ভোর হল দোর খোল
[ শো ওয়ার ঘর/মশারি/ভেতরে স্বামী-স্ত্রী/সকাল/কড়া নাড়ার শব্দ/প্রবল থেকে প্রবলতর] ভেসে-আসা কন্ঠস্বর : ও দিদিমণি দরজা না খুললে লাইন কেটে যাবে।
মশারির ভেতর ধড়মড় করে উঠে বসলেন কর্তা, মশারির একটা পাশ তুলে নেমে এলেন। ঘুমচোখে দরজা খুলে দিয়ে বিছানার একপাশে বসে আড়মোড়া ভাঙছেন।
স্ত্রী : কি খুলে দিয়ে এলে?
স্বামী : জেগে শুয়েছিলে মটকা মেরে! শুনলে যখন, উঠলে না কেন?
স্ত্রী : তোমার অভ্যাসটা যাতে ঠিক থাকে। জানো তো, আলস্যই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। নিজেকে সব সময় ফিট রাখতে হয়। সদাতৎপর।
স্বামী : রোজ আমাকে আগে উঠতে হবে কেন?
স্ত্রী : যেহেতু তুমি রোজ আমার আগে ধপাস করো। ছেলেবেলায় পড়োনি।
Early to bed and Early to rise
makes one healthy, wealthy and wise.
স্বামী : কাল থেকে আমি যদি না উঠি।
স্ত্রী : না উঠে তুমি পারবেই না; কারণ ছেলেদের সহ্যশক্তি খুবই কম। মেয়েদের সহিষ্ণুতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। কড়া নাড়ার শব্দে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়বে। পড়বেই পড়বে। লাস্ট ফোর ইয়ার্স একদিনও পেরেছ, আমার মতো বিছানা কামড়ে শুয়ে থাকতে! আমাদের মেজাজ হল টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাটসম্যানের মতো। ক্রিজ কামড়ে পড়ে থাকি। রানও করি না, আউটও হই না।
[মশারি তুলে নেমে এলেন]
স্ত্রী : সবে মিলি করি কাজ, হারিজিতি নাহি লাজ। মশারিটা তুলে চাদরটা টানটান করে, বেডকভারটা পেতে দাও।
স্বামী : কেন, তুমি পারছ না?
স্ত্রী : রাতে আমার, সকালে তোমার। সকালে প্রত্যেক পুরুষেরই একটু ব্যায়াম করা উচিত। এই ঝাড়াঝাড়ি চারপাশে ঘোরাঘুরিটাই তোমার ব্যায়াম। সকালে মর্নিং ওয়াক, একটু ফ্রি-হ্যান্ড তো তোমার ধাতে সইবে না, তাই কায়দা করে এই বিছানা-ব্যায়ামটা করিয়ে নি।
স্বামী : আমার বাস-ব্যায়ামটার খবর রাখো। সকাল-বিকেল বাসে জনগনের সঙ্গে কোস্তাকুস্তি। কাঁপ ছিটকে যাওয়ার দাখিল।
স্ত্রী : ওটা তোমার ব্যায়াম নয়। সাধনা। লোকে গাইয়ে হওয়ার জন্য গলা সাধে, তুমি সাধ শরীর। ওই খেলাটুকু দেখাও বলেই মাসের শেষে দাওয়াই মেলে। রোজ আসা-যাওয়ার ঘণ্টাদুয়েক পেন্ডুলামের মতো দোলো বলেই সংসার ঘড়িটা সচল আছে।
[স্ত্রী বেরিয়ে গেলেন। স্বামী বিছানা মেরামতে ব্যস্ত। স্ত্রীর বালিশের তলা থেকে নোটের একটা রোল বেরোল। খুলে দেখলেন, তিনটে ২০ টাকার নোট।]
স্বামী : পেয়েছি, পেয়েছি। পরশু দিন পকেট থেকে হাওয়া হয়েছিল, আজ ফিরে এল। হজম করতে পারলে না ম্যাডাম। কাঁচা চোর। এইবার চোরের ওপর বাটপাড়ি।
[বইয়ের র্যাকের দিকে এগিয়ে গেলেন। একটা বই টেনে রবীন্দ্র রচনাবলী, দশমখণ্ড, একশো বত্রিশ পাতা। এই রইল তিনকুড়ি ষাট।]
[খাটের দিকে এগোচ্ছেন, স্ত্রীর পুন:প্রবেশ।]
কী হল! ফিরে এলে।
স্ত্রী : বালিশের তলায় কানের দুল ফেলে গেছি।
স্বামী : দুল তো তোমার কানেই দুলছে।
স্ত্রী : দুল নয়, আংটি।
স্বামী : আংটি তো তোমার আঙুলে।
স্ত্রী : [রেগে গিয়ে] বালিশের তলাটা দেখলে তোমার আপত্তিটা কিসের।
স্বামী : কোনও আপত্তি নেই।
স্ত্রী : বালিশটা উলটে ফেললেন।
স্ত্রী : কোথায় রেখেছ?
স্বামী : কী কোথায় রেখেছি?
স্ত্রী : টাকা?
স্বামী : টাকা? সে আবার কী?
স্ত্রী : টাকা কাকে বলে জানো না, তাই না।
স্বামী : তা জানব না কেন,
যখন তব জন্ম হইল ট্যাঁকশাল উদরে।
স্বর্গ হতে দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করে।।
টাকা নামে খ্যাত হলে এ বঙ্গমাঝারে।
অর্থ নামে সাধু ভাষা শুনি যে সংসারে।।
রজতখণ্ডের নাম জানে পুরোহিত।
মুদ্রারূপে করে তুমি সকলের হিত।।
মূলধন নাম তব জানে সর্বজন।
রূপেয়া দিয়াছে নাম হিন্দুস্থানীগণ।।
টঙ্কা নামে হও উড্রদেশের গোচর।
সুবর্ণগঠিত হয়ে হও যে মোহর।
গিনি নামে প্রচলিত তুমি বর্তমানে।
প্রণামি নামেতে যাও গুরুর চরণে।।
এ সংসারে সার জেনো শুধু এক টাকা।
টাকা বিনা জেনো ভবে সব কিছু ফাঁকা।
টাকাতে আত্মীয়-বন্ধু টাকাতে সকল।
টাকা না থাকিলে ভবে জনম বিফল।।
স্ত্রী : শোনো, সাতসকালে ভেজোর ভেজোর ভালো লাগে না, হোয়্যার ইজ মাই ষাট টাকা।
স্বামী : আই ডোন্ট নো।
স্ত্রী : জানো, আমার মাইগ্রেন আছে টেনশানে মাথা ধরে। মাথা ধরলে তিন দিন….
স্বামী : চোখে সরষে ফুল।
স্ত্রী : তাহলে কেন অমন করছ।
স্বামী : গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে পথে পথে
গেয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে,
ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলুম?
প্রথমে মাসি-পিসি তারপরে ঘুংড়ি কাশি
ট্যাঁ করে জন্মে আমি কী পেলুম?
[যথোচিত সুরে/ খোল সহযোগে।]
স্ত্রী : কেন? কেন?
আমার মতো বউ পেলে
বিশ ভরি সোনা পেলে
খাট পেলে গদি পেলে
ফ্রিজ পেলে টিভি পেলে
নগদ পেলে দশ হাজার।
[যথোচিত সুরে/ খোল সহযোগে।]
স্বামী : সবই তো বেরিয়ে গেল তোমার সেবায়।
সকালে মাথাধরা, সন্ধ্যায় পেট ব্যথা।।
মাঝরাতে দাঁত ব্যথা, শেষ রাতে হাঁচি।
আলসার, গলব্লাডার, রোগের রজনীগন্ধা।
[সুরে]
স্ত্রী : সার্ভিসিং-এ তো খরচ হবেই মাই ডিয়ার, সার। মটোর গাড়িকে গ্যারেজে পাঠাতে হয়। টিভি, ফ্রিজ, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার সার্ভিস করাতে হয়, বাড়ি রং করাতে হয়। মানুষও তো একটা যন্ত্র, প্রভু। শুধুই সার্ভিস দিয়ে যাবে, সার্ভিসিং হবে না, তা তো হয় না। এখন দয়া করে টাকাটা ফেরত দাও।
স্বামী : ওটা তো আমার পকেট থেকে মেরেছিলে।
স্ত্রী : আমার পকেট তো একটাই, তোমার পকেট থেকে মারব না তো কী শ্যামবাবুর পকেট মারতে যাব। আর এই তোমার আমার বিভেদটা ছাড়ো। আমরা এক। এই মানবশৃঙ্খল, সম্প্রীতি আর সদ্ভাবনার যুগে একটাই কথা—ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল, স্বামী-স্ত্রী, ভাই ভাই, ইনক্লাব জিন্দাবাদ, তোমার টাকা আমার টাকা। একমাত্র টাকা ছাড়া মানুষের নিজস্ব কিছুই নেই। তোমার টাকা, তোমারই টাকা।
[কাজের মেয়ের প্রবেশ। বেশ আপটু-ডেট সাজ-পোশাকে]
কাজের মেয়ে : বউদি, আমার সব হয়ে গেছে। সাত দিন আসব না।
স্ত্রী : সে কী রে! সাতদিন আসবি না।
মেয়ে : পুরী বেড়াতে যাব। আউটিং।
স্ত্রী : সে কী রে।
মেয়ে : ষাট টাকা দাও। খরচপত্তর আছে।
স্ত্রী : [স্বামীকে] টাকা?
স্বামী : ঠিকই তো, আমার বলে তো কিছুই নেই, সবই তোমার। টাক আমার টাকা তোমার।
স্ত্রী : [মেয়েটিকে টাকা দিতে দিতে] ঠিক সাতদিন তো।
মেয়ে : দেখি, ফিরে এসে শরীর কেমন থাকে! বাসে করে পুরী যাওয়ার ধকল তো কম নয়! তুমি তো সেবার সাউথ ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে সাতদিন বিছানায় পড়ে রইলে।
[বিনুনি দুলিয়ে বেরিয়ে গেল]
স্ত্রী : কী বুঝলে!
স্বামী : হাতে হারিকেন।
স্ত্রী : আর চলবে না। আমেরিকা হয়ে যাচ্ছে। এইবার নিজেদের কাজ নিজেদেরই করে নিতে হবে। তুমি শালপাতা কিনে আনো।
স্বামী : শালপাতা।
স্ত্রী : থালা-বাটি এই সাতদিন বেরোবে না। কে বসে বসে মাজবে। আমরা শালপাতায় খাব, যেন নেমন্তন্ন খাচ্ছি, আর গরুতে খাবে শালপাতা। আর কিছু কাগজের গেলাস কিনে আনো, তাইতে চা খাওয়া হবে। ঘরদোর তুমিই ঝাঁট দিয়ে মোছামুছি করে দিও। সবচেয়ে বড় সমস্যা তো ওইটাই। তোমার ব্যায়ামকে ব্যায়াম হবে আর কাজটা যদি ঠিকমতো ধরে নিতে পারো, তাহলে পয়সাও বাঁচবে—small savings মাসে মাসে একশো মানে বারোশো বছরে। কুড়ি বছর পরে কত হবে। কুড়ি ইনটু বারো তারপরে আরও তিনটে শূন্য।
স্বামী : ক্যালকুলেটার চাই।
স্ত্রী : সেই টাকাটাকে ফিক্সড ডিপজিটে রাখলে তেরো পারসেন্ট ইন্টারেস্ট। আরও দশ বছর পরে তোমার রিটায়ারমেন্টের সময় কত টাকা হবে একবার ভেবে দেখছ! তাই না বলে, Little drops of water, little grains of sand….
স্বামী : বাকিটা আর বলতে হবে না।
স্ত্রী : সেদিন একটা মেয়েদের ম্যাগাজিনে পড়ছিলুম, রোজ ঘর মুছলে ব্লাড সুগার হবে না, অর্থারাইটিস হবে না, যৌবন একেবারে সেঁটে থাকবে শেষ জীবন পর্যন্ত।
স্বামী : মেয়েদের ম্যাগাজিনে তো মেয়েদের কথা বলে।
স্ত্রী : না না, স্বামী-পালন পদ্ধতি শেখাচ্ছে, স্বামীদের কন্ট্রোলে রাখার কায়দা, স্বামীদের স্বভাব সংশোধন কায়দা—নিয়মিত ব্যায়াম করান, ভুঁড়ি সঙ্কোচন, যাতে ঘাড়ে গর্দানে না হয়ে যায় সেদিকে নজর রাখুন। তুমি বুঝতে পারো না, তোমাকে কেমন করেন মর্নিংওয়াক করাই।
স্বামী : কায়দাটা কী?
স্ত্রী : একসঙ্গে একেবারে কোনও জিনিস আনাই না। বারেবারে বাজার ছোটাই। যেই এসে দাঁড়ালে, অমনি আর একটা। তুমি ভাবো, আমি ভুলে যাই, আজ্ঞে না। তোমাকে ছোটাছুটি করানোটাই আমার উদ্দেশ্য। যত ছুটবে তত দেরিতে বুড়ো হবে। জানো তো গণ্ডার কখনও বুড়ো হয় না, কারণ ছোটে। আর গণ্ডারের চামড়া খুব পুরু। তোমার চাওড়াও যাতে বেশ পুরু হয়ে যায় সেইজন্যেই উঠতে বসতে কড়া কথা বলি। পুরুষ জাতটা কী রকম জানো, আদর দিলেই মাথায় ওঠে। খেতে পেলে শুতে চায়। তাদের সবসময় নরমগরম ট্রিটমেন্টে রাখতে হয়। হাফ-হাফ।
স্বামী : হাফ-হাফ মানে?
স্ত্রী : পাঁচটা মিষ্টি কথা বললে তো, পাঁচটা কড়া কথা। রাশ আলগা দিয়েছ কী মরেছ। তোমাদের স্বভাব হল বেড়ালের স্বভাব। নরম মাটি দেখলেই আঁচড়াবে।
স্বামী : তোমাদের দ্বারা আর ঘর-সংসার হবে না, মেনকা। তোমাদের মগজে পলিটিকিস ঢুকে গেছে। আর কোনও আশা নেই। হোম হোম সুইট হোম আর কেউ বলবে না।
স্ত্রী : কেন বলবে! সেদিন একটা প্রাচীন ভক্তিগীতি শুনছিলুম, সংসার সমরাঙ্গনে জীব সাজ সমরে। এটা তো বিপ্লবের যুগ, লড়াই-লড়াই, লড়াই-লড়াই, ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ষাটটা টাকা দিও।
স্বামী : এই তো দিয়ে দিলুম।
স্ত্রী : নিয়ে তো চলে গেল।
স্বামী : দিলে কেন?
স্ত্রী : মোটা মাথা, বুঝবে না। ও তো টাকা দেওয়া নয়, তেল দেওয়া। একটু আস্কারা দেওয়া, যাতে ঠিক সাতদিন পরে প্রেমসে আসে। ষাটটা টাকা দিও, আজ সেলুনে যাব। চুল কাটতে।
স্বামী : আমাদের সেলুনে এখনও পাঁচ টাকা।
স্ত্রী : তাই তো আমাদের সেলুনের নাম বিউটি পার্লার।
[ঘড়ির আওয়াজ]
এই। সর্বনাশ, সাতটা বেজে গেল। আমি চায়ের জলটা চড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছি, তুমি ছেঁকে ফ্যালো।
স্বামী : এইটা তোমার নতুন কায়দা শুরু হয়েছে।
স্ত্রী : তোমাকে আমি আস্তে আস্তে সায়েব করে দেব, একেবারে ইংলিশ মিডিয়াম। সাযেবরা সকালে উঠে চা তৈরি করে। তার মধ্যে আলাদা একটা আভিজাত্য, আলাদা একটা রোমন্স। চায়ের গন্ধে যেন কবিতার লাইন :
ভোর হল দোর খোল / খুকুমণি ওঠ রে
ওই দেখ জুই শাখে / ফুল খুকি ছোটরে
রবিমামা দেয় হামা….
[দৃশ্যান্তর]
[চায়ের জল ফুটছে /গ্যাসের টেবল /চায়ের কৌটো/চামচে আছে, চা নেই।]
স্বামী : আরে। তোমার চা কোথায়।
স্ত্রী : [অন্তরাল থেকে] এই যা:, কাল তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। ছুটে গিয়ে নিয়ে এসো না গো!
স্বামী : ফার্স্ট রাউন্ড গরম জলই হোক। সেকেন্ড রাউন্ডে না হয় চা হবে।
[দর্শকদের দিকে ঘুরে]
আহা! যেমন লিকার তেমন ফ্লেভার।
।। সামনে অন্ধকার ।।
দৃশ্য : এক।। একটি ঘর। চারিদিকে দারিদ্রের ছাপ। ঘরে প্রবেশ করার একটি মাত্র দরজা। ছোট ছোট জানালা দিয়ে অল্প একটু আলো-বাতাস যেন চুরি করে ঢোকে। একটি চারপায়ার ওপর ময়লা বিছানা। বিছানায় বসে আছেন একটি মধ্যবয়সি শীর্ণ মানুষ। নাম অতুল। দরজার কাছে একটি ১৩-১৪ বছরের ছেলে। অতুলের ছেলে। নাম মলয়। সময় সকাল।
অতুল। আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারব না। যাও, রোজগারের চেষ্টা দেখ। আজ থেকে ভাত বন্ধ। ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। বসে বসে অন্ন ধ্বংস করবে, ওটি আর হচ্ছে না। বুঝেছ নবাব পুত্তুর—
মলয়। বারে, আমি কী করব? আমার কি রোজগারের বয়স হয়েছে। কে আমাকে চাকরি দেবে। আমার কী যোগ্যতা আছে? যা খুশি, তাই বলছ? আমি লেখাপড়া করব।
অতুল। লেখাপড়া করবি। পণ্ডিত হবি। জানিস, ইঞ্জিনিয়াররাও বেকার বসে আছে। আর তোর মতো মূর্খের পেছনে লেখাপড়ার জন্যে টাকা খরচ করে লাভ কী? খেটে খা। দিনমজুরী কর। এ দেশে মজুরের দাম ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে বেশি। লেখাপড়া শিখে আর কাপ্তেনি করতে হবে না, বুজেছিস? খাটো খাও, এই আমার সাফ কথা।
[অতুলের স্ত্রী শরমার প্রবেশ। হাতে একগ্লাস দুধ ছাড়া ফিকে চা। অতুলকে চা দিয়ে]
সরমা। সকাল থেকেই লেকচার। তোমার লেকচারে কারুর পেট ভরবে না। যাও, রেশন নেওয়ার ব্যবস্থা করো।
অতুল। চুপ করো। আজ আমি সকলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে চাই। আমার আট ছেলে চার মেয়ে, তবুও আমার ভাত জোটে না। অথচ দৌলতকে দেখে এসো। কেমন সুখে আছে। সব ক’টা ছেলে রোজগার করছে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আনছে। আর আমার চায়ে একটু দুধ জোটে না।
সরমা। কী আর হবে! তোমার যত ছেলে বাড়ছে, তোমার দু:খও তত বাড়ছে।
অতুল। কিছুই বোঝোনো যখন চুপ করে থাকো। ছেলে হল সংসারের সম্পদ। আমার ছেলেরা ভালো হলে আমার কি এই দুর্গতি হত! (বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বীরদর্পে) আজকে আমি সাফ কথা বলে দিচ্ছি—ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, যে রোজগার করে আনবে, সেই খেতে পাবে। তা না হলে উপোস।
দৃশ্য দুই। চায়ের দোকান। কাউন্টারে বসে আছেন মালিক বিষ্টুবাবু। অতুলের ছেলে মলয় এই দোকানে বয়ের চাকরি পেয়েছে।
বিষ্টু। এই মলয়, অনেক কাপ ডিশ জমেছে। তাড়াতাড়ি ধুয়ে ফেল। বাজারটা আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আয়। আর আসার সময় বউদির কাছ থেকে আমার জলখাবারটা নিয়ে আসবি। বুঝেছিস?
খদ্দের ১। কী বিষ্টু, আবার একটা নতুন ছেলে এল। কার ছেলে?
বিষ্টু। অতুলের ছেলে।
খদ্দের ২। ও অতুল। হ্যাঁ, একটা বাপের মতো বাপ। কুঁড়ে, হাড়-হাভাতে। সারাদিন কেবল বকবক করে বকছে।
খদ্দের ৩। আস্তে বলো, আস্তে বলো। ছেলেটা শুনতে পাবে!
খদ্দের ২। আরে যেতে দাও। আমি যা বলছি অতুলের সামনেই বলব। আরে ভাই, ওর জন্যে পাড়ায় একটু শান্তিতে বাস করার উপায় নেই। সারাদিন ঝগড়া মারামারি। একপাল ছেলে। সব ক’টাই শয়তান। কেউ গাছ ভাঙছে, কেউ চুরি করছে। কেউ জানলার কাচ ভাঙছে। মুখ-খারাপের ঠেলায় বাড়িতে টেঁকা দায়। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর ঝাড়ে-গুষ্ঠি শেষ করে দি।
খদ্দের ৩। চুপ চুপ। অতুল আসছে।
খদ্দের ২। আসতে দাও। আমি দরকার হলে আজই বোঝাপড়া করব।
[অতুল ঢোকে]
অতুল। বিষ্টুদা, আমাকে কিছু টাকা দেবে ভাই। বড় বিপদে পড়েই এসেছি। তুমি মলয়ের মাইনে থেকে কেটে নিও, কেমন?
বিষ্টু। বেশ আছ, অতুল। তোমার বিপদ ক্রমশই বড় হবে। এই দুর্দিনে তোমার ছেলেকে এক কথায় কাজে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছি, দেখছি। রোজ একবার করে টাকার ধান্দায় আসছ। তোমাকে আমি এক পয়সাও দেব না। সময় হলে তোমার ছেলের হাতে দোব। কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ো। (জোরে ডাকে) মলয় মলয়।
মলয়। (নেপথ্যে) আজ্ঞে যাই।
বিষ্টু। আজ্ঞে যাই, শালা শুয়োরের বাচ্চা। চারটে কাপ ডিশ ধুতে ক’বছর লাগবে? কখন বলেছি টিফিনটা বাড়ি থেকে নিয়ে আয়। খিদেতে নাড়ি ভুঁড়ি জ্বলছে। শালা দশটা বাজতে চলল। মলয়। (নেপথ্যে) আজ্ঞে, এখনি যাচ্ছি।
[অতুল আর মলয় এক সঙ্গে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।]
দৃশ্য তিন। অতুলের ঘর। অতুল বসে আছে তার ময়লা বিছানায়। সময় সকাল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতুলের আর এক ছেলে জিতেন।
অতুল। তোর আবার কী হল? হঠাৎ চাঁদপানা মুখ করে সাত সকালেই এসে হাজির।
জিতেন। আমি ওদের বাড়ি আর কাজ করব না। আমি ব্রাহ্মণের ছেলে। রোজ সকালে তেরো জোড়া জুতো সাফ করতে হবে; ছাড়া কাপড় কাচতে হবে। পাইখানার প্যান পর্যন্ত আমাকে দিয়ে পরিষ্কার করায়। না করলেই মেজোবাবু মেরে কালশিটে ফেলে দেয়। ভেবেছ কী? আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি।
অতুল। ( ঝাঁঝিয়ে বলে) বেশ করেছ। এখন পৈতে ধুয়ে জল খাও। যা যা—সাত সকালে বিরক্ত করিসনি। আমার জন্ম দেওয়া কাজ, জন্ম দিয়েছি। খুঁটে খেতে পারো ভালোই, না পারো শুকিয়ে মরো। আমার ত্রিসীমানায় এসো না।
[সরমা ঢোকে]
সরমা। এদিকে বকবক করে মরছ ওদিকে কি হয়েছে জান? তোমার পঞ্চম সন্তান যে ক’টা পিতলের বাসন ছিল, সব বাসন আর তোমার সেই গরম কোটটা নিয়ে কেটে পড়েছে।
অতুল। কী! শুয়োরের বাচ্ছাকে আমি খুন করে ফেলব।
সরমা। ওকে মারবে তুমি! তোমাকেই শেষ করে দেবে। যত গুণ্ডার সঙ্গে ওর আলাপ।
অতুল। আমাকে চেনো না তোমরা। আমি সমস্ত গুণ্ডাকে এক কথায় শেষ করে দিতে পারি। আমি স্বদেশি করতুম, বুঝেছ। একবার এক সাহেবকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়েছিলুম। বেটা একটুর জন্যে বেঁচে গিয়েছিল। নইলে আমার জেল হত! দেশের জন্যে আমরা কত কষ্ট করেছি জানো, কত ত্যাগ! আমার আজ মন্ত্রী হবার কথা। তা না এই শুয়োরের বাচ্ছাগুলোর সঙ্গে বকে মরছি। আমাকে বিরক্ত কর না। যেখান থেকে পার আমার জিনিস উদ্ধার করে আন। তোমার ছেলে তোমারই শিক্ষায় গুণ্ডা হয়েছে। সন্ধ্যের মধ্যে আমার সব জিনিস চাই।
সরমা। ছেলে কেবল আমার একলার —না? তোমার নয়? আপসে হয়েছে! ভিমরতি ধরেছে। যাও বাজার করে আনো!
[বাইরে বাজখাঁই গলা ‘অতুল অতুল। অতুল ইঁদুরের মত ছুটে ঘরের ভিতর দিয়ে গেল।]
অতুল। (চুপি স্বরে) বলে দাও বাড়ি নেই।
সরমা। (চুপি স্বরে) আমি আর মিথ্যে কথা বলতে পারব না।
অতুল। স্বামীর কথা মানতে হয় বুজেছ। তুমি না হিন্দু মহিলা!
সরমা। থাক, খুব হয়েছে। যত অন্যায় কাজের বেলায় আমি। স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে তুমি কী করেছ?
[আবার হাঁক ‘অতুল অতুল’। সাড়া না পেয়ে বলিষ্ঠ দৈত্যাকৃতি একটি লোক বাড়িতে ঢুকে এল।]
আগন্তুক। কোথায় অতুল?
সরমা। (জড়োসড়ো হয়ে) বাড়িতে নেই।
আগন্তুক। যখনই আসি শুনি বাড়ি নেই। হারামজাদা শালা ভেবেছে কী।
জিতেন। গাল দেবেন না। মেরে তক্তা করে দেব।
আগন্তুক। কী? মানসম্মান যদি অতই টনটনে, তাহলে ন’ মাস ধরে না ঘুরিয়ে আমার টাকাটা ফেলে দিলেই হয়! নেওয়ার সময় তো খুব কান্নাকাটি, আর দেওয়ার সময় যত মেজাজ, তাই না! আজ আমার টাকা না নিয়ে আমি নড়ছি না। শালা আজ লাশ নাবিয়ে দেব, সে-ও ভি আচ্ছা। কিন্তু আমার টাকা চাই।
সরমা। আপনি আমাকে তিনটে দিন সময় দিন। আমি যেমন করে পারি আপনার টাকা শোধ করে দেব।
আগন্তুক। ঠিক আছে। আপনার কথায় আমি আজ চলে যাচ্ছি। কিন্তু মনে থাকে যেন ভদ্রলোকের এক কথা।
[লোকটি চলে যেতেই অতুল বেরিয়ে এল।]
অতুল। জানোয়ার কোথাকার। ভদ্রভাবে কথা বলতেও শেখেনি। এরপর আসুক আমি দেখে নেব।
সরমা। আহা-হা। থাক, খুব হয়েছে। তুমি স্বদেশি বীর! সাহেবকে বোম মেরেছিলে, আর আজ! যত জালিয়াতি জোচ্চুরি। এক পয়সা রোজগার করার ক্ষমতা নেই, কেবল বংশ বৃদ্ধি করে চলেছ।
অতুল। (জিতেনকে এক লাথি মেরে) বদমাইশ। এখানে কী! থিয়েটার দেখছিস। যা চুরি করে পারিস, ডাকাতি করে পারিস, ভিক্ষে করে পারিস টাকা জোগাড় করে নিয়ে আয়। আজ আর তোর নিস্তার নেই।
[জিতেন মুখ ভেঙচে বেরিয়ে গেল]
দৃশ্য চার। ঘরের দেওয়ালে একটি ছবি ঝুলছে। রুক্ষ চেহারার গোঁপওয়ালা এক ভদ্রলোক। গলায় চাদর। অতুল ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। সময় রাত।
অতুল। বাবা, আমি তোমার অযোগ্য বংশধর। আমি উড়িয়ে পুড়িয়ে সব শেষ করেছি। তুমি জন্মই দিয়ে গেলে, পৃথিবীর সঙ্গে লড়াই করবার মতো কোনও অস্ত্রই আমাকে দিয়ে যাওনি। আমার শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, একখণ্ড চাষের জমিও নেই যে ফসল ফলাব। কিন্তু আমার বংশ মর্যাদাকে কিছুতেই ধুলোয় লুটোতে দেবা না।
[সরমা এসে দৃশ্যটা দেখে]
সরমা। কী করছ এখানে? তোমার মেয়ে-জামাইকে কোথায় শোয়াবে? তোমার বিছানাটাই ছেড়ে দাও। তুমি নবীনের বাড়িতে ঘুমোও গে।
অতুল। মহামুশকিল। মেয়েটা বিয়ে করেও মুশকিলে ফেলেছে। কী দরকার ছিল হুট করে আসবার? এদিকে নবীন সেদিন রাগারাগি করছিল। বলছিল, ‘যত শালা ভিখিরি, এখানে রাত কাটাতে আসে। এটা কী সরাইখানা না ধর্মশালা? আমি এবার থেকে পয়সা চাইব।’
সরমা। চেঁচাচ্ছ কেন? ওরা পাশেই রয়েছে যে।
অতুল। আমাকে কিছু খেতে দাও। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।
সরমা। চুপ । খাবার কিছু নেই। যা ছিল মেয়ে-জামাইকে খাইয়ে দিয়েছি।
[অতুল রেগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। মঞ্চ অন্ধকার। অতুলের গলা।]
অতুল। (নেপথ্যে ) নবীন, নবীন।
নবীন। ( নেপথ্যে) আজ আর জায়গা হবে না। ভাই। হাউসফুল। বিষ্টুর চায়ের দোকানে চেষ্টা করে দেখতে পারো।
[বিষ্টুর চায়ের দোকানের পাল্লা বন্ধ। অতুল দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের ফাঁকে চোখ রেখে। দর্শক দোকানের ভিতরে যা ঘটছে তাই দেখছেন। অতুল মঞ্চের ও পিঠে, ফাঁকে চোখ রেখে একই দৃশ্য দেখছে। দর্শক অতুলকে দেখছেন না। তার গলা শুনছেন। দোকানের মধ্যে বিষ্টুর কোলে অর্ধনগ্ন একটি ষোলো-সতেরো বছরের তরুণী বসে আছে। সুঠাম শরীর। বিষ্টু তরুণীকে আদর করছে। কিছু দূরে টেবিলের ওপর খালি মদের বোতল। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে কাঠের বন্ধ পাটাতন নড়ে উঠল। চমকে উঠলেও বিষ্টু মেয়েটিকে ছাড়ল না।]
অতুল। (দরজায় ধাক্কা মারছে) এই হারামজাদা শুয়োরের বাচ্ছা, কি করছিস আমার মেয়ের সঙ্গে? শালা ভদ্রলোকের নিরীহ মেয়েকে তুমি ভুলিয়ে এনেছ এখানে? তোমার চামড়া খুলে নেব।
বিষ্ট। (উপহাসের স্বরে) কী করছি তোমার মেয়ের সঙ্গে? নতুন কিছু নয়।
অতুল। বিষ্টু, আমি তোমাকে খুন করে ফেলব। আমার রক্ত ফুটছে। তোমাকে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলব। জানো, এক সময় স্বদেশি করতুম। (আরও জোরে) এই মালতী, বেরিয়ে আয়।
মালতী। আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না। যাও, ঘুমোও গে যাও। খামোকা চেঁচিও না। তোমার যা কাজ, তাই করগে যাও।
অতুল। (বিস্ময়ে) কী বলছিস মালতী! আমি যে তোর বাপ হই! তুই আমাকে এই কথা বলতে পারলি হারামজাদি! আমি তোকে জন্ম দিয়েছি। (রেগে ) তুই আর আমার বাড়ি ঢুকবি না। আমি তোর পাপ মুখ আর দেখতে চাই না।
মালতী। বেশ দেখো না। তবে মনে রেখো মাসে মাসে দুশো করে টাকা তুমিও আর পাচ্ছ না। তোমার চলবে তো?
অতুল। টাকাটাই বড় হল! কতকগুলো কাগজের কাছে চরিত্র, আত্মমর্যদা সব বিকিয়ে দিলি? আমি অনাহারে মরব, আমি আত্মহত্যা করব, তবু তোর ওই পাপ টাকা আমি ছোঁবো না।
মালতী। ঠিক আছে। এই প্রতিজ্ঞার কথা যেন মনে থাকে। পরে মাসের শেষে যেন চাইতে এসো না।
বিষ্টু। (মালতীকে) ঠিক বলেছ। (অতুলকে) যা চাইবে মাসের প্রথমে চাইবে, বুজেছ, অতুল। মালতী ভারী ভালো মেয়ে, তোমাকে দিয়ে দেবে। ( থেমে) তুমি চলে যাচ্ছ ভাই? যাও যাও। যাওয়ার আগে তোমার ছেলেটাকে তুলে নিয়ে যেও। বেচারি বমি করে পড়ে আছে দোকানের পিছনে। ছেলেটা তোমার বড় ভালো, অতুল। তবে মাত্রাটা ঠিক রাখতে পারেনি। তুমি বাবা। তুমি যখন এসেই গেছ আর ভয়কি। ছেলের ভার তোমার, আর তোমার মেয়ের ভার আমার।
অতুল। কী! সে হারামজাদা এখানে মদ খেয়ে বমিতে ভাসছে। আজ সপ্তাভর আমাকে একপয়সাও ঠেকায়নি। (হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে) বিষ্টু, তুমি কী আমার সর্বনাশ করলে ভাই! আমার ছেলেটাকে মদ ধরালে, মেয়েটার ধর্ম নষ্ট করলে। আর কী করবে ভাই।
বিষ্টু। আ: বুড়োটা মহা জ্বালালে দেখছি! বাবা, এসব মুফতে হচ্ছে না—। তোমার মেয়েকে নগদ পঞ্চাশটি টাকা দিয়েছি। সকালে এসো বাবা, চা খেয়ে যেও। রাগ করে আখের নষ্ট কোরো না। দেখে ফেলেছ, আরও দশ টাকা বেশি দেব।
মালতী। (এইবার কেঁদে ফেলে) প্রত্যেক মাসে যখন টাকা টাকা করে আমাদের পিছনে লাগতে তখন তুমি জানতে না আমার মতো অশিক্ষিত একটা মেয়ে কী ভাবে টাকা রোজগার করবে! মাসে মাসে সংসারে যখন টাকাগুলো গুনতুম তখন তো একবারও জিগ্যেস করতে না টাকা আসে কোথা থেকে! তুমি আমার বাবা, তুমি একটা শরীর ছাড়া আমাকে আর কী দিয়েছ? আমি সেই শরীর ভাঙিয়েই খাচ্ছি। আমার মার পরনে কাপড় নেই, পেটে খাবার নেই। আমি মার কথা ভেবেই এই রাস্তায় এসেছি। তুমি জানো না, তোমার বড় মেয়ের বাচ্ছা হবে—সে টাকা আসবে কোথা থেকে? (হঠাৎ জ্বলে উঠে) জানো না, তুমিও আবার বাবা হতে চলেছ? যাও তোমার ও মুখ আর কাউকে দেখিও না।
[বিষ্টু হোহো করে হেসে উঠল। সেই হাসিতে রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল।]
দৃশ্য পাঁচ। ডাক্তারখানা। বৃদ্ধ ডাক্তারবাবু বেশ উত্তেজিত। অতুল আর সরমা বেঞ্চিতে বসে।
ডাক্তার । স্ত্রীকে তো মেরেই ফেলেছ। তুমি তো খুনি। দেশে আইন থাকলে তোমাকে ফাঁসিতে লটকাতুম।
অতুল। (বিচলিত) কী করেছি, ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার। কী করেছ? তোমার স্ত্রীর দুটো লাংসই ছেঁদা হয়ে গেছে, তার ওপর পুর্ণ অন্ত:স্বত্বা। তুমি ভাবো ওকে আর বাঁচানো যাবে?
অতুল। আমি কী করব ডাক্তারবাবু। গরীব মানুষ—ছেলেমেয়ে কী মানুষের হাত, সবই ভগবানের দান।
ডাক্তার। মূর্খ! ভগবান হলে তুমি। তোমাদের উদাসীনতার জন্যেই এইসব অনাহূত সন্তানেরা আসে। এদিকে এসো। (অতুল ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে।) জামা খোলো। (অতুল জামা খোলে) যাও, ওই আরশির সামনে দাঁড়াও অতুল আরশির সামনে দাঁড়াল) কী দেখছ? চামড়ায় ঢাকা একটি কঙ্কাল। তুমি খেতে পাও না। তোমার হাড় ক’খানাই সার হয়েছে। অথচ প্রত্যেক বছর তুমি একটি করে নতুন প্রাণ পৃথিবীতে টেনে নিয়ে আসছ। প্রত্যেক রাতে তোমার জীবনী-শক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। মূর্খ তুমি বোঝোনা, তোমার চেয়ে বড় সমাজবিরোধী আর কে আছে। তোমরাই সমাজকে উপহার দিচ্ছ যত চোর ছেঁচোড় গুণ্ডা বাটপাড়। তোমাদেরই রক্তে তৈরি হচ্ছে যত হীনবুদ্ধি বিকৃতমস্তিস্ক নাগরিক। তোমরা এই সমাজের জঞ্জাল।
অতুল (অশ্রুসজল) ডাক্তারবাবু, আমি কিছুতেই নিজেকে সংযত করতে পারি না। যেই রাত গভীর হয়, মনে হয় কী করি, কী করি! অথচ সত্যি কথা বলতে কী, আমার স্ত্রীর কাছ থেকে প্রকৃত কোনও আনন্দই পাই না। এ এক ধরনের উন্মাদনা, এক ধরনের অভ্যাস। ডাক্তারবাবু আমাকে অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিন। রাস্তার নেড়ি কুকুরকে যেভাবে ইনজেকশন দিয়ে মারে, আপনি আমাকেও সেইভাবে সরিয়ে দিন।
ডাক্তার। অনেক দেরিতে বুঝেছ ভাই। আর কয়েকটা বছর আগে এলেও তুমি তোমার স্ত্রীকে ফিরে পেতে। এখন আর কোনও উপায় নেই। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমারও ওই এক ব্যাধি। শরীরকে ক্ষয় করে ফেলেছ। শুধু ওষুধে এসব রোগের কী হবে। চাই পথ্য। চাই বিশ্রাম। পারবে তুমি?
অতুল। আমি গরীব মানুষ। আমার টাকা কোথায়, ডাক্তারবাবু? আমার ছেলেরা বিপথগামী, আমার মেয়েরা বেশ্যা। ডাক্তারবাবু, আমি চোরাবালিতে ক্রমশই ডুবছি। আমি নিজেই নিজের কবর খুঁড়ে রেখেছি।
ডাক্তার । এখন বুঝেছ সমাজকে কারা ধ্বংস করছে! কোথা থেকে আসছে সমাজবিরোধীরা! কারা সমাজকে যোগাচ্ছে গণিকা! তোমার কোলের ছেলেমেয়েদের কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে সমাজবিরোধী শক্তি। তাদের নির্বিচারে ব্যবহার করছে নিজেদের দুষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। এদের ফাঁদে পা দিতে তোমার লজ্জা করল না! তুমি না মানুষ! তোমার মাথার মধ্যে একটা আটচল্লিশ আউন্স ওজনের ঘিলু আছে না। ( থেমে) এই নাও, একটা চিঠি লিখে দিলাম। যত তাড়াতাড়ি পারো তোমার স্ত্রীকে টি.বি. হাসপাতালে ভরতি করো।
[অতুল চিঠি নিয়ে ডাক্তারবাবুকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেল।]
দৃশ্য ছয় । রাত্রি। বিছানায় বিবর্ণ সরমা শুয়ে আছে। অতুল পাশে বসে আছে। আরও বিপর্যস্ত।
সরমা। (চোখ বুজে) আমার ছেলেরা কোথায়?
অতুল। (হাল্কাভাবে) কে জানে। এই আসছে, এই যাচ্ছে। কে কার পরোয়া করে, এটা তো বাড়ি নয়, যেন ধর্মশালা। এ বাড়ির জাত গেছে।
সরমা। তোমার মনে পড়ে। আমাদের যখন প্রথম বিয়ে হল। তুমি বলতে দু-একটি ভালো ছেলেমেয়ে, বেশি না। কেউ হবে ডাক্তার, কেউ হবে ইঞ্জিনিয়ার। জগৎজোড়া সব খ্যাতি হবে। বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল হবে।
(দীর্ঘশ্বাস) আমাদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল।
অতুল। ঠিক বলেছ। কিন্তু ভাগ্য যাবে কোথায়!
সরমা। সেটা ঠিক নয়। ভাগ্য তো মানুষই তৈরি করে। তুমি শেষটায় কী রকম বেপরোয়া হয়ে গেলে! তুমি দেখছ সামনে অন্ধকার, ঘন অন্ধকার—দারিদ্রের হাত এগিয়ে আসছে কিন্তু তুমি চোখ বুজে রইলে। যেন নেশার ঘোরে চলেছ। সমস্ত শুভবুদ্ধি যেন লোপ পেয়ে গেল। একের পর এক নিরীহ প্রাণকে ছুঁড়ে দিলে আগুনে। পুড়ছে ওরা। এখন আমাদের চোখের সামনেই পুড়ছে তিলেতিলে।
অতুল। সবই বুঝছি সরমা। তবে বড় দেরিতে। অন্ধকার এখন ঘিরে এসেছে। এ অন্ধকারে আলো আর জ্বলবে না।
[দূরে বোমার আওয়াজ।]
সরমা। কী যে হবে! যা দিনকাল পড়ল! আমি অসুস্থ। তোমার মেয়েকেও যে কোন মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। অথচ পথে ঘাটে এই বোমাবাজি। মানুষ মানুষকে নির্বিচারে মারছে। কত সন্তান, কত নিরীহ সন্তান মার কোল খালি করে চলে যাচ্ছে।
অতুল। আমি আমার জামাইকে বলব একগাদা ছেলেপুরে কোরো না। আমাকে দেখে শেখ।
সরমা। তোমাকে আর বলতে হবে না! তোমার মেয়েই হাড়ে হাড়ে বুজেছে। সে তার মাকে দেখেছে কি ভাবে হাড়মাস কালি হয়েছে। এ সংসারে সেও কম ভোগেনি। নেহাৎ বরাত জোর এ সংসার থেকে বেরিয়ে গিয়ে বেঁচেছে। অমানুষ ছেলেপুলে সংসারের যে কি অশান্তি —সে দু’বেলা দেখেছে। সেই জামাইকে সাবধান করে দেবে।
[প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ]
সে জানে শুধু সন্তানের জন্ম দিলেই হয় না। তাকে মানুষ করতে হাড়ে দুর্বা গজায়। তার লেখাপড়া, জামাকাপড়, শরীর স্বাস্থ্য—। সুখের কথা, সে আমাকে বলেছে একটি কি দুটি। তিনের বেশি কখনই নয়।
[আবার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ]
তুমি একবার দেখবে ছেলেরা কোথায়। এই সময় বাড়ি থাকাই ভালো। এই সব গোলমালে না জড়িয়ে পড়ে।
অতুল। আমরা আর কী করব বলো। আমাদের কথা শুনছে কে। ওদেরও তো কিছু করা চাই। সমস্ত মানুষেরই শক্তি খরচ হওয়ার একটা রাস্তা চাই। সে যে পথেই হোক।
সরমা। বেশি দূর নয়, তুমি ওই মোড় অবধি গিয়ে একবার দেখে এসো।
[অতুল বেরিয়ে গেল।]
দৃশ্য ঃ সাত।। বাড়ির বাইরে। অতুল আর তার জামাই নিখিল—মুখোমুখি দেখা।
নিখিল। কোথায় যাচ্ছেন এই গোলমালে?
অতুল। দেখি কী হচ্ছে। ছেলেদের ডেকে আনি। তোমার মা বড় উতলা হয়েছেন।
নিখিল। আপনি ভিতরে যান, বুড়ো মানুষ। আমি দেখছি।
অতুল। দেখো বাবা, কোনও ঝুঁকি নিও না। অপগণ্ডগুলো মরলে ক্ষতি নেই, কিন্তু তোমার জীবনের দাম আছে। সাবধান!
নিখিল। কিছু ভাববেন না, আমি কোনও বিপদের মধ্যে যাব না।
[অতুল মঞ্চ ছেড়ে চলে গেল। নিখিল সামনে এগোচ্ছে। মঞ্চ আলো-আঁধারি। এফেক্ট সাউন্ড। হঠাৎ অতুলের ছেলে মৃণালের প্রবেশ। হাতে ব্যাগ।]
এই মৃণাল, কোথা যাচ্ছ তুমি এই গোলমালে? বাড়ি চলো।
[মৃণাল নিখিলকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। নিখিলও তাকে ধরতে গেল। দুজনেই স্টেজের বাইরে চলে গেল। মঞ্চ অন্ধকার। নেপথ্যে—]
মৃণাল। জামাইবাবু চলে যান। আমার পিছন পিছন আসবেন না। এখনই এখানে ভীষণ গোলমাল হবে। বাড়ি গিয়ে সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করুন।
নিখিল। মৃণাল, তা হয় না ভাই। তোমাকেও যেতে হবে। তোমার আর সব ভাইয়েরা কোথায়? আমি তোমার বাবাকে কথা দিয়েছি তোমাদের ধরে নিয়ে যাব। চলো ভাই।
মৃণাল। জামাইবাবু, বোকার মতো বকবেন না। আমাদের ফেরার উপায় নেই। আমাদের প্রত্যেকেরই কাজের ভাগ আছে।
নিখিল। আমি তোমাকে পেয়েছি, তোমাকে ছাড়ব না চলো শিগগির।
মৃণাল। (চিৎকার করে) জামাইবাবু ওকী করছেন, ব্যাগটা টানবেন না।
সমস্ত কথা চাপা পড়ে গেল প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে, একের পর এক।
দৃশ্যঃ আট।। সকাল। উদভ্রান্ত অতুল পাথরের মতো বসে আছে। বাড়িতে প্রতিবেশীরা ভেঙে পড়েছে। অতুলের অন্ত:সত্বা মেয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না। হঠাৎ অতুলের সামনে দাঁড়িয়ে—
মেয়ে । ওই যে, ওই যে রক্ত খেয়ে বসে আছে। বুড়ো ছেলের রক্ত, জামাইয়ের রক্ত। ও মারবে, ও সবকটাকে মারবে। ওর রক্তে তৈরি হয়েছে রক্ত বীজের ঝাড়। ও সৃষ্টি কে ধ্বংস করবে। ওর সবক’টা ছেলে গুণ্ডা। ওকে বাঁধো।
জনৈকা। ছি: মা, বিপদের সময় মাথা গরম করতে আছে। দেখছ না তোমার বাবা শোকে পাথর হয়ে গেছে! তোমার মার এখনও জ্ঞান ফেরেনি।
মেয়ে। (কান্নায় ভেঙে পড়ে) কেন আমি এখানে এসেছিলাম! কেন আমি মার কাছে মরতে এসেছিলাম! ও যে একটা ছেলে চেয়েছিল আমার কাছে।
[পুলিশ বাহিনীর প্রবেশ।]
(পুলিশ অফিসারকে) এসেছেন আপনি! ওই যে, ওই যে খুনি। ও সমস্ত সংসারকে খুন করেছে, ও সমস্ত কিছুকে টুকরো টুকরো করবে। দারোগা ওকে খাঁচায় পুরুন। সমস্ত গণ্ডগোলের জন্মদাতা পিতা হল ওই লোকটা।
দারোগা। একে ভিতরে সরান। আমাদের কাজের অসুবিধে হচ্ছে। আমরা পারোয়ানা নিয়ে এসেছি সমস্ত বাড়ি সার্চ করতে হবে।
[যবনিকা।]