ভেরনল – মণীন্দ্রলাল বসু

ভেরনল – মণীন্দ্রলাল বসু

উত্তর-ভারতের নানাস্থানে ঘুরতে ঘুরতে নৈনিতালে এসেছি৷ নভেম্বরের শেষে নৈনিতাল প্রায় জনহীন৷ আমাদের হোটেলের দোতলায় আমি আর একজন বাঙালি প্রৌঢ় ডাক্তার, দুজন আছি৷ হোটেলটি পাহাড়ের মাথায় বনের ধারে, নীচে নীলহ্রদ, পাহাড়-ঘেরা, কখনো মরকতমণির মতো ঝকমক করে, কখনো গলিত পোখরাজের মতো৷ রৌদ্রতপ্ত সুনির্মল, দিন৷ জ্যোৎস্নাময় সুশীতল পাণ্ডুর রাত্রি, চারিদিকে অপূর্ব নিস্তব্ধতা৷

সমস্ত দিন হ্রদটি দর্পণের মতো স্থির ছিল৷ রঙিন বাংলোর সারি, সবুজ ঘন, নীলাকাশ, মেঘের স্তূপ, তার ওপর নানা রূপ ও বর্ণের প্রতিবিম্ব৷ সন্ধ্যাবেলায় পশ্চিমাকাশে মেঘপুঞ্জে রঙের ঠেলাঠেলি, দিগ্বধূরা হোলিখেলায় মেতে উঠল, হ্রদ সুবর্ণবর্ণ৷ তারপর পাইন-বনের পিছনে চাঁদ উঠল৷ পাহাড়ের তলায় ঘন অন্ধকারময় হ্রদ রহস্যময়ী নারীর কালো চোখের মতো৷

ডিনার খেয়ে যখন ঘরের সামনে কাঁচ-ঘেরা বারান্দায় বসলুম, বৃষ্টি পড়ছে৷ চারিদিকে সজল অন্ধকার৷ দেবদারু-বন আন্দোলিত করে ঝোড়ো বাতাস উঠছে ক্ষুব্ধ ক্রন্দনের মতো৷

বারান্দায় বসে থাকা গেল না, ঝড়ের জন্য নয়, দাঁতে অসহ্য বেদনা অনুভব করলুম৷ বাঁ মাড়ির শেষে একটু ব্যথা দুদিন ধরে রয়েছে, সারারাত্রে ঝড়ের মধ্যে ব্যথা অসহ্য মনে হল, দাঁতের স্নায়ুগুলি যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা৷ ঘরে ঢুকে দেখলুম এ্যাসপিরিন বা বেদনা-নাশক কোনো ওষুধ সঙ্গে নেই৷ রাত বারোটা হবে, বাইরে ঝড় উঠেছে—ওষুধের জন্য কোথায় যাওয়া যায়?

মনে পড়ল আমার ঘরের পরে দুটি খালি ঘর, তার পরেরটাতে প্রৌঢ় ডাক্তার সরকার আছেন৷ তাঁর কাছে নিশ্চয় কোনো ওষুধ পাওয়া যাবে৷ ডাক্তারের সঙ্গে একদিন সামান্য আলাপ হয়েছিল৷ অদ্ভুত মানুষ মনে হয়৷ তিনি সমস্ত পৃথিবী দু’বার পরিভ্রমণ করেছেন৷ কোনোদিন দেখি বারান্দায় বেতের ইজিচেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসে আকাশে মেঘের লীলা, হ্রদের খেলা দেখছেন, কোনোদিন দেখি মোটা চাবুক হাতে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে চলেছেন ভীমতালের দিকে৷ ছ’ফুট লম্বা দীর্ঘদেহ, সুঠাম, দৃঢ়, বৃদ্ধ শালগাছের মতো৷ সব সময় ছাইরঙের একটা সুট পরে, চোখে কালো কাচের চশমা, রেখাঙ্কিত মুখে আরক্তিম ভাব নাকের ডগায় লালছাপ কাচ-ঢাকা ফ্রেমের নীচে টকটক করে৷

দাঁতের যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে উঠল৷ ডাক্তারের ঘরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই৷

করিডরের এক কোণে একটি আলো মৃদু জ্বলছে৷ ডাক্তারের ঘরের দরজার ওপর তিনটে টোকা দিলুম—ডাক্তার সরকার৷

ভেতর হতে উত্তর হল,—আঁত্রে! (দরজা খুলে আসুন)

দরজা ভেজানো ছিল, একটু ঠেলতে খুলে গেল৷

ঘরে প্রবেশ করে দেখলুম, স্প্রিং-গদিওয়ালা রেক্সিন-মোড়া লম্বা সেত্তিতে ডাক্তার সরকার অর্ধশয়ানভাবে সামনের জানালার দিকে চেয়ে৷ জানালার কাচের ওপর বৃষ্টি-ঝড় আছড়ে পড়ছে ক্ষুব্ধ সমুদ্র-তরঙ্গোচ্ছ্বাসের মতো৷ বাইরে ঝঞ্ঝার আর্তনাদ, কিন্তু ঘরের ভেতর অদ্ভুত স্তব্ধতা৷

সেত্তির পিছনটা দরজার দিকে, ডাক্তার সরকার আমার প্রবেশ দেখতে পান নি৷ তিনি বলে উঠলেন, আসুন হের রোজেনবেয়ার্গ, আপনার প্রতীক্ষা করছিলুম৷

হের রোজেনবেয়ার্গ! এ হোটেলে কোনো জার্মানকে তো কখনো দেখিনি! চেঁচিয়ে বল্লুম, আমি,—কিছু মনে করবেন না—দাঁতের অসহ্য যন্ত্রণা—

চমকে তিনি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, চশমায় কালো কাচ-ঢাকা চোখ দেখা গেল না, কুঞ্চিত কপালের ওপর কালো সাদা চুলগুলি চকচক করতে লাগল৷

ও, আপনি! কি চাই?

দেখুন দাঁতে বড় ব্যথা, যদি আপনার কাছে কোনো ওষুধ থাকে, আমার এ্যাসপিরিন—

ব্যথা! ভালো৷ যত ব্যথা পাবেন, জীবনকে তত গভীরভাবে অনুভব করবেন৷ যার যত বেদনাবোধ, সে তত উচ্চস্তরের জীব৷

দেখুন, ডাক্তার যদি দার্শনিক হয়ে ওঠেন রোগীর অবস্থা বড় সঙ্গীন হয়৷

হা হা! ডাক্তার দার্শনিক! কোথায় ব্যথা বলুন?

দাঁতে, এই বাঁ মাড়িতে, স্নায়ুগুলি কে ছিঁড়ে—

থাক, ব্যথার বর্ণনা করতে হবে না, আমি বুঝেছি৷ বসুন৷ বসুন ওই সোফায়৷ কি লিকার আপনি ভালোবাসেন? কুমেল, বেনেডিকটিন—আমার এখানে কয়েকরকম আছে মাত্র৷

সামনের ছোট টেবিলে নানা বর্ণ ও আকৃতির বোতল ও ছোট বড় লিকার-গ্লাস৷

না, আমি কিছু খাই না৷

খান না? হা হা, খেলে দাঁতের ব্যথা হত না৷ খুব যন্ত্রণা হচ্ছে দেখছি! আচ্ছা দেখি, একটা ওষুধ আছে৷

ডাক্তার সরকার লেখবার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি ছোট শিশি বের করলেন৷ শিশি হতে দুটি চ্যাপ্টা বড়ি এক মাঝারি গ্লাসে রাখলেন, তারপর একটা বড় বোতল হতে সোনালী তরল পদার্থ গ্লাসে ঢেলে দিলেন৷ গ্লাসটা নেড়ে আমার হাতে দিয়ে বল্লেন, খেয়ে ফেলুন৷ একটু হাল্কা বোর্দো দিলুম, ওতে ওষুধের কাজ ভালোই হবে৷ আর আমার ঘরে জল নেই, চাকরটা সন্ধ্যা থেকে পলাতক৷ ভাবুন ওষুধের অনুপান হচ্ছে দক্ষিণ ফ্রান্সের সূর্যালোকপুষ্ট রক্তিম দ্রাক্ষারস!

ব্যথা দূর করবার জন্য তখন কেউ হাতে বিষ দিলেও খেয়ে ফেলতে পারতুম৷ বড়ি-মিশ্রিত বোর্দো এক চুমুকে খেয়ে ফেল্লুম৷

ডাক্তার সরকার আমার মুখোমুখি বসলেন সেত্তিতে হেলান দিয়ে৷ ছোট গ্লাস হতে একচুমুক সারত্রুজ খেয়ে বল্লেন, কেমন মনে হচ্ছে?

বেদনা কম মনে হচ্ছে৷

ব্যস, তাহলেই হল৷ বেদনা হয়তো আপনার আগেকার মতোই আছে, তবে ওই যে মনে হচ্ছে বেদনা নেই—তাহলেই হল৷ আসল হচ্ছে মন, আর মন দিয়ে যা অনুভব না করি তাই মিথ্যা৷ বসুন, গল্প করা যাক৷ এ ঝড়ের রাতে কি আর এখন ঘুম হবে!

বেশ তো, আপনি একটা গল্প বলুন৷ আপনার জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা, কত দেশ কতরকম মানুষ দেখেছেন, তার ওপর আপনি ডাক্তার, কতরকম রোগী—

ডাক্তারের রোগী দেখা clinical eye দিয়ে দেখা, সত্যিকার দেখা নয়৷ যে দেখায় বেদনা নেই, হৃদয়ের ব্যথা নেই, আতঙ্ক নেই, সে দেখা সত্যি দেখা নয়৷

কিন্তু দেখায় আনন্দও তো থাকতে পারে৷

হাঁ, কিন্তু সব গভীর আনন্দানুভূতির সঙ্গে তীব্র বেদনা রয়েছে৷ শুধু মনের ব্যথা নয়, দেহের ব্যথাকেও যতরকম ভাবে যত নূতন নূতন করে জানতে পারবেন, জীবনকে তত গভীরভাবে জানবেন, প্রাণের মর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছবেন৷ এই দেহ-মনের বেদনার অভিজ্ঞতায় আমাদের সত্তা গড়ে ওঠে, আমাদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়৷

আপনার জীবনে বহু অভিজ্ঞতা আছে মনে হয়৷

হাঁ, নব নব অনুভূতি লাভের তৃষ্ণা আমাকে সারাজীবন দিশাহারা করেছে৷ ডাক্তাররূপে আমাকে দেখতে হয়েছে মানুষের দেহ-মনের ভাঙনের রূপ, তারপর বেদনার মূর্তি৷ সেজন্য প্রকৃতির বা মানবসৃষ্ট পরিপূর্ণ সৌন্দর্য দেখবার জন্য আমি দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরেছি, দেহের সমস্ত স্নায়ু শিরা উপশিরায় রক্তস্রোত দিয়ে প্রাণের গতি-উল্লাস আনন্দময় অভিব্যক্তি অনুভব করতে চেয়েছি৷ এমনি ঝড়ের রাতে আমি সাঁতরে পদ্মা পার হয়েছি, বন্যায় নগর-গ্রাম ভেসে যেতে দেখেছি, কারাকোরাম পর্বতের সতের হাজার ফিট উঁচুতে তুষার-নদী পার হয়ে কাশ্মীর হতে খোটান গেছি, মোটরকারে সাহারা মরুভূমি অতিক্রম করেছি, উগান্ডার জঙ্গলে সিংহ মেরেছি৷ কত অপূর্ব বস্তু কত অপরূপ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে! শ্রীনগরে ডালহ্রদে রঙিন সন্ধ্যা, শীতের সুইজারল্যান্ডে জ্যোৎস্নারাত্রে তুষার-শুভ্রতায় শ্লেজ চালানো, লিডোতে ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রতীরে সূর্যালোক পান, নিউইয়র্কের পঞ্চম এভিনিউর জনতা, জঙ্গলবেষ্টিত এঙ্কোর ভাট, বেলজিয়ামের যুদ্ধ-ট্রেঞ্চ, অন্ধকার রাত্রে তাজমহল, প্রয়াগে কুম্ভমেলা, মিসিসিপির ঘন অরণ্য, প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর এরোপ্লেন৷ এসব অভিজ্ঞতা আমার আত্মাকে মূর্ত করেছে বটে, কিন্তু আমার সত্তার বিকাশ হয়েছে মানব-অন্তরের বেদনাময় অনুভূতিতে৷

ডাক্তার সরকার চুপ করলেন৷ ঝোড়ো বাতাসে কাচের জানালা ঝনঝন করে উঠল৷ অন্ধকার আকাশের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে বিদ্যুৎ চমকে গেল৷ ঘন নীলপর্দা-ঘেরা আলো কেঁপে কেঁপে উঠল৷

আমি ধীরে বল্লুম, আচ্ছা আপনি হের রোজেনবেয়ার্গ নামে কার আগমনের প্রতীক্ষা করছিলেন?

ডাক্তার সরকার চমকে সোজা হয়ে বসলেন, তাঁর চশমার কাচ চকচক করতে লাগল অন্ধকার রাত্রে কালো চোখের মতো৷ বোতল থেকে একটু সুরা ঢেলে পান করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন৷

তারপর আমার দিকে চুরুটের বাক্স এগিয়ে দিয়ে বল্লেন, একটা চুরুট ধরান৷ গল্পটা আপনাকে তাহলে বলি—

ম্যুনসেনে ডাক্তারি পরীক্ষায় পাশ করে আমি কিছুদিন সুইজ্যারল্যান্ডে ডাভোসে এক যক্ষ্মা স্যানাটোরিয়মে কাজ করি৷ এমনি নভেম্বর মাসের শেষাশেষি একবার ডাভোস থেকে প্যারিসে আসি৷ গার-দ্য-লিয়ঁতে যখন নামলুম, রাত এগারটা হবে৷ কুলিকে জিনিস বুঝিয়ে দিচ্ছি, ওভারকোটের ওপর কে থাপ্পড় মারলে—হের ডক্টর!

ফিরে দেখি রিচার্ড রোজেনবেয়ার্গ, আমাদের স্যানাটোরিয়মের একটি রোগী৷ লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে, দেখতে আমার চেয়েও লম্বা, বহুদিন রোগে ভুগে শীর্ণ শুষ্ক মুখ, চোখে একটা তীব্র ক্ষুধিত দৃষ্টি৷ তার বাঁ পায়ের গোড়ালির এক হাড়ে যক্ষ্মা, ছ’বছর স্যানাটোরিয়ম বাসের পর প্রায় সেরে গেছে, এখন ক্রাচের সাহায্যে বাঁ পা তুলে খটখট করে ঘুরে বেড়ায়৷ লোকটি জাতিতে সুইস, তার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন নরওয়ে থেকে৷ জুরিকের এক ধনী মহাজনের একমাত্র সন্তান৷

বিস্মিত হয়ে বল্লুম, আপনি এখানে? পরশু আপনার জ্বর হয়েছিল, আপনার তো স্যানাটোরিয়ম হতে বার হওয়া বারণ৷

আমি পলাতক, হের ডক্টর৷ প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছিল৷ আপনি কোন হোটেলে যাচ্ছেন?

ল্যাটিন কোয়ার্টারে আমার এক জানা সস্তা হোটেল আছে, সেখানে ঘর রাখতে লিখেছি৷

চলুন আপনার সঙ্গেই যাব৷ একা বড় হোটেলে গিয়ে থাকতে ভালো লাগবে না৷ ছাত্রদের থাকবার হোটেল তো!

পথে ট্যাক্সিতে রোজেনবেয়ার্গ বল্লেন, তাঁর মাথায় মাঝে মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা হয়, তাঁর বিশ্বাস তাঁর মস্তিষ্কে ক্যানসার হচ্ছে৷ জুরিখে এক ডাক্তার নাকি বলেছেন ছোট একটা টিউমার হতেও পারে৷ প্যারিসে বড় ডাক্তার দেখাবার জন্য তিনি স্যানাটোরিয়ম থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছেন৷ তাঁর বিশ্বাস, একটা ক্যানসার কোথাও হচ্ছে!

কথাটা আমি বিশ্বাস করলুম না৷ আমার হোটেলে আমার ঘরের কাছেই রোজেন- বেয়ার্গের জন্য ঘর ঠিক করে দিলুম৷ শোবার উদ্যোগ করছি, ট্রেনের স্যুট বদলে সাজসজ্জা করে রোজেনবেয়ার্গ আমার ঘরে এসে ঢুকলেন৷ বল্লেন,—চলুন একটু বেরোনো যাক৷

আমি বড় শ্রান্ত৷

ছ’বছর পরে প্যারিসে এলুম, এর মধ্যেই শেষ৷ Tender is the night–

আপনি ঘুরে আসুন, আমি জামাকাপড় ছেড়ে ফেলেছি৷

সেন-নদীর তীরে একবার ঘুরে আসতে না পারলে রাত্রে ঘুম হবে না৷ আচ্ছা বননুই!

বিছানাতে শুয়ে শুনতে লাগলুম, হের রোজেনবেয়ার্গ সরু সিঁড়ির কাঠের ওপর ক্রাচের খটখট শব্দ করে দ্রুত নেমে চলেছেন, প্যারিসের পথে আনন্দলাভের সন্ধানে৷

পরদিন সকালে খবর নিয়ে জানলুম, রোজেনবেয়ার্গ অকাতরে ঘুমোচ্ছেন, রাত তিনটের সময় মত্তাবস্থায় হোটেলে ফিরেছিলেন৷

এরপর সাতদিন রোজেনবেয়ার্গের সঙ্গে দেখা হয়নি৷

রাত্রে পুচিনির টস্কা দেখে অপেরা-প্রাসাদ হতে রাস্তায় বের হয়েছি, ওভারকোটের ওপর এক থাপ্পড় মেরে কে বল্লে—হের ডক্টর! পিছন ফিরে দেখি, রিচার্ড রোজেনবেয়ার্গ৷

হের ডক্টর, কেমন লাগলো অপেরা?

চমৎকার৷

চলুন, কাছে ইটালীয়ান রেস্তোরাঁ আমার জানা আছে, চমৎকার মোজেল মদ রাখে, ১৯১৩ সালের যুদ্ধের ঠিক আগের বছরের মোজেল মদ৷ না এলে আমি সত্যই দুঃখিত হব৷

অপেরার সঙ্গীতলহরী শ্রবণে অন্তর তখন উল্লসিত৷ শার্লিয়াপেনের সুরদীপ্ত মহান কণ্ঠধ্বনি কানে বাজছে৷ বল্লুম, চলুন আজ রাত্রে একটু হল্লা করা যাক৷

রেস্তোরাঁতে কিছু খেয়ে আমরা অপেরার কাছে এক কাফেতে এসে বসলুম৷ পথের ফুটপাথের অর্ধেক জুড়ে টেবিল-চেয়ারের সারি, পাশ দিয়ে নানাসজ্জার নরনারী-স্রোত অবিরাম চলেছে৷

রোজেনবেয়ার্গ, প্যারিসের জীবন কেমন উপভোগ করছ?

বড় বেদনা, মাথার মধ্যে অসহ্য বেদনা হয়৷

পকেট থেকে সে একটি ছোট শিশি বের করে ছোট টেবিলের ওপর রাখলে৷ কিছুক্ষণ পর শিশি থেকে দুটো বড়ি বার করে কফির সঙ্গে খেয়ে ফেল্লে৷

দু’ঘণ্টা অন্তর এই এ্যাসপিরিন খাচ্ছি, না খেলেই যন্ত্রণায় মরে যাব৷

কোনো ডাক্তার দেখালে?

দেখালুম বই কি৷ ডাক্তার লেভি বললেন, মাথায় নয় পেটে, লিভারের কাছে টিউমার মনে হচ্ছে, ক্যানসারের পূর্বলক্ষণ হতে পারে৷ তবে আমি জানি ক্যানসার, ও ক্যানসার হবেই৷ ক্যানসারে আমার মা মরেছেন৷ ওঃ! সে কি অসহ্য যন্ত্রণা৷

সহসা সে থামল৷ দেখলুম জ্বালাময় তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে পথের সুসজ্জিতা বারবিলাসিনীদের দিকে চেয়ে আছে৷ তিনটি রূপাজীবা চলেছে শিকারের সন্ধানে৷ রোজেনবেয়ার্গের চেয়ারের পাশে খাড়া করা ক্রাচ দুটির দিকে বক্র দৃষ্টিতে চেয়ে তারা চলে গেল৷ রোজেনবেয়ার্গের শীর্ণ মুখ আরো কালো হয়ে উঠল৷

বল্লুম, ডাক্তাররা তো নিশ্চিতরূপে কিছু বলছেন না!

নিশ্চিতভাবে কে কি বলতে পারে? অহর্নিশি এই যে অসহ্য ব্যথা অনুভব করছি—ক্যানসার রোগীকে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে মরতে আমি দেখেছি, তার সব সিমটম আমি জানি৷ গারসঁ, আরো দু’গ্লাস৷ আচ্ছা আপনি ডাক্তার, ক্যানসারের কোনো চিকিৎসা আছে?

এখনো পর্যন্ত আমাদের জানা নেই, নানা পরীক্ষা চলছে৷

শুধু রোগী অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে মরে!

একদিন তো আমাদের প্রত্যেককে মরতে হবে৷

ক্যানসারের রোগী যদি আত্মহত্যা করে, তাতে দোষ কি?

প্রাণ অমূল্য, প্রাণকে আমরা এখনো সৃষ্টি করতে পারি নি, স্বইচ্ছায় তাকে বিনাশ করার অধিকার আছে কি?

শুধু যন্ত্রণাভোগের অধিকার আছে! আমি আত্মহত্যা করতে পারি—আমার মা নেই, বাবা দু’মাস হল মারা গেছেন৷ কিন্তু এক বুড়ি দিদিমা আছেন, তিনি মনে বড় আঘাত পাবেন৷ গারসঁ, এই নোটটা ভাঙিয়ে আন দেখি৷

কাফের এক খিদমতগার এগিয়ে আমাদের কাছে এল৷ রোজেনবেয়ার্গ তার বুকের পকেট থেকে এক মোটা মনিব্যাগ বের করলে, নানারঙের নোটে ভরা৷ নোটের তাড়া থেকে একখানি একহাজার ফ্র্যাঙ্কের নোট বের করে গারসঁর হাতে দিলে৷ তারপর মনিব্যাগটা খুলেই টেবিলের ওপর রাখলে৷ শুধু কাফের নয়, রাস্তার লোকেও দেখতে পেলে নোটভরা মনিব্যাগ টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে৷

ব্যাগটা তুলে রাখ, রিচার্ড!

হুঁ৷ এ ব্যাগে মার্ক-ফ্রাঙ্ক-ডলারে ত্রিশ হাজার ফরাসি ফ্র্যাঙ্কের বেশি আছে৷

রোজেনবেয়ার্গ কথাগুলো এত উচ্চস্বরে বল্লে যে রাস্তার লোকও শুনতে পেলে৷ কাফের লোকেরা আমাদের টেবিলের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল৷

আস্তে, এত চেঁচামেচি করছ কেন! ব্যাগটা পকেটে রাখ৷ এত টাকা পকেট নিয়ে প্যারিসের রাস্তায় এরকম ভাবে ঘোরার মানে কি?

হুঁ, মানে কি? বেশ বলেছ ডক্টর! আচ্ছা তোমাকে ধাঁধা দেওয়া যাচ্ছে, উত্তর দাও৷ একটা লোক ত্রিশ হাজার ফ্র্যাঙ্ক পকেটে নিয়ে সবাইকে দেখিয়ে প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? হা হা, জীবনটা একটা গোলোক-ধাঁধা নয় কি? একবার প্রবেশ করলে সব সময় তা থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাওয়া যায় না৷

দেখ, এর চেয়ে কম টাকার জন্য প্যারিসের পথে লোক খুন হয়েছে!

বাঃ, বেশ বলেছ! শোন ডাক্তার, তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল ভালোই হল৷ আমার যেরকম শরীরের অবস্থা, যে কোনো সময়ে কিছু ঘটতে পারে৷ আমার যদি হঠাৎ মৃত্যু হয়, দেখ আমি এখন লক্ষপতি, আমার সম্পত্তির অর্ধেক আমি এক ক্যানসার রিসার্চ হাসপাতালে দিয়ে যেতে চাই৷ আমার একটা উইল আছে, স্যানাটোরিয়ামে আমার ঘরে নয়, এক জায়গায় লুকনো আছে, সেটা তোমায় বলে যেতে চাই—

সহসা রোজেনবেয়ার্গ চুপ করে পথের দিকে চাইলে৷ আমাদের কাছ দিয়েই একটি যুবক ও যুবতী যাচ্ছিল, যুবকটি কদাকার ভীমপ্রকৃতির দেখতে, প্যারিসের গুণ্ডাদলের মনে হয়, যুবতী কিন্তু পরমাসুন্দরী, সদ্যপ্রস্ফুটিত শ্বেতপদ্মের মতো স্নিগ্ধ লীলায়িত মূর্তি৷

রোজেনবেয়ার্গ দাঁড়িয়ে তাদের দিকে চেয়ে ডাকলে,—মাদলেন!

মেয়েটি হেসে এগিয়ে এল, আমাদের টেবিলে আমাদের দু’জনের মাঝে চেয়ারে এসে বসল৷ যুবকটি কিন্তু কোথায় সরে পড়ল৷

হ্যালো মাদলেন, কি খাবে?

চল, এক রেস্তোরাঁতে যাওয়া যাক৷ সন্ধে থেকে খাইনি, বড় খিদে পেয়েছে৷

মাদলেনের দুই চোখে কৌতুকময় হাসি৷ রোজেনবেয়ার্গ তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে বল্লে, আমরা এই খেয়ে এলুম, এই নাও কাল সকালে খেও৷

রোজেনবেয়ার্গ আবার ব্যাগ বের করে মাদলেনের হাতে একখানা পাঁচশ’ ফ্র্যাঙ্কের নোট দিলে৷ ব্যাগে নোটের তাড়া রাস্তার লোকসুদ্ধ দেখতে পেল৷ মাদলেনের নয়ন দু’টি বিদ্যুৎপর্ণা৷

আমি বল্লুম, অনেক রাত হয়েছে, এবার যাওয়া যাক!

আমরাও যাব, চলো মাদলেন৷

ট্যাক্সিতে মেয়েটি বসল আমাদের দু’জনের মাঝখানে৷ আমি চুপ করে বসে রইলুম, রোজেনবেয়ার্গ অনর্গল বকে যেতে লাগল৷

দেখ ডাক্তার, আজকাল রাত্রে ভেরনল না খেলে আমার ঘুম হয় না৷ আচ্ছা কোনো ভালো ঘুমের ওষুধ তোমার জানা আছে? তুমি দিতে চাও না, বুঝতে পারছি!

মেয়েটি হেসে বলে উঠল, আমি জানি৷

আবেগের সঙ্গে রোজেনবেয়ার্গ বল্লে, কি?

মেয়েটি উচ্চ হেসে বল্লে, সে বলব না৷

তারপর সমস্ত পথ রোজেনবেয়ার্গ আমার সঙ্গে ভেরনলের গুণ ও ক্রিয়া সম্বন্ধে আলোচনা করতে করতে এল,—সে তিন থেকে চার ট্যাবলেট খায়, কটা ট্যাবলেট খেলে মৃত্যু হবার সম্ভাবনা, ডাভোসে কে কবে ভুলে বেশি ভেরনল খেয়ে মরেছে ইত্যাদি৷

হোটেলে ঢুকে রোজেনবেয়ার্গকে একটু আড়ালে ডেকে বল্লুম, মেয়েটি কে?

সে অবাক হয়ে বল্লে, কে? আমি কি ওকে জানি? ওকে আমি চিনি না৷

বিস্মিত হয়ে বললুম, তাহলে তুমি ওকে জান না! তোমার সঙ্গে এত টাকা রয়েছে, ব্যাগটা না হয়—দেখলুম আমাদের ট্যাক্সির পেছনে আর একটা মোটরকার আসছিল!

রোজেনবেয়ার্গের বিস্তীর্ণ পাণ্ডুর মুখে অদ্ভুত হাসি খেলে গেল৷

হের ডক্টর, এই পৃথিবীতে আমরা কে কাকে জানি?

মেয়েটিকে নিয়ে রোজেনবেয়ার্গ তার ঘরে গেল৷ আমি আমার ঘরে গিয়ে কোচে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লুম৷ বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, বাতাস বইছে ক্ষ্যাপা কুকুরের অবিশ্রান্ত আর্তনাদের মতো৷ সমস্ত হোটেল নিঝুম নিদ্রিত৷

এই রাত্রে ঘুমোবার আশা নেই৷ ফায়ারপ্লেসের উপর অষ্টাদশ শতাব্দীর পুরাতন ঘড়িটা শূন্যভাবে চেয়ে রইল৷ মোপাসাঁর একটি গল্পের বই নিয়ে পড়তে বসলুম৷

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম জানি না, জানালায় সার্সির ঝনঝন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল৷ ঝড় উঠেছে, তারসঙ্গে মৃদু তুষারপাত৷

বাহিরে উন্মত্তা প্রকৃতি, গর্জমান অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝিকিমিকি, কিন্তু হোটেল অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ৷

চমকে উঠলুম, রোজেনবেয়ার্গের ঘরে কি হয়েছে কে জানে? মেয়েটি নিশ্চয়ই কাজ শেষ করে চলে গেছে৷ পাশে স্নানের ঘরে জলের কল ভালো করে বন্ধ হয় নি, জলের ফোঁটা টপ টপ করে পড়ছে৷

মনে হল কে যেন আমায় ডাকছে, ডক্টর হের ডক্টর! কাঠের দরজার ভেতর দিয়ে অন্ধকার করিডর পার হয়ে সে আহ্বান আসছে৷

ধীরে উঠে ঘরের দরজা খুললুম, অন্ধকার করিডর, রোজেনবেয়ার্গের ঘরের দরজা ফাঁক করা, সেই ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা পথের তমিস্রপুঞ্জে এসে পড়েছে৷ আলোর রেখা দেখে মনে সাহস হল৷

চকিতপদে করিডর পার হয়ে রোজেনবেয়ার্গের ঘরে প্রবেশ করলুম৷ স্তব্ধ ঘর, রোজেনবেয়ার্গ বিছানাতে চাদরের ওপর স্থির হয়ে শুয়ে আছে৷ সুট ছেড়ে রাতের পোশাকও পরে নি৷ অতি স্থির হয়ে শুয়ে, চোখে অচঞ্চল দৃষ্টি৷ পাশে ছোট টেবিলে ভেরনলের শূন্য শিশি, দুটি খালি বোতল ও খালি গেলাস৷ মেয়েটি কোথায়ও নেই৷

ডাকলুম,—রোজেনবেয়ার্গ! রিচার্ড!

কোনো সাড়া নেই৷ কোথায় একটা খটখট শব্দ হল৷ কপালে হাত দিয়ে দেখলুম, তুষারশীতল৷ হাত ধরে নাড়ী দেখলুম, কোনো স্পন্দন নেই৷ জামা খুলে বুকের ওপর কান চেপে শুনতে চেষ্টা করলুম, বুকের ধুকধুকানি একটু আছে কিনা৷ চিরদিনের মতো হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গেছে৷ বাহিরে ঝোড়ো বাতাস গর্জন করছে৷

বুঝলুম আমার আর কিছু করবার নেই৷ ধীরে চোখ দুটি বন্ধ করে গায়ের ওপর একটি চাদর ঢাকা দিয়ে দিলুম৷

নিজের ঘরে পরিশ্রান্ত হয়ে সোফায় বসতে শীতের রাত্রে গায়ে ঘাম দিল৷

আবার মনে হল, কে আমায় ডাকছে, ডক্টর! ডক্টর! হের ডক্টর! অন্ধকার করিডর পার হয়ে কাঠের দরজার ভেতর দিয়ে সে ডাক আমার সমস্ত ঘরে ধোঁয়ার মতো ভরে তুলেছে৷ একটা সিগারেট ধরালুম, একটা জানালা খুলে দিলুম, যদি বাহিরের ঝোড়ো বাতাসের গর্জনে ঘরের এই ডাক ডুবে যায়৷

আহ্বান অতি মৃদু ছিল, তীব্র উচ্চ হয়ে উঠল৷ শুধু আমার নাম ডাকা নয়, খটখট শব্দ, সিঁড়ির কাঠের ধাপের ওপর ক্রাচের খটখট শব্দে সুপ্ত হোটেলের স্তব্ধতা কেঁপে উঠছে৷

ক্রাচের শব্দ সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরের সারি পার হয়ে অন্ধকার করিডর অতিক্রম করে আমার ঘরের সম্মুখে এসে থামল, ঘরের দরজার ওপর তিনটে টোকা পড়ল,—হের ডক্টর!

তখন আতঙ্কে মূর্ছা যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি আতঙ্ক-রস অনুভব করতে চেষ্টা করছিলুম—রিচার্ড রোজেনবেয়ার্গের প্রেতাত্মা দেখতে আমি প্রস্তুত৷

বল্লুম,—আঁত্রে!

ধীরে দরজা খুলে গেল৷ অন্ধকার পটভূমিতে ছবির মতো রিচার্ড রোজেনবেয়ার্গের মূর্তি ফুটে উঠল৷ মোটা কালো ওভারকোট পরা, মাথায় ধূসর টুপি, দুই বগলে ক্রাচ৷ মুখের ওপর ঘরের আলো পড়ে কাচের মতো চকচক করছে৷ চোখে ক্ষুধিত তীব্র দৃষ্টি নেই, বড় শ্রান্ত ঝিমনো ভাব৷

যেন বেতার-যন্ত্র হতে কথাগুলি কানে এল৷—হের ডক্টর, আমি বাইরে যাচ্ছি৷ উইলের কথা বলতে এলুম, উইলটা আছে আমাদের স্যানাটোরিয়ামে, ফ্রাউ মায়ারের ঘরের টেবিলের তৃতীয় ড্রয়ারে৷ আচ্ছা বননুই, অনেক দূর যেতে হবে!

মূর্তি মিলিয়ে গেল৷ অন্ধকারে বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলুম৷ খটখট শব্দ দূর হতে দূরে চলে যাচ্ছে৷

এতক্ষণে গা শিরশির করে উঠল, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, নিজের বুকের ধুকধুকানি শুনতে পাচ্ছি৷

দু’ঘরের পরে রোজেনবেয়ার্গের মৃতদেহ৷

সহসা করিডরে কে আলো জ্বাললে, চোখ ঝলসে উঠল৷ সিঁড়িতে যুবকদলের হাস্য, যুবতীদলের চঞ্চল পদধ্বনি৷ একদল চৈনিক ছাত্রছাত্রী হাস্যে গল্পে সিঁড়ি মুখর করে উঠছে৷ রাত দুটোর আগে তারা সাধারণত ফেরে না৷

ছাত্রের দল যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলে৷ আমিও আমার ঘরের দরজায় চাবি দিলুম৷ হোটেল আবার সুপ্ত, স্তব্ধ৷

ঝড় থেমেছে৷ নিঃশব্দে শুভ্র তুষারপাত হচ্ছে, যেন কে দোলনচাঁপা ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ খোলা জানালার কাছে একটা সিগারেট ধরিয়ে বসলুম আলোর আশায়৷

ডাক্তার সরকার চুপ করলেন৷ আমি নিঃশব্দে চুরুট টানতে লাগলুম৷ বাইরে ঝড়বৃষ্টি থেমেছে, মৃদু জ্যোৎস্নায় আকাশ থমথম করছে৷

ধীরে উঠে দাঁড়ালুম৷

ডাক্তার সরকার বলে উঠলেন,—মিস্টার ঘোষ, আজ রাত্রেও আমার ঘুম হবে না দেখছি৷ এখন রাত্রে ভেরনল না খেলে আমার ঘুম হয় না৷

কথাগুলি শুনে কোনো অজানা ভয়ে চমকে উঠলুম৷ এ যেন ডাক্তার সরকারের কণ্ঠস্বর নয়!

দেখুন তো, ওইখানে একটা শিশি আছে, হাঁ—ওই হলদে শিশিটা৷ আমি আর উঠতে পারছি না৷ পায়ে কেমন ব্যথা হয়েছে৷ কয়েকটা ট্যাবলেট শিশি থেকে এই গেলাসে রাখুন৷

ভীতস্বরে জিজ্ঞাসা করলুম, কটা?

কটা? ও, এই পাঁচ-ছটা! ওতে কিছু হবে না আমার৷ ওর কমে ঘুম হয় না৷ আপনি হয়তো ছ’টা খেলে—

মন্ত্রচালিতের মতো ছ’টা ট্যাবলেট গেলাসে ফেলে তার সঙ্গে একটু মদ মিশিয়ে ডাক্তার সরকারকে দিলুম৷ তিনি এক চুমুকে সবটা খেয়ে বল্লেন,—একটু বসুন৷

তারপর চোখ বুজে সেত্তিতে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লেন৷

আমি চুপ করে বসে রইলুম৷ পা যেন নাড়তে পারছি না৷ ঘরের স্তব্ধতা পাথরের মতো ভারী৷ জানালার কাচ ঝকমক করছে অবগুণ্ঠিতা নারীর ভীতিব্যাকুল দৃষ্টির মতো৷

কতক্ষণ বসেছিলুম জানি না৷ কালের স্রোত যে বয়ে চলেছে, সে অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিলুম৷

মনে হল খটখট শব্দ আসছে, কাঠের মেজের ওপর ক্রাচের খটখট শব্দ৷ সে শব্দ সিঁড়ি দিয়ে উঠে আমার ঘরের পাশ দিয়ে বারান্দা পার হয়ে ঘরের সামনে এসে থামল৷ দরজার ওপর তিনটে টোকা, টক টক টক!

ভয়ে শিউরে উঠলুম৷ চেঁচিয়ে উঠলুম—ডাক্তার সরকার!

কোনো সাড়া নেই৷

প্রাণপণে চেঁচালুম—ডাক্তার সরকার! ডাক্তার!

নিঃসাড়, স্পন্দনহীন দেহ৷

ডাক্তার সরকারের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলুম৷ বরফের মতো কনকনে হাত, নাড়ী খুঁজে পাওয়া গেল না৷

নাকের কাছে হাত রাখলুম, বুকের উপর কান দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলুম, নিশ্চল হৃৎপিণ্ড, দেহে রক্তচলাচল নেই৷

ডাক্তার সরকার মৃত? হয়তো ভেরনলের মাত্রা অধিক দিয়েছি! বিবর্ণ মুখ সাদা মুখোসের মতো৷

আতঙ্কে বিহ্বল দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকালুম৷ দরজার ওধারে রিচার্ড রোজেনবেয়ার্গের প্রেতাত্মা, আর এধারে ডাক্তার সরকারের মৃতদেহ!

কালো চশমার কাচের পেছনে চোখ দুটো নড়ে উঠল৷ শিউরে উঠলুম৷

ডাক্তার সরকার বলে উঠলেন,—কি মিস্টার ঘোষ? আবার দাঁতের ব্যথা হচ্ছে নাকি?

না৷

তবে ভয় পেয়েছেন৷ না, আমি মরি নি৷ অত সহজে মৃত্যু হয় না৷

আমার মনে হচ্ছিল—

হুঁ, সে রাত্রে প্যারিসের হোটেলে কি রকম আতঙ্ক অনুভব করেছিলুম, তার কিছু আভাস পেলেন বোধ হয়!

আপনি চমৎকার অভিনেতা দেখছি!

অভিনয় করতে পারি বলেই এতদিন বেঁচে আছি৷ আচ্ছা আপনি শুতে যান, আজ রাত্রে আর রোজেনবেয়ার্গ এল না, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে শুতে যান৷ একটু খেয়ে যান, ভালো ঘুম হবে৷ শুনুন, গল্পের শেষটুকু আপনাকে বলা হয়নি৷ সকালে কিন্তু রোজেনবেয়ার্গের মৃতদেহ হোটেলের ঘরে পাওয়া গেল না৷ দু’দিন পরে সেন-নদীর জলে মৃতদেহ পাওয়া গেল৷ লোকে বলে গুণ্ডারা রাতারাতি মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে গেছল৷ কিন্তু আমার থিওরি হচ্ছে, মাদলেন ওকে মারে নি৷ আপনার কি মনে হয়?

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চলে এলুম৷ ঘরে এসে খোলা জানালার পাশে বসলুম৷ হ্রদের জলে জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি৷

ভাবতে লাগলুম, ডাক্তার সরকার কি উন্মাদ, না বানিয়ে গল্প বলতে ওস্তাদ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *