ভৌতিক উপন্যাস
ভৌতিক গল্প

ভৈরব আচার্যের কথা

ভৈরব আচার্যের কথা

সময়টা ১৯৪৪—৪৫ সাল। অর্থাৎ তখনও দেশ ভাগ হয়নি। শেয়ালদা—যশোর লাইনে বনগ্রাম ছিল একটা নগণ্য স্টেশন। বনগ্রাম নয়—’বনগ্রাম জংশন’! শেয়াল ডাকা যে স্টেশন সন্ধের পর কেরোসিনের টিমটিমে আলোয় স্টেশনমাস্টার নিজেই ঘটাং ঘটাং করে পাঞ্চ করে মাত্র খান দশেক টিকিট বিক্রি করেন সেই স্টেশনও নাকি জংশন!

হ্যাঁ, জংশনই। বনগাঁ থেকে একটা ফ্যাকড়া লাইন মাত্র তিনটি স্টেশন—গোপালনগর, মাঝেরগ্রাম, গাঙনাপুর হয়ে পৌঁছেছে রানাঘাট। এইসব স্টেশনে প্যাসেঞ্জার খুব কম। লাইনের দু—পাশে খাঁ খাঁ মাঠ কিংবা জঙ্গল।

খাস বনগাঁর চেহারাটা সেদিন কীরকম ছিল আজকের বনগাঁয় যাঁরা যাতায়াত করেন তাঁরা কল্পনাই করতে পারেন না। সংকীর্ণ ইছামতী নদী বনগাঁকে দু’ভাগ করে দিয়েছে। একটি ভাগে পড়েছে বনগ্রাম স্টেশন থেকে ইছামতীর চর পর্যন্ত। যেটা বনগাঁ শহর বাজার। আর বোটের ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে ওপারে পৌঁছলে আর এক বনগাঁ। এ বনগাঁর চেহারা আলাদা। দীর্ঘ যশোর রোডের দু—পাশে আকাশছোঁয়া সারবদ্ধ শিশুগাছ। মোতিগঞ্জ পার হয়েই পেট্রাপোলের দিকে জয়পুর, ছঘরিয়া, হরিদাসপুর, নাভাঙার সাঁকো পার হয়ে যতই এগোনো যায় রাস্তার দু—পাশে শুধু মাঠ আর বন। এত বন যে মনে হয় এর জন্যেই বনগ্রাম নামটা সার্থক।

এই সারবদ্ধ বনের সঙ্গে সুন্দরবনের যোগ আছে, সে সময়ে স্থানীয় লোক তা মনে করে আতঙ্কিত হত।

তারা মনে করত এই বনের পথ ধরেই মাঠ, নদী—নালা পার হয়ে সুন্দরবনের কোনো ভয়ংকর জন্তু হয় তো একদিন ঢুকে পড়বে শহর বনগাঁ—এ না হলেও, ছ’ঘরে, জয়পুর, হরিদাসপুরের সীমানায়।

কিন্তু এ তো অসম্ভব কল্পনা। কোথায় উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁ! আর কোথায় মোছলন্দপুর হয়ে বসিরহাট পেরিয়ে তারপর ইছামতীর ধার ঘেঁষে হাসনাবাদ হয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবনের সীমানা…

কিন্তু তবু মোতিগঞ্জ, জয়পুর, হরিদাসপুরের লোকেরা গভীর রাতে হঠাৎ হঠাৎ অজানা পাখি কিংবা অচেনা জন্তুর বুক—কাঁপানো ডাক শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে।

পরের দিন শিশুগাছের নীচে ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে বাঁশের মাচানে বসে খদ্দেররা চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ভয়ে ভয়ে কথাটা তোলে—কাল রাতে কিছু শুনেছিলেন কর্মকারমশাই?

কানাই কর্মকার যেন এইরকম একটা কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করে ছিলেন। বললেন—শুনিনি আবার! ও ডাক যে মরা মানুষকেও জাগিয়ে দেয়। বাপরে!

——ডাকটা কোনদিক থেকে এল বলুন তো! জিজ্ঞেস করল সাহেব আলি মণ্ডল।

—দক্ষিণ দিক থেকে। চায়ের দোকানের মালিক রেণুপদ চায়ের গেলাসে চামচ নাড়তে নাড়তে বলল।

—হ্যাঁ, ঠিক। ব্রহ্মডাঙার দক্ষিণে যে বনটা তারই মাথার ওপর থেকে। রেণুপদর কথার সমর্থন করল গদাই কৃতেন।

—কিন্তু ডাকটা কীসের? আমি ঘুমের মধ্যে যতদূর শুনেছি পরপর তিনবার ডেকেই থেমে যায়।

—তার পরেও দূরে আর একবার ডাকতে শোনা গিয়েছিল।

এইভাবেই যশোর রোডের ধারে ছোট্ট চায়ের দোকানটা সক্কালবেলাতেই সম্ভব—অসম্ভব নানা বিতর্কে জমে ওঠে।

এই ডাক যে প্রথম শোনা গেল তা নয়। এর আগেও শোনা গিয়েছিল—কেউ বলে পাঁচ বছর আগে, কেউ বলে তা বছর তিনেক আগে তো বটেই। কিন্তু বড়ো সমস্যা ডাকটা কীসের তা কেউ বলতে পারে না। হরিদাসপুরের লোকেরা বলে কোনো অজানা পাখির ডাক, আর জয়পুরের লোকেদের বিশ্বাস ও ডাক কোনো ভয়ংকর জন্তুর। আবার কেউ কেউ বলে কোনো অশরীরী আত্মার আর্তনাদ। নইলে ছোটো ছেলের কান্নার মতো কোনো জন্তুর ডাক হয়?

একজন বললে—একবার ভৈরব গুণিনকে জিজ্ঞেস করলে হয় না? ঝিকরগাছায় তো খড়ি কেটে, মন্ত্রের জোর দেখিয়ে খুব নাম করেছিল। যশোর—খুলনাতেও তার নামডাক আছে বড়ো ওঝা হিসেবে। কত সাপে—কাটা রুগি, কত ভূতে—পাওয়া রুগি—বেঁচে উঠেছে ওনার ঝাড়ফুঁকের জোরে। লোকটি নিতান্ত ফ্যালনা নয় হে।

এ কথায় সবাই বললে—তা মন্দ বলনি। একবার গেলে হত।

এইরকম সময়েই অর্থাৎ ১৯৪৪—৪৫ সালে আমাকে একবার আসতে হয়েছিল এই বনগাঁয়ে। উঠতে হয়েছিল মোতিগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়ি। বনগাঁ স্টেশন থেকে রিকশা করে যখন ইছামতীর এপারে নামলাম তখন বিকেল। তারপর পায়ে হেঁটে বোটের পোল পার হয়ে মোতিগঞ্জ। দু—পাশে শিশুগাছে ছাওয়া রাস্তা চলে গেছে সোজা যশোর। আমার আত্মীয়ের বাড়ি বোটের পোল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কাজেই হাঁটাই শুরু করলাম। অবশ্য হাঁটা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না তখন। রিকশা চলত শুধু শহরের মধ্যে।

অল্প কয়েকটি দোকান। দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল অনেকগুলো। কিন্তু সবই পুরোনো, জীর্ণ। তখনও বিকেল শেষ হয়নি। এরই মধ্যে লোক চলাচল কমে গেছে। এই সন্ধের মুখে কোথায় বা যাবে এক বনগাঁ টাউন ছাড়া? যেতে গেলে ইছামতী পার হতে হবে বোটের ওপর দিয়ে। কিন্তু প্রায়ই এই সন্ধের মুখে একটা জোর বাতাস ওঠে। সেই বাতাসে উত্তাল ইছামতীর সবুজ জল কলবল খলবল করে ওঠে। অন্ধকারে অসাবধানে বোটের কিনারে পা পড়লে আর রক্ষে নেই।

আমার আত্মীয়ের বাড়িটাও খুব পুরোনো। অনেকখানি উঠোন পাঁচিলঘেরা। অনেক জায়গাতেই ইট ভেঙে পড়েছে। যে কেউ ইচ্ছে করলে পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। বাড়ির পিছনে খানিকটা মাঠ। তারপর আমবাগান আর বাঁশঝাড়। সন্ধে লাগবার আগেই ওদিকের জানলাগুলো বন্ধ করে দিতে হয়। সন্ধের পর ওদিকটা যেন এক নিষিদ্ধ জগৎ।

উঠোনের একপাশে একটা নিমগাছ আর একটা পেঁপে গাছ। ওদিকে একটা ইঁদারা। ইঁদারার তিনদিক ঘিরে ঝাঁপ ফেলে বাথরুমের ব্যবস্থা। আর খাটা পায়খানাটা একেবারে মাঠের দিকের পাঁচিল ঘেঁষে। বাড়ির লোকে সাবধান করে দেয়—’রাত্তিরে ওদিকে না যাওয়াই ভালো।’

কেন না যাওয়াটা ভালো তা আর জিজ্ঞেস করতে হয় না। জীর্ণ টিনের ছাউনি দেওয়া পায়খানার ঠিক মাথার উপর নিষ্ফলা আমগাছের একটা শুকনো ডাল গভীর রাত্রে বাতাসের ধাক্কায় মাঝে মাঝে দুলে ওঠে। মনে হয় কোনো অশরীরী জীব যেন তার রক্তমাংসশূন্য হাতটা নাড়ছে।

এ তো কাল্পনিক ভয়। এ ছাড়া বাস্তবের কিছু ভয় আছে। সে কথা মনের মধ্যেই চাপা থাকে।

রাস্তার ধারে শিশুগাছের নীচে সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে আমিও প্রায় যাই। কলকাতার ‘বাবু’ বুঝে দোকানি আমায় বেশ খাতির করে। খাতির করার আরও কারণ, আমার মতো নগদ খদ্দের তার খুব কমই আছে। শুধু দোকানিই নয়, অন্য খদ্দেররাও আমায় সমীহ করে। এদের মুখেই আমি প্রথম শুনি সেই রহস্যময় ডাকের কথা। আর শুনি ভৈরব আচার্যের কথা। গুণিন হিসেবে তাঁর জুড়ি নাকি এ অঞ্চলে নেই। তাঁর ‘গৃহবন্ধন’ ‘ক্ষেত্রবন্ধন’ মন্ত্র অব্যর্থ। কোনো জন্তু—জানোয়ার দূরের কথা, সাপ পর্যন্ত ঢুকতে পারে না ঘরে। আমার আত্মীয়টির বাড়ির সকলের মুখেই তাঁর কথা। ভৈরব আচার্য নাকি সাপে—কাটা মড়াও বাঁচিয়ে তুলতে পারে! কাছেই বাড়ি। তাই একদিন চলে গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জীবনে কখনও ওঝা, গুণিন দেখিনি। তাই কৌতূহলটা ছিল বেশি।

আমাদের বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড় আর মাঠ ছাড়িয়েই তাঁর বাড়ি। একতলা। টালির ছাউনি। উঁচু দাওয়া। সামনে উঠোন। পাশে সবজির বাগান।

উঠোনে একটি বছর সাতেকের ছেলে মার্বেল খেলছিল। তার চোখে চশমা। দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে পাঁচ—ছ’ বছরের একটি মেয়ে একটি একটি করে মুড়ি খাচ্ছিল।

ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম—তুমি কি ভৈরববাবুর ছেলে?

সে মাথা দুলিয়ে সায় দিল।

—একবার ডেকে দাও।

—বাবা বাড়ি নেই।

—বাড়ি নেই! কোথায় গেছেন?

—জানি না।

—কখন আসবেন?

—জানি না।

এমনি সময়ে ঘরের মধ্যে থেকে খুব ভারী গলার স্বর শোনা গেল—ক্যা রে গোপী?

কোনো মহিলার গলার স্বর যে এত মোটা হতে পারে এমন ধারণা আগে ছিল না।

গোপী উত্তর দিল—একটা লোক মা।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যে মহিলাটির আবির্ভাব ঘটল তাঁকে দেখে কেমন থমকে গেলাম। যেমনি লম্বা তেমনি চওড়া চেহারা। কুচকুচে কালো রং। মস্ত গোলমুখ। সদ্য স্নান করেছেন। পিঠ জুড়ে ভিজে চুলের রাশ। কপালে টাকার মতো বড়ো সিঁদুরের টিপ। সিঁথির সিঁদুর, হাতের নোয়া, শাঁখা একসঙ্গে যেন তাঁর স্বামীর গৌরব ঘোষণা করছে।

—কী চাই?

নম্র গলায় বললাম—আচার্যমশাই আছেন?

মহিলাটি বললেন—না। ‘কলে’ গেছেন।

‘কলে’ গেছেন! অবাক হলাম। ‘কলে’ তো ডাক্তাররাই যায়। ইনিও কি—

—কখন ফিরবেন?

মহিলাটি চোখ—মুখ ঘুরিয়ে বললেন—বলা যায় না। গোপালনগর গেছেন। শক্ত কেস—ঘন ঘন ভিরমি খাচ্ছে ঘরের বৌ। আপনার কী কেস আমায় বলে যেতে পারেন।

ইতস্তত করে বললাম—আমার কোনো কেস নেই। এমনি আলাপ করতে এসেছিলাম।

ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন—কেস নেই! এমনি এমনি আলাপ করতে এসেছেন! না দাদা, উনি শুধু শুধু দেখা করেন না। অত সময় ওঁর নেই। চার জায়গায় তাঁকে ছুটতে হবে পরপর ক’দিন। পার্টি টাকা অ্যাডভান্স করে গেছে। তার মধ্যে তিনটে গৃহবন্ধনের কাজ আছে। একটা আবার মুখবন্ধন!

ফিরে এলাম। বুঝলাম আচার্য—গৃহিণী স্বামীগর্বে বেজায় গরবিনী! তা ছাড়া পয়সা রোজগারও ভালোই হয়। কিন্তু এই সব তুকতাক, ঝাড়ফুঁকে কাজ কতটা হয় তার কি কোনো নজির আছে? সবই তো দূরে দূরে। বাঁচল কি মরল, ভালো হল কি হল না এখান থেকে কে তা দেখতে গেছে?

সেদিন এই জয়পুর, হরিদাসপুর, অঞ্চলে হঠাৎ চাঞ্চল্য—আগের দিন গভীর রাতে সেই ডাক নাকি আবার শোনা গিয়েছিল। তবে খুব অল্প সময়ের জন্যে। এবার নাকি গত দু—বছরের মধ্যে চারবার শোনা গেল। তবে অন্যবারের মতো সবাই শুনতে পায়নি। অল্প কিছু লোক শুনেছে। আর তারা যে ভুল শোনেনি তার ভয়ংকর প্রমাণ পাওয়া গেল হরিদাসপুরের জঙ্গলে একটা ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে। হিংস্র জীবটি গভীর রাতে জীবন্ত মানুষ না পেয়ে কাঁচা কবর থেকে একটা তাজা মৃতদেহ তুলে ছিঁড়ে খেয়েছে। এমন ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি।

ইস! এখানে থাকা সত্ত্বেও ডাকটা শুনতে পেলাম না! তবু ছুটলাম হরিদাসপুর। তখন সবে পুলিশ মৃতদেহটা তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু ভিড় কমেনি। এগিয়ে যেতে দেখলাম একজন মধ্যবয়স্ক লোককে ঘিরে লোকে কথাবার্তা বলছে। লোকটি মোটাসোটা। গায়ে হাফহাতা পাঞ্জাবি। গলায় রুদ্রাক্ষ আর কাচের মালা। হাতে অজস্র তাগা—তাবিজ। কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা। জানলাম ইনিই স্বনামধন্য ভৈরব আচার্য। তাঁর হাতে একটা ঝকঝকে ত্রিশূলও আছে।

তিনি গত রাতে কোনো ডাক শুনতে পেয়েছিলেন কিনা কবুল করলেন না। এখন ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। মৃতদেহটিও তিনি দেখে এসেছেন।

সবাই তাঁকে ছেঁকে ধরেছে। জিজ্ঞেস করছে—বলুন আচার্যমশাই, আপনি থাকতে এসব কী অলৌকিক ব্যাপার ঘটছে!

ভৈরব আচার্যের ঠোঁটে হালকা হাসি লেগেই আছে। বললেন—ও কিছু নয়।

কিছু নয়! কিছু নয় তো কবর থেকে মড়া তুলে খায় কীসে?

কিন্তু ভৈরব আচার্যের মুখের ওপর কিছু বলতে সাহস হয় না। তবু কেউ সাহস করে জিজ্ঞেস করে—ওই ডাক কি কোনো অজানা হিংস্র পাখির কিংবা জন্তুর? এলই বা কোথা থেকে?

এক বৃদ্ধ বললেন—আমাদের মনে হয় সুন্দরবনে কত রহস্যময় জন্তু—জানোয়ার তো আছে—তাদেরই কোনোটা হয় তো দলছুট হয়ে জঙ্গলের পথ ধরে এদিকে এসে পড়েছে…

কিন্তু সদাব্যস্ত আচার্যমশাই—এর এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অলস জল্পনা—কল্পনা শোনার ধৈর্য নেই। অসহিষ্ণু হয়ে বলে উঠলেন—অহেতুক ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার ওপর কি আপনাদের বিশ্বাস নেই? আমি তো এখানে এসেই পঁচিশ কাঠা জায়গা জুড়ে নিজের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে ‘ক্ষেত্রবন্ধন’ দিয়ে দিয়েছি। রয়াল বেঙ্গলের বাপেরও সাধ্য নেই এ তল্লাটে ঢোকে।

বলেই তিনি হাতের ত্রিশূল মুঠোয় শক্ত করে ধরে বাড়ির দিকে ফিরে গেলেন।

আমার মনে হল আচার্য—গৃহিণীর চেয়ে স্বয়ং আচার্যমশাই—এরও অহংকার কম নয়। একমাত্র তিনিই যেন এ অঞ্চলের রক্ষাকর্তা।

এর মাসখানেক পর।

অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি। শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই অন্ধকার নেমে আসে। বাইরে বেরোনো যায় না। অন্ধকার ঘুটঘুন্টে পথে কে বেরোবে? তার ওপর রাস্তার দু—পাশে সার সার শিশুগাছ যেন অন্ধকারকে আরও ভয়ংকর করে তোলে।

বিকেল হতে না হতেই আমাদের বাড়ির জানলাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। একতলা বাড়ি বলেই বোধ হয় একটু বেশি সাবধান হতে হয়।

টিনের চাল দেওয়া রকে একটা চৌকির ওপর গরম চাদর জড়িয়ে বসেছিলাম। দরজার কোণে লণ্ঠনটা জ্বলছিল টিমটিম করে। চারিদিকে নিস্তব্ধ। রাস্তার ওপারে ঝোপেজঙ্গলে ঝিঁঝিঁ ডেকেই যাচ্ছিল অবিশ্রান্ত।

হঠাৎ বাড়ির খুব কাছে একটা অদ্ভুত ডাক শোনা গেল ওঁয়া—ওঁ—য়া—

ঠিক যেন কোনো বাচ্চা ছেলে মর্মান্তিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাঁদছে। তার পরেই মনে হল কোনো কিছু যেন বাড়ির ঠিক পিছনের জঙ্গল দিয়ে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে পিছনের জানলাটা খুলে দেখতে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে জন্তুটা চলে গেছে।

এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কত দূর আর যাবে মনে করে হাতে একটা লাঠি আর লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে পিছনের দিকে খিড়কির দরজাটা খুলতে গেলাম, বাড়ির পুরোনো কাজের লোকটি ছুটে এসে আমার হাত ধরে নিরস্ত করল—না, না, বাবু, বাইরে যাবেন না।

আমি থমকে গেলাম।

পরের দিন সকালে যদিও আমার মন টানছিল রেণুপদর চায়ের দোকানের দিকে, তবু আমি সে প্রলোভন কষ্ট করে সম্বরণ করলাম। কারণ, জানি ওখানে গেলে আমি গত সন্ধ্যার ঘটনা না বলে পারব না। আর তারপরই শুরু হবে অজস্র প্রশ্ন, সে সব প্রশ্নর সত্য উত্তর দিলেও সবাই তা বিশ্বাস করবে এমন মনে হয় না। আমাকে দোষ দিয়ে কেউ কেউ এমনও বলতে পারেন—একলা যেতে যদি সাহসে নাই কুলিয়েছিল তবে হাঁক দিয়ে লোক ডাকলেন না কেন?

শীতের নিস্তব্ধ রাতে হাঁক দিলেও যে লোক জড়ো হয় না এ কথা ওঁদের বোঝাব কী করে?

সন্ধের মুখে যখন গেলাম তখন কানাই কর্মকারমশাই দোকান থেকে বৈকালী চা খাওয়া সেরে একটি বিড়ি ধরিয়ে তাড়াতাড়ি উঠছিলেন।

আমায় দেখে ব্যস্ত হয়ে বললেন—এ কী স্যার এত দেরিতে এলেন? রেণুপদ যে ঝাঁপ ফেলে দিচ্ছে।

কেন এত তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করছে জানতে না চাওয়ায় কানাই নিজেই বললেন—তাড়াতাড়ি বন্ধ না করেই বা উপায় কী! কাল সন্ধের পর পরই তো—এবার পাড়াতেই—এই পর্যন্ত উচ্চারণ করে ব্যস্ত হয়ে বললেন—আপনার হাতে তো টর্চ আছে। চলুন আপনার সঙ্গেই যতটুকু যাওয়া যায়। বলে কানাই কর্মকার তেল সাশ্রয় করার জন্য হাতের লণ্ঠনটার দম কমিয়ে দিলেন।

কর্মকারমশাই—এর বাড়ি আমার বাড়ি থেকে কিছুদূর পশ্চিমে।

বেশি রাত হয়নি তখনও। তাই কানাই কর্মকারকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরব মনে করে ওঁর সঙ্গে সারা পথ টর্চ জ্বেলেই হাঁটতে লাগলাম।

আমাদের বাড়ির পিছনের মাঠ পেরিয়ে ভৈরব আচার্যের বাড়ি পেরিয়ে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে ধুলোভরা সরু রাস্তা। দু—পাশে ঝোপঝাড়। টর্চ জ্বালিয়েই চলেছি। হঠাৎ বাঁ দিকের ঝোপ থেকে ঝাঁপিয়ে কী যেন বেরিয়ে এসে সাঁ করে চক্ষের নিমেষে ডান দিকের ঝোপের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওই সময়টুকুর মধ্যেই দেখে নিয়েছিলাম একটা বড়ো কুকুরের দ্বিগুণ আকৃতির কুচকুচে কালো—কী জন্তু জানি না। তবে কিছুতেই বাঘ নয়। মুখে কিছু একটা বড়োসড়ো শিকার কামড়ে ধরা। কানাই কর্মকার আমাকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন।

সব কিছুই ঘটে গেল এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে। ভালো করে সব বুঝে উঠতে পারিনি। নিজেকে সামলাতে সময় লাগল আরও কিছুক্ষণ। তারপর কোনোরকমে কর্মকারমশাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ওই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরে এলাম।

পরের দিন সক্কালবেলায় অনেকেই ভৈরব আচার্যের বাড়ি এসেছিল ব্যাপারটা জানতে। সম্ভবত কানাই কর্মকারই ঘুম থেকে উঠেই রেণুপদর দোকানে গিয়ে সবিস্তারে বিষয়টি সকলকে জানিয়েছিলেন। আমিও গিয়েছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য অত সকালেও আচার্যমশাই—এর দরজায় তালা ঝুলছিল। এত সকালে বাড়ির সবাই মিলে কোথায় গেল প্রতিবেশীরা কেউ বলতে পারল না। তারা বললে ঘুম থেকে উঠেই দেখছে বাড়িতে তালা। এমন কখনও হয় না।

একে একে সবাই যখন ফেরার মুখে তখন হঠাৎ আমার চোখে পড়ল দাওয়ার একপাশে পড়ে আছে কতকগুলো পড়ার বই, খাতা, একটা চশমা আর—আর পিছনের পাঁচিলের দিকের মাটিতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। আঁতকে উঠলাম। মুহূর্তের দেখা সেই কালো জন্তুটার মুখে কী ছিল তা বুঝতে আর বাকি রইল না।

ভৈরব আচার্য আর এখানে ফেরেননি। অনেক পরে শুনেছিলাম উনি বর্ডার পার হয়ে ওপার বাংলার কোনো নিভৃত গ্রামে বাস করছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শোনা—স্বামী—স্ত্রী আর একটি মেয়ে নিয়ে সংসার। একটি ছেলে ছিল। সে নাকি মারা গেছে এক রাত্রে ওলাওঠায়।

কিন্তু কেন তিনি রাতারাতি দেশত্যাগ করলেন কেউ তা বুঝতে পারেনি। বুঝতে পেরেছিলাম আমি। মন্ত্র—তন্ত্রের জাদুকর তিনি। তাঁর তৈরি ক্ষেত্রবন্ধন যে এমন নিষ্ঠুর ভাবে ব্যর্থ হয়ে যাবে তা স্বামী—স্ত্রী কেউই কল্পনাও করেননি। সেই লজ্জায় রাতারাতি দেশত্যাগ।

২০০৪, ময়ূরপঙ্খী (নিউ বেঙ্গল প্রেস)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *