৮
চানু জানত না ব্যাঁকা সাহার নাম বঙ্কিমচন্দ্র। টিভিতে দেখল মন্দারমণিতে পর্যটক গুলিবিদ্ধ। ভোটার কার্ডের ছবিটা দেখাচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্র সাহা, পিতা বিহারীলাল সাহা। স্ট্রেচারে শোয়া রক্তাক্ত ছবিটাও এক ঝলক দেখল চানু। বলল—একটি রিসর্টে উঠেছিল, সঙ্গে ছিল পাপিয়া মণ্ডল নামের এক যুবতী। ওই যুবতীটির সঙ্গে ওঁরা যখন সমুদ্র সৈকতে ঘুরছিলেন, তখন একটি মোটরসাইকেল থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের পিছন দিক থেকে মাথায় পরপর কয়েকটি গুলি করা হয়। পাপিয়া মণ্ডলকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাপিয়ার ছবিটাও দেখা গেল। মাথা নীচু।
তখন বেলা বারোটা মতন। টিভিটা এমনি খুলে ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র মানে ব্যাঁকা সাহাই তো? ছবিটা তো তাই বলছে। পাপিয়া ওর সঙ্গে? ছবিটা তো তাই বলছে। এবার চানুর কী করা উচিত? বসকে ফোন করে ফেলল। সুইচড অফ। বস নেই। চারদিন হল। গত পরশু চানু ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিল। ঠিকঠাক পৌঁছেচেন তো স্যার? স্যার বলেছিল একদম ঠিকঠাক। অখন আরতি দেখতাছি। ফোনে ঘণ্টার শব্দও শুনতে পেয়েছিল চানু। চানুর মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। হাতের পাতা দুটো জোড়া করে ফেলল। কিছু একটাকে হাতে চেপে ধরছে, যেন, তারপর প্রার্থনার মতো বিড়বিড় করল—যেন বেঁচে যায়।
চানু তো জানে সাহাবাবু ওর বিরুদ্ধ লোক। ওর বিরুদ্ধ মানে গুরুপদর বিরুদ্ধ শক্তি। সাহাবাবু আউট হয়ে গেলে গুরুপদবাবুর উত্থান হবে তাড়াতাড়ি। গুরুপদর উত্থান মানে তো ওর উত্থান। তবু চানু চায় লোকটা যেন বেঁচে যায়। লোকটা বেঁচে গেলে কি বদলা নেবে না? ওকি আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে না? ঝামেলা তো লেগেই থাকবে। কিন্তু মরে গেলে কি বদলা হবে না? খুন কা বদলা খুন হ্যায়…। চিন্তা করতে পারে না চানু। টিভির চ্যানেল পালটায়। দুপুরে ভালো করে খেতে পারে না। অঙ্কর বই খুলে বসে। এসএসসি দেবে এলিমেন্টারি ম্যাথস। খাতা জুড়ে শূন্যগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাপিয়া কেন ওর সঙ্গে গেল! পাপিয়া কি যেতে বাধ্য হল? পাপিয়া কি একটা টোপ? পাপিয়া একটা গ্রামের মেয়ে। বাদুর কাছে থাকে ও। ওর সঙ্গে কথা বলেছে চানু। ওর বাবা প্রাইমারি টিচার। পাপিয়া বলেছিল ছেলেবেলায় টিভিতে নাচ দেখে নিজেই নাচত। স্কুলেও নেচেছে, কেউ শেখায়নি। তারপর মধ্যমগ্রামের একটা নাচের স্কুল। টিভিতে ‘সুন্দরী কমলা নাচে’র রিয়েলিটি শো-তে অডিশনে পাশ, টিভিতে অনুষ্ঠান। তিন চারটে রাউন্ড উঠেছিল। কলকাতার হোটেলে অফার। বাবা যেতে দেয়নি। বলেছিল ওর বাবা খুব ভালো। ওর দাদারা ভালো নয়। বলেছিল নাচের লাইনটা ভালো নয়, কিন্তু ঢুকে পড়েছে, বেরতেও পারছে না। বলেছিল একদিন ওর বাড়িতে নিয়ে যাবে। বেলা পাঁচটা নাগাদ টিভিতে দেখল গুলিতে আহত বঙ্কিম সাহাকে মেদিনীপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, হাসপাতাল থেকে ওকে মৃত ঘোষণা করা হয়। চানু কিট্টুকে ফোন করল। কিট্টু ফোন ধরল না। চানুর বুক দুরুদুরু করতে লাগল। টিভিতে আসর বসে গেছে। ব্রেকিং নিউজ। নারীর ফাঁদে প্রোমোটার? পাপিয়ার ছবি দেখানো হচ্ছে। মুখটা সামান্য ঝাপসা। সেই কুয়াশা মাখানো রহস্যময়তার ভিতরে পাপিয়ার মুখ। চানুর তো নিষ্পাপ মুখ মনে হচ্ছে। পাপিয়া, তুই গেলি কেন? কে যেতে বলল? ষড়যন্ত্র? সুপারি দেওয়া ছিল? পুলিশ কি চানুকেও ধরবে? চানু কিছু জানে না, কিচ্ছু না। চানু ভাবছে কেন, গুরুপদই ষড়যন্ত্র করেছে! সাহাবাবুর গ্রুপের ভিতরের গন্ডগোলও তো হতে পারে। তাই যেন হয়। যেন ভজাই কিংবা নাটাপাঁচুর ষড়যন্ত্র হয়। ওরা সাহাবাবুর লোক। হতে কি পারে না—সাহাবাবুর অনেক টাকা রাখা আছে ওদের কাছে। খুনি যেন রামপিয়ারি হয়। রামপিয়ারির সঙ্গে হয়তো গণ্ডগোল ছিল। তাই যেন হয়। বোমার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বাবা বড়বাজারের গদিতে। বাবাকে কিছু করবে না তো? টিভিতে দেখাচ্ছে বীরভূমের কোথায় মুখে রক্ত ওঠা মানুষ, ভ্যানে করে গামছা ঢাকা মৃতদেহ চলেছে, পা দুটো নড়ছে ঝাঁকুনিতে। মোটাসোটা নেতার মুখ ভাবলেশহীন। বলছে—এসব ওদের চক্রান্ত। সাজানো। দেখছে একটা প্রাচীরের গায়ে সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা সার সার মনীষীর মুখ। মুখগুলির উপর বোমা পড়ছে। ভেঙে পড়ল রামমোহনের টুপি, বিদ্যাসাগরের মুখ থেকে খসে পড়ল নাক, নজরুলের বড় বড় চোখে গর্ত হয়ে গেল। বলছে এই প্রাচীরটা নিয়েই কাজিয়া শুরু হয়…।
গুরুপদও একটা প্রাচীর তুলিয়েছিল নতুন কেনা জমিতে। সাইনবোর্ড লেখার আর্টিস্ট ডাকিয়ে ডাকিয়ে প্রাচীরের গায়ে প্রথমে লিখিয়েছিল—এখানে প্রস্রাব করিবেন না। তারপর কালীঠাকুর, এরপর ছ’টা মনীষী লাইন দিয়ে পরপর, লোকনাথ বাবা। বোমার শব্দ আসছে দুমদাম। কোথায় বোম পড়ছে? ওই প্রাচীরের গায়েও?
একটা মিছিল। বেশি লোক নয়। বঙ্কিম সাহার হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, বিচার চাই। মিছিলটা এ পাড়ায় ঢুকেছে। লোকগুলো এই বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে কেন? জানালা বন্ধ করে দেয় চানু। চানুর মা আটা মাখছে। নির্বিকার। কিচ্ছু জানে না। সুলতার পরনে ম্যাক্সি, হাতে ছুঁচ। পাড় বসাচ্ছে। শাড়িতে। কিছু জানে না। দরজায় ধাক্কা। কে এখন? চানু দরজা খুলবে না। মা কেন আটামাখা হাতে এগিয়ে যায়। ওধারে যেও না মা, ওদিকে যেও না—চানু চেঁচায়, কিন্তু গলা থেকে শব্দ বের হয় না। দরজা খুলতেই চারজন—গামছা ঢাকা মুখ…জ্বালিয়ে দে সবাইকে। গুরুপদর চামচেটা কোথায় গেল। চানু, দ্রুত খুব দ্রুত তক্তাপোষের তলায় সেঁধিয়ে যায়। খুব গালাগালি শোনা যাচ্ছে। মায়ের চিৎকার। একদম চুপ, চুউপ, মেশিন দেখছেন, গুলি করে দেব। একদম…এরপর সুলতার চিৎকার—মায়ের গোঙানি। কিছু একটা পড়ে গেল। কাচের ঝনঝন। কাকে ফোন করবে? কাকে? পুলিশ? পুলিশ কত? ১০০? ফোন করলে কি ওকেও ধরবে। ষড়যন্ত্রের অংশ চানুও! চানুও গুরুপদর লোক! তাই তো, তাই তো এই বদলার অভিযান। সাহাবাবুর বদলা কি চানুও হতে পারে? কে জানে, কে জানে কে জানে? বিপদে তো পুলিশই বাঁচায়। ১০০ ফোন করল। ফোন বেজে গেল। গুরুপদকে ফোন করল, ফোন বেজে গেল। কিট্টুকে ফোন করল, ব্যর্থ, বেজে গেল। চানু চিৎকার করল মা-মা-মা…কোনও আওয়াজ এল না। তক্তাপোষের তলদেশ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এল। গুহাকন্দর থেকে বের হল যেন।
কতক্ষণ সময় চলে গেল এর মধ্যে? পাঁচ মিনিট? না পাঁচ ঘণ্টা? নাকি একটা জন্মই বৃথা বয়ে গেল? দরজা ধাক্কা দিতে গেল। দরজা খুললেই যদি গুলি করে দেয়? করুক। করুক গুলি। ওরা কী করছে সুলতা ঠিক আছে তো? দিদিটা? দরজা খুলতে গিয়ে দরজা বন্ধ। ওরা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। দরজা ধাক্কা দিল। দরজা ধাক্কা দিল জোরে। আর একটা ধাক্কা শুনতে পেল। ওখান থেকে শুনল চুপ থাক। একদম চুপ। ঝাঁঝরা করে দেব। জানালা খুলে চিৎকার করবে? চিৎকার করলে কি কেউ আসবে? প্রতিবেশী? অন্য ফ্ল্যাটের লোক? এসে কী দেখবে? দেখবে রেপ হয়ে গেছে চক্রবর্তীবাড়ির মেয়ে। কি দেখবে? একটা উলঙ্গ নারী? চানু চেঁচায় না। ও চুপ। সাপুড়ের বাঁশি বাজছে। বাঁশি বাজছে টিভিতে। পাশের ঘরটাতে দিদি। দেওয়ালে কান রাখে চানু। কান চাপে দেওয়ালে। একটা হু-হু করা শব্দ। সমুদ্রের হাহাকারের শব্দ। দেওয়ালে মাথা ঠোকে চানু। নিজের গালে সপাটে চাপড় মারে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। ঠোঁট থেকে রক্ত। খামচে ধরে নিজের গা। হে ভগবান, হে গুরুপদদা, হে বিমল নন্দী, হে রামপিয়ারি, হে মাখন পাত্র, হে বাবা লোকনাথ—রণে বনে জঙ্গলে…। এটা কি জঙ্গল? জঙ্গলে শুধু বৃক্ষ। নির্বাক বৃক্ষ। নির্বাক প্রতীক্ষা। কখন কিছু একটা হবে। এইভাবে বেশিক্ষণ থাকা যায় না আর। দরজা ভেঙে ফেলবে। যত জোর আছে গায়ে ধাক্কা দেয়।
ধাব্বা চলতেই থাকে। কিছুক্ষণ পর এলিয়ে গেল হাত। ওর দিদিই দরজা খোলে। রক্তমাখা ঠোঁট। ম্যাক্সিটার উপর গামছা পেঁচিয়েছে। বাথরুমের দরজাটাও ভিতর থেকে ধাক্কাচ্ছিল মা। ওই দরজাটাই খুলল সুলতাও। ওর মায়ের হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা, ওর মায়ের মুখে বাথরুম মোছার তেনা কাপড়টা গুঁজে রাখা। কাপড়টা টেনে খুলে দিতেই সলুরে…বলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। সুলতা টাল রাখতে পারে না, পড়ে যায়। ওর দিদির ম্যাক্সিটা ফালা করে ছেঁড়া। অন্তর্বাস নেই। অন্যদিকে মুখ ফেরায়। দিদির রক্ত মায়ের মুখে লাগে। ওরা চলে গেছে। চানুর এখন কী কর্তব্য বুঝে উঠতে পারে না। ওরা চলে গেছে। চানু কর্তব্য বুঝে ফেলে। ও তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি দিয়ে দেয়। তারপর একটা বেরোলিনের টিউব নিয়ে এসে টিপে দাঁতমাজার আঙুলে কিছুটা নিয়ে সুলতার গালে আর হাতে নখের দাগগুলির উপর প্রলেপ দেবার জন্য এগিয়ে গেলে সুলতা ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ওর মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ওঠে, ওই দুই নারীর সারা শরীর কাঁপতে থাকে। ওদের মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু শব্দ বের হয়। ওটা কান্না না চিৎকার না গোঙানি না আর্তনাদ না ঘৃণা না ভেজা বারুদের ভীত বিস্ফোরণ চানু বুঝে উঠতে পারে না। চানু কর্তব্য ঠিক করে নেয়। জানালার কপাট বন্ধ করে। টিভিটা জোরে করে। সন্ধ্যাবেলার শাঁখ—যেটা রোজ এই সময় বাজে। যেন কিচ্ছু হয়নি। এ বাড়িতে কিচ্ছু হয়নি। আরও জোরে শব্দ করে ওঠে দুই নারী। এক গ্লাস জল খায়। আর এক গ্লাস কান্নার মাঝখানে রেখে চানু দূরে সরে যায়। ছশো বত্রিশ স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের কত দূর—কত দূর যেতে পারে কেউ।
সিরিয়ালের মেয়েটা আমেরিকায় বরের কাছে চলে যাবার আগে পুরানো প্রেমিকের কাছে যাবে। টিভি বন্ধ করে। কান্নার শব্দ থেমে গেছে। মা আর মেয়ে কলঘরে। জলের ছরছর শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই আর।
মা বেরুল কলঘর থেকে। দিদি ভিতরে। মা একটা মিইয়ে যাওয়া বোমার মতো দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল চানুর দিকে। চানু মাথা নীচু করল।
—ওরা কারা?
চানু দুবার মাথা নাড়াল।
সমাজবন্ধু?
চানু মাথা নাড়ালো দুবার।
এবার কী হবে?
প্রশ্নচিহ্ন পেঁচিয়ে ধরছে চানুকে।
জলের অবিরাম বলহরি।
কী হবে এবার?
ওই ওষুধটার নাম মনে করতে চেষ্টা করল চানু। সংযোগের বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে খেয়ে নিলে গর্ভ…। নামটা মনে পড়তেই নিজের গালে থাপ্পড় মারল চানু।
মা বলল, কেউ যেন না জানে…।
চানুর চোখ ফেটে জল ঝরল এবার।
থানায় কোনও ডায়েরি করেনি ওরা। কাউকে জানায়নি। বাড়ির একজন জিজ্ঞাসা করেছিল কিছু কী হয়েছিল—কয়েকটা ছেলে ঢুকল…। চানু বলেছিল ওরা এমনি ঢুকেছিল, এমনি এমনি। হরিপদ জেনেছিল। কতটা জেনেছিল চানু জানে না। চানু কিট্টুকেও জানায়নি, গুরুপদকেও নয়। গুরুপদ ফিরে এসেছিল দিন সাতেক পরে। অনেকগুলো প্যাঁড়া নিয়ে এসেছিল। গুরুপদ ফিরে এসে এসব শুনে খুব আশ্চর্য হয়েছিল।
গুরুপদর মোবাইল অফ ছিল। গুরুপদ বলেছিল—মোবাইল চালু রাখি নাই। মা গঙ্গার কাছে গেছি, শিবের নিবাস হিমালয় চোখের সামনে। ওই অবস্থায় কীসের বালি, সিমেন্ট, রড। কীসের বিঘা কাঠার হিসাব? কিচ্ছু না। হৃষীকেশ গেলাম, লছমন ঝুলার কাছে এক ধর্মশালায়। ওইখানে সব শোক জল। টিভি-মিভি খুলি নাই। সন্ধ্যায় আরতি দেখতাম, তারপর দুইখানা রুটি আর দুধ। সমস্তরকম কূটকাচালির ঊর্ধ্বে। ভাবতেও পারি নাই মেয়েটার এরকম হতে পারে।
এই মেয়েটা মানে সুলতা নয়, একদম নয়। সুলতার ব্যাপারটা কাউকে বলেনি চানু। কেউ জানে না। নীরবে রেপ হয়েছে ও মেয়েটা মানে পাপিয়া। পাপিয়া মারা গেছে। আত্মহত্যা। গায়ে আগুন। টিভির সব চ্যানেলে এই ব্যাপারটা নিয়ে তিন দিন সরগরম। এখন আর ওটা নয়। এখন মানুষের হাসপাতালে বড় মানুষের পোষা কুকুরের ডায়ালিসিস নিয়ে চলছে। পাপিয়ার সুবাদে মুম্বাচুম্বা রেস্টুরেন্টটাকে দেখিয়েছে কয়েকবার। আরও বিখ্যাত হয়েছে। মুম্বাচুম্বা ঠিকঠাক চলছে। ওটা তো বেআইনি নয়, লাইসেন্স তো ছিলই।
বঙ্কিমচন্দ্র সাহার মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছিল, আর পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা লকআপে রাখা হয়েছিল। বাথরুমে সে গায়ে আগুন দেয়। ওর পরনে ছিল সিনথেটিক শাড়ি।
থানা লকআপে দেশলাই কী করে পেল তা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলেছিল। কেউ বলছে বৃহৎ কোনও চক্রান্ত করে মেয়েটাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখলে অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যেত। দীঘার ওই হোটেলের ৪০৩ নম্বর ঘরে এরা দুজন ছাড়াও আর একজন ব্যক্তিকে একদিন আগে ঢুকতে দেখা গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন হোটেল কর্মচারীরা। ওই ব্যক্তিটি সারা দুপুর ছিলেন। তবে কি প্রোমোটার সাহা মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিল কাউকে ভেট দিতে?
পাপিয়া মন্ডলের দগ্ধ দেহটাকে ঝাপসা করে দেখানো হয়েছিল। ওর বাবার হাতে দেহ সমর্পণের দৃশ্যও। ওর বাবার মুখের কাছে চারটে, পাঁচটা, ছটা টিভি বুম। বলুন, আপনার কেমন লাগছে। আপনি কি বঙ্কিম সাহাকে চিনতেন? আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন? আপনি কি জানতেন আপনার মেয়ে এসব করে…এসকর্ট সার্ভিস। লোকটা এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। এইবার চিৎকার করে উঠল।
—আমি জানতাম আমার মেয়ে নাচত…সতী বেউলাও নাচত। আমি জানতাম ও নাচতে গেছিল। আমার মেয়ে নিজি হাতে গায়ে আগুন দিতি পারে না।
—তাহলে বলছেন ওকে আগুন লাগিয়ে মারা হয়েছে?
—হ্যাঁ। আমি তাইতো বলি।
—পুলিশকে বলেছেন?
—বলেছি।
—কে মেরেছে?
—ওরা।
—ওরা মানে?
ওরা মানে? কেমন পাংশু হয়ে যায় মুখ। ওরা মানে…সবাই।
আপনারা। ওরা মানে…দু হাতে মুখ ঢাকে। পুলিশ সরিয়ে দেয়।
পাপিয়া মণ্ডলের বাড়িটায় জবা গাছ ফুলে ভরা, তিনটে হাঁস হেলতে-দুলতে উঠানে ঘুরছে। একটা টালির চালের ঘরের পাশে কংক্রিটের পিলার ফুঁড়ে কয়েকটা লোহার রড হাত বাড়িয়ে আছে। পাশে ডাঁই করা বালি, ইট।
একটা পাকা ঘর করতে চেয়েছিল মেয়েটা…টিভির ভিতর থেকে কণ্ঠস্বর বলে ওঠে। একটা গানের কলিও বাজে ব্যাকগ্রাউন্ডে—কেন রে এত যাবার ত্বরা? বিদায়পথে হতাশ বকুল/কপোত কূ-জনে হল যে আকুল/চরণ পূজনে ঝরাইছে ফুল বসুন্ধরা। ক্যামেরা তখন করবী গাছ তলে, যেখানে হলুদ করবী লুটিয়ে পড়েছে। এটা বিশেষ প্রতিবেদন। নাম : হত্যা, না আত্মহত্যা।
পুলিশ আর কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। কারণ কেউ অভিযোগ করেনি। মেয়েটির বাবার অভিযোগ ছিল ‘ওরা’। আঙুলটা সামনে উঁচোনো।
টিভির ক্যামেরা যখন সামনাসামনি ওর বাবাকে ধরেছিল, ওর বাবা কল্পিত হত্যাকারীর দিকে আঙুল উঁচিয়ে ছিল, সেই আঙুলটা ছিল সোজাসুজি। আপনার আমার দিকেও বোঝায়।
ব্যাপারটা কয়েকদিনের মধ্যেই ঝিমিয়ে গেল। বঙ্কিম সাহার ছবির গলার মালাও শুকিয়ে গেল। মাখন পাত্র জামিন পেলেন, কিন্তু তার পুরানো পদ ফিরে পেলেন না। মাখন পাত্র গুরুদেবের কথায় রাজনীতি ছেড়ে দিলেন। বললে,—জেলে ওঁর দৈবদর্শন হয়েছে। উনি আধ্যাত্মিক মার্গেই থাকবেন, ওঁর বিরোধীরা বললেন—অলরেডি যা করে নিয়েছে, তাতে ওঁর পরের তিন পুরুষের কিছু করতে হবে না। মাখন পাত্রের ডান হাত রামপিয়ারি মাখন পাত্রর বিরোধী গোষ্ঠীর ভীম ঘোষের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করলেন এবং দু ঘণ্টা ধরে দেশের পরিস্থিতি আলোচনা করলেন। নফরগঞ্জ এলাকার ব্যাঁকা সাহা তথা প্রয়াত বঙ্কিমচন্দ্রের অনুগামীরা একে একে কিট্টুর সঙ্গে দেখা করল এবং গুরুপদর লোক হয়ে গেল, গুরুপদ সবাইকে সমাজবন্ধু হিসেবে গ্রহণ করল না। বঙ্কিমচন্দ্রের দুইজন স্ত্রী ছিল। দুজনই বৈধ স্ত্রী হিসেবে দাবি করতে লাগল। বড় বউ এফআইআর করেছিল, সেখানে গুরুপদ কর্মকারের নাম নাকি ছিল, আর ছোটবউ যে এফআইআর করেছিল, সেখানে বড় বউয়ের নাম ছিল। বলেছিল বড় বউ চক্রান্ত করে স্বামীকে মেরেছে। তালেগোলে কিসসু হল না। বঙ্কিম সাহা হত্যায় কেউ গ্রেপ্তারই হল না। তাতে কী হয়েছে, এমন তো অনেক হয়। আসল কথা হল শান্তি। নফরগঞ্জে এখন কোনও অশান্তি নেই। ঝোপেঝাড়ে কাশফুল ফুটেছে। মুদি দোকানেও সাপের ছবিওলা তেল বিক্রি হচ্ছে। দুর্গাপুজো উদ্বোধন করতে আসছেন বুলবুলি মল্লিক।
গুরুপদর বাড়িটা শূন্য শূন্য। ওর বউয়ের একটা ছবি বড় করে বাঁধানো। মা বলছেন—এমন থাকলে কি চলে, আবার বিয়া কর বাপ। লোকটার এখন খাওয়ার ঠিক নেই। সকালবেলায় অফিস ঘরে নেমে আসে। বাইরের পুরি-কচুরি আসে। অম্বল হচ্ছে।
মুম্বাচুম্বা চলছে। পাপিয়া নেই তো কী হয়েছে? কিটি আছে। আর সুলতার জীবনে যে তিন অক্ষরের একটা ব্যাপার ঘটে গেল, মূর্ধণ্যষয়ের উপর র-ফলাটা ছোরার মতোই বিঁধে রইল, ধর্ষণ, অক্ষরটা থেকে রক্ত চোঁয়াচ্ছে আজও। শব্দটাকে অন্ধকারেই রাখতে চেয়েছিল চানুদের পরিবার। মাটি চাপা দিয়ে, বাক্সবন্দি করে। কিন্তু শব্দটা কংক্রিট ফুঁড়ে ওঠা কাশফুলের মতোই উঠে এসে নড়ছে এখানে ওখানে।
হরিপদকে অচেনা কেউ রাস্তায় বলল, স্যাড, ভেরি স্যাড।’ পোস্টাল অর্ডার কিনে বেরিয়ে আসার সময় মাসিক সুদ নিতে আসা চানুদের পাড়ার এক বয়স্ক ভদ্রলোক বলল—বুঝলে, কিচ্ছু করার নেই। সব ব্যাধি, ব্যাধি। এক ফোঁটা রক্ত থেকেই সারা শরীরের জার্ম বোঝা যায়, একটা ঘটনা থেকেই বোঝা যায় সারা দেশ। আমরা জ্যান্ত থেকেও মড়া। এই জ্যান্ত থাকার মানে নেই। এখন আমরা সব ভেজা বারুদ। লোকটা চানুর পিঠে হাত দেয়। সহানুভূতির, নাকি বলছে ওঠো জাগো…। স্বামী বিবেকানন্দ-র ছবির তলায় যেমন লেখাটা থাকে।
কিট্টু কিছু বলেনি, গদাই নকু ওরা বলেছে—কিরে, তোর বোনের কোনও প্রবলেম নেই তো?
গুরুপদ একদিন চানুকে অফিসঘর থেকে সোজা দোতলায় নিয়ে যায়। বলে, কথা আছে। শোবার ঘরে। এর মৃত স্ত্রীর আঠারো বাই বারো ছবি। শোকেসে তাজমহল, গীতা রহস্য এবং ব্ল্যাক লেবেল বোতল। ঝিকিমিকি কাচের গেলাস। বলল—শোন, বিয়ে একটা করতে হয়, মা-বাবার চাপ আছে। তোমার বোনটা সুন্দরী। তাছাড়া ঘটনাটা তো জানি। ভেরি স্যাড। তোমার বাবার সঙ্গে কথা বল। তোমার বোন তো নয়। দিদি। বয়স তো হয়েছে। ফেলে রেখেছ। রাস্তায় মাংস পড়ে থাকলে শিয়াল কুকুর টানাহিচড়া করে। আমি যদি ওকে…ও কিন্তু উদ্ধার হয়। তোমারে ফ্যামিলিটাও বাঁচে। আর শুনো, তোমাদের বাবা খুব ব্লান্ডার করেছে। সাদা কাগজে সই করে রেখেছে। যা হোক, ওটা এখন আমার কাছেই আছে। সে যাক। তোমার বুন যে আমার কাছে ভালোই থাকবে, সেটা হয়তো বলার দরকার নেই।
চানু তো সবই জানে। ও নব আনন্দে জেগে ওঠা গুরুপদর এখনকার ক্ষমতাও জানে। ও কর্তব্যকর্ম ঠিক করে। রাজি করাতে হবে দিদিকে। না হলে আবার রেপ।
হরিপদ একজন ছোটখাটো সাদাসিধে লোক। কথাটা শুনেই তেড়ে উঠল।…তার আগে কেরোসিন ঢেলে পোড়া।
সুলতা প্রেসার কুকারের সিটির মতো চিৎকার করে বলল—রাজি…আমি রাজি…আমিও পুড়ে যেতে রাজি আছি রে ভাই…।
আর মা বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁপতে লাগল। এবারে সেই তারসানাইটা বেজে ওঠে। পথের পাঁচালি সিনেমায় সর্বজয়ার কান্নার পিছনে যেমন বেজেছিল।
সেই শব্দের ভিতরেই যেন মাদল বাজন—ওখানে যাব না।
___