1 of 2

ভৌতিক চক্রান্ত

ভৌতিক চক্রান্ত

শিল্পী প্রমোদ রায়ের নাম অনেকেরই কাছে সুপরিচিত। আমি উদীয়মান চিত্রকর ও ভাস্কর প্রমোদ রায়ের কথা বলছি। ছবি আঁকায় এবং মূর্তি গড়ায় তার সমান খ্যাতি।

সে বাস করত নিমচাঁদ মল্লিক স্ট্রিটের একখানা ভাড়াবাড়িতে। স্ত্রী ছাড়া তার পরিবারে আর কোনো লোক নেই, বাড়িখানা ছোটো হলেও সে কোনো অসুবিধা বোধ করত না। নীচের তলায় ছিল তার কারুকক্ষ বা ‘স্টুডিয়ো’।

তার দিনগুলি কেটে যাচ্ছিল দিব্য নির্ভাবনায়, কিন্তু হঠাৎ হল এক মুশকিল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এক নোটিশ এসে হাজির, এ বাড়ি ছেড়ে তাকে উঠে যেতে হবে।

কলকাতায় তখন ভাড়াবাড়ির একান্ত অভাব, পাড়ায় পাড়ায় উদ্বাস্তুদের ভিড়। মোটা টাকা সেলামি এবং ত্রিগুণ ও চতুর্গুণ ভাড়া দিতে চাইলেও খালি বাড়ি পাওয়া ভার হয়ে উঠেছিল। অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই পুরাতন ভাড়াটিয়া উঠে গেলে খুশি হয়, নূতন ভাড়াটিয়া বসিয়ে বেশি লাভ করবার লোভে।

প্রমোদ বাড়িওয়ালার দাবি সহজে মানতে রাজি হল না। বাড়িওয়ালা নালিশ করলে। মামলা হল এবং মামলায় হেরে গেল প্রমোদই। বাড়ি ছাড়বার জন্যে সে সময় পেলে মাত্র এক মাস।

।। দুই ।।

ইতিমধ্যে ঘটতে লাগল অদ্ভুত সব কাণ্ড!

প্রমোদদের ঠিক পাশের বাড়িতে থাকত নরহরি দাস, মফসসলের লোক, কলকাতায় বাস করত ব্যবসাসূত্রে। মাঝখানের একটা পাঁচিল টপকালেই তাদের বাড়ির ছাদ থেকে অনায়াসে প্রমোদদের বাড়ির ছাদের উপরে এসে পড়া যেত।

নরহরির চেহারাখানি ছিল আদর্শ গদিওয়ালার মতো—মোটাসোটা, বেঁটেসেটে, কালোকোলো দেহ; চাঁদের মতো গোলাকার মুখমণ্ডল; সাজগোজও তথৈবচ। সে পরম বৈষ্ণব, মাথায় চৈতনচুটকি, কপালে ও নাসিকায় তিলকমাটির চিহ্ন এবং কণ্ঠদেশে তিন সার তুলসীর মালা।

অথচ তার অত্যন্ত দহরম-মহরম ছিল মহাশাক্ত ভৈরব ভটচাজের সঙ্গে। ভৈরবের চেহারা ছিল লম্বায়-চওড়ায় দশাসই, হাস্য ছিল অট্টহাস্যের মতো এবং বাক্য ছিল হুংকারের মতো। তান্ত্রিক ক্রিয়া ছিল তার পেশা এবং মদ্য আর মাংসই ছিল তার প্রধান পানীয় ও খাদ্য।

কিন্তু চেহারায় ও চরিত্রে আকাশ-পাতাল তফাত থাকলেও ভৈরব ও নরহরি দুজনেরই নেশা ছিল এক এবং সেটা হচ্ছে দাবাখেলা।

রোজ সন্ধ্যাবেলায় নরহরি তাম্বুল চর্বণ করতে করতে এবং ভৈরব তামাকু টানতে টানতে দাবাবোড়ের ছকের সামনে বসে খেলায় বিভোর হয়ে থাকত। সে সময়ে তাদের দেখলে লোকে বলাবলি করত, ‘এও যখন সম্ভবপর, তখন বাঘে আর গোরুতে মিলনই বা অসম্ভব হবে কেন?’

কিন্তু এমন মিলনেও তাগড়া পড়ল। আচম্বিতে মেনিনজাইটিস রোগে নরহরি হল গতাসু এবং সে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে গেল তার পরিবারবর্গ। ভেঙে গেল সেখানকার দাবাবোড়ের সান্ধ্যআসর।

।। তিন ।।

নরহরির মহাপ্রস্থানে ভৈরব ভটচাজ দুঃখ পেলে বটে, কিন্তু পরম আনন্দ লাভ করলে তার বাড়িওয়ালা ক্ষেত্র বা ক্ষেতু মল্লিক।

নরহরি ভাড়া দিত মাসিক পঞ্চাশ টাকা। ক্ষেতু মল্লিক এখন জো পেয়ে দাবি করে বসল এককালীন এক হাজার টাকা সেলামি এবং মাসিক দেড়শো টাকা ভাড়া। দিনকাল যা পড়েছে, তার দাবি নিশ্চয়ই অপূর্ণ থাকত না। এমনকি, হবু ভাড়াটিয়ারা আনাগোনাও শুরু করে দিলে।

কিন্তু সহসা সংঘটিত হল এক রোমাঞ্চকর ও অভূতপূর্ব ঘটনা।

এক পূর্ণিমার রাত্রে পথ দিয়ে চলতে চলতে নরহরিদের পরিত্যক্ত, তালাবন্ধ, খালি বাড়ির বারান্দার দিকে তাকিয়ে বদন চাটুজ্জে দেখলে এক বিসদৃশ দৃশ্য!

বারান্দার একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মুখ ছাড়া সর্বাঙ্গ সাদা কাপড়ে ঢেকে এক সন্দেহজনক মূর্তি!

বদন চেঁচিয়ে বললে, ‘কে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে?’

কোনো সাড়া নেই।

বদনের সঙ্গে ছিল টর্চ, সে টপ করে টর্চের চাবি টিপে আলো জ্বেলে যা দেখলে, তা সম্ভবপরও নয়, যুক্তিসঙ্গতও নয়।

সে মূর্তি হচ্ছে নরহরি দাসের!

তার পেটের পিলে চমকে গেলেও, নিজের চোখের ভ্রম ভেবে বদন চাটুজ্জে আরও ভালো করে দেখবার চেষ্টা করলে। উঁহু, মোটেই চোখের ভ্রম নয়, ও মুখ অবিকল নরহরি দাসের! ভয়ে সাদা হয়ে গেল বদনের বদন, ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ‘আঁ’ বলে পাড়াকাঁপানো চিৎকার করে সে ঘণ্টায় বিশ মাইল বেগে দৌড় মারলে নিজের বাড়ির দিকে।

।। চার ।।

বলা বাহুল্য,খবরটা পাড়ার ঘরে ঘরে রটে যেতে দেরি লাগল না।

ক্ষেতু মল্লিক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললে, ‘বদনাব্যাটা ভাংচি দিতে চায়! নরহরি ছিলেন পরম বৈষ্ণব মানুষ, তিনি এখন গোলকধামে বসে মনের সুখে বিশ্রাম করছেন, কোন দুঃখে আবার এই ছাই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন?’

কিন্তু নরহরি যে এখনও সশরীরে বিরাজ করছে তার ওই ভাড়াবাড়িতেই, পাড়ার আরও কেউ কেউ তার অকাট্য চাক্ষুষ প্রমাণ পেলে। তবে দিনের বেলায় তাকে দেখা যায় না এবং দিনের বেলায় তাকে দেখবার আশাও কেউ করে না।

ফলে দাঁড়াল এই : প্রথমত, নরহরির বাড়ির সুমুখ দিয়ে লোকে রাত্রে পথচলাই ছেড়ে দিলে। দ্বিতীয়ত, হবু-ভাড়াটিয়ারা ক্ষেতু মল্লিককে একেবারেই বয়কট করলে। বিনা ভাড়াতেও নরহরির বাড়িতে বাস করবার মতো লোকও আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

অবস্থা যখন এই রকম, ঠিক সেই সময়ে তান্ত্রিক ভটচাজ এসে বাসনাপ্রকাশ করলে, ‘ক্ষেতুবাবু, নরহরিদের বাড়িখানা আমি ভাড়া নিতে চাই!’

নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে না পেরে ক্ষেতু মল্লিক বললে, ‘তাই নাকি?’

—‘হ্যাঁ ক্ষেতুবাবু! আমি হচ্ছি তন্ত্রসিদ্ধ মানুষ, বৈষ্ণবের প্রেতাত্মা আমাকে দেখলেই ভয়ে পিঠটান দেবার পথ পাবে না!’

ক্ষেতু মল্লিক তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ঠিক বলেছ ভটচাজ! তোমার সঙ্গে আমিও একমত।’

—‘কিন্তু আমি হচ্ছি গরিব মানুষ, মাসে ত্রিশ টাকার বেশি ভাড়া দেবার শক্তি আমার নেই।’

—‘বেশ, তাই সই।’

।। পাঁচ ।।

নরহরির বাড়িতে এসে জাঁকিয়ে বসল ভৈরব ভটচাজ। সত্য সত্যই মনে মনে তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, বৈষ্ণবের প্রেতাত্মা কিছুতেই শাক্তের নিকটবর্তী হওয়ার সাহস প্রকাশ করতে পারবে না।

এবং যখন প্রথম দুই রাত্রির মধ্যে নরহরির চৈতনচুটকি পর্যন্ত দেখা গেল না, ভৈরব তখন পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তন্ত্রের অপূর্ব মহিমা সম্বন্ধে জোরগলায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে লাগল।

তারপরই এল অমাবস্যার রাত্রি।

দোতলার একটি ঘরে পূজার উপকরণ নিয়ে আসনাসীন হল ভৈরব ভটচাজ। নরহরির ভয়ে পথ নির্জন, কোথাও টুঁ শব্দটি পর্যন্ত শোনা যায় না। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, ঘরের ভিতরে জ্বলছে একটা হারিকেন লন্ঠনের টিমটিমে আলো।

ভৈরব একমনে দুই চক্ষু বুজে মন্ত্র জপ করছিল।

আচমকা একটা বিকৃত, অনুনাসিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ভৈঁরঁব, এঁকচাঁল দাঁবাঁ খেঁলবেঁ ভাঁয়াঁ?’

ভয়ংকর চমকে গিয়ে ভৈরব চোখ খুলেই দেখে, ঘরের দরজার কাছে পা থেকে গলা পর্যন্ত ধবধবে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং নরহরি ছাড়া আর কেউ নয়! ভৈরবই সবচেয়ে বেশি চিনত নরহরিকে, তার চোখের ভ্রম হবার জো নেই।

তারপর আর কিছু নয়, বিকট এক আর্তনাদ এবং ভৈরবের ভূমিতলে পতন ও মূর্ছা!

।। ছয় ।।

ক্ষেতু মল্লিক হতাশভাবে স্থির করলে, ওই ভূতুড়ে বাড়িখানা ভেঙে ফেলে একেবারে নতুন বাড়ি তৈরি করবে।

কিন্তু হঠাৎ যখন শিল্পী প্রমোদ রায় এসে নরহরির বাড়িখানা ভাড়া নিতে চাইলে, তখন ক্ষেতু মল্লিকের চেয়ে বিস্মিত লোক পৃথিবীতে আর কেউ ছিল না বোধ হয়।

প্রমোদ বললে, ‘কলকাতায় খালিবাড়ি দুর্লভ, অথচ বাড়িওয়ালার হুকুমে আর এক হপ্তার মধ্যেই আমাকে উঠে যেতে হবে। সুতরাং আমার অবস্থা বুঝতেই পারছেন তো?’

ক্ষেতু মল্লিক বললে, ‘বেশ বাবা, আমি বেশি ভাড়াও চাই না, তুমি মাসে পঁচিশটি করে টাকা দিয়ো।’

—‘তাহলে এই পঁচিশ টাকা অগ্রিম নিয়ে তিন বছরের কড়ারে আমাকে চুক্তিপত্র লিখে দিন।’

—‘আচ্ছা।’

।। সাত ।।

পাশের বাড়িতে উঠে যাবার জন্যে প্রমোদ নিজের ‘স্টুডিয়ো’র ছবি ও প্রতিমূর্তিগুলোকে স্থানান্তরিত করবার ব্যবস্থা করছে, এমন সময়ে তার স্ত্রী নমিতা এসে ভয়ে ভয়ে বললে,‘ওগো, নরহরিবাবুর বাড়িতে গিয়ে আমি থাকতে পারব না।’

—‘কেন?’

—‘কেন, তা কি তুমি জানো না?’

প্রমোদ হাসিমুখে নমিতার হাত ধরে ঘরের এককোণে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর একখানা সাদা চাদর একধারে সরিয়ে নিতেই দেখা গেল, একটা খড়ের কাঠামোর উপরে বসানো রয়েছে নরহরির রং-করা মাটি দিয়ে গড়া মুখমণ্ডল!

নমিতা হতভম্ব!

প্রমোদ বললে, ‘আমি হচ্ছি ভাস্কর, নরহরির মুখ আমি অনায়াসেই গড়তে পেরেছি। পাঁচিল টপকে পাশের বাড়িতে যাওয়াও আমার পক্ষে কঠিন হয়নি; আমাকে সাহায্য করেছে আবছা রাত, মানুষের স্বাভাবিক ভয় আর কুসংস্কার!’

___

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *