ভ্যাদা কবির প্রস্থান কবিতা
ক.
নিশ্চিন্তপুর। মেহেরপুরের মৃতপ্রায় ভৈরব নদীর ওপর পেটে পেট, পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। বছর বছর নদীর খামখেয়ালি চলনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় গ্রামটির ভুগোল। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, কচি হাতে আঁকা একটি নদী-গ্রাম। সাপের মতো মেরুদণ্ডহীন লিকলিকে দেহ নিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে, গ্রামটিও অতি উৎসাহের সাথে বাঁকে বাঁক মিলিয়ে খানিকটা পথ হেঁটে পিছুটান মেরেছে। অন্যদিকে নিরন্তর মাঠ। যত দূর চোখ যায় ধানী জমি, যেখানে আকাশ-মাটি এক হয়েছে বলে গ্রামের মানুষ মনে করে, সেখান থেকে ভারত দেশের শুরু। ওদিকটাতে গ্রামটা আরেকটু হাতপা ছড়াতে পারত, কিন্তু কেন জানি তার যত চাপ এই নদীটার দিকেই। ফলে ওদিকে আয়তনে না বেড়ে নদী যেখানে যেখানে কোমর বাঁকিয়েছে সেখানে সেখানেই নতুন করে বসতি হয়েছে। নদী একটু আড়মুড়া কেটেছে তো বেদখল হয়েছে তার শরীরের খানিকটা।
নদীর সঙ্গে উঠোন মিশিয়ে ভ্যাদা কবির ভিটে বাড়ি। কয়েকপুরুষ থেকে তাদের বাস এখানে। কাগজে-কলমে সে এক দাগে দু’বিঘা জমির মালিক। কিন্তু কাঠা সাতেক নদীর চর দেখিয়ে দখল করে রেখেছে বিল্লাহ চেয়ারম্যান। বিল্লাহ চেয়ারম্যান নির্বাচিত চেয়ারম্যান না, তার সাতপুরুষে কেউ চেয়ারম্যান ছিল কি না। সন্দেহ। বছর দশেক আগে একবার চেয়ারম্যানের ইলেকশন করেছিল বিল্লাহ, ভোট যা পেয়েছিল তা মুখে বলবার না। সেই থেকে তার নামের শেষে চেয়ারম্যান শব্দটা কে বা কারা যেন লেপে দিয়েছে, সঙ্গে একটা বায়বীয় ক্ষমতাও। ভ্যাদা কবির অবশ্য জমি হারানো নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আশেপাশের তিন গাঁয়ে একজনই কবি, সে হল ভ্যাদা, তাকে জমিজমা নিয়ে ভাবলে চলবে কেন! তাছাড়া ছেলেপুলেও হয়নি যে উত্তরসূরি নিয়ে ভাবতে হবে। আছে একখান বৌ- মিছরি সুন্দরী। দেখতে উটের মতো, গা-গতরে শ্রী-এর ছিটেফোঁটাও নেই, নামের শেষে তবুও বাপ-মা জোর করে বিশেষণটা জুড়ে দিয়েছে। ভ্যাদা সেটি হেঁটে ফেলার চেষ্টাটুকুও করেনি। বরং ‘মিছরি’ শব্দটা বাদ দিয়ে সে সুন্দরী’ নামটিই ব্যবহৃত নাম হিসেবে গ্রহণ করেছে। আশেপাশের বাড়িগুলোতে এ নিয়ে হাসিঠাট্টাও কম হয়নি। ভ্যাদার ওসব নিয়ে ভাবলে চলে না। কবি সে, তার ভাবনা অন্যখানে। তাকে কাব্য নিয়ে থাকতে হয়, কাব্য নিয়ে ভাবতে হয়। নিশ্চিন্তপুরসহ সামনে পিছনের আরো দু’গা দিয়ে ভ্যাদার আগে-পিছে কোনো কবি নেই। ছবির মতো গ্রাম এই নিশ্চিন্তপুর। নয়নমেলে তাকালে পাগলেরও কাব্য করার কথা। তবুও কেন যে কোনো কবির জন্ম হল না এখানে। এজন্যেই এই অঞ্চলের জন্যে নিজের কবিজন্মকে ঐশ্বরিক দায়িত্ব বলে জ্ঞান করে ভ্যাদা। সে সংসারের সাতপাঁচে জড়িয়ে তার এই কবিজন্মকে অবহেলা করতে পারে না। নিয়ম করে সে কাব্যচর্চা করে। এটিকে সে তার ইহধর্ম বলেই মনে করে।
ভ্যাদার কাব্যচর্চা আর পাঁচটা কবির মতো না। সে কবিতা কাগজে-কলমে লেখে না। মনে মনে কবিতা বোনে, মনে মনে চাষ, ফসল মনে মনেই উজাড়। কদাচিত দু’একটি শব্দ সে বাইরে ফেলে। সেটি শোনার সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়। তার কবিতা কোনো দিন কারো শোনার বা পড়ার সুযোগ না হলেও, এই এলাকা ছাড়িয়ে মেহেরপুর শহরের সাহিত্যপ্রেমীরাও তার নাম জানে। মানেও। মাঝে মাঝে শহর থেকে সাহিত্যানুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্যে তার নামে ডাকও আসে। কিন্তু কাব্যচর্চাকে একান্ত ব্যক্তিগত জ্ঞান করে সব ধরনের সামাজিকতাকে এড়িয়ে চলে কবি ভ্যাদা। সে নিয়ম করে মাসে দু-তিনটা দিন কাব্য নিয়ে বসে। একটা তেলচিটচিটে কেলে পাটি নিয়ে চলে যায় নদীর ধারে, কোনো কোনো দিন ধান ক্ষেতের মধ্যখানে, আসন পেতে বসে। কবিতা নিয়ে ধ্যান করে। বাড়ি ফিরলে বৌ বা ফেরার পথে কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, “আজ কি কাব্য বানালি শুনাও দেখি নি? ভ্যাদা সরলভাবে উত্তর করে, ‘সেকি, শুনাবু কেমুন করি, আজ তো আমি শব্দ দি’ কাব্য করিনি। আজ কাব্য করিচি গন্ধ দি। কোনো কোনো দিন বলে, “আজ কাব্য করিচি ফড়িং আর দুধধানের নেঙোর দি। যা রঙ হলু না, সে মুখে বুলি বুঝানু যাবে না! সূর্যির আলো ফুটার সাথে সাথে সব উবে গিচে। থাকলি না দেকাব! যেদিন নদীর ধারে বসে, সেদিন কেউ জিজ্ঞেস করলে উত্তর করে, “আজ কাব্যটা খুব জমিলো বটে। কেন্ত সব তো জল দি নির্মাণ করিলাম, তাই ভেসি গিচে দখিনের হাওয়াই গা এলি দি। কিছু তো ধরি রাখতি পারিনি!
শব্দ দিয়ে যে সে মোটেও কোনো কাব্য করে না, তা নয়। যেদিন তার কাব্যে শব্দ থাকে, সেদিন সে নিজেই রাস্তার লোকজন জড় করে বলে, “আসু, তুমাদের শুনায়। লোকজন যে কাব্য বোঝে বা কবিতায় আগ্রহ আছে তা নয়, তবুও দেখা গেল জনা বিশেক লোকের জমায়েত ঘটে গেল। তাদের মধ্যে শিক্ষিতরাও যেমন থাকত, তেমন রাখাল কৃষাণরাও থাকত। সে হয়ত খানিক চুপ থেকে বলল, ‘ডুবসাগর, জগতজুড়ি কেবলই যে অচিন ডুবসাগর!…’ এরপর খানিক চুপ থেকে চলা শুরু করল। লোকজন পথ আটকে বলল, সারা বিকাল দি এইটুকুন? কেউ হয়ত একটু রাগীস্বরে বলে উঠল, ‘সবটা না শুনি যাবি নি ভ্যাদা! ভ্যাদা সরলভাবে বলে, সবটা তো আমি শব্দ দি বুনিনি। এর সাথে কিছু কিছু বাতাস ছেল যে, আর ছেল পশ্চিমের আকাশে হটাত করি ফুটি উঠা রঙধনুটা। কি করি ওসব শুনায় বোল্ তো?
যেদিন জনতা জেদ করে বসে সেদিন সে আরেকটু বাড়িয়ে বলে, ‘কবিতা হলু রান্না করার মতোন। শুধু তরকারি সেদ্ধ করলি কি স্বাদ জমে? মসল্লা দিতি হয় না? কাব্যেরও তেমন মসল্লা লাগে। তরকারি যেমন দেখলি হয় না, চেকি বুঝতে হয়, তেমুন কাব্যও খালি শুনলি বা পড়লি হয় না, বোধ দি অনুভব করতি হয়। সেই বোধ আমি তুমাদের মাঝে কেমুন করি বিলাই, কও তো?’ এর বেশি কথা বলে না ভ্যাদা।
যেসব দিনে সে কাব্য করতে যায় না, সেসব দিনে সারা দিন সারারাত ঝিম মেরে বসে থাকে। আবার কখনো কখনো টানা দু’তিন দিন ঘুমিয়ে কাটায়। দেখা গেল তিন দিন ঘুমিয়ে আর তিন দিন জেগে-বসে কাটিয়ে হঠাৎ একদিন কেলে পাটিটা কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিল। সেদিন বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত কারো সাথে কোনো কথা নেই। বাড়িতে বৌ কিংবা পথে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ইশারায় উত্তর করে অথবা না শোনার ভান করে আপন গতিতে হেঁটে চলে। বাড়ি ফেরার পথেও তার ভেতর থমথমে রেশটা রয়ে যায়। প্রসব করার পর যে সাময়িক যন্ত্রণা ও প্রশান্তির মিশেল অভিব্যক্তি তৈরি হয়, অনেকটা সেই রকম।
ভ্যাদা কবির গ্রামে একটা অন্যরকম সম্মান ছিল। লোকজনের বিশ্বাস, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের অলৌকিক শক্তি ছিল তার। যেদিন কাব্য করতে বসত, সেদিন তার চারপাশের প্রকৃতি একেবারে বদলে যেত। দেখা যেত গ্রামজুড়ে কটকটে চাদি ফাটা রোদ, অথচ সে বসে স্নিগ্ধ ছায়াময় প্রকৃতির মাঝে। তাকে ঘিরে প্রকৃতির একটা আলাদা আয়োজন থাকতই। গাঁয়ের কৃষাণ বালকেরা নিজ চোখে দেখেছে বলে গায়ে এসে গল্প করেছে, ভ্যাদা চোখ বন্ধ করে বৃষ্টি ডেকে এনেছে। সে বৃষ্টির মাঝে বসে আছে অথচ তার শরীরে একফেঁটাও বৃষ্টি পড়েনি। কিংবা ভ্যাদার একেবারে মাথার ওপর নেমে এসেছে একখণ্ড মেঘ। কখনো কখনো কিছু অচেনা পাখি এসে ভ্যাদার পাশে বসে আছে, যেন আলাপ করছে। এমন অনেক রটনা আছে ভ্যাদার কাব্য করা নিয়ে। সত্যি মিথ্যা যাচাই করতে যায়নি কেউই।
ভ্যাদার বৌ জানে, তাকে দিয়ে সংসারের একটি কাজও হবে না, কোনো দিন হয়ওনি। তবুও সে এটা-সেটার কথা তুলে সারা দিন ঘ্যান ঘ্যান করে। এটা তার রোজকার কাজ, এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। ভ্যাদা দু-তিন দিন ঝিম মেরে পড়ে থেকে যেদিন কাব্য করে ফেরে কেবল সেদিনই কী মনে করে কে জানে, মিছরি সুন্দরী বেশি কথা পাড়ে না। অথচ ভ্যাদার সেদিন মনটা ভীষণ ফুরফুরে থাকে, ইচ্ছে করে মিছরির হাতে হাত লাগিয়ে সংসারের কোনো কাজে আসার। মিছরির চুপ মেরে যাওয়া দেখে সে আর সাহস করে আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না। বাড়ির পেছনে পাশাপাশি দুটো বাবলাগাছ আছে। একটার ছায়াতলে আর একটা চারাগাছ। ভ্যাদা সেদিকটায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে বেখেয়ালি হয়ে ওঠে। নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে, অনাগত সন্তানের কথা ভাবে, যে হয়ত কোনো দিন জন্মাবে না।
.
খ.
একই গাঁয়ের ছেলে আমি, ভ্যাদার কথা শুনেছি কিংবা শুনিনি। আমাদের বাড়ি ছিল ও পাড়ায়, নদী থেকে বেশটুকু দূরে। একবার নদীর ধারে ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে সুতা কেটে গেলে আমাদের মধ্যে কে যেন বলেছিল, “ঐ দেখ ভ্যাদা কবির চালে গি পড়লু! আমি ঐ প্রথম তার কথা শুনি।
কবির বাড়ি? আমি ছোট্ট করে প্রশ্ন করেছিলাম। কেউ খেয়াল করেনি, আমিও না। কিভাবে যেন মুখ ফসকে বের হয়ে গিয়েছিল। আর একবার ভ্যাদার কথা শুনেছি, মা’র মুখে। তোর মিনসে আর মানুষ হলু না! ভ্যাদাকে বুলিস ওসব কাব্যকরা ছেড়ি সংসারে মন দিতি। আমি তোর ভাইকে বুলি একটা জমির ব্যবস্থা করি দেব।’–বুঝেছিলাম, মহিলা ভ্যাদার বৌ।
ভ্যাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ তারও অনেক পরে। আমি খেলতে যাব পশ্চিম পাড়ার মাঠে। উত্তরপাড়ায় আমাদের বাড়ি। শর্টকাটে যাওয়ার জন্যে মাঠের মধ্যিখানের আইল ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কার যেন নিঃশ্বাসের শব্দ পেলাম। একটু গা ছমছম করে উঠল। আশপাশে ঘুরে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলাম না।
‘ভয় পেয়ু না। আমি!’ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম, কয়েক হাত দূরে ধানী জমির এক কোণে খানিকটা জায়গা করে বসেছিল সে। হাতে-পাছে কিছু ছিল না। একা একটা মানুষ। পরনে ছেঁড়া সাদা পাঞ্জাবি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে গিয়ে আমিও কবিতায় মন বসালাম। কবিতা তখন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হচ্ছিল। বন্ধুদের মিলে নিজেরাও একটা ম্যাগ প্রকাশ করব উদযোগ নিলাম। লেখা সংগ্রহ করতে করতে আমার হঠাত্তই একদিন ভ্যাদা কবির কথা মনে হল। কয়েক দিনের ছুটি পেয়ে বাড়ি গিয়ে এক বিকেলে তার উঠোনে দাঁড়ালাম। ভ্যাদার বউ আমাকে বসার জন্য একটা ভাঙা চেয়ার পেতে দিল। বলল সাবধানে বসতে, পেছনের পায়াটা নড়া। ভ্যাদার বউ বেশ শুকিয়ে গেছে। বয়সের ভারে চুলে পাক ধরেছে। আমার সেই আগের দেখা মানুষটির সঙ্গে এই মানুষটির কোনো মিলই নেই। কেবল চোখজোড়া বদলায়নি, আর সব বদলেছে। সে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। একটা ফুটো ফুটো স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে থাকা ভ্যাদা আমার সামনের চটটা মেলে নিয়ে বসলো। ওর বসার ভঙ্গিমা দেখে মনে পড়ে গেল, সেদিন বিকেলে ধান ক্ষেতের কোণায় যাকে বসে থাকতে দেখেছিলাম, সে ভ্যাদাই ছিল। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।
‘তুমার মা ভালো আছে?’ ভ্যাদার বৌ উঠোনের চুলাটা গোবর দিয়ে লেপতে লেপতে জিজ্ঞেস করল।
‘কে ওর মা? ভ্যাদা চাচা আস্তে করে বলল।
‘নছিরন বুবু।’
‘ও, মিয়া বাড়ির ছেলি তুমি!’ বলল ভ্যাদা।
আপনি আমার মাকে চেনেন?
তুমার আব্বাকে চিনি।
তুমার আব্বা ওর বন্ধু ছেল। ভ্যাদার বৌ যোগ করে।
‘বন্ধু না। ওই একসাথে কদিন স্কুলে গিলাম। ভ্যাদা কথাটা ঘুরিয়ে নেয়।
আপনি একটা কবিতা শোনাবেন? শুনেছি আপনি ভালো কবিতা লেখেন। আমার কথা শুনে তার মুখে একটা হাসি ঝিলিক দিয়ে আবার নিভে গেল।
‘ও তো আর কাব্য করে না, বাবু। কাব্য করা ছেড়ি দিচে। ভ্যাদার বৌ উত্তর করল।
কেন? কবিতা লেখা ছেড়ে দিল কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ভ্যাদার বৌ কোনো উত্তর করল না। ভ্যাদাও চুপচাপ। ঠিক আছে, আমাকে একটা আগের কবিতা দিলেও চলবে। আমি একটা ম্যাগাজিন করছি, চাচার কবিতা প্রকাশ করতে চাই। আমি আর একসময় এসে নিয়ে যাব বলেই উঠে পড়লাম। ওরা কেউ কোনো কথা বলল না। ভাবলাম, গাঁয়ের মানুষ হয়ত জানবে। এত দিন ধরে কবিতা নিয়ে পড়ে থাকা মানুষটা কেন কাব্য করা বন্ধ করে দিল, তার একটা যুৎসই উত্তর সবার জানা উচিত। নিশ্চয়ই কারণটা হালকা কিছু না। সাহিত্যের ছাত্র আমি। জানি, ঘোষণা দিয়ে কবিত্ব ছেড়ে দেয়া যায় না। দিন কতক গ্রামের পাড়ায় পাড়ায়, আড্ডায় আড্ডায় ঘুরে ভ্যাদা কবির কথা জানতে চাইলাম। আশ্চর্য হলাম, তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না দেখে। একদল তো বলেই ফেলল, ‘ও একুনু বেঁচি আছে নাকি! আবার কেউ কেউ পাল্টা প্রশ্ন করল–কুন ভ্যাদা? যেন সে কোনো দিনই এই গায়ে ছিল না।
আশপাশের দশ গাঁয়ের এক কবি, ভ্যাদা-কবি, বেঁচে থেকেও এমন আড়াল হয় কি করে? মাকে বলেছিলাম মা, তুমি কিছু জানো? ভ্যাদা চাচার বউ না তোমার কাছে আসত?
‘ভ্যাদা চলি যাওয়ার পর ওর বৌ একদিন এসিলো। সেও বছর চারেক আগে। হাউমাউ করি কেঁদিকেটি করি চলি গিচে। মাঝে মদ্যি আমি একেউকে দি চালডাল পাঠাই। দেখতি যাবো, আমার কি আর সেই জো আছে!’ মা বললেন।
ভ্যাদা চলে গেলে, মানে? কোথায় গিয়েছিল সে?
‘তা আর কেউ জানতি পারলু কই? সেই যে দিন পরে নদীর ধারে কাব্য করতি করতি নিরুদ্দেশ হলু, আর তো ফিরলু না। মাঠে-ঘাটে একুনু দেখা যায় বুলি রব ওঠে। কেন্তু বাড়ি তো ফেরে না!
ভ্যাদা চাচা যে বাড়ি ফিরে এসেছে। আমি যে ওকে বাড়িতে দেখে এসেছি। সেকথা আর পাড়লাম না।
রাতে রান্নাঘরে বসে মায়ের সঙ্গে কথাগুলো হচ্ছিল। পরদিন ভোরে উঠেই ভ্যাদা কবির উঠোনে আমি হাজির। তার বৌ সবে উঠে উঠোনের কোণে কটা শুকনো কুলের ডালের ওপর পুঁইশাকের ডগা উঠেছে, সেগুলো ঠিক করে দিচ্ছিল। বলল, বসো। একবার বলল, বসেন। চেয়ারটা সেভাবে সেখানেই আছে। আমি সাবধানে বসলাম।
চাচার কাছে এসেছিলাম আমি বললাম। সে কোনো কথা বলল না।
‘কটা মুড়ি তুলা আছে। দেব?’ খানিক বাদে বলল সে।
আমি এত ভোরে কিছু খাই না। কাল চলে যাব, তাই কবিতাটা নিতে আসলাম। আমি জবাব দিলাম।
‘বুউন ভালো আছে? জানতে চাইল সে।
হুম। আছে। কাল আপনার কথা বলছিল। আপনি আর যান না, আপনি গেলে মা ভীষণ খুশি হবে।
তুমার চাচা থাকতি মেলা গিচি। একুন আর সুময় পাইনি। একা একাই সব করতি হয়।
চাচা নেই মানে? আমি না সেদিনই আপনার সামনে বসে থাকতে দেখে গেলাম?
আমরা দুজনে কথাও বললাম!
‘আমি তো সব সুময় দেখি তাকে। দুজনে সারা দিন মেলা কথা বুলি। মাঝমদ্যি
আমার সাথে খাইও।
কিন্তু নেই বললেন যে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘একদিন তো চলি গেল। না বুলি চলি গেল। ঘুমের ঘোরে বুলতুক, যাবে। কুতায় যেনে কী আছে, বুঝা যাতুক না। শুধু যাবে, এটা বুঝা যাতুক।
সেদিন আমি স্পষ্ট করে দেখলাম। আমার পায়ের কাছে ঘেঁড়া চটে বসেছিল। পরনে ছেঁড়া স্যান্ডো আর লুঙ্গি। তার গায়ের গন্ধও আমি পেয়েছি। এটা মিথ্যে হতে পারে না। চাচা যদি গিয়েও থাকে, নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে।
সে আর কথা না বলে পাতি-হাঁস দুটোকে মাটি দিয়ে বানানো খাঁচা থেকে বের করে নদীর দিকে ছেড়ে দিয়ে বলেন–”যাহ্, দপরের আগ দি চলি আসিস। বিয়িনে আবার একবার যাস। আমি নিজেই দি আসবু তোদের।
ভ্যাদা কবির বউকে আমার স্বাভাবিক বলে মনে হল না। আমি যখন আসলাম তখন বিড়বিড় করে পুঁইগাছের সঙ্গে কথা বলছিল। ঠিক মতো আঁকড়ি ধরি থাকিস। বড় হচ্ছিস, আর কত জ্বালাবি!’ তখন আমলে তুলিনি। আমার গা ছমছম করে উঠল। মনে হল যেন ভ্যাদা কবি আমার পাশেই বসে আছে। মনে হল ভ্যাদা কেবলই একটা ক্ষয়ে যাওয়া নাম। নামটি থেকে আমি কেমন মৃত মৃত গন্ধ পাচ্ছিলাম। উঠে আসার আগে একবার চেয়ারটা ভালো করে আঁকি দিলাম। একটি পায়া টুপ করে খুলে পড়ে গেল।
.
গ.
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পথে ট্রেনে বসে আমার টুকে রাখা নোট:
মিছরি সুন্দরী ভ্যাদার কাব্য করা নিয়ে একসময় কত কথা শুনিয়েছে। আজ সে নিজেই তার কবিতা হয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে।
ভ্যাদা কবি খুব সম্ভবত নিজের প্রস্থান নিয়ে রচনা করে গেছেন তার সবচেয়ে মহান কবিতাটি।