ভৌতিক ক্রিসমাস

ভৌতিক ক্রিসমাস

আমি আগে কখনো একাকী কাটাইনি ক্রিসমাস।

সাজানো গোছানো কামরায় একা একা বসে থাকতে আমার গা কেমন ছমছম করে। মাথায় যত রাজ্যের ভূত প্রেতের চিন্তা এসে ভিড় করে, মনে হয় রুমের মধ্যে কারা যেন কথা বলছে। অতীতকাল থেকে আসা মানুষজন। কেমন দম বন্ধ করা একটা অনুভূতি হয় আমার ফেলে আসা সবগুলো ক্রিসমাসের স্মৃতি জট পাকিয়ে যায় মনের মধ্যে : শিশুতোষ ক্রিসমাস, বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন, জানালার ধারে গাছ, পুডিংয়ের মধ্যে পুরে রাখা ছয় পেন্সের মুদ্রা এবং কালো আকাশ ঘেরা সকালের ক্রিসমাস; কৈশোরের ক্রিসমাস, বাবা-মায়ের সঙ্গে। যুদ্ধ, হাড় কাঁপানো শীত। দেশের বাইরে থেকে

আসা চিঠিপত্র; বড়ো হয়ে ওঠার পরের ক্রিসমাস; প্রেমিকের সঙ্গে তুষারপাত, যাদুকরী মোহ, রেড ওয়াইন, চুম্বন এবং মাঝরাতের আগে অন্ধকার রাস্তায় হাঁটাহাঁটি, বরফ পড়ে ধবধবে সাদা জমিন, কালো আকাশের পটভূমে ফুটে থাকা নক্ষত্রের হীরক দীপ্তি কত কত ক্রিসমাসের স্মৃতি বছর ঘুরে।

আর এবারই প্রথম আমার একলা ক্রিসমাস কাটানো।

তবে শুধু একাকীত্বই যে অনুভব করি তা নয়। আরও অনেক লোকই একা একা ক্রিসমাস কাটায় তাদের সঙ্গে এক ধরনের একাত্মতা অনুভূত হয় মনে। এদের সংখ্যা লক্ষাধিক

তারা অতীত এবং বর্তমানের মানুষ। এরকম একটা অনুভূতি জাগে, চোখ বুজলে মনে হয় অতীত বলে কিছু নেই, ভবিষ্যতের কোনো অস্তিত্ব নেই, শুধু রয়েছে সীমাহীন বর্তমান যার নাম সময় আর এ সময়টুকুই কেবল আমাদের হাতে আছে।

তবু আপনি যতই উন্নাসিক হোন না কেননা, কিংবা ধর্মকর্মে আপনার আগ্রহ না-ইবা থাকুক, ক্রিসমাসের সময় একা থাকলে আপনার কাছে অদ্ভুতই লাগবে।

কাজেই যখন যুবকটিকে আমি দেখলাম ভেতরে ঢুকতে, মনে বেশ স্বস্তি লাগল। তবে এর মধ্যে রোমান্টিক ব্যাপার কিছু নেই–আমি পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক নারী, চিরকুমারী স্কুল শিক্ষিকা, গম্ভীর, মাথা ভর্তি কালো চুল, এক সময়ের সুন্দর চক্ষু জোড়া এখন ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন আর যুবকের বয়স কুড়ির কোঠায়, একটু অন্যরকম পোশাক গায়ে, গলায় ওয়াইন কালারের টাই এবং কালো ভেলভেট জ্যাকেট, মাথার বাদামী চুলে কতদিন নাপিতের কাঁচি পড়েনি কে জানে! তার নীল, সরু চোখজোড়ায় অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, খাড়া নাক, উদ্ধত চিবুক। তবে খুব একটা শক্তিশালী কাঠামো তার নয়। গায়ের রঙ ধবধবে সাদা।

সে দরজায় কড়া না নেড়েই ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, দুঃখিত। ভেবেছিলাম এটা আমার কামরা। বেরিয়ে যাচ্ছিল, কী মনে করে থমকে গিয়ে ইতস্তত গলায় জানতে চাইল, আপনি কি একা?

হ্যাঁ।

এটা–ব্যাপারটা অদ্ভুত। মানে ক্রিসমাস একাকী কাটানো, তাই না? আমি কি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

নিশ্চয় পারো।

সে এসে আগুনের ধারে বসল।

আশা করি আপনি ভাবছেন না আমি কোনো মতলব নিয়ে এখানে এসেছি। আমি সত্যি ভেবেছিলাম এটা আমার রুম, ব্যাখ্যা দিল সে।

তুমি ভুল করেছ বলে আমি খুশি। কিন্তু তোমার মতো তরুণের তো ক্রিসমাসের সময় একা থাকার কথা নয়।

আমি দেশে যেতে পারিনি আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। তাহলে আমার কাজের ক্ষতি হতো। আমি একজন লেখক।

ও আচ্ছা, আমার মুখে হাসি এসে গেল। এরকম অস্বাভাবিক পেশার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল আর এ তরুণটি দেখছি নিজের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। তা তো বটেই, লেখালেখির মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আমি চোখ মটকে বললাম।

না, একটি মুহূর্তও নষ্ট করা উচিত নয়। কিন্তু আমার পরিবার বিষয়টি বুঝতে চায় না। তারা কোনটা জরুরি তা-ই জানে না।

সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে পরিবারের সহায়তা পাওয়া যায় খুব কম।

পাওয়া যায় না বললেই চলে, গম্ভীর গলায় বলল যুবক।

তুমি কী লিখছ?

কবিতা এবং ডায়ারি একযোগে। নাম রেখেছি মাই পোয়েমস অ্যান্ড আই। লেখক ফ্রান্সিস র‍্যাণ্ডেল। এটাই আমার নাম। আমার পরিবার বলে লেখালেখি করে কোনো লাভ নেই। বিশেষ করে এত কম বয়সে। কিন্তু নিজেকে আমি কম বয়সী বলে ভাবি না। মাঝে মধ্যে নিজেকে বয়োবৃদ্ধ বলে মনে হয়। মনে হয় অনেক কাজ বাকি থাকতেই না আবার মরে যাই।

সৃজনশীলের চাকায় দ্রুত গতি আনতে হবে।

ঠিক তাই। আপনি আসল কথাটি বুঝতে পেরেছেন। আপনি একদিন আমার লেখা পড়বেন। দয়া করে অবশ্যই পড়বেন! তার কণ্ঠে মরিয়ার সুর, চাউনিতে ভয় দেখে আমি বললাম :  

ক্রিসমাসের দিনে আমরা বড় বেশি নিরানন্দ আচরণ করছি। তোমার জন্য একটু কফি বানিয়ে আনি? আমি কেক খাব।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। কফি চড়িয়ে দিলাম পারকোলেটরে। তবে আমার কথায় বোধহয় আঘাত পেয়েছিল ছেলেটি, ফিরে এসে দেখি সে চলে গেছে। আমি যারপরনাই হতাশ হলাম।

কফি বানিয়ে রুমটির বইয়ের তাকে চোখ বুলাতে লাগলাম। মোটা মোটা বইয়ের ভলিউম। বাড়িওয়ালি এজন্য আগেই আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে বলেছিলেন : আশা করি বইপত্রে আপনার বিরাগ নেই, মিস। আমার স্বামী এগুলো ছুঁয়েও দেখেন না আর বইগুলো রাখবার জায়গাও পাচ্ছি না। এ কারণে এ কামরার ভাড়া আমরা একটু কম নিই।

বইতে আমার বিরাগ নেই, বললাম আমি। বই বরং আমার ভালো বন্ধু।

কিন্তু এ বইগুলোর চেহারাসুরত তেমন বন্ধুসুলভ মনে হচ্ছে না। আমি হাতের কাছে যা পেলাম তা-ই একখানা তুলে নিলাম। নাকি নিয়তিই আমাকে ওই বইটি তুলে নিতে বাধ্য করেছে?

কফিতে চুমুক দিতে দিতে আর সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমি জীর্ণ চেহারার পাতলা বইটি পড়তে লাগলাম। এটির প্রকাশনাকাল ১৮৫২ সালের বসন্ত। মূলত কবিতার বই- কাঁচা হাতের লেখা তবে পরিচ্ছন্ন। তারপর দেখি ডায়ারির ঢঙে কিছু লেখাও রয়েছে। কৌতূহল নিয়ে ওতে চোখ বুলালাম। শুরুতেই লেখা ক্রিসমাস, ১৮৫১। আমি পড়তে লাগলাম :

আমার প্রথম ক্রিসমাস দিনটি কাটল একাকী। তবে আমার একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে। হাঁটাহাঁটি শেষে আমি যখন আমার লজিং হাউজে ফিরেছি, এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেলাম। প্রথমে ভেবেছি বোধহয় ভুল করে ভুল কামরায় প্রবেশ করেছি। কিন্তু তা নয়। ভদ্রমহিলার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পরে হঠাৎ তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমার মনে হয় উনি ভূত ছিলেন। তবে আমি ভয় পাইনি। ওনাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। তবে আজ রাতে আমার শরীরটা কেনো জানি ভালো লাগছে না। একদমই ভালো লাগছে না। এর আগে কোনোদিন ক্রিসমাসের সময় আমি অসুস্থ হইনি।

বইয়ের শেষ পাতায় প্রকাশকের একটি নোট রয়েছে :

ফ্রান্সিস র‍্যাণ্ডেল ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ক্রিসমাসের রাতে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু বরণ করেন। এ বইতে যে ভদ্রমহিলার কথা বলা হয়েছে তিনিই ওকে সর্বশেষ জীবিত দেখেন। তাঁকে সামনে আসার আহ্বান জানালেও তিনি কোনোদিনই তা করেননি। তাঁর পরিচয় রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *