মগরাজ – ১

অধ্যায় এক – সময়: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ

আরাকানের রাজধানী ম্রোহঙের কাছেই এক জঙ্গলে

দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন প্রতিফলিত হচ্ছে মোঘল শাহজাদা শাহ সুজার পিঙ্গল চোখের মণিতে। বাস্তবের আগুনের চেয়ে শত-সহস্র গুণ বেশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে যেন যুবরাজের চোখের আগুন।

দেখতে দেখতে তার চোখের সামনেই ধসে পড়ল তার অস্থায়ী বাসস্থানের একাংশ। হোক না অস্থায়ী বাসস্থান। কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নেওয়া বাসস্থানটা এভাবে নিজের হাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়াতে বুকের গহিনে একটু হলেও কষ্ট হচ্ছে শাহজাদার। কিন্তু তার অন্য কষ্টের তুলনায় এই কষ্ট কিছুই না।

আহত-রক্তাক্ত-নিঃস্ব শাহজাদা ফিরে তাকাল তার অবশিষ্ট লোকদের দিকে। প্রায় অন্ধকার জঙ্গলের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকলেও আগুনের আলোয় প্রত্যেকের চেহারা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সংখ্যায় তারা সব মিলিয়ে শখানেক হবে। মগ রাজার বিরাট বাহিনীর তুলনায় যেটা কিছুই নয়। আগুন থেকে চোখ সরিয়ে মোঘল শাহজাদা শাহ সুজা তার বাহিনীর অগ্রভাগে অবস্থানরত কয়েকজনের চেহারায় চোখ বুলাল। পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সব হারানো রক্তাক্ত-আহত-বীভৎস চেহারাগুলো দেখলেই বোঝা যায় এরা হেরে গেছে। প্রত্যেকের চেহারায় দিশাহারা ভাবের সঙ্গে যোগ হয়েছে মৃত্যুভয়।

জীবনে অসংখ্য ছোটো-বড়ো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুবাদে শাহজাদা শাহ সুজা খুব ভালো করেই জানে এরকম মানুষদের নিয়ে পলায়ন সম্ভব কিন্তু যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়।

যুদ্ধ জয় যে প্রকৃতপক্ষে সম্ভব নয় এটা তারাও জানে। স্রেফ কিছুক্ষণের প্রতিরোধে নিজেদের জীবনটাকে আরেকটু প্রলম্বিত করার জন্যই তারা আশ্রয় নিয়েছে এই জঙ্গলে। আসলে তারা কিছুটা সম্মানের সঙ্গে মরতে চাইছে, এটাই উদ্দেশ্য। শাহ সুজার লোকেরাও জানে না, তারা যে আসলে কী করতে চাইছে। কিন্তু সুজা ঠিকই জানে সে কীসের জন্য অপেক্ষা করছে। সে আসলে অপেক্ষা করছে নিজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষটার পৌঁছানোর জন্য। শাহ সুজার নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপূর্ণ জীবন থেকে যে-কটা বড়ো শিক্ষা পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো, নিজের বিশ্বস্ত লোকদের ওপর ভরসা করা। মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো সেটাই করতে চাইছে সে। তবে মনের গহিন কোণে সে এটাও জানে, তার বিশ্বস্ত সুবাদার যতই তেলেসমাতিসম্পন্ন লোক হোক না কেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আসলে সে-ও খুব বেশি কিছু করতে পারবে না।

সুবাহ বাংলার মোঘল ভাইসরয় মহাপরাক্রমশালী মোঘল সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজমহলের দ্বিতীয় পুত্রসন্তান শাহ সুজার সর্বনাশের সূচনা হয়েছিল আসলে ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে, যখন সে অকস্মাৎই পিতা সম্রাট শাহজাহানের অসুস্থতা কাম তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে উঠেছিল। গত চারটা বছর ধরে সেই অস্থিরতারই মাশুল দিতে হচ্ছে তাকে। সেই অস্থিরতার মাশুল দিতে হয়েছে তার পরিবার-পরিজনকে। সেই অস্থিরতার ক্রমধারায় সে আজ এই আরাকান রাজের রাজধানী ম্রোহঙের কাছে, নাফ নদের ক্ষীণধারার পাশে নিজের শেষ লোকলস্কর আর সম্পদ নিয়ে মৃত্যুর ক্ষণ গুনছে। নিজের শেষ লোক-লস্করের দিকে তাকিয়ে কেন জানি শাহ সুজার আজ থেকে বিশ বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল, যেদিন সে বাঙাল মুলুকে পা রেখেছিল সুবাদার হিসেবে।

বাঙ্গাল মুল্লকে পা দেওয়ার আগে এই এলাকা সম্পর্কে খুব একটা পরিষ্কার ধারণা ছিল না শাহ সুজার। তাদের নিজেদের জাসুস আর খবরিদের মুখে সে বাঙ্গাল মুলুক সম্পর্কে যতটুকু শুনেছিল তাতে তার মনে হয়েছিল বাঙ্গাল মুলুক হলো সম্পদে পরিপূর্ণ একটা এলাকা, সেই সঙ্গে বিদ্রোহীদের আস্তানা। এর পেছনে কারণও ছিল। নানাজনের মুখে চিরকাল শুধু বাঙ্গাল মুলুকের সবুজ ফসল, দামি মসলিনের গল্প আর নানা বিদ্রোহের কাহিনিই শুধু শোনা যেত।

দিল্লি থেকে বেশ অনেকটা দূরে অবস্থিত হওয়াতে সুবাহ বাংলাতে প্রায়ই দেখা যেত দিল্লির শাসন অমান্য করে ছোটোখাটো রাজা থেকে শুরু করে জমিদাররা বিদ্রোহ ঘোষণা করত। বিশেষ করে বারো ভূঁইয়াদের ব্যাপক প্রভাবের কারণে এতে আরো বেশি অগ্নিস্ফুলন ঘটত। বারো ভূঁইয়াদের প্রধান সেনাপতি ঈশা খাঁ’র সঙ্গে তো বিরাট যুদ্ধই হয়ে গেছে মোঘলদের। যাই হোক সেটার শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়ার পরও তার প্রভাবে প্রায়ই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটত। যে কারণে শাহ সুজা যখন প্রথমবারের মতো এখানে এলো তখন নিজের লোকলস্কর নিয়ে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল।

তবে বাঙ্গাল মুলুকে পৌঁছানোর পর তার ধারণা একেবারেই বদলে যায়। প্রথমেই এখানকার সবুজে ঘেরা প্রকৃতি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলে সুবাদার সুজাকে। এরপরে স্থানীয় মানুষের আচার-ব্যবহার থেকে শুরু করে তাদের অতিথিপরায়ণতা শুধু তার মুগ্ধতার মুকুটে একটার পর একটা পালকই যুক্ত করে যেতে থাকে। এরপর একে একে কেটে যায় বিশটি বছর।

মাঝে দুবার বাবা সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে দুটো অভিযানে যাওয়া ছাড়া এই দীর্ঘ সময়ের প্রায় পুরোটা সময়ই সুজা কাটিয়েছে এই সবুজে ঘেরা বাংলার বুকে। ভালোবাসার এই এলাকার জন্য সে উজাড় করে দিয়েছে নিজেকে। বাঙ্গাল মুলুকে শাহ সুজার মতো ভাইসরয়, কিংবা শাসক, অথবা সুবাদার, যাই বলা হোক না কেন, এর আগে কখনোই আসেনি। সম্রাটের পুত্র হওয়ার পরও স্থাপনা নির্মাণ থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই সে করার চেষ্টা করেনি এই মুলুকের মানুষদের জন্য। স্থানীয় লোকেরাও বিনিময়ে নিজেদের ভালোবাসার পাত্র কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছে শাহজাদা সুবাদারের জন্য।

যদিও ভালোবাসা, সম্মান আর সফলতম শাসনের এই মুকুটে দু-একটা শুষ্ক পালকও রয়েছে। যেমন, তার শাসন আমলে মগ আর ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের উৎপাত সে সামলাতে পারেনি। তবে সেখানেও সে নিজের চেষ্টার কমতি রাখেনি। পর্তুগিজরা যাতে জলদস্যুতা ছেড়ে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা করতে পারে সেজন্য পর্তুগিজদের বিশেষ অনুমতিপত্র ‘এক নিশান’ প্রদান করেছিল সে। এরপরও সে চট্টগ্রামকে আরাকান শাসন থেকে মুক্ত করতে পারেনি। তবে তার শাসন আমলেই সে পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা আর মনিপুর রাজ্যের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। নিজের শাসন আর স্থানীয় মানুষদের ভালোবাসায় মোঘল শাহজাদা তার পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ চমৎকারভাবেই জীবন স্রোতের তোড়ে প্রবাহিত করছিল নিজের সময়। এমন সময় ঘটে বিশেষ এক ঘটনা। মোঘল সম্রাট শাহ জাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন দিল্লিতে।

দিনটা ছিল ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ। যেদিন সম্রাটের অসুস্থতার খবর তার কাছে এসে পৌঁছায় সেদিনটার কথা পরিষ্কার মনে আছে শাহ সুজার। আর দশটা স্বাভাবিক দিনের মতোই প্রাত্যহিক কাজ সেরে সে দরবারে বসেছিল রোজকার বিষয়গুলো সমাধান করতে, এমন সময় দিল্লিতে নিযুক্ত বিশেষ দূত এসে জানায় সেখানে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গেই পুরো দরবারের সবাই সচকিত হয়ে ওঠে। সম্রাটের অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়া মানে দিল্লির মসনদের ভিত কেঁপে ওঠা। আর দিল্লির মসনদের ভিত কেঁপে ওঠা মানে পুরো মোঘল সালতানাত, মানে পুরো ভারতবর্ষের ভিত কেঁপে উঠেছে। সিংহাসনে বসা সম্রাটের লৌকিক কিংবা পরলৌকিক প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম প্রশ্ন যেটা মাথায় আসে সেটা হলো, কে হতে যাচ্ছে পরবর্তী সম্রাট। নিজের লোকদের নিয়ে আলোচনায় বসে শাহজাদা শাহ সুজা। দিল্লির সিংহাসনের প্রতি তার লোভ কোনোকালেই খুব বেশি ছিল না। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় তো ঠিক করতে হবে।

নিজের লোকদেরকে নিয়ে আলোচনায় বসে করণীয় ঠিক করার আগেই খবর এসে পৌঁছায় সম্রাট শাহজাহান আসলে মারা গেছেন, কিন্তু তার বড়ো পুত্র দারা শিকো নিজের ক্ষমতায় আরোহণ নিশ্চিত করতে পিতার মৃত্যুর খবর চেপে রেখে অসুস্থতার গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে যাতে সম্রাট হিসেবে নিজের অবস্থান ঠিক করে আগেভাগেই সব গুছিয়ে নিতে পারে। কোনটা সঠিক খবর আর কোনটা যে গুজব সেটা পরখ করার কোনো উপায় ছিল না। সিংহাসনের প্রতি খুব বেশি লোভ না থাকলেও সাম্রাজ্য আর নিজের লোকদের প্রতি এক ধরনের দায়িত্ববোধ ছিল শাহ সুজার। এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার আগেই খবর এসে পৌছায়-যুবরাজ দারা শিকো আসলে নিজের অসুস্থ পিতাকে বন্দি করে সিংহাসন দখলের পাঁয়তারা করছে। অন্যদিকে এ-ও জানা যায় যে, আরেক শাহজাদা আওরঙ্গজেব নিজের বাহিনী নিয়ে দিল্লি অভিমুখে রওয়ানা দেওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে।

এবার আর শাহ সুজা নিজেকে সামলাতে পারল না। একদিকে খবর আর গুজবের ভিড়ে সঠিকভাবে কোনোকিছু জানা যাচ্ছে না, অন্যদিকে সালতানাত আর নিজের মানুষদের প্রতি দায়িত্ববোধের ক্ষীণ ধারাটা কাছের লোকেদের পরামর্শে তখন ক্ষমতা দখলের পরাকাষ্ঠা আর দিল্লির সিংহাসন দখলের লোভাতুর দানবে পরিণত হয়েছে। এমতাবস্থায় সে নিজের প্রধান সুবাদার তালেব তৈমূরের পরামর্শ চায়। তালেব তৈমূর স্বাধীন একজন ব্যবসায়ী, সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম এলাকার বণিক সম্প্রদায়ের হর্তাকর্তা ও শাহ সুজার অন্যতম সুবাদারদের একজন। এর আগেও ফিরিঙ্গি ও ডাচ বণিকদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ঝানু ব্যবসায়ী ও নৌবিদ্যায় পারদর্শী তালেব তৈমূরই ছিল সুজার সবচয়ে বড়ো পরামর্শক।

শাহ সুজা যখন নিজের লোকেদের সঙ্গে পরামর্শ করতে উদ্যোগী হয়েছিল তখন দুঃখজনকভাবে তৈমূর ছিল ব্যবসার কাজে বাইরে। তাকে জরুরি তলব করা হয় কিন্তু সে আসতে আসতে শাহ সুজার দরবারের লোকেরা শাহজাদাকে আত্মস্থ করিয়ে ফেলে যে, এই মুহূর্তে তার দিল্লি অভিমুখে রওয়ানা দেওয়া উচিত। কাছের মানুষদের পরামর্শে সে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়। কিন্তু শাহজাদার আসলে খুব বেশি ভাববার অবকাশ ছিল না। কারণ মনের গোপন বাসনাগুলো সবসময়ই বড়ো বড়ো তাড়নার দারাই তাড়িত হয়। সেটা রাজা হোক আর ফকির হোক, সবার ক্ষেত্রেই এক। শাহ সুজার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

তৈমূর এসে পৌছানোর আগেই সে তার যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে। একান্ত উপদেষ্টা ও বন্ধু তৈমূর যেদিন এসে রাজমহলে পৌঁছায় সেদিন ছিল শাহ সুজার নিজেকে রাজা ঘোষণা করার দিন। বহু বছরের কর্মতৎপরতা সততা আর নিষ্ঠাকে এক বাক্যে জলাঞ্জলি দিয়ে শাহ সুজা সেদিন রাজমহলে নিজেকে আসলে রাজা ঘোষণা করেনি, বরং সে সেদিন নিজেসহ তার পরিবারের ধ্বংসযজ্ঞ ঘোষণা করেছিল। যাই হোক, তৈমূর যখন রাজ মহলে এসে পৌঁছায় শাহ সুজা ততক্ষণে নিজেকে মোঘল সালতানাতের সম্রাট ঘোষণা করে নিজের সভাসদদের উপস্থিতিতে নিজেই রাজমুকুট পরিধান করে ফেলেছে। তৈমূর দূর থেকেই সুজার বরণ অনুষ্ঠান অবলোকন করে। সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হওয়ার পর তৈমূর ফুসরত পায় শাহ সুজার সঙ্গে মোলাকাত করার।

নিজেকে রাজা ঘোষণা করার আনন্দে শাহ সুজা তখন বিভোর, আর তার লোকেরা আবেশে আচ্ছন্ন। উৎসবমুখর পরিববেশেই তৈমূর সুযোগ বুঝে একবার শাহ সুজাকে সাবধান করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। একই ঘটনা ঘটে স্বঘোষিত রাজা যখন গঙ্গা নদীতে নিজের নৌবহর সাজাতে শুরু করে। তৈমূর নিজে যোদ্ধা না হলেও নৌপথের ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে পানির যুদ্ধের বিষয়ে তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা ছিল। স্বঘোষিত সম্রাট শাহ সুজাকে সাবধান করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেও যুদ্ধে গমনরত নিজের বন্ধু সুজাকে সে হতাশ করেনি। শাহ সুজার বাহিনীকে সজ্জিত করতে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করে সে। বিপুল প্রস্তুতিসহ গঙ্গা নদীতে বিরাট বাহিনী নিয়ে রওয়ানা দেয় সম্রাট শাহ সুজা।

তার যাত্রা দিল্লি অভিমুখে হলেও নৌবাহিনী ঠিকই জানত দিল্লি পর্যন্ত তারা পৌছাতে পারবে না। এর আগেই যুদ্ধ অনিবার্য। কারণ গঙ্গার নদীপথে তার বাহিনীর দিল্লি অভিমুখে রওয়ানা দেওয়ার খবর তো আর চাপা থাকবে না। বাস্তবে হলোও তাই। গঙ্গা নদী বেয়ে রওয়ানা করা বিরাট বাহিনী বাহাদুরপুরের কাছেই সম্মুখীন হলো সুজার বড়ো ভাই দারা শিকোর বাহিনীর সঙ্গে। বাহাদুরপুরে দুই বাহিনীর ভেতরে যা ঘটল সেটাকে যুদ্ধ না বলে বলা উচিত পলায়ন করে প্রাণরক্ষা। দারার বাহিনীর সামনে শাহ সুজার বাহিনী দাঁড়াতেই পারল না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে শাহ সুজার বাহিনী ফিরে এলো রাজমহলে। শাহ সুজা ছিল বাংলার সবচেয়ে সফল সুবাদারদের একজন। বাংলার পথে পথে মানুষ তার করিৎকর্মতা ও শাসক হিসেবে তার সফলতার গুণগান করে চলে, সেখানে সে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শাসনের গন্ধ পেতেই এমনভাবে ছুটে গেল যেন পাগল হয়ে গেছে।

বাহাদুরপুরের যুদ্ধে হেরে গিয়ে শাহ সুজা রাজমহলে ফিরে এলো ঠিকই কিন্তু আগের সেই ঠান্ডা মাথার সুশাসক শাহ সুজা ফিরে আসেনি। এবার ফিরে এসেছে যুদ্ধে পরাজিত হিংস্র আর ক্ষমতার লোভে অন্ধ একজন মানুষ। রাজমহলে ফিরেই সে আবারও দিল্লি অভিমুখে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। তার কাছের লোকেরাও তাকে উৎসাহের সঙ্গে উসকানি দিয়ে যেতে লাগল সম্রাটের চোখে ভালো হওয়ার জন্য। শাহ সুজার একান্ত মিত্র তৈমূর বহুবার চেষ্টা করেও তাকে কোনোকিছুই বোঝাতে সমর্থ হলো না। শাহ সুজা তোড়জোরের সঙ্গে আবারও দিল্লি অভিমুখে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি চালিয়ে গেল।

এদিকে শাহ সুজা যখন পুনরায় দিল্লি অভিমুখে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে তখন দিল্লিতে ঘটে চলেছে আরেক নাটক। শাহ সুজা আর তার বড়ো ভাই দারা শিকো তখন একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। এমন সময় তাদের আরেক ভাই আওরঙ্গজেব ঠিকই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজের বাহিনী গোছাতে শুরু করেছে। বাহাদুরপুরের যুদ্ধে শাহ সুজা পরাজিত হলেও দারার বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিও একেবারে কম হয়নি। বাহাদুরপুরের যুদ্ধের ধাক্কা দারা তখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এমন সময় আওরঙ্গজেব আক্রমণ চালাল দিল্লিতে। পরপর দুবার, একবার ধর্মাতের যুদ্ধে, আরেকবার সামগড়ের যুদ্ধে দারা শিকোকে পরাজিত করে আওরঙ্গজেব দখল করে নিল দিল্লির সিংহাসন। সিংহাসন দখল করে সে নিজের অসুস্থ বাপ শাহজাহানকে বন্দি করে রাখল আগ্রার দুর্গে। আগ্রার দুর্গে বন্দি শাহজাহান দুর্গের বুরুজের বন্দিখানা থেকে তাকিয়ে থাকেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্থাপত্য তার নিজের নির্মাণ তাজমহলের দিকে। এমনি একদিন তার বন্দিখানার দরজা খুলে গেল। সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজের পিতার জন্য বিশেষ উপহার পাঠিয়েছেন। উপহারের সঙ্গে বিশেষ বার্তা। ছোট্ট চিরকুটে সম্রাটের নিজের হাতে লেখা ছোট্ট বার্তাটি পড়ে শাহজাহান খুশিতে আন্দোলিত হয়ে উঠলেন। কারণ চিরকুটে ছোটো করে লেখা ‘সম্রাট আওরঙ্গজেব তার পিতাকে ভুলে যায়নি, আর তাই নিজের পিতার জন্য এই ছোট্ট উপহার।’ চিরকুটটা পড়ে সম্রাট খুশির সঙ্গে উপহারের ডালার ওপর থেকে আচ্ছাদন সরিয়ে সেখানে নিজের আদরের সন্তান দারা শিকোর কর্তিত মুণ্ড দেখে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।

দিল্লির তখতের এই বীভৎস খবর সুজার রাজমহলে গিয়ে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। বড়ো ভাইয়ের এই বীভৎস মৃত্যু আর পিতার সঙ্গে ছোটো ভাই ও বর্তমান সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিষ্ঠুর আচরণের খবর শুনে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে উঠল শাহ সুজা।

অপ্রস্তুত-অর্ধপ্রস্তুত নিজের বাহিনী নিয়ে আবারও সে রওয়ানা দিল রাজধানী অভিমুখে অভিযান চালানোর জন্য। এবার তার অভিযান সদ্য নিজেকে সম্রাট ঘোষণাকারী নিজেরই ছোটো ভাই সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে।

এবার শাহ সুজার বাহিনী আওরঙ্গজেবের বাহিনীর মুখোমুখি হলো খাজোয়াতে। শাহ সুজার বাহিনী এর আগে দারার তুলনামূলক দুর্বল বাহিনীর সামনেই যেখানে দাঁড়াতে পারেনি সেখানে আওরঙ্গজেবের দুর্দান্ত শক্তিশালী বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে টিকতে পারার প্রশ্নই ছিল না। আওরঙ্গজেবের বাহিনীর কাছে খাজোয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা যখন অনুধাবন করতে পারল, আসলে তার বিরাট ভুল হয়ে গেছে, কিন্তু ততক্ষণে আর কিছুই করার ছিল না। একে তো যুদ্ধে তার পরাজয় হয়েছে তার ওপরে তার পশ্চাৎপদ বাহিনীর পেছনে আওরঙ্গজেব লেলিয়ে দিয়েছে তার সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাপতিদের একজন মির জুমলাকে।

একদিকে ছোটো ভাই ও সদ্য সম্রাট আওরঙ্গজেবের বাহিনীর কাছে মার খেয়ে রীতিমতো কুকুরের মতো লেজ তুলে পলায়নরত, তার ওপরে আবার মির জুমলার বাহিনীর কাছে তাড়া খাওয়া শাহ সুজার বাহিনীর অবস্থা হলো ঢিল খাওয়া মৌমাছির চাকের মতো। সৈনিক থেকে শুরু করে ছোটোখাটো সেনাপ্রধান তো বটেই, এমনকি তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতিরাও তাকে ফেলে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে যেতে শুরু করল। এতদিন যারা তাকে দিনের পর দিন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য, দিল্লি অভিমুখে আক্রমণ চালাতে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল চূড়ান্ত পরাজয়ের সময়ে তারাই প্রথমে একে একে তাকে ছেড়ে সরে পড়তে শুরু করল।

এমন অবস্থায় কোনোমতে নিজের অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে শাহ সুজা তাণ্ডায় পৌছাল। ইচ্ছে খানিকটা বিশ্রাম নেওয়া, সেই সঙ্গে সম্ভব হলে যতটা সম্ভব নিজের বাহিনীকে কিছুটা গুছিয়ে নেওয়া। কিন্তু তাণ্ডায় পৌঁছে নিজের একান্ত মিত্র তৈমূরকে নিয়ে আলোচনায় বসে শাহ সুজা ও তার পরিষদবর্গ। সমস্ত হিসেব-নিকেশ সম্পন্ন করে যা বুঝতে পারল তা হলো আওরঙ্গজেব তো দূরে থাক তার পাঠানো সেনাপতি মির জুমলাকে মোকাবেলা করার মতো সামর্থ্যও তাদের নেই। যদিও তাণ্ডায় পৌঁছাতে গিয়ে ছোটোখাটো যুদ্ধে মির জুমলার বাহিনীর সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়ে গেছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যা বোঝা যাচ্ছে তাতে এটা পরিষ্কারই মনে হচ্ছে যে, মির জুমলার সঙ্গে সরাসরি মোলাকাত হলে তাদের সবাইকে কচুকাটা হতে হবে। আর মির জুমলার তাড়া করার ধরন দেখে এটা সুস্পষ্ট যে, এটাই তার উদ্দেশ্য। আওরঙ্গজেবের নিদের্শে শাহ সুজা আর তার বাহিনীকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতেই যেন সে বদ্ধপরিকর।

এমতাবস্থায় শাহ সুজার একান্ত মিত্র তৈমূর তাকে বাঙ্গাল মুলুকের দক্ষিণ দিকে সরে যেতে পরামর্শ দিল। চট্টগ্রাম যেহেতু সরাসরি আরাকানের অধীনে সেখানে তার নিজের কিছুটা হলেও প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, সেদিক এগোলে সে কিছুটা হলেও শাহ সুজাকে সাহায্য করতে পারবে সে। কিন্তু তৈমুরের পরামর্শ না মেনে শাহ সুজা ঘোষণা করে বসল এসব যুদ্ধ-টুদ্ধ অনেক হয়েছে এসবের ভেতরে সে আর নেই। বীতশ্রদ্ধ সম্রাট চিরকালের মতো নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে মক্কা চলে যেতে চায়। অনেকেই বোঝালো, অনেকেই অনুনয় করল কিন্তু স্বঘোষিত সম্রাট নিজের ভাবনায় অবিচল। কেউই তার মত টলাতে পারল না। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। তাণ্ডা থেকে নিজের বাহিনী নিয়ে শাহ সুজা রওয়ানা করল আরাকান অধিষ্ঠিত চট্টগ্রামের দিকে। তার দুদিন আগে তালেব তৈমূর রওয়ানা দিল চট্টগ্রামে। ইচ্ছে, ওখানে গিয়ে সম্রাটের যাত্রার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা।

শাহ সুজা নিজের বাহিনী থেকে শুরু করে পরিবার-পরিজন তো বটেই, নিজের সমস্ত ধন-সম্পদ নিয়ে যখন চট্টগ্রামে পৌঁছালে সেখানে আরাকানরাজের প্রতিনিধি ও তৈমূর তাকে গ্রহণ করে নিল। কিন্তু সেখানে পৌছে সম্রাট যা শুনলো তাতে বেশ দমে গেল সে। প্রাকৃতিক অবস্থা মক্কা রওয়ানা দেওয়ার জন্য ঠিক সঙ্গিন নয়। তৈমূর সম্রাটকে পরামর্শ দিল, মাস দুয়েক কিংবা যতটা সময় লাগে এখানেই অপেক্ষা করতে। সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে দুলতে থাকা সম্রাট স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই খবর এলো, পিছু ধাওয়া করে আসতে থাকা মির জুমলার বাহিনী বাংলার রাজধানী ঢাকায় পৌঁছে গেছে। এবার শাহ সুজা কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই বুঝতে পারল, বাঙ্গাল মুলুকের মাটি তার জন্য অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। নিজের লোকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে, চট্টগ্রাম থেকে তারা আরাকানে চলে যাবে। যত দিন পর্যন্ত মক্কা রওয়ানা করার মতো অনুকূল আবহাওয়া না পাওয়া যাচ্ছে তত দিন আরাকান রাজের অতিথি হিসেবেই সে-সময়টা পার করবে সে। নিজের পরিজনদের নিরাপত্তার কথা ভেবে যে সিদ্ধান্ত সে নিচ্ছে সে সিদ্ধান্তই যে তার পরিজনসহ নিজের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে সম্রাট তো আর তা জানত না।

শাহ সুজা নিজের লোকলস্করসহ বিরাট বাহিনী নিয়ে আরাকান রাজের রাজধানী ম্রোহঙের কাছে পৌঁছাতেই স্বয়ং সম্রাটের দূত এসে তাদেরকে নিয়ে গেল সম্রাটের দরবারে। তবে তার দরবারের নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রাজধানীতে প্রবেশ করতে হলো সমস্ত অস্ত্র জমা দিয়ে। যদিও শাহ সুজার সঙ্গের অনেকেরই এতে আপত্তি ছিল কিন্তু এছাড়া তাদের আর কোনো উপায়ও ছিল না। যাই হোক, আরাকান রাজের দরবারে সম্রাট থানডা থুরামার সঙ্গে তাদের সাক্ষাটা হলো চমৎকার। সম্রাট তাদের প্রতিশ্রুতি দিল যেহেতু সম্রাটের নির্দেশে তারা নিজেদের সকল অস্ত্র জমা দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেছে সেহেতু অতিথি হিসেবে তাদের বরণ করে নিতে তার কোনো আপত্তি নেই। সেই মোতাবেক শাহ সুজাসহ সব অতিথিদের রাজধানীসংলগ্ন চমৎকার এটি বাড়ি দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে সম্রাট এটাও প্রতিশ্রুতি দিল, আবহাওয়া অনুকূল হলে সে নিজে তাদের মক্কা রওয়ানা করার জাহাজের ব্যবস্থা করে দেবে। শাহ সুজা সরল মনে সব মেনে নিয়ে সম্রাটের আতিথ্য গ্রহণ করল।

কিন্তু ভুলেও সে ভাবতে পারেনি আরাকান সম্রাটের নিয়ত ছিল একেবারেই ভিন্ন। দুশ্চরিত্র ও লোভী আরাকান সম্রাট জানত শাহ সুজার সঙ্গে ছিল ছাব্বিশটা ঘোড়ায় বহন করে নিয়ে আসা বিরাট সম্পদের পাহাড়। প্রথম দিন থেকেই আরাকান সম্রাটের নজর ছিল সেগুলোর ওপরে। সেই সঙ্গে দুশ্চরিত্র সম্রাটের নজর পড়েছিল শাহ সুজার সুন্দরী কন্যা গুলরুখ বানুর ওপরে। কিন্তু শাহ সুজা কিংবা তার লোকেদের কেউ ঘুণাক্ষরেও আরাকান সম্রাটের কূট উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি।

রাজধানীসংলগ্ন বাড়িতে তারা বেশ নির্বিঘ্নেই বাস করতে শুরু করে। আরাকানের রাজদরবার থেকেই শাহ সুজার সঙ্গে পরিচয় মুসলিম কবি আলাওলের। শাহ সুজা নিজেও শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী। সেই হিসেবে কবি আলাওলের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কবি আলাওলকে একসময় আরাকান সম্রাটের লোকেরা দাস হিসেবে ধরে আনলেও এখন সে আরাকানের রাজদরবারে থিতু হয়ে কাব্যচর্চা করে চলেছে। সবমিলিয়ে শাহ সুজার সময়টা ম্রোহঙে একেবারে খারাপ কাটছিল না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল আরাকান সম্রাটের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেমন জানি শুকনো ধারার মতো শুষ্ক হয়ে যাচ্ছিল। সম্রাট থুরামা আর তার লোকজনের আচরণে কোথায় যেন একটা ভিন্নতা কাজ করছিল। এমন সময় আরাকানে এসে হাজির হয় শাহ সুজার একান্ত মিত্র তৈমূর। সে এসেই আগে বাঙ্গাল মুলুকের খবর জানায়। যদিও মির জুমলা এখনো ঢাকায় অবস্থান করছে তবে তার জাসুসেরা ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। এমনকি তৈমূর এ-ও জানায় মোঘল জাসুসেরা আরাকানেও আছে। কারণ শাহ সুজার আরাকানে অবস্থানের যাবতীয় খবর বাঙ্গাল মুলুক হয়ে ঠিকই গিয়ে পৌঁছেছে মোঘল দরবারে। ওদিকের অবস্থা শুনে, শাহ সুজা তৈমূরকে এখানকার পরিস্থিতি জানায়। সব শুনে তৈমূর জানায়, হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। কারণ যত দিন মক্কা যাওয়ার মতো জলপথ খুলে না যাচ্ছে, সেই সঙ্গে জাহাজ প্রস্তুত না হচ্ছে ততোদিন তারা এখানে একরকম বন্দি। তবে সে নিজের লোক থেকে জাসুস নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চালাবে যাতে আরাকানের দরবারের ভেতরের খবর বের করে আনতে পারে।

সেদিন বিকেল থেকে শাহ সুজার বাসস্থানে কবিতা পাঠের আসর বসেছিল। আলাওল তো বটেই, এমনকি খোদ সম্রাট শাহ সুজা পর্যন্ত কবিতা পাঠ করেন সে আসরে। আরাকান সম্রাটকে নিমন্ত্রণ জানালেও প্রথমে সে বলেছিল আসবে না, কিন্তু শাহ সুজার ছোটোকন্যা গুলরুখের নৃত্য-গীত পরিবেশনের সময়ে ঠিকই সে এসে হাজির হয়। যদিও সে খুব বেশি সময় অবস্থান করেনি তবুও গুলরুখের গীত পরিবেশনের ভূয়সী প্রশংসা করে বিদায় নেয় সে। কাব্যচর্চার আসর শেষে ব্যাপক খানাপিনা আর মদ্যপানের পর বহুদিন পর শাহ সুজা সেদিন খুব ফুরফুরে মন নিয়ে নিদ্রায় যান।

সেদিন রাতেই শাহ সুজার নিরস্ত্র লোকজনের ওপরে আক্রমণ করে বসে আরাকান সম্রাটের বাহিনী। রাত তখন সবেমাত্র পূর্বভাগ থেকে গভীর রাতের দিকে বয়ে চলেছে। এমন সময় আরাকানরাজের বাহিনী পূর্ণ প্রস্তুতির সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে শাহ সুজার মহলে। শাহ সুজার লোকেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কচুকাটা হতে শুরু করে আরাকানরাজের বাহিনীর হাতে। বুঝে উঠতেই অনেকেই মারা গেছে। বন্দি হয়েছে পরিবারের লোকেরা। মেয়েদেরকে গণহারে ধর্ষণ করতে শুরু করেছে আরাকান রাজের বাহিনী।

এমন বীভৎস খুনোখুনি দেখে, বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞথাকা সত্ত্বেও শাহ সুজা কেমন যেন ঘোরের ভেতরে পড়ে যায়। যখন তার হুঁশ ফেরে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে তৈমূরের নিয়ন্ত্রণে।

শাহ সুজা যখন আরাকানে আসে তখন নিজের ব্যবসা আর পারিবারিক কারণে তৈমূর তার সঙ্গে আসেনি। তাছাড়া মির জুমলার বাহিনীর খবরাখবর নেওয়ার জন্য হলেও বাঙ্গাল মুলুকে কারো না কারো থাকার প্রয়োজন ছিল। তৈমূর তার নিজের কিছু লোকলস্কর নিয়ে আরাকানে এসে পৌঁছেছে মাত্র অল্প কদিন আগে। এরইমধ্যে আক্রমণ হয় শাহ সুজার লোকদের ওপরে।

তৈমূর যদিও সামরিক বাহিনীর লোক নয় আর তার তেমন কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও নেই তারপরও যৌবনে সম্রাট শাহজাহানের সেনাবাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা তার ছিল। আর ওরকম বিক্ষিপ্ত সময়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নয় বরং ঠান্ডা মাথার একজন মানুষের প্রয়োজন ছিল। আগের দিনের কাব্যচর্চার অনুষ্ঠানের পর সবাই মদ খেয়ে প্রায় চুর হয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। এটা তার সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য সে নিজেও জানে না কারণ সে জেগে ছিল ওই সময়। এমনিতেও তৈমূর খুব বেশি মদ্যপান করে না, আর সেদিন একেবারেই করেনি। একে তো আয়োজনের পরেই কবি আলাওলের সঙ্গে তার জরুরি কিছু আলোচনা ছিল। অন্যদিকে আরাকানের রাজসভার ভেতর থেকে একজনের খবর নিয়ে আসার কথা ছিল। এ কারণে সে অপেক্ষায় ছিল।

আক্রমণের সময়ে সে ছিল বাড়ির পেছন দিকে। আলাওলের দেখা করার কথা ছিল সেখানে, আর তার লোকেরও। কিন্তু দুজনার কেউই আসেনি সময়মতো। আপেক্ষা করতে করতে সে যখন অস্থির সেই সময় বাড়ির সামনের অংশ থেকে ভেসে আসে মরণপণ চিৎকার। নিরস্ত্র অবস্থাতেই সে রওয়ানা দেয় বাড়ির সামনের দিকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে পৌছাতে আরাকান রাজের বাহিনীর বীভৎস খুনোখুনি শুরু হয়ে গেছে। মুহূর্তের ভেতরে পরিস্থিতি বিবেচনা করে সে বুঝতে পারে যা ঘটতে শুরু করেছে সেটা ঠেকানোর মতো অবস্থায় নেই তারা। প্রথমেই সে সাবধান করে দেয় তার নিজের একান্ত কয়েকজনকে। তাদেরকে বিশেষ কিছু নির্দেশনা দিয়ে সে রওনা দেয় শাহ সুজার বসবাসের কামরার দিকে। সেখানে পৌঁছানোর আগেই বুঝতে পারে শাহ সুজা আর তার পরিবারই ছিল আরাকানিদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। সেই সঙ্গে সুজার সম্পদ। সুজার পরিবারকে ইতোমধ্যে আরাকানিরা বন্দি করে ফেললেও আড়াল থেকে সে দেখে তাদের মাঝে শাহ সুজা নেই। সুজাকে সে খুঁজে পায় নিজের অবশিষ্ট লোকদের সঙ্গে বাড়ির শেষ ভাগে। সেখানেই সে সুজাসহ তাদের বাহিনীর বাকি কয়েকজনকে নিয়ে সে গড়ে তোলে প্রতিরোধ। প্রথমেই সুজাকে তার বিশ্বস্ত লোকজনসহ পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বাড়িসংলগ্ন জঙ্গলে। এরপর বাকিদের নিয়ে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যদিও এতে সুজার ভীষণ আপত্তি ছিল। কারণ তাতে তার নিজের লোকদেরও ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু তৈমূর তো জানে তার লোকেরা আর খুব বেশি জীবিত নেই। সেই সঙ্গে তৈমূর এটাও বুঝতে পারে বাড়িতে আগুন না লাগালে বাকিদেরকেও বাঁচানো যাবে না। তাই সুজা পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিতেই সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

জঙ্গলের কিনারায় পৌছামাত্র শাহ সুজা দেখতে পেল তার বাসভবনে দাউ-দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে, সে বুঝতে পারল তৈমূর তার নিষেধাজ্ঞা শোনেনি। সে ঠিকই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বাড়িতে। সঙ্গে-সঙ্গে সে ফিরে তাকাল নিজের অবশিষ্ট লোকদের দিকে। পা কাঁপছে তার, মনে হচ্ছে যেকোনো সময়ে টলে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু তীব্র রাগ-ক্ষোভ আর অসহায়ত্বের চোটে নিজেকে একটা তোপ মনে হচ্ছে। স্রেফ সেই শক্তিতেই দাঁড়িয়ে আছে সে। নিজের লোকদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। প্রত্যেকের চেহারা বিধ্বস্ত, সেই সঙ্গে প্রিয়জনসহ সব হারানোর বেদনায় সিক্ত। শাহ সুজা নিজের হাতের তরবারির দিকে তাকাল। কোনো এক আরাকানি সৈন্যের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল সে। তার লোকদেরও অনেকের হাতে একরকম কেড়ে নেওয়া অস্ত্র অথবা লাঠিসোটা। যে যা পেয়েছে তাই উঠিয়ে নিয়েছে।

‘হুজুর, আমাদের জঙ্গলের আরো ভেতরের দিকে সরে যাওয়া প্রয়োজন,’ সুজার দ্বিতীয় প্রধান সেনাপতি ভাঙা গলায় কোনোমতে বলে উঠল। গলার কাছে বিরাট ক্ষত থেকে রক্ত গড়াচ্ছে লোকটার। এরকম ক্ষত নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে কে জানে।

‘না আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব,’ সুজার গলায় ছোটো বাচ্চাদের মতো জেদ। ‘এভাবে…’ সুজা তার বক্তব্য শেষ করার আগেই জঙ্গলের ভেতরে কোথাও থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে এলো। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল সবাই সচকিত হয়ে উলটো ঘুরে তাকাল সেদিকে। যার যা আছে তাই নিয়ে সম্ভাব্য শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু জঙ্গল ফুঁড়ে অন্ধকারের ভেতর থেকে উদয় হলো যে দুজন ঘোড়সওয়ার তাদের দেখে একটু শিথিল হলো তাদের সতর্ক ভাব।

দুজন সৈনিক ওদের কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে সম্মান ভরে সম্রাটকে কুর্নিশ করল। ‘তোমরা এখানে…?’

‘আমি পাঠিয়েছি ওদেরকে, ওদের পেছনের দিক থেকে একাধিক মানুষের পায়ের আওয়াজের সঙ্গে পরিচিত বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শুনে সুজা ফিরে তাকাল সেদিকে। রক্ত-ঘাম আর কালিঝুলিতে মাখামাখি তৈমূর আর তার সঙ্গের কয়েকজনকে দেখে মানুষ বলে চেনার উপায় নেই। তবে তৈমুরের সঙ্গে নিজের প্রধান তল্পিবাহক ছইরুদ্দি আর কবি আলাওলকে দেখতে পেয়ে তাদের দিকে প্রায় ছুটে গেল শাহ সুজা।

‘গুলরুখ, ওর মা আর আদ্দিন, ওদের কী অবস্থা?’ শাহ সুজার গলায় সম্রাটের সুর নয় বরং একজন সব হারানো পিতার ব্যাকুলতা।

তল্পিবাহক ছইরুদ্দি কিছু বলার আগে দুবার মাথা নাড়ল। ‘সবাই সবাই শেষ… আরাকানিরা যারে পাইছে তারেই শেষ কইরা দিচ্ছে খালি… খালি এই কথাটা বলার আগে সে থেমে গিয়ে একবার তৈমূরের দিকে দেখে নিল। তৈমূরের কালিঝুলি মাখা রক্তাক্ত চেহারা পাথরের চেয়েও কঠিন। ‘খালি শাহাজাদি গুলরুখ বাঁইচা আছে। কিন্তুক না থাকলেই ভালা আছিল। হেরে আরাকানিরা নিয়া গেছে সম্রাটের প্রাসাদে,’ বলেই ছইরুদ্দি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।

শাহু সুজা শেষ কথাটা শুনে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল তারপর প্রাণপণে চেচিয়ে উঠল। সমস্ত রাগ ক্ষোভ অসহায়ত্ব আর যন্ত্রণা আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে এলো তার গলা চিড়ে। চিৎকার করেই সে হাতে ধরা অস্ত্রটা তুলে ধরে সামনে এগোতে যাচ্ছিল তৈমূর এগিয়ে এসে শক্ত হাতে ধরে ফেলল তাকে। ‘সম্রাট, সাবধান। আবেগের বশে আর বোকামি করার সুযোগ নেই আমাদের,’ সে এক হাতে সম্রাটের অস্ত্র ধরা হাতটা ধরে আছে। অন্য হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সম্রাটকে। এমনকি এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও সম্রাটকে অন্য কেউ স্পর্শ করার অধিকার বা সাহস কোনটাই রাখে না। ‘খবরদার সম্রাট, যারা বেঁচে আছি তারাও মারা পড়ব।’

‘তুমি কি বলছো তৈমূর? ওরা ওরা আমার পরিবারের সবাইকে…’

তৈমূর শক্ত হাতে সম্রাটাকে ধরে এমন এক কাজ করল যা মোঘল সালাতানাতে কেউ ভাবতেও পারে না। সে অস্থির হয়ে ওঠা সম্রাটকে শক্ত দুই হাতে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে দুবার ঝাঁকি মারল তারপর তাকে ঠেসে ধরল একটা গাছের সঙ্গে। ‘সম্রাট, আমি আগেই বলেছি আমাদের আবেগী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি আপনাকে বহুবার বহুভাবে সাবধান করেছি, আপনি আমার কথা শোনেননি। একের পর এক ভুল করেই গেছেন আবেগের বশে। আপনার পরিবারের মৃত্যুর জন্যও আপনি নিজেই দায়ী। কিন্তু অবশিষ্ট যা আছে সেটা আমাদেরকে রক্ষা করতে হবে।’

সম্রাট শাহ সুজা স্থির হয়ে ফিরে তাকাল তার দিকে। ‘অবশিষ্ট আর আছে কি। আমার পরিবার শেষ, আমার সাম্রাজ্য শেষ আর রইল কী?’ বলেই সে আবারও ভেঙে পড়তে যাচ্ছিল। কিন্তু তৈমূর শক্ত হাতে তাকে ধরে রাখল।

‘আছে সম্রাট, এমনি কিছু আছে যা আপনার পূর্বপুরুষরা তিলতিল করে গড়ে তুলেছে আর আপনি সেটাকে সারাজীবন ধরে আঁকড়ে রেখেছিলেন যাতে একসময় সেটা আপনার মানুষের কাজে লাগে। সেটা এখনো ধ্বংস হয়ে যায়নি। আপনি জানেন। বরং সেটা শত্রুর হাতে পড়লে আরো বড়ো বিপদ হবে,’ তৈমূর আর সম্রাটের ভেতরে চোখে চোখে কথা হচ্ছে।

‘ওই আগুন,’ বলে সম্রাট জ্বলন্ত বাড়িঘরের দিকে দেখাল। ‘ওই আগুন সব গিলে খেয়েছে। আমার সব…’

‘না সম্রাট,’ তৈমূর একবার ওদের আশপাশের সবাইকে দেখে নিয়ে বলে উঠল। ‘আমি আপনার পরিবারকে বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু আমি অন্য কিছু রক্ষা করতে পেরেছি। বাড়িসংলগ্ন গোলাঘরে লুকিয়ে রাখা বাক্সপ্যাটরাসহ সব আমি এমনভাবে রেখেছিলাম যাতে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে পারি। আক্রমণ টের পেতেই ঘোড়ায় চড়িয়ে আমার লোকেরা সেগুলো আগেই জঙ্গলের ভেতরে সরিয়ে ফেলেছে। ওই লোকদুজন,’ বলে সে জঙ্গলের ভেতর থেকে আসা দুই ঘোড়সওয়ারকে দেখাল। ‘ওরা সেখান থেকেই এসেছে।’

এবার সম্রাট শক্ত করে তৈমূরের জামা ধরে ফেলল। ‘তুমি আমার পরিবারকে না বাঁচিয়ে…’

তৈমূরও স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্রাটের চোখে। ‘আপনি আমাকে অনেককিছুই করতে দেননি সম্রাট। অনেক সিদ্ধান্ত আমার হাতে ছিল না, তবুও আমি চেষ্টা করতাম কিন্তু তার আগেই… সম্রাট আমাদের হাতে সময় নেই। আমার ধারণা যদি ভুল না হয়ে থাকে তবে আমরা এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছি এটা আরাকানিরা ইতোমধ্যেই টের পেয়ে গেছে। এবার আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কী চান। আমি আগেই বলে রাখছি, আমি সব রক্ষা করতে পারব না। হয় আমি আপনাকে বাঁচাতে পারব আর না হয়…’ এরকম মৃত্যুমুখী অবস্থায় দাঁড়িয়েও তৈমূর অনুভব করল সম্রাট আসলে সম্রাটই। এমনকি বন্ধু হলেও তাকে সরাসরি সব কথা বলা যায় না। তবুও নিজেকে সে শক্ত করল। একমাত্র তারই সম্রাটকে এ কথা বলার অধিকার আছে, একমাত্র সে-ই বলতে পারবে, আর তাকে বলতে হবে।

‘আপনাকে আপনার আকাঙ্ক্ষা আর দায়িত্বের মধ্যে বেছে নিতে হবে সম্রাট। একটাকে রক্ষা করতে হলে আপনাকে অন্যটার বলিদান দিতে হবে। এখন আপনাকে বেছে নিতে হবে কোনটাকে আপনি রক্ষা করতে চান। হয় আপনি বাঁচবেন আর না হয়…’

‘আমার অস্তিত্বের আর কোনো দাম নেই,’ বলে সে চারপাশে একবার দেখে নিয়ে ভেজা চোখের দৃষ্টি স্থির করল ধরাধামের অবশিষ্ট একমাত্র মানুষটির ওপরে, যাকে সে বন্ধু মনে করে। ‘কাজেই আমার সত্তার আর কোনো দাম নেই। আমার আকাঙ্ক্ষা আর দায়িত্বটাই বেঁচে থাক, যাতে সেটা আমার মানুষদের কাজে লাগে

এক মুহূর্তেও জন্য তৈমূর কোনো কথা বলল না, এরকম ভয়ংকর মুহূর্তের বন্ধুসম সম্রাটের শেষ ইচ্ছেটাকে বিবেচনা করে দেখছে সে। নিজের পরবর্তী শব্দগুলো খুব সাবধানে নির্বাচন করল তৈমূর। সম্রাট আপনি যা বলছেন বুঝে বলছেন তো?’ তৈমুরের দৃষ্টি পর্বতের মতো স্থির আর শান্ত। ‘আপনি যা বলছেন সেটার ওপরেই কিন্তু আপনার জীবন…’

তৈমূর কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই সম্রাট পুতুলের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে প্রাণপনে সামলে নিয়ে হাতের তলোয়ার ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে তৈমূরকে ধরে ফেলল। ‘আমার সব শেষ বন্ধু, শেষ ইচ্ছেটা অন্তত শেষ হতে দিও না।’

সম্রাট আবেগে ভেসে গেলেও তৈমূর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। পাহাড়ি চিতার মতো হিংস্র আর বরফাচ্ছন্ন শৈলশিলার মতো স্থির দৃষ্টিতেই সে এখনো তাকিয়ে আছে সম্রাটের দিকে। হঠাৎই নিজের লোকদেরকে ইশারা করে প্রস্তুত হতে বলল। ‘সেক্ষেত্রে সম্রাট আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে। একমাত্র তবেই সম্ভব হবে আপনার শেষ ইচ্ছে পূরণ করা। তবে এর জন্য মূল্য দিতে হবে। অনেক অনেক চড়া মূল্য…হয়তো বা আপনার প্রাণও…’ শেষবারের মতো সম্রাটের অনমুতি পেতেই সে একবার সম্রাটকে দেখে নিয়ে আরেকবার তার ছেলেকে দেখল। শেষবারের মতো সম্রাটের হাতটা তুলে ধরে হাতের মোঘল নিশানি আংটিটাতে চুমু খেল সে।

এরপর দুই হাত তুলে আবারও নিজের লোকদের দিকে ইশারা করে সবাইকে শেষবারের মতো সাবধান করে সে তার বাহিনী নিয়ে নিজের কাজ শুরু করে দিল।

***

আরাকানের রাজা থানডা থুরামার রাজ্যে তার সেনাপ্রধানই হলো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অনেকে এমনও বলে থাকে যে, রাজা স্রেফ বালক সত্যিকার অর্থে চালক হলো তার সেনাপতি। তবে বাস্তবে এই কথার কোনো ভিত্তি কখনওই পাওয়া যায়নি। তবে এটা সত্য যে রাজা থানডা আর তার সেনাপতি ম্রি অঙ দুজনের কেউই কারো চেয়ে কম না। বিশেষ করে লোভ, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচারের দিক থেকে একজন অপরজনকে সহজেই পাল্লা দিতে পারে। তবে রাজা থানডার রাজত্বে যে তার সেনাপতি ম্রি অঙের একটা দারুণ প্রভাব আছে সে ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই রাজার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে তার সেনাপতি। আর সেই সেনাপতির চাচাতো ভাই হিসেবে যথেচ্ছই ক্ষমতার প্রয়োগ আর অপব্যবহার করে থেই সেন। যেমন আজ রাতে তার ওপরে বিশেষ একটা দায়িত্ব পড়েছে। আর সেটা নিয়ে সে বেশ অস্বস্তিতে আছে এই মুহূর্তে।

গত কয়েক বছর ধরেই দিল্লির সালতানাত আর তার উত্থান-পতনের খবর এসে পৌঁছাচ্ছিল আরাকান রাজ্যে। কিন্তু এর প্রভাবে যে ভাগ্য বিড়ম্বিত স্বঘোষিত সম্রাট শাহ সুজা আরাকানে এসে পৌঁছাবে সেটা কেউই ভাবতে পারেনি। শাহ সুজা আরাকানে এসে পৌছানোর আগেই রাজা থানডা আর তার সেনাপতি মিলে সিদ্ধান্ত নেয় তারা শাহ সুজাকে আশ্রয় দেবে। কিন্তু এ-নিয়ে একটা বাজি খেলবে তারা। আশ্রয়ের বিনিময়ে হয় শাহ সুজা তাদের অনেক অর্থ-সম্পদ উপঢৌকন হিসেবে দেবে আর না হয় তাকে দিল্লির সম্রাট তারই ভাই আওরঙ্গজেবের হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে দিল্লি থেকে তারা অর্থ সম্পদ আদায় করবে। কিন্তু এই দুটোই যে তারা একসঙ্গে হাসিল করতে পারবে এটা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি।

শাহ সুজা আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সময় তারা দেখল শাহ সুজার সঙ্গে প্রায় ছাব্বিশটা হাতি-ঘোড়া বোঝাই করা সম্পদ আছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় এগুলো তাদের দখল করতেই হবে। এছাড়াও চরিত্রহীন রাজার নজর পড়ে শাহ সুজার সুন্দরী কন্যা গুলরুখ বানুর ওপরে। আর তাই সেভাবেই পরিকল্পনা চলতে থাকে যাতে সে সম্পদ আর শাহ সুজার কন্যা দুটোকেই দখল করতে পারে। কিন্তু এরই মাঝে দিল্লির প্রতিনিধির মাধ্যমে খবর এসে পৌঁছায়, দিল্লির সম্রাট জানিয়েছে শাহ সুজাকে নিকেশ করার বিনিময়ে আরাকান রাজ অনেক পুরস্কার তো পাবেই, সেই সঙ্গে ওদের সঙ্গে থাকা সবকিছুও তারা দখল করতে পারবে। তবে শাহ সুজার সঙ্গে একটা বিশেষ জিনিস থাকার কথা যেটা দিল্লি সম্রাটের চাই। বিশেষ জিনিসটা বাদে বাকি সব সম্পদ তারা রাখতে পারবে, তবে শাহ সুজাকে হত্যা করা যাবে না বরং তাকে তুলে দিতে হবে তাদের হাতে।

আরাকানরাজ খুশিতে বাগবাকুম হয়ে শাহ সুজাকে সপরিবারে নিকেশ করার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলে। কবি আলাওলের আসর শেষে রাজার সেনাপতি মি অঙের খুনে বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপরে। তার বাহিনীর ওপরে কড়া নির্দেশ ছিল সবাইকে নিকেশ করো, কিন্তু দুজনকে কিছুই করা যাবে না। প্রথমজন হলো খোদ সম্রাট শাহ সুজা। কারণ তাকে দিল্লির লোকেদের হাতে তুলে দেওয়া হবে অর্থের বিনিময়ে। আর দ্বিতীয় জন হলো, তার কুমারী কন্যা গুলরুখ। শাহ সুজাকে দিল্লি পাঠাতে হবে, না হলে দিল্লি থেকে একটা পয়সাও পাওয়া যাবে না। আর গুলরুখকে চাই সম্রাট থানডার। সব নির্দেশ মেনে সেভাবেই নিজের লোকদের নির্দেশ দিয়েছে সেনাপতি ম্রি অঙ। সুজা বা রাজকুমারীর কিছু হলে সম্রাট তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। মাঝরাতের ব্যাপক খুনোখুনির পর প্রথমেই থেই সেনের বাহিনীর লোকেরা সঙ্গে গুলরুখকে পাকড়াও করতেই সেনাপতি ম্রি অঙ নিজে তাকে নিয়ে রওয়ানা করে প্রাসাদের দিকে।

অন্যদিকে থেই সেনের ওপরে দায়িত্ব পড়ে শাহ সুজার বহন করে নিয়ে আসা সম্পদ হস্তগত করার। আজকের রাতটার ওপরে বিশেষ নজর ছিল থেই সেনের। কারণ সেনাপতির ভাই হলেও সেনাপতি থেকে সে অনেকটাই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। সেনাপতি নিষ্ঠুরতা দেখায় প্রয়োজনে। কিন্তু থেই সেনের ব্যাপারটা ভিন্ন। সে প্রকৃতিগতভাবেই একটা নিষ্ঠুর দানব। মানুষের ওপরে অত্যাচার করে, মানুষকে কষ্ট দিয়ে সে বিশেষ মজা পায়। সে ভেবেছিল আজ রাতে যথেচ্ছ খুনোখুনি করতে পারবে। কিন্তু খোদ সেনাপতি যখন তাকে ভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দিল একটু বিরক্তই লাগছিল তার। কারণ শাহ সুজার বাসস্থান থেকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার করুণ আর্তনাদ ভেসে আসছিল। আর মনে-মনে সে অস্থির হয়ে উঠছিল।

তবে যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন সে বোকা নয়। এটা ঠিকই জানে আজ রাতে কেন তাকে এই বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়েছে তার ভাই ম্রি অঙ। কারণ অর্থ সম্পদ নিয়ে বেশি লোককে সে বিশ্বাস করে না। আর এ-কারণেই এই দায়িত্ব তার ওপরে এসে বর্তেছে। সেনাপতি নিজের লোক দিয়ে গুলরুখকে খুঁজতে যেতেই নিজের প্রায় ত্রিশজনের দলটাকে সজ্জিত করে ফেলল থেই সেন। তাদের তথ্য মতে শাহ সুজা তার সম্পদের বেশিরভাগটাই অস্তাবলে লুকিয়ে রেখেছে। নিজের লোকদেরকে নিয়ে সেদিকেই রওনা দিল সে। কিন্তু মাঝপথে যেতেই দেখতে পেল প্রাসাদে আগুন ধরে গেছে। কোনোমতে আস্তবল পর্যন্ত পৌছাতেই দেখল পুরো আস্তবলে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আক্ষেপের চোটে মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করবে নাকি নিজের হাত নিজেই চিবিয়ে খাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তার একান্ত লোক এসে খবর দিল আগুন লাগিয়েছে শাহ সুজার একান্ত সচিব তৈমূরের লোকেরা, তবে আগুন লাগানোর আগে বাক্সপেটরাসমেত সবকিছু তারা সরিয়ে নিয়েছে মোহঙের কাছেই এক জঙ্গলে।

সঙ্গে সঙ্গে নিজের তরবারি বের করে লোকদের অস্ত্রসহ প্রস্তুত হতে বলল। সেই সঙ্গে নির্দেশ দিল ঘোড়সওয়ারি ও তোপবাহিনীকে খবর দিতে। আর নিজের লোকদের নিয়ে সে রওনাদিল ম্রোহঙের পাশেই জঙ্গল পথে। পথিমধ্যে একবার সেনাপতিকে সে খবরটা জানিয়ে এলো। সেনাপতি তাকে বলল পেছনের পথসহ পুরো জঙ্গল ঘিরে ফেলতে। তবে সুজার তরফ থেকে আক্রমণ না হলে সে যেন কিছু না করে।

আরো আধঘণ্টার ভেতরেই থেই সেন আর তার ঘোড়সওয়ারি ও তোপবাহিনী নিয়ে ছোট্ট জঙ্গলটাকে ঘিরে ফেলল। ঘেরা সম্পন্ন হতেই থেই সেন নেমে এলো ঘোড়া থেকে। উত্তেজনার চোটে চক চক করছে তার নিষ্ঠুর দুই চোখ।

জঙ্গলটা বেশি বড়ো না। প্রাসাদ এলাকা সংলগ্ন হয়ে গিয়ে মিশেছে নাফ নদমুখী একটা জলধারার সঙ্গে। বাঙ্গাল মুলুকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বড়ো রাস্তার কোণে গিয়ে মিশেছে এর অংশ। থেই সেন নেমে এসেই প্রথমে খোঁজ নিল জঙ্গল থেকে বেরুনো স্থল ও জলপথ বন্ধ করা হয়েছে কি না। তার সৈন্যবাহিনীর প্রধান প্রতিউত্তরে জানাল পুরো জঙ্গল একেবারে নিশ্ছিদ্রভাবে বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। ওদের জঙ্গলটা ঘিরে ফেলতে দেখে শাহ সুজার লোকেরা আশ্রয় নিয়েছে জঙ্গলের ভেতরের অংশে।

মুখে নিষ্ঠুর হাসি নিয়ে থেই সেন এসে দাঁড়াল তার তোপবাহিনীর কাছে। প্রত্যেকেই নিজেদের তলোয়ার, গাদা বন্দুক আর তোপ প্রস্তুত করে টানটান হয়ে আছে। শুধু তার নির্দেশের অপেক্ষা। আর সে অপেক্ষা করছে তার বড়ো ভাই সেনাপতির। কিন্তু এই অপেক্ষা বড়োই কষ্টদায়ক। কারণ সামনেই অসহায় বন্দি, অন্যদিকে অস্ত্র প্রস্তুত। চাইলেই সে একদল মানুষকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারে। ওদের রক্ত-মাংস কীভাবে তোপের আঘাতে থেঁতলে গিয়ে মিশে যাচ্ছে মাটিতে ভাবতেই সে রীতিমতো যৌন উত্তেজনা বোধ করল। কিন্তু চাইলেও কিছু করার নেই। কারণ সেনাপতির কড়া নির্দেশ, ওপার থেকে আক্রমণ না হলে কিছুই করা যাবে না।

জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কিছু একটা উড়ে আসতে দেখল সে। তাদেরই একটা বর্শা। তার বাহিনীর কারো ক্ষতি না করে সেটা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে অন্যপাশে পড়ল। কিন্তু থেই সেনের মুখে ফুটে উঠল হাসি। এবার আক্রমণের রাস্তা খুলে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজের লোকদের আক্রমণ চালাতে বলল। প্রথমেই তিরন্দাজ বাহিনী এগিয়ে এলো সামনের দিকে। কিন্তু তাদের পরাস্ত থাকতে বলে সে তোপ দাগাতে বলল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল পাঁচটা তোপ।

আবারও… আবারও… আবারও।

তোপের আক্রমণের শব্দ শুনে সেনাপতি ম্রি অঙ যখন জঙ্গলের কিনারায় পৌঁছাল তখনো থেই সেনের বাহিনী তোপ দেগেই চলেছে ছোট্ট জঙ্গলটাতে। আর তোপের প্রতিটি গোলা বর্ষণের সঙ্গে উন্মাদের মতো হাসছে থেই সেন। নিজের ঘোড়া থেকে নেমে এক হাতে থেই সেনকে ধরে অন্য হাতে কামাঞ্চিদেরকে থামার নির্দেশ দিল সে। সপাটে দুটো চড় লাগাল সে থেই সেনকে। বড়ো ভাইয়ের চড় খেয়ে একেবারে চুপসে গেল থেই সেন।

‘আমি তোকে বলেছিলাম কী!’ শক্তিশালী সেনাপতির জোর ঝাঁকুনির চোটে থেই সেন বাঁশপাতার মতো কাঁপছে। ‘এই সবাই চলো আমার পিছু,’ বলে সে নিজের লোকদের ভেতরে মশালধারীকে সামনে রেখে পুরো দলটাকে নেতৃত্ব দিয়ে এগোতে বলল।

থেই সেনের বাহিনীর আক্রমণে জঙ্গলের একটা অংশ একেবারে ধসে পড়েছে। বড়ো বড়ো অনেক গাছ পর্যন্ত টুকরো-টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছে। জঙ্গলের আরেকটু ভেতরে প্রবেশ করতেই তারা দেখতে পেল শুরু হয়েছে রক্তের দাগ। আরেকটু এগোতেই এমনকি নিষ্ঠুর আরাকানি সেনাদের পর্যন্ত গা গুলিয়ে উঠল বীভৎস দৃশ্য দেখে। মানুষ আর মানুষ নেই। টুকরো টুকরো হাত-পা আর শরীরের টুকরো অংশের যেন মেলা বসেছে চারপাশে। থেঁতলানো শরীর আর নাড়িভুঁড়ি এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যেন কোনো খেয়ালি চিত্রশিল্পী ইচ্ছেমতো রং গুলিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে।

একহাতে অস্ত্র বাগিয়ে রক্তাক্ত বীভৎস সব লাশ ছড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সেনাপতি। একটা বিশেষ জিনিস খুঁজছে সে। আরেকটু এগোতেই তার দলের একজন চেঁচিয়ে উঠল। কাছে গিয়ে সেনাপতি দেখল লোকটা লাশের স্তূপের ভেতর থেকে একটা হাত ধরে বসে আছে। হাতটাকে আরেকটু টেনে বার করতেই দেখা গেল ছিন্নভিন্ন মুণ্ডুসহ শরীরের একটা অংশ, হারানো লাশটার হাতে একটা বিশেষ আংটি।

জিনিসটা লাশের হাত থেকে খুলে নিতে নিতে আনমনেই সেনাপতি বলে উঠল, ‘শাহ সুজা,’ বলেই সে ঝট করে ফিরে তাকাল নিজের ভাই থেই সেনের দিকে। ‘এটা তোর ক্রিয়াকর্ম, এর ধাক্কাও তোকেই সামলাতে হবে। আমার ওপরে নির্দেশ ছিল সুজাকে জীবিত ধরার।’ সেনপতির কথা শুনে থেই সেন কুঁকড়ে মুকড়ে দাঁড়িয়ে রইল। ‘এই সবাই ছড়িয়ে পড়, ঘোড়া আর পিপেগুলো খুঁজে বার কর। আর বাক্সগুলোও।

বলেই তারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। জঙ্গলের ভেতরের দিকে আরেকটু এগোতেই দেখতে পেল ঘোড়া বাহিনীর মৃত স্তূপ। মানুষের চেয়ে প্রাণিগুলোর পরিণতি হয়েছে আরো খারাপ। ক্রমাগত টানা তোপের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে সব। কিন্তু কোনো হাতির দেহাবশেষ দেখা গেল না। সেনাপতি অনুমান করল গতি কম হওয়ার কারণে ওগুলোকে সম্ভবত আস্তবল থেকে আনা হয়নি। আগুন লাগা আস্তাবলেই পুড়ে মরেছে ওগুলো। হাতি-ঘোড়া নিয়ে বেশি চিন্তা না করে সামনে এগোলো সে।

এক জায়গাতে ভেঙে পড়া বেশ কিছু কাঠের বাক্স দেখে উত্তেজনার সঙ্গে এগিয়ে গেল সে। কিন্তু ওগুলোর ভেতরে শাহ সুজার নিজের চেহারা খোদাই করে বসানো রাশি রাশি রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই নেই। এমনকি একটি স্বর্ণমুদ্রার ঢেলাও পাওয়া গেল না, বিশেষ যে জিনিসটার কথা বলা হয়েছিল সেটা তো অনেক দূরে, আর কোনো সম্পদও নেই।

কিন্তু এগুলো ছাড়া মৃত ঘোড়াগুলোর আশপাশে আর কিছু নাই। বেশ অবাক হয়েই সে নিজের লোকদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে সিন্দুক, বাক্স আর পিপের খোঁজ করতে বলল। কিন্তু চারপাশের পুরো জঙ্গল চষে ফেলেও বাক্সপেটরা তো দূরে থাক শাহ সুজার নিজের বানানো রৌপ্য মুদ্রা ছাড়া মোঘলদের বিরাট ধনরাশির একটা আধলাও পাওয়া গেল না।

কিছুই না পেয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে সেনাপতি ম্রি অঙ সামনে থাকা এক সৈন্যের কল্লা নামিয়ে দিল তরবারির কোপে। থেই সেন থেকে শুরু করে ভয়ে সবাই কাঁপছে সেনাপতির পাশে দাঁড়িয়ে। কল্লা নামিয়ে দিয়েও শান্তি হলো না সেনাপতির। ক্ষোভ, হতাশা, উন্মত্ত ক্রোধ চিৎকার হয়ে বেরিয়ে এলো তার গলা দিয়ে।

***

সেনাপতি ম্রি অঙ যখন ম্রোহঙের পাশের জঙ্গলে রাগের সঙ্গে চিৎকার করে চলেছে, তখন খুব ধীর লয়ে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে জঙ্গলের সংলগ্ন জলধারা বেয়ে মূল নাফ নদের দিকে বয়ে চলেছে বেশ বড়ো আকারের একাধিক সাম্পান নৌকা। খুব খেয়াল করে দেখলে ওগুলো যেদিকে এগিয়ে চলেছে, সেদিকে দূরের রাশি রাশি উত্তাল নোনা জল পাড়ি দিয়ে অন্ধকারের ভেতরে যে অস্পষ্ট আকৃতি আবছাভাবে চোখে পড়ে, সেগুলোকে দিনের আলোতে দেখলে আপনি কিংবা আমি হয়তো জাহাজ বলতাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *