ে গেল। বিশেষ করে বেদু যতখানি জানে পর্তুগিজরা ভীষণ ধর্মভীরু হয়। সেই ধর্মভীরু একটা খ্রিস্টান এভাবে একদল হিন্দু আর মুসলমানের সঙ্গে থাকে—ব্যাপারটা যে দেখে সেই অবিশ্বাসের সঙ্গে অবলোকন করে। তার ওপরে আরেকটা বড়ো ব্যাপার হলো, এই লোকটাকে মাঝে মাঝে তার একেবারে শিশুর মতো লাগে আবার কখনো কখনো ভীষণ ভয় করে। বেদু নিজে অত্যন্ত শক্তিশালী গড়নের মানুষ। নিজ গোত্রের ভেতরে সে আজ অবধি এমন কোনো মানুষ পায়নি যে কিনা শারীরিক শক্তিতে তার সঙ্গে পেরে ওঠে। কিন্তু এই গোমেজকে দেখলে ওর নিজেকে কেন জানি ভীষণ দুর্বল আর অসহায় মনে হয়।

‘গোমেজ এই দিকে,’ তাকে তুই, তুমি নাকি আপনি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না বেদু। বরং সে তাকে হাতের ইশারায় তার সঙ্গে এগোতে বলল। গোমেজ কিছু না বলে নিজের হাতের লম্বা লাঠিটা দুবার ঘুরিয়ে ওর পিছু পিছু আসতে লাগল। আরেকবার অবাক হয়ে বেদু ভাবতে লাগল এরকম বিরাট আকৃতির একটা লোক কীভাবে এতটা নিঃশব্দে চলতে পারে।

ওরা মূল বাজার আর তার হট্টগোলকে পাশ কাটিয়ে খুব সাবধানে পানির ধারাকে অনুসরণ করে জলার ঘাটের দিকে এগিয়ে চলল, সেখানে ওদের নাও বাঁধা আছে। ওরা এখন যেখানে যেভাবে যাচ্ছে তাতে করে যেকোনো সময় কারো চোখে পড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে হার্মাদদের কারো চোখে পড়লেই ওরা সোজা গুলি করবে আর না হয় দল বেঁধে তেড়ে আসবে ওদের দিকে। কিন্তু প্রায় নির্বিঘ্নেই ঘাটের কাছাকাছি এসে পৌঁছাতে পারল ওরা।

ঘাটের কাছে এসে ওদের নৌকোটাকে দেখে খুশিতে অদ্ভুত এক শব্দ করে উঠল গোমেজ। ‘গোমেজ, আমি নৌকার দিকে আগাইতাছি, তুই নৌকার দড়িটা খুলে দিবি। বুঝছোস?’ বেদু প্রশ্ন করতেই প্রায় নিঃশব্দে গোমেজ সেদিকে রওনা দিল যেখানে নৌকার দড়িটা বাঁধা আছে। বেদু খুশি মনে এগোল নৌকার দিকে। গোমেজ নৌকার দড়ি খুলে দিয়ে বৈঠা হাতে বেদু নৌকাটাকে ঘুরিয়ে দিতেই গোমেজ লাফিয়ে লাফিয়ে নৌকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এমন সময় হঠাৎ ওদের নৌকাটা টান খেয়ে স্থির হয়ে গেল। দুজনেই একসঙ্গে ফিরে তাকিয়েই দেখতে পেল কেউ একজন ওদের নৌকার দড়ি টেনে ধরেছে। সেটাও অতো বড়ো কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু নৌকার দড়ি টেনে ধরার সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে লোকটা। আর ঘাটের ওপর থেকে একদল দস্যু দৌড়ে আসছে ওদের ধরার জন্য। ‘সর্বনাশ,’ আপনাতেই কথাটা বেদুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।

***

ড্যাগারটাকে দাঁতে কামড়ে ধরে জাহাজে ওঠার দড়ির গোছাটাকে বেশ শক্ত হাতে ধরে ফেলল কিরান। কিন্তু ওটা বেয়ে উঠতে গিয়ে একটু অবাক হয়ে সে লক্ষ করল তার হাত চলছে না। দড়িটাকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে স্থির করে ফেলল ও। বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে নিজের দম ফিরে পাবার চেষ্টা করতে লাগল সে। কিন্তু অবাক হয়ে গেল নিজের অবস্থা দেখে। বহু বছর যুদ্ধের ময়দানে, পানিতে,জাহাজে কাটানো যে মানুষটা আজ থেকে বছর কয়েক আগে হারিয়ে গিয়েছিল বিগত চার বছরের জীবনের নানা চড়াই-উত্রাইয়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে মানুষটার ভেতরটা কতটা ক্ষয় হয়ে গেছে তারই প্রমাণ যেন ওর এই অবস্থা। বহু বছরের অনভ্যস্ততায় পানিতে কিছুদূরে সাঁতরেই দম হারিয়ে ফেলেছে ও। কিছুক্ষণ চুপ চাপ ঝুলে থেকে দম নিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করল ও। জাহাজের পাটাতনের কাছাকাছি পৌঁছে শরীরটাকে একবার দোল খাইয়ে সাবধানে পাটাতনের ওপাশ থেকে উঁকি দিল ও।

পাটাতনে একটা প্রাণিরও অস্তিত্ব নেই। ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলো কিরান। বলতে গেলে প্রায় নিঃশব্দে জাহাজের ডেকের ওপরে নেমে দুপাশে চোখ বুলাল। কেউই নেই। ড্যাগারটাকে কোমরে গুঁজে পানিতে ভেজা পিস্তলটাকে হাতে নিয়ে এলো। জিনিসটা কোনো কাজের না, কিন্তু যে দেখবে সে তো আর সেটা জানে না। কাজেই এই বুদ্ধিতেই পিস্তলটাকে নিয়ে এসেছে ও।

যদিও এ ধরনের জালিয়া জাহাজের আকৃতির ব্যাপারে বেশ ভালো ধারণা আছে কিরানের কিন্তু তবুও সে একবার ভালোভাবে পরখ করে নিল চারপাশটা। কিরান অনুমান করল কমপক্ষে ছাব্বিশ দাঁড়ির জাহাজ হবে এটা। আবার ওপরে পাশের ব্যবস্থাও আছে। মাঝখানে বিরাট মাস্তুলের সঙ্গে ভাঁজ করা পাল আর দড়িদড়া ঝুলছে। জাহাজের একপাশ থেকে শুরু হয়েছে লোকেদের থাকার কামরা। সেটার ওপরে আবার ছোটো একটা ঘর। ওখান থেকেই শুরু করবে কিরান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল।

চল, এখন পুরো জাহাজটা চক্কর দিতে হবে,’ কথাটা সে বানরটার উদ্দেশ্যে ইশারা করে জাহজের খোলের দিকে রওনা দিল। কিন্তু বানরটা সাহায্য করার বদলে এদিকে ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগল। ওটাকে সামান্য ধমক দিয়ে কিরান চলে এলো জাহাজের একপাশে খোলের দিকে। প্রথমে যে কামরাটায় প্রবেশ করল সেটা জাহাজের রসুইঘর। কিরান ভেতরে ঢুকে চোখের পলক বুলিয়ে নিয়ে ও অন্য দিকে সরে যাবে তার আগেই রসুইয়ের পাশের দরজা খটখট শব্দে খুলে গেল।

কিরান চট করে একপাশে সরে গেল, ওর পিস্তল ধরা হাতটা ভাঁজ করা। কিন্তু অন্য হাতটা ড্যাগারের বাঁটের ওপরে। কিরান দম বন্ধ করে একপাশে স্থির হয়ে রইল। এখনো জানে না কে এসেছে ভেতরে। কোনো দস্যু হতেও পরে আবার হয়তো সাধারণ কোনো কাজের লোক। কাজেই কে আছে ওখানে নিশ্চিত না হয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে মোটেই আগ্রহী নয় ও। কিন্তু সেটা আর পূরণ হলো না।

কারণ কিরান সময়মতো সরে পড়তে পারলে ওর সঙ্গে নিয়ে আসা বানরটা খাবার পরিবেশনের চৌপায়ার ওপরে এমনভাবে বসেছিল ওটা না পারল সরতে, না কিরান পারল ওটাকে ইশারা করে সরাতে। পাশের দরজা দিয়ে যেই প্রবেশ করে থাকুক চৌপায়ার ওপরে বানরটাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল আর বানরটা ভয় পেয়ে ঝুলতে ঝুলতে কামরার বাইরে রওনা দিলে মনে মনে কিরান খুশিই হলো। যে উদ্দেশ্যে বানরটাকে নিয়ে এসেছিল সেটা পূরণ না করে বরং ভেজাল লাগানোতে কিরান খানিকটা বিরক্তই হয়েছিল কিন্তু ওটার কারণে লোকটা বেরিয়ে যাওয়াতে খুশি হয়ে উঠল ও। কারণ লোকটা চেঁচিয়ে উঠেছে পর্তুগিজ ভাষায়। দ্বিতীয়ত, লোকটা বাইরে চলে গেলে পাটাতনের ওপরে তাকে কাবু করতে যেমন সুবিধা হবে ঠিক তেমনি তাকে পানিতে নামাতেও সুবিধা হবে। লোকটা বানরটার পিছু পিছু বেরিয়ে যেতেই কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল কিরান। তারপর বেরিয়ে এলো দরজার আড়াল থেকে।

বাইরে এসেই দেখতে পেল ডেকের ওপরে লোকটা বানরটার দিকে পিস্তল তাক করেছে। পেছন থেকে জোরে চেঁচিয়ে উঠে নিজের পিস্তল তুলল এবং সঙ্গে সঙ্গে বোকা বনে গেল। ডেকের ওপরে আরেক দস্যু খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, তাকে দেখতেই পায়নি কিরান।

একজনের সঙ্গে লড়াই করা এক জিনিস আর দুজনার সঙ্গে লড়াই করে একটাকে নিকেশ করে অন্যটাকে বন্দি করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আপনাতেই মুখটা হাঁ হয়ে গেল কিরানের।

***

বেদু আর গোমেজের উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব কারো নজরে না পড়ে দ্রুত গতিতে নৌকা নিয়ে সরে পড়া। কিন্তু বাস্তবে ঘটে গেল একেবারে ভিন্ন ঘটনা। তাও আবার ব্যাপারটা ঘটল পুরোপুরি ভাগ্যের দোষে। যদি ব্যাপারটা নিজেদের দোষেও ঘটত তাও হয়তো ওরা নিজেদের খানিকটা সান্ত্বনা দিত। কিন্তু এভাবে স্রেফ ভাগ্যের দোষে ব্যাপারটা ঘটাতে বেদুর ইচ্ছে করছে নিজের চুল ছিঁড়তে।

আসলে ঘটনা ঘটেছে কিরান পানিতে লাফ দেওয়ার পর বেদু আর গোমেজ যখন লোকচক্ষুর অন্তরালে সন্তর্পণে ঘাটের দিকে এগোচ্ছে নৌকা আনার জন্য ঠিক তখুনি বাজারের ভেতরে এক দল লোককে তাড়া করেছে হার্মাদরা। সেই লোকগুলো তাড়া খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘাটে এসে দেখে ঘাট থেকে একটা নৌকা ছাড়ছে। বেশির ভাগ নৌকাই যখন হয় হার্মাদরা ফুটো করে ফেলেছে আর না হয় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সেখানে আস্ত একটা নৌকা দেখে ওরা বাঁচার আশায় সেটা বেঁধে রাখা দড়ি ধরে টানতে শুরু করে। ঠিক একই সময়ে পলায়নরত লোকগুলোর পিছু নিয়ে পৌছায় একদল দস্যু। ওরাই এখন এদের পিছু নিয়েছে। সবমিলিয়ে ত্রাহি অবস্থায় পড়ে গেছে গোমেজ আর বেদু।

ব্যাপারটার সমাধান যে খুব জটিল তা কিন্তু না। তবে যে সমাধান বেদুর মাথায় এসেছে সেটা বাস্তবায়ন করতে বেদুর মন টানছে না। কারণ যে মানুষগুলো ওদের নৌকোতে উঠতে চাইছে তারাও বিপদে পড়েই কাজটা করছে। সমাধানটা হলো, ছুরি দিয়ে দড়ি কেটে দেওয়া। লোকগুলো যে দড়িটা ধরে নৌকো টানছে সেই দড়িটা গোড়া থেকে কেটে দিলেই আর কেউ সেটা ধরতেও পারবে না আর নৌকাটাও মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু এখানেই বেদুর মনটা আটকে গেছে। এতে করে ওরা পালাতে পারবে কিন্তু ধরা পড়ে যাবে লোকগুলো।

পাড়ে দাঁড়ানো লোকগুলো এবার দড়ি ধরে টানতে শুরু করেছে। ফলে নৌকোটা খোলা পানি দিক না গিয়ে উলটো আবারও ঘাটের দিকে যেতে শুরু করল। গোমেজ আঁতকে উঠে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে বেদুর দিকে তাকিয়ে আছে। কী করবে সে জানতে চাইছে। উপায় না দেখে বেদু কোমরের কাছ থেকে ছুরিটা বের করে আনল। এখনো সে দড়িটা কেটে দিতে চাইছে না। একজনও যদি বাঁচে তাতেও তো একজন মানুষ হার্মাদদের হাত থেকে বাঁচল। কিন্তু সে তো আর জানে না ভবিতব্যে লেখা ছিল ভিন্ন কিছু

লোকগুলো চিৎকার চেঁচামেচি করে দড়ি টানতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ঘাটের ওপরে থাকা হার্মাদরা পৌঁছে গেছে ঘাটের কাছে। লোকগুলোকে রেঞ্জের মধ্যে পেয়েই একজন গুলি চালাল। কারো গায়ে না লাগলেও একেবারে বেদুর কাছাকাছি একটা বুলেট নৌকোর খানিকটা ছাল-চামড়া উঠিয়ে দিয়ে চলে গেল। এবার আর বেদুর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করল না গোমেজ। সে টানতে থাকা দড়িটার গোড়া ধরে ফেলল তারপর পা দুটো নৌকোর খোলের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে উলটো টান মারল। দড়িটা ধরে টানছিল তিনজনে। গোমেজের ভীষণ শক্তিশালী টানে তিনজনই উলটো পড়ে গেল পানিতে। নৌকাটা বাঁধন মুক্ত হতেই বেদু বৈঠা হাতে ওটাকে ঘোরাতে শুরু করে দিল। আর ওপার থেকে আরো দুটো গুলি ছুটে এলো নৌকার দিকে। দড়ি টেনে তুলে নিয়ে নৌকার ওপরে রেখেই গোমেজ নৌকাটাকে টেনে সরানোর লাঠিটা তুলে দিয়ে ওটাকে সর্বশক্তিতে ঠেলে দিতে লাগল।

পরবর্তী কয়েক মিনিট চোখে-মুখে কিছু না দেখে টানা স্রেফ নৌকো বেয়ে গেল দুজনে। মোটামুটি ঘাট আর হার্মাদের আয়ত্ত থেকে বেরিয়ে এসে নৌকা বাইতে বাইতে ফিরে তাকাল ওরা দুজনে।

স্বস্তির সঙ্গে দেখল যা হয়েছে ভালো হয়েছে। পাড়ে দাঁড়ানো লোকগুলোর ভেতরে তিনজনে পানিতে পড়ে যাওয়াতে ওরাও সাঁতরে সরে পড়তে পেরেছে। বেদু হাসি মুখে ফিরে তাকাল গোমেজের দিকে। কিন্তু গোমেজের মুখে হাসি নেই। সে মাইল দুয়েক দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা জালিয়া দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেরা তো কোনোমতে ঘাট থেকে পালাতে পেরেছে কিন্তু ওখানে কিরানের কী অবস্থা কে জানে।

***

কিরানের অবস্থা কাহিল। একইসঙ্গে একটা নয়, দুই-দুটো হার্মাদকে সামলাতে হচ্ছে ওর এই মুহূর্তে। কিরান জীবনে বহু জায়গায় বহু ধরনের শত্রুর মোকাবেলা করেছে। কখনো একা, আবার কখনো দলগতভাবে কিন্তু জীবনে কখনো ওকে একাই দুটো ফিরিঙ্গির মোকাবেলা করতে হবে তাও আবার একটা বানর আর একটা ইগল পাখিকে নিয়ে এমনটা কোনোদিন ওর কল্পনাতেও আসেনি।

একটু আগে ফিরিঙ্গিটাকে অনুসরণ করে জাহাজের খোলা জায়গাটাতে এসে পেছন থেকে ওর ভেজা নষ্ট পিস্তলটা তাক করতেই সে দেখতে পায় বিপরীত দিক থেকেও আরেকজন বন্দুক তাক করে আছে। কিন্তু ঘাবড়ে না গিয়ে বরং সে চেহারাটাকে শক্ত করে হেসে উঠে ভাঙা পর্তুগিজ দুজনকেই হাত তুলে দাঁড়াতে বলে, সেই সঙ্গে এটাও জানায় যদি ওর কথা না শোনে তবে খুলি উড়িয়ে দেবে সে। যে ফিরিঙ্গিটাকে অনুসরণ করে কিরান ডেকের ওপরে এসেছে ওর হাতের পিস্তল আর অভিব্যক্তি দেখে ভয়ে দুই হাত তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে বন্দুক তুলে থাকা ফিরিঙ্গি নিজের বুন্দকটাকে আরেকটু ওপরে তুলে ধরে কিরানকে দেখিয়ে অন্য ফিরিঙ্গিটাকে কিছু একটা বলে। কথাটা শুনতে পায় না কিরান। কিন্তু এটা বুঝতে পারে লোকটা কথাটা শুনেই ওর পিস্তল থেকে ঝরতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে হাত দুটো নামিয়ে নেয়। কিরানের মুখ শুকিয়ে যায়। কারণ ও বুঝতে পারে জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে।

মাথা ঠান্ডা রাখে সে। চট করে একপাশে সরে যায় কিরান। এর ফলে বিপরীত দিক থেকে চাইলেও বন্দুক হাতের ফিরিঙ্গি ওকে গুলি করতে পারবে না। মাঝখানের জনের গায়ে লাগতে পারে তাতে। একপাশে সরে এসেই সে ডেকের ওপরে এক গড়ান দিয়ে এগিয়ে এসে প্রথম ফিরিঙ্গির দুই হাত চেপে ধরে কুস্তির কায়দায় শরীরটাকে খানিকটা বাঁকিয়ে কাত করে ফেলে একপাশে। এই লোকটাকে আরেকটু সরাতে পারলে একে নিয়ে দ্বিতীয়টার গায়ের ওপরে ফেলাই ওর উদ্দেশ্য। কিন্তু সেটা করার আগেই আটকে গেল সে।

ফিরিঙ্গিটা কিরানের হঠাৎ আঘাতে খানিকটা চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে চট করে ধরে ফেলে কিরানকে। লম্বা চওড়া লোকটা কিরানকে ধরে ফেলেই বাচ্চাদের মতো তুলে ফেলে সরিয়ে দেয় একপাশে। বিশালদেহী ফিরিঙ্গির এক ধাক্কায় পাটাতনের ওপরে পড়ে যায় কিরান। ওকে পড়ে যেতে দেখেই এগিয়ে এসে ওর পাঁজর বরাবর বুট পরা পায়ে সর্বশক্তি দিয়ে দুটো লাথি মারে লোকটা। সেই সঙ্গে মুখে ছুটছে গালির তুবড়ি। এই সুযোগে তার দ্বিতীয় সঙ্গী এগিয়ে এসে বন্দুক তোলে ওর দিকে। কিন্তু প্রথম জন তাকে থামিয়ে হড়বড়িয়ে কিছু একটা বলতে থাকে।

আঘাতের চোটে দিব্যলোকে তারা দেখতে পেলেও কিরান ওদের কথোপকথনে বুঝতে পারে ওকে মেরে ফেলতে মানা করছে। তাতে কারো লাভ নেই। বরং ওকে দাস হিসেবে বন্দি করতেই বেশি আগ্রহী প্রথম জন। কিরান কোনোমতে নিজেকে বাঁকিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল ডেকের ওপরে।

ওকে সোজা হতে দেখে একজন এগিয়ে এসে ওর ঘাড় ধরতে চাইছিল কিন্তু কাছাকাছি আসতেই পায়ে পা বাঁধিয়ে ল্যাং মারল ওকে কিরান। লোকটা পড়ে যেতেই তার গায়ের ওপরে গড়ান দিয়ে লাফিয়ে সোজা হলো ও। দ্বিতীয় জন আয়ত্তের মধ্যেই ছিল, তার বন্দুকের নলটা এক হাতে ধরে ওটাকে ওপরের দিকে উঠিয়ে দিল। সেই সঙ্গে লোকটার হাতে চাপ পড়ে কিরানের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল উত্তপ্ত সিসা। কিন্তু ধাক্কার চোটে বন্দুকটা ছুটে গিয়ে কিরানের হাতে চলে এলো।

পাটাতনের ওপরে সোজা হয়ে দাঁড়াল প্রথমজন। দুইপাশে দুই দস্যু, আর মাঝখানে খালি বন্দুক হাতে কিরান। প্রথম জন তার কোমর থেকে বের করে আনল ছোটো একটা তরবারি। লোকটাকে ওটা বার করতে দেখে হেসে উঠল কিরান I ‘এমনটাই তো চাই’ বলে সে শিস বাজাল।

ওর শিসের শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই শূন্যে উদয় হলো ইগল পাখিটা। তরবারি হাতের লোকটার মাথার ওপরে ছোবল দেওয়ার ভঙ্গিতে আঁচড় কাটল সেই সঙ্গে তার মুখের ওপরে চড়ে বসল বানরটা। এই সুযোগে কিরান হাতের খালি বন্দুকটাকে দুবার পাক খাইয়ে ওটার বাঁট বসিয়ে দিল দ্বিতীয় দস্যুর খুলিতে।

তীব্র আঘাতে ফিরিঙ্গিটা গড়িয়ে পড়ে যেতেই কিরান হাচড়ে পাচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখল মানুষ আর দুই প্রাণির যুদ্ধ ততক্ষণে তুঙ্গে উঠেছে। আড়চোখে দেখল একটা নৌকা এগিয়ে আসছে জাহাজের দিকে। সেই সঙ্গে হট্টগোল বাড়ছে পাড়ের দিকে। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে ও জোরে শিস বাজাল। পাখিটা সরে যেতেই এক দৌড়ে লোকটাকে জাপটে ধরে লাফ দিল পানিতে।

পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটো মানুষ আর একটা বানরকে যেন গিলে নিল নোনা ঠান্ডা পানি। কিরান পানিতে পড়েই ডুব-সাঁতার দিল লোকটার দিকে। খানিকটা সাঁতরে ও চলে এলো মানুষটার পায়ের দিকে। ফিরিঙ্গিটাকে আরেকটু টেনে পানির নিচে নামাতেই ব্যাটা হাতের তলোয়ার ছেড়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। লোকটাকে আরো খানিকটা চেপে রাখতে পারলেই জ্ঞান হারাত কিন্তু দম হারিয়ে কিরানের মনে হলো ও নিজেই জ্ঞান হারাবে। কোনোমতে নিজেকে টেনে পানির ওপরে এনে দম নিতে লাগল ও। স্রোতের ধাক্কায় কিছু দেখতে পাচ্ছে না। পাশ থেকে শক্ত কিছু একটা ওর গলা পেঁচিয়ে ধরে আবারও টেনে নিল পানির নিচে। দস্যুটা চেপে ধরেছে ওকে। কিরান ইচ্ছে করেই পানির নিচে নামার চেষ্টা করল কিন্তু দস্যুটাও যেন নিয়ত করছে ওকে ছাড়বে না। লোকটার শক্ত হাতের চাপে যেন বুকের হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিরান বুঝতে পারছে আর একটু সময় এভাবে চললে জ্ঞান হারাবে। জিতে যাবে লোকটা।

হঠাৎ গলা থেকে লোকটা হাতের চাপ আলগা হয়ে গেল। ক্লান্তি ব্যথা আর পানির টানে টুপ করে ডুবে যেত অর্ধচেতন কিরান কিন্তু শক্ত একজোড়া হাত ওকে টেনে নৌকায় তুলে ফেলল। নৌকায় উঠে কিরানের মনে হতে লাগল অনন্তকাল ধরে যেন শুধু বাতাসই টেনে চলেছে বুকের ভেতরে।

একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে ও দেখতে পেল নৌকার একপাশে বসে নিজের বিরাট দুই হাতে ভিম বেগে বৈঠা চালাচ্ছে গোমেজ। আর ঠিক তার পাশেই বসে একহাতে নিজের ইগলটাকে কিছু একটা খাওয়াচ্ছে বেদু আর তার পাশেই গলুইয়ের ওপরে বসে কলা খাচ্ছে বানরটা। ওকে উঠে বসতে দেখে কিচকিচ করে খুশির শব্দ করল ওটা। কথা বলতে না পারলেও হাতের ইশারায় কিরান জানতে চাইল যে জন্য এত হাঙ্গামা, সে কই?

ইশারায় বেদু নিচের দিকে দেখাল। নৌকার পাটাতনের নিচে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে ব্যাটাকে। আবারও নৌকার রেলিংয়ের সঙ্গে হেলান দিল ও। ক্লান্তিতে চোখ ভেঙে আসতে চাইছে কিন্তু ওকে কথা বলতে হবে ওই দস্যুটার সঙ্গে। ও উঠে বসে বেদুকে ডেকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। ও নিজে নৌকার হাল ধরে বসে রইল। বেদু আর গোমেজকে পাঠাল নৌকার অন্যপাশে দস্যুটার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিরান দিগন্তের দিকে তাকিয়ে দেখল কাপসের হাট অনেক দূরে সরে গিয়ে ছোটো বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। আগুন জ্বলতে থাকা লালচে একটা বিন্দু।

সমস্ত দিন পরিশ্রমের পর যে মানুষগুলো পরিবার-পরিজনের জন্য তার কষ্টে অর্জিত অর্থে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়ে যেত, আনন্দে মশগুল হতো পরিবারের সান্নিধ্যে, বিশ্রাম নিত, ভালোবাসত, স্নেহ-মমতায় ভরিয়ে তুলত জীবন, একদল দানবের থাবায় সেই সহজ-সরল মানুষগুলো আর কোনোদিন ফিরে যাবে না পরিবারের কাছে। অপেক্ষা করতে করতে একসময় পরিবারের লোকেরাও হয়তো ভুলে যাবে তাদের। কোনো এক অলস দুপুরে হয়তো কোনো গাঁয়ের বধূ মনে করবে তার হারানো স্বামীর কথা। মাঝ রাত্রিতে নিজের স্নেহময় সন্তানের কথা মনে করে হয়তো কোনো মায়ের ঘুম ভেঙে যাবে। যে সন্তানকে সে ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়ে ভরিয়ে তুলতে চাইবে। কিন্তু সেই সন্তান হয়তো তখন দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে গেছে অজানা-অচেনা কোনো বাজারে। গায়ের বধূ যখন মনে করবে তার হারানো স্বামীর কথা সে তখন হয়তো নিজের সাধ্যের চেয়ে অনেক বেশি শ্রম দিচ্ছে আরাকানের কোনো ফসলের মাঠে-বিনা আপনজনে, আপনজনের ভালোবাসা, সেবা-যত্ন ছাড়াই সেখানে হয়তো পরিজনবিহীন পরিবেশে মৃত্যু হবে তার। আর এ-জন্য দায়ী থাকবে স্রেফ কিছু দানবের লালসা।

নিজের ভাবনার জগতে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে বসেছিল কিরান। কিন্তু হঠাৎ বেদু ফিরে এলো। তার চেহারা দেখেই কিরান বুঝল খারাপ কোনো খবর আছে। ‘কী ব্যাপার?’

‘চুকচুক,’ মুখ দিয়ে বিশেষ শব্দ করে ইগলটাকে উড়িয়ে দিল বেদু। ‘ওস্তাদ, ব্যাটা বহুত ঘেড়েল মাল। প্রথমে কিছু বলবেই না। তারপর টানা কয়েকবার

গেমেজের হাতের শক্ত মার খেয়ে কথা বলেছে। ওর কাছে বহুত খবর আছে। সব বাইর করা যায় নাই।’

‘এ-জন্যই এত ঝুঁকি নিয়েও ওকে ধরে এনেছি। কারণ এদের কাছে সিলভেরার ব্যাপারে তথ্য থাকতে বাধ্য। রাতে জাহাজ ছাড়ার পর ওকে শক্ত করে ধরব।’

‘কিন্তু এখন বিশেষ একটা খবর আছে,’ বলে বেদু একটু থেমে যোগ করল। ‘ওরা কাপসের বাজারে হামলা চালাইতে আসে নাই। ওরা দুইটা জাহাজে কইরা একটা বিশেষ জায়গাতে যাইতেছিল। এর মধ্যে একটা জাহাজের কাপ্তান কাপসের বাজারের ধোঁয়া দেইখা এদিকে আসে। এইডা আসলে অগো মূল পরিকল্পনায় আছিল না।’

‘ওরা যাইতাছিল কই?’ কিরান চিন্তিত মুখে জানতে চাইল।

‘দাঁড়াও দেহাই,’ বলে বেদু হাতের খড়ি দিয়ে নৌকার পাটাতনে একটা ম্যাপের মতো এঁকে দেখাল। ওরা রওনা দিয়েছে সন্দ্বীপ থাইকা। এটা হইলো কাপসের বাজার। আর ওরা যাইতেছিল এহনে,’ বলে সে ছোটো একটা বিন্দু দেখাল। ‘জাগাডার নাম নুনের ভিটা।’

‘কী আছে ওইখানে?’

‘ওইখানে ওরা যাইতাছিল একজন মানুষরে ধইরা আনতে,’ বলে বেদু থেমে কিরানের দিকে তাকিয়ে যোগ করল, ‘গোলন্দাজ রঙ্গন।’

কিরানের মনে হলো ওর শরীরে সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে। ‘তাইলে তাইলে,’ ওর মুখ দিয়ে কথা সরছে না।

‘ওই ব্যাটার কথায় যা বুঝলাম,’ বলে সে নৌকার অন্যদিকে থাকা ফিরিঙ্গিটাকে দেখাল। ‘সিলভেরার সরাসরি নির্দেশে না হলেও তারই কোনো লোকের নির্দেশে বিশেষ অভিযানে নামার আগে ওগোর খুব ভালা কিছু কামাঞ্চি দরকার ছিল। আর সে-জন্যই গোলন্দাজরে ধইরা আনতে ওরা অইদিকে…

‘তারমানে সিলভেরার খবরডা ভুয়া না,’ কিরানের দৃষ্টি পাথরের মতো স্থির। ‘তারমানে ওরাও আমগো মতোই অভিযানে নামতাছে। কিন্তু অভিযান পরে। আগে গোলন্দাজরে বাঁচাইতে হবে,’ বলে সে বেদুর দিকে ফিরে তাকিয়ে জানতে চাইল ‘তুই চিনোস জায়গাডা? যেহানে ও থাহে পরিবারসহ? যেকোনো উপায়ে কি এহান থাইকা জলদি যাওয়া সম্ভব?’

‘চিনি কিন্তু অগো আগে তো ওইহানে পৌঁছানো মনে অয় না সম্ভব অইবো,’ বেদু মনে মনে হিসেব করছে। ‘একটা রাস্তা আছে। ওরা তো বড়ো জাহাজ নিয়া যাইতাছে গতি বেশি হইলেও ওগো ঘুরা পথে যাইতে অইবো। কিন্তু আমরা নৌকা নিয়া যদি…’

বেদুকে কথা শেষ করতে দিল না কিরান। ‘ওইটাই ধর। আগে গোলন্দাজরে বাঁচাইতে হবে। আগে কী হইছিলো সেইটা বিষয় না, ওরে বাঁচানো আমাগো দায়িত্ব,’ বলে সে নৌকার হালটা বেদুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিল। ‘যেহান দিয়া কম সময়ে যাওয়া যাবে, ওইদিক দিয়াই চল।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *