মগধী, তৃণা এবং সব আধুনিকাদেরই জন্যে
ফোনটা অনেকক্ষণ ধরেই বাজছিল। বাথরুমে স্নান করছিল শুদ্ধ। ফোনটা ধরতেও পারছিল না অথচ অন্যায় হচ্ছে না-ধরা, এই ভেবেই ভীষণ টেনশান হচ্ছিল। ওর কারণে কেউ কষ্ট পান তা ভেবেই ওর কষ্ট হয়। তাড়াতাড়িতে বেরিয়ে এসে যখন ফোন ধরল ওপাশ থেকে তৃণার গলা, সিদ্ধদা?
গত দু-দিন ধরে গলাতে ভীষণই ব্যথা। নুন-জল এবং ডিসপিরিন দিয়ে গার্গল করেও কোনো উপশমই হচ্ছে না। গান ছিল রবীন্দ্রসদনে। গজুদার সঙ্গে ডুয়েট ছিল অনেকগুলো।উনি সি সার্প-এ গান। ওর গলা কষ্টেসৃষ্টে বি ফ্ল্যাট অবধি ওঠে। চেহারা ষাঁড়ের মতন হলে কী হয়! আজকেই অমিদার কাছে যাবে ভাবছিল। আবিরদার কাছেও যেতে পারে, আবিরদার চেম্বার ওর অফিস থেকে ঢিল মারলেই পড়ে।
শুদ্ধর গলাটা তৃণা একেবারেই চিনতে পারেনি, বলাই বাহুল্য। কিন্তু নাম্বার ডায়াল করার সময়ে ও শুদ্ধর নাম্বারই ডায়াল করেছিল। তাই উত্তর পাওয়ার পরে কে? সিদ্ধদা? বলার কী মানে তা বুঝল না শুদ্ধ। তা ছাড়া ও সিদ্ধ নয়।
এরকম বোকা বোকা ব্যাপার সকলেই করে ফেলে অবশ্য অনবধানে। পরশু বম্বে এয়ারপোর্টে জেট এয়ারওয়েজের ফ্লাইট থেকে নেমেই টুটু আর তাপসের সঙ্গে দেখা। আর্কিটেক্ট দম্পতি। ব্যাগেজ ক্লেইম-এর কনভেয়র বেল্ট-এর সামনে ট্রলিতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল। শুদ্ধ-ও তাই।
টুটু বলল, কোত্থেকে?
শুদ্ধ বলল, তুমিও যেখান থেকে আমিও সেখান থেকেই।
তার পরে ও হেসে ফেলে বলল সত্যি কী বোকা বোকা! না? জুয়েলারের দোকানে সেদিন অমৃতার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াতে ও বলল, এখানে কী করতে?
তার পর, দুজনেই হেসে উঠেছিলাম।
সেইরকমই আর কী। অবধান আর অনবধানে তফাত তো থাকবেই!
তৃণা আবারও বলল, সিদ্ধদা?
শুদ্ধ বলল, না। আমি অসিদ্ধ। অথবা আধ-সিদ্ধও বলতে পারো। এমনকী নিপাতনেও সিদ্ধ নই।
সরি, রং নাম্বার। বলে, ছেড়েই দিচ্ছিল তৃণা।
শুদ্ধ তাড়াতাড়ি বলল, ছেড়ো না। ছেড়ো না। আমি অসিদ্ধও নই আধসিদ্ধও নই। আমি, শুদ্ধ। এবং পবিত্র।
তার পর বলল, তোমার কোয়ার্টার-বয়েলড কোনো দাদা নেই তৃণা? এত দাদা থাকতে আমার মতন অভাগার খোঁজ করা কেন? তবে এটা ঠিক যে, ফোনে রোজই তোমার গলাটা একবার শুনতে না পেলে মন খারাপ লাগে।
খুব জোরে হেসে উঠল তৃণা। বলল, সত্যি! কত জনকে যে দিনে এইকথাটি বলেন।
শুদ্ধ কিছু বলল না জবাবে। ও জানে না যে, সত্যিই ওর গলা শুনতে পেলে ভারি ভালো লাগে শুদ্ধর।
পারেনও! আচ্ছা! সত্যি করে বলুন তো আপনার কতজন গার্ল-ফ্রেণ্ড আছে?
সত্যিই যদি জানতে চাও তাহলে বলব যে, গোনা-গুনতি নেই কোনো। কিন্তু একটা কথা অবশ্যই বলব যে, প্রত্যেকটি সম্পর্কই শুদ্ধ। আমার সব গার্ল-ফ্রেণ্ড-ই সদ্যস্নাতা, সুগন্ধি। তাদের গরদের বা সুতির লালপেড়ে শাড়ির নীচের ব্লাউজের পিঠে ভিজে চুল ছড়ানো, তারা পুজোর নৈবেদ্যর জোগাড় দেয় ফুলের আর সদ্যকাটা ফলের গন্ধের মধ্যে বসে ঢাকের শব্দ আর কাঁসরের শব্দর মধ্যে। কেউ বা দুব্বো ঘাস থেকে মধ্যের ছোটো অংশটি আলাদা করে ছেঁড়ে। তারা সবাই অস্পৃশ্য, দেবীরই মতন পবিত্র।
আপনার জন্য আমার দুঃখ হয়।
তৃণা বলল।
কেন?
এমন সুন্দর করে কথা বলেন, লেখেন না কেন আপনি শুদ্ধদা?
ধন্যবাদ। এই জগৎ-সংসারে বিনা স্বার্থে কারোকে কারো জন্যেই দুঃখিত হতে দেখলে বড়ো আহ্লাদ হয় আমার। তা ছাড়া লিখলেই কি আর লেখক হওয়া যায় তৃণা? লেখক হওয়া অত সোজা নয়। প্রাইজ পাওয়া সোজা, লিখে গাড়ি-বাড়ি করাও কঠিন নয় কিন্তু লেখক হওয়া?
কেমন আছেন? রোজ আপনার গলাটা একবার শুনতে না পেলে আমারও মনে হয় কী যেন হারালাম। মনে হয়, দিনটাই অসম্পূর্ণ রইল। মাঝে মাঝে আপনার গলাটা উত্তমকুমারের মতন শোনায়। সত্যি বলছি।
উত্তমকুমারের দিন কি এখনও আছে? মানুষটাও বোধ হয় আমারই মতন হতভাগা ছিলেন। নিজের জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়ে কুলুঙ্গির ঠাকুর না হয়ে থেকে একটু নীচে নেমে এলে উনি হয়তো সগর রাজা হতে পারতেন।
কেন? সগর রাজা কেন?
ষাট হাজার সন্তান থাকতে পারত তাঁর।
ভারি অসভ্য আপনি।
হা:।
হাসল, শুদ্ধ।
বলল, শুদ্ধতার মতো মূর্খামি যে হয় না সেটাও যেমন সত্যি তেমন কুলুঙ্গির দেবতা হয়ে থাকার মধ্যে যে এক আশ্চর্য সুগভীর আত্মপ্রসাদ তারও কোনো তুলনা নেই। দেবতা যাঁরাই হতে পেরেছেন তাঁরাই সেই গভীর সুখের কথা জানেন। সেই আত্মবঞ্চনারসুখের কাছে শরীরের এক বিশেষ সামান্য সুখের কোনো তুলনাই চলে না।
তার পর শুদ্ধ তৃণাকে বলল, এখন বলো তোমার প্রিয় সখী মগধী কেমন আছে? বহুদিন তো সে ফোন করে না। ফোন ছাড়া অন্য কোনোভাবে যোগাযোগ করার উপায় তো আমার নেই কারো সঙ্গেই।
তৃণা ভাবছিল, শুদ্ধর দুটি-পা-ই যে গতবছর বম্বে রোডে গাড়ি দুর্ঘটনাতে কেটে ফেলতে হয়েছে এই নির্মম সত্য ওরা সকলেই ভুলে থাকতে চাইলেও পারে না। কিন্তু শুদ্ধ নিজে মনে করে যে, পা হারানোর ক্ষতি কোনো ক্ষতিই নয়। মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্গে যে তার দুটি পায়ের কোনো সাযুজ্য নেই, মানুষ বাঁচে তার মনের জোরে, ভ্রমণ করে তার তীব্র কল্পনাশক্তিতে, ভালোবাসতে পারে শুধু মন দিয়েও— একথাটাই যেন, জোরের সঙ্গে বলতে চায় শুদ্ধ সারাপৃথিবীকে। কোনো প্রতিবন্ধকতাই যে প্রতিবন্ধকতা নয় একজন প্রকৃত মানুষের কাছে, সেই কথাই সারাপৃথিবীকে জানাতে চায় যেন।
ওর দাম্পত্যতে যে-চিড় ধরেছিল এবং তাতে তুমি যে তোমার নিজস্ব বুদ্ধি প্রয়োগ করেছিলে, তাতে কি কাজ হল কিছু?
শুদ্ধ শুধোল।
কার কথা বলছেন?
মগধীর কথা। আর কার?
না:। মনটা ভারি খারাপ লাগে শুদ্ধদা ওর কথা ভেবে।
তৃণা, তুমি আমাকে বিশুদ্ধ বলে সম্বোধন কোরো এখন থেকে।
কেন?
শুদ্ধতার ওপরেও একটা প্রোটেক্টিভ কোটিং থাকবে অন্তত। ফর অ্যাডিশনাল প্রোটেকশান। তাতে অন্যর ব্যাপারে এতখানি উৎসুক হওয়াতেও কেউ আমাকে ভুল বুঝবে না। ভালো হওয়াই তো যথেষ্ট নয়, তুমি যে-ভালো, একথাটা অন্যকে বোঝাতেও তো হবে।
ওদের খবর খুব খারাপ শুদ্ধদা। মানে মগধীদের।
কেন? আরও খারাপ? ভেরি স্যাড।
খারাপ হবে জানতাম। দীনেশ দেবাংশীর মতন সোনার টুকরো ছেলেকে হেলা করে ও আভাস দাড়িপার সঙ্গে যেদিন রেজিস্ট্রি করল আমি সেদিনই জানি গোলমাল একদিন হবেই।
কেন? আভাস কি খারাপ ছেলে? কত গুণ তার।
দেখো, দাম্পত্যে দোষ-গুণ ছাড়াও আরও অনেক কিছু উপাদান, উপচার লাগে। মজার কথা হচ্ছে এই যে, তা দাম্পত্যে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত বোঝাই যায় না। জলে না নামিলে কেহ শেখে না সাঁতার!
তাই?
তাই মানে? তুমি কি অবনের সঙ্গে পনেরো বছর ঘর করেও এই সরল সত্যটি বোঝোনি?
ঘর আর করলাম কোথায় শুদ্ধদা? মণিপুরের নাচুনে হরিণেরা যেমন বাদার মধ্যের পুরু ঘাসের গালচেয় ঘর বাঁধে তেমনই ঘর। সে-ঘর নড়ে যায়, সরে যায় প্রতিনিয়ত। নেচেনেচেই বেঁচে থাকতে হয়। আমার ঘরের আর্কিটেক্ট কি বালকৃষ্ণা ভিঠলদাস দোশী?
প্রত্যেকের দাম্পত্যের ঘরই ওইরকমই।
শুদ্ধ বলল।
আসলে একটা কথা তোমরা ভুলে যাও তৃণা, তোমাদের মতন সর্বক্ষণ অনুযোগ-করা সব মানুষ-মানুষীই যে, জীবনে কোনো সত্য, কোনো বোধ, কোনো অনুভূতিই Static নয়। তা সতত সঞ্চরমাণ। মনের মধ্যে ফুলশয্যার রাতের ছবিটাকেই শুধুমাত্র ধরে রাখলে চলবে কী করে? সে-ছবি শুধু দেওয়ালেই টাঙিয়ে রাখা উচিত। সে-ছবি শুধু দেওয়ালেরই। তার পর তুমি তোমার জীবনের কাজ নিয়ে থাকো। অধ্যাপনা তো নিছক কোনো কাজ নয়, সেও তো এক ব্রতই। অবনও অবনের জীবনের কাজ নিয়ে থাকবে। বিয়ে-টিয়ে নয়, কাজই প্রত্যেক আধুনিক শিক্ষিত মানুষের জীবনের সব। জীবনের সংজ্ঞা। দাম্পত্য তারমধ্যে একটা Relief মাত্র। মূল ব্যাপার নয়। একজন মানুষের সারাজীবনের কাজের প্রেক্ষিতে বিয়েটা একটা ঘটনামাত্র। বিয়েকে বেশি প্রাধান্য দেয় অশিক্ষিত মানুষেরা। এক্সকিউজ মাই সেইং সো।
তার পরে শুদ্ধ বলল, এই সামান্য অথচ সহজ কথাটা তো মানুষে জন্তুজানোয়ারদের একটু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করলেও জানতে পারত!
সেকথা নয় শুদ্ধদা, আপনি ব্যতিক্রম হতে পারেন কিন্তু অধিকাংশ পুরুষই বড়ো Gross, স্থূল। নারী বলতে তারা শুধু নারীর শরীরকেই বোঝে। মগধীর স্বামী সেরকম। তৃণা বলল।
তা কী করবে বেচারারা। মানে, পুরুষ বেচারারা! ঈশ্বর তাদের তেমন করেই যে গড়েছেন। হনুমানের যেমন ল্যাজ থাকে, ক্যাঙারুর পেটে থলে, ইঁদুরের দাঁত, যে-দাঁতে সবসময়ে কাটাকুটি না করলে তাদের মগজ ফুঁড়ে তাদের নিজেদেরই মেরে ফেলে, সেইরকমই। তাই ইঁদুর বেচারারা সর্বক্ষণ বালিশ কাটে, কাগজ কাটে বলে আমরা যেমন ইঁদুরদের দুষি, তেমন পুরুষদেরও দোষী করি। তারা নারীকে এক বিশেষ চোখে দেখে বলে। তাদের মনকেও কেটে কুচিকুচি করে বলে।
বা:! আমরাও কি মানুষ নই? বাসে, ট্রেনে বা মিনিতে আমাদের বুকে আর পেছনে চিমটি কাটার জন্যেই কি আপনার মহান ঈশ্বর এই ন্যক্কারজনক পুরুষ প্রজাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন?
শুদ্ধ হেসে ফেলল এবারে। তার পর চেয়ার টেনে বসল পাখার নীচে। ক্রাচ নামিয়ে।
বলল, আমরাও মানুষ, তোমরাও মানুষ। ইকুয়ালি। কিন্তু আমাদের শরীর এমন আলাদা করে গড়লেন কেন বিধাতা? চক্রান্তটা তো তাঁরই! তুমি কি ষাঁড়, কি পাঁঠা, কি কুকুরকে, গোরু বা ছাগল বা কুকুরিদের সঙ্গে পথে-ঘাটে অশোভন ব্যবহার করতে দেখোনি কখনো? রীতিমতো অশ্লীল আচরণও? আমরা এই হতভাগা পুরুষরাও তো সেই পুংলিঙ্গরই জীব! অনেক কায়দার জামাকাপড়, অনেক ডিগ্রির বোঝাতে নিজেদের ভারাক্রান্ত করে অনেক সংস্কৃতিসম্পন্ন হয়েও আমাদের ভেতরের সেই আদিম প্রবণতা ও প্রবৃত্তিকে ছাই-চাপা দিয়ে রাখতে যে পারা যায়নি। এতদিনেও যায়নি। তোমাদের মধ্যেও সেই প্রবৃত্তি নেই যে তা নয়। তবে সেটা পুরুষদের মতন অমন অশোভনভাবে উগ্র নয়। না-থাকলে পুরুষ-এর সঙ্গে প্রকৃতির মিলন সম্ভব হত না। তবে তোমাদের ভূমিকাটা গ্রহীতারই দাতার নয়। পরোক্ষ, প্রত্যক্ষ নয়। তাই বাইরে থেকে দেখে মনে হয় তোমরা বুঝি অন্যরকম। তা তো হয় না, হতেই পারে না। তাই এই ব্যাপারে শুধুমাত্র পুরুষদেরই দোষ দেওয়াটা অনুচিত তোমার।
তার পরই শুদ্ধ বলল, তুমি কিন্তু মগধীর কথা বললে না।
হ্যাঁ। আপনাকে তো বলেছিলাম যে, আভাস প্রতিসপ্তাহে ক্যানিং-এ যায়, সেখানে ওদের কোম্পানির কীসব কনস্ট্রাকশন হচ্ছে। সেখানে একটি ক্যাম্প-অফিস মতো আছে ওদের। ও-ই তার ইনচার্জ। তা সেই অফিসে একটি অল্পবয়েসি টাইপিস্ট মেয়ে আছে। হায়ার সেকেণ্ডারি পাস। দেখতে মোটামুটি, কিন্তু…। কাজে নাকি যাচ্ছেতাই। ক-দিন আগে Venerable শব্দটাকে টাইপ করেছিল veneral। আভাসের মুখেই শুনেছি। কিন্তু তার স্বাস্থ্য ভালো। হাসিখুশি। লাস্যময়ী। সবসময়ে সাজুগুজু করে থাকে, মাথায় ফুল থাকেই। যে ফুলই হোক।
বা:।
শুদ্ধ বলল।
তার পর বলল, মগধীর মতন বেশি পড়াশুনো করে শরীরকে অকালে বুড়িয়ে ফেলেনি বলছ? তোমরা মেয়েরা লেখাপড়া শিখলেই জোর করে অন্যরকম হতে চাও কেন বলো তো? সেজেগুজে থাকা বা চুলে ফুল গোঁজা কি পাপ?
কেন? মগধী তো যথেষ্টই সুন্দরী। স্লিম। তার ছাত্রীরা তো তার রূপের আর মেধার প্রশংসাতে পঞ্চমুখ।
তাই? তার পর বলো। কী করে জানব আমি? দেখিনি তো কখনো তাকে।
তার পর আর কী! সেই টাইপিস্ট মেয়েটির কোয়ার্টার ওদের ক্যাম্প-অফিসের কাছেই। আভাস দুপুরে হোটেলে যেত লাঞ্চ ব্রেকে। সেই মেয়েটিই তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়। বিধবা মা আর সে একাই থাকে। তার পর ভালো ডাল, মাছের সঙ্গে ধীরে ধীরে আরও অন্য কিছু খেতে আরম্ভ করে আভাস।
এমন করে বলছ যে, দোষটা যেন আভাসেরই একার। খাদক না থাকলে খাদ্যর কোনো ভূমিকাই থাকত না। মেয়েটি খাদ্য হয়েছে বলেই না, আভাস খেয়েছে। এবং আভাসও নিশ্চয়ই সেই খাদ্যকে সুখাদ্যর মধ্যেই গণ্য করেছে। তা ছাড়া, পুরুষ যে বড়ো ভঙ্গুর জাত। কাচের বাসনের চেয়েও ভঙ্গুর। তাদের ভাঙাটা কোনো ব্যাপারই নয় মেয়েদের পক্ষে।
তার পর আর কী? মগধীর আত্মসম্মানে এমনই লেগেছে যে, বলার নয়। ও পিএইচ ডি করেছিল ইংরেজিতে। ইয়েটস-এর ওপরে। ক্যানিং-এর একটা অশিক্ষিত হায়ার সেকেণ্ডারি পাস অশিক্ষিত দেহসর্বস্বী মেয়ে যে Venerable-কে veneral লেখে, সেই কিনা হারিয়ে দিল তার মতন একজন এত বড়ো বিদুষীকে! না না। আপনি যাই বলুন, আভাস একটি থার্ডক্লাস রুচিহীন দেহসর্বস্বী মেয়ের সঙ্গে…না:। আনথিঙ্কেবল। ডিগ্রেডিং। মগধী কাজপাগলা মেয়ে। কাজ ছাড়া আর কিছুই জানে না। তা ছাড়া কোম্পানি কী দেয়নি ওকে? ফ্ল্যাট, গাড়ি, ফার্নিচার, ফ্রিজ, মাইক্রোআভেন। এর তুলনাতে আভাস একটা… একটা… কী বলব….কোনো ম্যাচ-ই নয়।
তবুও আভাস কেন ক্যানিং-এর সেই হায়ার সেকেণ্ডারি পাস venerable-কে veneral টাইপ করা মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হল? কত মাইনে পায় মেয়েটি?
শুদ্ধ বলল।
তার পর বলল, ব্যাপারটার গভীরে গিয়ে ভাববে একটু?
মেয়েটির মাইনে কত হবে? হাজার দুয়েক বড়োজোর। টিনের চালের বাড়ি। ছি:।
আর মগধী?
কুড়ি হাজার পায়, পার্কস-টার্কস নিয়ে। বাড়িতে বইয়ের পাহাড়। হুসেন-এর ছবি আছে, সোমনাথ হোড়ের কাজ, পিকাসোর ব্লু-পিরিয়ডে আঁকা কিছু ছবির প্রিন্ট, অতুলপ্রসাদের গান গায় মগধী অত্যন্ত ভালো। সেদিনই সুমন চট্টোপাধ্যায় গান গেয়ে গেলেন ওর বাড়িতে…কী আর বলব? যাকে বলে অ্যাকমপ্লিশড।
শুদ্ধ বলল, একটা কথা বলবে আমাকে? তৃণা?
কী? বলুন?
মগধী কি সাজে-গোজে?
মানে?
মানে, আভাস যখন তার আউটডোর সাইট থেকে ফেরে বাড়িতে…
তার পরই বলল… কখন ফেরে?
মগধী ফেরে সাতটা নাগাদ আর আভাসের ফিরতে ফিরতে ন-টা হয়ে যায়।
অতক্ষণে মগধী কি গা ধুয়ে নেয়? মগধী তো আগেই ফেরে অনেক আভাসের তুলনাতে। একটা শাড়ি পরে কি, পাটভাঙা? গায়ে পাউডার এবং সুগন্ধি কি মাখে? কখনো খোঁপা বা বেণীতে ফুল কি গোঁজে? ভুল করেও।
আমাদের সকলেরই তো চুল ছোটো করে কাটা। বেণীই বা কোথায় আর চুলই বা কোথায় যে ফুল গুঁজবে।
সেইটাই তো কথা! একজন পুরুষমানুষ যে কত অল্পে সন্তুষ্ট হতে পারে, সে-সম্বন্ধে তোমাদের এই আধুনিকাদের কোনো ধারণাই নেই। মেয়েদের বড়ো চুল, চুলে তেলের সুগন্ধ, বেণীতে একটি চন্দ্রমল্লিকা বা জুঁyইয়ের মালা পুরুষের কাছে যে কত বড়ো যৌনতার দ্যোতক সে সম্বন্ধে তোমরা একেবারেই অনবহিত।
একটুক্ষণ চুপ করে রইল শুদ্ধ। এবং তৃণাও।
তার পর শুদ্ধ বলল, পুরুষেরা তোমাদের মাথায় করে রেখেছিল এতদিন। পুরুষদের যা কিছুই দুর্বলতা, তাই তোমাদের বল। অথচ তোমরা মাথা থেকে নেমে এসে পথে নেমে মারামারি শুরু করলে পুরুষেরই সমান হতে। পুরুষের মতন পোশাক পরতে শুরু করলে, তাদের মতন চুল ছাঁটলে। সব ব্যাপারে তাদের টেক্কা মেরেই নয়, তাদের চেয়ে বড়ো হয়েও তোমাদের এত যুগের মিথ্যে হীনম্মন্যতা ছিঁড়ে ফেললে বলে মনে করলে, অথচ একথা একবারও ভেবে দেখলে না যে, বিধাতা, পুরুষ আর নারীকে আলাদা করে গড়েছেন, চেহারায়, মনে, নমনীয়তায়, চরিত্রে। একের মধ্যে যা নেই, অন্যের মধ্যে তাই দেখে পুরুষ ও নারী চিরদিন একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, তাই দিয়েই একে অন্যকে সুখী করেছে। এতে লজ্জার কী আছে? ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী কি ফরাসি, ইংরেজি বা সংস্কৃত জানতেন না? তিনি কি তাঁর যৌবনে চুলে ফুল দিতেন না? ইন্দিরা গান্ধি? কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়? এমনকী হালফিলের ভারতী রায়, এখন রাজ্যসভার সদস্যা? বিদুষী হওয়ার সঙ্গে, ইয়েটস-এর ওপরে পি এইচ ডি করার সঙ্গে ‘মেয়েলি মেয়ে’ হতে অসুবিধেটা কোথায়? মনের সৌন্দর্যের সঙ্গে শারীরিক সৌন্দর্যকেও সমানভাবে বিকশিত করতে, মনের সংগমের সঙ্গে শরীরের সংগমকেও সমান মর্যাদা দিতে অপরাধবোধ আদৌ জাগে কেন তোমাদের মনে? বুঝি না আমি। সত্যিই বুঝি না।
আপনি কী বলতে চাইছেন শুদ্ধদা?
বলতে চাইছি যে, শুদ্ধ হও, প্রাকৃত হও, প্রাকৃতিক হও, স্বাভাবিক হও। কোনো মেয়েকে ‘দেহসর্বস্বী’ বলে দুষো না। তাহলে সেও তোমাদের ‘মনসর্বস্বী’ বলে দুষতে পারে। শরীর আর মনের সুস্থ-স্বাভাবিক-সুন্দর মেলবন্ধনই একজন নারীকে তো বটেই, পুরুষকেও পূর্ণ নারী বা পূর্ণ পুরুষ করে তোলে।
আপনি এমন করে কথা বলেন, না শুদ্ধদা যে মনে হয় আপনার কথা ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনি।
তা বলে, ফোনে নয়। তোমার অনেক বিল উঠে গেল আজ।
উঠুক। ইচ্ছে করে, আপনার সঙ্গে কোনো জঙ্গলে যাই। নিজেকে শরীরে-মনে নবীকৃত করে ফিরি।
যখন দিন ছিল তখনই গেলে না। জঙ্গলে গেলে জঙ্গলের নির্জন পথে হেঁটে বেড়াতে না পারলে মজাই নেই। কিন্তু…। দুই বগলের নীচে ক্রাচ নিয়ে, হাঁটতে বড়ো লাগে। আর কি হবে সেসব? এখন বি বি সি-র ট্রাভেল স্লট দেখি। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে।
এবার ছাড়ি শুদ্ধদা। অবনের আসার সময় হল। আজকে আমরা জোয়ার দেখতে যাব।
বা:। তবে দেখো। এ বছরের অগাস্টের জোয়ার নাকি সাংঘাতিক হবে। দেখো, আবার ভেসে যেয়ো না যেন।
তৃণা হেসে বলল, জোয়ারে ভাসার সাহস বা কপাল করে কি এসেছিলাম? তাহলে তো ছ-বছর আগে আপনার হাত ধরেই ভেসে যেতাম।
হো হো করে হাসল শুদ্ধ। বলল, জোয়ারের মধ্যে, বন্যার মধ্যে কিছু নতুনত্ব আছে বই কী! উন্মাদনা। কিন্তু যখন জল সরে যায়, নেমে যায়, তখন কি চোখ মেলে দেখেছ? মৃত গবাদি পশু, পেট-ফোলা, ভেসে যাওয়া গাছপালা, বাড়িঘর, মৃতদেহ, শকুন, মহামারি, ওলাওঠা, ম্যালেরিয়া, আন্ত্রিক। কোনো কিছুই জীবনে বা সংসারে অবিমিশ্র ভালো নয় তৃণা। —এই কথাটা মানতে পারলেই মগধী হেরে যেত না ওই ‘দেহসর্বস্বী’র কাছে। এখনও সে বাঁচতে পারে। মিথ্যে অহং ছাড়তে হবে। শরীরকে নিজের এবং পরেরও ঘৃণা করলে চলবে না।
তার পর বলল, আভাস কি আর থাকেই না মগধীর সঙ্গে?
থাকে। এখনও থাকে। তবে বলেছে যে, ও ক্যানিং-এ গিয়েই থাকবে। এবার থেকে। ডিভোর্সও চাইবে নাকি!
তাই? ভেরি স্যাড। মগধী কি নিজের দেহের প্রতি আর একটু মনোযোগী হতে পারে না?
মনই যদি সরে যায় তখন দেহ তো মৃতদেহ। কী করতে বলেন ওকে আপনি? নিজের দেহ দেখাবে নিজের স্বামীকে?
তাতে দোষের কী? স্বামীও তো একজন পুরুষই। পুরুষেরা সবাই একজাত, মানে বজ্জাত।
তা ঠিক। অবশ্যই ঠিক। খুব দামি কথা বলেছেন।
দেহে প্রাণ থাকতে আর প্রাণে দেহ থাকতে সকলেরই একটু ভেবে দেখা দরকার। সম্পর্ক ভাঙাটা তো অতিসহজ, গড়ে তোলাটাই বড়ো কঠিন। বাঁচিয়ে রাখাটা আরও কঠিন। বহু বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে একসেকেণ্ড লাগে।
হুঁ। তৃণা বলল।
তার পর বলল, আজ ছাড়ি।
শুদ্ধ বলল, মগধীকে বোলো যে, আমি ওর জন্যে দুঃখিত। দাম্পত্যর ব্যাপারে বাইরের মানুষের দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কিছুই তো করার নেই। আমার পূর্বঅভিজ্ঞতা বলে যে, অন্যর দাম্পত্য-কলহে সালিশি করতে যাওয়াটাও পরমমূর্খামি। যদি আবার জোড় বাঁধে তারা, তখন দুজনে মিলে একইসঙ্গে সেই আব্রিটেটরকেই মারে।
ছাড়ছি! শুদ্ধদা। অবনের আসার সময় হল।
আপনি করবেন আমাকে কালকে ফোন?
ঠিক আছে।
ঠিক তো?
বলেই, হেসে ফোনটা ছেড়ে দিল তৃণা।
রিসিভারটা নামিয়ে রাখার পর কিছুক্ষণ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে রইল তৃণা। ভাবল অনেক কিছু। তার পর বেডরুমের আয়নার সামনের টুলে এসে বসল। ভালো করে দেখল নিজেকে। কতদিন যে নিজেকে ভালো করে দেখে না ও আয়নাতে। না মুখের দিকে তাকায়, না শরীরের আর কিছুর প্রতি। অথচ মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময়ে চানঘরের দেওয়ালজোড়া আয়নার সামনে নিজের নিরাবরণ শরীরের ছায়া দেখে সেই ছায়াকে, সেই ছায়ার আনাচ-কানাচকে কতই না ভালোবাসত! তখন কল্পনা ছিল, সম্ভাবনা ছিল, ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছিল, জীবনের নানা রহস্য অজানা, অদেখা, অননুভূত ছিল। আজ তো সবই জানা হয়ে গেছে। রহস্য-রোমাঞ্চ সেসবের কিছুই যেন আর নেই।
আগামীকালই ‘সানফ্লাওয়ার’-এ ওর চুল কাটতে যাওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। ক্যানসেল করে দেবে। ভাবল, চুল বাড়তে দেবে। চুল বড়ো করবে আবার। সেই পুরোনো দিনের মতন ‘জবাকুসুম’ তেল মাখবে মাথায়। শোয়ার সময়ে চুল বেঁধে শোবে। মুখে এবং সারাশরীরেই নিয়ম করে ‘বসন্তমালতী’ অথবা ‘তুহিনা’ মাখবে শুতে যাওয়ার আগে। এবং শাড়ি পরবে। শুধুই শাড়ি। ঋতু অনুযায়ী ফুল গুঁজবে মাথায়, খোঁপাতে অথবা বেণীতে। ‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না?’ ঠাকুমা বলতেন। তার অত্যন্ত আধুনিক, শিক্ষিত মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরকেও সময় দেবে তৃণা এবার অনেক বেশি।
অবনও আজকাল প্রত্যেক উইকএণ্ডে বাগনানে যায় একটি হাসপাতালে রোগী দেখতে। সেখানেও যে কোনো ‘দেহসর্বস্বী পুরুষখেকো বাঘিনি’ নেই, তা কে বলতে পারে! Prevention is always Better than cure।
তৃণা ঠিক করল যে, ও-ও আজ থেকে সময়ে সময়ে দেহসর্বস্বী হবে। কিন্তু অবন যদি সাড়া না দেয়? তবে? তবে কী হবে?
শুদ্ধদা ঠিকই বলেছিলেন, পুরুষেরা ওদের কাছে যে কী চায়, সেই চাওয়া যে কত সামান্য সে কথাটা অতিঅল্প নারীরাই বোধ হয় জানেন।
জানলেও হয়তো মানেন না।
মগধীকেও বলবে।
সব বলবে।