মগরাজ – ১৪

অধ্যায় চৌদ্দ – বর্তমান সময়

চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের বাইরে এসে চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাল শারিয়ার। ও ভেবেছিল বেলা থাকতে থাকতেই পৌছাতে পারবে কিন্তু সেটা হয়নি। উলটো বিকেল পার হয়ে সন্ধে নেমে এসেছে আরো আগেই। এতটা দেরি হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু হয়ে গেছে বিশেষ একটা কারণে। কুমিল্লা পার হওয়ার পর এক জায়গায় ওদের সামনের ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়াতে ওটা তো আটকেছিলই ওদের ট্রেনও লেট করেছে বেশ কয়েক ঘণ্টা।

ট্রেনে আসার ব্যাপারটা পাশা স্যারের দেওয়া শাস্তি মনে করে প্রথমে মেনে নিলেও এই অযাচিত দেরি হওয়ার ব্যাপারটা কাজ শুরু করা থেকে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে দিল ওকে, এই বিষয়টা একেবারেই ভালো লাগছে না ওর। তার ওপরে জার্নিটা একদিকে লম্বা হয়েছে অন্যদিকে ট্রেনের বীভৎস রকম বাজে খাবার একবার খেয়ে দ্বিতীয়বার আর মুখেও তুলতে পারেনি ও, যে কারণে ক্লান্তির সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভেতরে তীব্র ক্ষুধার একটা ভারী ঝোঁক টের পাচ্ছে ও।

চট্টগ্রাম স্টেশনের মূল ভবনের বাইরের খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে দম নিল ও। বিকেলের রেশ গড়িয়ে বন্দরনগরীর বুকে সন্ধে নেমে এসেছে আরো অনেক আগেই। শারিয়ার ব্যাকপ্যাকটাকে পিঠে চাপিয়ে ব্লেজারের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে স্টেশন থেকে কেনা বিক লাইটার দিয়ে আগুন ধরাল ওটাতে। লাইটারটা হাতে নিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠল ও। এই লাইটারটা নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে ওর, বিশেষ এই ধরনের লাইটারটা অনেকদিন পর ব্যবহার করছে ও। নাক-মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ও ভাবতে লাগল কতদিন পর এলো চট্টগ্রামে। একজন প্রফেশনাল হিসেবে এই শহরেই ওর জীবন শুরু হয়েছিল। বোর্ডিং স্কুল-কলেজের জীবন শেষ হওয়ার পর যখন আর্মিতে টিকে গেল ও, একজন ট্রেইনি ক্যাডেট হিসেবে এখান থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ওর।

আজও মনে পড়ে, ভীরু ভীরু পায়ে এই স্টেশনের বাইরে অ্যাকাডেমির গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল বিরাট আকারের একটা ব্যাগ নিয়ে। নিজের পিঠে এই মুহূর্তে ঝোলানো ব্যাকপ্যাকটার কথা মনে পড়তেই আরেকবার হাসি ফুটে উঠল শারিয়ারের মুখে। হাতের আঙুলের কড়ে গুনে হিসেব করল ও, এতগুলো বছর সেই এক লহমায় পার হয়ে গেছে, মনেই হয় না। সেদিনের সেই বিরাট প্যাক আজ ছোটো হয়ে ফাস্টপ্যাকে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ও নিজে মানুষটা বড়ো হয়ে গেছে অনেক বেশি। সেই সঙ্গে নিজের ভেতরটাও ম্যাচিউর হয়েছে অনেক। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে আবেগের স্রোতে ভেসে যেতে দিল ও, সেই সঙ্গে নিজেকে মনে করিয়ে দিল খুব বেশি সময়ের জন্য আবেগের স্রোতে ভাসলে চলবে না, কাজে নামতে হবে ওকে।

যাত্রার কারণে যে দেরি হয়ে গেছে সেটা ওকে পুষিয়ে দিতে হবে দ্রুত কাজের স্রোতে অবগাহন করে। তবে ট্রেনে দেরি হওয়াতে একটা ব্যাপার খুব ভালো হয়েছে। যথেষ্ট সময় পাওয়াতে সব কেইস ফাইল ও পড়ে নিয়েছে এবং পুরো কেসটা একেবারে গেঁথে গেছে ওর মাথার ভেতরে। তবে ও স্বীকার করবে যে আলীম পাটোয়ারি কিংবা মৌসুমির কথা একেবারে ঠিক। কারণ, কেসটাতে অনেক আলগা ঘটনা আছে। মাঠে নেমে একটার পর একটা বাস্তব ব্যাপার জোড়া লাগিয়ে এই ফাঁকফোকড়গুলো খুঁজে বের করে জোড়া লাগাতে হবে পুরো ব্যাপারটা।

সিগারেটটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ও মোবাইলটা বের করে আনল। ট্রেন থেকে নেমেই ওর লোকাল কনট্যাক্টকে কল করেছিল কিন্তু লোকটা ফোন ধরেনি। স্টেশন থেকে বের হতে হতে আরেকবার কল করেছিল। সেবারও ধরেনি। পকেট থেকে মোবাইল বের করে আনতে আনতে ও ভাবল এই লোকটা এবার আর কল রিসিভ না করলে ওকে অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। কারণ লোকাল কনট্যাক্ট ছাড়া কিছুতেই ও কাজে নামতে পারবে না। মোবাইল বের করে কল দিতে যাবে তার আগেই ওর দিকে হাত নাড়ল হালকা পাতলা লম্বা দেখতে এক যুবক। হাসিমুখে ও দিকে এগিয়ে আসতে দেখে শারিয়ার কলটা কেটে দিয়ে নিজেও খানিকটা এগিয়ে গেল মানুষটার দিকে। মানুষটার নাম মনে আছে ওর। ‘আপনি ভুবন?’ বহু চেষ্টা করেও মানুষটার নামের শেষ অংশটুকু মনে করতে পারল না ও।

এগিয়ে আসতে থাকা মানুষটার মুখে বত্রিশ ভোল্টের হাসি। পরনে নীল জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে মানানসই একজোড়া কেডস জুতো, সেই সঙ্গে সাদা শার্ট আর জ্যাকেট। শারিয়ার অনুমান করল যুবক ওর বয়সের হবে কিংবা ওর থেকে দুয়েক বছরের বড়োও হতে পারে। ‘জি, জি আমি ভুবন শৰ্মা,’ মানুষটা খুব হাসিমুখে শারিয়ারকে সম্বোধন জানিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।

লোকটার বাংলায় বেশ অদ্ভুত এক টান। শারিয়ার অনুধাবন করল তার লোকাল কনট্যাক্ট স্থানীয় কোনো আদিবাসী গোত্রের মানুষ হবে। আর একারণেই তার নামের শেষ অংশটুকু সে কিছুতেই মনে করতে পারছিল না। শারিয়ার হাত বাড়িয়ে দিতেই ছেলেটা ওর হাত ধরে শক্ত করে একটা ঝাঁকি দিল। ঝাঁকিটা খেয়ে শারিয়ার মানুষটার হ্যাংলা-পাতলা শরীরে শক্তির পরিমাণ অনুধাবন করে একটু তাজ্জব বনে গেল।

মানুষটার হাসিটাই এমন ছোঁয়াচে, যে কেউ তার দিকে তাকালে আপনাতেই হেসে উঠবে। শারিয়ার অনুধাবন করল মানুষটার বাংলাতে যে বিচিত্র টান এই টান বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার নয়। সম্ভবত এটা তার গোত্র থেকে পেয়েছে সে। শারিয়ার তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু লোকটার কথা আর হাসির তোড়ে ভুলে গেল সে।

‘স্যার, আপনার আসতে কষ্ট হয়নি তো?’ বলে সে আবারও হেসে উঠল। ‘আমি অনেক সময় ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি,’ মানুষটার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের শুরুতে অদ্ভুত এক চাপ পড়ায় তার বাংলাটা খুব বিচিত্র এক রূপ নেয়।

‘নাহ, একটু দেরি হয়ে গেছে ট্রেন লেট হওয়ার কারণে,’ বলে সে নিজের প্যাকটা টেনে ঠিক করে নিল পিঠের ওপরে।

‘স্যার, ওটা আমাকে দিন,’ বলে সে রীতিমতো হা হা করে এগিয়ে এলো শারিয়ারের দিকে।

‘না না,’ শারিয়ারও প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ‘তা কি হয় নাকি?’ লোকটা যত যাই হোক না কেন একজন অফিসার লেভেলের কর্মকর্তা, তাকে কীভাবে নিজের ব্যাগ দিতে পারে ও।

কিন্তু সেই লোকও নাছোড়বান্দা। ‘না না, স্যার। এটা আমি কিছুতেই হতে দেবো না। হাজার কাজে এলেও আপনি আমাদের এলাকার মেহমান,’ বলে সে একরকম জোর করেই শারিয়ারের হাত থেকে ব্যাকপ্যাকটা টেনে নিয়ে নিল নিজের কাছে। তারপর সামনের দিকে পথ দেখিয়ে বলে উঠল, ‘স্যার, এদিক দিয়ে আসুন। বাইরে রাস্তার পাশেই আমার গাড়ি পার্ক করে রাখা আছে।’

‘আপনার গাড়ি?’ শারিয়ার একটু অবাক হয়েই জানতে চাইল। শারিয়ারের প্রশ্ন শুনে নিজে জিভ কাটল লোকটা। ‘সরি স্যার, নিজের গাড়ি বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অফিসের পাঠানো গাড়ি। স্যার, সত্যি কথা কি, এইসব গাড়ি এত বেশি আমাকে চালাতে হয় যে ভুলেই গেছি গাড়িটা আসলে অফিসের। স্যার, আমাদের এখানে তো আর কী বলব। যারা কাজ জানে তাদের সবাইকে তো একেবারে… স্যার, এদিকে,’ ওরা হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের উঁচু অংশ থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তার পাশে চলে এসেছে।

‘ভুবন আপনি…?’ শারিয়ার গাড়িতে ওঠার আগে তাকে কিছু নির্দেশনা দিতে চেয়েছিল কিন্তু এবারও মানুষটার কথার চোটে সেটা রীতিমতো উড়ে গেল।

‘স্যার, এই যে আমাদের পঙ্খীরাজ,’ বলে সে সামনেই রাস্তার ঠিক পাশেই রাখা একটা সাদা বেন্টলি কার দেখাল। গাড়িটা দেখে সত্যিকার অর্থেই শারিয়ার খুশি হয়ে উঠল। কারণ একেবারেই চকচকে নতুন একটা গাড়ি। ‘বাহ, বাহ,’ শারিয়ার গাড়িটার কাছাকাছি যেতেই ছেলেটা সামনে এগিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটটা টেনে খুলে ওর ব্যাকপ্যাকটা রেখে ধাম করে দরজাটা লাগিয়ে দিল। তারপর প্রায় দৌড়ে এসে ওর জন্য দরজাটা মেলে ধরল। শারিয়ার রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছে লোকটার আচরণে। এতটা সুপিরিয়রিটি অনুভব করে অভ্যাস ওর নেই। তবে এদের ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারে ও। ঢাকার ভেতরে বিশেষ পরিবেশে ওরা যেভাবে কাজ করে অভ্যস্ত, ঢাকার বাইরে এরা সে ধরনের পরিবেশে কাজ করে অভ্যস্ত নয়। তাই এখানে ডেকোরাম-সিনিয়রিটি অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করে।

শারিয়ারকে দরজা খুলে ভেতরে বসতে দিয়ে ছেলেটা সামনের ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল। ‘স্যার, আগে বলেন কী খাবেন? নিশ্চই আপনি লম্বা জার্নি করে একেবারে টায়ার্ড। আগে একটা শাহি খানা দিয়ে তারপর আপনার জন্য হোটেল সুইট বুক করে রাখা হয়েছে সেখানে গিয়ে লম্বা ঘুম দেবেন। আপনার জন্য সরকারি বাংলোও ঠিক করে রাখা আছে। আগে বিশ্রাম। তারপর কাল সকাল…’

‘ভুবন সাহেব, আপনি আমাকে স্পটে নিয়ে যাবেন, শারিয়ার বেন্টলির কাচের ফাঁক দিয়ে ওর স্মৃতির সেই পুরনো চট্টগ্রামকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু স্মৃতি স্মৃতির জায়গাতেই রয়ে যাচ্ছে। পুরনো সেইসব আবেগের সঙ্গে বর্তমান চট্টগ্রামের এই ঝাঁ চকচকে পরিবর্তিত চেহারার কোনো মিলই খুঁজে পাচ্ছে না ও। ওদের গাড়ি ধীরে ধীরে শহর পার হয়ে বাইরের দিকে চলছে। গাড়ি যতটা না জোর গতিতে চলছে তার চেয়ে অনেক বেশি জোর গতিতে চলছে ভুবনের মুখ। ওদের নতুন অফিস, ওদের কাজকর্ম থেকে শুরু করে ও কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে যে ট্রেনিং সম্পন্ন করে এসেছে সেটা নিয়ে তার কৌতূহলের কোনো শেষ নেই।

‘ভুবন,’ শারিয়ার মানুষটার কথার স্রোতের ভেতরে একটু ফাঁক পেতেই সে নিজের কথা বলে উঠল। ‘আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন আমাকে একটু বলেন তো, ‘ শারিয়ার গ্লাসের ভেতর থেকে দেখে চট্টগ্রামের কোনো অংশে আছে আর কোনদিকে যাচ্ছে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছে না।

‘স্যার, আপনে কোনো চিন্তা করবেন না আমি,’ শারিয়ারের প্রশ্ন ঠিকঠাক শেষ হওয়ার আগেই সে কথা বলে উঠল। ‘আমি ঠিক-ঠাক আপনাকে নিয়ে চলে যাব। আমি বলতে চাচ্ছিলাম আগে আমরা আপনার খাওয়া আর বিশ্রামের ব্যাপারটা ঠিকঠাক করতে। তা-না হলে স্যার আমার নিজের ভেতরে ভীষণ রকমের গিল্টি ফিলিং হচ্ছে। স্যার আমি কি…’

এবার একটু বিরক্ত বোধ করল শারিয়ার। ও মোবাইলটা বের করার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল কিন্তু তার আগেই থেমে গেল। ‘ভুবন, আপনাকে না বললাম আমি আগে স্পটে যাব, ওর গলার সুরটা একটু বেশিই উঁচু হয়ে গেছে দেখে সেটাকে আবারও আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করল ও। শারিয়ার নিজে সরকারি লোক হলেও তেলবাজি জিনিসটা একেবারেই পারে তো না-ই সবচেয়ে বড়ো কথা সে নিজে এই জিনিসটা ঠিক পছন্দও করে না। ও হলো কাজের মানুষ ওর নিজের কাজের পন্থা হয়তো সব ঠিক পছন্দনীয় না, কিন্তু তেলবাজি জিনিসটাকে ভীষণ ভীষণ অপছন্দ ওর। ‘দেখুন এমনিতেই কাজের বেশ দেরি হয়ে গেছে। কাজেই আমি আগে ওখানে যেতে চাই, পরিস্থিতি বুঝতে চাই। তারপরে খাওয়া-বিশ্রাম সব হবে,’ বলে ও একবার বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে বলে উঠল ‘আপনি বরং আমাকে ওখানকার পরিস্থিতি নিয়ে একটু ব্রিফ করুন।’

‘অবশ্যই, স্যার,’ ভিউ মিররে শারিয়ার দেখতে পেল ভুবন লোকটার হাসিতে এক বিন্দু পরিবর্তন আসেনি। সে ঝাড়ি খেয়ে একটুও দমে যায়নি বরং সেই পুরনো বত্রিশ ভোল্টের হাসি ঠিকই ধরে রেখেছে মুখে। মনে মনে লোকটার প্রশংসা না করে পারলা না শারিয়ার। এলেম আছে ব্যাটার, মনে মনে বলে উঠল ও। ছোটো একটা ঝাঁকির সঙ্গে শারিয়ার বাইরে ফিরে তাকাল। ওদের গাড়ি শহর ছাড়িয়ে বাইরের দিকে এসে পড়েছে বলে মনে হলো শারিয়ারের কাছে।

‘আচ্ছা আমাকে একটা ব্যাপার বলুন তো, শারিয়ার জানতে চাইল। ‘পতেঙ্গা রোডে যে অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটা ঘটেছে সেটা তো খুবই সাধারণ। আর দশটা অ্যক্সিডেন্টের ঘটনার সঙ্গে আমার কাছে তেমন কোনো পার্থক্যের কোনো ব্যাপার মনে হয়নি। তবে এখানে বাইরের দেশের মানুষজন, লাশ চুরি এতসব কাহিনি কীভাবে পেঁচিয়ে গেল বলেন তো?’

‘আসলে, স্যার…’ ভুবন শুরু করার আগেই শারিয়ার তাকে থামিয়ে দিল।

‘ভুবন, ফাইলে যা আছে সেগুলো বলে কোনো লাভ নেই। আমি ফাইল খুব বিস্তারিত পড়েছি,’ শারিয়ার অনুভব করল ওরা শহর থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে ভুবনের গাড়ির। ভালো, মনে মনে ভাবল ও। লোকটা ওর মুখের গতি নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ির গতি বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে, এটা একটা ভালো ব্যাপার। ‘বিশেষ করে আপনি তো স্থানীয় ছেলে। আমাকে বলেন তো এই ঘটনার ভেতরে আপনি স্থানীয় কোনো অ্যাঙ্গেল দেখতে পাচ্ছেন কি না?’ শারিয়ার ওর একেবারে প্রথম দিনের ট্রেনিংয়ে একটা কথা শিখেছিল ওর ইন্সট্রাকটরের কাছ থেকে, কথাটা ওর মনের ভেতরে একেবারে খুব ভালোভাবে গেঁথে গেছে সারা জীবনের জন্য। আর ও যতবারই মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছে প্রতিবারই দেখেছে কথাটার একটা আলাদা মূল্য আছে।

ইন্সট্রাকটর বলেছিল, ‘আপনারা যখনই যেকোনো জায়গাতে যেকোনো কেস সমাধান করতে যাবেন কিংবা কাজ করতে যাবেন সবসময় মনে রাখবেন একটা ঘটনা যত বড়োই হোক না কেন, সেই ঘটনার সঙ্গে যত বড়ো বড়ো রাঘব বোয়ালরাই জড়িত থাক না কেন, প্রতিটি ঘটনার একটা ছোটো ক্ষেত্র থাকে এবং স্থানীয় একটা অ্যাঙ্গেল থাকে। ঘটনা বুঝতে হলে সেই স্থানীয় অ্যাঙ্গেলটা বোঝা খুবই জরুরি। শারিয়ারের আজও ইন্সট্রাকটরের গলাটা পরিষ্কার মনে পড়ে, মনে রাখবেন রাজারা ঘটনা ঘটাবার নির্দেশ দেয় কিন্তু ঘটনা তারা ঘটায় না। বরং ঘটনা ঘটায় হাট-ঘাট আর মাঠের মানুষেরা। কাজেই সবসময় ঘটনা বুঝতে হলে ঘটনার স্থানীয় অ্যাঙ্গেলটা বোঝা খুবই জরুরি।’

‘স্যার, আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি,’ বলে ভুবন দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ির হুইল ঘোরাল। শারিয়ার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল ওরা শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূরে সরে এসেছে। ‘স্যার, আমি তো ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছি অনেক পরে তাই খুব বিস্তারিত এখনো জানি না। তবে আমি এখন পর্যন্ত যতোটুকু বুঝতে পেরেছি…’ ভুবন কথা বলতে বলতে গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিল। ‘তাতে আমার মনে হয়েছে…’

ভুবন কথা বলে চলেছে। শারিয়ার খুব একটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে না তার কথা, সে বরং বাইরের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে বোঝা চেষ্টা করছে ওরা আসলে যাচ্ছে কোনদিকে। একদিকে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে শুরু করেছে শহরের আলো। অন্যদিকে গাড়ি এই মুহূর্তে চলছে প্রায় আশি কিলোমিটারের বেশি স্পিডে। শারিয়ার বাইরে দেখতে দেখতে ভুবনকে বলে উঠল, ‘ভুবন আপনি গাড়ির গতিটা…’ ও কথা শেষ করার আগেই মোবাইল বাজতে লাগল ওর পকেটে। শারিয়ার নিজেও চমকে উঠল ওর মোবাইলের শব্দে। তবে ও অবাক হয়ে লক্ষ করল ভুবন ওর চেয়েও বেশি অবাক হয়ে পেছন ফিরে দেখছে ওকে। তবে ব্যাপারটা আসলেই ঘটল, নাকি পুরোটাই ওর মনের ভাবনা ঠিক ধরতে পারল না শারিয়ার। পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখতে পেল মৌসুমি আপার কল।

‘হ্যালো…’

‘কী ব্যাপার? এতক্ষণ ধরে তোকে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছি তোর কোনো খবরই নেই,’ শারিয়ার কল রিসিভ করতেই প্রায় তড়বড় করে কথা বলতে শুরু করল মৌসুমি আপা। এমনকি সে ওর কথা ঠিকমতো শুনছেও না। বলেই চলেছে। কিন্তু তার কথা শুনে শারিয়ারের কান খাড়া হয়ে গেছে।

‘আস্তে আস্তে, আপু,’ শারিয়ার মৌসুমির বলা কথাগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করছে। ‘কী বলছো তুমি? আমি কল রিসিভ করব না কেন। আমার মোবাইলে কোনো কল তো আসেইনি।’

‘হ্যাঁ, সে জন্যই তো আমরা আরো অস্থির হয়ে উঠেছি। শেষবার তোর মোবাইলের অবস্থান দেখা গেছে স্টেশনের বাইরে। এরপর থেকে না তোর মোবাইলে আর কল ঢুকছিল না। এদিকে ভুবন ছেলেটা তোকে না পেয়ে একবার তোকে কল করে আরেকবার আমাদের এখানে যোগাযোগ করতে করতে আমাদের পাগল করে ফেলেছে। পুরো ঢাকা আর চট্টগ্রাম গরম হয়ে উঠেছে তোর….’

মৌসুমি বলেই চলেছে। কিন্তু শারিয়ারের কানে কোনো কথাই ঢুকছে না। মৌসুমি আপার শেষ কথাটাই কানে বেজে চলেছে।

‘ভুবন ছেলেটা পাগলের মতো খুঁজছে তোকে।’

ভুবনের সঙ্গে যদি ওর দেখাই না হয়েই থাকে তবে সামনে ড্রাইভারের সিটে বসা এই লোকটা কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *