মগরাজ – ১৫

অধ্যায় পনেরো – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

কাপসের হাট, দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকা, চট্টগ্রাম

কিরানদের নৌকো কাপসের হাটের কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে কিরানের চোখে পড়ল বাজারের ঠিক কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট বটগাছটার ছড়ানো ডালপালা। যদিও প্রায় মাইলখানেক দূর থেকে বাজারের ভিড় কিংবা বটগাছের নিচে জমে ওঠা মানুষের জমায়েত চোখে পড়ার কথা না। কিন্তু বাজারের সেই পুরনো পরিচিত চেহারা চোখে পড়তেই কিরানের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মৃদু হাসি।

বাজার ঘাট আর পানির বুকে বেড়ে ওঠা মানুষ সে। মানুষের মাঝে, মানুষের সান্নিধ্যেই জীবনের প্রকৃত সুখ খুঁজে পায়। কিন্তু গেল কয়েক বছরের পরিবর্তিত জীবনে নিজেকে যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলতে বসেছিল। আকরাম বেগের মাধ্যমে এই কঠিনতম কাজের দায়িত্ব ঘাড়ের ওপরে চেপে বসাতে একদিকে যেমন ভয়-ভীতি আর কাজের বোঝা টের পাচ্ছে নিজের ওপরে, সেই সঙ্গে কোথায় যেন নিজের ভেতরের পুরনো সত্তাকে সে আবিষ্কার করতে পারছে আবারও। নিজেকে নিজের কাছেই আবার সেই পুরনো মানুষ মনে ওর যাকে সে গেল কয়েক বছরের ডামাডোলে পুরোপুরিই হারিয়ে ফেলতে বসেছিল।

‘ইয়ানে নৌকা বিড়াইতাম নি?’ কিরানের পাশ থেকে বিল্লাল জানতে চাইল। কিরান তার দিকে ফিরে তাকাল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে একবার দেখে নিল নৌকার একপাশে চাদর মুড়ি দিয়ে ঝিমোচ্ছে গোমেজ আর তার পাশেই নিজের ছেলের ঘুমন্ত হাত ধরে বসে আছে বৈঠা।

‘নৌকা এইখানে ভিড়াইবো নি?’ বিল্লালের প্রশ্নটাই সে ছুড়ে দিল বৈঠাকে লক্ষ করে।

নিজের ছেলের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বৈঠা নিজের ডান হাতের আঙুলটা ভরে দিল মুখের ভেতরে। তারপর ভেজা আঙুলটা তুলে ধরল মাথার ওপরে। বাতাসের গতি বুঝে নিয়ে সে বিল্লালকে ঘাটের একপাশে নৌকা ভেড়াতে ইশারা করল। বিল্লাল সর্দার নৌকোটাকে সেই অনুযায়ী এগিয়ে নিয়ে যাবে পাশ থেকে তার একটা হাত চেপে ধরল কিরান।

‘বিলু,’ সে নজরদারির চোখে পরখ করার চেষ্টা করছে চারপাশ। ‘বাজারের পাশ্চিম পাশে একটা খাল আছে না, যেইডা দিয়া ভেতরে ঢুইকা গেলে এক্কেরে সরাসরি বাজারের ভেতরে যাওয়া যায়?’ মনে মনে সে কাপসের হাটের নকশাটা মনে করার চেষ্টা করছে।

‘আছে,’ বলে বিল্লাল হেসে উঠল। ‘ওস্তাদে কি নাও বান্দুনের পয়সা বাঁচাইবার লাইগা উতলা অইলা নি?’ সে টিটকিরি মেরে জানতে চাইছে ঘাটে নৌকা বেঁধে রাখতে হলে যে আনা পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয় সেটা বাঁচানোর জন্য কিরান কি এই পন্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে নাকি?

বিল্লালের টিটকিরির জবাবে তার দিকে আগুন চোখ করে তাকাল কিরান। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঢোক গিলে হাত তুলে কিরান যা বলছে সে তাই করবে বলে সে কিরানকে আশ্বস্ত করল। ওদের দুজনের নীরব কথোপকথন দেখে বৈঠা মুচকি হেসে উঠল পেছন থেকে।

বিল্লাল সর্দারকে আর দ্বিতীয়বার বলতে হলো না। সে নৌকোটাকে সুন্দর- মতো ঘুরিয়ে ঘাট পার হয়ে খোলা পানিতে চলে এলো অনেকদূর। তারপর সেটাকে পানির গতি অনুযায়ী সরু খালের মতো একটা পানির ধারা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে গেল। সেদিক দিয়ে ঘুরে বাজারের পেছন দিকে চলে এলো ওরা। সেখানে এখানে- ওখানে ভাসমান ময়লার ফাঁক দিয়ে সে দক্ষ হাতে বৈঠা মেরে নৌকোটাকে নিয়ে এলো একেবারে বাজারের পেছন দিকে।

বিল্লাল সাবধানে নৌকোটাকে একপাশে ভেড়াতেই কিরান বাকিদেরকে নামার ইশারা করে নিজে লাফিয়ে নেমে এলো হাঁটু পানিতে। পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে কিনারায় উঠে এসে শরীরটাকে টানটান করে আড়মোড়া ভাঙল। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় নৌকায় স্থির বসে থাকার কারণে শরীরে মনে হচ্ছে সব গিট্টু লেগে গেছে।

বেলা এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে রওনা দিয়েছে। দুপুরের দিকে খণ্ডালের গুহাতে যাওয়ার আগেই বিল্লাল সর্দার আর বৈঠাকে ও লাগিয়ে দিয়েছিল বেদুর খোঁজ বের করার জন্য। কারণ যে অভিযানে ওরা নামতে যাচ্ছে তাতে করে বেদুর মতো দক্ষ একজন বাজিকর ওর দরকার হবে। এছাড়াও বেদুর আলাদা আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলোর জন্য বেদু অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। এর আগে কিরানের দলে সে বহু বছর হয় কাজ করেছে। আরেকটা কারণে বেদুকে ওর দরকার। ওর দলের সবচেয়ে দক্ষ গোলন্দাজ রঙ্গনের খোঁজ

বের করার জন্য হলেও বেদুকে ওর দরকার। দল ভাঙার পর গোলন্দাজের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়াতে কিরান আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। তাই সে কোথায় আছে জানতে হলে বেদুকে দরকার ওর।

খণ্ডালের গুহাতে পট্টবর্ধন আর তুলারামের লোকদের রাতে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে কিরান আর গোমেজ যখন মন্দারহাটে পৌছে দেখে ইতোমধ্যেই বেদুর খবর নিয়ে বিল্লাল আর বৈঠা ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে বিল্লালের কাছ থেকেই জানতে পারে বেদু এখন হাটে-হাটে বাজিকরের খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। তার নিজের কিছু পোষা প্রাণি আছে আর সেই সঙ্গে আছে ছোটো একটা দল। সেই দলটাকে নিয়ে আজ বিকেলে কাপসের হাটে খেলা দেখানোর কথা।

বিল্লাল সর্দারের মুখে প্রাণিদের কথা শুনে কিরাণের মুখে অদ্ভুত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বিল্লাল আরো জানায়, বেদুর এই খেলা দেখানোর ব্যাপারটা ইদানীং বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে বৃহত্তর এলাকায়।

এরপর মন্দার হাটেই ওরা দুপুরে খাওয়া সেরে খানিক বিশ্রাম নিয়ে একটা নৌকা ভাড়া করে মন্দার হাট থেকে রওনা দেয় কাপসের হাটের উদ্দেশে।

তবে কাপসের হাটে এসে একটু অবাক হয়ে গেল কিরান। এখন থেকে পাঁচ বছর আগে সে শেষবারের মতো এসেছিল এই হাটে, তখন এই হাটের সবে গোড়াপত্তন হয়েছিল কিন্তু একটা বিশেষ কারণে অল্প সময়ের ভেতরেই এই হাট অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। আর সেই কারণটা ছিল কাপস নামের বিশেষ এক ধরনের তুলা। এই হাটের নাম কাপসের হাট হওয়ার পেছনেও এই তুলারই মূল অবদান। বাঙ্গাল মুল্লকে যতগুলো উৎকৃষ্ট উপাদান তৈরি হয় তার মধ্যে অন্যতম এই এলাকার বস্ত্র। মসলিনের ব্যাপারটা বাদ দিলেও আরো নানা ধরনের বস্ত্র রয়েছে যা অত্যন্ত উন্নতমানের এবং রোসাঙ্গ, আরাকান, ত্রিপুরা থেকে শুরু করে হুগলি এমনকি দিল্লির বাজার পর্যন্ত এসব বস্ত্রের সীমাহীন চাহিদা। এ-কথা সবাই জানে। কিন্তু যে-কথাটা বেশিরভাগ মানুষই জানে না সেটা হলো শুধু বস্ত্রই নয় বরং বাঙ্গাল মুলুকের বিশেষ ধরনের তুলার চাহিদাও সুদূর আরব দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। আর বাঙ্গাল মুল্লকে যত ধরনের উন্নত তুলা থেকে সুতা তৈরি হয় তারমধ্যে সবচেয়ে সহজলভ্য এবং কম খরচের একটি হলো কাপস তুলা। আর সেই তুলা বেচা-কেনার জন্যই এই হাট। আর সে-থেকেই এর নাম কাপসের হাট।

রামু আর লাউক্কার বিশেষ সংযোগস্থলে পানি বিধৌত এক ছোটো দ্বীপে হাটটার অবস্থান হওয়ার কারণে এই হাট খুব অল্প সময়ে আর খুব সহজেই সব ধরনের ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। আজ পাঁচ বছর পর এখানে এসে কিরান ভেবেছিল দেখবে হাট আরো বড়ো হয়েছে, সেই সঙ্গে লোক সমাগম থেকে শুরু করে সবকিছুই আরো বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু এখানে এসে যা দেখল তাতে পরিষ্কার যে, হাটের বেশ দৈন্য দশা চলছে।

‘কীরে বিল্লাল, এই হাটের এমন অবস্থা ক্যান?’ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে জানতে চাইল কিরান।

কিন্তু তার প্রশ্নের জবাবটা দিল বৈঠা। ‘হাম্মাদ ওস্তাদ,’ বলে সে আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘খালি এইয়া না, এই এলাকার সব হাট থেইকা শুরু কইরা যেন যা আছে এমনকি গ্রামকে গ্রামে এহন খালি ওই গেছে হাম্মাদগো ডরে। ওরা যেয়ানে যায় জিনিসপত্র সয়-সম্পদ তো বাদ যাক, মানুষ পর্যন্ত ছাড়ে না। যেয়ানে যারে পায় ধইরা লইয়া যায়।’

‘এহন তো হেরা আর জিনিসপত্র, টেকা লুডও করে না। এহন হেগো নজর খালি মাইনষের দিকে। উপকূল এলাকা থাইক্কা ঝাড়কে ঝাড় মানুষ ধইরা ল‍ই যাইতাছে। আমগো এয়ানে গ্রামকে গ্রাম খালি অইতাছে, হাটের পর হাট খালি অইতাছে অর এই মানুষগো নিয়া হেরা রোসাঙ্গের খালি ভূমি আবাদ করতাছে। হুগলির বাজারে চড়া দামে বেচতাছে মানুষগুলারে,’ বলে জোরে ফুঁ দিয় শূন্যে যেন নিজের সব আফসোস উড়িয়ে দিল বিল্লাল। ‘ভাবতে পার ওস্তাদ, বিদেশ থেইকা জানোয়ারের বাচ্চারা আইসা আমাগো মানুষগো নিয়া পশুর মতো বাজারে বেচতাছে। মুসলমান, ব্রাহ্মণ, ফকিররে একই লগে একই দড়ি দিয়া বাইন্দা হাটে তুলতাছে…’

কিরান একটা হাত তুলল। এসব ব্যাপার এমনিতেই সে মেনে নিতে পারে না। কেন জানি এসব অনাচারের কথা শুনলে নিজেকে খানিকটা হলেও দোষী মনে হয় ওর। আজ থেকে কয়েক বছর আগে ওদের বাহিনী যদি ওভাবে হেরে না যেত তবে হয়তো দক্ষিণ উপকূলের অবস্থা এতটা খারাপ হতো না।

‘শোন, আমি বৈঠা আর বিল্লালরে নিয়া বাজারে ঢুকতাসি,’ বলে সে গোমেজ আর বৈঠার ছেলেকে দেখাল। ‘তোরা দুইজন এইহানেই থাকবি। সাবধানে থাকবি, নজর রাখবি আর কোনো বিপদ অইলে লুকায়া পড়বি। মনে থাকব?

গোমেজ মাথা নেড়ে বোঝাল সে বুঝতে পেরেছে। কিরানের কথা শেষ হতেই সে বৈঠার ছেলের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। ছেলেটাও তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। কিরান বুঝল এদের দুজনের ভেতরে আলাদা একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করেছে।

কিরান বৈঠা আর বিল্লালকে ইশারা করল ওর সঙ্গে এগোনোর জন্য। ও ইচ্ছে করেই পেছন দিয়ে এসেছে। কারণ এসব খোলা বাজারে বিপদের কোনো আগা- মাথা নেই। আর যেকোনো সময় বিপদ হানা দিলেই যাতে চট করে সরে পড়া যায় সে কারণেই এই ব্যবস্থা। ঠিক একই কারণে সে গোমেজকে সঙ্গে আনেনি কারণ গোমেজকে নিয়ে এলে খুব সহজেই অনেকের চোখে পড়ে যাবে। সেই সঙ্গে খবর চাউর হতে দেরি লাগবে না। আর যে কয়েকটা কারণে ও আজ এই বাজারে এসেছে সেগুলোকে সফল করতে হলে ওকে যতটা সম্ভব কম লোকের চোখে পড়তে হবে।

বৈঠা আর বিল্লালকে নিয়ে বাজারের পথে পা বাড়াল কিরান। খালপাড়ে থাকা আস্তাবল পার হয়ে ওরা চলে এলো সারি সারি তুলা আর সুতার গুদাম এলাকায়। সেখান থেকে ওরা কোনাকুনি এগুলো মূল হাটের দিকে। কাপসের মূল বাজার এলাকাটা গড়ে উঠেছে দ্বীপের মতো জায়গাটার ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত বিরাট বট গাছটাকে কেন্দ্র করে। বিশাল বট গাছটাকে কেন্দ্রে রেখে গোল করে ছোটো ছোটো দোকানের মতো অস্থায়ী জায়গাতে বসে নানা ধরনের তুলার পাইকারি হাট। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যাপারিরা কেনাকাটা করে। তারপর নিজেদের নৌকো আর জাহাজে করে সেগুলো নিয়ে রওয়ানা দেয় বিভিন্ন দিকে।

বাজারের সারি সারি তুলার দোকানের বেশিরভাগই এখন খালি পড়ে আছে। কারণটাও সহজেই অনুমেয়, দিন প্রায় শেষ হতে চলেছে। একেবারে ভোর থেকে শুরু হওয়া হাটে সারা দিনের কেনা-বেচার পর এই সময়টা হাট প্রায় বন্ধ হওয়ার সময়। ঠিক একারণেই দোকান-পাট কিংবা গুদামের চেয়ে হাটের বেশিরভাগ মানুষের মনোযোগ এখন হাটের কেন্দ্রে থাকা বটগাছটার নিচে যেখানে বেদু তার নানাবিধ পশুপাখি নিয়ে জমিয়ে তুলেছে খেলা।

বটগাছটাকে দূর থেকে দেখে বৈঠা আর বিল্লালকে সেদিকে এগোনোর নির্দেশ দিল কিরান। আর ওর নির্দেশ শুনে দুজনেই আনন্দের সঙ্গে এগিয়ে গেল সেদিকে। কিরান বাজারের এক কোনায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকে পুরো বাজারটাই চোখে পড়ে।

বাজারের একদিকে দাঁড়িয়ে কোমরে রাখা থলে থেকে একটা ছোটো বাক্স বের করে সেটার ভেতর থেকে খানিকটা তামাক বের করে গোল করে পাকাতে পাকাতে

বাজারের চারপাশে নজর বোলাতে লাগল। পুরো বাজার এখন বলতে গেলে শেষ বিকেলের ঢিলেমিতে আক্রান্ত। শেষ বিকেলের আয়েশি সময়ে এখন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী-ব্যাপারি আর জোতদারদের বেচাকেনার চেয়ে বরং আড্ডা আর বট গাছের নিচে খেলা দেখায় ব্যস্ত। কিরান খেয়াল করে দেখল যারা বটগাছের নিচে খেলা দেখছে তারা তো আছেই। বাকিরাও গোল করে বসে আয়েশ করে তামাক টানায় ব্যস্ত আর না হয় পাশা খেলার দান সাজাচ্ছে।

কিরান বাজারের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে ঘাটের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। সেখানে বিশেষ কিছু একটা ওর নজর কেড়ে নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ তাকিয়ে সে কিছু দেখতে পেল না। ওদিকে খানিকটা এগিয়ে আরো ভালোভাবে দেখবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই বটগাছের নিচ থেকে ভেসে আসা বাঘের গর্জনে চমকে উঠল সে। সেই সঙ্গে মুখে আবারও পুরনো হাসিটা ফুটে উঠল ওর। ঘাটের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে বটগাছের গোড়ার দিকে তাকাল। হাতের মুঠোয় দলা পাকানো তামাকটা আবারও কোমরের চামড়ার থলিতে রেখে দ্রুত পায়ে এগোল বটগাছের গোড়ার দিকে।

বেদুর দেখানো খেলা আগেও দেখেছে কিরান। কারণ বহু বছর বেদু তার অধীনেই কাজ করেছে। কিন্তু আজ এখানে আসার আগে লোকমুখে সে যা শুনেছে তাতে সত্যিই আশ্চর্য হয়েছে সে। বট গাছের গোড়া অব্দি পৌছাতে পৌছাতে ভিড়ের ভেতরে হাততালির শব্দ ফেটে পড়ল। লোকজনকে ঠেলেঠুলে ভিড়ের শেষ মাথায় পৌঁছাতে তার চোখে পড়ল কালো রঙের একটা ঝলকের মতো এপাশ থেকে ওপাশে কী যেন নেচে বেড়াচ্ছে।

পাকানো দড়ির মতো পেশির অপূর্ব সমাহারে কুচকুচে কালো যে মানবদেহটা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো বটগাছের গোড়াকে কেন্দ্র করে এদিক থেকে সেদিকে ঝলসে উঠছে সেটা যে একজন মানুষ সেটা বুঝতে হলে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করতে হবে পুরো ব্যাপারটা। ভিড়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে সেটাই করার চেষ্টা করল কিরান।

গোল হয়ে দাঁড়ানো ভিড়টাকে বাদ দিলে ভিড়ের কেন্দ্রে ফাঁকা জায়গাতে মোট তিনটি প্রাণির অস্তিত্ব আছে। কিরান জানে আশপাশে বা ওপরে আরো একটা আছে। কিন্তু এইমুহূর্তে মাটির বুকে যে খেলা জমে উঠেছে তিনটি প্রাণির ভেতরে সেটাতে মনোযোগ দেওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো ওর কাছে। তিনটি প্রাণির ভেতরে প্রথমেই খুব স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টি কেড়ে নেয় হলুদ রঙের রাজকীয় প্রাণিটা যাকে সুন্দরবনের রাজা নামে চেনে সবাই। এই মহূর্তে সে বটগাছের শিকড়ের কাছটাতে শরীরটাকে বাঁকা করে লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে আছে তার সামনে অবস্থিত বাকি দুটো দুষ্টু প্রাণিকে শায়েস্তা করার জন্যে। দ্বিতীয় প্রাণিটি অবশ্য মাটিতে অবস্থান করছে না। সে তার লম্বা লেজটা দিয়ে বটগাছ থেকে নেমে আসা একটা মোটা লতা আঁকড়ে ধরে একবার বাঘটাকে দেখে আরেকবার তার থেকে অদূরেই মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখছে। দেখতে দেখতেই সে খোপ ধরে থাকা বাঘটার উদ্দেশে নিজের দাঁত বের করে আরেকবার ভেংচে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাজ পড়ার মতো শব্দ করে রাগের সঙ্গে গর্জন করে উঠল বাঘটা।

অন্যদিকে বাঘের গর্জন শুনে হাসি মুখে ধমকে উঠল যে তৃতীয় প্রাণিটি সেই আসলে মঞ্চে উপবিষ্ট এই নাটকের মূল পরিচালক। তৃতীয় প্রাণিটিকে অবশ্য স্বাভাবিক জ্ঞানে মানুষ বলেই অবিহিত করা উচিত। কিন্তু তার শারীরিক গঠন আর অস্বাভাবিক সাহস তাকে আর দশটা মানুষের কাতার থেকে ওপরে তুলবে নাকি নিচে নামাবে সেটা ভাববার বিষয়। এই মানুষটার নামই বেদু, কিরান যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

পাকানো নারকেলেরর লতার মতো পেশিবহুল শরীরটা একেবারেই উদোম, পরনে শুধু একটা গেরুয়া রঙের ধুতি। সেটাও আবার এমনভাবে পেঁচিয়ে শক্ত করে পরা হয়েছে যে সেটাকে ধুতি কাম ল্যাঙট বেশি বলা উচিত। গাছের শিকড়ের মতো মোটা পায়ে লোহার বালা, মাথায় নিশানের মতো সাদা কাপড় আর দুই হাতে পরা চামড়ার মোটা দস্তানায় তাকে মানুষ কম দৈত্য বেশি মনে হচ্ছে। তবে তার অবয়বের ভেতরে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে তার এক হাতে ধরা কালো রঙের লোহা কাঠ দিয়ে বানানো একটা মুগুর, যেটাকে সে তাক করে আছে বাঘটার দিকে।

কিরান বেদুকে ভালোভাবে লক্ষ করতে করতে বুঝতে পারল যে, সে বানর, বাঘ আর নিজেকে নিয়ে একটা নাটক সাজিয়েছে যেখানে এই বানর আর বাঘ হলো স্রেফ পাত্র-পাত্রী আর সে নিজে হলো একাধারে পরিচালক ও নায়ক। আর এই মুহূর্তে এই নাটকের শেষ দৃশ্য মঞ্চস্থ হতে চলেছে। বাঁদরটা বাঘটাকে ভেংচে দিতেই বাঘটা রাগের সঙ্গে গর্জন করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাতের মুগুর তুলে বেদু ধমকে উঠল ওটাকে। লাফ দিতে গিয়েও বাঘটা যেন থমকে গেল খানিকটা। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো বেদু এগিয়ে গেল খানিকটা সামনের দিকে। তাকে হঠাৎ এভাবে এগোতে দেখে বানর আর বাঘ দুজনেই যেন খানিকটা থমকে গেল। বাঘটা আবারও নড়ে উঠেও থেমে গেল। কিন্তু লতা ধরে ঝুলতে থাকা বাঁদরটা বাঘের এই থেমে যাওয়া দেখে যেন আরো সাহসী হয়ে উঠল। সে আবারও জিভ বের করে ভেংচে দিল বাঘটাকে। সঙ্গে সঙ্গে তালির সঙ্গে হেসে উঠল জনতা যা মোটেও ভালোভাবে নিল না বাঘটা। রাগের সঙ্গে গড় গড় করে সে লাফ দিল বাঁদরটাকে ধরার জন্য। কিন্তু বাঁদরটাও কম ক্ষিপ্র নয়, বাঘটাকে এগোতে দেখেই সে ল্যাঙচি মেরে সরে পড়তে লাগল।

এতে বাঘটা আরো খেপে উঠল। সে আবারও লাফ দিয়ে বাঁদরটার লাফাতে থাকা একটা লতার কিনারা ধরে ফেলল। গাছের দুলুনিতে বাঘ কি আর বাঁদরের সঙ্গে পারে? কিন্তু লতার দুলুনিতে বাঁদরটা ব্যালেন্স হারিয়ে পড়তে লাগল নিচের দিকে। খুশির সঙ্গে গর্জন করে উঠল বাঘ। সে বাঁদরটাকে ধরার জন্য লাফ দেবে কিন্তু তার আগেই মৃদু একটা তীক্ষ্ণ শিসের শব্দের সঙ্গে শূন্য থেকে উদয় হলো একটা ইগল। বাঘটা বাঁদরটাকে ধরার জন্য লাফ দেওয়ার আগেই ওটা নিচু হয়ে অপ্রস্তুত বাঘটার মুখে সামান্য খামচির মতো দিয়ে যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল তেমনি ঝড়ের বেগেই শূন্যে উঠে গেল। ইগলের আগমনে উত্তেজনা আর আনন্দে ফেটে পড়ল জনতা, কিন্তু রাগের সঙ্গে গর্জন করে উঠল বাঘটা। বাঁদর আর পাখি দুটোই গেছে, নিজেকে সামলে নিয়ে সে সামনে দেখতে পেল একমাত্র দু-পেয়ে মানুষটাকে। ওটার দিকেই ঝড়ের বেগে এগিয়ে গেল সে। বাঘটাকে ছুটে আসতে দেখে বেদু হাতে ধরা মুগুরটাকে উঁচু করল কিন্তু এই মুগুর ওরকম একটা বাঘের জন্য পলকা কাঠির চেয়ে বেশি কিছু না। বাঘটা এগিয়ে আসছে, প্রায় ধরে ফেলবে মানুষটাকে, সবাই ভাবছে বেদু হয়তো মুগুর দিয়ে বাঘটাকে আঘাত করবে, কিন্তু তা না। বাঘটা তাকে ধরার ঠিক আগ মুহূর্তে লাফিয়ে সে বটগাছের একটা মোটা লতা ধরে ফেলল। প্রায় বাঁদরের মতোই ক্ষিপ্রতায় ওপরে উঠতে শুরু করল ওটা বেয়ে। শিকার ফসকে যেতেই বাঘ ওপরে লাফ দিল কিন্তু শিকার নাগালে বাইরে। তবে বেদুর কপাল খারাপ, সে আরেকটু উঠতেই হাত ফসকে সোজা বাঘটার গায়ের ওপরে এসে পড়ল। উত্তেজনা আনন্দ আর ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সবাই। কিন্তু একটু হুটোপুটির পর ধুলো সরে যেতেই তারা দেখতে পেল হলদে বাঘের পিঠের ওপরে রাজার মতো বসে আছে এক মানবসন্তান। তার দুই হাত দুই দিকে ছড়ানো। নিখাদ প্রশংসা আর করতালিতে ফেটে পড়ল জনতা।

কিরান সরে এলো। ভিড়ের ভেতর থেকে এখন ওখানে কী হবে খুব ভালো করেই জানে ও। বাঁদর, ইগল আর বাঘটাকে নিয়ে আরো কিছুক্ষণ চক্কর কাটবে বেদু। তারপর সে আর তার সহযোগী অর্থ সংগ্রহ করবে ভিড়ের ভেতর থেকে।

কিরান ভিড়ের কাছ থেকে সরে এলো বাজারের সারি সারি দোকানগুলোর দিকে একটু আগে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে সে ঘাটের দিকে কিছু একটা চোখে পড়েছিল ওর। ঠিক কী চোখে পড়েছিল সেটা মনে করতে পারল না সে। বরং চামড়ার থলে থেকে আবারও তামাকটা বের করে আনল সে। এক হাতে নিয়ে ওটাকে দলা পাকাতে শুরু করবে তার আগেই পেছন থেকে ভারী একটা গলা শুনে খানিকটা চমকে উঠল সে।

‘ওই জিনিসটার ঠিক ব্যবহারের জইন্যে তুমার একটা ভালো হুক্কা লাগব,’ কিরান পেছন থেকে ভেসে আসা ভারী গলাটা, দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল বেদু হাসি মুখে হাতে একটা ছোটো হুকো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও ফিরে তাকাতেই হুকোটা সে ছুঁড়ে দিল ওর দিকে। জিনিসটা হাতে নিয়ে তামাক না সাজিয়ে বরং বেদুর দিকে এগিয়ে গেল কিরান। ও কাছে যেতেই ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে ফেলল বেদু।

‘ওস্তাদ, কতদিন পরে তুমারে দেখলাম,’ বলে সে আবারও শূন্যে তুলে ফেলল সে কিরানকে। ‘তুমার ওজন কমপক্ষে পনরো-বিশ কেজি বাইড়া গেছে,’ বলে সে হেসে উঠল আবারও।

‘তাতে কী!’ বলে বেদুর হাত ছেড়ে দিয়ে সে ওর কাঁধ আর হাতের পেশিতে হাত বুলাল। ‘আমি মোটা অই গেলে কী হবো তুই তো আগের চায়া আরো অনেক বেশি শক্ত হয়া গেছোস,’ বলে সে জোরে হেসে উঠে যোগ করল, যদিও তোর গায়ের বদ গন্ধটা আগের মতোই আছে।’

‘হা-হা,’ করে জোরে হেসে উঠল বেদু। আগের চেয়ে আরো জোরে হেসে উঠল সে। ‘জীবনে আমার লগে কেউই বল্লম চালায়া পারে নাই ওস্তাদ একমাত্র তুমি ছাড়া। তুমি এই কথা কইলে হবে! আসো, তোমারে পরিচয় করায়া দিই,’ বলে সে কিরানকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এলো বটগাছের গোড়ার কাছে যেখানে গিয়ে দেখল বাঘটাকে শিকল পরিয়ে একটা লোহার খাঁচায় ঢোকানো হয়েছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছোটো একটা ছেলে।

‘ও অইলো মতি,’ ছেলেটাকে দেখিয়ে বেদু বলে উঠল। ‘এই ব্যাটা এনি আমার ওস্তাদ, তারে সালাম কর।’ বেদু বলতেই ছেলেটা দৌড়ে এসে প্রায় ওর পায়ের ওপরে এসে পড়ল।

‘এই থাক থাক,’ কিরান প্রায় চমকে গেছে ছেলেটার আচরণে।

‘আরে সালাম করছে দেইহা ভাইবো না ও ভালা। বহুত বদ পোলা,’ বলে সে ছেলেটাকে টেনে তুলে স্নেহ ভরে তার চুল এলো করে দিল। ‘আর এই দেহো,’ বলে সে খাঁচার দিকে দেখাল। ‘ও অইলো সুলেমান,’ বাঘটাকে দেখাল। ওরে এইটুক থাকতে কিনছিলাম হুগলির বাজার থনে। এইটা কিচাক,’ বলে সে মতিকে ইশারা করতেই খাঁচার ওপর থেকে লাফিয়ে মতির কাঁধ গিয়ে বসল বানরটা। কী বুঝল কে জানে। কিরানকে উদ্দেশ্য করে জিভ দেখিয়ে দিল সে। কিরান হেসে উঠল।

‘তোর পরিবার তো দেখি….

‘আছে শেষ অয় নাই তো,’ বলেই সে জোরে শিস বাজাতেই শূন্য থেকে উদয় হলো বিরাট একটা চিল। ওদের মাথার ওপরে একটা পাক খেয়ে বেদুর দস্তানা পরা হাতের ওপরে এসে বসে পড়ল। ‘ও অইলো শায়ক, শায়ক মানে জানো তো ওস্তাদ, তির। এই ব্যাটা সবসময় তিরের মতোনই উড়তে উড়তে নিশানার ওপরে ঝাঁপায়া পড়ে। ধইরা দেহো,’ বলে মৃদু হেসে উঠল বেদু। ‘হ ওস্তাদ, এহন ওরাই আমার পরিবার।’

‘আমিও পরিচয় করায়া দিতাছি,’ বলে সে পায়ে পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসা বৈঠা আর বিল্লালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। ওদের দুজনকে দেখে বেদু একটু অবাক হলো। ‘ওস্তাদ কি কোনো কামে আসছো নাকি?’

‘তুই কি কিছু শুনেছিস আমার ব্যাপারে?’ প্রশ্নটা করার সময়ে একটু সরু চোখে তাকাল সে, সেই সঙ্গে একবার দেখে নিল বৈঠা আর বিল্লালকে।

বেদুও প্রায় একইরকম সরু চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ‘কুন ব্যাপারে ওস্তাদ?’

‘আচ্ছা, তার মানে তোর কানে এহনো কিছু আসে নাই,’ বলে সে বেদুকে ইশারা করল। ‘তোর লগে কথা আছে। নির্জনে বইসা বলা যাবে?’

‘যাবে,’ বলে সে মতিকে ইশারা করল প্রাণিগুলোকে নিয়ে নৌকায় ওঠাতে।

‘ও পারবে এগুলারে নিয়া যাইতে একলা?’

‘নাহ, আরো লোক আছে,’ বলে বেদু ইশারা করল।

‘শোন, তোর নৌকা কি ঘাটে বান্ধা?’ বেদু হ্যাঁ-সূচক ইশারা করতেই কিরান বলে উঠল। ‘এক কাম কর, হাটের পিছে খালের দিকে আমগো নাও বান্ধা। তোরডাও অইহানেই নিয়া রাখতে ক।

বেদু কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করল তারপর কিছু না বলে মতিকে ডেকে বুঝিয়ে দিল ব্যাপারটা। কিরানও বৈঠা আর বিল্লালকে নৌকায় গিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। আর ওরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো নদীর কিনারায় হাটের একপাশে নির্জনে।

ওখানে একটা গাছের নিচে বসতেই এতক্ষণ হাতে রাখা হুঁকোটা বেদুর হাতে দিতেই সেটাতে আগুন দিয়ে গুড়গুড় করে এক বুক ধোঁয়া ছাড়ল বেদু। ‘আহ, কতদিন পরে এত বালা তামুক টানলাম। তুমি ওস্তাদ আগের মতোই আছ। এই কারণেই তুমারে এত পছন্দ করি আমি।’

কিরান হেসে উঠে হুঁকোটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। গুড়গুড় করে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠল, ‘বেদু, আমি তোর এইহানে আইছি একটা বিশেষ কামে,’ বলে সে একটু থামল। বেদু অপেক্ষা করে আছে কিরান কী বলে সেটা শোনার জন্য।

‘তুই কি জানোস সম্রাট সুজারে আরাকানে খুন করা অইছে?’

‘হুনলাম,’ বেদু আফসোসের সঙ্গে মাথা নাড়ল। ‘ব্যাপারটা বালা অয় নাই এমনেই…’

‘ওইহনে ওইদিন রাইতে বাপুও আছিল,’ বলে কিরান না থেমেই যোগ করল। ‘ওইদিন রাতে ওইখান থেইক্কা কিছু মানুষ পলাইতে পারছিল। বাপু তাগো একজন। কিন্তু এরপরে হের কুনো হদিস নাই। ধারণা করা অইতাছে হেরা পশ্চিম দিকে গেছে কিন্তু সঠিক খবর নাই। হেগো পিছে লাগছে রোসাঙ্গের লোকেরা। আর সিলভেরার বিরাট বাহিনী,’ বলে সে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল। খুব সাবধানে লক্ষ করছে বেদুর প্রতিক্রিয়া।

‘কও কি ওস্তাদ, চাচায় যদি বাঁইচাও থাকে তাইলে তো,’ বলে সে মাথা চুলকাল। ‘তার চায়া বড়ো কথা-সিলভেরারে ধরার এই সুযোগ। তুমি…’ বলে সে চোখ তুলে তাকাল কিরানের দিকে।

‘আমি ওগো পিছে যাইতেসি,’ নিষ্কম্প গলা কিরানের। ‘বাপুরে তো বাঁচাইতে হবেই। আর সিলভেরার লগে আমগো পুরান হিসাব চুক্তা করতে হবে।

নিজের ডান হাতটা মাথার ওপরে তুলে হাঁটুর ওপরে সশব্দে নামিয়ে আনল বেদু। ‘এইডা অইলো একটা কথার মতোন কথা। তুমি আমারে নিবা তো?’

কিরান হেসে উঠল। বেদু এত সহজে রাজি হবে সে ভাবেনি। ‘আমি তো সে জন্যই আইছিলাম। কিন্তু আমি তো ভাবছি তুই রাজি হবি না। তুই খেলা দেহাস এহন, এত নাম-ডাক তোর।’

‘তুমি কি পাগল নাকি ওস্তাদ?’ বেদু প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। ‘তুমি আমারে চিনো না। আমি অইলাম যুদ্ধের মানুষ। এইসব খেলা ফেলা,’ বলে সে মাথা চুলকাল। কিন্তু আমি গেলে তো মতিরে দেহার কেউই নাই আর সুলেমান, শায়ক…

‘তুই যদি আমার সঙ্গে যাস তয় আমি ওগোরে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করতে পারি,’ কিরান বলে উঠল। ‘আমার পরিকল্পনা অইছে বড়ো। আমার আরো লোক লাগবো। গোলন্দাজরে আমার লাগব। তুই কি হের খবর জানোস?’

বেদু একটু চিন্তা করল, ‘গোলন্দাজের খবর বাইর করা কঠিন না। আমি জানি হেয় কই থাহে। কিন্তু কথা অইলো হেয় যাইব কি না। এক কাম করন যায়, তুমি আমি গিয়া হেরে…’

‘এখান থেকেই যাব আমরা,’ কিরান তামাকটা আবারও বেদুর হাতে ধরিয়ে দিল। ‘শোন এখানে একটা সমস্যা হইলো আমাগো হাতে অস্ত্র-জাহাজ সব আছে। খালি নাই তথ্য। আমার আরো কিছু ব্যাপারে জানতে অইবো…’

হঠাৎ বাজ পড়ার মতো শব্দ হতেই কিরানের কান খাড়া হয়ে গেল। ‘ওস্তাদ এইটা বন্দুকের গুলি না?’ বেদুও সচেতন হয়ে গেছে।

অবশ্যই বন্দুকের শব্দ। কিন্তু এখানে বন্দুকের শব্দ হবে কীভাবে।

কিরানের ভাবনা শেষ না হতেই আরো একাধিক বন্দুক একসঙ্গে গর্জে উঠল।

সেই সঙ্গে মানুষজনের হইহল্লার সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ ভেসে এলো,

‘হাম্মাদ, হাম্মাদ ভাগো…’

কিরান চট করে ফিরে তাকাল বিহ্বল বেদুর দিকে। কাপসের হাটে হার্মাদ ডাকাতরা আক্রমণ করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *