ভোম্বলের দুপুর

ভোম্বলের দুপুর

ভোম্বলের অসুখ করেছে।

ডাক্তার পাল একগাদা ট্যাবলেট দিলেন আর গম্ভীর মুখে প্রেসক্রিপশনের ওপর খসখস করে লিখে দিলেন, ‘রেস্ট’। শুধু লিখে দিলেন না, মাথা নেড়ে বললেন, পুরোপুরি বিশ্রাম! যত বেশি বিশ্রাম নেবে তত তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।

ভোম্বলের মা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কীরকম বিশ্রাম ডাক্তারবাবু?

ঘরে তো থাকতেই হবে, বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলে সব থেকে ভাল হয়। আর দেখবেন কেউ যেন ভোম্বলকে বিরক্ত না করে।

ভাক্তার পালের কথা শুনে বাড়িতে মিটিং বসে গেল। প্রথমে ঠিক হল, ভোম্বলকে একতলায় রাখা হবে। দক্ষিণের ঘরে। ও-ঘরে আলো বাতাস দুটোই যথেষ্ট। বিছানা, মশারি সব রেডি করা হল। বাবা আপত্তি করলেন। বললেন, খেপেছ? একতলায় সারাদিন লোকের আসা যাওয়া। এখানে ভোম্বলের বিশ্রাম হবে কী করে? না না তোমরা অন্য কোথাও বাবস্থা করো।

তখন ঠিক হল ভোম্বল উঠবে দোতলায়। বারান্দার পাশে যে ঘরটা আছে, সেখানে।

মা বলল, হবে না। দোতলায় সারাদিন রান্নার ছ্যাঁকছোঁক। সন্ধেতে টিভি। বেচারি নিশ্চিন্ত মনে দু’মিনিট চোখ বুজতে পারবে? পারবে না। এই শরীরে ঠিকমতো ঘুম না-হলে সর্বনাশ।

তা হলে?

মেজদি বলল, তা হলে দেড়তলায় গ্যারাজের ওপর যে ছোট ঘরটা রয়েছে ওখানেই ঢুকে যাক।

ছোড়দা আঁতকে উঠল, বলছিস কী! ভোম্বল ওই ঘরটা নিলে নাটকের রিহার্সাল হবে কোথায়? পুজোর আর ক’টা দিন বাকি? এখন টানা রিহার্সাল ছাড়া সবটা ভেস্তে যাবে না?

শেষ পর্যন্ত ছাদের ওপরের ছোট্ট ঘরটা ভোম্বলের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। সারাদিন এই ঘরেই থাকবে। শুধু রাতে শোওয়ার সময় নেমে আসবে। ওখানে থাকলে ডোম্বলের অসুবিধে হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। লোকজন কেউই এত ওপরে চট করে উঠে আসতে পারবে না। ঘরটাও খারাপ নয়। শান্ত। বিশাল ছাদের একপাশে। একটা নতুন ক্যাম্প খাট এনে পেতে দেওয়া হল।

প্রথমটায় ভোম্বল খুবই ভেঙে পড়েছিল। এ তো বন্দি অবস্থা! একতলায় থাকতে পারলে তাও দু’-একজনের দেখা মিলত। কয়েকটা কথাটথা হত। কথা না-হোক, কে আসে কে যায় সেটা অন্তত দেখা যেত। বিল্টু, গণেশ যদি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে চুরিয়ে আসত। ওপরে সে-সুযোগ রইল না। সারাটা দিন একা একা।

বড় জানলাটার একেবারে গায়েই ভোম্বলের বিছানা পাতা হয়েছে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই জানলা দিয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। কিন্তু সে দেখতে পেলেই বা তার লাভ কী? কতক্ষণ আর আকাশ দেখে সময় কাটানো যাবে?

বেজার মুখে একগাদা ওষুধ, খান তিনেক গল্পের বই নিয়ে ছাদের ঘরে ঢুকে পড়ল ভোম্বল।

প্রথম দিনটা কোনওরকমে কাটল। বইয়ের পাতা উলটে। বিছানায় গড়িয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে একেবারে ভয়ংকর অবস্থা! সময় আর কাটতেই চায় না। একা থাকা এত ভয়ংকর! মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা ঘটর ঘটর করে ঘুরছে। বইয়ের পাতা সেই হাওয়ায় উড়চ্ছে ফরফর করে। উফ! কী একঘেয়ে রে বাবা! কী বিরক্তিকর!

ভোম্বলের প্রথমে রাগ হতে লাগল। অসুখের ওপর রাগ। ডাক্তারবাবুর ওপর রাগ। বাড়ির লোকের ওপর রাগ। এই ঘরের ওপর রাগ। তারপর সেই রাগ বদলে এসে গেল দুঃখ। শোচনীয়। মনে হচ্ছে দমবন্ধ হয়ে আসবে। খেতে ভাল লাগছে না। ঘুমোতে ভাল লাগছে না। বই পড়তে ভাল লাগছে না। এমনকী রেডিয়োতে ক্রিকেট খেলার রিলে শুনতে পর্যন্ত ভাল লাগছে না! বন্ধুটন্ধু ছেড়ে একা থাকাটা যে এমন মারাত্মক জিনিস ভোম্বল কল্পনাও করতে পারেনি। তার মনে হতে লাগল, আরও ক’টা দিন যদি তাকে এরকম একা একা থাকতে হয় তা হলে নির্ঘাত তার অসুখ দশ গুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু কথাটা কে বুঝবে? মনে হচ্ছে না, কেউ বুঝবে।

ঘটনাটা ঘটল পরের দিন।

সেদিন দুপুরে ভোম্বলের লাঞ্চের মেনু ছিল হালকা মাগুর মাছের ঝোল আর নরম ভাত। সঙ্গে পেঁপেসেদ্ধ। বেলা বারোটার মধ্যে খাওয়া শেষ। শুয়ে পড়ল ভোম্বল। জানলা দিয়ে তাকাল। মনটা হুহু করে উঠল। বিল্টু, গণেশ, ভট্টাই, বাবলু এখন কী করছে? স্কুলের টিফিনের সময় তো হয়েই এল। আজ কি ওরা কুলের আচার খাবে? নাকি স্কুলের পেছনের ঝাপসা রেন্ট্রি গাছটায় উঠে চোর পুলিশ খেলবে? চোর পুলিশ খেলাটা আজ দারুণ জমবে। মেঘ মেঘ আছে।

এতদিন শুধু কান্না পেয়েছে, আজ ভোম্বল সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল। তবে ডাক ছেড়ে নয়, চুপিচুপি।

আর তখনই কে যেন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল।

অ্যাই ভোম্বল, ছেলেমানুষের মতো কাঁদছিস কেন?

চমকে উঠল ভোম্বল! ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

কে কথা বলল? কেউ কি বলল? নাকি সে ভুল শুনেছে? সেটাই হবে। অসুস্থ শরীরে মানুষের মনের ভেতর অনেকরকম গোলমাল হয়। এমনকী ভুলও শোনে। ভোম্বল চোখের জল মুছল।

আবার সেই গলা।

অ্যাই আবার কাঁদে। বারণ করলাম না? এবার কিন্তু গাঁট্টা খাবি।

কে? কে?

কান্নাটান্না ভুলে চিৎকার করে উঠল ভোম্বল। স্বপ্ন দেখছে না তো? ভাল করে দু’হাত দিয়ে চোখ কচলাল ডোম্বল।

ওই দেখ, ষাঁড়ের মতো চেঁচায়। এই তো আমি, জানলা দিয়ে বাইরে তাকা। দেখ ভাল করে। এখানেই তো রয়েছি।

ভোম্বল জানলার গ্রিল ধরে বাইরে তাকাল।

ওমা, কোথায় কে! কেউ তো নেই! শূন্য দুপুর খাঁ খাঁ করছে। ছাদের ওপাশটায় জেঠিমা বড়ি শুকোতে দিয়েছেন। সাদা কাপড়ের ওপর সারি সারি বসে রয়েছে। আরে, বড়িগুলোকে খুব মজার দেখতে লাগছে তো! এক-একটা এক-এক রকম! কেউ যেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মতো হাসছে। কেউ যেন ফেলুদার সঙ্গী জটায়ু। ওই তো, একেবারে পাশেরটাকে দেখলে মনে হচ্ছে, ভুঁড়িওলা হর্ষবর্ধন। ভাই গোবর্ধন কই? হি হি। দারুণ মজা তো। বড়ি সে কম দেখেনি। বহুবারই দেখেছে। কিন্তু এরকম মজার লাগেনি কখনও! আশ্চর্য!

কিন্তু তাকে ডাকলটা কে? ধমকই বা দিল কেন?

টিকুদের বাড়ির ছাদে একটা কাক বসে আছে। বসে বিজ্ঞের মতো একবার এদিকে, একবার ওদিকে ঘাড় কাত করছে। ঠিক যেন অঙ্কের স্যার বিজিতবাবু! ওই কাকটাই ডাকল নাকি? দূর। ভোম্বল নিজের মনেই হেসে ফেলল।

এই মাঝদুপুরে কে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে? পেটকাটা? না না মুখপোড়া। আহা, আর একটা ঘুড়ি থাকলে দারুণ হত। নিশ্চয় দু’জনে মিলে প্যাঁচ খেলত। জমিয়ে প্যাঁচ খেলা দেখা যেত। দুপুরবেলার ঘুড়ির প্যাঁচে অন্যরকম মজা হয়। হাওয়া বেশি থাকে না বলে, সুতো ছেড়ে খেলতে হয়। অনেকক্ষণ ধরে খেলা চলে। ভোম্বল অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল।

কিন্তু ডাকলটা কে?

এই রে, নীতিশকাকুদের পেয়ারা গাছটায় কে যেন উঠেছে। কে উঠেছে? ভোম্বল গ্রিলের ফাঁক দিয়েই ঝুঁকে পড়ল। পটলা না? হ্যাঁ পটলাই তো। উফ, এইটুকু ছেলে, কী দুষ্টু রে বাবা! তপতী কাকিমাদের নারকোল গাছটা কত বড় হয়ে গেছে! পাতাগুলো জড়িয়ে মুড়িয়ে ঠিক জঙ্গলের মতো মনে হচ্ছে। আফ্রিকার জঙ্গল। এক্ষুনি টারজান নেমে আসবে। এই যাঃ ভুবনদের ছাদ থেকে একটা গামছা উড়ে গেল। বেশ হয়েছে। ভুবনটা মহা পাজি। ইস মেঘ করেছে। বেশি নয়, অল্প। ছেঁড়া ছেঁড়া। ঠিক যেন একটা দাড়িওলা ছাগল ভুল করে আকাশে উঠে পড়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে! ছাগলের শিং কোথায়? ডোম্বল মেঘের মধ্যে ছাগলের শিং খুঁজতে খুঁজতে খেয়াল করল, মেঘ আর ছাগল নেই। হয়ে গেছে টুপিওলা সাহেব। বাঃ। ভারী মজার! সাহেব কোট প্যান্ট পরেছে?

একটু পরেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। তবে সব আকাশটা জুড়ে নয়। শুধু এই দিকে একটুখানি বৃষ্টি! ওই দিকটায় রোদ। একই সঙ্গে রোদ-বৃষ্টি যে ভোম্বল আগে কখনও দেখেনি এমন নয়। দেখেছে। তবে এমনভাবে মন দিয়ে দেখেনি। সোনালি আলোয় রুপোলি বৃষ্টির জল বুঝি এত সুন্দর লাগে! ভোম্বল মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

বৃষ্টির জল ধরবার জন্য ভোম্বল জানলা দিয়ে হাত বাড়াল।

আরও এক সপ্তাহ ভোম্বল ছাদের ঘরে রইল। এখন সে একদম ভাল হয়ে গেছে। ডাক্তারবাবু আজ সকালে তাকে দেখে গেছেন। হাসিমুখে বলেছেন, গুড। রেস্টটা তা হলে ভালই হয়েছে দেখছি।

ভেম্বলের খাটটাট সব ছাদের ঘর থেকে নেমে এসেছে। কাল থেকে সে স্কুলে যাবে। বিকেলে মাঠেও যেতে পারবে। তবে বেশি সময়ের জন্য নয়। বাড়ির সকলে খুশি। খুশি ভোম্বলও। তবু একটু একটু মন খারাপ করছে যেন! কার জন্য মন খারাপ? ছাদের ঘরের দুপুরবেলাগুলোর জন্য? ঠিক তাই। সেই সেদিনের পর থেকে ছাদের ঘরে তার একটুও একা লাগেনি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কত মজার মজার জিনিস দেখেছে সে! দুপুর যে এত আনন্দের, এত মজার হতে পারে কে জানত? তার জন্যই মন খারাপ।

তবে মন খারাপের সঙ্গে একটা মন ভাল করা ব্যাপারও আছে।

সেদিন বুঝতে পারেনি, কিন্তু আজ ভোম্বল বুঝতে পারছে, সেদিন কে তাকে ডেকেছিল? কে তাকে কাঁদতে বারণ করেছিল? কে তাকে বলেছিল, অ্যাই ছেলে, বাইরে তাকা?

তার নাম দুপুর। দুপুরবেলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *