অধ্যায় বারো – বর্তমান সময়
গুলশান, ঢাকা
চাচার সঙ্গে কথা বলার সময় কীভাবে কী হয়ে যায় বুঝতে পারে না কিরান। তাও ভালো আজ অন্তত তৰ্ক হয়নি। তাই একটু হলেও স্বস্তি বোধ করছে ও।
চাচার কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে বাইরে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল শারিয়ার। শীতের সকাল হওয়ার কারণে ভোরের আলোর সঙ্গে সঙ্গে ছটা ছটা উজ্জ্বল রোদ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পুরো লন জুড়ে। কিন্তু সেই আলোর ছটাকে ম্লান করে দিয়ে আরো অধিক উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে লনের একপাশের রাস্তায় একটা সাদা পুলিশি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার হাসি।
‘বাহ, তুই গোঁফ রেখেছিস দেখি,’ বলে সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বিশেষ একটা ভঙ্গি করল। ‘তোকে দেখতে ‘টেকিং অব পেলহাম’ সিনেমার জন ট্রাভোল্টার মতো লাগছে,’ হাসতে হাসতে বলে উঠল সে।
‘আরে, মৌসুমি আপা। এতদিন পর দেখা। এটা কী বললে তুমি! আমি কি অতো বুড়ো আর টাকলা নাকি?’ বলে তার সামনে গিয়ে প্রায় জড়িয়ে ধরার উপক্রম করল শারিয়ার।
‘শোন, স্মার্টনেস জিনিসটা বয়স বা মাথার চুল দিয়ে নির্ধারণ হয় না। ওটা ধারণ করার ব্যাপার,’ কপট রাগের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘আর শোন, এসব হাগটাগ পরে হবে। আগে বল আমার গিফট কই?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল পুলিশ ব্যুরো অব স্পেশাল ইনভেস্টিগেশনের অ্যাডমিন অফিসার এবং স্পেশাল উইংয়ের প্রধান সৈয়দ হাবিব আনোয়ার পাশার সেক্রেটারি মৌসুমি সারোয়ার। ‘তানভীর কিছুই না এনে শুধু চকলেট দিয়ে কাজ চালিয়েছে। তুই অমনটা করলে কিন্তু আমি মানব না, শারিয়ার আর তানভীর দুই বন্ধুর জন্য মৌসুমি সারোয়ার হলো ওদের বড়ো বোনের মতো। আসলে বলা চলে বোনের চেয়েও বড়ো।
শারিয়ার তার দিকে ফিরে একটা হাতে কান ধরল, ‘সরি, আপা। একেবারেই সময় পাইনি, তুমি যেটা বলেছিলে সেটা আনা সম্ভব হয়নি।’
‘মানে তুই আনিসনি?’ প্রায় রাগের সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল মৌসুমি।
‘আরে এত অস্থির হলে হয়?’ বলে সে হাতে ধরে থাকা প্যাকেটটা মৌসুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল। ‘এটা এনেছি তোমার জন্য।’
‘দেখি,’ বলে প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ওটা খুলে হাঁ হয়ে গেল মৌসুমি। ভেতরে সবুজ পান্না বসানো একটা নেকলেস। জিনিসটা দেখে প্রথমে অবাক হলো মৌসুমি, তারপর একটু অস্বস্তির সঙ্গে বলে উঠল, ‘শারিয়ার, এত দামি জিনিস তুই এনেছিস! এটা, এটা আমি নিতে পারব না,’ মৌসুমির গলায় চূড়ান্ত অস্বস্তি।
এবার শারিয়ার ওর দিকে রাগের সঙ্গে ফিরে তাকাল। ‘ফালতু কথা বলো না তো,’ বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল ও। ‘গাড়িতে ওঠো, দুনিয়ার আলাপ আছে। ট্রেন ছাড়তে কত সময় বাকি?’ বলে সে গাড়িতে উঠে রাগের সঙ্গে বলে উঠল। ‘বুড়ো হারামজাদা নিশ্চয়ই আমাকে ট্রেনে পাঠাচ্ছে নিজের কুমতলব চরিতার্থ করার জন্য। আমার ওপরে খেপেছে সেটার প্রতিশোধ নিশ্চয়ই।’
‘আর তুই মনে হয় কাজটা খুব ভালো করেছিস?’ মৌসুমি এখনো পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ হতে পারছে না। শারিয়ার, তুই এত পাগলামি করিস ক্যান? তোরই ক্লোজ ফ্রেন্ড তানভীর একেবারে ধীর-স্থির। আর তুই পুরো উলটো।’
‘আচ্ছা, আগে বলো তানভীরের অবস্থা কী এখন? সুস্থ হয়ে উঠেছে?’
‘সুস্থ তবে ও দুই হপ্তা ধরে সিলেটেই আছে। ওখানে অনেক কাজ ওর এখন, ‘ মৌসুমি বলে উঠল। যদিও বেচারা প্রথম মিশনে অনেক ভুলভাল করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও কাজটা খুব দারুণভাবে সমাপ্ত করতে পেরেছে,’ মৌসুমি ব্যাগ রেডি করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
‘আচ্ছা, এখন বলো পরিস্থিতি কী?’ এতক্ষণ এমনি কথা হচ্ছিল এবার শুরু হতে যাচ্ছে কাজের ব্রিফিং। হঠাৎ এত ঢাক গুড়গুড় কেন? হয়েছেটা কি আসলে চট্টগ্রামে?’
‘আগে এটা ধর,’ বলে সে একটা প্লাস্টিকের ফোল্ডার এগিয়ে দিল শারিয়ারের দিকে। আমি তোকে সংক্ষেপে মুখে যা বলব তার সব বিস্তারিত পাবি এই ফাইলে। ট্রেনে যেতে যেতে ফাইলটা খুব ভালোভাবে পড়ে নিবি। সম্ভব হলে স্পটে যেতে যেতে নষ্ট করে ফেলবি এটা পড়ার পর, শারিয়ার ফাইলটা নিজের হাতে নিয়ে একবার পলক বুলিয়ে নিয়ে পাশে রেখে দিল।
‘এটা হলো তোর ফাস্ট প্যাক,’ বলে ওর দিকে একটা মোটামুটি ভারী ট্রাভেল ব্যাকপ্যাক এগিয়ে দিল মৌসুমি। শারিয়ার একবার মাথা নেড়ে জিনিসটা নিয়ে নিল। যদিও ওর মন চাচ্ছিল একবার খুলে দেখতে। কিন্তু সেটা না করে ওটার একপাশ খুলে সেই প্লাস্টিকের ফোল্ডারটা রেখে দিল ওটার ভেতরে। ফাস্ট প্যাক জিনিসটা খুবই কাজের একটা জিনিস। ওদের অফিসে প্রতিটা এজেন্টের জন্য একটা করে এরকম প্যাক রেডি থাকে। প্রতিটি এজেন্টের মাপে দুই সেট কাপড় থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় প্রায় সব উপাদান থাকে এর ভেতরে। একেবারে হাতকড়া থকে শুরু করে অস্ত্র, ওষুধ, পর্যাপ্ত টাকা, টুল কিট, মেডিসিন প্রায় সবই আছে এতে। মানে একজন এজেন্ট দেশের ভেতরে অপারেট করতে গেলে যা যা লাগতে পারে তার সবই এক সেট করে রাখা থাকে এই ব্যাগে। যেকোনো এজেন্ট খুব দ্রুত যেন এটা নিয়ে মুভ করতে পারে তাই এটাকে ফাস্ট প্যাক বলে।
‘তোর টিকিট ব্যাগের সামনের পকেটে আছে বলে ও এক মুহূর্ত দেখল শারিয়ারকে। ‘তুই তো হালকা ব্লেজার পরে বেরিয়েছিস, আচ্ছা ওতে কাপড় আছে। চট্টগ্রামে ঠান্ডা অনেক বেশি। আর তোর মেশিন ঠিক আছে তো?’
ডিপেন্ড করে তুমি কোনো মেশিনের কথা বলছো সেটার ওপরে,’ শারিয়ার হোলস্টারে রাখা পিস্তলটা চেক করতে করতে হেসে উঠল।
মৌসুমি একটা চড় তুলল, ‘বড়ো বোনের সামনে ফাজলামো,’ বলে সে যোগ করল, ‘শোন, ট্রেনে তোর সঙ্গে একজন মিট করবে তোকে অস্ত্র আর ট্র্যাকার বুঝিয়ে দেবে।’
‘বুঝেছি বুঝেছি,’ শারিয়ার দাপকে উঠল। ‘এখন বলো চট্টগ্রামে আসলে হয়েছেটা কী?’
‘যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ একটা অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা,’ মৌসুমি খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল। ‘চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের, মানে সোজা কথায় বলতে গেলে বেশ কিছু বড়োলোকের পোলাপান মদ খেয়ে পার্টি করছিল এমন সময় তাদের ভেতরে কেউ একজন প্রস্তাব করে বসে বৃষ্টির ভেতরে ড্রাইভে যাওয়ার। ব্যস, বাইরে বেরিয়ে পড়ে। ওরা যখন পতেঙ্গা রোডে ড্রাইভ করছিল সম্ভবত ড্রাঙ্ক অবস্থায় বৃষ্টির ভেতরে অনেক বেশি গতি থাকায় কন্ট্রোল করতে না পেরে একজন মানুষকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে।
‘স্পট ডেড?’ শারিয়ার স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইল।
‘হুমম, সম্ভবত স্পটেই মারা যায় বয়স্ক লোকটা,’ বলে মৌসুমি থামল।
শারিয়ার অপেক্ষা করছে পরবর্তী কথা শোনার জন্য কারণ ও জানে এটা কোনো কেস হতে পারে না। ‘কিছু বড়োলোকের ছেলেমেয়ে এটা করেছে সেটা যেহেতু জানো তোমরা তারমানে ওরা ধরা পড়েছে, রাইট?’
‘রাইট, ওরা ওখানেই ধরা পড়ে। মানুষটাকে চাপা দিয়ে ওরা আসলে কী করবে বুঝতে পারছিল না। এমন সময়ে একেবারে পুলিশের একটা টহল কারের সামনে পড়ে যায়।’
‘এখন কি ওদেরকে ইন্টারোগেশনের জন্য স্পেশাল ট্রেনিং অফিসার শারহান শারিয়ারকে পাঠানো হচ্ছে?’ শারিয়ার দুষ্টুমি করে বলে উঠল।
‘মূল ঘটনা এটা নয় বালক, ঘটনা ঘটতে শুরু করে এরপর,’ মৌসুমি ফোড়ন কাটার মতো করে বলে উঠল। ‘প্রথম ঘটনা হলো, মানুষটাকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিয়ে পুলিশ যখন আশপাশে দেখতে শুরু করে প্রথমেই তারা খুব অবাক হয় এটা ভেবে যে, মানুষটা ওখানে এসেছে কোথা থেকে। কারণ আশপাশে বাড়িঘর কম এবং বেশ দূরে দূরে। লোকটা ঘুমানোর পোশাক পরে ছিল। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে ঘুমানোর পোশাক পরা একজন মানুষ বৃষ্টির ভেতরে ওখানে আসলে কী করছিল? পুলিশ খুঁজতে শুরু করে মোটামুটি কাছে যে বাড়িটা পায় সেখানে গিয়ে দেখে ওটা চট্টগ্রামের বড়ো একজন ব্যবসায়ীর বাড়ি কিন্তু তারা সপরিবারে বাইরে থাকে, এটা অবশ্য পরে জেনেছি আমরা। কিন্তু সে-বাড়িতে খুঁজতে গিয়ে পুলিশ আবিষ্কার করে মানুষটা ওই বাড়িতেই থাকত এবং বাড়ির বেজমেন্টে থাকত, সম্ভবত ইল্লিগ্যালি। সে সম্ভবত কেয়ারটেকারকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে থাকত। সেই লোকটার থাকার জায়গা খুঁজতে গিয়ে পুলিশ বেইজমেন্টে গিয়ে দেখতে পায় সেখানে সে বেশ সংসার সাজিয়ে বসবাস করছে এবং সে যে ওখানে বেশ লম্বা সময় ধরে থাকছে সে- ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। ওই বেজমেন্টে বসে সে কিছু একটা নিয়ে গবেষণা করছিল।’
‘তাই নাকি?’ শারিয়ার এই প্রথমবারের মতো একটু আগ্রহ পেল, এতক্ষণ তার কাছে ভীষণ বিরক্ত লাগছিল।
‘কারণ লোকটা সেই বেইজমেন্টেই তার থাকার জায়গাতে ছোটো একটা স্টাডির মতো বানিয়েছে যেখানে দেয়ালে এত বিস্তারিত গবেষণার মতো দেয়ালচিত্র এবং পোস্টার বানানো হয়েছে যে ওটা দেখে পুলিশের মাথা ঘুরে গেছে। তোর ফাইলে আছে তবুও এটা দেখ,’ বলে মৌসুমি তার মোবাইল এগিয়ে দিল শারিয়ারের দিকে।
ছবিটা দেখে আক্ষরিক অর্থেই শারিয়ারের চোখ কপালে উঠে গেল। ‘মাই গড, একজন মানুষ এটা করেছে,’ ছবিটাতে দেয়ালজোড়া মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর পেইন্টিংয়ের মতো গবেষণাপত্র ছড়ানো। ‘এই লোক কোন ফিল্ডের মানুষ?’
‘এইখানে আসে দ্বিতীয় মজার ব্যাপার,’ বলে মৌসুমি হেসে উঠল। ‘একদিকে যখন পুলিশ অবাক হয়ে লোকটার স্টাডি দেখছিল অন্যদিকে একই সময়ে লোকটাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানে ডিউটি ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। কিন্তু এরপরে সেখান থেকে মানুষটার লাশ চুরির প্রচেষ্টা চালানো হয়।’
বলো কী? কে এই লোক?’ কথাটা আপনাতেই বেরিয়ে গেল শারিয়ারের মুখ দিয়ে।
‘পেশায় সে একজন আর্কিওলজিস্ট এবং কনটেম্পেরারি সময়ে উপমহাদেশের সেরা আর্কিওলজিস্টদের একজন। নাম তার প্রফেসর ডক্টর সুলতান। মজার ব্যাপার হলো মানুষটা একই সঙ্গে খুব বিখ্যাত আবার কুখ্যাতও ছিল।’
‘কেন?’
‘কারণ সে তার কাজের জন্য যেমন বিখ্যাত একই সঙ্গে বারবার সে বাংলাদেশ, ভারতের সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে গণ্ডগোলে জড়িয়েছে। সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে সরকারের সঙ্গে মতবিরোধে গেছে এবং একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে কিছু প্রজেক্ট নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধ হলে বাংলাদেশ সরকার তার আর্কিওলজির লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। এরপর থেকে এই লোককে কেউ খুঁজে পায়নি। একরকম বলতে গেলে সে হারিয়ে যায়।’
‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত,’ শারিয়ার ছবিটার দিকে আরেকবার দেখে নিয়ে মোবাইলটা ফেরত দিল মৌসুমিকে। ‘একজন বিখ্যাত প্রফেসর যে কিনা তার লাইনের সেরা লোক সে সরকারের সঙ্গে গণ্ডগোল করে হাইবারনেশনে চলে গেল এবং তিন-চার বছর গায়েব থাকার পর তার লাশ পাওয়া গেল চট্টগ্রামের এক রাস্তায়। এখানে প্রশ্ন হলো দুটো। এক, মানুষটা এই ক’বছর করছিল কী?’
‘সে যে বড়ো কিছু একটা করছিলে সেটা তো ছবি দেখেই ধারণা করা যায়,’ মৌসুমি বলে উঠল।
‘প্রশ্ন নম্বর দুই, সরকারের সঙ্গে তার গণ্ডগোল বেঁধেছিল কী নিয়ে এবং সরকারের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে সে কার কাছে গেল এবং সে কিংবা তারা তাকে কীভাবে সাহায্য করল এবং বিনিময়ে কী চাইল?’
মৌসুমি একটা আঙুল তুলল শারিয়ারের দিকে। ‘তুই একটা আস্ত হারামি এবং বেয়াদব। কিন্তু তবুও তোকে আমি পছন্দ করি কেন জানিস? কারণ তুই একেবারে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গাটা খুব দ্রুত ধরতে পারিস,’ বলে সে হেসে উঠল, সঙ্গে শারিয়ারও। ‘এই ব্যাপারটাই বলব এখন। যে-কারণে তোকে ডেকে পাঠানো হলো এই মিশনে এবং পাশা স্যার পুলিশ সিআইডি আর সিবিআইয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে কেসটা আমাদের কাঁধে নিয়ে এলো সেটার পেছনে একটা বড়ো কারণ হলো ওই বেইজমেন্টে এমন কিছু ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো আর্কিওলজিক্যাল চোরাচালানি সংস্থার সংযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে এদের কখনো বাংলাদেশে অপারেট করতে শোনা যায়নি। কিন্তু বেইজমেন্টে পাওয়া ডকুমেন্ট থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে প্রফেসর সুলতানের সঙ্গে এদের যোগাযোগ ছিল।’
‘এবার বোঝা গেল কাকু সরকারের সঙ্গে বিফল হয়ে কার কাছে গেছিল,’ ওর অনুমান মিলে যাওয়াতে আনমনেই হেসে উঠল শারিয়ার।
‘ঠিক, খুব সারফেস লেভেল থেকেই এটা ধারণা করা যাচ্ছে যে, রেলিক এবং নেক্রপোলিস নামক দুটো আন্তর্জাতিক চোরাচালানি সংস্থার দুটো অথবা যেকোনো একটার সঙ্গে অন্তত প্রফেসরের যোগাযোগ ছিল এবং ওদের হয়ে সম্ভবত সে বড়ো কিছু একটার প্ল্যান করছিল। খুব জোর সম্ভাবনা এ রকম যে, ওরাই এই লোকটাকে সব ধরনের সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল এবং মানুষটার মৃত্যুর পর সম্ভবত ওরাই তার লাশ চুরি করতে চেয়েছিল যাতে তার পরিচয় আমরা বের করতে না পারি অথবা অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে,’ টানা কথা বলে একটু দম নিল মৌসুমি।
এরপর সে যোগ করল, ‘এখন চট্টগ্রামে গিয়ে তোর কাজ হবে এটা বের করা যে, লোকটা আসলে ওখানে কী করছিল? তার যদি আসলেই আন্তর্জাতিক কোনো চোরাচালানি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ থেকে থাকে তবে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা যে ওসব সংস্থাগুলো আসলে আমাদের দেশে কতটা অ্যাকটিভ এবং,’ বলে সে একটা হাত তুলল। ‘ওইদিন রাতে ওই লোকটা স্রেফ ঘুমানোর পোশাকে ওখান থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির ভেতরে হাইওয়েতে আসলে কী করছিল।’
‘বুঝতে পেরেছি,’ মাথা নাড়ল শারিয়ার।
‘না, পারিসনি,’ বলে মৌসুমি সাবধান করে দিল শারিয়ারকে। ‘তুই জানিস না তানভীরকে আমরা যখন সিলেটে পাঠাই ওর মতো অনভিজ্ঞ একজন অপারেটরকে ওখানে পাঠানোর পেছনে কারণ ছিল কেসটা অনেকটাই সাদামাটা মনে হচ্ছিল আমাদের কাছে। কিন্তু তানভীর ওখানে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় সেটা বলার মতো নয়। এর কয়েকদিন পরেই ইন্সপেক্টর বাশার নামে এক পুলিশ অফিসারের প্রায় কাছিকাছি অভিজ্ঞতা হয় ময়মনসিংহে। উভয় ক্ষেত্রেই মূল লোকগুলোর সংশ্লিষ্টতা পওয়া গেছে আন্তর্জাতিক অ্যান্টিক চোরাচালানি সংগঠনের সঙ্গে। ভেবে দেখ, আমরা যেসব সংগঠনের কথা জানতামও না, ওরা স্রেফ আমাদের নাকের ডগায় বসে এতদিন অপারেট করছিল। ওরা আর কী কী করছে আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই এই ব্যাপারে। আমার ধারণা তোর এই কেসটা যদি সত্যি সত্যি ওদের সঙ্গে কানেকটেড হয়ে থাকে তবে একদিকে তোর কোসটা ভীষণ জটিল হতে যাচ্ছে, অন্যদিকে আবার এই কেসটার মাধ্যমেই আমরা হয়তো একটা ধারণা পাবো ঘুমন্ত অজগর আসলে কতটা বড়ো। বুঝেছিস?’
শারিয়ার মাথা নাড়ল।
‘সেই সঙ্গে তোর এই কেসের সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের পাশা স্যার ও তানভীরের বিশেষ টিম তৈরির ব্যাপারটাও। কাজেই শারিয়ার, আমার ভাই, খুব সাবধান; কোনো ভুল করা চলবে না তোর,’ মৌসুমির গলায় আকুতি।
‘আরে তুমি দেখি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ,’ বলে শারিয়ার হেসে উঠল ‘এখন একটা হাগ দাও, আমি বিদেয় নেই,’ বলে শারিয়ার মৌসুমির কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে ওর ফাস্ট প্যাক কাঁধে নিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে দেখল ট্রেন ছাড়তে আর খুব বেশি বাকি নেই। ও টিকিটের সঙ্গে নম্বর মিলিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার ট্রেনের সামনে এসে নির্দিষ্ট বগিতে চলে এলো। বিরাট বগিটার ভেতরে ছোটো- বড়ো বিভিন্ন আকারের কেবিন। প্রথম কেবিনটার সঙ্গে নম্বর না মিললেও ওটাতে উঁকি দিয়ে দেখল ওটা চার বার্থের কেবিন। ওটা হওয়ার প্রায় কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ও নির্দিষ্ট নম্বর মিলিয়ে তেরো নম্বর কেবিনের সামনে চলে এলো। নম্বরটা দেখে আনমনেই হেসে উঠল। এটা কোনো সতর্কবার্তা নয় তো। কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল এটা দুই বার্থের কেবিন। ভেতরে ঢুকে ও ব্যাগটা রাখতে যাবে এমন সময়ে একটু চমকে উঠে খেয়াল করল নিচের বার্থের এক কোনায় জানালার পাশে একহাতে মুখ ঢেকে একজন মানুষ ঘুমাচ্ছে। শারিয়ার একটু অবাক হয়ে কেবিনের নম্বরটা মেলাল ওর টিকিটের সঙ্গে।
ব্যাপার কী? নম্বর তো ঠিক আছে। দরজার হাতলে হাত রেখে জোরে টান দিল ও খোলার জন্য কিন্তু খুলল না ওটা।
ব্যাপার কী? দরজাটা জ্যাম হয়ে গেল নাকি? এসব ট্রেনের কোনো জিনিসের কোনো আগামাথা নেই। যেকোনো সময় এগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বরং প্রথমবারেই কাজ করলে অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হতো। শারিয়ার দরজার হাতল ধরে আবারও টান দিল জোরে। মনে মনে ভাবল, এরকম নতুন ট্রেনের দরজা এভাবে আটকে গেল। অবাক করার মতোই ব্যাপার।
‘ওইডা খুলত না, বাইরে থাইক্কা লাগায়া দেওয়া অইছে,’ পেছন থেকে বয়ষ্ক একজন মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে একটু অবাক হয়েই পেছন ফিরল শারিয়ার। আনমনেই ওর দৃষ্টি চলে গেল সিটের ওপরে রাখা ব্যাকপ্যাকটার দিকে। ওটার ভেতরেই ওর অস্ত্রটা রাখা আছে। জিনিসটাকে হাতের কাছে না রাখার কারণে নিজেকে একটু হলেও অভিশাপ দিল ও মনে মনে। যদিও এখনো ঝুঁকি অনুভব করার মতো কিছু হয়নি তবুও মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনিং আর অভ্যাসবশত সতর্ক হয়ে উঠেছে ও। আড়মোড়া ভাঙতে থাকা মানুষটার দিকে চোখ রেখে আপনাতেই শরীরটাকে খানিকটা বাঁকিয়ে চট করে সিটের দিকে খানিকটা সরে গেল ও। এতে করে দুটো ব্যাপার ঘটবে। একে তো মানুষটা যদি হঠাৎ ওকে আক্রমণ করতে চায় ওর দ্রুত নড়ার কারণে সেটা পারবে না, তার ওপরে শরীরটাকে বাঁকিয়ে ফেলাতে সম্ভাব্য টার্গেট হিসেবে একটু হলেও ছোটো হয়ে যাবে ও, সেই সঙ্গে সিটে রাখা ব্যাকপ্যাকটার দিকে খানিকটা এগিয়ে গেল। আরেকটু এগোলেই চট করে হাতের নাগালে চলে আসবে ওটা।
শারিয়ার অনেক কিছু কল্পনা করে ফেললেও আড়মোড়া ভাঙতে থাকা মানুষটার মধ্যে কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না। সে আড়মোড়া ভেঙে খুব তরল দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল শারিয়ারের দিকে। ‘ভাতিজার রিফ্লেক্স তো বালাই,’ বলে সে নিজের শার্টের বুক পকেটের দিকে হাত বাড়াল, সথে সঙ্গে আবারও নড়ে উঠল শারিয়ার।
‘আরে আস্তে,’ শারিয়ারকে নড়ে উঠতে দেখে আধবুড়ো মানুষটা প্রায় ধমকে উঠল। শারিয়ার অবাক হয়ে দেখল মানুষটা তার বুকপকেট থেকে একটা স্টিলের চকচকে বাক্স বের করে সেটা থেকে একটা পানের খিলি বের করছে। ‘কে আপনি? এভাবে…’
‘খারাও ভাতিজা,’ বলে সে গড়গড় করে একটা পাসকোড বলে গেল। ওটা শুনেই শারিয়ারের শক্ত হয়ে ওঠা স্নায়ু শান্ত হয়ে গেল। ‘কি এবার মাথা ঠান্ডা অইছে?’ বলে সে মৃদু হেসে উঠে শারিয়ারকে বসার জন্য ইশারা করল।
দুই হাত তুলে সারেন্ডারের ভঙ্গি করে হেসে উঠল শারিয়ার। মানুষটার বিপরীত দিকের সিটে বসতে বসতে বলে উঠল, ‘সরি, আমি এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারলাম না,’ হঠাৎ ট্রেনের বগিতে এই লোকটার আবির্ভাব এবং খানিকটা উত্তেজনায় শারিয়ার একটু চমকে গেছে। মনে মনে সে ভাবল একজন ট্রেইনড এজেন্ট হিসেবে এই উত্তেজনা তাকে একেবারেই মানায় না। আরো অনেক ঠান্ডা মাথায় এবং ফোকাসড হয়ে চিন্তা করতে হবে।
‘ভাতিজা যা কইতাছিলাম,’ বলে লোকটা তার হাতে ধরা পানের খিলিটা খুলতেই মিষ্টি জর্দার গন্ধে ভরে উঠল ট্রেনের ছোটো কামরাটা। ‘তুমার রিফ্লেক্স তো বালাই কিন্তু এত চট কইরা মাথা গরম কইরা ফালাও ক্যান?’ পানের খিলিটাকে ভাঁজ করে বেশ আয়েশের সঙ্গে সেটাকে মুখে পুরে দিল মানুষটা।
আর শারিয়ার একটু বিরক্তির সঙ্গে চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। কথা নেই বার্তা নেই, আধ বুড়ো পুরনো দিনের অফিসের ক্লার্কের মতো চেহারার লোকটা তখন থেকে ওর প্রশ্নের উত্তর তো দিচ্ছেই না উলটো মানুষটার হামবড়াই ভাব দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে শারিয়ারের। ‘আপনি কে আগে বলুন তো, তখন থেকে…’
এবারও মানুষটা কোনো জবাব দিল না, বরং চোখ তুলে তাকাল সে শারিয়ারের দিকে। পানের রসে লাল হয়ে উঠতে থাকা ঠোঁটের সামনে একটা আঙুল তুলে চুপ থাকতে বলল সে শারিয়ারকে। মানুষটার চেহারা যতই মরাধরা হোক কিন্তু চোখের দৃষ্টি আর ব্যক্তিত্ব এমন চট করে চুপ হয়ে গেল শারিয়ার।
‘এই তো বালো ছেলে,’ বলে সে নিজের ডান হাতে একটা রুমাল বের করে মুখ মুছল তারপর তৃপ্তির সঙ্গে বলে উঠল, ‘বুঝলা ভাতিজা, পুরান ঢাকার বুইড়া মোক্তারে পানডা যা বানায় না,’ বলে সে তৃপ্তির সঙ্গে আরো কয়েক সেকেন্ড পান চিবুল। তারপর আবারও, যোগ করল, ‘নতুন ঢাকার পুলাপানে দুনিয়ার জিনিস দিব পানে কিন্তু পান থাকব লুয়ার মতোন শক্ত। আর মোক্তারের পান মাখনের মতোন নরম…’ বলে সে হাসতে হাসতে পাশে রাখা নিজের পুরনো ব্যাগটাতে হাত দিল।
‘আমি এটা বুঝতে পেরেছি আপনাকে অফিস থেকে পাঠিয়েছে…’
‘তুমার রেকর্ড পড়ছি আমি, ভাতিজা। আগে কও মাথা এত গরম কইরা ফালাও ক্যান?’ কথাটা বলতেই সিটি বাজিয়ে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করল। শারিয়ার মানুষটার কথার জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে, কী জবাব দেবে বুঝতে পারছে না ও। কিছু না বলে সামান্য কাঁধ ঝাঁকাল। ওর কাঁধ ঝাঁকানো দেখে মৃদু হেসে উঠল মানুষটা। তার মান্ধাতার আমলের ব্যাগটার ভেতর থেকে একেবারে চকচকে একটা অ্যাপলের ট্যাব বের করল সে। গলার সঙ্গে কালো চশমার রিবন দিয়ে ঝুলানো গান্ধি চশমটা তুলে দিয়ে নাকের ওপরে লাগাল। তারপর চোখ তুলে ট্যাবে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘বাহ, রেকর্ড তো মারাত্মক তোমার, ভাতিজা,’ বলে সে আবারও হেসে উঠল, ‘আর্মি থেইক্কা বহিষ্কার, পুলিশ থেইক্কা পরায় সাসপেন্ড,’ আনমনে মাথা নাড়ল সে। ‘যা ভাবছিলাম, কেরাতির বিলাক বেল্ট, মার্কম্যানশিপে শতকরা সাতানব্বইভাগ অ্যাকুউরেসি রেইট, বাহ- বাহ,’ মানুষটা ওর প্রোফাইলে চোখ বুলিয়ে চলল সেই সঙ্গে মজার মজার মন্তব্য করে চলল, নিজের সিটে হেলান দিল শারিয়ার। ওর একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না।
‘… এবং অত্যন্ত অনিয়ন্ত্রিত জীবন,’ বলে নিজের বক্তব্য শেষ করে চোখ তুলে তাকাল সে শারিয়ারের দিকে। এবার যেন খানিকটা চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।
‘এভাবে কারো সামনে তার প্রোফাইল পড়াটা কি শোভনীয়?’
শারিয়ারের প্রশ্ন শুনে লোকটা এক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর প্রায় উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। ‘এই কথা তুমি কইতাছ পোলা? তুমি? সারা জীবন কোনো নিয়মের ধার ধারছ তুমি?’ বলে সে হেসেই চলল। ‘আমি ভাবতাসি তুমি আর তানভীর বন্ধু অইলা ক্যামতে? দুইজন পুরা উলটা!’
শারিয়ার একটু অবাক হয়ে ফিরে তাকাল মানুষটার দিকে। ‘ আপনি তানভীরকে চেনেন নাকি?’
‘সিলেট যাওনের আগে তুমার বন্ধুরে আমিই বিরিফ করছিলাম,’ বলে সে চোখ থেকে চশমাটা খুলতে খুলতে বলে উঠল। ‘ভালো পোলা। ঠান্ডা মাথা, নিয়ম মাইন্না চলে,’ শেষ কথাগুলো সে একটু বিশেষভাবে উচ্চারণ করল যেন শারিয়ারকে কোনো ইঙ্গিত দিতে চায়।
‘বাই দ্য ওয়ে, আমি আলীম পাটোয়ারি, রিসোর্স সেকশন,’ বলে সে ব্যাগটা আবারও টেনে নিয়ে কিছু একটা বের করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। আর শারিয়ার অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল মানুষটার দিকে। আলীম পাটোয়ারি বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভেতরে প্রায় লেজেন্ডারি পর্যায়ের নাম। টেকনো পুলিশিং এবং অস্ত্রের জগতে তার মতো বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে তো বটেই সারা বিশ্বেই খুব কম আছে। দীর্ঘদিন ইন্টারপোলের টেকনো সেকশনে কাজ করেছে এই লোক। এই কেরানি-মার্কা হালকা-পাতলা চেহারা, ছাগুলে দাড়ি আর পান চিবানো মানুষটাই যে লেজেন্ডারি একজন টেকনো এক্সপার্ট কে ভাবতে পারবে সেটা।
‘দেহি, তুমার হাতটা দেহি,’ বলে সে নিজের ব্যাগ থেকে একটা কালো কেইস বের করে আনল। সেটার ভেতর থেকে একটা সিরিঞ্জের মতো জিনিস বের করে শারিয়ারের হাতের ভেইনে প্রবেশ করে ইনজেকশন দিল সে। তারপর ছোটো একটা ব্যান্ড এইড লাগিয়ে দিল ওখানে। ‘লিকুইড ট্র্যাকার, তুমার রক্তের লগে মিশা যাইব কয়েক ঘণ্টার ভেতরে। অ্যাকটিভ থাকব পাঁচ দিন পর্যন্ত। তারপর বাইর হয়া যাব শরীর থাইক্কা। এক্কেরে আধুনিক মাল। তুমি যেখানেই যাও আমরা ট্র্যাক করতে পারব তোমারে,’ বলে সে শারিয়ারের বাঁ হাতটা ছেড়ে দিয়ে ডান হাতের দিকে ইশারা করে বলে উঠল, ‘দেহি অই হাতড়া,’ শারিয়ার ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মজা করে বলে উঠল, ‘আংটি পরাবেন নাকি?’
মানুষটা কিছু না বলে হাতটাকে আরেকটু টেনে নিল নিজের দিকে, তারপর গরুর বাজারে লোকজন যেভাবে কুরবানির আগে গরু পরীক্ষা করে সেভাবে ভালোভাবে টিপেটুপে দেখতে লাগল।
‘পাঁচ ফিট সাড়ে এগারোর তুলনায় তুমার হাতটা এট্টু বেশিই বড়ো, আঙুল গুলা বেশি মোড়া। কাজেই বলে সে ভাবতে লাগল, ‘খারাও দেহি।’
মানুষটার কথা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়েই বলে উঠল, ‘এক্সকিউজ মি?’
‘আরে ব্যাডা খারাও,’ বলে সে ওর গায়ে চড়ানো অ্যাশ কালারের ব্লেজারটাও খুলতে বলল। ট্রেনের ঝাঁকুনির সঙ্গে ব্যালেন্স করে শারিয়ার উঠে দাঁড়াল। ব্লেজারটা খুলে ও ছুঁড়ে দিল সিটের দিকে।
‘হুম বহো,’ বলে সে তার ব্যাগের ভেতর থেকে ছোটো একটা অ্যাটাচি কেসের মতো বের করে আনল। শারিয়ার দেখতে পেল ওটার ভেতরে সারি দেওয়া বেশ কিছু অস্ত্র। ‘তুমার হাইট, বডি আর আঙুলের গিরিপ হিসাব কইরা আমি ভাবছিলাম তুমারে ম্যাগনাম দিমু, কিন্তু এহন মনে অইতাছে তুমার লাইগা এইটাই সেরা অইবো,’ বলে সে দুহাতে ছোটো কোনো শিশুকে তুলে ধরছে আদর করার জন্য এমনভাবে কালো হ্যান্ডেলের চকচকে লম্বা নলের একটা পিস্তল বের করে আনল। জিনিসটা এক্কেরে নতুন, কোল্ট কিং কোবরা। জার্মান পুলিশের নিয়মিত অস্ত্র। বলে সে অভ্যস্ত হাতে সিলিন্ডার বের করে এনে দেখাল ভেতরে চেম্বারে ছয়টা রাউন্ড ভরা। ‘মজার বিষয় অইলো এইডাতে গুলি থাকে ছয়টা। কিন্তু নিচে আমার আবিষ্কার করা এই চেম্বারটা লাগায়া লইলে এই চেম্বারটা থেইক্কা একদিকে লেজার পয়েন্ট করতে পারবা টার্গেটে, লগে এটা তুমার পিস্তলের মেশিনের মতো ফায়ার করতে তো পারবাই আর এই হাতে একটা এক্সট্রা সিলিন্ডার লাগায় রাখলে আগেরডা শেষ অইতেই নিজে থাইকা আরেকটা সিলিন্ডার লোড কইরা দিব। তুমার কাম খালি গুল্লি মারন,’ বলে সে নিজের আনমনে হেসে ওঠে জিনিসটা ধরিয়ে দিল শারিয়ারের হাতে।
অস্ত্রটা হাতে নিয়ে শিশুদের মতো খুশি হয়ে উঠল শারিয়ার। সিলিন্ডার লোড- আনলড করে লেজার পয়েন্টার সেট করে দেখে আনমনেই বলে উঠল, ‘দারুণ জিনিস, পুরো আগের দিনের ওয়েস্টার্ন কাউবয়দের মতো মনে হচ্ছে।’
ভুল কও নাই, কহনো কহনো পুরান জিনিসই সেরা জিনিস। এইডা পইরা লও,’ বলে সে একটা সোল্ডার হোলস্টার এগিয়ে দিল ওর দিকে। পিস্তলটাকে ওটাতে ঢুকিয়ে জিনিসটা নিজের শার্টের ওপরে ওপরে পরে নিতে যাচ্ছিল তার আগেই আলী পাটোয়ারি থামতে বলল তাকে। ‘খারাও খারাও আগে এইডা পরো, বলে সে ভেস্টের মতো দেখতে শক্ত একটা জিনিস এগিয়ে দিল তার দিকে। ‘যেই কামে যাইতাসো এইডা লাগবই।’
শারিয়ার জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখল একদম হালকা শক্ত একটা জিনিস। এক হাতে ধরে ওটাকে ওজন করে বলে উঠল, ‘বুলেট প্রুফ জ্যাকেট এত হালকা?’
‘হ, আমিও পরথমে অবাক অইছিলাম। লাইটওয়েট কার্বনের জিনিস। পরো দেহি।’
শারিয়ার পিস্তলসহ হোলস্টারটাকে সিটের ওপরে রেখে পাশ ফিরে জিনিসটাকে যত্নের সঙ্গে পরে নিল শার্টের ওপরে। ‘বাহ বেশ ফিটও বটে। কিন্তু এটা ঠিকমতো কাজ করবে তো?’ বলে সে পাশ ফিরে পাটোয়ারির দিকে তাকাতে যাচ্ছিল, তার আগেই বুকের একেবারে মাঝখানে শক্ত আঘাতে পিছিয়ে গেল। দেখল সর্বশক্তিতে একটা ছুরি তার বুকে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই সেটা ভেস্টে লেগে ছিটকে গেল একপাশে।
‘আপনি পাগল নাকি?’ অবাক হয়ে গেছে শারিয়ার।
‘হা-হা, তুমিই তো জিগাইতাছিলা কাম অইবো কি না?’ বলে খিক খিক করে হাসতে লগলো বুড়ো পাটোয়ারি।
শারিয়ার ভেস্টের ওপরে পিস্তলসহ হোলস্টারটা পরে নিতেই ওর দিকে সুইচ নাইফটা ছুঁড়ে দিল। ‘তুমি নাকি ছুরি রাখতে পছন্দ করো হুনলাম, তাই এইডা আনছি। আমেরিকার মাইক্রোটেক কোম্পানির জিনিস, নাম অইলো মাইক্রোটেক হালো ভি। জন উইক সিনেমায় কিয়ানু রিভিস এই কোম্পানির চুরিই ব্যবহার করে। ওরডা অবশ্য ভিন্ন মডেল। রিভিস, নামডা কি ভুল কইলাম ভাতিজা? নাকি রিভস?’ ভ্রু কুঁচকে কথাটা বলে সে জোরে হেসে উঠল।
শারিয়ার ছুরিটা নিয়ে সেটাকে খাপসহ গোড়ালির ওপরে আটকে নিল। ‘পেন্সিল নেই?’ মুচকি হাসি দিয়ে জানতে চাইল শারিয়ার। ও ভেবেছিল বুড়ো বুঝতে পারবে না ও কি বলছে কিন্তু বুড়োর হাসি দেখে অনুমান করল সে ঠিকই বুঝেছে ও কি বলেছে। ‘দারুণ,’ এই পাটোয়ারি লোকটাকে তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। ছুরিটা রেখে সোজা হয় সে বলে উঠল। ‘আপনাকে দেখে আমার জেমস বন্ডের কিউয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে,’ ও আবারও গায়ের ওপরে ব্লেজারটা পরে নিতেই বুড়ো পাটোয়ারি একবার জানালা দিয়ে বাইরে দেখে নিয়ে ওকে তার সামনে বসার ইশারা করল।
‘শুনো পোলা, ওইসব আজগুবি জিনিস সিনেমাতেই দেহা যায়,’ বলে সে তার স্টিলের বাক্স থেকে আরেকটা পান বের করে মুখে পুরে দিল। ‘যা কইতাছি মন দিয়া শুনবা। যেই কামে যাইতাছো কামডা কিন্তু ঝামেলার। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওইহানে আসলে কী ঘটছে কেউই ঠিকভাবে জানে না। এই কারণেই পাশা তুমারে পাঠাইতাছে। বিশেষ করে যেই মানুষড়া মারা গেছে তার অতীত নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি চলতাছে। সেই কাম আমিই করতাসি। তয় ওইহানে দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনগুলার অন্তত দুইডার যুগাযুগ পাওয়া যাইতাছে। কিন্তু কেন আর ক্যামনে হেইডা কিছুই বুজা যাইতাসে না। যেই সংগঠনগুলা দুনিয়া কাঁপাইতাছে হেরা হঠাৎ আমগো গরিব দেশে কী করতাছে হেইডা বোঝার কুনো উপায় এহনো পাওয়া যায় নাই। একদিকে মমিসিঙে একজন ধরা পড়ছে, হের লগে এগো সংযোগ পাওয়া যাইতাছে। তার আগে আবার তানভীরের হাতে সিলেট জ্যাক মাস্টার ধরা পড়ছে, যে এই সংগঠনগুলার মাথাগোর একজন। কাজেই আমগো দেশে আসলে ঘটতাসে কী, হেইডা বোঝার একমাত্র উপায় এহন তুমি। যদি মনে কইরা থাহো ময়দান সাফ পাইবা, তয় ভুল করতাছো ভাতিজা। তার ওপরে পাশার এই নতুন বানানি সংগঠন অনেকেরই চক্ষুশূলে পরিণত অইছে ইতোমধ্যেই। কাজেই ঘরের ভেতরে আর বাইরে দুইহানেই খুব সাবধান থাকবা।’
শারিয়ার মৃদু হেসে উঠল, ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’
ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে দেখে পাটোয়ারি আরেকবার বাইরে দেখে নিল। ‘মোটেই না, তুমার ওই গরম মাথার ভেতরে পরিস্থিতির গুরুত্বডা ঢুকানির চেষ্টা করতাসি, ট্রেনটা স্লো হতে হতে একেবারে থেমে গেছে। সম্ভবত বিমানবন্দর স্টেশন চলে এসেছে। বাইরে লোকজনের হইহল্লা আর হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। পাটোয়ারি তার ব্যাগ গোছাতে গোছাতে উঠে দাঁড়াল।
‘বিমানবন্দর আইসা গেছে, আমি যাই,’ বলে সে ব্যাগটা আর পুরনো দিনের ছাতাটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর শারিয়ারকে খুব অবাক করে দিয়ে একেবারে শুদ্ধ ভাষায় অত্যন্ত স্মার্ট ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘বালক, আজ পর্যন্ত বহু এজেন্টের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। ভালো-মন্দ-দক্ষ-অদক্ষ কোনো ইয়ত্তা নেই। সফল হতে দেখেছি কাদের জানো?’ বলে সে থেমে গেল। শারিয়ার তাকিয়ে আছে তার জবাবের অপেক্ষায়। ‘যারা মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে তাদেরকে,’ বলে সে নিজের ছাতাটা শারিয়ারের দিকে বন্দুকের মতো তাক করল। ‘তুমি একটা শক্তিশালী বোমা। কিন্তু মনে রাইখো বোমার শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে যেমন পাহাড় ভেঙে রাস্তা তৈরি করে ফেলতে পারে, আবার সেই বোমাই ধ্বংসযজ্ঞ এনে লাখো প্রাণের হন্তারক হতে পারে। তুমি তোমার শক্তি কীভাবে কাজে লাগাবে সেটা তোমার ব্যাপার। কাউকে বিশ্বাস করবে না, নিজের মস্তিষ্কটাকে ছাড়া। পাসকোড ছাড়া কোনো আলাপ করবে না। তোমার বন্ধু তানভীরকে আমি যা বলেছিলাম সেটাই বলব তোমাকে। বেস্ট অব লাক মাই বয়। ওটাই এখন তোমার সবচেয়ে বেশি দরকার,’ বলে সে মৃদু হেসে ছাতা দিয়ে দরজায় টোকা দিতেই ওটা খুলে গেল।
শারিয়ার জানালা দিয়ে দেখল ছোটোখাটো মানুষটা ট্রেন থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে প্ল্যাটফর্ম ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। শারিয়ার মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। ট্রেন আবারও চলতে শুরু করেছে ধীর লয়ে। দরজাটা ভেতর থেকে ভালোভাবে আটকে দিয়ে সিটে বসে চোখ মুদল ও।
পাটোয়ারি যাই বলুক না কেন ভেতরে-ভেতরে এসব মোটেও আমলে নিচ্ছে না ও। অনেকদিন পর সত্যিকারের একটা মিশনে চলেছে। উত্তেজনায় রক্তের ভেতরে বান ডাকতে শুরু করেছে ওর। ঠোঁটের দুইপাশ দিয়ে নেমে আসা চোখা গোঁফের কিনারার হাত বোলাতে বোলাতে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ওর মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি।