অধ্যায় এগারো – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ
রামু, চট্টগ্রাম
জীবনে কোনদিন যেটা করবে না ভেবেছিল সেটাই করতে হচ্ছে কিরানকে, ফিরে আসতে হয়েছে নিজের বাড়িতে, তাও আবার লুকিয়ে চোরের মতো
সামনের ভিড়টার দিকে খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তালেব কিরান। একবার ফিরে তাকাল ওর পাশে নিচু হয়ে বসে থাকা গোমেজের দিকে। গোমেজ নিজের দাঁত বের করে ফোকলা হাসি দিল।
কিরান আর গোমেজ এই মুহূর্তে অবস্থান করছে সমুদ্রের তীরে বিশাল এক বাড়ির সামনে। রামুর মন্দার গ্রামটা একেবারে সমুদ্রের কিনারায় অবস্থিত। আবার গ্রামের একেবারে কিনারায় কিরানদের বাড়ির অবস্থান। শেষ কথাটা মনে হতেই কিরানের মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। এই বাড়িটাকে কি আর নিজের বাড়ি বলা সম্ভব। ও কি আর এই বাড়ির, এই পরিবারের অংশ হিসেবে আছে? নাকি সব বদলে গেছে? সময়ের থাবা খুব খারাপ জিনিস, সবকিছু বদলে দেয়।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ-নিশ্বাস বেরিয়ে এলো কিরানের বুক চিড়ে। সামনে খোলা প্রাঙ্গণ, তার ঠিক পেছনেই বড়ো একটা দোচালা বাড়ি। এই বাড়িগুলোকে দোচালা বলা হয় এ-কারণে যে, বাড়িগুলোর একটা চালার ওপরে আবার একটা অতিরিক্ত চিলেকোঠার মতো থাকে।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কিরানের যেন দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছে করছে না। ওর বাবা সুবাদার তালেব তৈমূরের বাবা নাকি নির্মাণ করেছিল এই বিরাট বাড়িটা। যখন এটা বানানো হয়েছিল তখন অত্র এলাকার সবচেয়ে বড়ো বাড়ি ছিল এটা। কিরানের পরিষ্কার মনে না পড়লেও ও শুনেছে এক ব্যবসায়িক সফর থেকে ফেরার পথে কিরানকে কুড়িয়ে পেয়েছিল তালেব তৈমূর। তখন ওর বয়স ছিল তিন, সেই থেকে এ বাড়িতেই বড়ো হয়েছে সে। এই বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক ছিল ওর, এখনো আছে, চিরকালই থাকবে।
এসব পরিবারের সাধারণত কুড়িয়ে পাওয়া শিশুদের ঠিকানা হয় রান্নাঘর কিংবা আস্তাবলে। অথবা পরিবারের বাকি সবার ফাইটফরমায়েশ খাটার কাজে। কিন্তু কিরানের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। এর পেছনে কারণ ছিল খোদ তালেব তৈমূর। মানুষটার অপরিসীম ভালোবাসা ছিল কিরানের প্রতি। লোকে এমনও বলত যে তার নিজের তিন ছেলে আর দুই মেয়ের চেয়ে সে নাকি অনেক বেশি ভালোবাসত কিরানকে। আর এ কারণেই সে কিরানকে বাড়িতে এনে ঘোষণা করে কিরান তার ছেলে হিসেবে বড়ো হবে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত পরিবারের কর্তা যা ঘোষণা করে পরিবারের কর্ত্রী করে উলটোটা। কিন্তু কিরানের প্রতি তৈমুরের ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়েছিল তার অর্ধাঙ্গিণীর মাঝেও। যে-কারণে দীনহীন পথ শিশু হলেও তৈমূরের রাজসিক পরিবারে রাজার শিশুর মতোই বড়ো হয়ে উঠতে থাকে কিরান। যতদিন পর্যন্ত না সে বড়ো হওয়ার পর হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় মোঘল বাহিনীতে যোগ দেবে। তারপরেই বদলে যায় সবকিছু।
বাড়ির দিকে ফিরে তাকানোতে পুরনো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যেতে থাকলেও সেগুলোকে যত্নের সঙ্গে সামলানোর চেষ্টা করে বরং বর্তমানে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করল সে। আকরাম বেগের সঙ্গে কথোপকথনের পর প্রথমেই কিরান সিদ্ধান্ত নেয় বাড়িতে যেতে হবে তাকে। যেকোনোভাবে হোক মায়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আর সে উদ্দেশেই এখানে এসেছিল সে। কিন্তু বাড়ির সামনে অস্বাভাবিক ভিড় দেখে থমকে গেছে। এরকম ভিড় থাকার কথা ছিল না। এখানে ভিড়টা কীসের অনুমান করতে পারে সে। সম্ভবত আরাকান থেকে শাহ সুজার মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছেছে এখানে। আর আকরাম বেগের কথা যদি সত্য হয় তবে এই খবরও এসে পৌঁছেছে যে, শাহ সুজার সঙ্গে তালেব তৈমূরও মারা গেছে। কারণ সে-যে আরাকান থেকে পালাতে পেরেছে এটা তেমন কারো জানার কথা নয়। তৈমুরের মৃত্যুর কারণেই এই মাতমের আয়োজন।
কিন্তু আসলেই কি তাই? ভিড় দেখে তো মনে হচ্ছে না। ভিড় যে কারণেই হোক অপেক্ষা করতে হবে। এটা না কমলে সে যে উদ্দেশে এসেছে সেটা পূরণ হবে না। গোমেজের পাশে বসে সে কোচর থেকে তামাক পাতা বের করে মোড়াতে শুরু করল। তারপর ওটাতে আগুন দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল এক গাদা। গত রাতে আকরাম বেগের সঙ্গে তার কথোপকথন মনে পড়ে গেল।
***
তার বাবার অন্তর্ধানের কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠলেও খুব দ্রুতই কিরান আবারও বসে পড়ে আকরাম বেগের সামনের কেদারায়। এরই মধ্যে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কী করতে হবে তাকে। ‘আমি আমার বাপের সুসন্তান হইতে পারি নাই ঠিকই কিন্তু বাপের সবচেয়ে বড়ো বিপদের সময়ে আমি পিঠ দেখায়ে পলাবো এতটাও খারাপ না আমি। আমার সর্বোচ্চ দিয়া চেষ্টা করব। আর সেই জন্য প্রয়োজন হলে এক সিলভেরা না একশ সিলভেরার লগে লড়াই করতেও আমি পিছপা হবো না।’
আকরাম বেগ ইশারায় তার প্রধান লাঠিয়াল চাপদাড়িকে গড়গড়াটা নিয়ে যেতে বলল। তারপর নিজের পাঞ্জাবির কোচর থেকে একটা রেশমি রুমাল বের করে মুখ মুছল। ‘কিরান, তুমি কাজটা করবা শুইনা আমার সত্যি ভালো লাগতাছে। যদিও তুমি তোমার বাপের কারণে রাজি অইছো কিন্তু দুইটা কারণে তুমার কাজটা করা দরকার। এই কামডা করতে পারলে নতুন জীবন শুরু করতে পারবা, যেমনডা আমি বলছি। তবে তার চায়া বড়ো কথা তুমি নিজের ভেতরে যেমনে ভাইঙ্গা গেছিলা সেইটা ঠিক করতে পারবা। একজন মানুষের জন্য নিজের কাছে নিজে হাইরা যাওনের চায়া খারাপ কিছু আর অইতে পারে না। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে,’ আকরাম বেগ কেদারায় নিজের পা তুলে বসল। সম্ভবত অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করছে সে। ‘একদিকে তুমি নিজের দেশের মানুষরে সাহায্য তো করতেই আছ। তার চায়া বড়ো কথা তুমি নিজের মানুষগো খুনের বদলা নিতে পারবা। তয় কিরান,’ বলে সে থেমে গেল। ‘কামডা কিন্তু সহজ অইবো না। অনেক অনেক বিষয় আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সিলভেরা আর তার বাহিনীরে আইজতক কেউ হারাইতে পারে নাই। এমনকি মোঘলরা পর্যন্ত হের হাতে ঘোল খায়া গেছে। ওরে মোটেও ছোটো কইরা দেইখো না।’
‘চাচা, এক ভুল আমি দুইবার করব না, কিরানের দৃষ্টি আবারও সেই পুরনো সময়ে ফিরে গেছে। ‘আর এইবার আমার ভুল মানে বাবার জীবনের ঝুঁকি। কাজেই…’ সে বাক্য শেষ না করে মাথা নাড়ল। ‘তয় চাচা অনেক কিছু লাগব। বিরাট খরচের ব্যাপার,’ শেষ কথাটা বলে সে আকরাম বেগের দিকে তাকিয়ে রইল তার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য।
আকরাম বেগ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। ‘খরচ কোনো সমস্যা না কিরান। আমি আছি, আমার পেছনে চাঁটগাওয়ের ব্যবসায়ীরা আছে, ঢাকার মসলিনের কারবারিরা আছে। আরো বড়ো একটা হাত আছে আমগো পিছে,’ কথা শেষ অংশটা সে খুব রহস্যময়ভাবে বলে উঠল, ‘কাজেই ওইগুলা কুনো সমস্যা না। আমার ধারণা সমস্যা অইবো তুমার মানুষ নিয়া। এই কামে অনেক লোক লাগব তুমার। সাধারণ লাঠিয়াল আর লোকবল লাগলে কোনো বিষয় আছিল না। কিন্তু তুমার লাগব বিশেষ কামে পারদর্শী লোক। সেইডাও বড়ো সমস্যা না। বড়ো সমস্যা অইবে সময়। খুব অল্প সময়ে অনেক মানুষ জড়ো করতে হইবে তোমার। তাও যার যার কামে সেরা লোকজন,’ আকরাম বেগের গলায় সামান্য অস্থিরতা।
‘আমার নিজের আগের দলের মানুষগোরে লাগব,’ কিরান মনে মনে হিসেব করতে শুরু করে দিয়েছে। সবাইরে হয়তো পাওয়া যাবে না। কিন্তু সত্যি কথা অইলো অগোর অন্তত কয়েকজনরে না অইলে আমার চলবোই না,’ বলতে বলতেই সে চুপ করে আড়মোড়া ভাঙল। ‘কারণ এরকম একটা কামে আমার চিনা পরিচিত ছাড়া অন্য মানুষের ওপরে আমি ভরসা করতে পারব না।’
‘জাহাজ,’ আকরাম বেগ গুনতে শুরু করেছে। ‘অস্ত্র, মালসামান এইগুলা কোনো সমস্যা না। রামুর মন্দার হাটের কাছেই পাহাড়ি খাঁড়ির উদ্দেশে তিনটা জাহাজ এরইমধ্যে রওয়ানা দিছে।’
‘তাইলে সেগুলাতে অস্ত্র আর মালসামান ভরতে লাগায়া দেন। আমি মানুষের ব্যবস্থা করতাসি। আমি যাগোরে নিবো তাগোর অনেক অর্থ দিতে হবে। যদি কোনো কারণে তাগো প্রাণের ওপরে ঝুঁকি আসে বা তারা মারা যায়, তাগো পরিবাররে অনেক অর্থ দিতে হবে। এইগুলার ব্যবস্থা আপনের করতে হবে। আমি খোঁজ লাগাইতাছি। তয় তার আগে আমি বাড়ি যাব।’
‘বাড়ি ক্যান?’ আকরাম বেগের গলায় সাধারণ কৌতূহল।
‘আমার আম্মার সঙ্গে দেহা করতে হবে,’ কিরান জোর গলায় বলে উঠল। ওর গলার স্বরেই আকরাম বেগ বুঝে গেল ওকে ফেরানো যাবে না।
‘ঠিক আছে, আমি তোমারে বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেব না। কারণ তোমার তো রামুতে যাইতেই হবে। তবে খুব সাবধান দুইটা বিষয়ে। একে, আমাগো এই যাত্রা নিয়া বাইরের কেউ যাতে জানতে না পারে। আর, তুমি কিন্তু চিনা মুখ। বহু মাইনষে তোমারে খুঁজতাছে এহন। কাজেই খুব সাবধান।’
সেদিন রাতেই ওরা ওদের ডেরায় ফিরে গিয়ে বৈঠা, ওর ছেলে আর গোমেজকে নিয়ে ভোরে ভোরে উঠে রওয়ানা দেয় রামুর উদ্দেশে। রামুতে নেমেই বৈঠাকে পাঠিয়ে দেয় কিরান একটা বিশেষ কাজে। এরপরে গোমেজকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসে দেখে এখানে বিশাল যজ্ঞ চলছে। কাহিনিটা কী ঠিক বুঝতে না পেরে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় ও।
***
অপেক্ষা করতে করতে মাটিতে বসে তামাক টানছিল। হঠাৎ কাঁধে গোমেজের খামচি খেয়ে কাঁধ ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়াল কিরান। জটলার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন মহিলা। এর ভেতর থেকে মাতম করে কাঁদতে থাকা দুজনে মিলে একজন মহিলাকে ধরে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। মাঝখানের মহিলাই কিরানের মা সালেহা বানু।
মহিলারা নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিতেই গোমজকে উদ্দেশ্য করে কিরান বলে উঠল, ‘গোজু, তুই এহানেই থাক,’ বলে সে নিজের কাফতানের ওপরে পরে থাকা আলোয়ানের মতো জিনিসটা দিয়ে মাথা আর মুখ ঢেকে ফেলল, তারপর দ্রুত পায়ে রওয়ানা দিল বাড়ির পেছনের অংশের দিকে।
মাঝেমধ্যে টুকরো টুকরো পরিবর্তন হলেও বাড়ির মূল অংশ বলতে গেলে আগের মতোই আছে। আর একারণেই খুব সহজেই কিরান পানির ছোট্ট একটা ইঁদারার পাশ দিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়ির পেছনের অংশে। এখান থেকেও বাড়ির একেবারে অন্দরমহল পর্যন্ত প্রবেশ করাটা খুব একটা সহজ হতো না ওর জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা অনেকটাই সহজ হয়ে এলো বাড়িতে আজ বিশেষ আয়োজনের কারণে।
বাড়ির পেছন দিকে বাড়ির মূল পানির উৎসকে কেন্দ্র করে রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। কিরান দেখেই বুঝল আজ বাইরে থেকে পাকোয়ান এসেছে। বাড়ির পেছনে পুরুষ-মহিলারা মিলে কাজ করছে। কেউ মশলা বাটছে, কেউ সবজি কুটছে, কেউ পেঁয়াজ-মরিচ আবার কেউ মাংস প্রক্রিয়া করতে ব্যস্ত। বাড়ির এই অংশ দেখে মনেই হয় না বাড়িতে সবাই একজন মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জড়ো হয়েছে। বাড়ির পেছনের এই আয়োজন দেখে কিরানের মনে হলো মত্যু যেমন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সত্য, ঠিক তেমনি মৃত্যু সবচেয়ে বড়ো আয়োজনও বটে।
বাড়ির ভেতরে বাইরের মানুষজনের সুযোগ নিয়ে খুব সহজেই বাড়ির মূল পাকোয়ানখানার কাছে চলে এলো সে। সেখানে এসে একটা খালি ঝুড়ি তুলে নিয়ে মাথা-মুখ আড়াল করে এমনভাবে বাড়ির ভেতরের দিকে রওয়ানা দিল যেন কিছু একটা আনতে যাচ্ছে। ঝুড়ি হাতে নিয়ে সোজা বাড়ির জমায়েতখানায় চলে এলো কিরান।
তারপর রওয়ানা দিল ভেতরবাড়ির দিকে। মার শোবার ঘরের সামনে আসতেই ভেতর থেকে দুজন মহিলা বেরিয়ে এলো। মাথা নিচু করে চুপচাপ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল কিরান। মহিলা দুজন দূরে সরে যেতেই শ্লথ পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল কিরান। ভেতরে ঢুকে বহু পুরনো একটা পরিচিত গন্ধ পেল সে। এই গন্ধের সঙ্গে কত পরিচিতি ওর। কতদিন পর এই গন্ধের রাজ্যে প্রবেশ করল ও।
ঘরের ঠিক মাঝখানে বিরাট একটা উঁচু পালঙ্কের মতো কাঠের খাট। কিরান ওটার কাছাকাছি যেতেই মাকে শুয়ে থাকতে দেখল। বালিশে মুখ নিচু করে আছে সালেহা বানু। সামান্য ফোঁপানোর শব্দও শুনতে পেল ও। সেই সঙ্গে মায়ের পিঠটা বার-বার ফুলে ফুলে উঠছে। বিছানার কাছাকাছি গিয়ে দুবার অস্বস্তির সঙ্গে হাত এগিয়ে দিয়েও আবার ফিরিয়ে আনল। তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হলো ও। নিজের হাতটা মার পিঠের ওপরে রেখে অপরাধীর স্বরে ডেকে উঠল, ‘মা।’ কিন্তু মায়ের ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। বরং সে আগের মতোই ফোঁপাতে লাগল। আবারও কিরান ডেকে উঠল। এবার একটু জোরে।
একজোড়া লাল চোখ নিয়ে ফিরে তাকাল মা। কিরান তার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে উঠল। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল কিরানকে চিনতে। কিন্তু চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রায় চিৎকার করে উঠে বসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কিরানকে, ‘কিরান, তুই আইছিস,’ বলে সে আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠল। ‘এদ্দিন পর…তোর বাপু… এমন দিনে আইলি… এতদিন পরে মনে পড়ল তোর আমার কথা। তোর বাপু …’ মা একের পর এক অসংলগ্ন কথা বলে যাচ্ছে। কিরান কিছুই না বলে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইল। ধাতস্থ হওয়ার মতো সময় দিল তাকে।
তারপর খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে আসার পর সে বলে উঠল, ‘মা, তুমি ঠান্ডা হও। আমি আইছি না।’
‘বাবা, তুই আইলি, তোর বাপে কই গেল,’ বলে সে বাইরে দেখাল। ‘ওরা সব ভাগ করতে চায়। সব জমি-ব্যবসা-বাড়িঘর,’ বলে সে আবারও হাউমাউ করে উঠল। ‘এই বাড়ি, তোর বাপ-দাদার এই বাড়ি ওরা সবাই ভাগ করে ফেলতে চায়।’
‘মা, তুমি শান্ত হও,’ কিরান মায়ের চোখের পানি মুছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর অনেকটাই শান্ত হয়ে এলো মা। কিরানের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বলে উঠল, ‘বাবা, তুই কই গেছিলি? এমন দুবলা হয়ে গেলি ক্যামনে?’
মায়ের কথা শুনে কিরান হেসে উঠল। ‘মা, তুমি পাগল,’ বলে ও একটা মাটির পাত্র থেকে পানি এনে এগিয়ে দিল মায়ের দিকে। মা ছোটো বাচ্চাদের মতো করে পানি খাচ্ছে, কিরান নিজের ভারী হয়ে আসা কোমর দেখিয়ে হেসে উঠল। ‘এই আমার দুবলা হওয়ার লক্ষণ!’ বলে ও আনমনে মার কপালে হাত বুলিয়ে দিল।
তুমি বুড়ি হয়া গেছো, মা,’ দুজনেই হেসে উঠল একসঙ্গে।
‘বাবা, তোর বাপে…’ মা আবারও আগের মতো হয়ে যাচ্ছিল তার আগেই কিরান ত্রস্ত পায়ে গিয়ে কামরায় প্রবেশ করার দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ফিরে এলো।
‘মা, তোমার সঙ্গে কথা আছে,’ বলে ও শক্ত করে মায়ের হাত চেপে ধরল। ‘মা, তুমরা যা শুনছো সেটা পুরোপুরি ঠিক না,’ বলে ও আরেকবার চারপাশে দেখে নিল। ‘বাবা আসলে মরে নাই,’ কিরান এইটুক বলতেই মা মুখ তুলে তাকাল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
‘আরাকানে শাহ সুজার লগে সবাই মরে নাই,’ বাপুর ব্যাপারে বিস্তারিত সব কথা মাকে বলতে গিয়েও সে থেমে গেল। এসব মাকে বলার প্রয়োজন নেই। ‘ওইদিন রাতেই বাবা একটা জাহাজ নিয়া পলাইছে ওইহান থাইক্কা,’ সিলভেরা আর মগরা যে বাপুর পিছু নিয়েছে, এই ব্যাপারটাও সে চেপে যাবে সিদ্ধান্ত নিল। ‘মা, আমি এহন আর বিস্তারিত কিছু বলব না তুমারে। খালি এটুক কই, আমি দ্রুতই রওয়ানা দিতাছি বাবারে ফিরায়া আনার জন্য। তুমি আশীর্বাদ রাইখো,’ বলে সে মায়ের পা ছুঁল একবার।
‘কিন্তু বাবা তুই কখে জানলি…’
‘মা, আমি কিছুই তুমারে বলব না। খালি বলছি আমি যাচ্ছি বাবারে ফিরায়া আনতে। তুমি আশীর্বাদ রাইখো। আর শোন এই শকুনগুলারে যেইগুলা জড়ো হইছে বাইরে তুমি ওগোরে খালি একটা কথা বলবা, যেই পর্যন্ত বাপুর মৃত্যুর নিশ্চিত খবর না পাওয়া যাইতাছে অথবা বাবার মরদেহ না পাওয়া যাইতাছে, সব আগের মতোই থাকব? বুঝছো?’
কিরানের প্রশ্নের জবাবে মা স্রেফ মাথা নাড়ল। কিরান অনুমান করল একের পর এক ধাক্কায় মায়ের মাথা কম কাজ করছে।
‘আরেকটা কথা, যেটা জানার জন্য আমি এহানে আইছি,’ বলে সে মায়ের একেবারে কাছ থেকে জানতে চাইল। ‘বাবা কী অরাকান যাওয়ার আগে তোমারে শেষ কথা বইলা গেছিল?’ মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিরান বুঝল বাবা যদি কিছু বলে গিয়েও থাকে কাজ হবে না, এইমুহূর্তে মা কিছুই বলতে পারবে না।
কিরান আনমনেই একবার মায়ের মাথায় হাত বুলাল, ‘মা, আশীর্বাদ রাইখো। আমি যাই, আর শোন তোমার যদি কিছু মনে পড়ে তুমি আমারে খবর পাঠায়ো। আইজ রাতে মন্দারহাটের উত্তরের খাঁড়ির ভেতর থনে জাহাজ ছাড়ব আমি। আমি যাই, মা,’ বলে কিরান ফিরে যেতে নিচ্ছিল হঠাৎ মা পেছন থেকে ডেকে উঠল ‘শুন, কিরান,’ পালঙ্ক থেকে নেমে আসতে লাগল।
মা সোজা হেঁটে চলে গেল কাঠের বিরাট দেরাজের কাছে। সেটা খুলে ভেতর থেকে একটা চাবি বের করে কিরানকে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল ঘরের কিনারায় রাখা সিন্দুকের কাছে। কিরান একটু অস্থির হয়ে উঠছে, যেকোনো সময় যে কেউ চলে আসতে পারে। বিশেষ করে ওর ভাইদের কেউ যদি ওকে দেখে ফেলে নিশ্চিত মনে করবে ও সম্পত্তির ভাগ নিতে এসেছে। আর তাহলে তুলকালাম ঘটে যাবে। এই মুহূর্তে কোনো অবস্থাতেই নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চায় না ও।
‘মা, জলদি করো।’
একটু পরেই মা ফিরে এলো। তার হাতে ছোটো একটা কাপড়ের পোঁটলা। ‘তোর বাপে আরাকান যাওয়ার আগে এইটা আমারে দিয়া বলছিল সাবধানে রাখতে। আমি তোরে দিলাম।’
কিরান পোঁটলাটা খুলে দেখল ভেতরে মোটা একটা রুপার চেইন। আর চেইনের সঙ্গে আটকানো একটা গলায় ঝুলানোর বড়ো দোলক। অদ্ভুত দেখতে দোলকটার গায়ে বিচিত্র আঁকিবুকি কাটা। ‘কী এইটা?’
মা মাথা নাড়ল। ‘জানি না রে বাপ, তোর বাপে বাড়ি থনে বাইর হওয়ার আগে এইটা আমার হাতে দিয়া বলল, ‘এইটা সবসময় নিজের কাছে রাখবা। আর মনে রাখবা বুকের বলই সবচেয়ে বড়ো বল’,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল, ‘এইটা তুই রাখ, আমার কাছে থাকলে ওরা নিয়া যাব গা, বলেই সে আবারও কাঁদতে লাগল।
কিরান জিনিসটা নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে কাফতানের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘আরে, আবার কাঁদে,’ বলে ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল মাকে কিছুক্ষণ। ‘মা, আমি অবশ্যই বাবারে ফিরায়া আনব। এহন আমি যাই,’ বলে ও মাকে শুইয়ে দিয়ে ও সাবধানে মুখ আড়াল করে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। বাইরে এসে দেখল ঝোপের পেছনে ঘাসের ওপরে শুয়ে আরামে নাক ডাকছে গোমেজ। আর গালে হাত দিয়ে নিজের ছেলেকে নিয়ে তার পাশে বসে আছে বৈঠা। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়াল বৈঠা।
‘কিরে তুই কখন আসলি? আর এটা ঘুমায় ক্যান?’ বলে ও নাড়া দিল গোমেজকে।
ওর কথার জবাব না দিয়ে বৈঠা বলে উঠল, ‘ওস্তাদ খুব খারাপ একটা খবর নিয়া আসছি আমি।’
‘ক্যান তোরে যে কামে পাঠাইছিলাম সেই কাম অয় নাই?’ গোমেজকে আবারও নাড়া দিতেই সে উঠে বসল।
‘সেইজন্যই তো বলতাসি খারাপ খবর,’ বলে সে একটু থেমে যোগ করল। ‘তুমি যার খোঁজে আমারে পাঠাইছিলা সে আমগো সাহাইয্য কী করব হে তো কবেই মইরা গেছে।’
বৈঠার কথা শুনে বুকের ভেতরটা লাফ দিয়ে উঠল কিরানের। তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল কিরান। আনমনেই বলে উঠল, ‘হায়-হায়, কেমনে?’