1 of 2

ভৌতিক, না ভেলকি?

ভৌতিক, না ভেলকি?

[এটি একটি সত্য ঘটনা। প্রখ্যাত হস্তি শিকারি ডবলিউ বাকলে সাহেব, তাঁর Big Game Hunting in Central Africa পুস্তকের মধ্যে লিপিবদ্ধ করেছেন। স্মিথ নামে এক শিকারি বন্ধু তাঁর কাছে বলেছিলেন এই গল্পটি। আমরা স্মিথের মুখ থেকেই গল্পটি তুলে দিলুম।]

হ্যাঁ, আফ্রিকায় অনেক বিচিত্র ঘটনাই ঘটে।

তখন আমি ছিলুম কঙ্গো প্রদেশে। যেখানে গ্রিবিঙ্গুই ও চারি নদী পরস্পরের সঙ্গে মিলেছে, সেখানে পেয়েছিলুম একখানা খালি বাড়ি। সাধারণ বাড়ি, তার ওপরে ঘাসে-ছাওয়া চাল এবং তার চারদিকে বেষ্টন করে বারান্দা।

প্রথম দিনে আমার মালপত্তর বারান্দাতেই তোলা হল। পাহারা দেওয়ার জন্যে রাত্রে সেখানে রইল দুজন বেয়ারা।

রাত ন-টা বাজতেই নৈশভোজনের পর শয্যায় গিয়ে আশ্রয় নিলুম এবং ঘুমিয়ে পড়তে বিলম্ব হল না। কিন্তু খানিক পরেই ঘুম গেল ভেঙে এবং শুনতে পেলুম, বাইরে থেকে বন্ধ দরজার ওপরে আঁচড়াআঁচড়ির শব্দ হচ্ছে।

চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কে?’

কারুর সাড়া নেই, কিন্তু শব্দটা গেল থেমে। ভাবলুম, কোনো জন্তু-জানোয়ার হবে। আর মাথা না ঘামিয়ে আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলুম।

কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই আবার আঁচড়াআঁচড়ির শব্দ।

আবার শুধোলুম, ‘কে?’ কিন্তু কোনো সাড়া না-পেয়ে, উঠে আলো জ্বেলে ঘরের দরজা খুললুম।

কেউ কোথাও নেই। বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছে কেবল আমার দুজন বেয়ারা। কিছুই বুঝতে না-পেরে দরজা বন্ধ করে আলো না নিবিয়েই আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লুম।

কিন্তু মিনিটকয় যেতে-না-যেতেই ফের শুরু হল সেই আঁচড়াআঁচড়ি। এবারে ভারি রাগ হল। লাফ মেরে বিছানা ছেড়ে গালাগালি দিতে দিতে খুলে ফেললুম ঘরের দরজা। সব ফাঁকা, রাত করছে খাঁখাঁ। চারদিকের বারান্দায় এক চক্কর ঘুরে এলুম দ্রুতপদে। বেয়ারারা তেমনি নিদ্রিত। নেই আর কোনো জনপ্রাণী।

এবারে রীতিমতো হতভম্বের মতো ঘরের ভেতরে ফিরে এলুম। কেউ নেই, শব্দ করে কে? শুয়ে শুয়ে এই কথা ভাবছি, তারপরেই আবার কে দরজা আঁচড়াতে লাগল!

এবার বিছানা না ছেড়েই জ্বালাতন হয়ে চিৎকার করে বললুম, ‘দূর হ, দূর হ! নইলে বন্দুকের গুলিতে তোর মাথার খুলি উড়িয়ে দেব!’

শাসানির ফল ফলল। একটা কণ্ঠস্বরে শুনলুম, ‘ও মি. স্মিথ? আপনি কি আমাকে ভুলে গিয়েছেন? মনে নেই ঔবাংঘীতে আমি আপনাকে যেসব দৃশ্য দেখিয়েছিলুম?’

সিয়েরা লিয়নের একজন কালা আদমির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, মনে হল তারই কণ্ঠস্বর। স্থানীয় লোকদের বিশ্বাস, সে হচ্ছে জুজু-মানুষ, অলৌকিক জাদু জানে।

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিন্তু কোথায় তুমি? বাইরে গিয়েও আমি তো কারুকে দেখতে পাইনি?’

উত্তর হল, ‘হতে পারে, কিন্তু আমি এইখানেই আছি। আচ্ছা, একটু সবুর করুন, আমি আপনাকে আরও কিছু দেখাব!’

বিছানা থেকে নেমে চেয়ারের ওপরে বসে আমি আরও কিছু দেখবার অপেক্ষায় রইলুম।

এখানে এ ঘরের ভেতর থেকে আর একটা ঘরে যাওয়া যায়, মাঝে আছে একটা দরজা।

সেই দিকে তাকিয়ে দেখি— কী আশ্চর্য, দরজার মাথার ওপরে রয়েছে একটা কালা আদমির মুখ!

অবাক হয়ে ভাবছি, কেমন করে ওই অসম্ভব জায়গায় তার আবির্ভাব হল। হঠাৎ সে জিব বার করে আমাকে ভেংচি কাটলে।

না, এতটা বাড়াবাড়ি সহ্য করা অসম্ভব! আমি তেরিয়া হয়ে তার দিকে ছুটে গেলুম, সঙ্গে-সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল মুখখানা!

সেই দরজাটা খুলে ফেলে তার পিছনে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেও কারুর টিকি পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারলুম না। আবার দরজা বন্ধ করে চেয়ারের ওপরে এসে বসে পড়লুম দস্তুরমতো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মতো। কে হেসে উঠল আচম্বিতে! চোখ তুলে দেখি, দরজার টঙে আবার সেই কালা মুখ— আবার সে আমাকে ভেংচি কাটছে!

এবারে আমি আর চেয়ার ছেড়ে উঠলুম না, নাচারের মতো বসে রইলুম চুপচাপ। একটু পরেই মুখখানা মিলিয়ে গেল।

কে বললে, ‘মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখ।’

তাকিয়ে দেখলুম। মস্ত একটা সাপ সড়সড় করে আমার চেয়ারের দিকেই এগিয়ে আসছে।

এতক্ষণে বেশ বুঝলুম, এসব হচ্ছে আমার চোখের ভ্রান্তি। তবু সাপটা যখন চেয়ারের কাছে এসে পড়ল, আমি তাড়াতাড়ি পা দুটো ওপরে তুলে না-নিয়ে থাকতে পারলুম না।

পরদিন দুপুরে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার এবং শাসনকর্তার ওখানে ছিল আমার ভোজনের নিমন্ত্রণ। তাঁদের কাছে প্রকাশ করলুম গত রাতের কথা।

আমিও যা ভেবেছিলুম, তাঁরাও তাই বললেন। কেউ আমাকে নিয়ে মজা করেছে।

তাঁরা আমার সঙ্গে এলেন আমার বাসাটা খানাতল্লাশ করবার জন্যে। কিন্তু সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না।

শেষে স্থির হল, আজ রাত্রে পাহারাওয়ালারা এই বাড়িখানার চারদিক ঘিরে মোতায়েন থাকবে। এখান থেকে বিশ গজ দূরে আছে আর একখানা বাড়ি, সেখানে হাজির থাকবেন দুজন শ্বেতাঙ্গ রাজকর্মচারী। আজও রাত্রে আবার যদি সেইরকম শব্দ হয়, আমি যেন খুব চিৎকার করে বলি, ‘কে ওখানে?’ তৎক্ষণাৎ শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা বেগে ছুটে আসবেন এবং বাড়ির চতুঃসীমার মধ্যে কারুকে দেখতে পেলেই পাহারাওয়ালারা বন্দুক থেকে করবে অগ্নিবর্ষণ।

আবার রাত হল। যথাসময়ে আমিও শয্যাগ্রহণ করলুম। কেটে গেল মিনিট পনেরো। তারপরেই শুরু হল দরজার ওপরে সেই আঁচড়াআঁচড়ি।

চিৎকার করে উঠলুম আমি উচ্চকণ্ঠে। দ্রুতপদে ছুটে এলেন শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা। হাতে তাঁদের রিভলভার। পাহারাওয়ালারাও চারদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল, কিন্তু কাকে ধরবে? কোথাও নেই জনমানব!

তারপরেও এক সপ্তাহ কাল আমি সেই বাসায় বাস করেছিলুম। রোজ রাত্রেই ঘটত অমনি সব অলৌকিক ঘটনা।

কিন্তু আমি সেসব আর আমলে আনতুম না। আহারের পর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে বলতুম, ‘আর নয়, এইবারে বিদায় হও। আমি এখন ঘুমোতে চাই।’ সঙ্গে সঙ্গে আর কিছু শুনতে বা দেখতে পেতুম না।

আর একটা উল্লেখযোগ্য কথা। আমি আসবার আগে এখানে কোনো উৎপাত হয়নি। আমার পরে ও বাড়িতে বাসা বেঁধে ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার। তখনও ঘটেনি কোনো আজব ঘটনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *