ভ্রান্তিবিলাস – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

জয়স্থলবাসী কিঙ্কর, চন্দ্রপ্রভার আদেশ অনুসারে, দ্বিতীয় বার স্বীয় প্রভুর অন্বেষণে নির্গত হইয়া, বসুপ্রিয় স্বর্ণকারের বিপণিতে তাঁহার দর্শন পাইল; এবং কহিল, মহাশয়! এখনও কি আপনকার ক্ষুধা বোধ হয় নাই। সত্বর বাটীতে চলুন; কর্ত্রী ঠাকুরাণী আপনকার জন্য অস্থির হইয়াছেন। আপনি, ইতিপূর্বে সাক্ষাৎকালে, যে সকল কথা বলিয়াছিলেন, এবং অকারণে আমায় যে প্রহার করিয়াছিলেন, আমি সে সমস্ত তাঁহার নিকটে বলিয়াছি। শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, আজ কখন তোমর সঙ্গে দেখা হইল, কখন বা তোমায় কি কথা বলিলাম, এবং কখনই বা তোমায় প্রহার করিলাম। সে যাহা হউক, গৃহিণীর নিকট কি কথা বলিয়াছ, বল। সে কহিল, কেন আপনি বলিয়াছিলেন, আমি কোথায় যাইব, আমার বাটী নাই, আমি বিবাহ করি নাই, আমার স্ত্রী নাই। এই সকল কথা আমি তাঁহার নিকটে বলিয়াছি। তৎপরে, তিনি পুনরায় আমায় আপনার নিকটে পাঠাইলেন; বলিয়া দিলেন, যেরূপে পার, তাঁহাকে সত্বর বাটীতে লইয়া আইস।

 শুনিয়া, সাতিশয় কুপিত হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, অরে পাপিষ্ঠ! তুমি কোথায় এমন মাতলামি শিখিয়াছ; কতকগুলি কল্পিত কথা শুনাইয়া অকারণে তাঁহার মনে কষ্ট দিয়াছ। তোমার এরূপ করিবার তাৎপর্য্য কি, বুঝিতে পারিতেছি না। আমার সঙ্গে দেখা নাই, অথচ আমার নাম করিয়া তুমি তাঁহার নিকট এই সকল কথা বলিয়াছ। কিঙ্কর কহিল, আমি তাহাকে একটিও অলীক কথা শুনাই নাই; আপণে সাক্ষাৎকালে যাহা বলিয়াছেন, ও যাহা করিয়াছেন, আমি তাহার অতিরিক্ত কিছুই বলি নাই। আপনি যখন যাহাতে সুবিধা দেখেন, তাহাই বলেন, তাহাই করেন। আপনি আমায় যে প্রহার করিয়াছেন, কর্ণমূলে তাহার চিহ্ন রহিয়াছে। এখন কি প্রহার পর্য্যন্ত অপলাপ করিতে চাহেন। চিরঞ্জীব ক্রোধে অধীর হইয়া কহিলেন, তোমায় আর কি বলিব, তুমি গর্দ্দভ। কিঙ্কর কহিল, তাহার সন্দেহ কি, গর্দ্দভ না হইলে, এত প্রহার সহ্য করিতে পারিব কেন। গর্দ্দভ, প্রহৃত হইলে, নিরুপায় হইয়া, পদপ্রহার করে; অতঃপর আমিও সেই পথ অবলম্বন করিব; তাহা হইলে, আপনি সতর্ক হইবেন, আর কথায় কথায় আমায় প্রহার করিতে চাহিবেন না।

 চিরঞ্জীব, যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হইয়া, তাহার কথার আর উত্তর না দিয়া, বসুপ্রিয় স্বর্ণকারকে বলিলেন, দেখ, আমার গৃহ প্রতিগমনে বিলম্ব হইলে, গৃহিণী অত্যন্ত আক্ষেপ ও বিরক্তি প্রকাশ করেন, এবং নানা সন্দেহ করিয়া, আমার সহিত বিবাদ ও বাদানুবাদ করিয়া থাকেন। অতএব, তুমি সঙ্গে চল; তাঁহার নিকটে বলিবে তাহার জন্যে যে হার গড়িতেছ, তাহ এই সময়ে প্রস্তুত হইবার কথা ছিল; প্রস্তত হইলেই লইয়া যাইব, এই আশায় আমি তোমার বিপণিতে বসিয়াছিলাম; কিন্তু এ বেলা প্রস্তুত হইয়া উঠিল না; সায়ংকালে নিঃসন্দেহ প্রস্তুত হইবেক এবং কল্য প্রাতে তুমি তাঁহার নিকটে লইয়া যাইবে। তাঁহাকে এই কথা বলিয়া, সন্নিহিত রত্নদত্ত শ্রেষ্ঠীকে কহিলেন, আপনিও চলুন, আজ সকলে এক সঙ্গে আহার করিব; অনেক দিন আপনি আমার বাটীতে আহার করেন নাই। রত্নদত্ত ও বসুপ্রিয় সম্মত হইলেন; চিরঞ্জীব, উভয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া, স্বীয় ভবনের অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 কিয়ৎ ক্ষণ পরে, বাটীর সন্নিকৃষ্ট হইয়া, চিরঞ্জীব দেখিলেন, দ্বার রুদ্ধ রহিয়াছে; তখন কিঙ্করকে কহিলেন, তুমি অগ্রসর হইয়া, আমাদের পঁহুছিবার পূর্ব্বে, দ্বার খুলাইয়া রাখ। কিঙ্কর, সত্বর গমনে দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া, অপরাপর ভূত্যদিগের নাম গ্রহণ পূর্ব্বক দ্বার খুলিয়া দিতে বলিল। চন্দ্রপ্রভার আদেশ অনুসারে হেমকূটবালী কিঙ্কর ঐ সময়ে দ্বারবানের কার্য্য সম্পাদন করিতেছিল, সে কহিল, তুমি কে, কি জন্যে দ্বার খুলিতে বলিতেছ; গৃহস্বামিনী যেরূপ অনুমতি দিয়াছেন, তাহাতে আমি কদাচ দ্বার খুলিব না এবং কাহাকেও বাটীতে প্রবেশ করিতে দিব না। অতএব তুমি এখান হইতে চলিয়া যাও, আর ইচ্ছা হয়, রাস্তায় বসিয়া রোদন কর। এইরূপ উদ্ধত ও অবজ্ঞাপূর্ণ বাক্য শুনিয়া, জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, তুই কে, কোথাকার লোক, তোর কেমন আচরণ; প্রভু পথে দাঁড়াইয়। রহিলেন, তুই দ্বার খুলিয়া দিবি না। হেমকূটবাসী কিঙ্কর কহিল, তোমার প্রভুকে বল, তিনি যেখান হইতে আসিয়াছেন, সেই খানে ফিরিয়া যান। আমি কোনও ক্রমে তাঁহাকে এ বাটীতে প্রবেশ করিতে দিব না।

 কিঙ্করের কথায় দ্বার খুলিল না দেখিয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, কে ও, বাটীর ভিতরে কথা কও হে, শীঘ্র দ্বার খুলিয়া দাও। পরিহাসপ্রিয় হেমকূটবাসী কিঙ্কর কহিল, আমি কখন দ্বার খুলিয়া দিব, তাহা আমি আপনাকে পরে বলিব; আপনি কি জন্যে দ্বার খুলিতে বলিতেছেন, তাহা আমায় আগে বলুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আহারের জন্যে; আজ এ পর্য্যন্ত আমার আহার হয় নাই। কিঙ্কর কহিল, এখন এখানে আপনকার আহারের কোনও সুবিধা নাই; ইচ্ছা হয়, পরে কোনও সময়ে আসিবেন। তখন চিরঞ্জীব কোপান্বিত হইয়া কহিলেন, তুমি কে হে, যে আমায় আমার বাটীতে প্রবেশ করিতে দিতেছ না। কিঙ্কর কহিল, আমি এই সময়ের জন্য দ্বাররক্ষার ভার পাইয়াছি, আমার নাম কিঙ্কর। এই কথা শুনিয়া, জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, অরে দুরাত্মন! তুই আমার নাম ও পদ উভয়ই, অপহরণ করিয়াছিস্; যদি ভাল চাহিস্, শীঘ্র দ্বার খুলিয়া দে, প্রভু কত ক্ষণ পথে দাঁড়াইয়া থাকিবেন। হেমকূটবাসী কিঙ্কর তথাপি দ্বার খুলিয়া দিল না। তখন জয়স্থলবাসী কিঙ্কর স্বীয় প্রভুকে কহিল, মহাশয়। আজ ভাল লক্ষণ দেখিতেছি না; সহজে দ্বার খুলিয়া দেয়, এরূপ বোধ হয় না। ধাক্কা মারিয়া দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলুন, আর কত ক্ষণ এমন করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিবেন; বিশেষতঃ, আপনকার নিমন্ত্রিত এই দুই মহাশয়ের অতিশয় কষ্ট হইতেছে।

 এই সময়ে চন্দ্রপ্রভা অভ্যন্তর হইতে কহিলেন, কিঙ্কর। ওরা সব কে, কি জন্যে দরজায় জমা হইয়া গোলযোগ করিতেছে। হেমকূটবাসী কিঙ্কর কহিল, ঠাকুরাণি! গোলযোগের কথা কেন জিজ্ঞাসা করেন, আপনাদের এই নগরটি উচ্ছৃঙ্খল লোকে পরিপূর্ণ; এখানে গোলযোগের অপ্রতুল কি। চন্দ্রপ্রভার স্বর শুনিতে পাইয়া, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, বলি, গিন্নি। আজকার এ কি কাণ্ড। এই কথা শুনিবামাত্র, চন্দ্রপ্রভা কোপে জ্বলিত হইয়া কহিলেন, তুই কোথাকার হতভাগা, দূর হয়ে যা, দরজার কাছে গোল করিস না। লক্ষ্মীছাড়ার আস্পর্দ্ধা দেখ না, রাস্তায় দাঁড়াইয়া আমায় গিন্নি বলিয়া সম্ভাষণ করিতেছে। জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! বড় লজ্জার কথা, এঁরা দুজন দাঁড়াইয়া রহিলেন, আমরা দরজা খুলাইতে পারিলাম না। যাহাতে শীঘ্র খুলিয়া দেয়, তাহার কোনও উপায় করুন। তখন চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্কর! আমি দেখিয়া শুনিয়া এক বারে হতবুদ্ধি হইয়াছি, আজকার কাণ্ড কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। তখন কিঙ্কর কহিল, তবে আর বিলম্বে কাজ নাই, দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, অতঃপর সেই পরামর্শই ভাল, দরজা ভাঙ্গা বই আর উপায় দেখিতেছি না। যেখানে পাও, সত্বর দুই তিন খান কুঠার লইয়া আইস। কিঙ্কর যে আজ্ঞা বলিয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল।  এই সময়ে রত্নদত্ত কহিলেন, মহাশয়! ধৈর্য্য অবলম্বন করুন। কোনও ক্রমে দরজা ভাঙ্গা হইবেক না। যাহা দেখিলাম, যাহা শুনিলাম, তাহাতে ক্রোধ সংবরণ করা সহজ নয়। রক্ত মাংসের শরীরে এত সহ্য হয় না। কিন্তু, সংসারী ব্যক্তিকে অনেক বিবেচনা করিয়া কাজ করিতে হয়। এখন আপনি ক্রোধাভরে এক কর্ম্ম করিবেন, কিন্তু ক্রোধশান্তি হইলে, যার পর नाই অনুতাপগ্রস্ত হইবেন। অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া কোনও কর্ম্ম করা পরামর্শসিদ্ধ নয়। যদি, এই দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, আপনি দ্বারভঙ্গে প্রবৃত্ত হন, রাজপথবাহী সমস্ত লোক, সমবেত হইয়া, কত কুতর্ক উপস্থিত করিবেক। আপনকার কলঙ্ক রাখিবার স্থান থাকিবেক না। মানবজাতি নিরতিশয় কুৎসাপ্রিয়; লোকের কুৎসা করিবার নিমিত্ত, কত অমূলক গল্প কল্পনা করে, এবং কপিত গল্পের আকর্ষণী শক্তি সম্পাদনের নিমিত্ত, উহাতে কত অলঙ্কার যোজনা করিয়া দেয়। যদি কোনও ব্যক্তির প্রশংসা করিবার সহস্ৰ হেতু থাকে, অধিকাংশ লোকে ভুলিয়াও সে দিকে দৃষ্টিপাত করে না; কিন্তু কুৎসা করিবার অণুমাত্র সোপান পাইলে, মনের আমোদে সেই দিকে ধাবমান হয়। আপনি নিতান্ত অমায়িক; মনে ভাবেন, কখনও কাহারও অপকার করেন নাই, সাধ্য অনুসারে সকলের হিতচেষ্টা করিয়া থাকেন; সুতরাং কেহ আপনকার বিপক্ষ ও বিদ্বেষী নাই; সকলেই আপনকার আত্মীয় ও হিতৈষী। কিন্তু আপনকার সে সংস্কার সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমূলক। আপনি প্রাণপণে যাঁহাদের উপকার করিয়াছেন, এবং যে সকল ব্যক্তিকে আত্মীয়া বলিয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশই আপনকার বিষম বিদ্বেষী। ঐ সকল ব্যক্তি আপনকার যার পর নাই কুৎসা করিয়া বেড়ান। কতকগুলি নিরপেক্ষ লোক আপনকার যথার্থ গুণগ্রাহী আছেন; তাঁহারা, আপনকার দয়া, সৌজন্য প্রভৃতি সদ্‌গুণপরম্পরা দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা করিয়া থাকেন। আপনি অতি সামান্য ব্যক্তি ছিলেন, এক্ষণে জয়স্থলে বিলক্ষণ মাননীয় ও প্রশংসনীয় হইয়াছেন। এজন্য, যে সকল লোক সচরাচর ভদ্র বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিরই অন্তঃকরণ ঈর্ষ্যারসে সাতিশয় কলুষিত হইয়া আছে। তাঁহারা আপনকার অনুষ্ঠিত কর্ম্মমাত্রেরই এক এক অভিসন্ধি বহিষ্কৃত করেন; আপনি কোনও কর্ম্ম ধর্ম্মবুদ্ধিতে করিয়া থাকেন, তাহা কোনও মতে প্রতিপন্ন হইতে দেন না। আমি অনেক বার অনেক স্থলে দেখিয়াছি, আপনকার অনুষ্ঠিত কর্ম্ম সমুদয়ের উল্লেখ করিয়া কেহ প্রশংসা করিলে, তাঁহাদের নিতান্ত অসহ্য হয়; তাহারা তৎক্ষণাৎ তত্তৎ কর্ম্মকে অসদভিসন্ধিপ্রয়োজিত বা স্বার্থানুসন্ধানমূলক বলিইয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা পান; অবশেষে, যাহা কখনও সম্ভব নয় এরূপ গল্প তুলিয়া, আপনকার নির্ম্মল চরিতে কুৎসিত কলঙ্ক যোজনা করিয়া থাকেন। এমন স্থলে, কুৎসা করিবার এরূপ সোপান পাইলে, ঐ সকল মহাত্মাদের আমোদের সীমা থাকিবেক না; তাঁহারা আপনারে একবারে নরকে নিক্ষিপ্ত করিবেন। আর, আমরা আপনকার গৃহিণীকে বিলক্ষণ জানি। তিনি নির্ব্বোধ নহেন। তিনি যে, এ সময়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আপনাকে বাটীতে প্রবেশ করিতে দিতেছেন না, অবশ্যই ইহার বিশিষ্ট হেতু আছে; আপনি এখন তাহা জানেন না; পরে সাক্ষাৎ হইলে, তিনি অবশ্যই আপনাকে বুঝাইয়া দিবেন। অতএব, আমার কথা শুনুন, আর এখানে দাঁড়াইয়া গোল করিবার প্রয়োজন নাই; চলুন, এ বেলা আমরা স্থানান্তরে গিয়া আহার করি। অপরাহ্লে একাকী আসিয়া, এই বিসদৃশ ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করিবেন।

 রত্নদত্তের কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর কহিলেন, আপনি সৎপরামশের কথাই বলিয়াছেন, ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া, এখান হইতে চলিয়া যাওয়াই সর্ব্বাংশে শ্রেয়ঃকল্প বোধ হইতেছে। যাহা বলিলেন, আমার স্ত্রী কোনও ক্রমে নির্ব্বোধ নহেন। কিন্তু তাহার একটি বিষম দোষ আছে। আমার বাটীতে আসিতে বিলম্ব হইলে, তিনি নিতান্ত অস্থির ও উন্মত্তপ্রায় হন, এবং মনে নানা কুতর্ক উপস্থিত করিয়া, অকারণে আমার সঙ্গে কলহ করেন। আজ বিশেষতঃ কিঙ্কর তাঁহাকে অতিশয় রাগাইয়া দিয়াছে; তাহাতেই এই অনর্থ উপস্থিত হইয়াছে, বুঝিতে পারিতেছি। অনন্তর, বসুপ্রিয়কে কহিলেন, বোধ করি, এত ক্ষণে হার প্রস্তুত হইয়াছে; তুমি অবিলম্বে বাটী প্রতিগমন কর; আমি অপরাজিতার আবাসে থাকিব, হার লইয়া তথায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে; দেখিও, যেন কোনও মতে বিলম্ব না হয়। ঐ হার আমি তাঁহাকে দিব; তাহা হইলেই, গৃহিণী বিলক্ষণ শিক্ষা পাইবেন, এবং আর কখনও আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিবেন না। বসুপ্রিয় কহিলেন, যত সত্বর পারি, হার লইয়া সাক্ষাৎ করিতেছি। এই বলিয়া, তিনি দ্রুত পদে প্রস্থান করিলে, চিরঞ্জীব ও রত্নদত্ত অভিপ্রেত স্থানে গমন করিলেন।

 এ দিকে, আহারের সময়, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব প্রায়ই মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন, চন্দ্রপ্রভা বা বিলাসিনীর কোনও কথার উত্তর দিলেন না; এবং, কোথায় আসিয়াছি, কি করিতেছি, অবশেষেই বা কি বিপদে পড়িব,, এই দুর্ভাবনায় অভিভূত হইয়া, ভাল রূপে আহারও করিতে পারিলেন মা। তাহার এই ভাব দেখিয়া, চন্দ্রপ্রভা স্থির করিলেন, তিনি তাঁহার প্রতি একবারেই নির্ম্মম ও অনুরাগশূন্য হইয়াছেন। তদনুসারে, তিনি শিরে করাঘাত ও রোদন করিতে করিতে, গৃহান্তরে প্রবেশ পূর্বক, ভূতলশায়িনী হইলেন। চিরঞ্জাব ব্যতিরিক্ত আর কেহ সেখানে নাই দেখিয়া, বিলাসিনী তাঁহাকে বুঝাইতে আরম্ভ করিলেন। তিনি কহিলেন, দেখ, ভাই! তুমি তাঁহার স্বামী নও, তিনি তোমার স্ত্রী নন, বারংবার যে এই সকল কথা বলিতেছ, ইহার কারণ কি! তুমি এত বিরক্ত হইতে পার, আমি ত দিদির তেমন কোনও অপরাধ দেখিতেছি না। এই তোমাদের প্রণয়ের সময়, যাহাতে উত্তরোত্তর প্রণয়ের বৃদ্ধি হয়, উভয়েরই প্রাণপণে সেই চেষ্টা করা উচিত। প্রণয়বৰ্দ্ধনের কথা দূরে থাকুক, তুমি একবারে পরিণয়পর্য্যন্ত অপলাপ করিতেছ। যদি কেবল ঐশ্বর্য্যের অনুরোধে দিদির পাণিগ্রহণ করিয়া থাক, তাহা হইলে, সেই ঐশ্বর্য্যের অনুরোধেই দিদির প্রতি দয়া ও সৌজন্য প্রদর্শন করা উচিত। আজ তোমার যেরূপ ভাব দেখিতেছি, তাহাতে দিদির প্রতি তোমার যে কিছুমাত্র দয়া বা মমতা আছে, এরূপ বোধ হয় না। তুমি আমার স্ত্রী নও, আমি তোমার পতি নই, আমি তোমার পাণিগ্রহণ করি নাই; বাটীর সকল লোকের সমক্ষে, দিদির মুখের উপর, এ সকল কথা বলা অত্যন্ত অন্যায়। স্বামীর মুখে এরূপ কথা শুনা অপেক্ষা স্ত্রীলোকের পক্ষে অধিকতর ক্লেশকর আর কিছুই নাই। বলিতে কি, আজ তুমি দিদির সঙ্গে নিতান্ত ইতরের ব্যবহার করিতেছ। যদি মনেও অনুরাগ না থাকে, মৌখিক প্রণয় ও সৌজন্য দেখাইবার হানি কি; তাহা হইলেও দিদির মন অনেক তুষ্ট থাকে। যা হউক, ভাই। আজ তুমি বড় ঢলাঢলি করিলে। স্ত্রীপুরুষে এরূপ ঢলাঢলি করা কেবল লোক হাসান মাত্র। তোমার আজকার আচরণ দেখিলে, তুমি যেন সে লোক নও, বোধ হয়। কি কারণে আজ এত বিরস বদনে রহিয়াছ, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। মুখ দেখিলে বোধ হয়, তোমার অন্তঃকরণ দুর্ভাবনায় অভিভূত হইয়া আছে। এখন আমার কথা শুন, ঘরের ভিতরে গিয়া দিদিকে সান্ত্বনা কর। বলিবে, ইতিপূর্ব্বে যাহা কিছু বলিয়াছি, সে সব পরিহাস মাত্র, তোমার মনের ভাব পরীক্ষা ভিন্ন তাহার আর কোনও অভিসন্ধি নাই। যদি দুটা মিষ্ট কথা বলিলে তাঁহার অভিমান দূর হয় ও খেদ নিবারণ হয়, তাহাতে তোমার আপত্তি কি।

 বিলাসিনীর বচনবিন্যাস শ্রবণ করিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, অয়ি চারুশীলে! আমি দেখিয়া শুনিয়া এককালে হতজ্ঞান হইয়াছি; আমার বুদ্ধিকস্ফূর্তি বা বাঙনিষ্পত্তি হইতেছে না। তোমার কথার কি উত্তর দিব, ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছি না। তুমি, যে পথে প্রবৃত্ত করিবার নিমিত্ত, এত ক্ষণ আমায় উপদেশ দিলে, আমি সে পথের পথিক নই; প্রাণান্তেও তাহাতে প্রবৃত্ত হইতে পারিব না। তোমরা দেবী কি মানবী, আমি এ পর্য্যন্ত তাহ স্থির করিতে পারি নাই। যদি দেবযোনিসম্ভবা হও, আমায় স্বতন্ত্র বুদ্ধি ও স্বতন্ত্র প্রবৃত্তি দাও; তাহা হইলে, তোমাদের অভিপ্রায়ের অনুবর্ত্তী হইয়া চলিতে পারি; নতুবা, এখন আমার যেরূপ বুদ্ধি ও যেরূপ প্রবৃত্তি আছে, তদনুসারে আমি কোনও ক্রমে পরকীয় মহিলার সংস্রবে যাইতে পারিব না। স্পষ্ট কথায় বলিতেছি, তোমার ভগিনী আমার পত্নী নহেন, আমি কখনও উঁহার পাণিগ্রহণ করি নাই। তিনি অধীর হইয়া অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন, সত্য বটে; কিন্তু তাঁহার খেদাপনয়নের নিমিত্তে তুমি এত ক্ষণ আমায় যে উপদেশ দিলে, আমি প্রাণান্তেও তদনুযায়ী কার্য্য করিতে পারিব না। আমি বিনয় করিয়া বলিতেছি, তুমি আর আমায় ওরূপ উপদেশ দিও না। যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে তিনি বিবা হিত কামিনী। জানিয়া শুনিয়া কি রূপে অপকর্ম্মে প্রবৃত্ত হই বল। আমি অবিবাহিত পুরুষ। তুমিও অদ্যাপি অবিবাহিতা আছ, বোধ হইতেছে। যদি তোমার অভিপ্রায় থাকে, ব্যক্ত কর। আমি তোমায় সহধর্ম্মিণীভাবে পরিগ্রহ করিতে প্রস্তুত আছি। প্রতিজ্ঞা করিতেছি, পরস্পর যথাবিধি পরিণয়শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইলে, প্রাণপণে তোমার সন্তোষ সম্পাদনে যত্ন করিব, এবং যাবজ্জীবন তোমার মতের অনুব্ররত্তী হইয়া চলিব। প্রেয়সি! বলিতে কি, তোমার রূপ লাবণ্য দর্শনে ও বচনমাধুরী শ্রবণে আমার মন এত মোহিত হইয়াছে, যে তোমার সম্মতি হইলে আমি এই দণ্ডে তোমায় বিবাহ করি। বিলাসিনী শুনিয়া, চকিত হইয়া, কছিলেন, আমি তোমার প্রেয়সী নই, দিদি তোমার প্রেয়সী, তাঁহারেই এই প্রিয়সম্ভাষণ করা উচিত। চিরঞ্জীব কহিলেন, যাহার প্রতি মনের অনুরাগ জন্মে, সেই প্রেয়সী; তোমার প্রতি আমার মন অনুরক্ত হইয়াছে, অতএব তুমিই আমার প্রেয়সী; তোমার দিদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি; তিনি আমার প্রেয়সী নহেন। এই কথা শুনিয়া বিলাসিনী কহিলেন, বলিতে কি, ভাই! তুমি যথার্থই পাগল হয়েছ; নতুবা এমন কথা কেমন করিয়া মুখে আনিলে। ছি ছি! কি লজ্জার কথা, আর যেন কেহ ও কথা শুনে না। দিদি শুনিলে আত্মঘাতিনী হইবেন। আমি দিদিকে ডাকিয়া দিতেছি; অতঃপর তিনি আপনার মামলা আপনি করুন। তোমার যে ভাব দেখিতেছি, আমি আর একাকিনী তোমার নিকটে থাকিব না। এই বলিয়া, বিলাসিনী সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। হেমকুটের চিরঞ্জীব, হতবুদ্ধি হইয়া, একাকী সেই স্থানে বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে, হেমকূটবাসী কিঙ্কর, উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া, চিরজীবের নিকটে উপস্থিত হইল, এবং আকুল বচনে কহিতে লাগিল, মহাশয়! আমি বড় বিপদে পড়িয়াছি; রক্ষা করুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, ব্যাপার কি বল। সে কহিল, এ বাটীর কর্ত্রী ঠাকুরাণী যেরূপ, পরিচারিণীগুলিও অবিকল সেই রূপ চরিত্রের লোক; কর্ত্রী ঠাকুরাণী যেমন আপনাকে পতি বলিয়া অধিকার করিতে চাহেন, পাকশালায় যে পরিচারিণী আছে, সে আমাকে সেইরূপ অধিকার করিতে চাহে। সে আমার নাম জানে, আমার শরীরের কোন স্থানে কি চিহ্ন আছে, সমুদয় জানে। সে কিরূপে এ সমস্ত জানিতে পারিল, ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। সে সহসা আমার নিকটে উপস্থিত হইল, এবং প্রণয়সম্ভাষণ পূর্ব্বক কহিল, এখানে একাকী বসিয়া কি করিতেছ; পাকশালায় আইস, আমোদ আহ্লাদ করিব। সে এই বলিয়া, আমার হস্তে ধরিয়া, টানাটানি করিতে লাগিল। তাহার আকার প্রকার দেখিয়া, আমার মনে এমন ভয় জন্মিল যে আমি কোনও ক্রমে তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলাম না। সে যেমন বিশ্রী, তেমনই স্থূলকায় ও দীর্ঘাকার। আমি আপনকার সঙ্গে অনেক দেশ বেড়াইয়াছি, কিন্তু কখনও এমন ভয়ানক মূর্ত্তি দেখি নাই; আমার বোধ হয়, সে রাক্ষসী, মানুষী নয়। আমি যমালয়ে যাইতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু প্রাণান্তেও পাকশালায় প্রবিষ্ট হইতে পারিব না। অধিক কি বলিব, তাহার আকার প্রকার দেখিয়া, আমার শরীরের শোণিত শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। আমি পাকশালায় যাইতে যত অসম্মত হইতে লাগিলাম, সে উত্তরোত্তর ততই উৎপীড়ন করিতে লাগিল। অবশেষে, পলাইয়া আপনকার নিকটে আসিয়াছি, যাহাতে আমি তাহার হস্ত হইতে নিস্তার পাই, তাহা করুন।

 এই সমস্ত কথা শুনিয়া চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্কর। আমি কি রূপে তোমার নিস্তার করিব, বল;আমার নিস্তার কে করে, তাহার ঠিকানা নাই। এ দেশের সকলই অদ্ভুত কাণ্ড। পাকশালার পরিচারিণী কিরূপে তোমার নাম ও শরীরগত চিহ্ন সকল জানিতে পারিল, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, সত্বর পলায়ন ব্যতিরেকে নিস্তারের পথ নাই। তুমি এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব করিও না, এখনই চলিয়া যাও এবং অনুসন্ধান – করিয়া জান, আজ কোনও জাহাজ এখান হইতে স্থানান্তরে যাইতেছে কি না। তুমি এই সংবাদ লইয়া আপণে যাইবে, আমিও ইতিমধ্যে তথায় উপস্থিত হইতেছি। অথবা বিলম্বের প্রয়োজন কি, এখন এখানে কেহ নাই; এক সঙ্গেই পলায়ন করা ভাল। এই বলিয়া চিরঞ্জীব, কিঙ্কর সমভিব্যাহারে সেই ভবন হইতে বহির্গত হইলেন, এবং তাহাকে অর্ণৰপোতের অনুসন্ধানে প্রেরণ করিয়া, দ্রুত পদে আপণ অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 বসুপ্রিয় স্বর্ণকার, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবের আদেশ অনুসারে, হার আনিতে গিয়াছিলেন। তিনি এই সময়ে হার লইয়া তাঁহার নিকটে যাইতেছিলেন; পথিমধ্যে হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে দেখিতে পাইয়া, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব বোধ করিয়া কহিলেন, এই যে চিরঞ্জীব বাবুর সহিত পথেই সাক্ষাৎ হইল। তিনি কহিলেন, হাঁ আমার নাম চিরঞ্জীব বটে। বসুপ্রিয় কহিলেন, আপনকার নাম আমি বিলক্ষণ জানি, আপনারে আর সে পরিচয় দিতে হইবেক না; এ নগরে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই আপনকার নাম জানে। আমি হার অনিয়াছি, লউন। এই বলিয়া, সেই হার তিনি চিরঞ্জীবের হস্তে সমর্পণ করিলেন। চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি আমায় এ হার দিতেছেন কেন; তামি হার লইয়া কি করিব। বসুপ্রিয় কহিলেন, সে কথা আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন; আপনকার যাহা ইচ্ছা হয়, করিবেন; হার আপনকার আদেশে তাপনকার জন্যে প্রস্তুত হইয়াছে। তিনি কহিলেন, কই, আমি ত আপনাকে হার গড়িতে বলি নাই। বসুপ্রিয় কহিলেন, সে কি মহাশয়! এক বার নয়, দুই বার নয়, অন্ততঃ বিশ বার, আপনি আমায় এই হার গড়িতে বলিয়াছেন। কিঞ্চিৎ কাল পূর্ব্বে এই হারের জন্য আমার বাটীতে অন্ততঃ দুই ঘণ্টাকাল বসিয়া ছিলেন এবং আধ ঘণ্টা পূর্ব্বে আমায় এই হার লইয়া আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বলিয়াছেন। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমি অত্যন্ত ব্যস্ত আছি, পরিহাস শুনিবার সময় নাই। আপনি হার লইয়া যান, আমি পরে সাক্ষাৎ করিব এবং হারের মূল্য লইয়া আসিব। তিনি কহিলেন, যদি নিতান্তই আমায় হার লইতে হয়, আপনি উহার মূল্য লউন; হয় ত, অতঃপর আর আপনি আমার দেখা পাইবেন না; সুতরাং এখন না লইলে, পরে আর হারের মূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। বসুপ্রিয় কহিলেন, আমার সঙ্গে এত পরিহাস কেন।

 এই বলিয়া, তিনি দ্রুত পদে প্রস্থান করিলেন। চিরঞ্জীব হার লইয়া ভাবিতে লাগিলেন, এ আবার এক অদ্ভুত কাণ্ড উপস্থিত হইল। এখানকার লোকের ভাব বুঝাই ভার। এ ব্যক্তির সহিত কস্মিন্‌ কালে আমার দেখা শুনা নাই, অথচ বহু মূল্যের হার আমার হস্তে দিয়া, চলিয়া গেল; মূল্য লইতে বলিলাম, তাহাও লইল না। এ কি ব্যাপার, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। অথবা, এখানকার সকলই অদ্ভুত ব্যাপার। যাহা হউক, এখানে আর এক মুহূর্ত্তও থাকা বিধেয় নহে। জাহাজ স্থির হইলেই প্রস্থান করিব। সত্বর আপণে যাই; বোধ করি, কিঙ্কর এত ক্ষণে সেখানে আসিয়াছে। এই বলিতে বলিতে, তিনি আপণ অভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *