ভ্‌-ভূত

ভ্‌-ভূত

আমাদের পাড়ায় একটা পুরনো বাড়ি আছে, তার বয়স হয়তো দুশো বছরের বেশি হবে। সেখানে কেউ থাকতে চায় না। তাই বলে যেন কেউ ভেবে না বসেন যে বাড়িটা খালি পড়ে থাকে। মোটেই তা নয়। তবে রাতে কেউ সামনের বারান্দাটাতে যায় না। সবাই বলে সেখানে নাকি লম্বা কালো কোট পরা এক রোগা সায়েব পায়চারি করে। তার সমস্ত শরীরটা স্পষ্ট দেখা যায়, বাদে পায়ের পাতা দুটো। পায়ের কব্জি দুটো মেঝের ওপর বসানো থাকে, তাই দিয়েই সে পায়চারি করে। বিকট দেখায়। কিন্তু সে কাউকে কিছু বলে না। তবু কিছুদিন ওইরকম দেখার পর, ভাড়াটেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আবার নতুন ভাড়াটে আসে।

আমাদের পাড়ার এক ফিরিঙ্গি বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম যে ওর ঠাকুরদা অনেক দিন ওই বাড়ির ভাড়াটে ছিলেন। ঠাকুরদার ছোটবেলাতেও রোগা সায়েব ওই বারান্দায় পায়চারি করত। কিন্তু তখন তার জুতোটুতো সব দেখা যেত। তারপর দেখা গেল বেশি বৃষ্টি হলেই রাস্তায় জল দাঁড়ায়। সেই জল ক্রমে বারান্দার ওপর উঠতে আরম্ভ করল। অগত্যা এক প্রস্থ ইট বসিয়ে বারান্দাটাকে উঁচু করা হল। রোগা সায়েব বোধহয় অতটা টের পায়নি, তাই অভ্যাসমতো পুরনো মেঝেটার ওপরেই হাঁটে। কাজেই জুতো দেখা যায় না।

কলকাতার পথেঘাটে ট্রামে-বাসে যে এত অসম্ভব বেশি লোক, তাদের সক্কলেই সত্যিকার মানুষ কি না এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। ট্রামে-বাসে যেখানে ধরে ঝুলবার মতোও এক ইঞ্চি জায়গা নেই, সেখানেও কী করে অনেকে লটকে থাকতে পারে, এ আমার বোঝার বাইরে। শুনেছি একবার নাকি এক পণ্ডিতমশাই অনেক কষ্টে ছাতার বাঁটটি বাসের জানলার শিকে আটকিয়ে কোনও রকমে ঝুলে আছেন, এমন সময় টের পেলেন কে যেন তাঁর মেরজাইয়ের পকেট হাতড়াচ্ছে!

ফিরে দেখেন কালো কুচকুচে, রোগা টিং-টিঙে এক ছোকরা, কিছু না ধরে শূন্যে ঝুলে আছে। পণ্ডিতমশাই এমনি আঁতকে উঠলেন যে ছাতার বাঁট থেকে হাত ফসকে, আরেকটু হলেই বিতিকিচ্ছিরি এক কাণ্ড করে বসতেন, কিন্তু শূন্যে-ঝোলা ছোকরা খপ্‌ করে তাঁর হাত ধরে, আবার ছাতার বাঁটে লটকে দিল।

পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘মন তোমার এত ভাল, তবু লোকের পকেট হাতড়াও কেন?’ ছেলেটা ফিক করে হেসে বলল, ‘কী করব, অব্বেস!’ এই বলে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

আরেক ভদ্রলোক, ঝমঝম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সন্ধেবেলায় বড়বাজারের এক গলি দিয়ে চলেছেন। হঠাৎ খেয়াল হল, তাঁর সামনে একটা লোক একপাল ছাগল ভেড়া নিয়ে যাচ্ছে। সবাই ভিজে চুপ্পড়, এমন সময় একটা পড়ো বাড়ি দেখা গেল। ভদ্রলোক শুনেছিলেন যে এই রকম বাড়িই বর্ষাকালে লোকের ঘাড়ে ভেঙে পড়ে, তাই একটু ঘাবড়াচ্ছিলেন।

তারপর যখন দেখলেন সেই লোকটা ছাগল-ভেড়াসুদ্ধু দিব্যি সুন্দর পড়ো বাড়ির দাওয়ায় উঠে পড়ল, উনিও সঙ্গে সঙ্গে উঠলেন। উঠে, গা থেকে জল ঝেড়ে, একটা বিড়ি ধরালেন। তাই দেখে লোকটির চোখ চকচক করে ওঠাতে, তাকেও একটা বিড়ি দিলেন। দুজনে একটুক্ষণ আরামে বিড়ি টানবার পর, ভদ্রলোক বললেন, ‘এ জায়গাটা নাকি ভাল নয়।’

লোকটি বলল, ‘ভাল তো নয়ই। এ পাড়ার কেউ এখানে পা দেয় না। বৃষ্টির জলে ভেসে গেলেও না। ভারী বদনাম এ বাড়ির।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি ভূতটুতে বিশ্বাস করি না।’ লোকটির বিড়ি খাওয়া হয়ে গেছিল, মাথাটুকু ফেলে দিয়ে বলল, ‘তা আপনি না করতে পারেন, কিন্তু আমি করি।’ এই বলে ছাগল-ভেড়ার পালসুদ্ধু অদৃশ্য হয়ে গেল! ভদ্রলোকও জল-ঝড়ে বেরিয়ে পড়ে ছুটতে লাগলেন।

ভবানীপুরে একটা পুরনো বাড়ি ছিল, ভাগে ভাগে ভাড়া দেওয়া। বাড়ির গিন্নির ছেলেপুলে ছিল না; স্বামীর সঙ্গে অষ্টপ্রহর খিটিমিটি লেগেই থাকত। ঝগড়া হলেই স্বামী দুমদাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন আর সে রাতে ফিরতেন না। ভয়ে ভাবনায় গিন্নির প্রাণ যায় আর কী! তখন তিনি তিনতলার রান্নাঘরের পাশে এক টুকরো খোলা ছাদে গিয়ে কান্নাকাটি করতেন, দেবতাকে ডাকতেন।

হঠাৎ দেখতেন পাশের ভাড়াটেদের ছোট্ট ছাদে তিন-চারটে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দুপুর রাতে মহা হুল্লোড় লাগিয়েছে। সঙ্গে আবার কতকগুলো কুকুর-বেড়াল। দেখে দেখে তাঁর মন ভাল হয়ে যেত। ছেলেমেয়েগুলো টপাটপ মধ্যিখানের পাঁচিল টপকে এদিকে এসে, তাঁর কোলে-পিঠে চাপত আর হিন্দিতে ইংরেজিতে মিশিয়ে কী যে না বলত, তার ঠিক নেই। কোথায় নাকি চমৎকার ফল-বাগান আছে, ঝরনা আছে, আন্টিকে সেখানে নিয়ে যাবে। ছিঃ! আর কেঁদো না, ডিয়ারি।

তারপর ওঁর স্বামী বদলি হয়ে গেলেন, ওঁরাও ও-বাড়ি ছেড়ে পশ্চিমে চলে গেলেন। তারপর প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর কেটে গেল। ততদিনে স্বামীর মাথা ঠান্ডা হয়ে গেছে, গিন্নিও অনেক বেশি সুখী। একটি অনাথ মেয়েকে মানুষ করে, বিয়ে দিয়েছেন। কলকাতায় এসে হঠাৎ মনে হল, সেই বাড়িটা একবার দেখে আসি। গিয়ে দেখেন ঘর-দোর আরও জীর্ণ, রং-ওঠা। মনে হয় এই বাইশ বছরে কোথাও এক পোঁছ পালিশ পড়েনি।

গেলেন ওঁদের সেই তিনতলার পুরনো ফ্ল্যাটে। এখন সেখানে এক বুড়ি থাকেন। তিনি বললেন, ‘তাঁর স্বামী বছর দশেক গত হয়েছেন, ছেলে-বউ বোম্বাইতে চলে গেছে, বড়ই একা পড়েছেন। তবে পাশের বাড়ির এক গাদা ছেলেমেয়ে, কুকুর-বেড়াল রাতে ভারী মজা করে।’

এবার গিন্নি আর কৌতূহল রাখতে না পেরে, একটা টুল টেনে নিয়ে পাশের ছোট ছাদটিতে গিয়ে নামলেন। তারপর উলটো দিকের পাঁচিলের ওপর দিয়ে ঝুঁকে দেখবার চেষ্টা করলেন, ছেলেমেয়েগুলো কোত্থেকে আসে। দেখলেন পাঁচিলের ওপাশে খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। ওদিকে কোনও ঘরের চিহ্ন নেই, জায়গাও নেই। পাশ দিয়ে একটা গলি চলে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *