ভোলানাথ সেন হত্যা মামলা ১৯৩১

ভোলানাথ সেন হত্যা মামলা ১৯৩১

তিনের দশকের উত্তর কলকাতা। কলেজ স্ট্রিট ততদিনে কলকাতা তথা গোটা অবিভক্ত বাংলার বইজগতের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। একদিকে হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুলের মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত স্কুল, অন্যদিকে প্রেসিডেন্সি কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, এতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চত্বরে গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য প্রকাশনা দপ্তর ও বইয়ের দোকান।

পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে গল্পের বই, বিদেশি জার্নাল থেকে শুরু করে দুষ্প্রাপ্য দুর্লভ কোনো পত্রিকা, কলকাতার বইপাড়া কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যায়না, এমন কোনো বই বলতে গেলে দুনিয়ায় নেই।

যে সময়ের কথা বলতে চলেছি, সেটা ১৯৩১ সাল।

কলেজ স্কোয়্যারের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে একটি ঝকঝকে বড় দোকান। দোকানটি কোনো খুচরো বিক্রেতার নয়, একটি প্রকাশক সংস্থার। বাজারচলতি বই, শিশু ও কিশোরপাঠ্য বই থেকে শুরু করে সাধারণ জ্যোতিষচর্চা বা ভাগ্য পরিবর্তন জাতীয় চুটকি বই, সব ধরনের বই এখানে মুদ্রিত ও বিক্রিত হয়।

দোকানের সর্বময় কর্তা শ্রীযুক্ত ভোলানাথ সেন নিজেও প্রকাশক ও বইব্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশি একজন লেখক। সাধারণ গল্পের বই নয়, তিনি ভালোবাসেন শিশু কিশোরদের জন্য গল্পের ছলে ইতিহাস ও ভূগোলের পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে।

ভোলানাথ সেন মধ্যবয়সি একজন নিপাট ভদ্রলোক। ব্যবসা করেন ঠিকই, কিন্তু চাল ডাল আলুর ব্যবসা আর বইয়ের ব্যবসার সংজ্ঞা তাঁর কাছে এক নয়। সহব্যবসায়ীমহলে বা কোনো সভাসমিতিতে তিনি সবসময় সোচ্চারে বলেন, বইয়ের ব্যবসা করতে গেলে লাভক্ষতির হিসেবের সঙ্গে থাকা প্রয়োজন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও। বই-ই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। বই-ই একটা শিশুর মাটির তালের মতো শৈশবকে সুন্দর আকার দেয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাই সারাদিনের ব্যবসা সামলে বাড়ি ফিরে হ্যারিকেনের আলোয় তিনি লিখতে বসেন ছোটদের জন্য বই। এমন বই যা পড়তে বাচ্চারা উৎসাহ পাবে, পড়ে আনন্দ পাবে, আবার তাদের মানসিক বিকাশও ঘটবে।

যে কালান্তক দিনে এই ঘটনার সূত্রপাত, সেটা গ্রীষ্মের এক তপ্তমুখর দিন।

১৯৩১ সালের ৭ই মে। সকালবেলা। কলেজ স্ট্রিটের ঘুম সবে ভেঙেছে। একে একে খুলছে ছোটবড় দোকান।

সকালের দিকে সাধারণ ক্রেতাদের থেকে পাইকারি বিক্রেতাদের ভিড় থাকে বেশি। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জ বা অন্যান্য শহর থেকে তারা ভোরের ট্রেনে এসে লম্বা ফর্দ ফেলে দেয় একেকটা প্রকাশনায়, লিস্টি মিলিয়ে পাইকারি দামে বই নিয়ে যায় নিজের জায়গায় বিক্রি করবে বলে।

ভোলানাথ সেনের দোকানেও সেদিন সকালে এমনই কয়েকজন বাইরের মফসসলের বিক্রেতাদের ভিড়। ভোলানাথ সেন নিজে কাউন্টারে বসে ক্যাটালগ মিলিয়ে মিলিয়ে বই খুঁজছেন। তাঁর পাশেই বসে রয়েছে দুই বিশ্বস্ত কর্মচারী সতীশ আর হরিদাস। তারা টাকাপয়সার হিসেব করছে।

 ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, সুকুমার সেনটা বের কর। কুড়ি পিস।’ ভোলোনাথ সেন হুকুম করলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনটা এনেছিস?’

‘হ্যাঁ বাবু।’ সতীশ ভেতরের গুদামঘরে গিয়েছিল, ফিরে এল বগলে সাত—আটটা বই নিয়ে, ‘আধুনিক বঙ্গের ভূগোলটা কার লাগবে বললেন যেন?’

‘এই যে আ-আমার! আট কবি।’ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভদ্রলোক একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন, ‘সুবিনয় গায়েন, বরিশাল বুক হাউজ।’

ভোলানাথ সেন কাগজটা নিয়ে হিসেব করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এইসময় ঘটে গেল ঘটনাটা।

সর্বসাকুল্যে বড়জোর পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড ধরে সংঘটিত হওয়া যে কাণ্ডের জন্য পরবর্তী একবছর ধরে আলোড়ন চলবে গোটা বাংলা, গোটা দেশে।

হঠাৎ করে দোকানের দরজা দিয়ে ঢুকে এল দুই যুবক। যুবক না বলে সদ্য তরুণ বলাই ভালো। বয়স আঠারো ছুঁয়েছে সবে। গালের সবুজ দাড়ি সবে ঘন হচ্ছে। দুজনেরই গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল। একজনের চোখে চশমা।

ভোলানাথ সেন জিজ্ঞাসু চোখে সবে বলতে যাচ্ছিলেন, ‘কী বই চাই তোমাদের?’

কিন্তু তিনি বলার সময় পেলেন না। দুজন আগন্তুক পোশাকের জেব থেকে বের করল একটা করে চকচকে ধারালো ছুরি। এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওপরে তুলে তারা চিৎকার করল, ‘আল্লা হু আকবর!’ তারপর প্রথম তরুণ সেই ছুরির ধাতব ফলাটা সটান ঢুকিয়ে দিল ভোলোনাথ সেনের বুকে।

কাউন্টারে দাঁড়ানো লোকেরা শিউড়ে উঠল, সতীশ আর হরিদাস চিৎকার করে উঠে মালিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল, কিন্তু তার আগেই দ্বিতীয় চশমাধারী তরুণটি তাঁদের শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে ছুরিকাঘাতে।

কয়েক সেকেন্ড মাত্র। উপস্থিত লোকদের ঘোর কাটার আগেই সেই দুই যুবক দোকান থেকে বেরিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে লাগল রাস্তায়।

মুহূর্তে চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরে গেল দোকান, কাউন্টারে দাঁড়ানো বইবিক্রেতাদের কয়েকজন হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে মোটা মোটা বই তাক করে ছুঁড়তে লাগল আততায়ীদের দিকে। কেউ কেউ পাশে রাখা জলের কলসি থেকে জল নিয়ে ঢালতে লাগল ভোলানাথ সেন, সতীশ আর হরিদাসের ক্ষতের ওপরে।

প্রবল আওয়াজ উঠল, ‘ধর ধর!’

দুই যুবক ব্যস্ত রাজপথের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটতে লাগল। ততক্ষণে পেছনে ধাওয়া করেছে আশপাশের দোকানদারদের একটা দল। কিন্তু জনস্রোতের মধ্য দিয়ে দুটো লোককে তাড়া করা খুব একটা সহজ কাজ নয়।

ছেলেদুটোর একজন ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরল। ফিরে চ্যালেঞ্জ জানানোর ভঙ্গিতে বলল, ‘কোই হ্যায় পকড়নেওয়ালা? তো আও!’

প্রথম যৌবন। অপরাধ করার পর ঔদ্ধত্যও থাকে কানায় কানায়। ছেলেটা কথা বলতে বলতে তার হাতের রক্তমাখা ছুরিটা ছুঁড়ে দিল পেছনে দৌড়নো জনতার দিকে। লোকজন থমকে গিয়ে পালাতে লাগল।

ঠিক এইসময় হঠাৎ করেই ঘটনায় একটা নাটকীয় মোড় নিল। রুটিন টহলদারিতে বেরিয়েছিল স্থানীয় থানার একজন কনস্টেবল ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সাবইনস্পেক্টর। তারা উলটোদিক থেকে আসছিল। জনতার চেঁচামেচিতে তারাও ওদের ধরার জন্য ছোটা শুরু করল।

যুবক দু-জন উভয়সংকটে সাময়িক ঘাবড়ে গেলেও হাল ছাড়ল না। রাজপথ ছেড়ে তারা ঢুকে পড়ল অপেক্ষাকৃত সরু গলি শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। কনস্টেবল আর এ এস আই মিলে একজন যুবককে ধরে ফেলল। অন্যজন পালিয়ে গেল।

ওদিকে ভোলানাথ সেন, সতীশ এবং হরিদাসকে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভরতি করা হল হাসপাতালে। ভোলানাথ সেন সেদিনই মারা গেলেন। বাকি দুজনও মারা গেল কয়েকদিনের মধ্যেই।

বইপাড়ার একজন নিরীহ প্রকাশক ও তাঁর কর্মচারীদের দোকানে ঢুকে দিনের বেলা এইভাবে নৃশংস হত্যায় সারা শহরে হইচই পড়ে গেল।

দ্বিতীয় যুবকটিকে পুলিশ ধরল ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই। লোয়ার চিৎপুর রোডে মুসা শেঠ নামক এক ব্যক্তির ‘মুসাফিরখানা’ লজ থেকে। তার নাম আবদুল্লা খান। বাড়ি অমৃতসর।

যে যুবকটিকে রাস্তায় ধরা হয়েছিল, তার নাম আমীর আহমেদ। আবদুল্লা খানের মতো সেও পাঞ্জাবি, তবে তার বাড়ি লাহোরে। পেশায় কামার।

সালটা ১৯৩১। লাহোর তখন ভারতেরই একটি শহর। কিন্তু সুদূর লাহোর থেকে কলকাতায় এসে এক প্রকাশককে সে খুন করল কেন?

খুনের আগের তিনদিন তারা রাত্রিবাস করেছিল লোয়ার চিৎপুর রোডের ওই মুসাফিরখানা লজেই।

কিন্তু কেন?

কী উদ্দেশ্য তাদের?

কলকাতা পুলিশ তদন্তে নেমে প্রথমেই লজের সেই ঘর সার্চ করল। ঘর থেকে মিলল দুটো স্টিলের ট্রাঙ্ক।

কী কী রয়েছে সেই ট্রাঙ্কে?

উত্তর-পশ্চিম রেলওয়ের একজন কর্মচারীর পাস। যা দেখে পুলিশ বুঝতে পারল, আবদুল্লা খান রেলওয়ের কর্মচারী। উত্তর-পশ্চিম রেলওয়েতে সে ছুতোরমিস্ত্রীর কাজ করে। তার বাবার নাম মীরন বক্স। বাড়ি অমৃতসর।

এছাড়া মিলল কিছু উর্দু বই, ৩রা মে, ১৯৩১ তারিখের লাহোরের একটি সংবাদপত্রের ছেঁড়া পাতা, ইংল্যান্ডের ইতিহাসের ওপর লেখা একটা বই এবং একখানা এয়ারগান।

ভারতীয় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা Criminal Investigation Department বা CID তখন খুবই সক্রিয়। গোটা কাণ্ডের তদন্তের ভার বর্তাল CID ইনস্পেক্টর গুলাম হায়দারের ওপর।

গুলাম হায়দার কাজের মানুষ। বেশি দেরি করলেন না। পরের দিনের ট্রেনে রওনা দিলেন অমৃতসর। সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করলেন আবদুল্লা খানের বাবা মীরন বক্সের বাড়ি।

মীরন বক্স তো অবাক। পুলিশ দেখে থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, আমার ছেলে? সে তো কয়েকদিন হল নেই। বন্ধুর সঙ্গে বাইরে কামধান্দায় গেছে।’

‘বটে? কীসের কামধান্দা? তোমার ছেলে তো রেলে কাজ করে।’ গুলাম হায়দার বললেন।

‘করলেও ও বাইরে টুকটাক কাঠের কাজ করে। আমি তো জানি ও সেখানেই গেছে। আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন?’

‘হ্যাঁ। তোমার ছেলে সেখানে একজনকে খুন করেছে।’ গুলাম হায়দার গম্ভীরমুখে বললেন।

পলকে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠল মীরন বক্সের মুখ, ‘হায় আল্লাহ! এ কী বলছেন আপনি! আমার ছেলে মোটে আঠেরো বছরের, সে কোনোদিনও বঙ্গালে যায়ইনি!’

গুলাম হায়দার বেশি কথা বাড়ালেন না। তার সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট ছিল, তিনি লোকাল কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে মিরন বক্সের বাড়ি তন্নতন্ন করে সার্চ করে ফেললেন।

বাড়ির যে ঘরে আবদুল্লাহ থাকত, সেই ঘর থেকে বেশ কিছু চমকপ্রদ জিনিস উদ্ধার হল। যেগুলো গোটা তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিল এক লহমায়।

এক, সরদা বিল, ১৯২৯ সালের বিরুদ্ধে প্রচার হওয়া অসংখ্য প্যাম্ফলেট।

যে সময়ের ঘটনা, তার ঠিক বছর দেড়েক আগে পাশ হয়েছে সরদা বিল। সেটা কী?

বিলটির অফিশিয়াল নাম Child Marriage Restraint Act. অর্থাৎ বাল্যবিবাহ বন্ধ করার আইন। এই আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ১৪ বছরের নীচে মেয়েদের বিবাহ ও ১৮ বছরের নীচে ছেলের বিবাহ দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করে বন্ধ করেছিল। এই আইনের জন্য সবচেয়ে বেশি গলা তুলেছিলেন বিচারপতি হরবিলাস সরদা। তাই তাঁর নামে এই আইন লোকমুখে সরদা বিল নামেই বেশি পরিচিত।

সরদা বিল পাশ হওয়ার সময় তার স্বপক্ষের চেয়ে বিপক্ষের দল ছিল অনেক বেশি ভারী। রক্ষণশীলরা রে রে করে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। সারা দেশ জুড়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়। মেয়েদের জ্ঞান হওয়ার আগেই তখন বিবাহ দেওয়া হত, শারীরিকভাবে পরিণত হওয়ার আগেই ঢুকে পড়তে হত সন্তান উৎপাদনের জাঁতাকলে। যার ফলাফল হত রুগণ সন্তান, রুগণ মা, অকালমৃত্যু এবং সর্বোপরি অশিক্ষা। সেই বিশদ আমি আমার ‘নারাচ’ উপন্যাসে বলেছি, তাই এখানে আর বিশদ বলছি না।

১৮৯১ সালের Age of Consent Act সহবাস সম্মতি আইনের সময় হিন্দু রক্ষণশীলরা প্রতিবাদ করলেও তার প্রায় ত্রিশ বছর পরের সরদা আইনের সময় প্রতিবাদ উঠেছিল মূলত মুসলিম সমাজ থেকে।

আবদুল্লাহ-র ঘর থেকে গুলাম আহমেদ যে প্যাম্ফলেটগুলো উদ্ধার করলেন, সেগুলো সব সরদা বিলের বিরুদ্ধে। ১৪ বছরের নীচে বিবাহ দেওয়াটা যে ইসলামসিদ্ধ এবং তা না করা মানে যে ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করা ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুই, খবরের কাগজের প্রচুর কাটিং যাতে রয়েছে ইলমুদ্দিনের ছবি ও সংবাদ।

কে এই ইলমুদ্দিন?

ইলমুদ্দিন ছিল লাহোরের এক উনিশ-কুড়ি বছরের ছুতোরমিস্ত্রী যে মাহাশে রাজপাল নামক এক প্রকাশককে নৃশংসভাবে মাথা থেঁতলে হত্যা করেছিল।

মাহাশে রাজপালের অপরাধ ছিল, তিনি রঙিলা রসুল নামক এক বই প্রকাশ করেছিলেন। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেইসময় হিন্দু রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান আর্য সমাজের সঙ্গে মুসলিম গোষ্ঠীগুলির সংঘাত চরমে পৌঁছেছিল। মুসলিম এক মৌলবাদী সংগঠনের তরফে একটি পাতলা বই প্রথমে প্রকাশিত হয়, যাতে শ্রীরামচন্দ্রজায়া সীতাকে বারবনিতা হিসেবে দেখানো হয়েছিল।

এই অপমানের প্রতিবাদে আর্য সমাজের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয় রঙিলা রসুল।

রঙিলা অর্থে রঙিন বা বর্ণময় (অবশ্যই ঋণাত্মক অর্থে)। এবং ‘রসুল’ অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের অবতার।

 রঙিলা রসুল বইতে হজরত মহম্মদের একাধিক বিবাহ ও বহুগামিতা সম্পর্কে বেশ কিছু সংবেদনশীল বক্তব্য ছিল, তা মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আপত্তিজনক মনে হয়েছিল। ‘রঙিলা রসুল’ বইটির লেখক কে, তা আজও অজানা। বইয়ের মলাটে পণ্ডিত চাম্পুটি লেখা থাকলেও তা যে ছদ্মনাম তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। অনেক চাপের মুখেও মাহাশে রাজপাল কিছুতেই মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লেখকের প্রকৃত নাম প্রকাশ করেননি। উর্দুতে লেখা বইটি আজও ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে নিষিদ্ধ।

মাহাশে রাজপালের ওপর একাধিক বার হামলা হয়। অবশেষে ১৯২৯ সালের ৬ই এপ্রিল ইলমুদ্দিন তাঁকে প্রকাশ্য দিবালোকে লাহোর বাজারের মধ্যে খুন করে।

ইলমুদ্দিনের পক্ষে আইনজীবী ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলী জিন্না দাঁড়ালেও বিচারপতি ফারুক হুসেইন ইলমুদ্দিনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং ১৯২৯ সালের ৩১শে অক্টোবর ইলমুদ্দিনের ফাঁসি হয়।

ইলমুদ্দিনের ফাঁসি তখন মুসলিম সমাজে এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। মৃতদেহ কবরস্থ করার সময় সমাধিক্ষেত্রে উপস্থিত ছিল ছ’লাখেরও বেশি মানুষ। কিংবদন্তি উর্দু কবি মহম্মদ ইকবাল, যিনি পরবর্তীকালে ‘পাকিস্তানের জাতীয় কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন, তিনি পর্যন্ত ইলমুদ্দিনের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত হয়ে বলেছিলেন, ‘We only kept talking. the carpenter’s son surpassed us.’

গুলাম হায়দার কিছু বুঝতে পারলেন না। ইলমুদ্দিনের ফাঁসি হয়েছে প্রায় দু-বছর আগে, সেইসময়ের এত পেপারকাটিং, ছবি আবদুল্লাহ ঘরে জমিয়ে রেখেছে কেন?

আবদুল্লাহ-র বাবা মীরন বক্স ভালো লোক। গুলাম হায়দারকে সঙ্গে করে তিনি নিয়ে গেলেন সাহু গলিতে, যেখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে আবদুল্লাহ তার কাঠের কাজ করত। সেখান থেকেও মিলল একইধরনের কিছু জিনিসপত্র।

অতিরিক্ত বলতে চোখে পড়ল, একটা বইয়ের কিছু ছেঁড়া পাতা। বইটা বাংলা ভাষায় লেখা, নাম প্রাচীন কাহিনী। লেখক ভোলানাথ সেন।

গুলাম হায়দার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ছেলে কি বাংলা পড়তে জানত?’

‘বাংলা?’ মীরন বক্স বলল, ‘কী করে জানবে সাহাব? আমরা সাতপুরুষ এই অমৃতসর থেকে কোথাও বেরোইনি! বাঙালি কাউকে চিনিই না আমরা!’

চিন্তিতমুখে দুজন ফিরে আসছেন, এমন সময় মীরন বক্স বলল, ‘সাহেব, আমি জানিনা আমার ছেলে কত বড় গুনাহ করেছে, তবু যদি মেহেরবানি করে একটা জায়গায় চলেন, তবে কিছু সাহারা মিললেও মিলতে পারে।’

‘কোথায়?’

মীরন বক্স বলল, ‘এই সাহু গলিতেই। রেল ওয়ার্কশপের একটা আড্ডা আছে, আবদুল্লাহ ওখানেই ফাঁক পেলে যেত। রেলের সব কর্মচারীরা মিলে চা খেত, গল্পগুজব করত।’

পুত্র হত্যাকারী জেনেও তার বিরুদ্ধে পুলিশকে সাহায্য করার মতো পিতার উদাহরণ ইতিহাসে কতজন আছেন, জানা নেই। তবু, মীরন বক্স এই কারণেই ব্যতিক্রম হয়ে থাকবেন।

রেলের সেই ওয়ার্কশপে যাওয়ার পর দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠল অনেক কিছু।

মাস চারেক আগে একজন রেলকর্মচারী হন্তদন্ত হয়ে এসে বলেছিল, ‘জানিস, কলকাতায় ভোলানাথবাবু বলে একজন একটা বই লিখেছে, যাতে নবীকে অপমান করা হয়েছে?’

‘কী!’ আবদুল্লাহ, আমীর ও তাদের বাকি বন্ধুরা তখন অলস বসেছিল। লোকটার কথা শুনে চমকে উঠল তাড়া, ‘কী বকোয়াস করছিস! ইলমুদ্দিনের পর তো এইসব লেখা ব্যানড হয়ে গেছে। অন্য ধর্ম নিয়ে উলটোপালটা লিখলেই পুলিশ গ্রেপ্তার করবে।’

‘আরে রাখ ওসব আইনের কথা!’ লোকটা একটা পাতলা বই সামনে ফেলে দিয়েছিল, ‘এই দ্যাখ।’

বইটার নাম ‘প্রাচীন কাহিনী।’ শিশুকিশোরদের জন্য গল্পের ছলে বিশ্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে এতে। খুন হওয়া প্রকাশক ভোলানাথ সেন খুব সহজসরল প্রাঞ্জলভাবে ইতিহাসকে তুলে ধরতে পারতেন। তিনি চেয়েছিলেন, ধর্মের বাতাবরণে বন্দি না হয়ে মুক্তমনে ছেলেমেয়েদের সবকিছু বোঝাতে। প্রস্তর যুগ, বৈদিক যুগ হয়ে তাঁর বইতে একে একে এসেছিলেন যীশুখ্রিস্ট এবং হজরত মহম্মদ। দুজনকেই মানবতার পূজারি ও ঈশ্বরের দূত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল সেখানে।

কিন্তু আবদুল্লাহ বা তার বন্ধুরা কেউই তো বাংলা পড়তে পারা ততো দূরে, বোঝেইনা। তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

বন্ধুটা তখন বলল, ‘বইয়ের ৯৬ পাতার ছবিটা দ্যাখ!’

সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল অমনি।

‘কত বড় স্পর্ধা চিন্তা কর! হজরত মহম্মদের ছবি এঁকেছে!’

সত্যিই তো! মহম্মদ কার সঙ্গে বসে যেন আলাপচারিতায় মগ্ন। উলটোদিকের মানুষটার আবার পেছনে দুটো ডানা। এত বড় দুঃসাহস? মহম্মদকে নিয়ে ইয়ার্কি?

হিব্রু বাইবেলে বর্ণীত দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে হজরতমহম্মদের আলাপচারিতা।
সেই বির্তকিত ছবি।
হিব্রু বাইবেলে বর্ণীত দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে হজরতমহম্মদের আলাপচারিতা।
সেই বির্তকিত ছবি।

আবদুল্লাহ বা তার সঙ্গীসাথীরা কেউই সেই অর্থে শিক্ষিত ছিল না। তাই তারা জানতেও পারল না, যে ছবিটি ভোলানাথ সেন বইতে দিয়েছিলেন, সেটি তাঁর বা কোনো ভারতীয় শিল্পীর আঁকা নয়। ছবিটি এঁকেছিলেন পঞ্চদশ শতকের একজন তুর্কি শিল্পী।

ছবিটিতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ বসে বাক্যালাপ করছেন হিব্রু বাইবেলে বর্ণীত দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে। দুজনেরই মুখে হাসি, চোখে প্রশান্তি। দুটি ধর্মের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও সৌহার্দ্যতার ভাব এই ছবিকে অনন্য করে তুলেছিল। যে কারণে ছবিটিকে পরে মুসলিম ধর্মগ্রন্থ ‘কোরআন’ এর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এডিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এবং হিন্দু ও মুসলিম দুই ধরনের সদস্য থাকা ভারতীয় শিক্ষা কমিটি ছবিটিকে পাঠ্যপুস্তকে দেওয়ার অনুমতিও দেন।

কিন্তু এত কথা তো আবদুল্লাহ, আমীর বা তার বন্ধুস্থানীয়রা জানে না।

মহম্মদের ছবি দেখে অগ্রপশ্চাৎ কিচ্ছু না জেনে না বুঝে তারা আক্রোশে উন্মত্ত হয়ে উঠল। ২২শে ফেব্রুয়ারি ওই ওয়ার্কশপেই এসে গুলাম মহম্মদ নামক এক উগ্র ধর্মগুরু এই বইয়ের বিপক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে গেলেন। আপাতভাবে সেই সভা শান্তভাবে মিটলেও সবাই রাগে ফুটতে লাগল। প্রায় সাড়ে তিনমাস ধরে এই নিয়ে ক্রোধোন্মত্ত হতে হতে আবদুল্লাহ আর আমীর একদিন চড়ে বসল কলকাতাগামী ট্রেনে।

শুধুমাত্র বইয়ের লেখক অচেনা ভোলানাথ সেনকে খুন করবে বলে।

সমস্ত তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষীসাবুদ সংগ্রহ করে গুলাম হায়দার কলকাতায় ফিরে এলেন। ১৯৩১ সালের ৫ই জুন আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানকে আদালতে তোলা হল। ফাইল করা হল The Emperor of India VS Abdulla Khan and anr মামলা।

সরকারি পক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর বললেন, ‘ধর্মাবতার! এই কেস দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট ও সহজবোধ্য। ভোলানাথ সেন যদিও বা মহম্মদের একটি সর্বজনগ্রাহ্য বিখ্যাত ছবি তাঁর বইতে দিয়েছিলেন, আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানের তা সহ্য হয়নি। কচি বয়সের অজ্ঞানতা ও অশিক্ষাজনিত ঔদ্ধত্য, অমৃতসর থেকে এসে তারা খুন করে ভোলানাথ সেনকে। প্রকাশনার ঠিকানা দেওয়া ছিল বইতেই। হত্যার সময় বাধা দিতে যাওয়ায় খুন করা হয় কর্মচারী সতীশ ও হরিদাসকেও। খুন করার আগে তারা ‘আল্লাহু আকবর!’ বলে চেঁচিয়েও উঠেছিল। ভোলানাথ সেন একজন শিক্ষাবিদ ছিলেন। নবীন প্রজন্মের জন্য বই লেখায় তাঁর অবদান অপরিসীম। তাঁর মতো নিরপরাধ একজন গুণী মানুষকে অকারণে হত্যা করার মতো ঘৃণ্য অপরাধের জন্য আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ ও নথি পেশ করা হয়েছে।’

ভোলানাথ সেনের দোকানে সেইসময় যারা উপস্থিত ছিলেন, সাক্ষ্য দিতে এসে তাঁরা সকলে একই কথা বললেন। খুনের অব্যবহিত পরেই আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানকে red handed ধরা হয়েছে, তাই সকলের বয়ান বিবেচনা করে ওই দুজনকে শাস্তি দিয়ে মামলার ফাইল বন্ধ করা ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

কিন্তু তা হল না। হল না একটিমাত্র মানুষের জন্য। এবং সেই ব্যক্তির হস্তক্ষেপে এই সাধারণ কেসটি ঝড় তুলে দিল গোটা দেশে। চলল তোলপাড়।

ভদ্রলোকের নাম এ কে ফজলুল হক। দোর্দণ্ডপ্রতাপ আইনজীবী এবং পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালে তিনিই হবেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর তিনি চলে যাবেন পাকিস্তানে, হবেন সে’দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

মুসলিম আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা প্রবল প্রতাপান্বিত ফজলুল হক ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। বাংলা তো বটেই, গোটা দেশের চোখে বিখ্যাত রাজনৈতিক চরিত্র। আমজনতার চোখে তিনি পরিচিত ‘শের-ই-বাংলা’ নামে।

 এহেন বাংলার শের দাঁড়ালেন ডিফেন্স কাউন্সেল হয়ে অর্থাৎ আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানের স্বপক্ষে। এবং দাঁড়ানোমাত্রই তিনি মোড় ঘুরিয়ে দিলেন গোটা মামলার।

নিজের উদাত্ত বক্তৃতায় নস্যাৎ করে দিতে লাগলেন একের পর এক যুক্তি। তিনি এবং সহকারীরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেরা করতে লাগলেন প্রতিটি প্রত্যক্ষদর্শীকে। এমনকি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা তাড়া করা কন্সটেবল-সাব ইনস্পেক্টররাও রেহাই পেলেন না।

‘ইয়োর অনার! ফরেনসিক সার্জন যেখানে রিপোর্টে পরিষ্কার লিখেছেন যে, মি. ভোলানাথ সেনের বুকের ক্ষত প্রায় সাড়ে ছয় ইঞ্চি গভীর, সেখানে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া ছুরির দৈর্ঘ্য ছয় ইঞ্চি। আপনিই বলুন, ছয় ইঞ্চির ছুরি দিয়ে সাড়ে ছয় ইঞ্চির ক্ষত সৃষ্টি করা কীভাবে সম্ভব?’

‘ইয়োর অনার! অকুস্থলে যারা উপস্থিত ছিল, প্রত্যেকে ভোলানাথ সেনের ঘনিষ্ঠ। কয়েকজনকে ভোলানাথ সেন ধারও দিতেন নিয়মিত। সেক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের নিরপেক্ষতা নিয়ে কি প্রশ্ন ওঠেনা? কে নিশ্চিত করে বলতে পারেন যে হত্যার আগে চিৎকার করে ওঠা ‘আল্লাহু আকবর’ এই ঘনিষ্ঠজনদের উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়?’

‘ইয়োর অনার! সবচেয়ে বেশিদিন বেঁচে ছিল দোকানের কর্মচারী সতীশ। তার হসপিটালের বেডের সামনে আয়োজন করা প্যারেডে দ্রুত আমীর ও আবদুল্লাহকে শনাক্ত না করে কেন অত্যধিক সময় নিয়েছিল সে? কেনই বা একজন ব্রিটিশ ওয়ার্ডেন নিজের কাস্টডির আসামি থাকা সত্ত্বেও ফারাক করতে পারেনি দুজনের মধ্যে? তার কারণ, দুজন সমবয়সি মুসলিম যুবকের চেহারা বেশিরভাগ সময়েই একরকম হয়। গালের চাপ দাড়ি, মাথার ফেজ টুপি ও অন্যান্য সাদৃশ্য গুলিয়ে দেয় সহজ শনাক্তকরণ।’

‘আপনি কী বলতে চাইছেন?’ বিচারপতি লর্ড উইলিয়ামস প্রশ্ন করলেন।

‘মাই লর্ড!’ মাথা নীচু করে সম্মান জ্ঞাপন করলেন ফজলুল হক, ‘আমি বলতে চাইছি, আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খান নির্দোষ। উনিশ বছরের তরুণ তারা, তাদের ওপর এই অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ওরা কোনো ব্যতিক্রম নয়। এভাবেই হাজার হাজার মুসলিম বিচারক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যে অপরাধে কোনো হিন্দু আসামি সামান্য কয়েকদিন জেল খেটে বেকসুর খালাস হচ্ছে, সেই একই অপরাধে মুসলিম আসামিকে ঝুলতে হচ্ছে ফাঁসিকাঠে। এই অবিচার আমরা মেনে নেব না। প্রয়োজনে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাব।’

গোটা দেশে শোরগোল পড়ে গেল। মুসলিম সমাজের মধ্যে খুব দ্রুত ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কেউ জানল না নেপথ্যকাহিনী, জানার চেষ্টাও করল না।

সারা দেশে রটে গেল, ‘আমাদের মহম্মদের অপমান করে বিকৃত ক্যারিকেচার করে কার্টুন এঁকেছিল লোকটা। তাকে খুন করেছে বলে দুটো বাচ্চা ছেলের সাজা হতে চলেছে।’

ফজলুল হক কোর্টে নিয়ে এলেন কলকাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রায়বাহাদুর হিদায়েত হুসেইনকে।

হিদায়েত হুসেইন পরিষ্কার বললেন, ‘মহম্মদের ছবি বইতে দিয়ে ভোলানাথ সেন ইসলাম ধর্মকে অপমান করেছিলেন। এবং সেই অপরাধ শাস্তিযোগ্য।’

সরকারি পক্ষের কৌসুলি বললেন, ‘যে ছবি ভোলানাথ সেন বইতে দিয়েছিলেন, সেই একই ছবির পোর্টেট কয়েকদিন আগে উদ্বোধন করা হয়েছে গভর্নমেন্ট হাউজে। আপনি তবে সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কেন?’

‘উপস্থিত ছিলাম কী হয়েছে? কোনো অনুষ্ঠানে কিছু মানুষের উপস্থিতির অর্থ এই নয় যে তা ইসলামকে অপমান করতে পারে না।’ হিদায়েত হুসেইন বললেন।

বিচারপতি লর্ড উইলিয়ামস কিছুদিন শুনানি চলার পর রায় দিলেন।

‘আমীর আহমেদ ও আবদুল্লাহ খান যে ধর্মীয় উন্মত্ততার কারণে অমৃতসর থেকে কলকাতায় এসে ভোলানাথ সেনকে খুন করেছে, তা প্রমাণিত। সরকার ধর্মীয় আবেগকে সম্মান করে, কিন্তু উন্মত্ততাকে নয়। হিংসাকে নয়। তাই দুজনকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হল।’

এই রায় ঘোষণামাত্র সারা দেশে উত্তেজনার আঁচ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আরেকটা ইলমুদ্দিন কাণ্ড কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। ফজলুল হক অনেক মান্যগণ্য মুসলিম ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে মৃত্যুদণ্ড রদের আর্জি পাঠালেন লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলে। সাময়িকভাবে সাজা স্থগিত হয়ে গেল।

১৯৩২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি বাংলার বিধানসভার তিন সম্মানীয় সদস্য স্যার আবদুল্লাহ সুরাওয়ার্দি, ঘুজানভি এবং আসরাফ আলী খান টেলিগ্রাফ করলেন খোদ বাকিংহাম প্যালেসে।

‘মহম্মদের ক্যারিকেচারের প্রতিবাদে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত দুই সদ্যযুবককে মুক্তি দেওয়া হোক। সমগ্র মুসলিম সমাজের তরফ থেকে এই অনুরোধ।’

আবদুল্লাহ সুরাওয়ার্দি আরও বললেন, ‘ভুলে যাবেন না, আমার ভাইপো হাসান সুরাওয়ার্দি কিছুদিন আগে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার মহামান্য গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে ছাত্রী বীণা দাসের গুলি থেকে বাঁচিয়েছে। এতবড় উপকার করল যে সম্প্রদায়, তাদের প্রতি কি সরকারের কি কোনো কৃতজ্ঞতা বা দায়বদ্ধতা নেই?’

তদন্তের বিশদ জোগাড় করতে গিয়ে ক্রমাগত আশ্চর্য হয়েছি। কারণ যে ছবিটি নিয়ে এত কাণ্ড, তা আঁকা হয়েছিল বহুশতাব্দী আগে, তুর্কি ও পার্সি মিশ্র ঘরানায়। তার সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই। আর তার চেয়েও বড় কথা, যারা প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁরা অনেকেই উচ্চশিক্ষিত।

অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিমও ফাঁসির স্বপক্ষে মত দিয়েছিলেন, তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন যে ওই ছবিতে কোনোভাবেই মহম্মদকে ছোট করা হয়নি। এবং গোটা বইটিতেই একটি সুন্দর সব ধর্মের সমন্বয়ের সুর রয়েছে। ভোলানাথ সেনের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। আমীর ও আবদুল্লাহ অবশ্যই দোষী।

তবে এই মতবাদের মানুষরা তখন সংখ্যালঘু।

যদিও শেষরক্ষা হল না। গোটা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে হতে থাকা আন্দোলনে কর্ণপাত না করে ব্রিটিশ সরকার ফাঁসির সাজা বহাল রাখল। ১৯৩২ সালের ১০ই মার্চ চূড়ান্ত সতর্কতার মধ্যে আমির আহমেদ ও আবদুল্লাহ খানের ফাঁসি হয়ে গেল।

কাহিনীর শেষে এসে সেই বিতর্কিত ছবি, যার জন্য অকালে ঝড়ে গিয়েছিল তিনটি তরতাজা প্রাণ, তা না দিলে কাহিনীটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।

 মাঝখান থেকে খুন হতে হল ভোলানাথ সেনকে। যিনি ছাত্রছাত্রীদের দিতে চেয়েছিলেন সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বার্তা।

শেষ করব একটি বহুলপ্রচলিত কাহিনী দিয়ে। যা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকৌতুক হলেও গভীর অর্থ বহন করে।

এক হিন্দু দম্পতি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছে। রাস্তায় অমুসলিম কাউকে দেখতে পেলেই জঙ্গিরা ধরে ধরে গুলি করছে।

দম্পতির গাড়িও আটকানো হল।

জিজ্ঞেস করা হল, ‘তোমরা কি মুসলিম?’

স্বামীটি নির্ভিক চিত্তে বললেন, ‘হ্যাঁ।’

জঙ্গি বন্দুকের নল উঁচু করে তুলে ধরে বলল, ‘কোরআনের দুটো আয়াত বলো।’

স্বামীটি দৃপ্তকণ্ঠে বলে গেলেন।

‘বহত খুব। আল্লাহু আকবর!’ জঙ্গিটি সেলাম ঠুকে গাড়ি ছেড়ে দিল।

গাড়ি যখন কিছুদূর চলে এসেছে, স্ত্রী বললেন, ‘আরে তুমি তো গীতার শ্লোক বললে!’

স্বামী হেসে বললেন, ‘তো কী! দেখলে না, কেমন সেলাম ঠুকে ছেড়ে দিল! আসলে যারা দাঙ্গা বাধায়, তারা কোরআনও পড়েনি, গীতাও পড়েনি।’

এই গল্পটিকে আপনার ইচ্ছেমতো হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান, যে কোনো ধর্মমতে পড়তে পারেন। দেখবেন, কোরআন, গীতা, বাইবেল বা জেন্দ আবেস্তা, সবেতে একই কথা বলা হয়েছে।

তা হল মানবতার জয়গান।

কৃতজ্ঞতা

Images of Islam: A Murder in Colonial Calcutta, Nandini Chatterjee, Department of History, University of Exeter

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *