ভেনডেটা

ভেন্‌ডেটা

এক

ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেকার কথা।

ওলগোবিন্দ ঘোষ ও কুঞ্জকুঞ্জর কর পাশাপাশি জমিদার ছিলেন। উভয়ের নামই বিস্ময়-উৎপাদক। আসল কথা, ওলগোবিন্দবাবু ছিলেন ওলাই চণ্ডীর বরপুত্র; এবং কুঞ্জকুঞ্জরবাবু শাক্তভাবাপন্ন বৈষ্ণববংশের সন্তান।

চারপুরুষ ধরিয়া দুই বংশে কলহ চলিতেছিল। শতাধিক বর্ষ পূর্বে কুঞ্জকুঞ্জরের বৃদ্ধপিতামহ ওলগোবিন্দের বৃদ্ধপিতামহের পুত্রের (অর্থাৎ পিতামহের) বিবাহের বৌভাত উপলক্ষে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিয়া নববধূ দেখিয়া প্রশংসাচ্ছলে বলিয়াছিলেন, ‘ছেলের কথা কিছু বলব না, বাপকা বেটা; কিন্তু ভায়া, বৌ হয়েছে যেন মুক্তোর মালা।’

রসিকতাটি বুঝিতে বরপক্ষের একটু দেরি হইয়াছিল, সেই অবকাশে রসিক ব্যক্তিটি নিজের জমিদারীতে ফিরিয়া গিয়াছিলেন।

তারপর হইতেই পুরুষ-পরম্পরায় কলহ চলিয়া আসিতেছে।

বর্তমানে, ওলগোবিন্দের সহিত আদালতে ছাড়া কুঞ্জকুঞ্জরের সাক্ষাৎ হইত না—তাহাও কালেভদ্রে। কিন্তু দেখা হইলে, যুযুধান ষণ্ডের মতো উভয়ে ঘোর গর্জন করিতেন!

পার্ষদ ও শুভানুধ্যায়িগণ উভয়কে দূরে দূরে রাখিত।

কিন্তু বিধির বিধান কে খণ্ডন করিতে পারে?

ওলগোবিন্দ একদা দেওঘরে এক বাড়ি খরিদ করিলেন। বাড়ির চারিধারে প্রকাণ্ড বাগান—পাঁচিলে ঘেরা। বাগানে ইউক্যালিপ্টাস, ঝাউ পেঁপে কলা—নানাবিধ গাছ।

ওলগোবিন্দ সপরিবারে একদিন হেমন্তকালে নব-ক্রীত বাড়িতে আসিয়া উঠিলেন। তাঁহার ভারি বাগানের সখ—বাগান দেখিয়া অত্যন্ত হরষিত হইলেন।

পাঁচিলের পরপারে আর একটা বাড়ি; অনুরূপ বাগানযুক্ত। সন্ধ্যাকালে ওলগোবিন্দ দারোয়ান সঙ্গে সেই পাঁচিলের ধারে বেড়াইতে বেড়াইতে পাঁচিলের ওপারে আর একটি মূর্তি দেখিয়া স্তম্ভের মতো দাঁড়াইয়া পড়িলেন।

তারপর ওলগোবিন্দ ঘোর গর্জন করিলেন।

প্রত্যুত্তরে কুঞ্জকুঞ্জর ঘোরতর গর্জন করিলেন।

কিন্তু মধ্যে পাঁচিলের ব্যবধান—তাই সেযাত্রা শান্তিরক্ষা হইল।

ওলগোবিন্দ নিজের দারোয়ানের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘ভেঁপু সিং, এই বুড্‌ঢাকো রাস্তামে পাওগে তো টাক ফাটা দেওগে।’ বলিয়া ভেঁপু সিং-এর হাতে একটি কোদালের বাঁট ধরাইয়া দিলেন।

ওদিকে কুঞ্জকুঞ্জর নিজের দারোয়ানকে বলিলেন, ‘মৃদং সিং, ঐ বুড্‌ঢাকে রাস্তামে দেখোগে তো ভুঁড়ি ফাঁসা দেওগে।’ বলিয়া মৃদং সিং-এর হাতে একটি ভোঁতা খুরপি ধরাইয়া দিলেন।

এইরূপে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া দিয়া উভয়ে স্ব স্ব গৃহে প্রবেশ করিলেন। ওলগোবিন্দ নিজের পুত্র প্রিয়গোবিন্দকে বলিলেন, ‘কুঞ্জ শালা পাশের বাড়িতে উঠেছে।’ কুঞ্জকুঞ্জর নিজ কন্যা সুধামুখীকে বলিলেন, ‘ওলা শালা পাশের বাড়িতে আড্ডা গেড়েছে।’

দুই

স্ত্রীজাতির কৌতূহলের ফলে জগতে অসংখ্য অঘটন ঘটিয়া গিয়াছে। পাশের বাড়ি সম্বন্ধে মেয়েদের কৌতূহল আজ পর্যন্ত কেহ রোধ করিতে পারে নাই; বৃথাই অবরোধ-প্রথা, হারেম, ঘোমটা, বোরখার সৃষ্টি হইয়াছিল।

ওলগোবিন্দের বাড়িতে তিনটি স্ত্রীলোক,—ওলগোবিন্দের স্ত্রী ভামিনী ও দুই কন্যা। কন্যা দুইটি বিবাহিতা—গিন্নীবান্নী-জাতীয়া। প্রিয়গোবিন্দ তাহাদের কনিষ্ঠ।

কুঞ্জকুঞ্জরের গৃহে তাঁহার স্ত্রী ও পাঁচ কন্যা। তাহাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠা সুধামুখীই কেবল অনূঢ়া।

দুই পরিবারের একুনে নয়টি স্ত্রীলোকের কৌতূহল একসঙ্গে জাগ্রত হইয়া উঠিল। পাঁচিলের আড়াল হইতে উঁকিঝুঁকি আরম্ভ হইল।

ক্রমে মুখ-চেনাচেনি হইল।

ভামিনী অন্যপক্ষের কর্তা সম্বন্ধে মত প্রকাশ করিলেন, ‘মিন্‌সের ঝ্যাঁটার মতো গোঁফ দেখলেই ইচ্ছা হয় ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দিই!’

গৃহিণী সম্বন্ধে বলিলেন, ‘মরণ আর কি!’

সুধামুখী সম্বন্ধে বলিলেন, ‘বেশ মেয়েটি?’

কুঞ্জকুঞ্জরের গৃহিণীও মত প্রকাশ করিলেন; ওলগোবিন্দ সম্বন্ধে বলিলেন, ‘মিন্‌সের পেট দেখ না—যেন দশমাস!’

গৃহিণী সম্বন্ধে—‘মরণ আর কি!’

প্রিয়গোবিন্দ সম্বন্ধে—‘বেশ ছেলেটি!’

তারপর সুগোপনে রমণীদের মধ্যে আলাপ হইয়া গেল। কর্তারা কিছুই জানিলেন না।

কেহ যদি মনে করে, নারীরা স্বামীর শত্রুকে নিজের শত্রু বলিয়া ঘৃণা করে—তবে তাহারা কিছুই জানে না। হিন্দুনারী স্বামীর চিতায় সহমরণে যাইতে প্রস্তুত; কিন্তু শত্রুপক্ষের নারীদের সঙ্গে গোপনে ভাব করিবার বেলা তাহাদের নীতিজ্ঞান সম্পূর্ণ পৃথক। এই জন্যই কবি ভর্তৃহরি বলিয়াছেন—কি বলিয়াছেন এখন মনে পড়িতেছে না। তবে প্রশংসাসূচক কিছু নয়।

তিন

ওদিকে কর্তারা পরস্পরকে জব্দ করিবার মতলব আঁটিতেছেন।

উকিল মোক্তার হাতের কাছে নাই, তাই মোকদ্দমা বাধাইবার সুবিধা হইল না। উভয়ে অন্য উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন।

জগতে একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যায়, শত্রুর কথা অহর্নিশি চিন্তা করিতে করিতে চিন্তার ধারাও একই প্রকার হইয়া যায়। তাই পরস্পরের অনিষ্ট চিন্তা করিতে করিতে ওলগোবিন্দ ও কুঞ্জকুঞ্জর একই কালে একই সঙ্কল্পে উপনীত হইলেন।

গাছ!

বাগান নির্মূল করিয়া দাও!

চিন্তাকে কার্যে পরিণত করিবার সময় কিন্তু দেখা গেল ওলগোবিন্দই অগ্রণী! ইহার গুটিকয় কারণ ছিল। প্রথমত ওলগোবিন্দ পুত্রবান—সুতরাং তাঁহার তেজ বেশী। কুঞ্জকুঞ্জর উপর্যুপরি পাঁচটি কন্যার পিতৃত্ব লাভ করিয়াছেন। সকলেই জানেন, ক্রমাগত কন্যা জন্মিতে থাকিলে উৎসাহী ব্যক্তিরও কর্মপ্রেরণা কমিয়া যায়। দ্বিতীয় কথা, ওলগোবিন্দকে শত্রুদলন কার্যে সহায়তা করিবার জন্য সাবালক পুত্র ছিল—কুঞ্জকুঞ্জরের তাহা ছিল না।

ফলে, একদিন গভীর রাত্রে ওলগোবিন্দ সাবালক পুত্রের হাতে একটি কাটারি দিয়া বলিলেন, ‘ঝাউগাছগুলো! একেবারে সাবাড় করে দিবি—একটাও রাখবি না।’

কর্তব্যপরায়ণ পুত্র পিতার আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া কাটারি হস্তে প্রস্থান করিল। প্রিয়গোবিন্দকে দেখিলে কাসাবিয়ান্‌কার কথা মনে পড়ে। কর্তব্যে কঠোর! The boy stood on the burning deck.

চার

পরদিন প্রাতঃকালে কুঞ্জকুঞ্জর দেখিলেন, তাঁহার ঝাউগাছগুলো কাৎ হইয়া শুইয়া আছে। তাঁহার গোঁফ ঝাউয়ের মতোই কন্টকিত হইয়া উঠিল; মাথায় চুল ছিল না বলিয়াই কিছু কণ্টকিত হইতে পাইল না।

তিনি চলনোন্মুখ ইঞ্জিনের মতো শব্দ করিতে লাগিলেন।

তারপর দারোয়ানকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘মৃদং সিং, দেখ্‌তা হ্যাঁয়?’

মৃদং সিং বলিল, ‘হুজুর!’

কুঞ্জকুঞ্জর বলিলেন, ‘ঐ বুড্‌ঢা কিয়া।’

‘আলবাৎ। বে-শক্।’

‘হাম্‌ভি বুড্‌ঢাকো দেখ্ লেঙ্গে!’

মৃদং সিং বলিল, ‘তাঁবেদার মোজুদ হ্যাঁয়!’

কুঞ্জকুঞ্জর ভাবিলেন, মৃদং সিংকে দিয়াই প্রতিশোধ লইবেন। কিন্তু কিছুক্ষণ বিবেচনার পর দেখিলেন তাহা উচিত হইবে না। চাকরকে দিয়া বে-আইনী কাজ করানো মানেই সাক্ষীর সৃষ্টি করা। তাহাতে কাজ নাই। যাহা করিবার তিনি নিজেই করিবেন।

ওলগোবিন্দ সে রাত্রি সুখনিদ্রায় যাপন করিলেন। প্রাতঃকালে উঠিয়া দেখিলেন, তাঁহার কদলীকুঞ্জে কুঞ্জকুঞ্জর প্রবেশ করিয়া একেবারে তচ্‌নচ্ করিয়া গিয়াছে। কলাগাছগুলি নিতম্বিনীর ঊরুস্তম্ভের মতো পাশাপাশি পড়িয়া আছে।

পদ্মাবতী-চরণ-চারণ-চক্রবর্তী শ্রীজয়দেব কবি এ দৃশ্য দেখিলে হয়তো একটা নূতন কাব্য লিখিয়া ফেলিতেন। কিন্তু ওলগোবিন্দের চক্ষুর্দ্বয় লাট্টুর মতো বন্ বন্ করিয়া ঘুরিতে লাগিল।

তিনিও চলনোন্মুখ ইঞ্জিনের মতো শব্দ করিলেন।

তারপর বাড়ির ভিতর হইতে বন্দুক আনিয়া দমা্‌দম্ আকাশ লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িতে লাগিলেন।

কুঞ্জকুঞ্জর হটিবার পাত্র নয়। তিনিও বন্দুক আনিয়া আকাশ লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িলেন। ঘোর যুদ্ধ চলিল কিন্তু হতাহতের সংখ্যা শূন্যই রহিল।

বিক্রম প্রকাশ শেষ করিয়া দুইজনে আবার চিন্তা করিতে বসিলেন। ওদিকে স্ত্রীমহলে কি ব্যাপার চলিতেছে কেহই লক্ষ্য করিলেন না।

পাঁচ

যুদ্ধ-বিগ্রহ একটু ঠাণ্ডা আছে।

কারণ, দুই পক্ষই বন্দুক লইয়া সারারাত বারান্দায় বসিয়া থাকেন এবং মাঝে মাঝে আকাশ লক্ষ্য করিয়া গুলি ছোঁড়েন।

কিন্তু দুই পক্ষই সুযোগ খুঁজিতেছেন।

ওলগোবিন্দের লক্ষ্য কুঞ্জকুঞ্জরের পুষ্পবর্ষী শিউলি গাছটির উপর।

কুঞ্জকুঞ্জরের নজর ওলগোবিন্দের কৃশাঙ্গী তরুণীর মতো ইউক্যালিপ্টাস গাছের উপর।

একদিন ওলগোবিন্দের স্ত্রী আসিয়া বলিলেন, ‘কী ছেলেমানুষের মতো ঝগড়া করছ—মিটিয়ে ফেল! সুধা মেয়েটি চমৎকার—প্রিয়র সঙ্গে—’

ওলগোবিন্দ চক্ষুর্দ্বয় লাট্টুর মতো ঘূর্ণিত করিয়া বলিলেন, ‘খবরদার!’

ওদিকে কুঞ্জকুঞ্জরের গৃহিণী বলিলেন, ‘বুড়োয় বুড়োয় ঝগড়া করতে লজ্জা করে না—মিটিয়ে ফেল। প্রিয় ছেলেটি চমৎকার—সুধার সঙ্গে—’

কুঞ্জকুঞ্জর গুম্ফ কণ্টকিত করিয়া বলিলেন, ‘চোপ রও!’

কিন্তু প্রিয়গোবিন্দ এসব কিছুই জানে না (সুধা জানে)। প্রিয়গোবিন্দ পিতৃভক্ত যুবক, তার উপর কর্মকুশল। ওলগোবিন্দ যখন কেবল শূন্যে বন্দুক ছুঁড়িতে ব্যাপৃত ছিলেন, প্রিয়গোবিন্দ সেই অবকাশে শিউলি গাছ কাটিবার উপায় স্থির করিয়া ফেলিয়াছে।

প্রিয়গোবিন্দ লক্ষ্য করিয়াছিল যে রাত্রি তিনটার পর কুঞ্জকুঞ্জর আর বন্দুক ছোঁড়েন না। অতএব তিনটার পর তিনি ঘুমাইয়া পড়েন সন্দেহ নাই। প্রিয়গোবিন্দ স্থির করিল, পিতাকে না বলিয়া শেষরাত্রে অভিযান করিবে। পিতাকে বলিলে হয়তো তাহাকে বন্দুকের মুখে যাইতে দিবেন না।

সেদিন চাঁদিনী রাত্রি—কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া কি চতুর্থী। ভোর রাত্রে উঠিয়া প্রিয়গোবিন্দ করাত হাতে লইল; তারপর নিঃশব্দে পাঁচিল ডিঙাইয়া কুঞ্জকুঞ্জরের বাগানে প্রবেশ করিল।

জ্যোৎস্না ফিন্ ফুটিতেছে; কেহ কোথাও নাই। প্রিয়গোবিন্দ পা টিপিয়া টিপিয়া শিউলি গাছের দিকে অগ্রসর হইল।

শিউলি গাছের তলায় উপস্থিত হইয়া দেখিল—

ছয়

একটি মেয়ে ফুল কুড়াইতেছে।

প্রিয়গোবিন্দ পলাইবার চেষ্টা করিল।

কিন্তু পলাইবার সুবিধা হইল না। সুধাও তাহাকে দেখিয়া ফেলিয়াছিল। এবং চিনিতে পারিয়াছিল। প্রিয়গোবিন্দ সুধাকে আগে দেখে নাই।

আমাদের দেশের পুরুষেরা স্ত্রীলোক দেখিলে উঁকিঝুঁকি মারে এরূপ একটা অপবাদ আছে; মেয়েদের সম্বন্ধে কোনও অপবাদ নাই, অথচ—

ত্রস্ত সুধা জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি চাই?’

প্রিয়গোবিন্দ করাত পিছনে লুকাইল; বলিল, ‘কিছু না।’

সুধা-‘তুমি আমার শিউলি গাছ কাটতে এসেছ!’ বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

প্রিয়গোবিন্দ স্তম্ভিত হইয়া বলিল, ‘মানে—এ গাছ কার?’

‘আমার!’

‘মানে—তুমি কে? এ গাছ তো কুঞ্জরবাবুর!’

‘আমি তাঁর ছোট মেয়ে। আমার নাম সুধা।’

‘ও—মানে, তা বেশ তো।’

সুধা চক্ষু মুছিয়া বলিল, ‘তোমরা কেন আমাদের ঝাউ গাছ কেটে দিয়েছ?’

প্রিয়গোবিন্দ ক্ষীণস্বরে বলিল, ‘আমাদের কলা গাছ—’

‘তোমরা তো আগে কেটেছ!’

প্রিয়গোবিন্দ নীরব। সুধার মুখে একটু মেয়েলী চাপা হাসি দেখা দিল। বিজয়িনী! পুরুষ ও-হাসি হাসিতে পারে না।

সুধা আবার আঁচলে ফুল কুড়াইয়া রাখিতে লাগিল; যেন প্রিয়গোবিন্দ নামক পরাভূত যুবক সেখানে নাই।

প্রিয়গোবিন্দ বোকার মতো এক পায়ে দাঁড়াইয়া রহিল। একবার করাত দিয়া পিঠ চুলকাইল।

শেষে ঢোক গিলিয়া বলিল, ‘তুমি রোজ এই সময় ফুল কুড়োতে আসো?’

সুধা মুখ তুলিয়া বলিল, ‘হাঁ—কেন?’

প্রিয়গোবিন্দের কান ঝাঁ ঝাঁ করিয়া উঠিল; সে তোৎলাইয়া বলিল, ‘তবে আ-আমিও রোজ এ-ই সময় গাছ কাটতে আসব।’ বলিয়া এক লাফে পাঁচিল ডিঙাইয়া পলায়ন করিল।

সুধা আবার হাসিল। বিজয়িনী!

সাত

অন্দরমহলের ষড়যন্ত্র ভিতরে ভিতরে জটিল হইয়া উঠিতেছে। The plot thickens!

একদিন কুঞ্জকুঞ্জরের কুলপুরোহিত হাওয়া বদলাইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার হঠাৎ ডিস্‌পেপসিয়া হইয়াছে।

ওদিকে কর্তারা রাত্রি জাগিয়া ও বন্দুক ছুঁডিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছেন। সাত দিন পরে দু’জনেই ঘুমাইতে গেলেন। মৃদং সিং ও ভেঁপু সিং বাগান পাহারা দিতে লাগিল।

তিন দিন ঘুমাইবার পর দুই কর্তা আবার চাঙ্গা হইয়া উঠিলেন। তখন আবার তাঁহাদের প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি চাগাড় দিল।

ইতিমধ্যে প্রিয়গোবিন্দ রোজ শেষরাত্রে শিউলি গাছ কাটিতে যাইতেছিল। ওলগোবিন্দ তাহা জানিতেন না; তাই তিনি তাহাকে ডাকিয়া পরামর্শ করিলেন। প্রিয়গোবিন্দ শিউলি গাছের প্রতি দারুণ বিদ্বেষ জ্ঞাপন করিয়া জানাইল, ওদিকে তাহার নজর আছে; সুবিধা পাইলেই সে শিউলি গাছের মূলে কুঠারঘাত করিবে।

ওলগোবিন্দ হৃষ্ট হইলেন।

ওদিকে কুঞ্জকুঞ্জর একজন মন্ত্রী পাইয়াছেন—পুরোহিত মহাশয়। তিনি ইউক্যালিপ্টাস গাছ সম্বন্ধে নিজের দুরভিসন্ধি প্রকাশ করিলেন।

পুরোহিত মহাশয় অত্যন্ত সাদাসিধা লোক, তার উপর ডিস্‌পেপসিয়া রোগী; তিনি বলিলেন, ‘এ আর বেশী কথা কি! ভাল দিন দেখে কেটে ফেল্‌লেই হল। দাঁড়াও আমি পাঁজি দেখি।’

পাঁজি দেখিয়া পুরোহিত বৃক্ষছেদনের উৎকৃষ্ট দিন দেখিয়া দিলেন; এমন সহৃদয় অথচ ধর্মপ্রাণ সহায়ক পাইয়া কুঞ্জকুঞ্জরের উৎসাহ শতগুণ বাড়িয়া গেল।

স্থির হইল সোমবার রাত্রি একটার সময় শুভকর্ম সম্পন্ন হইবে। গুলি গোলা বন্ধ আছে, ওলগোবিন্দটা নিশ্চয়ই এখনো ঘুমাইতেছে; সুতরাং নির্বিঘ্নে কার্য সম্পন্ন করিবার এই সময়।

আট

কিন্তু শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি।

বিশেষত নারীজাতি একজোট হইয়া যাহাদের পিছনে লাগিয়াছে তাহাদের জয়ের আশা কোথায়?

রাত্রি একটার সময় কুঞ্জকুঞ্জর করাত লইয়া নির্বিঘ্নে পাঁচিল পার হইলেন। কিন্তু ইউক্যালিপ্টাস গাছের কাছে যেমনি দাঁড়াইয়াছেন, অমনি ওলগোবিন্দ আসিয়া তাঁহাকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করিয়া ধরিলেন। কুঞ্জকুঞ্জর করাত দিয়া তাঁহার কান কাটিয়া লইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হইল না। ভেঁপু সিং দারোয়ান তাঁহাকে পিছন হইতে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল।

এইভাবে বুকে-পিঠে আলিঙ্গিত হইয়া কুঞ্জকুঞ্জর বাড়ির মধ্যে নীত হইলেন। তাঁহাকে একটি চেয়ারে বসাইয়া, তাঁহার পায়ে দড়ি বাঁধিয়া দড়ির অন্য প্রান্ত নিজ হস্তে লইয়া ওলগোবিন্দ আর একটি চেয়ারে বসিলেন। বন্দুক তাঁহার কোলের উপর রহিল।

দুইজনে পরস্পরের মুখ অবলোকন করিলেন।

চারি চক্ষুর ঠোকাঠুকিতে একটা বিস্ফোরক অগ্ন্যুৎপাত হইয়া গেল না, ইহাই আশ্চর্য। ওলগোবিন্দ চক্ষু ঘূর্ণিত করিয়া বলিলেন, ‘বুদিনানা অফ্ দি ব্রঙ্কাইটিস্ ইন্টু দি ঘুল্‌ঘুলি অফ্ চাট্‌নি কাবাব। তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা—। গিজিতাক্‌শিন!’—তাঁহার উদর জীবন্ত ফুটবলের মতো লাফাইতে লাগিল।

কুঞ্জকুঞ্জর কিছুই বলিলেন না।

ওলগোবিন্দ তখন ঈষৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া ভেঁপু সিংকে বলিলেন, ‘প্রিয়কে ডাক।’

প্রিয় আসিল।

ওলগোবিন্দ গর্জন করিয়া বলিলেন, ‘শিউলি গাছ।’

কাসাবিয়ান্‌কা তৎক্ষণাৎ পিতৃ-আজ্ঞা পালন করিতে ছুটিল।

নয়

পনের মিনিট কাটিয়া গেল। ওলগোবিন্দ দুই মিনিট অন্তর ফুটবল নাচাইয়া হাসিতে লাগিলেন, ‘হিঃ! হিঃ! হিঃ!’

তারপর ওলগোবিন্দ বলিলেন, ‘ভেঁপু সিং, থানামে খবর দেও! এই চোট্টাকে জেলমে ভেজেঙ্গে।’

‘যো হুকুম’ বলিয়া ভেঁপু সিং প্রস্থান করিল।

আরও পনের মিনিট অতীত হইল। ওলগোবিন্দ পূর্ববৎ দু’মিনিট অন্তর হাসিতে লাগিলেন।

কুঞ্জকুঞ্জর কেবল ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করিতে লাগিলেন।

হঠাৎ উভয়ের কর্ণে দূর হইতে একটা শব্দ প্রবেশ করিল—‘লু—লু—লু—’

দু’জনে শিকারী কুকুরের মতো কান খাড়া করিলেন। শব্দটা যেন কুঞ্জকুঞ্জরের বাড়ি হইতে আসিতেছে।

ওলগোবিন্দ একটু অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন। দুপুর রাত্রে ও আবার কিসের শব্দ! শেয়াল নাকি! প্রিয় এতক্ষণ ওখানে কি করিতেছে?

তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিতে লাগিলেন। অনুসন্ধান করিতে যাইবারও উপায় নাই—কুঞ্জকুঞ্জর পলাইবে।

এমন সময় ভেঁপু সিং হাঁপাইতে হাঁপাইতে ফিরিয়া আসিল; বলিল, ‘আয়্ হুজুর, আপ, বৈঠা হ্যাঁয়?’

ওলগোবিন্দ রাগিয়া বলিলেন, ‘বৈঠা রহেঙ্গে নেইত কি লাফাঙ্গে? ক্যা হুয়া?’

ভেঁপু সিং জানাইল ও-বাড়ির মাইজীলোগ দাদাবাবুকে পাকড়িয়া লইয়া অন্দর মহলে প্রবেশ করিয়াছে!

দুই কর্তা একসঙ্গে লাফাইয়া উঠিলেন। ওলগোবিন্দের কোল হইতে বন্দুক পড়িয়া গেল।

ভেঁপু সিং তখনও বার্তা শেষ করে নাই, সক্ষোভে বলিল, উক্ত মাইজীলোগ কেবল দাদাবাবুকে ধরিয়া লইয়া গিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, সকলে মিলিয়া উচ্চৈঃস্বরে তাঁহাকে ‘উল্লু উল্লু’ বলিয়া গালি দিতেছে।

এই সময় কর্তারা স্বকর্ণে শুনিতে পাইলেন—‘উলু—উলু—উলু’

দু’জনে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিলেন; তারপর, যেন একই যন্ত্রের দ্বারা চালিত হইয়া দৌড়িতে আরম্ভ করিলেন। কুঞ্জকুঞ্জরের পায়ের দড়ি অজ্ঞাতসারেই ওলগোবিন্দের হাতে ধরা রহিল।

তাঁহারা যখন কর্মস্থলে উপস্থিত হইলেন, তখন ডিস্‌পেপসিয়া রোগাক্রান্ত পুরোহিত মহাশয় শুভকর্ম শেষ করিয়াছেন।

দুই বাড়ির গৃহিণীই উপস্থিত ছিলেন। কর্তাদের মূর্তি দেখিয়া তাঁহারা পরস্পরের গায়ে হাসিয়া ঢলিয়া পড়িলেন; বলিলেন, ‘আ মরে যাই! বুড়ো মিন্‌সেদের রকম দ্যাখ না! যেন সঙ!’

৮ পৌষ ১৩৪১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *