ভ্রান্তিবিলাস – ৪

চতুর্থ পরিচ্ছেদ


বসুপ্রিয় স্বর্ণকার, এক বিদেশীয় বণিকের নিকট, পাঁচ শত টাকা ধার লইয়াছিলেন। যে সময়ে পরিশোধ করিবার অঙ্গীকার ছিল, তাহা অতীত হইয়া যায়, তথাপি বণিক বসুপ্রিয়কে উৎপীড়ন করেন নাই। পরে, দূর দেশান্তরে যাইবার প্রয়োজন হওয়াতে, তিনি টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে আরম্ভ করেন। অবশেষে, অনায়াসে টাকা পাওয়া দুর্ঘট বিবেচনা করিয়া, এক জন রাজপুরুষ সঙ্গে লইয়া, তিনি বসুপ্রিয়ের আলয়ে উপস্থিত হইলেন; এবং তাঁহাকে কহিলেন, আজ আমি এখান হইতে প্রস্থান করিব, সমুদায় আয়োজন হইয়াছে, জাহাজে আরোহণ করিলেই হয়; যে জাহাজে যাইব, উহা সন্ধ্যার প্রাক্কালে জয়স্থল হইতে চলিয়া যাইবে। আমি যে প্রয়োজনে যাইতেছি, তাহাতে সঙ্গে কিছু অধিক টাকা থাকা আবশ্যক। অতএব, আমার প্রাপ্য টাকা গুলি এখনই দিতে হইবেক; না দেন, আপনাকে এই রাজপুরুষের হস্তে সমর্পণ করিব। বসুপ্রিয় কহিলেন, টাকা দিতে আমার, এক মুহুর্ত্তের জন্যেও, অনিচ্ছা বা আপত্তি নাই। আপনি আমার নিকট যে টাকা পাইবেন, চিরঞ্জীব বাবুর নিকট আমার তদপেক্ষা অধিক টাকা পাওয়া আছে। তাঁহাকে এক ছড়া হার গড়িয়া দিয়াছি, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলেই ঐ হারের মূল্য পাইব। অতএব, আপনি অনুগ্রহ করিয়া, তাহার বাটী পর্যন্ত, আমার সঙ্গে চলুন, সেখানে যাইবা মাত্র আপনি টাকা পাইবেন। তিনি অগত্যা সম্মত হইলে, বসুপ্রিয় তাঁহাকে ও তাঁহার আনীত রাজপুরুষকে সমভিব্যাহারে করিয়। চিরঞ্জীবের আলয়ে চলিলেন।

 জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব অপরাজিতার আবাসে আহার করিয়াছিলেন। তাঁহার হস্তে একটি অতি সুন্দর অঙ্গুরীয় ছিল; তিনি তদীয় অঙ্গুলি হইতে ঐ অঙ্গুরীয়টি খুলিয়া লয়েন, বলেন, আমি এটি আর ফিরিয়া দিব না; ইহার পরিবর্তে আপনারে এক ছড়া নূতন হার দিব। হারের বর্ণনা শুনিয়া, অপরাজি্তা দেখিলেন, অঙ্গুরীয় অপেক্ষ হারের মূল্য অন্ততঃ দশগুণ অধিক। এজন্য, তিনি এই বিনিময়ে সম্মত হইয়া, জিজ্ঞাসা করেন, আমি হার কখন পাইব। চিরঞ্জীব কহিয়াছিলেন, স্বর্ণকারের সহিত অবধারিত কথা আছে, হার লইয়া তিনি অবিলম্বে এখানেই আসিবেন। আপনি চারি পাঁচ দণ্ডের মধ্যে হার পাইবেন। নির্দিষ্ট সময় অতীত হইয়া গেল, তথাপি স্বর্ণকার উপস্থিত হইলেন না। চিরঞ্জীব অতিশয় অপ্রতিভ হইলেন, এবং আমি স্বয়ং স্বর্ণকারের বাটীতে গিয়া হার আনিয়া দিতেছি, এই বলিয়া কিঙ্করকে সমভিব্যাহারে লইয়া প্রস্থান করিলেন।

 কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, চিরঞ্জীব কিঙ্করকে কহিলেন, দেখ! আজ গৃহিণী যে আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই, তাহার পুরস্কারস্বরূপ, হারের পরিবর্তে, তাঁহাকে একগাছা মোট দড়ী দিব; তিনি ও তাঁহার মন্ত্রিণীরা ঐরূপ হার পাইবারই উপযুক্ত পাত্র। তুমি ঐ রূপ দড়ী সংগ্রহ করিয়া রাখিবে, এবং আমি বাটতে যাইবা মাত্র আমার হস্তে দিবে; দেখিও, যেন বিলম্ব হয় না। এই বলিয়া,. রজ্জুক্রয়ের নিমিত্ত একটি টাকা দিয়া, তিনি তাহাকে বিদায় করিতেছেন, এমন সময়ে স্বর্ণকার, বণিক ও রাজপুরুষ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। যথাকালে হার না পাওয়াতে, চিরঞ্জীব স্বর্ণকারের উপর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া ছিলেন; এক্ষণে তাঁহাকে দেখিতে পাইয়া, ভৎর্সনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, তোমার বাক্যনিষ্ঠা দর্শনে আজ আমি বড় সন্তুষ্ট হইয়াছি; তোমায় বারংবার বলিয়া দিলাম, এই সময় মধ্যে আমার নিকটে হার লইয়া যাইবে; না তুমি গেলে, না হার পাঠাইলে, কিছুই করিলে না; এজন্য আজ আমি বড় অপ্রস্তুত হইয়াছি; তোমার কথায় যে বিশ্বাস করে, তাহার ভদ্রস্থতা নাই। তুমি অতি অন্যায় করিয়াছ। এ পর্যন্ত তুমি না যাওয়াতে, আমি হারের জন্য তোমার ব্তী যাইতেছিলাম।

 বসুপ্রিয়, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব জ্ঞান করিয়া, কিঞ্চিৎ কাল পূর্ব্বে তাঁহার হস্তে হার দিয়াছিলেন। সুতরাং, প্রকৃত ব্যক্তিকে হার দিয়াছেন বলিয়া, তাঁহার সংস্কার ছিল। এজন্য, তিনি কহিলেন, মহাশয়! এখন পরিহাস রাখুন; আপনকার হারের হিসাব প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি, দৃষ্টি করুন। এই বলিয়া, সেই হিসাবের ফর্দ্দ তাহার হস্তে দিয়া, বসুপ্রিয় কহিলেন, আপনকার নিকট আমার পাওয়ানা পাঁচ শত পঞ্চাশ টাকা। আমি এই বণিকের পাঁচ শত টাকা ধারি। ইনি অদ্যই এখান হইতে প্রস্থান করিতেছেন। এত ক্ষণ কোন কালে জাহাজে চড়িতেন, কেবল এই টাকার জন্যে যাইতে পারিতেছেন না। অতএব, আপনি হারের হিসাবে আমায় আপাততঃ পাচ শত টাকা দিউন।

 তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, আমার সঙ্গে কি টাকা আছে যে এখনই দিব। বিশেষতঃ, আমার কতকগুলি বরাত আছে, তাহা শেষ না করিয়াও বাটী যাইতে পারিব না। অতএব, তুমি এই মহাশয়কে সঙ্গে করিয়া আমার বাটীতে যাও; আমার স্ত্রীর হস্তে হার দিয়া, আমার নাম করিয়া বলিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ টাকা দিবেন; আর, বোধ করি, আমিও, ঐ সময়ে বাটীতে উপস্থিত হইতেছি। বসুপ্রিয় কহিলেন, হার আপনকার নিকটে থাকুক, আপনিই তাঁহাকে দিবেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, না, সে কথা ভাল নয়; হয় ত, আমি যথাসময়ে পহুছিতে পারিব না; অতএব, আপনিই হার লইয়া যান। তখন বসুপ্রিয় কহিলেন, হার কি আপনকার সঙ্গে আছে। চিরঞ্জীব চকিত হইয়া কহিলেন, ও কেমন কথা! তুমি কি আমায় হার দিয়াছ, যে হার আমার সঙ্গে আছে কি না, জিজ্ঞাসা করিতেছ। বসুপ্রিয় কহিলেন, মহাশয়! এ পরিহাসের সময় নয়, ইঁহার প্রস্থানের সময় বহিয়া যাইতেছে; আর বিলম্ব করা চলে না। অতএব, আমার হস্তে হার দেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, তুমি যে হারের বিষয়ে আমার নিকট অঙ্গীকার রক্ষা করিতে পার নাই, সেই দোষ ঢাকিবার জ্ন্য বুঝি এই ছল করিতেছ। আমি কোথায় সে জন্যে তোমায় ভৎর্সনা করিব, মনে করিয়াছি; না হইয়া তুমি, কলহপ্রিয়া কামিনতর ন্যায়, অগ্রেই তর্জ্জন গর্জ্জন আরম্ভ করিলে। .

 এই সময়ে, বণিক বসুপ্রিয়কে কহিলেন, সময় অতীত হইয়া যাইতেছে, আর আমি কোনও মতে বিলম্ব করিতে পারি না। তুখন বসুপ্রিয় চিরজীবকে কহিলেন, মহাশয়! শুনিলেন ত, উনি আর বিলম্ব করিতে পারেন না। চিরঞ্জীব কহিলেন, হার লইয়া আমার স্ত্রীর নিকটে গেলেই টাকা পাইবে। শুনিয়া, সাতিশয় বিরক্ত হইয়া, বসুপ্রিয় কহিলেন, মহাশয়। আপনি কেমন কথা বলিতেছেন; কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমি আপনকার হস্তে হার দিয়াছি; আমার নিকটে আর কেমন করিয়া হার থাকিবেক। হয়, হার পাঠাইয়া দেন, নয় পত্র লিখিয়া দেন। এই কথা শুনিয়া, কিঞ্চিৎ কুপিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, তোমার কৌতুক আর ভাল লাগিতেছে না; হার কেমন হইয়াছে, দেখাও।

 উভয়ের এইরূপ বিবাদ দর্শনে ও বাদানুবাদ শ্রবণে, যার পর নাই বিরক্ত হইয়া, বণিক চিরঞ্জীবকে বলিলেন, আপনাদের বাকচাতুরী আর আমার সহ্য হইতেছে না; আপনি টাকা দিবেন কি না, স্পষ্ট বলুন; যদি না দেন, আমি ইঁহাকে রাজপুরুষের হস্তে সমর্পণ করি। চিরঞ্জীব কহিলেন, আপনকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি, যে আপনি এত রূঢ় ভাবে আমার সহিত আলাপ করিতেছেন। তখন বসুপ্রিয় কহিলেন, আপনি হারের হিসাবে আমার টাকা ধারেন, সেই সম্পর্কে উনি এরূপ আলাপ করিতেছেন। সে যাহা হউক, টাকা এই দণ্ডে দিবেন কি না, বলুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি যত ক্ষণ হার ন। পাইতেছি, তোমায় এক কপর্দ্দকও দিব না। বসুপ্রিয় কহিলেন, কেন, আমি আধ ঘণ্টা পূর্ব্বে আপনকার হস্তে হার দিয়াছি। চিরঞ্জীব কহিলেন, তুমি কখনই আমায় হার দাও নাই। এরূপ মিথ্যা অভিযোগ করা বড় অন্যায়। উহাতে আমার যথেষ্ট অনিষ্ট করা হইতেছে। বসুপ্রিয় কহিলেন, হার পাওয়া অপলাপ করিয়া, আপনি আমার অধিকতর অনিষ্ট করিতেছেন; চির কালের জন্য আমার সন্ত্রম যাইতেছে।

 সত্বর টাকা পাইবার কোনও সম্ভাবনা নাই, দেখিয়া, বণিক রাজপুরুষকে কহিলেন, আপনি ইহাকে অবরুদ্ধ করুন। রাজপুরুষ বসুপ্রিয়কে অবরুদ্ধ করিলে, তিনি চিরঞ্জীবকে কহিলেন, দেখুন, আপনকার দোষে চির কালের জন্যে আমার মান সন্ত্রম যাইতেছে; আপনি টাকা দিয়া আমায় মুক্ত করুন; নতুবা আমিও আপনাকে এই দণ্ডে অবরুদ্ধ করাইব। শুনিয়া, সাতিশয় কুপিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে নির্ব্বোধ! আমি হার না পাইয়া টাকা দিব, কেন। তোমার সাহস হয়, আমায় অবরুদ্ধ করাও। তখন বসুপ্রিয় রাজপুরুষের হস্তে অবরোধনের খরচা দিয়া কহিলেন, দেখুন, ইনি আমার নিকট হইতে এক ছড়া বহুমূল্য হার লইয়া মূল্য দিতেছেন না, অতএব, আপনি ইঁহাকে অবরুদ্ধ করুন। সহোদরও যদি আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করে, আমি তাহাকেও ক্ষমা করিতে পারি না। স্বর্ণকারের অভিপ্রায় বুঝিয়া, রাজপুরুষ চিরঞ্জীবকে অবরুদ্ধ করিলেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি যে পর্যন্ত টাকা জমা করিতে, বা জামীন দিতে, না পারিতেছি, তাবৎ আপনকার অবরোধে থাকিব। এই বলিয়া, তিনি বসুপ্রিয়কে কহিলেন, আরে দুরাত্মন্‌! তুমি যে অকারণে আমার অবমাননা করিলে, তোমায় তাহার সম্পূর্ণ ফল ভোগ করিতে হইবেক; বোধ করি, এই দুর্বৃত্ততা অপরাধে তোমার সর্ব্বস্বান্ত হইবেক। বসুপ্রিয় কহিলেন, ভাল দেখা যাইবেক। জয়স্থল নিতান্ত অরাজক স্থান নহে। যখন উভয়ে বিচারালয়ে উপস্থিত হইব, আপনকার সমস্ত গুণ এরূপে প্রকাশ করিব, যে আপনি আর লোকালয়ে মুখ দেখাইতে পারিবেন না। আপনি অধিরাজ বাহাদুরের প্রিয় পাত্র বলিয়া, এরূপ গর্ব্বিত কথা কহিতেছেন। কিন্তু, তিনি যেরূপ ন্যায়পরায়ন, তাহাতে কখনই অন্যায় বিচার করিবেন না।

 হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব স্বীয় সহচর কিঙ্করকে জাহাজের অনুসন্ধানে পাঠাইয়াছিলেন। সমুদয় স্থির করিয়া, যার পর নাই আহ্লাদিত চিত্তে, সে স্বীয় প্রভুকে এই সংবাদ দিতে যাইতেছিল, পথিমধ্যে জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইয়া, স্বপ্রভু জ্ঞানে তাঁহার সম্মুখবর্ত্তী হইয়া কহিতে লাগিল, মহাশয়? আর আমাদের ভাবনা নাই, মলয়পুরের এক জাহাজ পাওয়া গিয়াছে; তাহাতে আমাদের যাওয়ার সমুদয় বন্দোবস্তু করিয়া আসিয়াছি। ঐ জাহাজ অবিলম্বে প্রস্থান করিবেক; অতএব, পান্থনিবাসে চলুন, দ্রব্য সামগ্রী সমুদয় লইয়া, এ পাপিষ্ঠ স্থান হইতে চলিয়া যাই। শুনিয়া চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে নির্ব্বোধ! আরে পাগল! মলয়পুরের জাহাজের কথা কি বলিতেছ। সে কহিল, কেন মহাশয়। আপনি কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমায় জাহাজের অনুসন্ধানে পাঠাইয়াছিলেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি তোমায় জাহাজের কথা বলি নাই, দড়ি কিনিতে পাঠাইয়াছিলাম। সে কহিল, না মহাশয়! আপনি দড়ি কিনিবার কথা কখন বলিলেন, জাহাজ দেখিতে পাঠাইয়াছিলেন। তখন চিরঞ্জীব যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া কহিলেন, আরে পাপিষ্ঠ! এখন আমি তোমার সঙ্গে এ বিষয়ের বিচার ও মীমাংসা করিতে পারি না; যখন সচ্ছন্দ চিত্তে থাকিব, তখন করিব, এবং যাহাতে উত্তরকালে আমার কথা মন দিয়া শুন, তাহাও ভাল করিয়া শিখাইয়া দিব। এখন সত্বর তুমি বাটী যাও, এই চাবিটি চন্দ্রপ্রভার হস্তে দিয়া বল, পাঁচ শত টাকার জন্য আমি পথে অবরুদ্ধ হইয়াছি; আমার বাক্সের ভিতরে যে স্বর্ণমুদ্রার থলী আছে, তাহা তোমা দ্বারা অবিলম্বে পাঠাইয়া দেন, তাহা হইলে আমি অবরোধ হইতে মুক্ত হইব। আর দাঁড়াইও না, শীঘ্র চলিয়া যাও। এই বলিয়া, কিঙ্করকে বিদায় করিয়া, তিনি রাজপুরুষকে কহিলেন, অহে রাজপুরুষ! যত ক্ষন টাকা না আসিতেছে, আমায় কারাগারে লইয়া চল। অনস্তর, তাঁহারা তিন জনে কারাগার অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। কিঙ্কর মনে মনে কহিতে লাগিল, আমায় চন্দ্রপ্রভার নিকটে যাইতে বলিলেন; সুতরাং, আজ আমরা যে বাটতে আহার করিয়াছিলাম, আমায় তথায় যাইতে হইবেক। পাকশালার পরিচারিণীর ভয়ে, সে বাটীতে প্রবেশ করিতে আমার সাহস হইতেছে না। কিন্তু প্রভু যে অবস্থায় যে জন্যে আমায় পাঠাই্ছেতেন, না গেলে কোনও মতে চলিতেছে না। এই বলিতে বলিতে, সে সেই বাটীর উদ্দেশে প্রস্থান করিল।

 এ দিকে, বিলাসিনী, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবের সমক্ষ হইতে পলাইয়া, চন্দ্র প্রভার নিকটে উপস্থিত হইলেন, এবং চিরঞ্জীবের সহিত যেরূপ কথোপকথন হইয়াছিল, সবিশেষ সমস্ত শুনাই লেন। চন্দ্রপ্রভা শুনিয়া কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর জিজ্ঞাসিলেন, বিলাসিনি। তিনি যে তোমার উপর অনুরাগ প্রকাশ, এবং পরিশেষে পরিণয় প্রস্তাব ও প্রলোভন বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তাহা কি তোমার বাস্তবিক বলিয়া বোধ হইল; আমার অনুভব হয়, তিনি পরিহাস করিয়াছেন। বিলাসিনী কহিলেন, না দিদি! পরিহাস নয়; আমার উপর তাঁহার যে বিলক্ষণ অনুরাগ জন্মিয়াছে, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় নাই; অন্তঃকরণে প্রগাঢ় অনুরাগ সঞ্চার না হইলে, পুরুষদিগের সেরূপ ভাবভঙ্গী ও সেরূপ কথাপ্রণালী হয় না। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস না হইলে, কখনই তোমার নিকট এই কথার উল্লেখ করিতাম না। শুনিয়া, দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাল, তিনি কি কি কথা বলিলেন। বিলাসিনী কহিলেন, তিনি বলিলেন, তোমার সহিত তাঁহার কোনও সম্পর্ক নাই, তিনি তোমার পাণিগ্রহণ করেন নাই, তোমার উপর তাহার কিছুমাত্র অনুরাগ নাই, তিনি বৈদেশিক ব্যক্তি, জয়স্থলে তাঁহার বাস নয়; পরে আমার উপর স্পষ্ট বাক্যে অনুরাগ প্রকাশ ও স্পষ্টতর বাক্যে পরিণয় প্রস্তাব করিলেন; অবশেষে, তাহার ভাবভঙ্গী দেখিয়া, ভয় পাইয়া, আমি পলাইয়া আসিলাম।

 সমুদয় শ্রবণ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, বিলাসিনি! তোমার মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে এ জন্মে আর র্তাহার সঙ্গে আলাপ করিতে হয় না। তিনি যে এমন নীচ প্রকৃতির লোক, তাহা আমি এক বারও মনে করি নাই। কিন্তু আমার মন কেমন, বলিতে পারি না। দেখ, তিনি কেমন মমতাশূন্য হইয়াছেন, এবং কেমন নৃশংস ব্যবহার করিতেছেন; আমি কিন্তু তাহার প্রতি সেরূপ মমতাশূন্য হইতে বা সেরূপ নৃশংস ব্যবহার করিতে পারিতেছি না; এখনও আমার অনুরাগ অণুমাত্র বিচলিত হইতেছে না। এই বলিয়া, চন্দ্রপ্রভা খেদ করিতে আরম্ভ করিলেন, বিলাসিনী প্রবোধবাক্যে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে হেমকুটের কিঙ্কর তাঁহাদের নিকটবর্তী হইল। তাহাকে দেখিয়া, জয়স্থলের কিঙ্কর বোধ করিয়া, বিলাসিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, কিঙ্কর। তুমি হাঁপাইতেছ কেন। সে কহিল, উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া আসিয়াছি, তাহাতেই হাঁপাইতেছি। বিলাসিনী কহিলেন, তোমার প্রভু কোথায়, তিনি ভাল আছেন ত। তোমার ভাব দেখিয়া ভয় হইতেছে; কেমন, কোনও অনিষ্টঘটনা হয় নাই ত। সে কহিল, তিনি রাজপুরুষের হস্তে সমর্পিত হইয়াছেন; সে তাহারে অবরুদ্ধ করিয়া কারাগারে লইয়া যাইতেছে। শুনিয়া, যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, কিঙ্কর। কাহার অভিযোগে তিনি অবরুদ্ধ হইলেন। সে কহিল, আমি তাহার কিছুই জানি না; আমায় এক কর্ম্মে পাঠাইয়াছিলেন; কর্ম্ম শেষ করিয়া তাহার সন্নিহিত হইবামাত্র, তিনি আমার হস্তে এই চাবিটি দিয়া আপনকার নিকটে আসিতে কহিলেন; বলিয়া দিলেন, তাঁহার বাক্সের মধ্যে একটি স্বর্ণমুদ্রার থলী আছে, আপনি চাবি খুলিয়া তাহা বাহির করিয়া আমার হস্তে দেন; ঐ টাকা দিলে, তিনি অবরোধ হইতে নিষ্কৃতি পাইবেন। শুনিবামাত্র, বিলাসিনী, চিরঞ্জীবের বাক্স হইতে স্বর্ণমুদ্রার থলী আনিয়া, কিঙ্করের হস্তে সমর্পণ করিলেন এবং কহিলেন, অবিলম্বে তোমার প্রভুকে বাটীতে লইয়া আসিবে। সে স্বর্ণমুদ্রা লইয়া দ্রুত পদে প্রস্থান করিল; তাঁহারা দুই ভগিনীতে, দুর্ভাবনায় অভিভূত হইয়া, বিষম অসুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।

 হেমকুটের চিরঞ্জীব, কিঙ্করকে জাহাজের অনুসন্ধানে প্রেরণ করিয়া বহু ক্ষণ পর্য্যন্ত, উৎসুক চিত্তে, তাহার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করিলেন; এবং সমধিক বিলম্ব দর্শনে নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, কিঙ্করকে সত্বর সংবাদ আনিতে বলিয়াছিলাম, সে এখনও আসিল না, কেন। যে জন্যে পাঠাইয়াছি হয় ত তাহারই কোনও স্থিরতা করিতে পারে নাই, নয় ত পথিমধ্যে কোনও উৎপাতে পড়িয়াছে; নতুবা, যে বিষয়ের জন্য গিয়াছে তাহাতে উপেক্ষা করিয়া, বিষয়ান্তরে আসক্ত হইবেক, এরূপ বোধ হয় না; কারণ, জয়স্থল হইতে পলাইবার নিমিত্ত সে আমা অপেক্ষাও ব্যস্ত হইয়াছে। অতএব, পুনরায় কোনও উপদ্রব ঘটিয়াছে, সন্দেহ নাই। এ নগরের যে রঙ্গ দেখিতেছি, তাহাতে উপদ্রবঘটনার অপ্রতুল নাই। রাজপথে নির্গত হইলে, সকল লোকেই আমার নাম গ্রহণ পূর্ব্বক সম্বোধন ও সংবৰ্দ্ধনা করে; অনেকেই চিরপরিচিত সুহৃদের ন্যায় প্রিয় সম্ভাষণ করে; কেহ কেহ এরূপ ভাব প্রকাশ করে, যেন আমি নিজ অর্থ দ্বারা তাহাদের অনেক আনুকুল্য করিয়াছি, অথবা আমার সহায়তায় তাহারা বিপদ হইতে উদ্ধার লাভ করিয়াছে; কেহ কেহ আমায় টাকা দিতে উদ্যত হয়; কেহ কেহ আহারের নিমন্ত্রণ করে; কেহ কেহ পরিবারের কুশল জিজ্ঞাসা করে; কেহ কেহ কহে, আপনি যে দ্রব্যের জন্য আদেশ করিয়াছিলেন তাহা সংগৃহীত হইয়াছে, আমার দোকানে গিয়া দেখিবে, না বাটীতে পাঠাইয়া দিব; পান্থনিবাসে আসিবার সময়, এক দরজী, পীড়াপীড়ি করিয়া, দোকানে লইয়া গেল এবং আপনকার চাপকানের জন্ত এই গরদের থান আনিয়াছি বলিয়া, আমার গায়ের মাপ লইয়া ছাড়িয়া দিল; আবার, এক স্বর্ণকার, আমার হস্তে বহু মূল্যের হার দিয়া, মূল্য না লইয়া চলিয়া গেল। কেহই আমায় বৈদেশিক বিবেচনা করে না। আমি যেন জয়স্থলের এক জন গণনীয় ব্যক্তি। আর মধ্যাহ্ন কালে দুই স্ত্রীলোক যে কাণ্ড করিল, তাহ অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব্ব। এ স্থানে মাদৃশ বৈদেশিক ব্যক্তির কোনও ক্রমে ভদ্রস্থতা নাই। এখানকার ব্যাপার বুঝিয়া উঠা ভার। যদি আজ সন্ধ্যার মধ্যে প্রস্থান করিতে পারি, তাহা হইলেই মঙ্গল। কিন্তু, কিঙ্কর কি জন্য এত বিলম্ব করিতেছে। যাহা হউক, আর তাহার প্রতীক্ষায় থাকিলে চলে না; অন্বেষণ করিতে হইল।

 এই বলিয়া, পান্থনিবাস হইতে নির্গত হইয়া, চিরঞ্জাব রাজপথে অবতীর্ণ হইয়াছেন, এমন সময়ে, কিঙ্কর সত্বর গমনে তাঁহার সন্নিহিত হইল, এবং কহিল, যে স্বর্ণমুদ্রা আনিবার জন্য আমায় পাঠাইয়াছিলেন, তাহা এই। ইহা কহিয়া, সে স্বর্ণমুদ্রার থলী তাঁহার হস্তে দিল; এবং জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি রূপে সেই ভীষণমূর্ত্তি রাজপুরুষের হস্ত হইতে নিস্তার পাইলেন; সে যে বড় টাকা না পাইয়া ছাড়িয়া দিল। তিনি স্বর্ণমুদ্রা দর্শনে ও কিঙ্করের কথা শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, কিঙ্কর এ স্বর্ণমুদ্রা কোথায় পাইলে এবং কি জন্যেই বা আমার হস্তে দিলে, বল; আমি ত তোমায় স্বর্ণমুদ্রা আনিবার জন্য পাঠাই নাই। কিঙ্কর কহিল, সে কি মহাশয়। রাজপুরুষ আপনারে কারাগারে লইয়া যাইতেছিল, এমন সময়ে আপনি, আমায় দেখিতে পাইয়া, আমার হস্তে একটি চাবি দিয়া কহিলেন, বাক্সের মধ্যে পাঁচ শত টাকার স্বর্ণমুদ্রা আছে; চন্দ্রপ্রভার হস্তে এই চাবি দিলে, তিনি তাহা বহিষ্কৃত করিয়া তোমার হস্তে দিবেন; তুমি ক্ষণ মাত্র বিলুম্ব না করিয়া আমার নিকটে আনিবে। তদনুসারে, আমি এই স্বর্ণমুদ্রা আনিয়াছি। বোধ হয়, আপনকার স্মরণ আছে, আমরা মধ্যাহ্ন কালে যে স্ত্রীলোকের বাটতে আহার করিয়াছিলাম, তাঁহার নাম চন্দ্রপ্রভা। তিনি ও তাঁহার ভগিনী, অবরোধের কথা শুনিয়া, অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়াছেন, এবং সত্বর আপনারে লইয়া যাইতে বলিয়াছেন। এক্ষণে আপনকার যেরূপ অভিরুচি। আমি কিন্তু প্রাণন্তেও আর সে বাটীতে প্রবেশ করিব না। আপনি বিপদে পড়িয়াছিলেন, কেবল এই অনুরোধে স্বর্ণমুদ্রা আনিতে গিয়াছিলাম। সে যাহা হউক, আপনি যে এই অবান্ধব দেশে সহজে রাজপুরুষের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছেন, ইহাতে আমি বড় আহ্লাদিত হইয়াছি। তদপেক্ষা অধিক আহ্লাদের বিষয় এই যে, এই এক উপলক্ষে পাঁচ শত টাকার স্বর্ণমুদ্রা অনায়াসে হস্তগত হইল।

 এই সমস্ত কথা শুনিয়া, পরিহাসরনিক কিঙ্কর কৌতুক করিতেছে ইহা ভাবিয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, আরে নরাধম! আমি তোমায় যে জন্যে পাঠাইয়াছিলাম, তাহার কোনও কথা না বলিয়া, কেবল পাগলামি করিতেছ এখান হইতে অবিলম্বে পলায়ন করাই শ্রেয়ঃ, এই পরামর্শ স্থির করিয়া, তোমায় জাহাজের অন্বেষণে পাঠাইয়াছিলাম। অতএব বল, আজ কোনও জাহাজ জয়স্থল হইতে প্রস্থান করিবেক কি না, এবং তাহাতে আমাদের যাওয়া ঘটিবেক কি না। কিঙ্কর কহিল, সে কি মহাশয়। আমি যে এক ঘণ্টা পূর্ব্বে আপনাকে সে বিষয়ের সংবাদ দিয়াছি। তখন অবরোধের হঙ্গামে পড়িয়াছিলেন; সে জন্যেই হউক, অ্ন্য কোনও কারণেই হউক, আপনি সে কথায় মনোযোগ করিলেন না, বরং আমার উপর বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। নতুবা, এত ক্ষণ আমরা দ্রব্যসামগ্রী লইয়া জাহাজে উঠিতে পারিতাম। কিঙ্করের কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব মনে মনে কহিতে লাগিলেন, হতভাগ্য বুদ্ধিভ্রষ্ট হইয়াছে, তাহাতেই পাগলের মত এত অসম্বদ্ধ কথা বলিতেছে; অথবা উহারই বা অপরাধ কি, আমিও ত স্থানমাহাত্ম্যে অবিকল ঐরূপ হইয়াছি। উভয়েরই তুল্যরূপ বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাহার আর কোনও সন্দেহ নাই। তিনি মনে মনে এই সমস্ত আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে কিঙ্কর, একটি স্ত্রীলোককে আসিতে দেখিয়া, চকিত হইয়া, আকুল বচনে কহিল, মহাশয়। সাবধান হউন, ঐ দেখুন, আবার কে এক ঠাকুরাণী আদিতেছেন। উনি যাহাতে আহারের লোভ দেখাইয়া, অথবা অন্য কোনও ছলে বা কৌশলে ভুলাইয়া আমাদিগকে লইয়া যাইতে না পারেন, তাহা করিবেন। পূর্ব্ব বারে যেমন, পতিসম্ভাষণ করিয়া, হাত ধরিয়া, এক ঠাকুরাণী আপন বাটীতে লইয়া গেলেন, আপনি, একটিও কথা না কহিয়া, চোরের মত চলিয়া গেলেন, এ বার যেন সেরূপ না হয়। জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব, স্বীয় ভবনে প্রবেশ করিতে না পাইয়া, মধ্যাহ্নকালে অপরাজিত নাম্নী যে কামিনীর বাটীতে আহার করিয়াছিলেন, তাঁহার অঙ্গুলি হইতে একটি মনোহর অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিয়া লয়েন, এবং সেই অঙ্গুরীয়ের বিনিময়ে, তাহাকে বসুপ্রিয়নির্ম্মিত মহামূল্য হার দিবার অঙ্গীকার করেন। হার যথাকালে উপস্থিত না হওয়াতে লজ্জিত হইয়া, তিনি স্বয়ং স্বর্ণকারের বিপণি হইতে হার আনয়ন করিতে যান। অপরাজিতা, তাঁহার সমধিক বিলম্ব দর্শনে, তদীয় অন্বেষণে নিৰ্গত হইয়া, কিয়ং ক্ষণ পরে হেমকূটবাদী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইলেন, এবং জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীববোধে তাঁহার সন্নিহিত হইয়া কহিলেন, মহাশয়! আমায় যে হার দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, আপনকার গলায় এ কি সেই হার। এ বেলা আমার বাটীতে আহার করিতে হইবেক; আমি আপনাকে লইয়া যাইতে আসিয়াছি। এ আবার কোথাকার আপদ উপস্থিত হইল এই ভাবিয়া, চিরঞ্জীব রোষকষায়িত লোচনে সাতিশয় পরুষ বচনে কহিলেন, অরে মায়াবিনি! তুমি দূর হও; তোমায় সতর্ক করিয়া দিতেছি, আমায় কোনও প্রকার প্রলোভন প্রদর্শন করিও না। কিঙ্কর, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, স্বীয় প্রভুকে সম্বোধন করিয়া কহিল, মহাশয়! সাবধান হইবেন, যেন এ রাক্ষসীর মায়ায় ভুলিয়া, উহার বাটীতে আহার করিতে না যান।

 উভয়ের ভাব দর্শনে ও বাক্য শ্রবণে, অপরাজিতা, বিস্মিত না হইয়া, সম্মিত বদনে কহিলেন, মহাশয়। আপনি যেমন পরিহাসপ্রিয়, আপনকার ভূতাটি আবার তদপেক্ষা অধিক। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমার বাটীতে যাইবেন কি না বলুন, আমি আহারের সমুদয় আয়োজন করিয়াছি। এই কথা শুনিয়া, কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! আমি পুনরায় সাবধান করিতেছি, আপনি কদাচ এই পিশাচীর মায়ায় ভুলিবেন না। তখন চিরঞ্জীব ক্রোধে অন্ধ হইয়া কহিলেন, অরে পাপীয়সি! তুমি এই দণ্ডে এখান হইতে চলিয়া যাও। তোমার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক যে তুমি আমায় আহার করিতে ডাকিতেছ। যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এখানকার স্ত্রীলোক মাত্রেই ডাকিনী। স্পষ্ট

 কথায় বলিতেছি, যদি ভাল চাও, অবিলম্বে আমার সম্মুখ হইতে চলিয়া যাও। জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবের সহিত এই স্ত্রীলোকের বিলক্ষণ সৌহৃদ্য ছিল, তিনি যে তাঁহার প্রতি এবংবিধ অযুক্ত আচরণ করিবেন, ইহা স্বপ্নের অগোচর। চিরঞ্জীববাবুর নিকট এরূপে অপমানিত হইলাম, এই ভাবিয়া, তিনি সাতিশয় রোষ ও অসন্তোষ প্রদর্শন পূর্ব্বক কহিলেন, এত কাল আপনাকে ভদ্র বলিয়া বোধ ছিল; কিন্তু আপনি যেমন ভদ্র, আজ তাহার সম্পূর্ণ পরিচয় পাইলাম। সে যাহা হউক, মধ্যাহ্নে, আহারের সময়, আমার অঙ্গুলি হইতে যে অঙ্গুরীয় খুলিয়া লইয়াছেন, হয় তাহা ফিরিয়া দেন, নয় উহার বিনিময়ে যে হার দিবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, তাহা দেন; দুয়ের এক পাইলেই আমি চলিয়া যাই; তৎপরে আর এ জন্মে আপনকার সহিত আলাপ করিব না, এবং প্রাণান্ত ও সর্ব্বস্বান্ত হইলেও কোনও সংস্রব রাখিব না। এই সকল কথা শুনিয়া কিঙ্কর কহিল, অন্য অন্য ডাইন, ছাড়িবার সময়, বাটা, কুলে, শিল, নোড়া বা ছেড়া জুতা পাইলেই সন্তুষ্ট হইয়া যায়, এ দিব্যাঙ্গনা ডাইনটির অধিক লোভ দেখিতেছি; ইনি হয় হার, নয় আঙ্গটি, দুয়ের একটি না পাইলে যাইবেন না। মহাশয়। সাবধান, কিছুই দিবেন না, দিলেই অনর্থপাত হইবেক। অপরাজিতা, কিঙ্করের কথার উত্তর না দিয়া, চিরঞ্জীবকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহাশয়! হয় হার, নয় আঙ্গটি দেন। বোধ করি, আমায় ঠকান আপনকার অভিপ্রেত নহে। চিরঞ্জীব উত্তরোত্তর অধিকতর কোপাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, অরে ডাকিনি! দূর হও। এই বলিয়া, কিঙ্করকে সঙ্গে লইয়া, তিনি চলিয়া গেলেন।

 এইরূপে তিরস্কৃত ও অপমানিত হইয়া, অপরাজিতা কিয়ৎ ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন; অনন্তর মনে মনে কহিতে লাগিলেন, চিরঞ্জীববাবু নিঃসন্দেহ উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন, নতুবা উঁহার আচরণ এরূপ বিসদৃশ হইবেক, কেন। চিরকাল আমরা উহাকে সুশীল, সুবোধ, দয়ালু ও অমায়িক লোক বলিয়া জানি; কেহ কখনও কোনও কারণে উহারে ক্রোধের বশীভূত হইতে দেখি নাই; আজ তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখিতেছি। উন্মাদ ব্যতিরেকে এরূপ লোকের এরূপ ভাবান্তর কোনও ক্রমে সম্ভবে না ইনি, বিনিময়ে হার দিবার অঙ্গীকার করিয়া, অঙ্গুরীয় লইয়াছেন; এখন, আমায় কিছুই দিতে চাহিতেছেন না। ইনি, সহজ অবস্থায়, এরূপ করিবার লোক নহেন। মধ্যাহ্নকালে, আমার আলয়ে আহার করিবার সময় বলিয়াছিলেন, চন্দ্রপ্রভা আজ উঁহাকে বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই। তখন এ কথার ভাব বুঝিতে পারি নাই। এখন স্পষ্ট বোধ হইতেছে, উনি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন বলিয়াই, তিনি দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। এখন আমি কি করি; অথবা উঁহার স্ত্রীর নিকটে গিয়া বলি, আপনকার স্বামী, উন্মাদগ্রস্ত হইয়া, মধ্যাহ্নকালে আমার বাটীতে প্রবেশ করিয়াছিলেন, এবং বল পূর্ব্বক আমার অঙ্গুরীয় লইয়া পলায়ন করিয়াছেন। ইহা শুনিলে, তিনি অবশ্যই আমার অঙ্গুরীয় প্রতিপ্রাপ্তির কোনও উপায় করিবেন। আমি অকারণে এক শত টাকা মূল্যের বস্তু হারাইতে পারি না। এই স্থির করিয়া, তিনি চিরঞ্জীবের আলয় অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব মনে করিয়াছিলেন, কিঙ্কর সত্বর স্বর্ণমুদ্রা আনয়ন করিবেক। কিন্তু বহু ক্ষণ পর্য্যন্ত সে না আসাতে, তিনি অবরোধকারী রাজপুরুষকে কহিলেন, তুমি অকারণে আমায় কষ্ট দিতেছ; যে টাকার জন্য আমি অবরুদ্ধ হইয়াছি, বাটী যাইবামাত্র তাহা দিতে পারি। অতএব, তুমি আমার সঙ্গে চল। আর, আমি যে কারাগার হইতে বহির্গত হইলে, পথে তোমার হাত ছাড়াইয়া পলাইব, সে আশঙ্কা করিও না। আমি নিতান্ত সামান্য লোকও নই, এবং তোমার অথবা অন্য কোনও রাজপুরুষের নিতান্ত অপরিচিতও নই। কিঙ্কর টাকা না লইয়া আসিবার দুই কারণ বোধ হইতেছে; প্রথম এই যে, আমি জয়স্থলে কোনও কারণে অবরুদ্ধ হইব, আমার স্ত্রী সহজে তাহা বিশ্বাস করিবেন না; সুতরাং কিঙ্করের কথা শুনিয়া উপহাস করিয়াছেন। দ্বিতীয় এই যে, কি কারণে বলিতে পারি না, তিনি আজ সম্পূর্ণ বিকলচিত্ত হইয়া আছেন; হয় ত, তজ্জন্য কিঙ্করের কথিত বিষয়ে মনোযোগ দেন নাই। রাজপুরুষ সম্মত হইলেন। চিরঞ্জীব, তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া, স্বীয় ভবন অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, কিঞ্চিৎ অন্তরে কিঙ্করকে দেখিতে পাইয়া, চিরঞ্জীব রাজপুরুষকে কহিলেন, ঐ আমার লোক আসিতেছে। ও টাকা সংগ্রহ করিয়। আসিয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই। অতএব, আর তোমায় আমার বাটী পর্যন্ত যাইতে হইবেক না। অল্প ক্ষণের মধ্যেই কিঙ্কর সম্মুখবর্ত্তী হইলে, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন, কিঙ্কর! যে জন্যে পাঠাইয়াছিলাম, তাহা সংগ্রহ হইয়াছে কি না। সে কহিল, হাঁ মহাশয়। তাহা সংগ্রহ না করিয়া, আমি আপনকার নিকটে আসি নাই। এই বলিয়া, সে ক্রীত রজ্জু তাঁহাকে দেখাইল। চিরঞ্জীব কহিলেন, বলি, টাকা কোথায়। সে কহিল, আর টাকা আমি কোথায় পাইব; আমার নিকটে যাহা ছিল, তাহা দিয়া এই দড়ী কিনিয়া আনিয়াছি। তিনি কহিলেন, এক গাছ দড়ী কিনিতে কি পাঁচ শত টাকা লাগিল। এখন পাগলামি ছাড়; বল, আমি যে জন্যে তাড়াতাড়ি বাড়িতে পাঠাইলাম, তাহার কি হইল। সে কহিল, আপনি আমায় দড়ী কিনিয়া বাড়ি যাইতে বলিয়াছিলেন; দড়ী কিনিয়াছি, এবং তাড়াতাড়ি বাড়ি যাইতেছি। চিরঞ্জীব, সাতিশয় কুপিত হইয়া, কিঙ্করকে প্রহার করিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া সমভিব্যাহারী রাজপুরুষ চিরঞ্জীবকে কহিলেন, মহাশয়! এত অধৈর্য্য হইবেন না; সহিষ্ণতা যে কত বড় গুণ, তাহা কি আপনি জানেন না। এই কথা শুনিয়া কিঙ্কর কহিল, উঁহারে সহিষ্ণু হইবার উপদেশ দিবার প্রয়োজন কি। যে কষ্ট ভোগ করে, তাহারই সহিষ্ণুতা গুণ থাকা আবশ্যক; আমি প্রহারের কষ্ট ভোগ করিতেছি; আমায় বরং আপনি ঐ উপদেশ দেন। তখন রাজপুরুষ রোষ প্রদর্শন করিয়া কছিলেন, অরে পাপিষ্ঠ! যদি ভাল চাও, মুখ বন্ধ কর। কিঙ্কর কহিল, আমায় মুখ বন্ধ করিতে বলা অপেক্ষা, উঁহাকে হাত বন্ধ করিতে বলিলে ভাল হয়।

 এই সকল কথা শুনিয়া, যার পর নাই ক্রোধান্বিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে অচেতন নরাধম। আর আমায় বিরক্ত করিও না। সে কহিল, আমি অচেতন হইলে, আমার পক্ষে ভাল হইত। যদি অচেতন হইতাম, আপনি প্রহার করিলে, কষ্ট অনুভব করিতাম না। তিনি কহিলেন, তুমি অন্য সকল বিষয়ে অচেতন, কেবল প্রহার সহন বিষয়ে নহ; সে বিষয়ে তোমায় ও গর্দ্দভে বিভেদ নাই। সে কহিল, আমি যে গর্দ্দভ, তার সন্দেহ কি; গর্দ্দভ না হইলে, আমার কান লম্বা হইবেক কেন। এই বলিয়া, রাজপুরুষকে সম্ভাষণ করিয়া, কিঙ্কর কহিল, মহাশয়। জন্মাবধি প্রাণপণে ইঁহার পরিচর্য্যা করিতেছি, কিন্তু কখনও প্রহার ভিন্ন অন্য পুরস্কার পাই নাই। শীত বোধ হইলে, প্রহার করিয়া গরম করিয়া দেন; গরম বোধ হইলে, প্রহার করিয়া শীতল করিয়া দেন, নিদ্রাবেশ হইলে, প্রহার করিয়া সজাগর করিয়া দেন; বসিয়া থাকিলে, প্রহার করিয়া উঠাইয়া দেন; কোনও কাজে পাঠাইতে হইলে, প্রহার করিয়া বাটী হইতে বাহির করিয়া দেন; কার্য্য সমাধা করিয়া বাটীতে আসিলে, প্রহার করিয়া আমার সংবৰ্দ্ধনা করেন; কথায় কথায় কান ধরিয়া টানেন, তাহাতেই আমার কান এত লম্বা হইয়াছে। বলিতে কি, মহাশয়। কেহ কখনও এমন গুণের মনিব ও এমন সুখের চাকরি পায় নাই; আমি ইহার আশ্রয়ে পরম সুখে কাল কাটাইতেছি।

 এই সময়ে চিরঞ্জীব দেখিতে পাইলেন, তাঁহার সহধর্ম্মিণী কতকগুলি লোক সঙ্গে লইয়া আসিতেছেন। তখন তিনি কিঙ্করকে কহিলেন, আরে বানর। আর তোমার পাগলামি করিতে হইবেক না। এখন এখান হইতে চলিয়া যাও; আমার গৃহিণী আসিতেছেন। কিঙ্কর, তাহাকে দেখিতে পাইয়া, উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিল, মা ঠাকুরাণি। শীঘ্র আসুন; বাবু আজ আপনাকে বিলক্ষণ পুরস্কার দিবেন; হারের পরিবর্ত্তে এক রমণীয় উপহার পাইবেন। এই বলিয়া, হস্তস্থিত রজ্জু উত্তোলিত করিয়া, সে তাঁহাকে দেখাইতে লাগিল। চিরঞ্জীব, ক্রোধে অন্ধ হইয়া, তাহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন।

 অপরাজিতার মুখে চিরঞ্জীবের উন্মাদের সংবাদ পাইয়া, যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইয়া, চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাধর নামক এক ব্যক্তিকে ডাকাইয়া আনেন। বিদ্যাধর ঐ পাড়ার গুরুমহাশয় ছিল; কিন্তু অবসরকালে পাড়ায় পাড়ায় চিকিৎসা করিয়া বেড়াইত। অনেকে বিশ্বাস করিত, ভূতে পাইলে, কিংবা ডাইনে খাইলে, সে অনায়াসে প্রতিকার করিতে পারে; এজন্য, সে সেই পল্লীর স্ত্রীলোকের ও ইতর লোকের নিকট বড় মান্য ও আদরণীয় ছিল। বিখ্যাত বিজ্ঞ বৈদ্য চিকিৎসা করিলেও, বিদ্যাধর না দেখিলে, তাহাদের মনের সন্তোষ হইত না। ফলতঃ, ঐ সকল লোকের নিকট বিদ্যাধরের প্রতিপত্তির সীমা ছিল না। সে উপস্থিত হইলে, চন্দ্রপ্রভা, স্বামীর পীড়ার বৃত্তান্ত কহিয়া, তাহার হস্তে ধরিয়া বলেন, তুমি সত্বর তাহাকে সুস্থ ও প্রকৃতিস্ত করিয়া দাও, তোমায় বিলক্ষণ পুরস্কার দিব। সে কহে, আপনি কোনও ভাবনা করিবেন না। আমি অনেক বিদ্যা জানি; আমার পিতা মাতা, না বুঝিয়া, আমায় বিদ্যাধর নাম দেন নাই। সে যাহা হউক, অবিলম্বে তাঁহাকে বাটতে আনা আবশ্যক। চলুন, আমি সঙ্গে যাইতেছি। কিন্তু, উন্মত্ত ব্যক্তিকে আনা সহজ ব্যাপার নহে; অতএব লোক সঙ্গে লইতে হইবেক। চন্দ্রপ্রভা, পাচ সাত জন লোক সংগ্রহ করিয়া, বিদ্যাধর, বিলাসিনী ও অপরাজিতাকে সঙ্গে লইয়া, চিরঞ্জীবের অন্বেষণে নির্গত হইয়াছিলেন।

 যে সময়ে চিরঞ্জীব, ক্রোধে অধীর হইয়া, কিঙ্করকে প্রহার ও তিরস্কার করিতেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে চন্দ্রপ্রভা তাঁহার সমীপবর্ত্তিনী হইলেন। অপরাজিতা তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দেখ, তোমার স্বামী উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন কি না। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, উঁহার ব্যবহার ও আকার প্রকার দেখিয়া, আমার আর সন্দেহ বোধ হইতেছে না। এই বলিয়া, তিনি বিদ্যাধরকে কহিলেন, দেখ, তুমি অনেক মন্ত্র, অনেক ঔষধ, এবং চিকিৎসার অনেক কৌশল জান, এক্ষণে সত্বর উহারে প্রকৃতিস্থ কর; তুমি যে পুরস্কার চাহিবে, আমি তাহাই দিয়া তোমায় সন্তুষ্ট করিব। বিলাসিনী সাতিশয় দুঃখিত ও বিষন্ন হইয়। কহিলেন, হায়! কোথা হইতে এমন সর্ব্বনাশিয়া রোগ আসিয়া জুটিল; উঁহার সে আকার নাই, সে মুখশ্রী নাই; কখনও উহার এমন বিকট মূর্ত্তি দেখি নাই, উঁহার দিকে তাকাইতেও ভয় হইতেছে। বিদ্যাধর চিরঞ্জীবকে কহিল, বাবু! তোমার হাতটা দাও, নাড়ীর গতি কিরূপ, দেখিব। চিরঞ্জীব যৎপরোনাস্তি কুপিত হইয়া কহিলেন, এই আমার হাত, তুমি কানটি বাড়াইয়া দাও। তখন বিদ্যাধর স্থির করিল, চিরঞ্জীবের শরীরে ভুতাবেশ বশতঃ প্রকৃতির বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে। তদনুসারে সে, কতিপয় মন্ত্র পাঠ করিয়া, তাঁহার দেহগত ভুতকে সম্বোধিয়া কহিতে লাগিল, অরে দুরাত্মনৃ পিশাচ। আমি তোরে আদেশ করিতেছি, অবিলম্বে উঁহার কলেবর হইতে নিৰ্গত হইয়। স্বস্থানে প্রস্থান কর। চিরঞ্জীব শুনিয়া নিরতিশয় ক্রোধভরে কহিলেন, অরে নিবোধ! অরে পাপিষ্ঠ! অরে অর্থপিশাচ! চুপ কর, আমি পাগল হই নাই। শুনিয়া, যার পর নাই দুঃখিত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা বাষ্পাকুল লোচনে অতি দীন বচনে কহিলেন, পূর্ব্বে ত তুমি এরূপ ছিলে না; আমার নিতান্ত পোড়া কপাল বলিয়া, আজ অকস্মাৎ এই বিষম রোগ কোথা হইতে তোমার শরীরে প্রবেশ করিয়াছে। চন্দ্রপ্রভার বাক্য শ্রবণে, চিরঞ্জীবের কোপানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি তাঁহাকে যথোচিত ভর্ৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, অরে পাপীয়সি। এই নরাধম, বুঝি, আজ কাল তোর অন্তরঙ্গ হইয়াছে। এই দুরাত্মার সঙ্গে আহার বিহারের আমোদে মত্ত হইয়াই, বুঝি, দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলি, এবং আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দিল নাই। শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা চকিত হইয়া কহিলেন, ও কেমন কথা বলিতেছ; তোমার আসিতে কিছু বিলম্ব হইয়াছিল বটে; তার পরে ত সকলে এক সঙ্গে আহার করিয়াছি। তুমি আহারের পর বরাবর বাটীতে ছিলে; কিঞ্চিৎ কাল পূর্ব্বে, কাহাকেও কিছু না বলিয়া, চলিয়া আসিয়াছ। এখন কি কারণে আমায় ভর্ৎসনা করিতেছ ও এরূপ কুৎসিত কথা বলিতেছ, বুঝিতে পারিতেছি না।

 এই কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব স্বীয় অনুচরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হে, কিঙ্কর। আজ আমি কি মধ্যাহ্নকালে বাটীতে আহার করিয়াছি। সে কহিল, না মহাশয়। আজ আপনি বাটীতে আহার করেন নাই। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসিলেন, আমি আজ যখন আহার করিতে যাই, বাটীর দ্বার রুদ্ধ ছিল কি না, এবং আমাকে বাটীতে প্রবেশ করিতে দিয়াছিল কি না। সে কহিল, আজ্ঞা, হাঁ, বাটীর দ্বার রুদ্ধ করা ছিল, এবং আপনাকে প্রবেশ করিতে দেয় নাই। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসিলেন, আচ্ছা, উনি নিজে অভ্যন্তর হইতে আমাকে গালাগালি দিয়াছেন কি না। সে কহিল, আজ্ঞা, হাঁ, উনি অত্যন্ত কটুবাক্য বলিয়াছিলেন। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসিলেন, তৎপরে আমি, অবমানিত বোধ করিয়া, ক্রোধভরে সেখান হইতে চলিয়া যাই কি না। সে কহিল, আজ্ঞা, হাঁ, তার পর আপনি ক্রোধভরে সেখান হইতে চলিয়া যান।

 এই প্রশ্নোত্তরপরম্পরা শ্রবণ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা আক্ষেপবচনে কিঙ্করকে কহিলেন, তুমি বিলক্ষণ প্রভুভক্ত; প্রভুর যথার্থ হিতচেষ্টা করিতেছ। যাহাতে উহার মনের শান্তি হয়, সে চেষ্টা না করিয়া, কেবল রাগবৃদ্ধি করিয়া দিতেছ। বিদ্যাধর কহিল, আপনি উহারে অন্যায় তিরস্কার করিতেছেন; ও অবিবেচনার কর্ম্ম করিতেছে না। ও ব্যক্তি উহার রীতি ও প্রকৃতি বিলক্ষণ জানে। এরূপ অবস্থায় চিত্তের অনুবর্ত্তন করিলে, যেরূপ উপকার দর্শে, অন্য কোনও উপায়ে সেরূপ হয় না। চিরঞ্জীব চন্দ্রপ্রভার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, তুই স্বর্ণকারের সহিত যোগ দিয়া আমায় কয়েদ করাইয়াছিস; নতুবা স্বর্ণমুদ্রা পাঠাইলি না কেন। শুনিয়া, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, সে কি নাথ! এমন কথা বলিও না; কিঙ্কর আসিয়া, অবরোধের উল্লেখ করিবামাত্র, আমি উহা দ্বারা স্বর্ণমুদ্রা পাঠাইয়া দিয়াছি। কিঙ্কর চকিত হইয়া কহিল, আমা দ্বারা পাঠাইয়াছেন? আপনকার যাহা ইচ্ছা হইতেছে, তাহাই বলিতেছেন। এই বলিয়া সে চিরঞ্জীবকে কহিল, না মহাশয়! আমার হস্তে এক পয়সাও দেন নাই; আপনি উহার কথায় বিশ্বাস করিবেন না। তখন চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি স্বর্ণমুদ্রা আনিবার জন্য উঁহার নিকটে যাও নাই? চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, ও আমার নিকটে গিয়াছিল, বিলাসিনী তদণ্ডে উহার হস্তে স্বর্ণমুদ্রার থলী দিয়াছে। বিলাসিনীও কহিলেন, আমি স্বয়ং উহার হস্তে স্বর্ণমুদ্রার থলী দিয়াছি। তখন কিঙ্কর কহিল, পরমেশ্বর জানেন ও যে দড়ী বিক্রয় করে, সে জানে, আপনি দড়ী কেনা বই আজ আমায় আর কোনও কর্ম্মে পাঠান নাই।

 এই সমস্ত কথোপকথন শ্রবণ করিয়া, বিদ্যাধর চন্দ্রপ্রভাকে কহিল, দেখুন, প্রভু ও ভৃত্য উভয়েই ভূতাবিষ্ট হইয়াছেন, আমি উভয়ের চেহারা দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি। বন্ধন করিয়া অন্ধকারগৃহে রুদ্ধ করিয়া না রাখিলে, প্রতিকার হইবেক না। চন্দ্রপ্রভা সম্মতি প্রদান করিলেন। শুনিয়া কোপে কম্পমান হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে মায়াবিনি! অরে দুশ্চারিণি! তুই এত দিন আমায় এমন মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলি, যে তোরে নিতান্ত পতিপ্রাণা কামিনী স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম; এখন দেখিতেছি, তুই ভয়ঙ্কর কালভুজঙ্গী; অসৎ অভিপ্রায় সাধনের নিমিত্ত, এই সকল দুরাচারদিগের সহিত মন্ত্রণা করিয়া, আমার প্রাণবধের চেষ্টা দেখিতেছিস, এবং উন্মাদ প্রচার করিয়া, বন্ধন পূর্ব্বক অন্ধকারময় গৃহে রাখিবি, এই মনস্থ করিয়া আসিয়াছিস। আমি তোর দুরভিসন্ধির সমুচিত প্রতিফল দিতেছি। এই বলিয়া তিনি, কোপজ্বলিত লোচনে, উদ্ধত গমনে চন্দ্রপ্রভার দিকে ধাবমান হইলেন। চন্দ্রাওপ্রভা নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া সন্নিহিত লোকদিগকে কহিলেন, তোমরা দাড়াইয়া তামাসা দেখিতেছ, তোমাদের কি আচরণ, বুঝিতে পারিতেছি না; শীঘ্র উহারে বন্ধন কর, আমার নিকটে আসিতে দিও না। তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, যেরূপ দেখিতেছি, তুই নিতান্তই আমার প্রাণবধের সঙ্কল্প করিয়া আসিয়াছিস।

 অনন্তর, চন্দ্রপ্রভার আদেশ অনুসারে, সমভিব্যাহারী লোকেরা বন্ধন করিতে উদ্যত হইলে, চিরঞ্জীব নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, রাজপুরুষকে কহিলেন, দেখ, আমি এক্ষণে তোমার অবরোধে আছি; এ অবস্থায় আমায় কিরূপে ছাড়িয়া দিবে; ছাড়িয়া দিলে তুমি সম্পূর্ণ অপরাধী হইবে। তখন রাজপুরুষ চন্দ্রপ্রভাকে কহিলেন, আপনি উঁহারে আমার নিকট হইতে লইয়া যাইতে পারিবেন না, উনি অবরোধে আছেন। এই কথা শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, অহে রাজপুরুষ! তুমি সমস্তই স্বচক্ষে দেখিতেছ ও স্বকর্ণে শুনিতেছ, তথাপি কোন বিবেচনায় উঁহারে ছাড়িয়া দিতে চাহিতেছ না। উঁহার এই অবস্থা দেখিয়া, বোধ করি, তোমার আমোদ হইতেছে। রাজপুরুষ কহিলেন, আপনি অন্যায় অনুযোগ করিতেছেন; উঁহাকে ছাড়িয়া দিলে, আমি পাঁচ শত টাকার দায়ে পড়িব। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, তুমি আমায় উঁহারে লইয়া যাইতে দাও; আমি ধর্ম্মপ্রমাণ অঙ্গীকার করিতেছি, উঁহার ঋণ পরিশোধ না করিয়া, তোমার নিকট হইতে যাইব না। তুমি আমায় উঁহার উত্তমর্ণের নিকটে লইয়া চল। .কি জন্যে ঋণ হইল, তাহার মুখে শুনিয়া, টাকা দিব। তদনন্তর, তিনি বিদ্যাধরকে কহিলেন, তুমি উহারে সাবধানে বাটীতে লইয়া যাও, আমি এই রাজপুরুষের সঙ্গে চলিলাম। বিলাসিনি! তুমি আমার সঙ্গে এস। বিদ্যাধর! তোমরা বিলম্ব করিও না, চলিয়া যাও; সাবধান, যেন কোনও রূপে বন্ধন খুলিয়া পলাইতে না পারেন। অনন্তর, বিদ্যাধর দৃঢ়বদ্ধ চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে লইয়া প্রস্থান করিল।

 বিদ্যাধর প্রভৃতি দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, চড়া রাজপুরুষকে জিজ্ঞাসা করিলেন, উনি কোন ব্যক্তির অভিযোগে অবরুদ্ধ হইয়াছেন, বল। তিনি কহিলেন, বসুপ্রিয় স্বর্ণকারের; আপনি কি তাহাকে জানেন। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, হাঁ, আমি তাহাকে জানি; তিনি কি জন্যে কত টাকা পাইবেন, জান। রাজপুরুষ কহিলেন, স্বর্ণকার এক ছড়া হার গড়িয়া দিয়াছেন, তাহার মূল্য পান নাই। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, আমার জন্যে হার গড়িতে দিয়াছেন, শুনিয়াছিলাম; কিন্তু এ পর্য্য়ন্ত হার দেখি নাই। অপরাজিতা কহিলেন, আজ আমার বাটীতে আহার করিতে গিয়া, উনি আমার অঙ্গুলি হইতে অঙ্গুরীয় লইয়া পলায়ন করিলে পর, কিঞ্চিৎ কাল বিলম্বে পথে আমার সঙ্গে দেখা হইয়াছিল; তখন উহার গলায় এক ছড়া নূতনগড়া হার দেখিয়াছি। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, যাহা বলিতেছ, অসম্ভব নয়, কিন্তু আমি কখনও সে হার দেখি নাই। যাহা হউক, অহে রাজপুরুষ! সত্বর আমায় স্বর্ণকারের নিকটে লইয়া চল; তাহার নিকট সবিশেষ না শুনিলে, প্রকৃত কথা জানিতে পারিতেছি না।

 হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব, ভর্ৎসনা ও ভয় প্রদর্শন দ্বারা অপরাজিতাকে দূর করিয়া দিয়া, কিঙ্কর সমভিব্যাহারে যে রাজপথে গমন করিতেছিলেন, চন্দ্রপ্রভা প্রভৃতিও সেই পথ দিয়া যাইতেছিলেন। বিলাসিনী, দূর হইতে দেখিতে পাইয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, চন্দ্রপ্রভাকে কহিলেন, দিদি! কি সর্বনাশ! কি সর্বনাশ! ঐ দেখ, তিনি ও কিঙ্কর উভয়েই বন্ধন খুলিয়া পলাইয়া আসিয়াছেন। এখন কি উপায় হয়। চন্দ্রপ্রভা দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইয়া, রাজপথবাহী লোকদিগকে ও সমভিব্যাহারী রাজপুরুষকে কহিতে লাগিলেন, যেরূপে পার, তোমরা উঁহারে বন্ধন করিয়া আমার নিকটে দাও। এই উপলক্ষে বিলক্ষণ গোলযোগ উপস্থিত হইল। চিরঞ্জীব দেখিলেন, যে মায়াবিনী মধ্যাহ্নকালে ধরিয়া বাটীতে লইয়া গিয়াছিল, সে এক্ষণে এক রাজপুরুষ সঙ্গে করিয়া আসিতেছে। ইহাতেই তিনি ও তাঁহার সহচর কিঙ্কর বিলক্ষণ ভয় পাইয়াছিলেন; পরে, তাঁহারা, বন্ধন করিয়া লইয়া যাইবার পরামর্শ করিতেছেন জানিতে পারিয়া, তরবারি নিষ্কাশন পূর্ব্বক, প্রহার অভিপ্রায়ে তাহাদের দিকে ধাবমান হইলেন। তদ্দর্শনে সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা ও তাহার ভগিনীকে সম্ভাষণ করিয়া, রাজপুরুষ কহিলেন, একে উঁহাদের উন্মাদ অবস্থা, তাহাতে আবার হস্তে তরবারি; এ সময়ে বন্ধনের চেষ্টা পাইলে, অনেকের প্রাণহানি সম্ভাবনা। আমি এ পরামর্শে নাই, তোমাদের যেরূপ অভিরুচি হয় কর; আমি চলিলাম, আর এখানে থাকিব না; আমার বোধে, তোমাদেরও পলায়ন করা ভাল। এই বলিয়া রাজপুরুষ চলিয়া গেলে, চন্দ্রপ্রভা ও বিলাসিনী অধিক লোক সংগ্রহের নিমিত্ত, প্রয়াণ করিলেন।

 সকলকে আকুল ভাবে পলায়ন করিতে দেখিয়া, চিরঞ্জীব স্বীয় সহচরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, কিঙ্কর! এখানকার ডাকিনীরা তরবারি দেখিলে ভয় পায়। ভাগ্যে আমাদের সঙ্গে তরবারি ছিল; নতুবা পুনরায় আমাদিগকে ধরিয়া লইয়া যাইত, এবং অবশেষে কি করিত, বলিতে পারি না। কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! যিনি মধ্যাহ্নকালে আপনার স্ত্রী হইবার নিমিত্ত ব্যস্ত হইয়াছিলেন, দেখিলাম, তিনিই সর্ব্বাপেক্ষায় অধিক ভয় পাইয়াছেন, এবং সর্ব্বাগ্রে পলায়ন করিয়াছেন। তরবারি ডাইন ছাড়াইবার এমন মন্ত্র, তাহা আমি এত দিন জানিতাম না। চিরঞ্জীব কহিলেন, দেখ, কিঙ্কর! যত শীঘ্র জাহাজে উঠিতে পারি, ততই মঙ্গল; এখানকার যেরূপ কাণ্ড, তাহাতে কখন কি উপস্থিত হয়, বলা যায় না। অতএব চল, পান্থনিবাসে গিয়া, দ্রব্যসামগ্রী লইয়া, সন্ধ্যার মধ্যেই জাহাজে উঠিব। কিঙ্কর কহিল, আপনি এত ব্যস্ত হইতেছেন কেন; আজকার রাত্রি এখানে থাকুন। উহারা কখনই আমাদের অনিষ্ট করিবেক না। আমরা প্রথমে উহাদিগকে যত ভয়ঙ্কর ভাবিয়াছিলাম, উহারা সেরূপ নহে। দেখুন, কেমন মিষ্ট কথা কয়; বাটীতে লইয়া গিয়া, কেমন উত্তম আহার দেয়; কখনও দেখা শুনা নাই, তথাপি পতিসম্ভাষণ করিয়া প্রণয় করিতে চায়; আবার, প্রয়োজন জানাইলে, অকাতরে স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে। ইহাতেও বদি আমরা উহাদিগকে অভদ্র বলি, লোকে আমাদিগকে কৃতঘ্ন বলিবে। আমি ত আপনকার সঙ্গে অনেক দেশ বেড়াইয়াছি, কোথাও এরূপ সৌজন্য ও এরূপ বদান্যতা দেখি নাই। বলিতে কি, মহাশয়! আমি, উহাদের ব্যবহার দেখিয়া, এত মোহিত হইয়াছি যে, যদি পাকশালার হস্তিনী আমার স্ত্রী হইতে না চাহিত, তাহা হইলে আমি, নিঃসন্দেহ, আহ্লাদিত চিত্তে এই রাজ্যে বাস করিতাম। চিরঞ্জীব শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, অরে নির্ব্বোধ! অধিক আর কি বলিব, যদি এই বাজ্যের অধিরাজপদ পাই, তথাপি আমি কোনও ক্রমে এখানে রাত্রিবাস করিব না। চল, আর বিলম্বে কাজ নাই; সন্ধ্যার মধ্যেই অর্ণবপোতে আরোহণ করিতে হইবেক। এই বলিয়া,উভয়ে পান্থনিবাস অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *