ভোজন
খাবার যেমনই হোক, বোগড়া চালের ভাতই হোক আর পুঁই-কুমড়োর ঘ্যাঁটই হোক, বেশ সাজিয়ে গুজিয়ে বসতে পারলে তার স্বাদই পালটে যায়। বেশ ঝকঝকে একটা খাবার টেবিল হবে, পরিষ্কার স্টেনলেস স্টিলের থালা, কোথাও একফোঁটা জল লেগে নেই, একছিটে সাদাটে দাগ নেই, মাঝখানে চুড়ো করে সাজানো ভাত, পরিষ্কার ঝকঝকে বাটিতে ডাল, পাতের একপাশে তরকারি, একটুকরো লেবু, একছিটে শুকনো ঝরঝরে নুন, খাই না-খাই লাল টুকটুকে যুবতী একটি লঙ্কা। দূর থেকে একনজর দেখে নিয়ে, বাহ বলে এগিয়ে গিয়ে বসা। আমি যে বাড়িতে থাকি, সে বাড়িতে খাবার একটা টেবিল আছে। একসময় খুব ঝকঝকে ছিল, তা আমার শুচিবায়ুগ্রস্ত বউ-এর ঘষা-মাজার ঠেলায় দাঁত-ছিরকুটে গেছে। আধ কৌটো মোম-পালিশ ঘষেও তার জেল্লা ফেরানো যায়নি। সেই টেবিলের ওপর একটা গোল লোহার রিং আছে। সেই রিংটার ওপর একটা দশাসই প্রেসার কুকার এসে বসে। বসাবার কোনও ছিরিছাঁদ নেই। কখনও ডানদিকে কাত, কখনও বাঁ-দিকে কাত। তার ওপর একটা হাতা, ‘সখি ধরো ধরো’ অবস্থায় দোল খেতে থাকে। এরপর একে-একে বাটি, অ্যালুমিনিয়ামের কড়া আসতে থাকে আসর জমাতে। অ্যালুমিনিয়ামের কড়াতে মাছের ঝাল, তার ওপর একটা খুন্তি, আর বিভিন্ন মাপের বাটিতে যাবতীয় তরকারি। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো আমাদের বাড়িতে তিন জাতের তিনটে কুকুর। তাদের আবার তিন জাতীয় পথ্য, সেই তিনজাতীয় খাবারও ওই খাবার টেবিলে। খাবার ঘরটা একসময় খুব সাজানোর চেষ্টা হয়েছিল। কাচের জানালা, দেওয়ালে প্ল্যাস্টিক রং, শেড লাগানো একজোড়া বাহারি আলো, ফুরফুরে একটা দেওয়াল পাখা, একটা হুক থেকে ঝোলানো হয়েছিল একগুচ্ছ নকল পুষ্পস্তবক। বাঙালি বাড়ির দেওয়াল কখনও পরিষ্কার রাখা যায় না। কারণ দেওয়ালই হল তাদের হাত মোছার জায়গা। কাচের শার্সি জীবনে পরিষ্কার না করাটাই বাঙালির ধর্ম। টেবিলটা একটা দিকের দেওয়ালে ঠেসানো। রোজ ভিজে কাপড় দিয়ে মোছার ফলে সেই দেওয়ালে টেবিল বরাবর কালো একটা দাগ পড়ে গেছে।
আমি যখন সেই টেবিলে খেতে বসি, তখন মনে হয়, কলকাতার ফুটপাথে থালা পেতেছি। এপাশে ওপাশে ভাত ছড়িয়ে আছে, একধার দিয়ে জল গড়াচ্ছে, কোথাও একটু ঝোল পড়ে আছে। সূক্ষ্ম একটা মাছের কাঁটা জীবন্ত হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। রহস্যটা হল তিনটে পিঁপড়ে সেই কাঁটাটাকে বলহরি হরিবোল বলে কোথাও টেনে নিয়ে চলেছে। টেবিলটার এই অবস্থা হওয়ার কারণ আমার আগে যিনি খেয়ে গেছেন তার উদার মনোভাব। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর কোনও এক সময়ে জন্মানোর ফলে অতি মাত্রায় স্বাধীন। আমার সামনে জল প্যাচপ্যাচে একটা থালা, তার যত্রতত্র শ্বেতীর দাগ। কারণ ঠিকে বাসন মাজার মেয়েটি মিনিটে ডজনখানেক থালা মেজে এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়িতে ফুরুক করে উড়ে চলে যায়। থালার এই চেহারা সম্পর্কে অভিযোগ করলে একটা তিরিক্ষি জবাবই আমার বরাতে জোটে, ‘তুমি তো থালাটা খাবে না, খাবে ভাত?’ আমি বসার পর প্রেসার কুকারের ঢাকনা খোলা হবে। খোলার ঠিক আগের মুহূর্তে ভারী হাতাটা পিলে চমকানো শব্দে গিয়ে পড়বে মাছের ঝালের কড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে খুন্তিটা ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে মেঝেতে গিয়ে পড়বে। সেখানে বসে আছে একটা লোমওয়ালা কুকুর আর গোটাকয়েক ‘গেস্ট’ বেড়াল। শালীন কুকুরটার খুন্তির এই অশালীন আচরণ সহ্য হবে না। সে তারস্বরে ঘেউঘেউ শুরু করবে। এইটাকে বলা চলে, লাট সাহেবের খাওয়ার আগে তোপ দাগা। প্রেসার কুকারের ঢাকনা খোলা এক বিদঘুটে কাজ। তার অনেক কেরামতি। যিনি খুলবেন, তাঁর হাতের কনুই একবার এদিকে ঘুরবে, একবার ওদিকে ঘুরবে; তারপর ঘড়াস করে একটা শব্দ করে ঢাকনাটা খুলে আসবে। আর ঢাকনাটা তোলার সঙ্গে-সঙ্গেই প্রেসার কুকারের ভালভটা গিয়ে পড়বে ডালের জামবাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে শান্তির জলের মতো কিছু ডাল ছিটকে আসবে গেঞ্জির বুকে। এই ডাল ছিটকে আসার আগে দু-তিনবার কনুই-এর গুঁতো খাওয়া হয়ে গেছে। এই খাওয়াটাকে আমি মনে করি অ্যাপেটাইজার। এইবার একগুঁয়ে পরিবেশনকারী হাতার পর হাতা ভাত দিতেই থাকবেন। আমি যতই না না করি, তিনি থামবেন না, কারণ তাঁর ধারণা, একটা মানুষের পেটে যতটা গেদে দিতে পারবে ততই তাঁর শান্তি। বাঙালি পরিবারে পুরানো একটা কথা চালু আছে পেট ঠেসে খাওয়া। তাতে তোমার চোখ ছাড়াবড়া হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। এখন যেই আমি বললুম, তোমার কোনও পরিমাণ-জ্ঞান নেই, সঙ্গে-সঙ্গে তিনি হাতা ফেলে, পরিবেশন ফেলে গুমগুম করে স্থানত্যাগ করলেন। এইবার তিনি কোথায় যাবেন, আমি জানি। সোজা তিন তলার ছাদে। সেখান থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ঠাকুরঘরের ছাদে। সেখানে বসার জন্যে একটা উঁচু বেদি করা আছে। সেই বেদির ওপর তিনি বীর হনুমানের ভঙ্গিতে গিয়ে বসবেন। বসবেন, মানে বসেই থাকবেন। মেয়েদের রাগ অতি সাংঘাতিক জিনিস, মানুষ হলেও গাছের মতন শেকড় বাকড় বেরিয়ে যেতে পারে। মায়ের জায়গায় এগিয়ে এল মেয়ে। এসেই বললে, মায়ের এই এক বেশ পলিসি হয়েছে; কিছু হল কি না হল, সব ফেলে চলে গেল টঙে। কী-কী পেয়েছ? থালা পেয়েছি, পাহাড়ের মতো ভাত পেয়েছি। এত ভাত আমি জীবনে খেয়েছি। তুলে নে তো।
মেয়ের উত্তর, তোলাতুলি পারব না, যা খাবে খাও, বাকি ফেলে রাখো পাতে।
মা-ও রাগপ্রধান, মেয়েও রাগপ্রধান।
এই নাও নুন, এই নাও লেবু, এই নাও উচ্ছে, এই নাও ঢ্যাঁড়স ভাতে।
বন্যার সময় হেলিকপ্টার থেকে যেমন খাবারের প্যাকেট পড়ে, সেইরকম আমার পাতের চারপাশে ধপাধপ পড়তে লাগল। নুন জলে ধুয়ে সাগর জলের মতো এগিয়ে আসছে। লেবুতে কালো দাগ। বললেই বলবে বঁটির কষ। বঁটির কষ মানে লোহা, লোহা মানে আয়রন ক্যাপসুল, আয়রন ক্যাপসুল মানে অ্যানিমিয়ার ওষুধ। ভাতে চুল থাকলে বলবে, ও তোমারই মাথার চুল। ন্যাড়া হয়ে খেতে বসলে ভাতে আর চুল পাবে না। ঢ্যাঁড়সের গায়ে কুকুরের লোম যেন ঢ্যাঁড়স ঋষি। বললেই বলবে, বাড়িতে লক্ষ গণ্ডা কুকুর-বেড়াল থাকলে দু-দশটা লোম খেতেই হবে। আমাকে ডাকাত-দলের সর্দার ভেবে সব রান্নাই প্রায় আলুনি। বললেই বলবে, নুন বেশি হওয়ার চেয়ে কম হওয়াই ভালো। নেগেটিভ পজিটিভ করা যায়। পজেটিভকে নেগেটিভ করা যায় না।
এরপর মানভঞ্জন পালা। আমি ছাদে উঠে গেলাম। বেদির ওপর দেবী। আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়াম বাজাবার ভঙ্গিতে গাইতে লাগলাম, মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, মেরা পাৎলুন হিন্দুস্তানী। দেড়শো গজ দূরে আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি। তার ন্যাড়া ছাদে দাঁড়িয়ে আমার পিসতুতো বোন। তার সঙ্গে আমার স্ত্রীর তুই-তোকারির সম্পর্ক। সে চিৎকার করতে লাগল, কি রে, টঙে উঠে বসে আছিস? বেশ আছিস।
চড়চড়ে রোদে শুরু হল আমার ভৈরবী—নামো, নামো, সংসার অন্ধকার। নামো-ও। মনে-মনে বলতে লাগলাম, জয় জয় দেবী চরাচর সারে। দুব্বো গজাল হাড়ে।