অধ্যায় দশ – বর্তমান সময়
গুলশান অ্যাভিনিউ, ঢাকা
‘আমরা যে বাড়িটা কিনব ওটাতে সব ধরনের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা থাকবে,’ বলে জর্জ একবার লেনিকে দেখল। লেনি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার বন্ধু- তার ভাই বিশাল দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা ক্ষুদ্র পৃথিবীর একমাত্র অবলম্বন জর্জের দিকে। সে ভেবেছিল প্রতিবারের মতো এবারও ‘খারাপ কিছু’ করার জন্য জর্জ তাকে বকবে। কিন্তু জর্জ তাকে কিছুই না বলে হঠাৎ এভাবে গল্প শোনাতে শুরু করবে এটা সে এখনো মেনে নিতে পারছে না। এর আগে যতবার সে কিছু না কিছু গুবলেট করেছে প্রতিবারই জর্জ তাকে হয় মেরেছে, না হয় বকেছে। কিন্তু এরকম গল্প বলেনি।
‘সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার কী জানিস লেনি, ‘ লেনি যদি বুদ্ধিতে একটু খাটো না হতো তবে সে ঠিকই বুঝতে পারত জর্জ তাকে গল্প বলছে ঠিকই কিন্তু কিছু একটা ঠিক নেই। কারণ এর আগে যতবার গল্প বলেছে, তাদের স্বপ্নের গল্প, তাদের ভবিষ্যতের গল্প, একটা বাড়ি কিনে খামার গড়ার করার গল্প, প্রত্যেকবার জর্জের চোখে অদ্ভুত এক আলোর দ্যুতি ছড়াত। কিন্তু আজ তার চোখে সেই দ্যুতি নেই। আজও তার দৃষ্টি চকচক করছে। কিন্তু সেটা আনন্দে নয়, স্বপ্নের বিভোরতায় নয় বরং চোখের পানিতে। ‘আমরা যে বাড়িটা কিনব ওটাতে অনেক অনেক খরগোশ থাকবে। অনেক, তোকে আর মরা ইঁদুর নিয়ে খেলা করতে হবে না…’
‘জর্জের গল্পের সঙ্গে বাইরে মানুষের শোরগোলের শব্দ বাড়ছে। একাধিক ক্ষিপ্ত উন্মত্ত মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর এগিয়ে আসছে গোলাঘরের দিকে। কথা বলতে বলতে জর্জ প্যান্টের পেছন থেকে বের করল পিস্তলটা। তারপর সেটা তার আদরের বন্ধুর মাথার পাশে ঠেকিয়ে গুলি করে দিল…’
এই পর্যন্ত পড়েই জন স্টেইনবেকের ‘অব মাইস অ্যান্ড ম্যান’ বইটা বিছানার পাশে নামিয়ে রাখল শারিয়ার, তারপর ফিরে তাকাল বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। মানুষটার দেহ স্থির হলেও চোখজোড়া সদাচঞ্চল। কিন্তু এই মুহূর্তে তার চোখজোড়ায় সেই চঞ্চলতায় ভাটা পড়েছে। সেখানে এখন চিকচিক করছে অশ্রু। শারিয়ার সেদিকে ফিরে তাকাতেই মানুষটার চোখের কোনা থেকে পানির ফোঁটাটা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।
‘আব্বু, তুমি একটা পাগল,’ বলে শারিয়ার বইটা বিছানার পাশে রেখে এগিয়ে গেল তার বাবার দিকে। একগাদা নল আর নানা চিকিৎসার সরঞ্জাম সরিয়ে প্রথমে বাপের চোখের নিচ থেকে অশ্রুর ফোঁটাটা ডান হাতের তালু দিয়ে মুছে দিয়ে বাপের মাথাটা নিয়ে নিল নিজের বুকের ওপরে। ওকে নল আর এটা সেটা সরাতে দেখে ওর বাবার বেডের অন্যপাশে অবস্থানরত নার্স একটু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ওসবের পরোয়া না করে গত সাতাশ বছর ধরে এভাবেই বিছানায় অচল পড়ে থাকা বাপের মাথাটা নিজের কোলের ওপরে নিয়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরল শারিয়ার। ‘আব্বু, তোমার মতো পাগল আমি আর দেখিনি। এই বইয়ের এই দৃশ্যটা তোমার এত প্রিয় কেন বলো তো!’ বলে সে বুকের ওপর থেকে নিজের বাপের মাথাটা তুলে নিয়ে দুইহাতে ধরে যত্ন করে চোখ-মুখে হাত বুলিয়ে মুছে দিল। ‘বারবার শুনবে আর প্রতিবার কাঁদবে।’
শারিয়ারের বাবা বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান এক ব্যবসায়ী পরিবারের বড়ো ছেলে। শারিয়ারের বয়স যখন চার তখন ওর মা একটা দুর্ঘটনায় মারা যায় আর ওর মায়ের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে না পেরে ওর বাবা এতটাই আঘাত পায় যে, কোমায় চলে যায় সে। গত সাতাশ বছর ধরে কোমাতেই আছে সে। শারিয়ারের নিজের মাকে একেবারেই মনে নেই। কারণ মাকে বুঝে ওঠার মতো বয়স হওয়ার আগেই সে চলে যায়। এরপরে ও যখন বুঝমান হয়েছে তখন থেকেই নিজের বাপকে দেখেছে বিছানায় শোয়া অবস্থায় একগাদা নল আর মেডিক্যাল ইকুইপন্টের মাঝখানে। বিশেষ মেডিক্যাল কন্ডিশন আর সার্বক্ষণিক দুজন নার্স তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
মা নেই, বাবা বেঁচে থেকেও নেই। বলতে গেলে একরকম এতিম শারিয়ার তার বিরাট প্রাসাদোপময় বাড়ি আর সম্পদের মাঝেও বড়ো হয়েছে একেবারেই একা। তবে ছোটোবেলা থেকেই ওর লিগ্যাল গার্ডিয়ান ছিল ওর একমাত্র চাচা। ছোটোবেলা থেকেই সে বড়ো হয়ে উঠেছে তার চাচার তত্ত্বাবধানে। শারিয়ারের কাছে এই হলো ওর পরিবার। গুলাশানের মতো এলাকায় কয়েক একর জায়গা নিয়ে বিরাট বাড়ি ওদের। শারিয়ার সবসময় যাকে বলে শূন্যতার তিন একর।
তবে ছোটোবেলা থেকেই শূন্যের মাঝে বেঁচে থাকাটাও শারিয়ারকে ওর বাবার ভালো বন্ধু হওয়া ঠেকাতে পারেনি। যদি শুধু চোখ নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না মানুষটা,তবুও শারিয়ার আর ওর বাবা অসাধারণ বন্ধু। যখনই বাড়িতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাপের সামনে বসে থাকে সে। বাপের সঙ্গে গল্প করে, তাকে বই পড়ে শোনায়। নিজের পছন্দের সব গান শোনায় ওকে। বোর্ডিং স্কুলে থাকার সময়ে বাড়িতে যতদিন থাকত বাপের সঙ্গে গল্প করত ও। তারপর ওর মিলিটারিতে গমন এবং সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা এবং তারপরের জীবনে স্পেশাল ফোর্সে জয়েন করা, ইউরোপে ট্রেনিংয়ে যাওয়া, এর কোনোকিছুই বাপের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি করতে পারেনি। যখনই বাড়িতে থাকে ও বাপের কাছে চলে আসে। বিশেষ করে নিজের বাপকে বিভিন্ন বই পড়ে শোনানো ওর অত্যন্ত প্রিয় একটা কাজ।
তবে কেন জানি দুঃখের বইগুলো ওর বাবার খুব প্রিয়। বিশেষ করে জন স্টেইব্যাকের অব মাইস অ্যান্ড ম্যানের বিখ্যাত সেই দৃশ্য যেখানে জর্জ তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, তার ভাইয়ের চেয়ে প্রিয় লেনিকে পৃথিবীর রোষ থেকে বাঁচানোর জন্য নিজ হাতে হত্যা করে, এই দৃশ্যটা বারবার তার বাপকে পড়ে শোনাতে হয়। প্রতিবার এই দৃশ্যটা পড়ে শোনানোর সময়ে তার বাপের চোখে অদ্ভুত এক আকুতি ফুটে ওঠে। শারিয়ার বুঝতে পারে না তার বাপ আসলে কী বোঝাতে চায়। কিংবা সে নিজেই স্বার্থপরের মতো বুঝতে চায় না। আজও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। বাপের মুখটাকে নিজের সামনে নিয়ে আসতেই শারিয়ার দেখতে পেল ওর বাপের চোখে অদ্ভুত এক আকুতি। বাপের চোখে চোখ রাখতে না পেরে ও দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ওই চোখের দৃষ্টি সে বুঝতে পারে না, বুঝতে চায়ও না। সবচেয়ে বেশি কাছের মানুষদের প্রতিই মানুষ সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা দেখায়। শারিয়ারও নিষ্ঠুরের মতোই ওর দৃষ্টি সরিয়ে নিল নার্সের দিকে।
তার দিকে ফিরে নির্দেশনা দিল, ‘সবদিকে ঠিকমতো খেয়াল রাখবেন। আর প্রয়োজনে আরো একজন নার্স নিয়ে নিন। কিন্তু কোনো ধরনের গাফলতি আমি সহ্য করব না। আর কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে ম্যানেজার হামিদ চাচাকে বলবেন। ঠিক আছে?’ বলে ও আবারও যোগ করল। ‘প্রয়োজনে ডাক্তার আঙ্কেলের উইকলি শিডিউল আরেক রাউন্ড বাড়িয়ে দিন। আব্বুর ব্যাপারে যাতে কোনো ধরনের খামখেয়ালি বা গাফলতি না হয়…আবারও বলে দিচ্ছি আমি।’
নার্স মহিলা ওর কথার জবাবে সম্মতি জানাতেই বাপকে ভালোভাবে শুইয়ে রেখে এসে জানালার সামনে দাঁড়াল শারিয়ার। ভোরের আলো সবে ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে দিগন্ত। আর তারই ছটা এসে পড়েছে ওদের সাদা বাড়ির সামনের সবুজ ঘাসে ছাওয়া লনে। সেদিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে উঠল শারিয়ার। এত বড়ো বাড়ি অথচ সবচেয়ে কম যে জিনিসটা আছে সেটা হলো মানুষ। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে এরকম জনবিরল কোনো বাড়ি আর আছে কি না ওর জানা নেই। মুখের কোণে ফুটে ওঠা হাসিটার বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ও আরেকবার উপলব্ধি করল, এই বাড়িটা আসলেই শূন্যতার তিন একর।
একবার ঘড়ি দেখে নিয়ে বাপের দিকে ঘুরে দাঁড়াল ও। ‘আব্বু, আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। একটা মিশনে,’ বলে সে একটু থামল বাপের চোখে প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছে। একটু আগের সেই বিমর্ষ চোখে যেন একটু আলোর রেখা ফুটে উঠল ইংল্যান্ড থেকে ট্রেনিং শেষ করে আসার পর এটাই আমার প্রথম বড়ো মিশন। দোয়া রেখো আমার জন্য,’ একবার ওর ইচ্ছে করল বাপের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নেয়। কিন্তু অজানা এক লজ্জা এসে রোধ করে দিল সেই ইচ্ছে। তার পরিবর্তে সে এসে বসে পড়ল বাপের পায়ের কাছে। ‘আমি জলদি ফিরে আসব, আব্বু। ওই পর্যন্ত একদম লক্ষ্মী ছেলের মতো থাকবে,’ বলে একবার বাপের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ও রুম থেকে বাইরের দিকে রওয়ানা দিল।
রুমের পর্দা সরিয়ে বাইরে যেতে গিয়ে আরেকটু হলেই হালকা-পাতলা মধ্যবয়স্ক মানুষটার সঙ্গে ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল ও। ‘আরে, হামিদ চাচা। আপনি এত সকালে!’
হ্যাংলা-পাতলা মানুষটার হাতে একটা ফাইল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ওদের পারিবারিক ম্যানেজার এবং ওর চাচার ডান হাত এই মানুষটাকে শারিয়ারের জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই একইরকম দেখছে। মানুষটার বয়স বাড়েও না আবার কমেও না, যেন সময়ের স্রোতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক জায়গায় থেমে আছে তার বয়স।
‘আসতে হলো তোমার জন্য,’ বলে সে হেসে উঠে জড়িয়ে ধরল শারিয়ারকে। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পর মানুষটার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। ওর আপন চাচা একমাত্র গার্ডিয়ান হলেও ছোটোবেলা থেকে এই মানুষটা ছিল তার খেলার সাথি, বন্ধু ও একমাত্র মানুষ যে ওকে পুরোপুরি বুঝতে পারে। নিজের চাচার সঙ্গে ওর সম্পর্ক যদি হয় লিগ্যাল গার্ডিয়ানের, তবে ওদের ম্যানেজার হামিদ চাচার সঙ্গে ওর সম্পর্ক হলো অভিভাবক কাম বন্ধুর। সেই সঙ্গে এই মানুষটা হলো ওদের বিরাট পারিবারিক সাম্রাজ্যের অন্যতম স্তম্ভ। লোকে দুষ্টুমি করে বলে মাহবুব তালুকদার, মানে ওর চাচা এই সাম্রাজ্যের মহীরুহ হয় যদি তবে ম্যানজার হামিদ হলো সেই সাম্রাজ্যের ভিত।
‘কী নাকি গোলমাল পাকিয়েছ আবার?’ সে শাসনের ভঙ্গিতে বলে উঠল। ‘তোমার জ্বালায় তো এখন মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি ছাড়তে হবে। কী হয়েছে, পাশা ভাই তোমার চাচাকে ফোন করে নাকি একগাদা কথা শুনিয়েছে তোমার নামে।
শারিয়ার একটা হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল, ‘গুল্লি মারো উনাদের। এইসব বাল- ছাল মুরব্বিদের কথা শুনলেই আমার আরো এক রাউন্ড পেগ লাগাতে ইচ্ছে করে। তোমার খবর বলো,’ বলে সে একটা হাত দিয়ে ম্যানেজার হামিদের হাত ধরে ফেলল, ‘চলো তুমি আমার সঙ্গে। তোমার জন্য গিফট এনেছি আমি,’ বলে সে রীতিমতো টানতে শুরু করল ম্যানেজার হামিদকে।
‘আরে থাম বেটা, থাম,’ বলে সে উত্তেজিত শারিয়ারকে থামিয়ে দিল। ‘তোর গিফট আমি পরে নেব। আগে তোর চাচার সঙ্গে দেখা করে আয়,’ বলে সে ইশারায় নিচের ফ্লোরের লিভিং রুমের দিকে দেখাল। ‘নাহলে তোর চাচা তোকে তো বটেই আমাকে সুদ্ধ পুঁতে ফেলবে,’ বলে সে কপট আতঙ্কের একটা ভঙ্গি করল।
শারিয়ারও মুখ ভেংচে দিল তাকে। ‘আচ্ছা শোনো, আমি নিচে নামলে আর ওপরে উঠতে পারব না,’ বলে সে ঘড়ি দেখল, অফিসের গাড়ি আসতে খুব বেশি সময় নেই। ‘শোনো, তুমি আমার রুমে গিয়ে আমার ক্লোদিং কেবিনের নিচে একটা বড়ো লাগেজ আছে, ওটার ভেতরে তোমার জন্য একটা পাকেট ফিলিপের ঘড়ি আছে, তুমি তো আবার এসব পুরনো আমলের ব্র্যান্ড ছাড়া পরোই না। তাই ওটাই এনেছি, নিয়ে নিয়ো। আর আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি,’ বলে সে আর বেশি কিছু যোগ করল না। ম্যানেজার হামিদও জানতে চাইল না। সে ভালোই বুঝতে পারে শারিয়ার কেন চট্টগ্রাম যাচ্ছে এবং এ নিয়ে যে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না, এই জ্ঞান তার ভালোই আছে। শুধু একবার মাথা নেড়ে সে শুভেচ্ছা জানাতেই শারিয়ার বিদেয় নিয়ে চলে এলো ডাইনিং রুমে। সেখানে টেবিলের ওপরে একটা ছোটো প্যাকেট রাখা আছে। সেটা তুলে নিয়ে প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে নিচের লিভিং রুমে চলে এলো।
সেখানে সোফায় হেলান দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন একজন মানুষ। পত্রিকাতে তার চোখমুখ ঢেকে থাকলেও চকচকে জুতো আর ধারালো ছুরির মতো আয়রন করা ট্রাউজার চোখে পড়ল। পাশেই টিপয়ের ওপর রাখা কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে শারিয়ার একবার নিজের ব্লেজারটা টেনে ঠিক করে তার সামনের সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। তারপর বেশ অনেকটা উদ্ধত গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো, আঙ্কেল।’
ওর কথার জবাবে খুব হুট করেই নড়ে উঠল না সামনে উপবিষ্ট মানুষটা। কিংবা চট করে পত্রিকা বন্ধ করে দৃষ্টি মেলাল না। শারিয়ার কথাটা বলে বসে রইল। পত্রিকাটা ধীরে ধীরে ভাঁজ করে মাহবুব তালুকদার পাশ ফিরে টিপয়ের ওপর থেকে কাপটা নিয়ে একবার চুমুক দিল। শারিয়ার খুব অবাক হয়ে দেখল মানুষটা এই ভোর বেলাতেও একেবারে পুরোদস্তুর ফরমাল পোশাক পরে আছে। কড়া পালিশ করা স্যুট-টাই এমনকি বুক পকেটে রাখা নিখুঁত স্কোয়ারটাও চকচক করছে তার। নিজের একমাত্র জীবিত ও কর্মরত অভিভাবক এবং তার রক্তের সম্পর্কের একমাত্র চাচাকে যখনই দেখে শারিয়ার মনে মনে আর যাই হোক তার ড্রেসিং সেন্সের প্রশংসা না করে পারে না। সুদর্শন মানুষটা কেন এবং কীভাবে সারাটা জীবন চিরকুমার হয়ে রইল এটা একটা চরম জিজ্ঞাসা শারিয়ারের মনে।
‘তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ এই সকালবেলা আমি এই পোশাকে কেন?’ বলে মাহবুব তালুকদার চায়ের কাপে একট চুমুক দিয়ে সরাসরি তাকাল শারিয়ারের দিকে। শারিয়ার কিছু না বলে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নিজের চাচার সঙ্গে শারিয়ারের সম্পর্কটা খুবই অদ্ভুত। শারিয়ার মাঝে মাঝে ভাবে, ওর জীবনে স্বাভাবিক কিছুই নেই কেন। চাচার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা অনেকটা স্নেহময় পিতা এবং বিদ্রোহী সন্তানের মতো। ওর চাচা ওকে কতটা ভালোবাসে শারিয়ার খুব ভালো করেই জানে। এমনকি মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, ওকে বড়ো করে তোলার জন্যই ওর চাচা কখনো বিয়ে করেনি। কিন্তু সামনাসামনি কখনোই ওর চাচা সেটা প্রকাশ করে না। অন্যদিকে নিজের পরিবারের একমাত্র সক্ষম মানুষটার প্রতি শারিয়ারের নির্ভরতা কতটুকু এটাও জানে। কিন্তু সামনে কখনোই সেটা দেখায় না ও।
আর এ কারণেই দুজনেই যখন সামনাসামনি হয় খুবই অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুজনই আপ্রাণ সচেষ্টতায় নিজের আবেগের বেগকে সামলে রেখে তীব্র কথার বানে সেটাকে ভাসিয়ে দিতে চায়। আর সে-কারণেই কথোপকথনের ভেতর কটাক্ষ আর তীব্রতার স্রোত বয়ে যেতে থাকে। ঠিক যেমনটা এই মুহূর্তে ঘটে চলেছে।
‘তুমি যা ভাবছ,’ মাহবুব তালুকদার আগের কথার জের ধরেই বলে চলল। ‘একই কথা কিন্তু আমিও ভাবতে পারি,’ বলে সে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, জুতো আর ধূসর ব্লেজার পরা পরিপাটি শারিয়ারকে দেখাল। ‘কিন্তু আমি সেটা করব না কেন জানো, ‘ বলে সে শারিয়ারের দিকে একটা আঙুল তুলল। ‘কারণ আমি জানি তুমি চট্টগ্রাম যাচ্ছ। কিন্তু আমি এটা জানি না ইংল্যান্ড থেকে আসার পর তোমার কেনই বা আমার সঙ্গে দেখা করার কিংবা অফিসের কারো সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হলো না,’ তার গলার স্বর ধীরে ধীরে উঁচু হচ্ছে। শেষ দিকে তার কথাগুলো প্রায় ধমকের রূপ নিল।
অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে উঠল শারিয়ার। ওর ইচ্ছে ছিল কথোপকথনটা যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করে এখান থেকে বিদেয় নেওয়ার। কিন্তু সেটা আর হলো কই। ‘আসলে ট্রেনিং থেকে এসে এতটা টায়ার্ড হয়ে গেছিলাম যে…’
‘তোমার টায়ার্ডনেসের নমুনার কথা আমি শুনেছি,’ রাগে গলার পারদ প্রায় আকাশে উঠে গেছে মাহবুব তালুকদারের। মানুষ বিশ্রাম নিতে বাড়িতে থাকে, না হয় বেড়াতে যায়। আর তুমি গেছ ইল্লিগ্যাল রেসের মাঠে। এই তোমার রেস্ট নেওয়ার নমুনা!’
‘চাচা, আপনি জানেন না, শারিয়ার একটা হাত তুলল। ‘আপনি যেটা বুঝতে পারেন না…’ শারিয়ারের গলাও চড়তে শুরু করেছে।
শারিয়ারের গলা উঁচু হওয়া শুরু করতেই মাহবুব তালুকদার স্রেফ চোখ তুলল তার দিকে, আর এতেই শারিয়ার থেমে গেল। শারিয়ার, তুমি জানো তুমি আমার ভাতিজা নও, তুমিই আমার সন্তান। আমাদের পরিবার, তোমার বাবা, এরপর আমি, আমরা সবাই মিলে যে বিরাট ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছি এর একমাত্র উত্তরাধিকারী তুমি। আর তুমি যদি নিজেকে এভাবে অপচয় করতে থাকো…’ কথার মধ্যে থেমে গিয়ে সে একবার মাথা নাড়ল। এরপর দুঃখী গলায় বলে উঠল, ‘ছোটোবেলা থেকেই তোমাকে কঠিন নিয়মের ভেতরে বড়ো করার চেষ্টা করেছি আমি। এরপরে তুমি বড়ো হওয়ার পর যখন যা করতে চেয়েছ সেটাও দিয়েছি আমি। তুমি যখন আর্মিতে যেতে চাইলে আমি মানা করিনি। কিন্তু সেখান থেকে তুমি… এরপরে তুমি ওখানে থেকে ফেরার পর প্রায় নষ্ট হতে ধরলে আমিই তোমাকে স্পেশাল ফোর্সে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেছি। কারণ…’ মাহবুব তালুকদারের গলার ধার কমে এখন সেখানে আবেগের ঘনঘটা। ‘কারণ আমি জানতাম হাহাকারে ভরা এই সম্পদের পাহাড় তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। এরপর তুমি সেখানে গিয়ে এতটাই ভালো করতে শুরু করলে যে গর্ব বোধ করতে শুরু করলাম। এরপর আমি নিজ থেকে পাশার মাধ্যম ওদের সবচেয়ে বড়ো প্রজেক্টের ফাইনেন্সিয়ার হয়েছি। আমাদের কোম্পানি এবং ওরা সবচেয়ে বড়ো ডিলগুলো করতে যাচ্ছে। তোমাকে নিয়ে আর নতুন ওই ছেলেটাকে নিয়ে পাশা যখন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে আর তুমি কিনা তখন নিজেকে এভাবে অপচয় করার চেষ্টা করছ। কেন, শারিয়ার?’ মাহবুব তালুকদারের গলায় জবাবদিহিতার চাপ। ‘কারণটাও কি আমি জানতে চাইতে পারি না?’
‘আপনি ফাইন্যান্স করছেন মানে?’ শারিয়ার মনেপ্রাণে চাইছে ওদের কথোপকথন অন্যদিকে মোড় নিক।
তুমি জানো না, পাশা নতুন ডিপার্টমেন্ট করতে চাইছে। সরকারের সঙ্গে সেই প্রজেক্টের পুরোটাই আমরা ফাইন্যান্স করছি। ভবিষ্যতে ওদের সব ডিল নিয়ে কাজ করার জন্য।’ সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্টে বাইরের ব্যবসায়িরা লগ্নি করে এটা শারিয়ার জানত কিন্তু এতে যে তার বা তাদের কোম্পানির বড়ো ভূমিকা আছে এটা সে জানত না।
‘শোনো, শারিয়ার,’ মাহবুব তালুকদার উঠে এসে শারিয়ারের পাশে বসে পড়ল। ‘তুমি আমার ও আমাদের সবার জন্য সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। এমনকি পাশাও ঠিক এটাই মনে করে। তা না হলে এত বড়ো ব্লান্ডারিং করার পরও ও তোমাকে চট্টগ্রামে পাঠাত না। কাজেই তুমি ওখানে গিয়ে ভালো কাজ করবে এটাই আমার বিশ্বাস,’ বলে সে শারিয়ারের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল, ‘আমার জন্য না হোক, পাশা কিংবা ডিপার্টমেন্টের জন্য না হোক, তুমি নিজের জন্য হলেও ভালো কাজ করবে আমি আশা করি।’
‘আমি চেষ্টা করব,’ শারিয়ার বারবার চেষ্টা করছে ওর চাচার কথার জবাবে শক্ত কিছু একটা বলতে যেরকমটা সে সবসময় বলে। কিন্তু আজ কেন জানি কিছুতেই সে শক্ত তো হতে পারছেই না বরং উলটো নরম হয়ে যাচ্ছে।
যাও, তোমার জন্য বাইরে অফিসের গাড়ি অপেক্ষা করছে,’ বলে সে শারিয়ারের কাঁধে ছোট্ট একটা চাঁটি দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
শারিয়ারও এই পরিস্থিতি থেকে জলদি পালানোর জন্য হাতের ছোটো প্যাকেটটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ পেছন থেকে ওর চাচা বলে উঠল, ‘আজ আমাদের বেশ বড়ো একটা ডিল আছে, আর এ কারণেই আমি এই পোশাকে আছি। এখান থেকে এয়ারপোর্টে যাব ফরেন ডেলিকেটদের রিসিভ করতে। শারিয়ার, মনে রেখো তুমি আজ যাই করছ সেগুলো হলো তোমার পরিবারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া। একদিন এই পরিবারের সব তোমাকেই সামলাতে হবে।
চাচার কথা শেষ হওয়ার আগেই মৃদু হাসি ফুটে উঠল শারিয়ারের মুখে। মনে মনে সে বলে উঠল, সেই অপেক্ষাতেই থাকুন, এই জীবনে আর সেটা হচ্ছে না।