দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

ভেলপুরির ভেলকি

ভেলপুরির ভেলকি

এই এমন একটা পৌষ মাস চলে গেল, কোথায় আমাদের আস্কে পিঠে। কোথায় আমাদের পুলি পিঠে। ঝোলা নতুন গুড়। বড়দিনে সেই এক টুকরো চিটচিটে কেক জুটেছিল। দাঁতে-দাঁতে আটকে দাঁতি লেগে যাবার জোগাড়। আসল কেক খাওয়ার রেস্ত কোথায়। এক চিলতে সায়েবী কেকের দাম দশ বারো টাকা। দিশি কেকের বাহার হল মোড়কটা। আর বাহার হল ভেতরে সেট করা থাবা-থাবা মিঠে কুমড়োর টুকরো। কষের দাঁতে গর্ত থাকলে দিশি কেকের মজা আরও খোলে। দাঁতের যন্ত্রণায় ত্রাহি-ত্রাহি রব। কি হয়েছে ছোটবাবুর? না দাঁতে কেক ঢুকেছে। গুড়ে চোবানো পাঁউরুটি। সেই খেয়ে হ্যাপি নিউইয়ার। এখন আবার ক্যাসেট বিপ্লব চলেছে। ঘরে-ঘরে খ্যানখেনে টেপরেকর্ডার। তাইতে একটা ইংরিজি বাজনা চাপিয়ে লুঙ্গি পরা কত্তার বিলিতি নৃত্য। সেই চাল কোথায় যে পিঠে হবে। নতুন চালের সেদ্ধপিঠের আহা মরি সুবাস। সোঁদা-সোদা গন্ধ। ভেতর থেকে কাঠের গুঁড়োর মতো গুড় মাখা নারকেল কোরা বেরিয়ে আসছে। সেই দুধ কোথায়! ঘন দুধে ছোট-ছোট শ্বেত হস্তির মতো পিঠে জুবড়ে আছে। সেই পেট কোথায়! যে পেটে এক কুড়ি পিঠে কোনও অন্তর্বিপ্লব না ঘটিয়ে দিব্য অবস্থান করতে পারে। পেট এখন মানুষে-মানুষে বড় পোয়েটিক হয়ে উঠেছে। স্ন্যাকবারের হাওয়া বইছে। একটা রোল এক কাপ চা, তাইতেই রোলিং শুরু হয়ে গেল। ফিশের জায়গায় ফিশফিংগার। এরপর হবে ফিশ নেল। তারপর হবে ফিশ পিকচার। ফিশপিকচার দিয়ে একমুঠো ভাত মেরে দৌড়।

সেদ্ধ পিঠের কম ওজন। জলে ভেজা ছুঁচো। গোটা দশেক খাওয়ার পর মনে হয় পেটটা যেন সিমেন্টের বস্তা। কেজিখানেক ওজন তো বাড়েই। একালের চালের ভাত যখন ফোটে তখন নাকে পরিমল নস্যি ঠুসতে হয়। সেই চালের পিঠে। ময়লা-ময়লা রঙ। হাত ফসকে একটা মেঝেতে পড়ে রবারের বলের মতো লাফিয়ে উঠল। পোষা কুকুর দৌড়ে এসে দাঁত দিয়ে কামড়াকামড়ি করল প্রাণপণ শক্তিতে, তারপর দুহাত দুরে সরে গিয়ে বিজাতীয় জন্তু ভেবে রোম ফুলিয়ে গোঁ-গোঁ করতে লাগল। পিঠের সুনিপুণ শিল্পী আদুরে কুকুরকে বোঝাতে লাগলেন—বাবু! পিঠে বাবু। বাবু। পিঠে বাবু। পিতে পিতে।

এ কাল আর সে-কাল, মাঝে মাত্র তিরিশ কি চলিশ বছরের ব্যবধান, এর মাঝে বিলকুল সব পাল্টে গেল। মানুষ পাল্টে গেল। মানুষের মন বদলে গেল। কেমিকেল সারে সর্বনাশ করে দিলে। ফলন বেড়েছে, স্বাদ কমেছে। একালের মানুষ খাওয়াদাওয়া নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। ফ্রায়েড রাইসের যুগ পড়েছে। রোববারের স্পেশাল খাওয়া ফ্রায়েড রাইস আর মুরগিপাথর। ডিপ ফ্রিজ থেকে যখন বেরোয় তখন আর মুরগীত্ব থাকে না। জমাট একটা আকৃতি। সেই বস্তুকে প্রথম গরম জলে চোবাতে হবে। কান পেতে শুনতে হবে কখন ডেকে ওঠে ভোরের মুরগির মতো। ভয় দেখিয়ে রেখেছেন খাদ্যবিজ্ঞানীরা। ডিফ্রিজ করে না খেলে মরতে হবে। মাংসের স্তরে-স্তরে ফাঙ্গাস হয়ে থাকে। পেটে ঢুকলেই পয়জনিং। এর নাম আধুনিক সভ্যতা। পদে-পদে বিপদ নিয়ে খেলা করা।

ভড়ং-এর যুগ। মেঝেতে বসে খাওয়াদাওয়ার যুগ শেষ। বিলিতি টেবিল চাই। ডিনার টেবিল। কেরসিন কাঠ কি ডবলপ্লাইয়ের তক্তায় সানমাইকা সাঁটা। চারটে গোলপায়া ছেতরে আছে। প্রত্যেকটা পায়া পেতলের ফেজ টুপির মতো খাপ পরানো। একটা টেবিল, চারটে কি ছটা হাতল ছাড়া চেয়ার। দাম শুনলে ভড়কে যেতে হয়। কথায় আছে, ছেলের চেয়ে পিলে বড়। আধুনিক সংসার হল তাই। খরচের বহর দেখলে মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। রাতে ঘুম আসে না। এলেও নানা মাপের পাওনাদার দু:স্বপ্নে কিলবিল করে। ছেলের মাস্টারমশাই, মেয়ের নৃত্যশিক্ষয়িত্রী। মুদিখানার মালিক, মুখটা যার রয়্যালবেঙ্গলের মতো, সর্বোপরি স্ত্রী। অতবড় পাওনাদার আর পৃথিবীতে দুটি নেই। বৃহৎ এক ফর্দ বিশেষ। একটা মাসে সবই চাই। সবই আর্জেন্ট। একটা ঢাউস, তাগড়া সাবান তিনদিনে সাবাড়। ভিসিয়াস সার্কল। সাবানের ধাক্কায় চামড়া খসখসে হয়ে যাচ্ছে। সেই খসখসেকে তেলা করার জন্যে লাগাও ক্রিম। গ্লিসারিনে পাতিলেবু। দুধের সর। এর নাম সভ্যতার বাঁশ। সরষের তেল পেটে খাওয়া যায় । কারণ পেট তো ভেতরের জিনিস চোখে দেখা যায় না। সরষের তেল গায়ে মাখলেই ইরাপসান। নিয়ে এস ভিটামিনে ভরপুর মাসাজ অয়েল। শ্যাম্পু করে-করে চুল এত পাতলা হয়ে গেল যে স্বাভাবিক করার জন্যে এইবার ভাইটালাইজার লাগাও। চায়ের সঙ্গে আড়াইশো চানাচুর উড়ে গেল। ভীষণ অম্বল। গলায় ঢালো আধবোতল লিকুইড অ্যান্টাসিড। ফুচকা দেখলেই মানুষখেকো বাঘের মতো তেড়ে যায়। শেষে আবার ঠোঙা পেতে বলা হয়, খাট্টা লাগাও, খাট্টা। ঝালেঝোলে, নাকের জলে চোখের জলে হাপুসহুপুস, খাবি খাওয়ার অবস্থা। শেষে লিভার তেঁএটে মেরে গেল। সাত স্পেস্যালিস্টে রুগিকে নিয়ে ফুটবল খেললেন। প্রত্যেকেই কিছুক্ষণ পায়ে বল রেখে আর একজনকে পাশ দিয়ে দেন। প্রজাপতির মতো নোট উড়ছে ওদিকে রুগি শনৈ: শনৈ: ওপরের পথে। কি যুগে বসবাস। ভেলপুরির যুগ। ফলে খাওয়ার ঘর জুড়ে পড়ে আছে খানা টেবিল। কিন্তু খাওয়ার কিছু নেই। টেবিলে আবার চাদর পাতা। অনেকের বাড়িতে ছোট্ট ফুলদানিতে গুটিকয় একালের নকল ফুল। টেবিলের মাঝখানে বসান। প্রায় আসলের মতো দেখতে। এক-এক পিস ফুলের দাম পনের টাকা। তাই না কি! তাই নাকি! বলে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়। ফুলদানির পায়ের তলায় যমজ ভাইয়ের মতো একজোড়া ডিম্বাকার প্ল্যাস্টিকের কৌটো। একটায় নুন আর একটায় মরিচ। নুনাধারটি একালের আর একটি রসিকতা। ঝেড়েই যাও, ঝেড়েই যাও। কিছুই বেরবে না। ছোটদের ঝুমঝুমির মতো। অবশেষে প্যাঁচ খোলার চেষ্টা। হাপুস করে পড়ে গেল টেবিলে। নাও এবার বুকপকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে চেঁছে চেঁছে তোল।

টেবিলে নানা রকম সব সাজান হবে। বেশির ভাগই ডেকরেটিভ। সে সবে হাত দেওয়া অসভ্যতা। যে জানে না সে টানাটানি করবে। থালার সন্নিকটে যা যা থাকবে তাই খাদ্য। বাঁ হাতে চামচে লগবগিয়ে তুলে নাও। অফিসে বাঁ হাতের ইনকাম ডান হাতের চেয়ে বেশি হতে পারে। খাবার টেবিলে অপটু বাঁ হাত হান্ডা থেকে আর কত টানবে। আর কিই বা টানবে। সেই তো আমি অকৃত্রিম—কাঁকরমণি চালের ভাত, প্যান্তাখ্যাচাং ডাল, ভ্যাপসা ফুলকপি আর মমি ভাজার মতো একটুকরো মাছ। আর ব্রয়লার চিকেন? মনে হয় কারুর চিবনো ডাঁটা ছিবড়ে। খাওয়ার পর মজুরি পোষায় না। একটায় খাওয়া হল, পাঁচটা পর্যন্ত মুখে-মুখে ছুকছাক শব্দ। মাংস তো নয়, ‘ডেন্টাল ফ্লস’, সব ঢুকে বসে আছে দাঁতের ফাঁকে।

খাওয়া এখন আর খাওয়া নেই, আর্ট। টেবল কভারে এক ফোঁটা ডাল বা ঝোল যেন না পড়ে। যদি পড়ে নিমন্ত্রিত চলে যাবার পর গৃহস্বামী বলবেন, খেয়েচে দ্যাখ! ব্যাটা চাষা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *