1 of 2

ভেলকির হুমকি

ভেলকির হুমকি

এক

সবাই বলে গুলে-সর্দার পিশাচসিদ্ধ। সে ইচ্ছা করলেই যেখানে খুশি যেতে পারে, যেকোনো পশুপক্ষীর আকার ধরতে পারে, বাতাসের সঙ্গে মিশিয়ে যেতে পারে।

গুলে-সর্দারের নামে বর্ধমান জেলার ছেলে-বুড়ো-মেয়ে ভয়ে থরহরি কম্পমান। তার মতো সাহসী ও নিষ্ঠুর ডাকাতের নাম আর কখনো শোনা যায়নি।

সে যে কত লোকের যথাসর্বস্ব কেড়ে নিয়েছিল, কত মানুষের প্রাণ বধ করেছিল, কত গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তার আর কোনো হিসাব নেই।

জ্যান্ত বা মৃত— যে অবস্থাতেই হোক, তাকে ধরতে পারলে সরকার অনেক টাকা বখশিশ দেবেন বলে প্রচার করলেন বটে, কিন্তু আজ দশ বৎসরের ভিতরে কেউ তার মাথার একগাছা চুল পর্যন্ত ছুঁতে পারলে না। আমার মনেও সন্দেহ হল, তবে কি সত্যই সে ভূতুড়ে মন্ত্রতন্ত্র কিছু জানে?

তারপর তার অত্যাচারে আমরা সকলেই যখন দিশেহারা হয়ে উঠেছি, তখন হঠাৎ একদিন শোনা গেল, গুলে-সর্দার ধরা পড়েছে।

দুই

মথুরা মণ্ডল ছিল এ অঞ্চলের খুব বড়ো এক মহাজন। ডাকাতের দল নিয়ে গুলে-সর্দার এক অমাবস্যার রাত্রে তার বাড়ি আক্রমণ করলে। ঢেঁকি দিয়ে বাড়ির দরজা ভেঙে ডাকাতরা ভিতরে ঢুকেই দেখলে, উঠানের ওপরে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, স্বয়ং মথুরা মণ্ডল! পর মুহূর্তেই সে বন্দুক ছুড়লে এবং সঙ্গে-সঙ্গে একজন ডাকাত আহত হয়ে মাটির ওপরে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে গুলে-সর্দার বাঘের মতো মথুরার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল! মথুরা দ্বিতীয় বার বন্দুক ছোড়বার আগেই গুলে তার ধারালো রাম-দা চালালে। বেচারা মথুরার মাথা উড়ে গেল তখনি।

মথুরা মারা পড়ল বটে, কিন্তু ভাগনে ছিল উঠানের পাশের একখানা ঘরে। সেইখান থেকে সে জানলা দিয়ে ক্রমাগত বন্দুক ছুড়তে লাগল। বেগতিক দেখে ডাকাতের দল ভয়ে সেখান থেকে চম্পট দিলে। কিন্তু পালাবার সময়ে গুলে-সর্দার অন্ধকারে পাঁচিলের ওপর থেকে এমনভাবে হুমড়ি খেয়ে মাটির ওপরে এসে পড়ল যে, তখনি অজ্ঞান হয়ে গেল। তাকে বন্দি করা হল সেই সুযোগে।

তিন

সেখানকার থানার ইন্সপেক্টর ছিলুম আমি। গাঁয়ের লোকেরা গুলে-সর্দারকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এল।

লোকটার চেহারা কী ভয়ানক! মাথার একগাছা চুল নেই, চোখ দুটো ভাঁটার মতো গোল, জবাফুলের মতো লাল, নাক খ্যাঁদা, গোঁফ বিড়ালের মতো, হাতে কাঁধে আর বুকে লোহার মতো শক্ত শক্ত মাংসপেশী। লম্বায় সে প্রায় সাড়ে ছ-ফুট উঁচু এবং তার গায়ের রং আবলুস কাঠের মতো কুচকুচে কালো। তার গায়ে আর কাপড়ে রক্ত মাখা থাকতে তাকে আরও ভয়ানক দেখাচ্ছিল।

যদিও তার হাত-পা বাঁধা, তবু তাকে দেখে আমার কেমন ভয় করতে লাগল। পাহারাওয়ালাদের হুকুম দিলুম, তারা যেন সর্দারের চারিদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।

গুলে দাঁত বার করে হেসে বললে, ‘যতই ঘিরে থাকো আর হাত-পা বাঁধো বাবা, আমাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না!’

এমন সময়ে পুলিশের বড়ো সাহেব খবর পেয়ে তাকে দেখতে এলেন। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকে দেখে সাহেব বললেন, ‘সর্দার, আর তুমি আমাদের ফাঁকি দিতে পারবে না!’

গুলে ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করে বললে, ‘আরে রেখে দাও সায়েব, তোমাদের বাহাদুরি। আমাকে ধরে রাখে কে, আমি পাখি হয়ে উড়ে পালাব।’

সাহেব বললেন, ‘ননসেন্স!… এই সেপাই, আসামিকো গারদ মে লে যাও!’

গুলে আবার অট্টহাস্য করে দুই হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললে, ‘এই বলে রাখলুম সায়েব, আমি তোমাদের ঠিক কলা দেখাব।’

চার

বিচারে গুলে-সর্দারের ফাঁসির হুকুম হল। ফাঁসির কথা শুনে সে আদালতের মাঝখানেই কোমরে হাত দিয়ে নাচতে নাচতে হেঁড়ে গলায় গান জুড়ে দিলে। জজসাহেব তো অবাক! আমি ভেবেছিলুম, তার এই মুখসাবাসি আর বেশিদিন থাকবে না। কিন্তু ফাঁসির দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, তার হাসিঠাট্টা বেড়ে উঠল যেন ততই। রোজই সে বলত, ‘আমার শখ হয়েচে বলেই দিন কয়েক জেলখানার ভেতরে বসে জিরিয়ে নিচ্চি! কিন্তু ফাঁসির দিন কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না!’

জেলের প্রহরীরা সকলেই তার এইসব কথা বিশ্বাস করত। তারা আমাকে বললে, ‘হুজুর, ও ব্যাটা জাদুকর! ও নিশ্চয়ই আমাদের ফাঁকি দিকে পালাবে! আমরা কী করব বলুন, ও যদি রাত্তির বেলায় মশা-মাছি হয়ে উড়ে যায়, কে ওকে দেখতে পাবে?’ বলতে লজ্জা হয়, কিন্তু আমারও মনে কেমন একটা খটকা লাগল।

গুলে-সর্দারের ফাঁসির ঠিক আগের দিনে আমি পুলিশের বড়ো সাহেবের কাছে গিয়ে, আমার মনের সন্দেহের কথা খুলে বললুম। সাহেব প্রথমটা হেসেই আমার কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওসব বাজে কথা নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার সময় নেই।’

আমি বললুম, ‘সায়েব, আমাদের দেশে কিন্তু ভোজবাজিতে মানুষ উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়।’

‘এমন ব্যাপার তুমি নিজে কখনো দেখেচ?’

‘না।’

‘তবে?’

‘কিন্তু অনেক ঘটনার কথা শুনেচি। গুলে-সর্দার যে রোজ একথাই বলচে, আর ফাঁসির হুকুম পেয়েও এতটা মনের খুশিতে আছে, এর কারণ কী?’

সাহেব খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চিন্তা করলেন। তারপর দোমনার মতন বললেন, ‘দেখ, যদিও আমি এ-সব আজগুবি ব্যাপারে বিশ্বাস করি না, তবু সাবধানের মার নেই। কাল সকালে তো সর্দারের ফাঁসি হবে? আচ্ছা, আজ রাতে তার ঘরের সামনে আমরা দুজনেও পাহারা দেব।’

পাঁচ

গুলে-সর্দার যে ঘরে বন্দি ছিল, তার দরজার সামনে সাহেব আর আমি দু-খানা চেয়ারের ওপরে বসে আছি। আমাদের আশেপাশে আরও দুজন প্রহরী। মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছি, ঘরের ভিতরে বসে গুলে-সর্দার প্রাণের ফূর্তিতে তুড়ি দিয়ে গান গাইছে!

রাত ক্রমে গভীর হয়ে উঠল। এখন গানের বদলে গুলের ভীষণ নাসা গর্জন শুনতে পাচ্ছি! কাল সকালে তার ফাঁসি, আর আজ সে নিশ্চিন্ত হয়ে নিদ্রা দিচ্ছে! আমার মনটা সন্দেহে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল! কিন্তু ঢংঢং করে তিনটে বাজল, তবু তো অস্বাভাবিক কিছুই ঘটল না।

সাহেব কৌতুক-হাস্য করে বললেন, ‘বাবু, দেখচ তো, একালে ভোজবাজি আর চলে না?’

আমি আর কিছু বললুম না। নিজের কুসংস্কারে নিজেরই লজ্জা করতে লাগল।

প্রায় যখন ভোর হয়ে এসেছে, তখন সাহেব আর আমি দুজনেই একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলুম। হঠাৎ প্রহরীদের চিৎকারে চমকে মাথা তুলে দেখি, কয়েদখানার দেয়ালের ঘুলঘুলির নীচেই একটা ভয়ঙ্কর কালো বিড়াল দাঁড়িয়ে আছে! আমরা সকলেই তার দিকে ছুটে গেলুম। কেউ লাঠি, কেউ বন্দুকের কুঁদো ও কেউ লাথি তুলে তাকে বার বার মারবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু সেই আশ্চর্য বিড়ালটা আমাদের সকলকেই এড়িয়ে, উঠানের দিকে চোঁচা দৌড় মারলে।

‘Lock out’— বলেই পুলিশ সাহেব তাঁর রিভলভার তুলে ঘোড়া টিপলেন, গুলিটা বিড়ালের পিছনের একটা পায়ে গিয়ে লাগল, সে আর্তনাদ করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আরও দুই-এক পা এগিয়ে স্থির হয়ে পড়ে রইল! আমরা ছুটে কয়েদখানার ঘুলঘুলির কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম, গুলে-সর্দার ঘরের মেঝের ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে যন্ত্রণাপূর্ণ স্বরে আমাদের লক্ষ্য করে গালাগালি দিচ্ছে!

আমি আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললুম, ‘আসামি ঘরের ভেতরেই আছে!’

সাহেব রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘থাকবে না তো যাবে কোথায়। ও-সব কুসংস্কার আমি মানি না— যদিও প্রথমটায় আমারও সন্দেহ হয়েছিল।

ছয়

গল্পটা এইখানেই শেষ করা যাক— বাকি আছে খালি আর দুটো কথা।

আজ সকালে যথাসময়ে গুলে-সর্দারকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু তাকে ফাঁসিকাঠে নিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখা গেল, তার একখানা পা হঠাৎ ভেঙে গেছে, সে অত্যন্ত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *