মগরাজ – ১৩

অধ্যায় তেরো – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

রামু, চট্টগ্রাম

সদা-হাস্যোজ্জ্বল মানুষটার মুখের হাসি এভাবে মুছে যাবে কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি কিরান।

একটা সময় যথেষ্ট শক্ত মানুষ মনে করত সে নিজেকে। কিন্তু সেই কাল এখন গত হয়েছে। সময়, ব্যর্থতা আর হীনমন্মতার পাশবিক আঘাত তাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে শারীরিক, মানসিক আর অর্থনৈতিক দিক থেকে। তবুও আজও নিজেকে আশপাশের সবার থেকে অনেক বেশি সামর্থ্যবান মনে করে কিরান। আর সেই শক্তির বলে সে জানে, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন অশ্রুপাত ঘটানোর মতো মানুষ সে নয়। কিন্তু তরফদারের পোড়া বাড়ি আর ছোট্ট এক টুকরো মাটিতে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘেরা আধভাঙা কবরটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অশ্রুকে সে কিছুতেই সামলাতে পারল না। ভাঙা বেড়া দেওয়া কবরটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল কিরান।

তরফদার, পুরো সুবর্ণগ্রামের সবচেয়ে সেরা তাঁতি ছিল, তার হাতে বোনা মসলিন ‘মলমল খাস’ আর ‘সরকারে আলা’ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সরাসরি চলে যেত দিল্লি-আগ্রা আর হুগলীর বাজারে। সেই মানুষটাই একদিন এক হিন্দু মেয়ের প্রেমে পড়ে পরিবারের বিরাগভাজন হয়ে ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল অজানার পানে। আর সেই অজানা সমুদ্রেই তার সঙ্গে দেখা হয় আরেক ঘরছাড়া বালক কিরানের। বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। একদিকে কিরান ছিল বাঁধন ছাড়া উদ্যমী আর হিংস্র, অন্যদিকে তরফদার ছিল শান্ত-শিষ্ট সর্বক্ষণ দুষ্টুমির হাসিতে ভরপুর একজন মানুষ। সেই হাসিখুশি মানুষটার এই করুণ পরিণতি দেখে অন্তত তালেবের জন্য অশ্রু সংবরণ করা মুশকিল।

কতক্ষণ তরফদারের কবরের সামনে ও হাঁটু গেড়ে বসে দিল খেয়ালই ছিল না। হঠাৎ কাঁধের ওপরে ভারী একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে ভেজা চোখে সে ফিরে তাকাল মানুষটার দিকে। ভাবলেশহীন গোমেজেরও চোখ ভেজা। কিছু বলতে না পারলেও কিরানের কষ্ট ওকেও ছুঁয়ে গেছে। আর তাছাড়া সেও তরফদারের ভালো বন্ধু ছিল। পরিজনবিহীন এই পৃথিবীতে গোমেজেরও গুটিকয়েক কাছের মানুষদের একজন ছিল তরফদার।

উঠে দাঁড়িয়ে গোমেজের পিঠ দুবার চাপড়ে দিয়ে কিরান ফিরে তাকাল বৈঠার সঙ্গে আসা ছোটোখাটো মানুষটার দিকে। ছুঁচোর মতো চেহারার মানুষটার চতুর চোখের দিকে তাকিয়ে কিরান শক্ত সুরে জানতে চাইল, ‘হয়েছিল কী?’

ছোটোখাটো মানুষটার চোখা চেহারায় যতটা না ধার তার চেয়ে অনেক বেশি ধার তার চোখে। নাফ আর পুলু নদীর মোহনায় অবস্থিত মন্দার হাটের সবচেয়ে ধুরন্ধর মানুষদের একজন এই বিল্লাল। মোঘল সৈন্যবাহিনী থেকে শুরু করে রোসাঙ্গের রাজার লোক, এমনকি পর্তুগিজ জলদস্যু পর্যন্ত সবার কাছেই খবর বিক্রি করা এই লোকের কাজ। লোকে দুই নৌকায় পা দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু এই প্রবাদ বাক্যকে প্রতিনিয়ত ভুল প্রমাণ করে বিল্লাল শুধু দুই নৌকাই নয় কত নৌকায় যে পা দিয়ে বছরের পর বছর ধরে দিব্যি বেঁচে আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর সবার মতো কিরানও বহু বছর ধরে এই লোকের মাধ্যমে খবর সংগ্রহ ও পাচার করে। তবে কিরান জানে, এই লোকের এত বছর ধরে টিকে থাকার ভিন্ন কারণ আছে। এর ওপরে বিরাট মাথা আছে। সেই মাথার সন্ধান কখনো বের করতে না পারলেও কিরান এটা জানে, ও যা করতে যাচ্ছে তাতে বিল্লালকে তার দরকার হবে। আর তাই রামুর মাটিতে পা রেখে প্রথমেই সে বৈঠাকে পাঠিয়েছে বিল্লালের খোঁজ করার জন্য। কারণ, এর মাধ্যমেই তাকে পুরনো সঙ্গীদেরকে বের করতে হবে দল গঠনের জন্য।

প্রথমে কিছুক্ষণ উলটো-পালটা করলেও কিরানের শক্ত ধমক খেয়ে বিল্লাল সর্দার যখন কথা বলে উঠল কিরান একটু অবাক হলো। কারণ, বিল্লালের মতো ধুরন্ধর আর আবেগহীন একজন মানুষের গলাতেও সামান্য ভেজা সুর, ‘ওস্তাদ, সত্যি কথা কইবাম। তরপদার ওই ঘটনার পরে,’ সে কিরানের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল হঠাৎ সে ওই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে চোখ নামিয়ে নিল মানে… হেয় যহন ফিরা আইলো…’

‘আমি তো জানতাম তরু ভাই ওর পরিবারের কাছে ফিরা গেছে,’ তরফদারকে আদর করে কিরান তরু ভাই বলে ডাকত। ‘সে এইখানে ক্যামনে?’

‘পরথমে তাই গেছিল হ্যায়,’ বিল্লাল আবারও বলতে শুরু করেছে। ‘কিন্তু পরিবারের লগে টিকতে পারে নাই। হের…হের কি জানি অইছিল,’ বিল্লাল সর্দারের গলায় অনিশ্চয়তা। কিরান এই পর্যন্ত শুনে আনমনেই মাথা নাড়ল। বিল্লাল সর্দার না জানলেও ও ঠিকই জানে তরু ভাইয়ের কী হয়েছিল। কারণ একই ব্যাপার ঘটছিল তার সঙ্গেও।

‘কামে মন দিতে পারে নাই। পরিবারের লগে বনতো না,’ বিল্লাল বলেই চলেছে। ‘তারপরে এক সময় এইহানে আইয়া থাকতে শুরু করল। কিছু জমানি টাহা-পয়সা আছিল। হেইডি দিয়া বালাই চলল দুই বছর। তারপরে টাহা শেষ অইতে থাকলে কিছু কিছু কাম করত। শেষ দিকে ধার দেনায় ডুইবা গেছিল। তারপরে বছরখানেক আগে…’

বিল্লাল সর্দারের কথা শুনতে শুনতে খুব খেয়ালিপনা অনুভব হতে লাগল কিরানের। মনের গহিনে একটা অস্থিরতা আর অপরাধবোধের জমাট বাঁধা যন্ত্রণা পাক খেয়ে উঠতে চাইছে। খুব ভালোভাবেই সে অনুভব করতে পারছে কী ঘটেছিল তরু ভাইয়ের সঙ্গে। যখন মানুষটা একাকী দুঃসহ যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করছিল তখন তার উচিত ছিল মানুষটার পাশে থাকা। কিন্তু সেটা সে করেনি। বা করতে পারেনি। একদিকে তরু ভাইয়ের জন্য যন্ত্রণা অন্যদিকে আরেকটা অন্ধকার ভয়ের হাতছানি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। তার দলের বাকি লোকেদের না জানি কী অবস্থা। সবাই যদি এভাবে জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে থাকে তবে…

‘তরফদার ভাই আর সইহ্য করতে পারতাছিল না। একদিন বাজার থেইক্কা দেহা গেল সব দাউদাউ কইরা জ্বলতাছে। কেউ কয় সে আগুন লাইগ্গা মরছে, কেউ কয় নিজেই নাকি পুইড়া আত্মহত্যা…’

বিল্লালকে কথা শেষ করতে দিল না কিরান। তার আগেই সে তার দিকে কোমরে গোঁজা একটা থলি হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারল। ‘এইডা রাখ, বিল্লাল। তোর লগে আমার অনেক কাম আছে,’ বলে সে বৈঠাকে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু নির্দেশনা দিল। ‘শোন, আমি একটা বড়ো কামে নামতাছি,’ বলে সে একটা আঙুল তুলল বিল্লালের দিকে। ‘এই কামে তোর সাহায্য লাগব আমার। তাই এগুলা দিলাম,’ বলে সে হাতের থলিটা দেখাল। মনে রাহিস আমার কাম গোপন রাখতে অইব তোর। এই জন্যই কামের আগে টাহা দিলাম, দরকারের চায়া অনেক বেশি দিলাম। কাজেই জবান এক্কেরে বন্ধ, ঠোঁটের সামনে একটা আঙুল তুলে চুপ থাকার ইশারা করল সে। ‘বুঝছোস?’

বিল্লাল সর্দার চতুর চোখে তাকিয়ে ছিল কিরানের দিকে। থলির ভেতরের মুদ্রাগুলোর প্রতিটি নড়াচড়ার সঙ্গে তার চেহারায় ভিন্ন ভিন্ন রং খেলা করে যাচ্ছে। কিন্তু কিরানের দিকে যখনই ফিরে তাকাল তার চেহারার বিশেষ কোনো ভাব নেই। কিরান সতর্ক চোখে তাকে দেখছে। সে খুব ভালোভাবেই জানে বিল্লালের মনে কী খেলা করছে। ‘কও ওস্তাদ, কী দরকার তুমার?’

‘বইদ্যা ওরফে বেদুরে দরকার আমার,’ আনমনে বলে উঠল কিরান। ‘ওরে খুইজ্জা বাইর কর। আগে ওর খবর আন। তারপরে তোর আরো অনেক কাম আছে। এই, তুই ওর লগে যাবি,’ বলে সে বৈঠাকে ইশারা করল।

‘ঠিক আছে, ওস্তাদ, বলে বৈঠা সামান্য মাথা নাড়ল। বৈঠা ওর দিকে তাকাতেই কিরান মুখে কিছু না বলে সে বৈঠার দিকে তাকিয়ে চোখের মণি বিশেষ ভঙ্গিতে দুবার দুদিকে নেড়ে একটা ভঙ্গি করল। যে কেউ দেখলে ভাববে কিরান স্রেফ এমনিতেই চোখ পিটপিট করল কিন্তু ও চোখ নাড়াতেই বৈঠার মুখে ফুটে ওঠা হাসিটা দেখেই সে বুঝতে পারল ওর পুরনো ইশারা বৈঠা এখনো ভোলেনি।

‘তোরা এহন যা, আমার কাম আছে,’ বলে সে বৈঠা আর বিল্লাল দুজনার দিকে তাকিয়েই শাসানোর ভঙ্গি করে বলে উঠল আইজ দুই পহরের ভেতরে আমার বেদুর খবর চাই। না অইলে তগো দুইডারই খবর আছে।’

কিরানের নির্দেশ শুনে বৈঠা তড়বড়িয়ে কথা বলে উঠল, ‘ওস্তাদ ও তো হাডে হাডে খেলা দেহায়া বেড়ায়। ওরে এত জলদি…’ তার কথা না শুনেই কিরান ধমকে উঠল, ‘অন্য কথা বুঝি না, অহন কামে নাম। ভালায় ভালায় বেদুরে খুঁইজ্জা বাইর কর। নাইলে তোগো খবর আছে। যা ভাগ অহন,’ কিরানের ধমক শুনে দুজনেই পড়িমড়ি করে রওনা হয়ে গেল হাটের পথে। আর কিরান ফিরে তাকাল গোমেজের দিকে, ‘চল, আমরা এহন বিশেষ একটা জায়গায় যামু।’

গোমেজ মুখে কিছু না বলে তার হাতের লাঠিটাকে দুবার পাক খাওয়াল শূন্যে, কথা বলতে না পারা গোমেজের এটাই প্রশ্ন। সে জানতে চাইছে, কোথায় যাবে ওরা এখন। কিরান মৃদু হেসে উঠল, ‘খণ্ডালের গুহায়।’

গোমেজ খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিরানের দিকে। আর সবার মতো সে এটা খুব ভালো করেই জানে, খণ্ডালের গুহা নিয়ে এলাকাতে অনেক ধরনের ভীতিকর গল্প প্রচলিত আছে। নাফ নদ, সমুদ্র আর চিতলখাল যেখানে মিশেছে সেখানে পাহাড়ের কোলেই কোথাও আছে খণ্ডালের গুহা। একসময় জাহাজ নির্মাণ আর মেরামতির কাজ চললেও এক ভূমিকম্পের পর থেকে সেই গুহা বহু বছর ধরে মানব-পরিত্যক্ত। এর পেছনে প্রচলিত আছে অনেক গল্প। কিন্তু কোনটা সঠিক সেটা কেউই বলতে পারে না। তবে এটা সবাই জানে প্রাকৃতিকভাবে খানিকটা বিপজ্জনক জায়গায় অবস্থিত এই জায়গা, আবার একে নিয়ে ভীষণ সব গল্প প্রচলিত থাকায় ভুলেও কেউ ওদিকে পা মাড়ায় না। গোমেজ তাই চোখে এক দঙ্গল প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে, কিরান কেন ওখানে যেতে চায়।

গোমেজের দিকে তাকিয়ে তার জিজ্ঞাসাগুলো সব পরিষ্কার বুঝতে পারলেও মুখে তেমন কিছু বলল কিরান। বরং গোমেজকে জলদি হাঁটতে ইশারা করল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘ওইখানে যাইতেসি কারণ আমগো বিশেষ কাম আছে,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল, ‘ওইখান থেইকাই জাহাজ নামানো হবে।’

কিরানের মুখে জাহাজ শব্দটা শুনে গোমেজের দাড়িভর্তি চওড়া মুখে ফুটে উঠল ততোধিক চওড়া একটা হাসি। হাঁটা বাদ দিয়ে জোরকদমে সে প্রায় দৌড়াতে শুরু করল সে। ‘এই আস্তে যা গোমেজ,’ বলে কিরানও দৌড়াতে লাগল তার পিছু পিছু।

ওরা ঘণ্টাখানেকের মতো জোরকদমে হেঁটে পার হয়ে এলো ক্রোশখানেকের মতো দূরত্ব। কিরানের নিজের গ্রাম আর মন্দার হাটকে মাঝ বরাবর রেখে সমুদ্রের সঙ্গে সমান্তরালে এগিয়েছে ওরা। আরো আধমাইলের মতো আসতেই সামনে পাহাড়ের সারি দেখতে পেল কিরান। তারমানে এখানে যে কোনোদিকেই থাকতে পারে খণ্ডালের গুহা। যেখানে পাহাড়, সমুদ্র আর নদীর মোহনা কোনাকুনিভাবে মিশেছে সেখানেই হতে হবে গুহাটাকে। কিন্তু কাছাকাছি এসে কিরান একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কারণ বহু বছর আগে আসা জায়গাটাকে সে ঠিক চিনতে পারছে না।

‘কী রে, গোমেজ,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল সে। একটানা রোদের ভেতরে হেঁটে হাঁপিয়ে গেছে সে। কথাটা গোমজেকে উদ্দেশ্য করে বলেই সে গোমেজের সঙ্গে থাকা পানির মশকটা নিজের দিকে টেনে নিল। ‘দেখ তো কুনদিক অইতে পারে?’ বলে সে মশকের মুখের অংশটা আলগা করে মুখ লাগাতে যাবে তার আগেই হুশ করে কিছু একটা চলে গেল একেবারে ওর পাশ দিয়ে। মুহূর্তের জন্য ধরতে পারল না সে আসলে ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটলো।

পাশ ফিরে দেখল মাটিতে কিছু একটা গেঁথে আছে। জিনিসটার লেজের কাছে নড়তে থাকা পালকটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পারল ওটা কী। কিন্তু পাশ ফিরে গোমেজকে সাবধান করতে যাওয়ার আগেই ফুঁচ করে সেই জিনিসটাই এসে বিঁধলো তার হাতে ধরা মশকের গায়ে। ধাক্কার চোটে জিনিসটা হাত থেকে ছুটে গেল ওর। একবারের জন্য কিরানের মনে হলো মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে কিন্তু সেটা না করে বরং দুই হাত ওপরে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াল। গোমেজ খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। প্রথম তিরটা ওদের কাছাকাছি বিঁধতেই সে হাতের লাঠিটাকে পাক খাইয়ে শূন্যে তুলে ফেলেছিল সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু কিরানকে হাত তুলে দাঁড়াতে দেখে অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে কিরানের মুখের হাসি দেখে নামিয়ে নিল লাঠিটা। ‘সাবধান গোমেজ, বাড়াবাড়ি করিস না।’

গোমেজ সামান্য মাথা নাড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আট-দশজন লাঠিয়াল এসে ঘিরে ফেলল ওদেরকে। লুঙ্গি আর কালো ফতুয়ার মতো পোশাক পরা প্রত্যেক লাঠিয়ালের হাতে তেল চকচকে বাঁশের লাঠি। মাথায় বাঁধা বিশেষ কাপড়। তাদের সর্বাগ্রে দাঁড়ানো লম্বা-চওড়া কাল চাপদাড়ি একজন মানুষ। সবাইকে ছাড়িয়ে তার মাথা যেমন ওপরের দিকে উঠে গেছে ঠিক তেমনি বড়ো তার লাঠিটাও। কঠোর চেহারার মানুষটা কিরানের দিকে এগিয়ে এসে ততোধিক কঠিন মুখে জানতে চাইল, ‘তুমরা যে এয়ানে আইছো, কেউ দেহে নাই তো?’

‘তুমার মালিকের কাছ থেইক্কা যে টাহা পাবা সেইটা থেইকা এই জিনিসটার দাম আদায় করব আমি,’ মাটিতে পড়ে ফুটো হয়ে থাকা মশকটা দেখাল কিরান। তারপর নিজের হাতটা নামিয়ে আকরাম বেগের প্রধান দেহরক্ষী ও তার লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান তুলারামের দিকে তাকিয়ে। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করল তুলারাম। কিরানের মনে হলো এটা সে তার মালিক আকরাম বেগের কাছ থেকে শিখেছে।

‘কথার উত্তর দেও। যেমনে আইছো তাতে তো রাখঢাক দেখলাম না, কেউ দেহে নাই তো তুমগো?’ সে এখনো আগের মতোই কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

কিরান মানুষটার কাজ আর কথা বলার ধরন খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল কারণ এ-ধরনের মানুষেরা বেশ কঠিন একটা পৃথিবীতে বাস করে। এদেরকেও বেশ কঠিন হতে হয় আর ঠিক একারণেই সে ধরেই নিয়েছিল মানুষটা স্রেফ নিজের কাজটাকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে করছে। কিন্তু মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে সে অন্য কিছু দেখতে পেল। মানুষটার চোখে পরিষ্কার জিঘাংসা দেখে সে অনুমান করল হয় এই লোক এখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে আর না হয় ওর ওপরে কোনো-না-কোনো কারণে এই লোকের পূর্ববর্তী রাগ আছে।

কিরান তার চোখ থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই দু-পা এগিয়ে গেল মানুষটার দিকে। ‘নিজের কাম করো লাঠাল। আমি কারে নিয়া আইছি, কেমনে আইছি সেইটা তোমার জানার কাম নাই। নিজের কামে মন দেও,’ বলে সে মানুষটার পায়ের দিকে ইঙ্গিত করল, ‘অন্যের ওপরে খবরদারি করতে গেলে কেডা জানে দুই পায়ের ওপরে খাড়ায়া থাকতে পারবা কি না,’ বলে সে গোমেজের দিকে ফিরে জানতে চাইল, ‘কী কস গোমেজ?’ কিরানের কথা শুনেই গোমেজ নিজের এক-পা পা শূন্যে তুলে ধাম করে মাটিতে নামিয়ে আনল, সেই সঙ্গে নিজের হাতে ধরা সাত ফিট লাঠিটা দুবার পাক খাওয়াল মাথার ওপরে।

‘এহন কও লাঠাল, কী কইবার চাইতাছিলা?’ কিরানের চোখেও আগুন।

তার চোখের দিকে সমান আগুন নিয়েই তাকিয়ে আছে তুলারাম। একবার কিরানের দিকে দেখে নিয়ে সে আরেকবার গোমেজকে দেখল। ‘চাচায় আমারে কইছিল, তুমি একটা ফাজিল বেদ্দপ,’ বলে সে একবার মাথা ঝাঁকাল। ‘আইজকা তুমি বাইচ্চা গেলা জাহাজি,’ বলে সে একটা হাত তুলে নিজের লোকদেরকে ইশারা করল। ‘বাইচ্চা গেলা তুমার মাথার ওপরে চাচার হাত আছে দেইখা। কিন্তু মনে রাইখো প্রত্যেক দিন কিন্তু তা থাকব না।’

‘সেইদিন আমিই নিজ হাতে তুমার মুণ্ডুটা…’ কিরান কথা শেষ করতে পারল না। গুহার দিক থেকে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসতে থাকা পদক্ষেপের শব্দে সেদিকে ফিরে তাকাল সে। ভেবেছিল তুলারামের কোনো লোক বুঝি দৌড়ে আসছে। কিন্তু তার বদলে ছোটোখাটো আধবুড়ো একজন মানুষকে দৌড়ে এগিয়ে আসতে দেখল সে। কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা প্রায় বামুন আকৃতির মানুষটা দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে এসে কোমরের কাছটায় ধরে প্রায় শূন্যে তুলে ফেলল ওকে। ‘আরে, রহমত চাচা তুমি, এইখানে?’ রহমত ছিল ওদের জাহাজের বাবুর্চি। চিরকুমার রহমত কিরানকে নিজের ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। ‘কিরান, কত্তোদিন পরে তোরে পাইছি,’ সে ঘুরানি থামাচ্ছে না।

‘আরে পইরা যাব তো, নামাও, কোনোমতে রহমত চাচার কোল থেকে নেমে আসতেই তাকে প্রায় দম বন্ধ করার মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। ‘কিরান, তুই ভালা আছস? কত্তোদিন পরে তোরে দেখলাম,’ ছোটোখাটো মানুষটা প্রায় ওর কোলের ওপরে চড়ে বসেছে। ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে প্রবল বেগে মুখ ঘষতে দেখে কিরান বুঝল মানুষটা নিজের চোখের পানি মুছছে ওর কাঁধের কাছের কাপড়ে।

‘আমি ভালো আছি, রহমত চাচা,’ বলে সে মানুষটাকে ছাড়িয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইল, তুমি এইহানে ক্যামনে? আর…’

‘রহমতরে আমি নিয়া আসছি। গুহার মুখের কাছ থেকে ভারী একটা কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে ফিরে তাকিয়ে আরেকবার বিস্ময়ের সঙ্গে চোয়াল প্রায় ঝুলে গেল কিরানের। গুহার মুখের ঝোপঝাড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা-চওড়া বলশালী একজন মানুষ। মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়ি একদিকে যেমন তার চেহারায় এনে দিয়ে আভিজাত্য, অন্যদিকে সৌম্য অবয়ব আর প্রশান্ত চেহারায় বেশ প্রজ্ঞার একটা ছায়া। সেই প্রজ্ঞার মাঝখান থেকে কালোপট্টি বাঁধা একটা চোখ যেন চাঁদের বুকে কলঙ্কের মতো।

‘কাপ্তান পট্টবর্ধন!’ বিস্ময়ের সঙ্গে অনুধাবন করল খুশির একটা জোয়ার যেন তার ভেতর থেকে উদ্বেলিত হয়ে উঠে আসছে, একেবারে ঠিক বুকের ভেতর থেকে। ‘কাপ্তান, তুমি এইহানে আইলা ক্যামনে?’

‘ভুল প্রশ্ন করলা, কিরান,’ বলেই সে তার দিকে এগিয়ে যাওয়া কিরানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘আমি এইহানে শুরু থেইকাই ছিলাম। বলতে পার আমার কারণেই তুমি এইহানে, কাপ্তান পট্টবর্ধন নিজের চওড়া ছাতির সঙ্গে ক্রমাগত পিষে চলেছে কিরানকে।

‘মানে ঠিক বুঝলাম না,’ কিরান নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কৌতূহলের সঙ্গে জানতে চাইল। ‘তুমি শুরু থাইক্কা মানে?’ কিরানরা যেই জাহাজের হয়ে মোঘল বাহিনীর জন্য কাজ করত সেই জাহাজের মূল চালক ছিল পট্টবর্ধন।

‘চল, ভেতরে যাইতে যাইতে কথা কই। তুলারামের সঙ্গে বেহেজ করলেও সে কথা কিন্তু ভুল কয় নাই,’ বলে সে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তুলারামকে ইশারায় কিছু একটা বলল। তারপর রহমত চাচার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে থাকা গোমেজকে ইশারা করল গুহার দিকে এগোতে। কিরান খেয়াল করল তুলারামের লাঠিয়াল বাহিনীর লোকেরা পাহারার উদ্দেশে গুহার চারপাশে লুকিয়ে গেল। এমনকি ওরা ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা আলগা ঝোপের চাঁদোয়া বসিয়ে দেওয়া হলো গুহাটার ছোটো প্রবেশপথের মুখে। এত ঢাক গুড়গুড় কেন ঠিক বুঝতে পারছে না কিরান। হচ্ছেটা কী এখানে?

‘কাপ্তান, তুমি কিন্তু এহনো আমারে ঠিক কও নাই, ব্যাপারটা কী?’ গুহার ভেতরে ঢুকে সরু প্রায় অন্ধকার প্রবেশপথ ধরে পট্টবর্ধনের পিছু পিছু হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছে কিরান। আধো অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না, ওরা আসলে এগোচ্ছে কোনদিকে। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে কিরান জানতে চাইল, ‘আমরা যাইতাছি কই?’ কিরান দেখল গুহার ভেতরের পথেও পাহারাদার আছে।

কিরান আবারও কিছু একটা জানার জন্য প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কাপ্তান পট্টবর্ধন ওকে চুপ থাকার ইশারা করল। আরেকটু এগোতেই ওরা গোলমতো একটা জায়গায় এসে পৌছাল। জায়গাটা পাহাড়ের ভেতরেই কোথাও হবে। ওপর থেকে পাথরের ফাঁক গলে চিলতে আলো আসছে। ওখানে নানা ধরনের কাঠের বাক্স সাজানো। তুলারামকে সামনে এগোতে ইশারা করে কিরানকে ওখানে গিয়ে বসার ইশারা করল সে, তারপর নিজেও বসে পড়ল একটা কাঠের বাক্সের ওপরে।

কিরান নিজে বসে, ওর পাশের বাক্সে গোমেজ আর রহমত চাচাকে বসার ইশারা করল। ‘কেমন আছিস, কিরান?’ পট্টবর্ধন কিরানদের জাহাজের কাপ্তান ছিল, মোঘল সেনাবাহিনীর জন্য ব্যাপারটা বিরলই বটে। কারণ যেখানে বেশিরভাগ জায়গাতেই মুসলমান সেনাপতি, সেখানে পট্টবর্ধনের মতো একজন নিম্নবর্ণের হিন্দুর জন্য একটা জাহাজের কাপ্তান হওয়াটা কঠিনই ছিল বটে। তবে পট্টবর্ধন আর কিরানদের দলে হিন্দু-মুসলমান, জাতপাত এসব নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিল না। কিরান ছিল পট্টবর্ধনের ঠিক ওপরের অবস্থানে আর একারণেই লোকসম্মুখে কিরানকে তুমি ডাকলেও নিজেরা কথা বলার সময়ে তাকে সবসময় তুই বলেই ডাকত সে।

‘ভালো আছি,’ কিরান হাসিমুখে বলে উঠল। ‘তুমি কেমন আছ? এত বছর কই ছিলা তুমি? তার চেয়ে বড়ো কথা তুমি এইহানে কেমনে?’

পট্টবর্ধন হেসে উঠল। ‘শরীরটা খানিকটা ঢিলা অইলেও তুই আগের মতোই আছোস। সব বুঝতে অইবো তোর,’ বলে কিরানের পিঠ চাপড়ে দিল সে। ‘শোন, চাঁটগাওয়ের ব্যবসায়ীরা পর্তুগিজ দস্যু সিলভেরা আর রোসাঙ্গ রাজের পিছে লাগার পরিকল্পনা অনেক দিন ধইরাই করতাছিল। কারণ অগো অত্যাচার দিন দিন মাত্ৰা ছাড়ায়া গেছিল। কিন্তু মধ্যিখানে দিল্লির কারণে সম্রাট সুজারে বাঁচাইতে গিয়া রোসাঙ্গের রাজারে কেউ কিছু কয় নাই। কিন্তু এরপরে ওরা যা করল,’ বলে সে আনমনেই আরাকানে ঘটে যাওয়া বীভৎস ঘটনাটা মনে করে মাথা নাড়ল একবার। ‘এরপরেই সবাই ঠিক করে সিলভেরা আর রোসাঙ্গরে ঠিক করতে অইবো,’ বলে সে একটা হাত তুলে দেখাল কিরানকে। ‘আর ঠিক এই জায়গাতেই বহু আগেই তোর কথা প্রস্তাব কইরা গেছিল তোর বাপে। আর এরকম কিছু যদি ঘটে তয় আমারে আগে থাইক্কাই সে কয়া গেছিল তোরে কামে লাগাইতে। আর তাই…’

‘তারমানে যে খেলা শুরু অইতে যাইতাছে সেই খেলার টাট্টু তুমি আগে থাইকাই ছিলা,’ বলে সে আনমনে মাথা নাড়ল। ‘রহমত চাচারেও নিশ্চই তুমিই আনছো?’

‘হ, ওর রান্না না অইলে চলবে, ক?’ বলে সে হেসে উঠে কিরানের পিঠে হাত রাখল। ‘কিরান, যে খেলা শুরু অইতে যাইতাছে। মনে রাহিস খেলা বড়ো অইতে অইতে অনেক বড়ো অইয়া গেছে। আর সবাই তোর দিকেই এহন তাকায় আছে। চল তোরে অনেক কিছু দেখানির আছে,’ বলে সে আবারও কিরানের পিঠ চাপড়ে দিল। আমরা অনেক দিন ধইরাই প্রস্তুতি নিতাছিলাম। চল সব দেহাব তোরে। এইগুলা দেখলে আমার বিশ্বাস তুই অনেক বেশি সাহস পাবি।’

কিরান উঠে দাঁড়িয়ে গোমেজ আর রহমতকে ইশারা করে নিজে এগোতে লাগল পট্টবর্ধনের পিছে পিছে। ওরা আধ-চিলতে জায়গাটা থেকে সরে এসে আরেকটা চিকন পথ ধরে ছোট্ট একটা নালা পার হলো। তারপর বাঁক ঘুরতেই কিরান যা দেখতে পেল তা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না সে। ওর সামনে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। কিরান যখন শুনেছিল ওরা অনেকদিন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলো দস্যুদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য। কিরান ভেবেছিল বড়োজোর কিছু বড়ো নৌকা আর সাধারণ অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে ওরা। কিন্তু সামনে যা দেখতে পাচ্ছে তা দেখে এই প্রথমবার সে আকরাম বেগ এবং পট্টবর্ধনের বয়ান করা ঘটনার গুরুত্ব পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারল।

‘সৰ্বনাশ! এত দেহি,’ বলে সে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

‘পছন্দ অইছে তোর?’ বলে হেসে উঠল পট্টবর্ধন।

‘অইছে মানে,’ বলেই সে প্রায় ছোটো বাচ্চাদের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠল।

ওরা এখন যে-জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে সেটাকে দুই পাহাড়ের আড়ালে অবস্থিত পানির সঙ্গে সংযুক্ত একটা খাঁড়ি বলা যেতে পারে। তবে জায়গাটা খাঁড়ি হলেও একসময় সেটার পরিব্যাপ্তি বৃদ্ধি করে একটা ছোটোখাটো বন্দরের রূপ দেওয়া হয়েছে। কিরান শুনেছিল একসময় এই জায়গাটায় জাহাজ মেরামতির কাজ চলতো। কিরান বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বুঝল, আগের সেই কাঠামোর ওপরেই নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে বড়ো আকারের ভিত। আর সেখানেই এখন চলছে বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ।

কিরান এই মুহূর্তে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পরপর সারি দিয়ে অর্ধেক পানি আর অর্ধেক মাটিতে মেরামত কাঠামোর ওপরে বসানো আছে তিনটা বিরাট আকারের জাহাজ। তিনটা জাহাজের কাঠামোই পরিষ্কার বলে দেয় গত বেশ কিছুদিন ধরে মেরামতের কাজ করে একেবারে ঝকঝকে করে তোলা হয়েছে জাহাজ তিনটাকে। তিনটের ভেতরে দুটো জালিয়া আর একটা যুদ্ধ জাহাজ। কিরান দেখে অনুমান করলো একেকটা জালিয়া কমপক্ষে ত্রিশ দাঁড়ির কম হবে না। সেই সঙ্গে পাল তো আছেই। আর যুদ্ধ জাহাজটাকে আক্ষরিক দানব বলা চলে। কমপক্ষে আশি বা নব্বই হাতের জাহাজ।

‘হায় খোদা, এ তো একেবারে যুদ্ধের আয়োজন,’ কিরান আপনাতেই বলে উঠল।

যুদ্ধ করতে হলে যুদ্ধের আয়োজনই তো দরকার,’ বলে পট্টবর্ধন কিরানের পাশে এসে একটা জালিয়ার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলে উঠল, ‘পুরোপুরি যুদ্ধের সাজে সাজানি অইছে,’ বলে সে কিরানের দিক ফিরে বলে উঠল, ‘ত্রিশ দাঁড়ির নৌকা। একবার দাঁড়িরা দাঁড় ফালাইলে আর পালে হাওয়া লাগলে তিরের চায়াও জোরে ছুটবো। আর এইটা,’ বলে সে কিরানকে নিয়ে এগিয়ে গেল জাহাজটার দিকে। ‘এইটা থাকব সবার সামনে। সব ছিড়াবিড়া ঢুইক্কা যাইব ভিতরে।’

‘বুঝতে পারতাসি তুমরা শক্ত অইয়াই নামছ।’ কিরান হঠাৎ তামাকের তৃষ্ণা অনুভব করতে লাগল। ‘সিলভেরার কিরুদ্ধে নামতে অইলে কিন্তু কামান লাগব, বন্দুক লাগব আর লাগব অনেক অনেক গোলাবারুদ,’ কিরান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে পট্টবর্ধনের দিকে। ‘তুমগো প্রস্তুতি কেমন?

পট্টবর্ধন জবাব দেওয়ার আগে পেছন থেকে আবারও তুলারামের গলা শোনা গেল। ‘জাহাজিরে আমগো অস্ত্রের কোষাগারডা দেহাও, কাপ্তান সায়েব,’ বলে সে হেসে উঠল। তার হাসিতে যোগ দিল পট্টবর্ধন।

‘তুমি ঠিকই কইছো কিরান, চলো,’ বলে সে কিরান আর তুলারামকে নিয়ে চলে এলো খাড়ির মতো জায়গাটার একপাশে। সেখানে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটা গুহার মতো জায়গাতে দেয়ালে ঝোলানো সারি সারি অস্ত্র। কিরান আরো একবার হাঁ হয়ে গেল অস্ত্রের বাহার আর পরিমাণ দেখে।

‘কী, মুখ বন্ধ অয় না ক্যান জাহাজি?’ ওর পাশ থেকে স্তম্ভিত কিরানকে দেখে সে বেশ মজা পাচ্ছে। কিরান অস্ত্রাগারের দিকে এগিয়ে দেখতে পেলো একপাশে কয়েকটা কামান সাজানো, সেই সঙ্গে কাঠের বাক্সে অসংখ্য গোলা।

‘এইগুলা পাঁচ আঙ্গুইলা কামান এইহানে, আর আরো নয়টা আছে তিন জাহাজে।’

‘বন্দুক কী পরিমাণ আছে?’ কিরান হাঁটতে হাঁটতে পাশ থেকে একটা লম্বা নলের গাদা বন্ধুক তুলে নিল।

‘গাদা বন্দুক আছে পঁচিশটা। তির, ধনুক অসংখ্য। প্রত্যেকের লাইগা দুই নলাও আছে,’ স্তূপ করা ছোটো নলের হাতবন্দুক দেখাল। ‘আর আছে এইগুলা। মাটিতে স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে অসংখ্য তলোয়ার আর চোখা নলের বর্শা। কিরান সেদিকে এগিয়ে বিশেষ জিনিস তুলে নিল।

পট্টবর্ধনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘এই জিনিসও আনছো?’ জিনিসটার চকচকে বাঁশের শরীর প্রায় ছয় ফিট লম্বা কিন্তু ওটার মাথায় সজারুর কাঁটার মতো এক ঝাঁক কাঁটা বসানো। এটাকে ছুঁড়ে শত্রুকে গেঁথে ফেলার জন্য এর চেয়ে ভালো অস্ত্র আর হয় না। স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলে কোঁচ।

‘মাছ না, এইবার কোঁচ দিয়া দস্যু শিকার অইবো। তোরে আরেকটা জিনিস দেহাই,’ বলে পট্টবর্ধন ওকে নিয়ে এলো এককোণে। ওখানে পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করানো সাদা লাঠির মতো বেশ কিছু জিনিস। কিরান ওগুলো দেখে খুশি হয়ে উঠল

‘বাহ বাইদও আছে?’ বলে সে সাদা লাঠির মতো জিনিসটা তুলে নিল নিজের হাতে। তারপর দুইবার পাক খাইয়ে এক হাতে ধরে ওজন পরখ করে দেখল জিনিসটার।

‘কী কস, কিরান?’ পট্টবর্ধনের মুখে হাসি। ‘পানির দূরপাল্লার যুদ্ধে নামব আর বাইদ থাকব না?’ বলে হাসতে লাগল সে। বাইদ জিনিসটা দেখতে একেবারেই নিরীহ, পরিষ্কার সাদা একটা লাঠি। কিন্তু একটু ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলে বোঝা যায় ওটার এক মাথা একেবারে সুচের মতো চোখা করা হয়েছে। আর ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্য মাথায় খুব সাবধানে পরানো হয়েছে সাদা ময়ূরের পেখম। বাইদ বানানো হয় সুপারি গাছের কাণ্ড লম্বা করে কেটে ঘষে ঘষে একেবারে সরু করে। সেই সঙ্গে চোখা করা হয় ওটার এক মাথা। বাইদ অস্ত্রটা শক্তিশালী একজন মানুষ ছুঁড়ে মেরে অসম্ভব দূরত্ব পার করতে পারে। যে-কারণে দূরপাল্লার যুদ্ধে এইটা হয়ে ওঠে ভয়ংকর এক অস্ত্র। এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে ওটাকে ছুঁড়ে দিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করার রেওয়াজ অনেক পুরনো। বিশেষ করে বাইদ ছুঁড়েই যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিরান খুশি হয়ে বাইদটা নামিয়ে রাখল।

সে ঘুরে দাঁড়াবে হঠাৎ পট্টবর্ধন এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরে ফেলল। ‘কিরান, এইবার সিলভেরা হারামজাদারে আমরা ছাড়ব না।’

তার অবশিষ্ট চোখটাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আবার একইসঙ্গে ভেজা একটা ভাব। কিরানের মনে পড়ে গেল সিলভেরা একহাতে মানুষটার গলা চেপে ধরে অন্য হাতে ছুরি দিয়ে বের করে এনেছিল পট্টবর্ধনের চোখটা। ‘কথা দে আমারে, কিরান ওর খুলির ভেতরে এইবার একটা শিসা তুই ঢুকায়া দিবি, কথা দে।’

কিরান কিছু না বলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর যখন মুখ খুলল তার চোখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। ‘আমি কথা দিলাম।’

‘অনেক শান্তি পাইলাম, কিরান,’ বলে সে চারপাশটাকে হাতের ইশারায় দেখাল। ‘তোর কি মনে হয়, প্রস্তুতি ঠিক আছে?’

কিরান আনমনে মাথা নাড়ল। ‘সবই ঠিক আছে, তয় জিনিসের কোনো দাম নাই যদি জিনিস ব্যবহার করার লোক না থাহে। আমি বেদুর খবর বাইর করার জন্য লোক লাগাইছি। ওরে আমার লাগব। তার চেয়ে বড়ো কথা গোলন্দাজে লাগব আমার,’ শেষ নামটা সে বেশ সাবধানে উচ্চারণ করল।

তারপরও নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পট্টবর্ধনের চোখটা যেন জ্বলে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *