ভোর হবে
জন্ম থেকে আমি নাস্তিক৷ একদম যাকে বলে গোঁড়া নাস্তিক৷ ইদানীং তো এমন হয়েছে যে কোনও আলোচনায় কী হালকা আড্ডায় ভগবানের কথা উঠলে আমি এমন ঠাট্টা তামাশা শুরু করি যে চরম ঈশ্বর বিশ্বাসীদের সাথে সেখানেই সম্পর্কে ইতি পড়ে৷ তা-ও যখন আকাশের এককোণে সময়ের ভারে বিষণ্ণ সূর্যটা রোজ ডুব মারে, পাশের আন্ডার কন্ট্রাকশন বিল্ডিংটার পাঁচতলায় ক্লান্ত রাজমিস্ত্রিটা শরীর এলিয়ে দেয় মেঝেয়, সুখটান দেয় বিড়িতে, আমি ভাবি ধুর, ভগবান টাইপের কিছু একটা থাকলে খারাপ হত না৷
সর্বশক্তিমান, ভালো খারাপের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা৷
এই যে এত ভাবুক হয়ে পড়েছি তার কারণ আছে৷ মানুষ হিসেবে আমি একটু নীরস, খটখটে৷ মানবিক অনুভূতির সূক্ষ্ম ব্যথা বেদনা আমাকে স্পর্শ করে না৷ তাও আজ সকাল থেকে প্রায় কোনও কাজেই মন বসছে না, কেন বসছে না সেটাই লিখতে বসেছি৷ বিকেলে বাড়িতে ক-জন অতিথি আসার কথা আছে৷ সকাল থেকে বউ তাড়া দিচ্ছে, মাংস আনো, মাংস আনো৷ আমি কেবলই গড়াচ্ছি৷ শেষ পর্যন্ত যখন বিছানা ছেড়ে উঠলাম তখন সাড়ে এগারোটা পার হয়েছে৷ এত বেলায় বাজারে গেলে কিচ্ছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, ভাবলাম আবার গড়িয়ে যাই, কিন্তু সাথে সাথে মনে পড়ল গুপীর কথা৷
গুপী আমাদের এ-পাড়ার বাজারে মুরগি বেচে, ছোটবেলায় একই স্কুলে পড়তাম বলে আমার সাথে বেশ চেনাজানা আছে৷ এ অসময়ে একমাত্র তার কাছে গেলেই মাংস পাওয়া যেতে পারে৷ আমি থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ বাজারের কাছে আসতেই তার দোকানের সাইনবোর্ডটা দেখতে পেলাম৷ ‘রাধিকা চিকেন সেন্টার৷’ কিন্তু তার সাথে আর একটা ব্যাপার চোখে পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম৷ সাইনবোর্ডটার ঠিক নিচেই মুরগি রাখার বড় খাঁচাটা রাখা আছে, কিন্তু সেটা ফাঁকা৷ নোংরা খাঁচাটার ভিতর শুধু কয়েকটা সাদা পালক ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে৷ ব্যাপার কী? এর মধ্যেই দোকান বন্ধ করে দিল নাকি? দোকানের সাথে লাগোয়া গুপীর ছোটো এক কামরার ঘর৷ দরজা খোলাই ছিল, এগিয়ে গিয়ে ভিতরে উঁকি দিলাম, আমাকে দেখতে পেয়ে গুপীর বউ এগিয়ে এল৷ শীর্ণ হাড় বের করা চেহারা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত অভাবের ছাপ, কিন্তু তার থেকেও বেশি কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে তাকে, বয়স বেশি নয় অথচ দেখলে মনে হয় এক্ষুনি সামনে টলে পড়বে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘দোকান বন্ধ নাকি?’ মেয়েটার মুখে একটা বিবর্ণ হাসি ফুটে উঠল, ‘দোকান তো আর খোলে না৷’ আমি একটু থমকে গেলাম৷ দীর্ঘদিন হল গুপীর দোকান থেকে মাংস কিনিনি৷ রাস্তাঘাটে কখনও দেখা হয়ে গেলে, ‘কেমন আছিস’ এর বেশি কথা হয় না৷ মাংসের দোকান তুলে দিয়ে সে যে অন্য কিছু করছে সেটা জানতাম না, চলে যাব ভাবছিলাম, দাঁড়িয়ে গেলাম, এতদিন পর তার বাড়ির দরজা পর্যন্ত এসেছি যখন একবার দেখা করে গেলে মন্দ হত না৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘গুপী বাড়ি নেই?’
‘হ্যাঁ আছে, চান করতে গেছে, বসুন৷’
‘বসুন’ কথাটা শুনে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হল, ভিতরে তাকিয়ে বসার মতো কোনও জায়গা চোখে পড়ল না, ঘরের চারদিকে নোংরা কাঁথা ঝুলছে, দেওয়ালগুলো চোখে পড়ে না৷ মেঝের বেশিরভাগটা জুড়ে একটা তুলো বের করা লেপ পাতা আছে, ভিতরে ঢুকতেই নাকে একটা বিকট গন্ধ এসে লাগল৷ অনেকটা হসপিটালের মেটারনিটি ওয়ার্ডের মতো৷ আমি কোনওরকমে লেপের এক কোনায় বসলাম, আর বসতেই একটা ব্যাপার চোখে পড়ল, লেপের অন্যদিকের কোনায় একটা কাপড়ের পুঁটলি মতো কিছু পড়ে আছে, ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম পুঁটলির ভিতর একটা মানুষের দেহ আছে বোধহয়, ঠিক যেন স্পন্দনহীন মৃতদেহ, সম্ভবত বাচ্চা, আমি চোখ সরিয়ে নিলাম৷ দম আটকে অপেক্ষা করতে লাগলাম, গুপীর সাথে দেখা করেই বিদায় নেব৷ বাচ্চাটার কী হয়েছে কে জানে, ছোঁয়াচে কিছু নয় তো? মিনিট পাঁচেক পরে গুপী বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল, আমাকে দেখতে পেয়েই পুরনো হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল মুখ জুড়ে৷
‘আরে শান্তি যে, বিয়ে করে ভুলেই গেলি শালা, অ্যাঁ?’
আমি হাসলাম, কী বলব বুঝতে পারলাম না৷ তার সাথে আমার সেরকম ভালো বন্ধুত্ব কোনওদিনই ছিল না, তাও অনেকদিন পর দেখা হলে এ কথাটা বলা যেন দস্তুর হয়ে উঠেছে৷
‘আমি… মানে মাংস নিতে এসেছিলাম, দোকান তুলে দিয়েছিস তো জানতাম না৷’ গুপী মাথা নামিয়ে নিল, তারপর যেন নিজেকেই বলছে, এমন ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, সেও এক কাণ্ড, আয়, বাইরে আয়, মেয়েটা ঘুমোচ্ছে৷ একটা সিগারেট খাওয়া দেখি৷’ আমি পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলাম, সে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আরিইসালা, এত দামি মাল খাওয়ার অভ্যাস নেই তো৷’
‘কী হয়েছে তোর মেয়ের?’ চেষ্টা করেও আমার গলা থেকে আশঙ্কাটা তাড়াতে পারলাম না৷ গুপী সেটা বুঝে নিয়েই বলল, ‘না না, ছোঁয়াচে কিছু না, হার্টে অক্সিজেন আসছে না৷’ কথাটা বলে গুপী বাইরে বেরিয়ে গেল, আমি ধীর পায়ে উঠে পুঁটলিটার দিকে আর একবার তাকালাম, এখনও সেটা আগের মতোই পড়ে আছে, একবার সন্দেহ হল, সত্যি মরে যায়নি তো? একটুও নড়ছে না৷ ‘কিরে, বাইরে আয়৷’ হাঁক শুনে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ খোলা হাওয়ায় এসে সাহস করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম৷ একটা সিগারেট ধরিয়ে ফাঁকা দোকানটারই একটা ধারে বসে পড়লাম৷ গুপী সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, ‘তোর বাড়ির সব খবর কী?’
‘ভালো৷’
‘কেষ্টর দোকানের পাশে একটা নতুন মাংসের দোকান হয়েছে দেখেছি, ওখানে পেয়ে যাবি এখন৷ আমিই আনিয়ে দিতে পারি, কতটা লাগবে?’
আমি কথাটার উত্তর দিলাম না, উলটে একটা প্রশ্ন করলাম, ‘ডাক্তার দেখিয়েছিস?’
‘হুম৷’ সংক্ষিপ্ত উত্তর৷ সিগারেটে টান৷
‘কী বলেছে ডাক্তার৷’
‘কী আর, নানা মুনির নানা মত৷’
‘কীরকম?’
‘কেউ বলেছে বাঁচবে না৷ কেউ বলেছে বছর কয়েক বাঁচবে, কেউ…’
‘কী?’
‘শালারা বলে অপারেশন করে দেখবে কিন্তু বাঁচাতে পারবে কি না গ্যারেন্টি নেই৷’
কথাটা বলে সে নিজেই হেসে ফেলল৷ সিগারেটের ফিল্টারের দিকটা ঘষতে লাগল ফাঁকা খাঁচাটার তারগুলোর উপরে৷ তবে কি মেয়ের অসুখ বলেই মুরগি কাটার ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে গুপী? কিন্তু তাই বা কী করে হয়? ছোটো থেকেই দেখে আসছি মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদেরও যে যন্ত্রণা আছে সেটা সে শেখেইনি৷ ক্লাস ফাইভ না সিক্সে ফেল করে একবার রাগের চোটে একটা আস্ত জলঢোঁড়া সাপকে পুকুর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলছিল, সেই ডানপিটে গুপী খালি মেয়ের অসুখ বলে জীবহত্যা বন্ধ করে দেবে এটা বিশ্বাস হল না৷
‘তা মুরগিগুলোকে বেচলি কোথায়?’
গুপী মাথা দুলিয়ে বলল, ‘বেচিনি, ছেড়ে দিয়েছি৷’
এবার আমার আর অবাক লাগল না, আমাকে এতদিন পরে বাগে পেয়ে কাঁচা রসিকতা করছে গুপী, উঠে পড়লাম, মাংস নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে৷ এখনও চান হয়নি, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে৷
আমাকে উঠতে দেখে গুপী হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘আরে উঠে পড়লি যে৷’
‘নাহ, আর বসলে চলবে না, বাড়িতে লোক আসবে৷’
‘কখন?’
‘দুপুরে৷’
‘ওহ, দেরি আছে, আমি ফনেকে মাংস আনতে পাঠাচ্ছি, দে ব্যাগটা দে৷’
একটা বছর পনেরোর ছেলের হাতে ব্যাগটা দিয়ে তাকে মাংস আনতে পাঠাল গুপী৷ তারপর ধীরে সুস্থে আমার পাশে এসে বসে বলল, ‘মিনিট কুড়ি লাগবে, কাটা নেই, নতুন কেটে দেবে৷’
আমি কিছু বললাম না, কিছুক্ষণ সব চুপচাপ৷ ভিতর থেকে গুপীর বউ এসে চা দিয়ে গেল, সেটা খেতে আমার একটুও ইচ্ছা করছে না৷ অবেলায় চা খেয়ে অম্বল হোক আর কী…
‘মেয়েটা বোধহয় আর বাঁচবে না৷’ চায়ে চুমুক দিয়ে গুপী বলল৷
আমি কী বলব ঠিক বুঝতে পারলাম না৷ এমনিতে জায়গাটা নোংরা, আমার থেকে মিটার খানেক দূরে পড়ে আছে একটা প্রায় মৃত শিশু, তারপর দোকানের চারপাশ থেকে এখনও মাংসের গন্ধ পাওয়া যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে, তবু আমার কেমন যেন মায়া লাগল, মনের কোথাও ছোট্ট একটা কৌতূহল উঁকি দিচ্ছিল, জিজ্ঞেস করলাম, ‘মুরগিগুলোকে ছেড়ে দিলি? দাম তো নেহাত কম নয়, এতগুলো টাকা… তোর কি হঠাৎ দয়ামায়া জাগল নাকি?’ আমার প্রশ্নটা শুনে সে সজোরে হা-হা করে হেসে উঠল, প্রায় মিনিট খানেক পরে হাসি থামতে বলল, ‘ভালো বলেছিস ভাই, দয়ামায়া! অ্যাঁ?
এ জীবনে কিছু না হলেও হাজারখানেক মুরগি কেটেছি, আমার খাঁচায় মুরগি ঢোকা মানেই সে মাংস হয়ে টেবিলে পৌঁছে যাবে৷’
‘তবে?’
কিছু একটা গোপন কথা বলবে, এইভাবে সে আমার দিকে সরে এল, তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘শুনবি?’
‘শোনা৷’ আমি উৎসাহ দেখালাম না৷
সিগারেটে একটা শেষ টান দিয়ে সেটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে সে বলতে আরম্ভ করল,
‘মাস কয়েক আগের কথা, দুপুরবেলা, আমি দোকানে বসে আছি খদ্দেরের অপেক্ষায়, বউ ভিতরে রান্না করছে, মেয়ে গেছে স্কুলে, তো হঠাৎ শুনলাম দোকানের ঠিক বাইরেই কারা যেন চেঁচামেচি করছে, বাইরে এসে দেখলাম, স্কুলের ড্রেস পরা ক-টা বাচ্চা ছেলেমেয়ে আর তাদের সাথে দু’একজন মাস্টার৷ এগিয়ে গেলাম, দেখি সবাই মিলে আমার মেয়েটাকে ধরে এনেছে, তার হুঁশ নেই, এলিয়ে পড়ে আছে, তাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে এলাম, স্কুলে খেলতে খেলতে নাকি পড়ে যায়, তারপর আর ওঠেনি৷ ওর মা কান্নাকাটি জুড়ে দিল, আমি নাড়ি ধরে দেখলাম বেঁচে আছে, নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিন্তু খুব আস্তে আস্তে, প্রায় বোঝাই যায় না, ডাক্তার ডাকলাম, সে এসে কিছুই ধরতে পারল না৷ বলল হসপিটালের ডাক্তার দেখাতে৷ তখন হাতে পয়সা ছিল না, ক-দিন গেল, মেয়েটা আস্তে আস্তে কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ল, ভালো করে কথা বলতে পারে না, খেতে পারে না, যেন সারাক্ষণ গলাটা কেউ চেপে ধরে আছে৷ মেয়েটাকে খুব যে ভালোবাসতাম তা নয়, কিন্তু তাও চোখের সামনে একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে, চুপ করে বসে থাকতে পারতাম না৷ কখনও মাঝরাতে কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে রক্ত বেরত, ওর মা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিত, তারপর জেগে থাকত সারারাত, আমি আর শুতে পারতাম না, বাইরে এইখানটায় এসে বসতাম৷ সেই রক্তাক্ত কাশি মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে উঠত৷ মনে হত সব শেষ করে দিয়ে, সবাইকে খুন করে ফেলি, ওই আধমরা নির্বাক মেয়েটাকেও, ওর মাকেও, সবাইকে, অন্তত একটা রাত নির্ভাবনায় শান্তিতে ঘুমাতে পারব, আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল খাঁচার ভিতর মুরগিগুলোর উপর, এক-একটাকে ধরে ধরে ইচ্ছামতো কাটতে লাগলাম, আগে প্রাণে মারতাম না, যন্ত্রণায়, তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করত মুরগিগুলো, এমনকি খাঁচার ভিতর থেকে যারা দেখছে তারাও, সেই চিৎকারে মেয়েটার কাশির শব্দ, বউয়ের কান্নার আওয়াজ সব ঢাকা পড়ে যেত৷’
কথাগুলো বলে একটু থামল গুপী, তার মুখটা থমথমে হয়ে আছে, ফাঁকা খাঁচার ঠিক সামনেই গাছের গুঁড়ি কেটে একটা ছোট টুল মতো বানানো আছে, তার উপরেই কাটা হত মুরগিগুলো৷ এতবছরের রক্তের দাগে সেটা এখনও লাল হয়ে আছে৷ কয়েকটা বড় করে নিঃশ্বাস নিল গুপী, তারপর শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে আবার বলতে শুরু করল৷
‘হাতে কিছু টাকা এসেছিল, তাই দিয়ে মেয়েকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম, তারা পরীক্ষা করে বলল হার্ট বড় হয়ে গেছে বলে হার্টে রক্ত আসছে না, আমি শালা অত বুঝি না, জিজ্ঞেস করলাম কী করতে হবে, তো তারা বলল অন্য কারও হার্ট খুলে লাগাতে হবে৷ বাড়ি ফিরে এলাম, সেদিন মেয়েছেলের মতো কেঁদেছিলাম জানিস, এতদিন ভাবতাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কিছু করতে পারবে, হাতে পয়সা এলেই নিয়ে যাব, মনে হল এই ক-দিনের মধ্যেই যদি মরে যেত তাহলেই বোধহয়…’
বাইরে ফনে এসে দাঁড়িয়েছে, তার হাতের ব্যাগটা এখন ফুলে রয়েছে, অর্থাৎ মাংস নিয়ে ফিরেছে সে, আমি তার হাতে টাকাটা দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম৷ গুপী উঠে দাঁড়াল, আমার হাতের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বোনলেস দিয়েছে নাকি?’
‘কী জানি, কালো প্যাকেটে দিয়েছে, বোঝা যাচ্ছে না৷’ আমি ব্যাগের ভিতরে দেখে বললাম, ‘দেখে নিই, হারামিটা মহা চোর৷ না দেখলেই হাড়ে ভরে দেবে৷’
আমার প্যাকেটটা খুলতে ইচ্ছা করল না৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু মুরগিগুলোকে ছেড়ে দিলি কেন?’
আমার কৌতূহল দেখে তার মুখে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল৷ আমার থাইতে একটা চাপড় মেরে বলল, ‘সেটা শুনলে শালা হাসবি৷’
‘হাসলাম না হয়, তুই বল৷’
‘তার আগে আর একটা সিগারেট ছাড়, এত দামি চিজ আবার কবে পাব কে জানে৷’ আমি সিগারেটের বাক্সটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম, সে একটা সিগারেট বের করে নিয়ে আগুন ধরাল, ঠিক সেই সময় ভিতর থেকে একটা চাপা কান্নার মতো আওয়াজ ভেসে এল, বোধহয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মেয়েটার, গুপীর কিন্তু কোনও হেলদোল নেই, আমি ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম, এতক্ষণে মেয়েটা সোজা হয়ে শুয়েছে, হাত দুটো যেন নড়ে উঠল কয়েকবার, ছটফট করার শক্তিও হয়তো ফুরিয়ে গেছে৷ খুব ক্ষীণ শিসের মতো একটা আওয়াজ হচ্ছে৷
আমি চেষ্টা করেও এগিয়ে যেতে পারলাম না, কেমন যেন অসহায় লাগল আমার৷ কিছু কি করার নেই? এখন তো ক্যান্সারেরও ট্রিটমেন্ট হয়, কত আধুনিক যন্ত্রপাতি এসে গেছে মানুষের হাতে, তবু একটা বছর দশেকের বাচ্চা মেয়েকে চোখের সামনে একটু একটু করে দম বন্ধ হয়ে মরতে দেখতে হবে?
‘বউটা যদি না থাকত না, কোনদিন গলা টিপেই মেরে ফেলতাম৷’ হাওয়ায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে বলল গুপী৷
আমার আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না৷ সব কিছুর মধ্যে কেমন যেন মৃত্যুর গন্ধ৷ আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় এই ঘরটা, ছেঁড়া লেপটা আর ঝুলন্ত নোংরা জামাকাপড়গুলো ভৌতিক চেহারা নিয়েছে৷
‘চল, তোর বাড়ি অবধি যাই, যেতে যেতেই বলব সবটা৷’
‘আমরা দু-জনে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ এতক্ষণে বেশ দুপুর হয়েছে, শূন্য রাস্তাটা খাঁ খাঁ করছে, আশপাশের কোনও বাড়ি থেকে টিভির আওয়াজ ভেসে আসছে৷ দু-জনে বেশ খানিকটা হেঁটে এলাম, আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি, গুপীও বোধহয় ভুলে গেছিল, হঠাৎ হাতের সিগারেটটা দেখেই যেন কথাটা মনে পড়ল তার, ‘ওহো, তোকে তো বলাই হল না৷’
‘হুম, বল৷’
গুপী কী যেন ভেবে আবার বলতে শুরু করল, ‘খাঁচায় একটা সাদা রঙের মোরগ ছিল, জানিস, অত সাদা ধবধবে মোরগ জীবনে দেখিনি, মায়াদয়া তেমন ছিল না বটে কিন্তু ওটাকে কাটতে ইচ্ছা করত না, খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে আগে ওটাকে সরিয়ে দিতাম, মোরগটাও বোধহয় বুঝে গেছিল ওকে আমি মারব না৷ হসপিটাল থেকে ফেরার ঠিক পরের দিন, মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল, বউ ডাকছে, উঠে দেখলাম মেয়েটা পাথরের মতো স্থির হয়ে আছে, মুখের এককোণ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে, তোকে কী বলব শান্তি, এক সেকেন্ডের জন্য মনটা খুশি হয়েছিল৷ বোধহয় মরেছে, শেষ হয়ে গেছে সব যন্ত্রণা৷ নাড়ি দেখলাম, নাহ, চলচে না৷ বুকটা ওঠানামা করছে না, অনেকদিন পর খুব শান্তি পেয়েছিলাম, শালা আমি বাপ হয়ে শান্তি পেয়েছিলাম মেয়ে মরে গেছে ভেবে, কিন্তু না, একটু পরে আবার শুরু হল চাপা শিসের মতো শব্দটা, তার সাথে থকথকে রক্ত মেশানো কাশি৷ মরেনি এখনও মরেনি, আরও যন্ত্রণা আরও, আরও আরও… রাগে আর কিছু হুঁশ ছিল না আমার, বিছানায় একটা লাথি মেরে বেরিয়ে এলাম বাইরে, আজ সব ক-টা মুরগিকে মারব, সামনে যাকে পাব মেরে শেষ করে ফেলব, শেষ পর্যন্ত হয়তো নিজেকেও, খাঁচা থেকে নেকড়ের মতো টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলাম একটা মুরগিকে, হাতে নিয়ে দেখলাম সেটা মোরগ, আমার সেই সাদা মোরগটা, আজ শালা এটাকেই কাটব, জানি না কেন এখন মনে হয় মোরগটা একবারের জন্যও চিৎকার করেনি, বোধহয় তখনও ভাবেনি আমি তাকে কাটব বলেই বের করেছি, চপারটা ডান হাতে ধরে ‘দুটো পা দিয়ে তাকে চেপে ধরলাম ওই গাছের গুঁড়িটায়৷ একটা পা গলায় আর একটা পেটে, মাথার উপর তুলে ধরলাম ধারালো চপারটা, উত্তেজনায় আমার পায়ের চাপ একটু ঢিলে হয়ছিল, সেই ফাঁকেই ডেকে উঠল মোরগটা৷ মৃত্যুর আগের আর্ত চিৎকার নয়, শান্তি, ঠিক সকাল হলে যেভাবে ডাকে, সেরকম৷ শালা ওইটুকুনি প্রাণী, কসাইয়ের চপারের তলায় শুয়ে আমাকে জানিয়ে গেল যে আমার হাতে কিছুই নেই, শত চেষ্টা করলেও যেমন মেয়েটাকে বাঁচাতে পারব না, তেমনি সব কিছু অন্ধকার করে ফেলার ক্ষমতাও আমার নেই, ভোর হবে… ভোর হবে, আমি আটকে রাখতে পারব না৷ সব কিছুর মতো একসময় অন্ধকারটাও শেষ হয়ে যাবে৷ মরবার আগে সে যেন ঘোষণা করে দিয়ে গেল৷ আমারও কী হল জানি না, মনে হল আমার পায়ের নিচে আমার মেয়েটাই শুয়ে আছে, সামনে নিশ্চিত মৃত্যু, নিঃশ্বাস বন্ধ, আর আমি, আমি ভগবান, এই মোরগটার জন্ম মৃত্যু আমার হাতে৷ আমি তাকে শুধু মারতেই পারি, যন্ত্রণাই দিতে পারি, ব্যস ওইটুকুই, এই অন্ধকার রাতটাকে আমি আটকে রাখতে পারব না৷ আলো ফুটবেই৷ আমি চপার নামিয়ে নিলাম৷ ছাড়া পেয়ে এক ঝটকায় মাটিতে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াতে লাগল মোরগটা৷ আমি ভিতরে ঢুকে এলাম, মেয়েটা স্থির হয়ে শুয়ে আছে৷ মুখের উপর থেকে চাদরটা সরানো৷ তাকে দু’হাতে চেপে ধরলাম বুকে, এখনও হৃৎপিণ্ডটা চলছে তার, ধুকপুক আওয়াজটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে৷ হয়তো ক-দিন পড়ে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে৷ কিন্তু তাও সেদিন আমার এতটুকু কষ্ট হয়নি৷ সারারাত মেয়েটাকে বুকে নিয়ে শুয়েছিলাম৷ তার রক্তে ভিজে গেছিল আমার গলাটা৷ তারপর থেকে আর মুরগি কাটি না, অন্য কিছুর ধান্দায় আছি৷’
গুপী থামল৷ আমিও আর কোনও কথা বললাম না৷ আগেই বলেছি আমি নাস্তিক মানুষ, কিন্তু জানি না কেন আজ মনে হল ভগবান বলে যদি কেউ থেকেও থাকে সে লোকটা ভগবান হিসেবে একটা কসাইয়ের থেকেও নিচু শ্রেণির৷
‘নেমন্তন্ন কর একদিন, খেয়ে যাব৷’ আমার বাড়ির সামনে এসে পড়েছি৷ গুপী হাসতে হাসতে বলল৷
‘এখনই আয় না৷’
‘নারে, আজ বেলা হয়ে গেছে৷ অন্য দিন আসব৷’
কথাটা বলে সে ফেরার পথ ধরল৷ এমন সময় বাড়ির আশেপাশে কোথা থেকে তারস্বরে একটা মোরগ ডেকে উঠল৷ পাশের বাড়ির গুপ্তরা পুষেছে বোধহয়৷ কিন্তু এই দুপুরে মোরগের ডাক! কী জানি হতেও পারে৷ হতচ্ছাড়ারা মাঝে মাঝে অকারণেই ডেকে ওঠে…