উপন্যাস
বড়গল্প
ছোটগল্প
1 of 2

ভোর

ভোর

সকাল। আটটা কি সাড়ে আটটা। দোতলার বারান্দায় মাসিমা অপরাজিতা গাছের পরিচর্যা করছেন। রোজ যেমন করেন। টোপা টোপা ফুলে গাছ ভরে গেছে। ঘন নীল রঙ। পুবের রোদ। মাসিমার ফর্সা টকটকে মুখে নীলের আভা। সেই গানটাই গুনগুন করছেন, ‘ফুল বলে ধন্য আমি।’

মেজোমামা বলিষ্ঠ একটা ক্যাঙ্গারুর মতো এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে আসছেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন দর্শন পড়াতে। এই ব্যায়ামটা শিখে এসেছেন। মাসিমা বলছেন, ‘এইবার থামলে হয় না। ক্যাঙ্গারুরাও মাঝে মাঝে রেস্ট নেয়।’ কোনও ফল হল না।

আমি দাঁড়িয়ে আছি ঠিক নীচের উঠোনে। বেশ বড় বাঁধানো উঠোন। দাঁড়িয়ে থাকার কারণ, মোবাইলে বড়মামার সংক্ষিপ্ত আদেশ, ‘মাল যাচ্ছে। ডেলিভারি নিবি।’

‘তুমি কোথায় আছ? কী মাল?

কটাস, লাইন কেটে দিল। সাতসকালে কোথা থেকে কী মাল আসবে নীচের উঠোনে একটা রবারের বল থাকে। আমি আর বড়মামা মাঝে মাঝে খেলি। পাশেই মাসিমার বিশাল রান্নাঘর। বড়মামার এলোপাথাড়ি শটে অনেক কিছু চুরমার হয়েছে। মাসিমা প্রতিবাদ করায় বড়মামা স্লোগানের মতো করে বলেছে। ‘ভাঙছি ভাঙবো।’

মাসিমা বলেছিলেন, ‘এমন বদ ছেলেকে হস্টেলে দেওয়া উচিত।’

এত বড় একটা নামকরা ডাক্তার, কিন্তু শিশুর মতো সরল। আমি সেই কারণে বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাকে নিয়ে একদিন ঘোষালদের বাগানের পাঁচিল টপকে আম চুরি করতে গিয়েছিলেন। ধরা পড়ে গেলুম। ঘোষালমশাই অবাক, ‘ডাক্তারবাবু আপনি? আমার মরা ছেলেকে বাঁচিয়েছিলেন। ক’ঝুড়ি আম খাবেন! বোম্বাই, ল্যাংড়া, হিমসাগর, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

বড়মামা বললেন, ‘সে হবে না। চুরি করে খাওয়ার আলাদা আনন্দ।’

ঘোষালমশাই মহানন্দে বললেন, ‘বেশ, বেশ, কুকুর তিনটেকে বেঁধে দিচ্ছি, যত পারেন চুরি করুন।’

বড়মামা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘চোরকে চুরি করতে বললে সেটা আর চুরি থাকে না, সেটা তখন হয়ে যায় নেওয়া।’

সদরে একটা টেম্পো দাঁড়াল। প্রথমেই ঢুকলো একটা খাট, যে-খাটে চাপিয়ে শ্মশানে ডেডবডি নিয়ে যাওয়া হয়। এল একটা তোশক সাদা চাদর দিয়ে রোল করা। অনেকটা নারকোলদড়ি, মোটা লম্বা দুটো বাঁশ। মোটা দু’প্যাকেট ধুপ। একটা মাটির কলসি। উঠোনের মাঝখানে সব জড়ো হল। দুজনের একজন বললেন, ‘মাল মিলিয়ে নিয়ে চালান সই করে দাও। সন্ধের মুখে ফুল, মালা, ধামা ভর্তি খই আর খুচরো পয়সা এসে যাবে।’

ওপরের বারান্দায় দুটো মুখ ঝুঁকে আছে। মেজোমামার মুখ থেকে কথা বেরল, ‘বাড়ি ভুল হয়েছে। এ-বাড়িতে কেউ মারা যায়নি।’

‘যাবে, রাত বারোটার সময় বড়বাবু অক্কা পাবেন।’

‘কোন জ্যোতিষে বলেছে?’

‘যিনি যাবেন তিনিই বলেছেন।’

বিকট শব্দে টেম্পো চলে গেল। মাল পড়ে রইল উঠোনে।

কিছুক্ষণ পরে স্বয়ং বড়মামা এলেন। মাসিমা রান্নাঘরে। ভীষণ গম্ভীর। চিত্রা শিলে মশলা বাটছে। ধনে, জিরের গন্ধ। হরিদা রোজকার মতো খিড়কির পুকুর থেকে একটা রুই মাছ তুলে দিয়ে গেছে। কলতলায় চোখ উলটে চিৎপাত। মাসিমার শিক্ষাপ্রাপ্ত তুলতুলে, থাপুর থুপুর আদুরে বেড়াল সুন্দরী অদূরে আধবোজা চোখে পাহারা দিচ্ছে। কার্নিসে দুটো সংযত কাক ঘাড় কাত করে কেবল দেখছে। ডাকছে না।

বড়মামা ঢুকেই বললেন, ‘বাঃ, সব রেডি। তুই টেপটা নিয়ে আয়।’

উঠোনের ওই মাথায় বেদিতে বসে মেজোমামা অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা ক্যাঙ্গারু কাপে নিউজিল্যান্ডের কফি পান করছিলেন। পরপর তিন দিন বাক্যালাপ বন্ধ। সামান্য কারণে। অস্ট্রেলিয়া ভালো না ইংল্যান্ড ভালো। বড়মামা বলেছিলেন, ইংল্যান্ড ইজ ইংল্যান্ড। খাঁটি সায়েবরা ইংল্যান্ডে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার সব ট্যাঁশ গরু। এই অবধি প্রবলেম ছিল না হঠাৎ সুকুমার রায় আবৃত্তি করায় কেস জন্ডিস হয়ে গেল,

ট্যাঁশ গরু গরু নয় আসলেতে পাখি সে;

যার খুশি দেখে এস হারুদের অফিসে।

চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু, মুখখানা মস্ত,

ফিটফাট কালো চুলে টেরিকাটা চোস্ত।

এই শেষ দুটো লাইন মেজোমামা নিজেকে খুঁজে পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি একটা ট্যাঁশগাধা।’

যথারীতি মাসিমা খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাক্যযুদ্ধ বন্ধ করলেও কথা বন্ধ হয়ে গেল।

বড়মামা মেজোমামাকে লক্ষই করেননি। টেপটা পেয়ে পকেট থেকে একটা ক্যাসেট বের করে চালিয়ে দিলেন, খোল-করতাল সংযোগে গম্ভীর, গম্ভীর সমবেত গলা, বলো হরি, হরিবোল, বলো হরি-হরিবোল। মাসিমা বিশেষ একটা কিছু রাঁধছিলেন—রবিবারের স্পেশ্যাল। সেটাকে সামলে বেরিয়ে এসে কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘জানতে পারি, ব্যাপারটা কী?’ বড়মামা বললেন, ‘নিশ্চয়! তোকে না জানিয়ে কবে আমি কোন কাজ করেছি! তার আগে বাঙালি কাপে এক কাপ দার্জিলিং চা খাওয়াবি কুসি। নো নিউজিল্যান্ড, নো অস্ট্রেলিয়া।’

বড়মামা এতক্ষণে বেদির দিকে তাকালেন। মেজোমামা বসে আছেন। খুঁচিয়ে ঘা করার কোনও দরকার ছিল না; কিন্তু বড়মামার স্বভাব। বললেন, ‘বাবা, গণপতি! কপি খাচ্ছেন, কপি।’ তারপর বিকট সুরে,

 গণেশদাদার পেটটি নাদা

 গায়ে মেখেছেন সিঁদুর,

 কলাগাছকে বিয়ে করেছেন,

 বাহন তাঁহার ইঁদুর।

মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘পাগলে কি-না বলে, ছাগলে কি না খায়।’

মাসিমা এসে পড়ায় ব্যাপারটা অধিক দূর এগলো না। বড়মামা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘মানুষ যখন মরে যায়, তখন সে একেবারেই মরে যায়।’

মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কি আবিষ্কার! নোবেল পুরস্কার পেলেই হয়।’

বড়মামা বললেন, ‘দেখছিস কুসি!’

মাসিমা বললেন, ‘অ্যায়! চুপ!’

বড়মামা বলছেন, ‘তাকে যখন খাটে চাপিয়ে হরি হরি বলে নিয়ে যায়, জীবনের এত বড় একটা ইভেন্ট, এত বড় একটা সেনসেশানের সে কিছুই জানতে পারে না, তার ফিলিংসের আমরাও কিছু জানতে পারি না, তাই…।’

‘তাই কী?’

‘আজ রাত বারোটায় আমি জ্যান্ত-মড়া হব। আমার চার সাকরেদ আমাকে কাঁধে করে, ধূপ জ্বালিয়ে, খই-পয়সা ছড়াতে ছড়াতে শ্মশান পর্যন্ত যাবে। শবাচ্ছাদনের তলায় এই ক্যাসেটটা বাজতে থাকবে। আবার আমি ফিরে আসব।’

মেজোমামা বললেন, ‘পাগল ভালো কর মা।’

মাসিমা বললেন, ‘উঃ, মা মারা গিয়ে কি বাঁশ যে দিয়ে গেছে আমাকে!’ মেজোমামা হঠাৎ খুব উৎসাহ পেয়ে গেলেন, ‘আইডিয়া, আমি আগে আগে খই ছড়াতে ছড়াতে যাব। সাতদিন অশৌচ পালন করব। তারপর ঘাটকামান, ঘটা করে শ্রাদ্ধ হবে। ওঁগঙ্গা চিঠি। নিয়ম ভঙ্গ। এরপর বড়কে যে দেখবে ভূত ভেবে দৌড়ে পালাবে। তখন গয়ায় পিণ্ডি দিতে যাব। ডিসপেনসারি বন্ধ, প্র্যাকটিস বন্ধ। আর, আর সব সম্পত্তির মালিক আমি। তুমি যখন রাত বারোটায় মরবে, তখন অ্যায়সা চিৎকার করে কাঁদব পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙে যাবে। তোমার সব কিছু আমার, আমার। মৃত্যুর পরে, আরও পরে, আরও পরে কি হয় সেটাও তো জানা দরকার। তাছাড়া চুল্লির উত্তাপ, সেটাও তো জানা দরকার। সঙ্গে যখন আছি, ঢুকিয়েও দিতে পারি।’

বড়মামা চিৎকার করে উঠলেন, ‘মার্ডার, মার্ডার!’

সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়িতে কান্নার রোল। ছুটতে ছুটতে অলকা এল। চুল উড়ছে। পায়ে চটি নেই, ‘কাকাবাবু মা…’। এইটুকু বলতে পারল। বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘কুইক, কুইক!’

বড়মামা ছুটছেন। ডাক্তারি ব্যাগ হাতে আমি পেছনে। রান্নাঘরের বাইরে, চাতালে অলকার মা চিত হয়ে শুয়ে আছেন। অমাদের এই দক্ষিণপাড়ার সকলের প্রিয় দিদি। স্কুলের শিক্ষিকা। বড়মামা ইঞ্জেকশান দিলেন। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু করার চেষ্টা করলেন। হল না। প্রাণ আর ফিরে এল না। মাসিমা, মেজোমামা। কেউই আর একটু আগের লোক নয়। মা আর মেয়ের ছোট্ট সংসার। মা চলে গেলেন। তরতাজা, সুন্দর এক মহিলা। গভীর ঘুম।

অলকার মাথা বুকে চেপে ধরে মাসিমা বারে বারে বলছেন—’আমি আছি। আমরা আছি।’

বড়মামার খাট, ফুলে ফুলে ঢাকা দেহ। এক আকাশ তারা, একটু চাঁদ। বারান্দায় মাসিমার পাশে অলকা। পাথরের মূর্তি। আমরা শ্মশানের দিকে এগোচ্ছি। গঙ্গার বাতাস গায়ে লাগছে।

শেষ রাতে গঙ্গার কিনারায় দাঁড়িয়ে বড়মামা বললেন, ‘কিস অফ ডেথ। মৃত্যুর শীতল ঠোঁট আমি স্পর্শ করেছি।’

মেজোমামার চোখে জল। বললেন, ‘বাজে জিনিস। মৃত্যু একেবারে থার্ডক্লাস। প্রতিজ্ঞা কর, আমার আগে তুই মরবি না।’

ভোরের বাতাসে কত প্রাণ! আকাশে কত আলো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *