ভ্রমণকাহিনি
নিতান্ত বুদ্ধিহীন কিংবা পাগল না হলে কি কেউ পুজোর সময় কলকাতার বাইরে যেতে চায়, অন্তত এই হাওড়া স্টেশন দিয়ে কারওর পক্ষে বেরোনো কী সম্ভব?
কাউকে যদি সত্যি সত্যিই কলকাতার বাইরে পুজোর সময়ে থাকতে হয়, তা হলে তাকে আষাঢ় মাসেই রওনা হতে হবে। আর তা ছাড়া অবশ্য পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু যোগেশবাবুর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। আর যোগেশবাবুর স্থিরই ছিল না যে কোথায় কবে যাবেন। ছোট শ্যালিকার বিশেষ অনুরোধে তাকে এই মহালয়ার দুঃসময়ে কলকাতা পরিত্যাগ করতে হচ্ছে।
স্ট্র্যান্ড রোডের কাছাকাছি থেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন যোগেশবাবু, পাকা সোয়া দুই ঘণ্টা লাগল স্টেশনে পৌঁছাতে, ট্যাক্সিওয়ালা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলল, অন্যদিনের তুলনায় আজ খুবই তাড়াতাড়ি হল।
মেল ট্রেন কথাটার মানে এতকাল ভাল জানতেন না যোগেশবাবু। তার ধারণা ছিল এইসব গাড়িতে ডাক যায় বলে এগুলিকে মেল ট্রেন বলে। এবার বুঝলেন মেল ট্রেন মানে এই গাড়িগুলো ফিমেল ট্রেন নয়, সত্যিকারের খাঁটি মেল যাকে বলে ইংরেজিতে, সেই জোয়ানমরদ ছাড়া আর কারওর সাধ্যি নেই যে এর কোনওটায় উঠতে পারে।
সমস্ত ট্রেনগুলো আগের থেকেই কোনও জায়গা থেকে যেন সম্পূর্ণ ভরতি হয়ে আসছে। একচল্লিশ ঘণ্টা লাইন দিয়ে সাড়ে তিন টাকার ঝালমুড়ি খেয়ে, জুতো হারিয়ে, ছাতা ভেঙে একটা টিকিট সংগ্রহ করেছেন যোগেশবাবু, সুতরাং এত সহজে নিরুদ্যম হয়ে ফিরে যাবেন তিনি ভাবতে পারেন না।
যোগেশবাবু খোঁজ করতে লাগলেন কোথায় এই ট্রেনগুলো দাঁড়ায় যেখানে এত লোক ওঠে। কিন্তু এই প্রশ্নের সদুত্তর কে দিতে পারে? কেউ বলল বর্ধমান, কেউ বলল দুর্গাপুর, একজন বলল মোগলসরাই। বর্ধমান বা দুর্গাপুর কিংবা মোগলসরাই গিয়েও উঠতে রাজি আছেন যোগেশবাবু। কিন্তু তার সমস্যা ওই সব জায়গাতেই বা এই লোকগুলো কোন ট্রেনে গেল?
উত্তর পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে। পাশে একটি কুলি দাঁড়িয়ে ছিল, সেই আধা বাঙলা আধা হিন্দি জবানিতে বলল, এরা সেখানে যাবে কেন, এরা তো সেখান থেকেই এল।
যোগেশবাবু অবাক হলেন, তা হলে এরা ট্রেন থেকে নামছে না কেন? এ ট্রেনটা তো আর হাওড়া স্টেশন পেরিয়ে কলকাতার মধ্যে ঢুকে যাবে না, এখানেই তো শেষ।
কুলিও অবাক হল, বা, এবার ফিরবে না?
ফিরবে, তাহলে এল কেন? যোগেশবাবুর এই জিজ্ঞাসায় কুলি একটু বিরক্ত বোধ করল, বোধহয় সেও কারণটা জানে না, সে সোজাসুজি অন্য প্রশ্ন করল, আপনি যাবেন কিনা বলুন?
যোগেশবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, যেতে তো চাই কিন্তু উঠব কী করে?
প্রশ্ন শুনে কুলি যা বলল তার মর্মার্থ এই যে যোগেশবাবুর সুটকেস, বেডিং, বেতের ঝুড়ি, জলের বোতল নিয়ে কুলি যেভাবেই হোক গাড়ির ভিতরে আগেভাগে উঠে যাবে। উঠে যোগেশবাবুর জন্যে একপায়ে দাঁড়াবার জায়গা করবে। তারপর যোগেশবাবু উঠে নিজের স্থান বুঝে নেবেন।
কুলি নিজের হাত থেকে পিতলের চাকতি খুলে যোগেশবাবুর হাতে দিল, এই চাকতিটা রাখুন, আমাকে না পেলে কাজে লাগবে।
কুলির প্রস্তাবে যোগেশবাবুর রাজি না হয়ে আর কীই বা উপায়? পিতলের চাকতির বিনিময়ে মালপত্র সব কুলির কাঁধে, পিঠে তুলে দিয়ে যোগেশবাবু অসহায়ের মতো প্ল্যাটফর্মে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।
দূরে হই-হই রব উঠল একটু পরেই। ছাদ-জানলা-দরজা আগাগোড়া লোকে ছাওয়া একটা গাড়ি গুটি গুটি প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে আসছে। জনতার উত্তাল সমুদ্রে যোগেশবাবুর কুলি ঝাঁপিয়ে পড়ল। যোগেশবাবু পড়ে রইলেন ভিড়ের ধাক্কায়। একটা ট্রাঙ্ক না কীসের কোনায় ব্রহ্মতালুতে একটা চোট খেয়ে ভিরমি খেয়ে সামনে পড়ে যাচ্ছিলেন, সামনের দুহাজার লোক তাকে পিছনে ঠেলে দিল। এরপরে পিছনের ধাক্কা সামনে এবং সামনের ধাক্কা পিছনে সামলিয়ে কয়েক মিনিট পরে যখন তিনি ধাতস্থ হলেন, আবিষ্কার করলেন তার নিজের পায়ে এখন আর কোনও জুতো নেই, তবে হাতে একটা মেয়েদের স্লিপার কী করে এসে গেছে এবং মাথায় একটা বিছানা।
বিছানা এবং স্লিপারটা জনসমুদ্রে ছুঁড়ে দিয়ে তার নির্দিষ্ট গাড়ির দিকে ধাবিত হলেন, অর্থাৎ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন যোগেশবাবু। বহু কষ্টে বহু জায়গায় ঘুরে এক জায়গায় এক ভদ্রমহিলার কনুই এবং আরেক ভদ্রলোকের কাঁধের মধ্যবর্তী এক স্কোয়ার ইঞ্চি পরিমাণ ফঁক দিয়ে মনে হল যেন তাঁর কুলিকে তিনি দেখতে পেয়েছেন।
কুলিও বোধহয় দেখতে পেয়েছে তাঁকে। চেঁচিয়ে, তারপরে হাতমুখের ইশারা করে সে কী বোঝাল যেন, যোগেশবাবু কিছুই বুঝতে পারলেন না। বুঝতে পারলেও উপায় ছিল না। মালপত্র নিয়ে কুলি ভিতরে রইল, কিন্তু যোগেশবাবু উঠবেন কী করে?
দরজায় যারা ঝুলছে তারা আসলে প্রত্যেকে বসে আছে দুজন কিংবা তিনজন করে লোকের পিঠে। এরা বসে রয়েছে পাদানিতে আর সেই পাদানির লোকগুলোর পা ধরে ঝুলে রয়েছে, একেক পায়ে দুজন করে চারজন লোক। এইভাবে সিঁড়ি ভাঙার অঙ্কের মতো ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে জনতার ডালপালা।
জানলায় কনুই এবং কাঁধের ফাঁকে এক স্কোয়ার ইঞ্চি জায়গা দিয়ে কুলিকে দেখেছিলেন, দরজার কোথাও সেটুকু ফঁক পেলে যোগেশবাবু ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করতে কসুর করতেন না। কিন্তু তাও তো নেই।
দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দের মতো তীক্ষ্ণ সিটি দিয়ে মেল ট্রেনে ছেড়ে দিল। একটু ছুটলেন যোগেশবাবু ট্রেনের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের সীমা পর্যন্ত, তারপর মালপত্রসুদ্ধ তাঁর কুলিকে নিয়ে তাঁর ট্রেন তাকে ফেলে ধীরেসুস্থে গড়িয়ে গেল।
অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে যোগেশবাবু এবার স্টেশনের অফিসের দিকে ছুট দিলেন একটা তদ্বির তদারক কিছু করা যায় কিনা এই আশায়।
এবার আরেকটা কুলি তার পথরোধ করে দাঁড়াল, কেয়া হুয়া?
যোগেশবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন, হামারা মালপত্র লেকে কুলি চলা গিয়া।
এই কুলির মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল, কৌন কুলি? চাকতি হ্যায়? যোগেশবাবু চাকতিটা দেখালেন। চাকতিটা দেখে এবার আর গোলমেলে হিন্দি বলল না, স্পষ্ট বাংলায় কুলি বলল, দুশো আশি নম্বর, তা হলে বিরজাবাবু এতদিনে যেতে পারলেন।
প্রথমত স্পষ্ট বাংলা, তারপর এইরকম অর্থহীন উক্তি–যোগেশবাবু রীতিমতো অবাক হলেন, কে বিরজাবাবু?
কুলি বলল, ওই যিনি চলে গেলেন, এই দুশো আশি নম্বর।
যোগেশবাবু থতমত খেলেন, কুলি মানে, বিরজাবাবু মানে?
কুলি যোগেশবাবুর প্রশ্নের পাশ এড়িয়ে বলল, আপনি তো চাকতি পেয়ে গেছেন, আপনি লেগে যান, আপনিও একদিন যেতে পারবেন।
যোগেশবাবু অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কুলি বলল, এই এইখানে দেখছেন আমরা এখানে কেউই আসলে কুলি নই। এখানে আটকে গিয়ে কুলি হয়েছি। এই আমি, আমি তো সরকারি কাজ করি, বদলি হয়ে যেতে গিয়ে এখানে আটকে গেছি। আমার মালপত্র নিয়ে নবীনবাবু চলে গেছেন।
কিন্তু বিরজাবাবু? যোগেশবাবুর তবুও বিমূঢ় ভাব একেবারে কাটেনি।
বিরজাবাবু তো এই এতদিনে যেতে পারলেন, আড়াই মাস লাগল ওঁর বেরোতে, আমার তো চার সপ্তাহ হয়ে গেল দেখি এবার যেতে পারি কিনা।কুলির মুখে আশা-নিরাশার আলোছায়া।
কিন্তু আমি? যোগেশবাবুর সংশয় তবু যায় না।
আগে হোক পরে তোক আপনিও যেতে পারবেন। বিরজাবাবুর মতোই আরেক জনের মাল নিয়ে ট্রেনে উঠবেন যেদিন পারেন, সে আর উঠতে পারবে না। কুলি ছাড়া আর কে উঠতে পারে? বলতে বলতে যোগেশবাবুর হাত থেকে পিতলের চাকতিটা নিয়ে কুলি যোগেশবাবুর বাহুতে শক্ত করে বেঁধে দিল, তারপর কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, কিছু ভাববেন না, এখন কাজে লেগে যান, এইভাবেই সবাই যায়। কেউ কি আর সারাজীবন স্টেশনে পড়ে থাকে? আমি যাব, আপনিও যেতে পারবেন। দুমাস হোক, চারমাস হোক একদিন নিশ্চয় যাবেন। এই বিরজাবাবুর মতোই আরেকজনের মালপত্র নিয়ে নিশ্চয়ই একদিন চলে যেতে পারবেন।