ভেজা বারুদ – ৭

টিপ টিপ বৃষ্টি। গতকাল থেকেই। খিচুড়ি হবে।

খিচুড়িতে ঝামেলা কম, রেখা খিচুড়ি বানাতেই চায়, তরকারি লাগে না সঙ্গে। মাছটাছও লাগে না। হরিপদ ভাবছে আজ মাছ ভাজা আর ইলিশ হলে বেশ হয়। এদিকে সমুদ্রের মাছ পাওয়া যায়। আমোদি মাছ, দামটা কম। ইলিশ নেবে নাকি—ইলিশ? একটা ছোটমোটো—সাড়ে তিনশো-চারশো গ্রামের …সামনে দাঁড়াল দুটো ছেলে। একজন সোজা ঘুষি চালাল মুখে। একটা দাঁত নড়ছিল, ওটা জিভের উপর পড়ল। আর একজন হাত ধরে টানল, টেনে নিয়ে গেল একটা টালির চালের ঘরে। ঘরের উপর পতাকা উড়ছিল। ঘরের ভিতরে ঢোকাল। ঘরের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ তাকিয়ে আছেন। শুয়োরের বাচ্চা—থানায় রিপোর্ট? কিট্টুর নাম, ভোলা, পুচাই—এদের সবার নাম—বাপের নাম কে বলে দিল তোকে—শালা ব্যাঁকার চামচে। তোর বাড়ি গিয়ে তোর মেয়েকে রেপ করিয়ে দেব…। দু-হাত নাড়ল হরিপদ। ওর শরীরে সমস্ত শক্তি উজাড় করে বলল—না-না-না। আমি থানায় যাইনি, মায়ের দিব্যি, মা কালীর দিব্যি। হরিপদ ভাবল কালীর দিব্যি যথেষ্ট নয়। ও বলল, মা-মাটি-মানুষের দিব্যি। আমি কিছু বলিনি। সাহাবাবু এসেছিল, আমায় বলেছিল থানায় জানাতে। আমি বলেছিলাম না, আমারই দোষ, আমি বটের ডাল ভেঙেছিলাম, ওদের ইট ভেঙেছিলাম, আমারই অন্যায়, কিট্টুবাবুর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলাম। ওরা জোর করে আমাকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করে নিয়েছিল। না সই করলে ওরা মারত।

—নে, তা হলে কাগজ দিচ্ছি, লেখ—ব্যাঁকা সাহা, নন্দ, গুলে, গুঁই এবং আরও কয়েকজন অচেনা লোক আমাকে মেশিন ঠেকিয়ে সাদা কাগজে সই করে নিয়ে গিয়েছিল। থানা থেকে হুমকি দিয়েছিল, ওরা এই কাজ দেখিয়ে পয়দা খেতে চায়। আরে ওই থানাকে আমরা পকেটে পুরে রাখতে পারি। এক ফোনে বড়বাবু বদলি করে দেবার ক্ষমতা রাখি। দুটো তুড়ি মেরে দিলে ছ-জন এসে তোর মেয়েকে রেপ করে চলে যেতে পারে। জেনে রাখ কাকু। শালা দেখে মনে হয় ভোলেভালা—শালা কিচ্ছু জানে না। তোর ব্যাঁকা সাহা কি তোর মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে শালা। আর তোর ব্যাঁকা সাহাকে বলে দিবি আমাদের পিছনে যেন না লাগে। ব্যাঁকা সাহা কি ভেবেছে ওর পিয়ারিরাম ওকে বাঁচাবে? জেনে রাখ, ওর হয়ে গেছে, ওর যে খুঁটি ছিল মাখন পাত্র, সে এখন জেলে। ও কিছু করতে পারবে না। ছটা ছেলেকে ঢুকিয়ে দেব ঘরে, কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। লেখ, যা বলছি লেখ…।

একটা খাতা ধরিয়ে দেয়। খাতার উপর মলাটে কতগুলি জন্তু-জানোয়ারের ছবি। লেখা—অ্যানিম্যাল কিংডম। খাতা খুলে একটা সাদা পাতা বের করে। হরিপদর সামনে ধূসর শূন্যতা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। একটা বিধবার থান কাপড় চোখের সামনে। কাগজের উপর একফোঁটা জল পড়ল। হাতের চেটোতে মুছে নিল চোখ।

লেখ, নকশা করতে হবে না, যা বলছি লেখ…। হরিপদর হাতের কলম কাঁপছে। একটি ছেলে বলল—লিখতে হবে না কাকু। একটা সই করে দিন—যা লেখার লিখে নেব পরে। হরিপদ সই করে দেয় শূন্য কাগজে।

একটা ছেলে বলল—এটা রইল আমাদের কাছে। ব্যাঁকার কাছে কি টাকা বাকি আছে কিছু? ফুল পেমেন্ট হয়ে গেছে?

হরিপদ বলে না, ও কিছু পায় না।

তা হলে রংয়ে থাকুন। ওকে কোনও পাত্তা দেবেন না। পিয়ারিরামবাবু আপনাকে এটা গছিয়েছে, আমরা জানি, আরে, বরানগরের মতো জায়গায়ও প্রোমোটিং করছে, হিসেব মতো ওখানেই আপনার একটা ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা, আপনাকে টুপি পরিয়ে একটা বাজে ফ্ল্যাট দিয়েছে, তাও আবার নাকি ক্যাশও দিতে হয়েছে আপনাকে। সব খবর আছে। হরিপদ মাথা চুলকে, আমতা-আমতা করে বলে—যেটা বলছেন, তার দুটো লাইন যদি বাদ দেওয়া যায়…।

কোন দুটো লাইন!

ওই যে, পিস্তল ঠেকানোর ব্যাপারটা, আর আমার মেয়েকে ইয়ে করার ব্যাপারটা…ওগুলো তো ওরা করেনি স্যার, মিথ্যে কথাটা লিখলে পুলিশ যদি আবার…। তা ছাড়া সাহাবাবুর লোকেরা যদি আমাকে আবার…। বলি কি, এসব বাদ দেন। কিট্টুবাবুও বাড়িটাড়ির লাইনে আছে, সাহাবাবুও আছেন। আপনারা মিলেমিশে উন্নয়নের কাজ করুন না…।

দুজনই হেসে উঠল ওরা। জ্ঞান দিচ্ছে মাইরি।

হরিপদ বলল—সরি সরি।

একজন বলল—যান। গুরুদা আপনাদের ফামিলির পাশে আছে বলে আমরাও আপনার পাশে আছি। সাবধানে থাকবেন। একটা মেয়ে আছে ঘরে, বিয়ে হয়নি, তাও আবার দেখতে হেবি। বলে রাখলাম—ব্যাঁকা সাহাকে ঘরে ঢুকতে দেবেন না। ওর কিন্তু আপনার মেয়ের প্রতি বুরা নজর আছে। কিছু সুবিধে-অসুবিধে হলে বলবেন। জানবেন পাশে আছি। যান। হরিপদ এগিয়ে চলে। কিট্টুরা ওর পাশে আছে। বিমলদা তুমি এগিয়ে চল, আমরা তোমার পাশে আছি—প্ল্যাকার্ডটা দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে গুরুপদ কর্মকারের ছোট ছবি। সৌজন্যে কিট্টুরা সব। ওখানে একটা অদৃশ্য নাম হরিপদরও। হরিপদর পাশে আছে কিট্টুরা। হরিপদ বুঝে গেছে দুটো দল আছে। ব্যাঁকা সাহার, আর গুরুপদর। হরিপদর উচিত গুরুপদর সঙ্গে থাকা। চানুকে কাজ দিয়েছে গুরুপদ। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে একটা গোটা কাতলা মাছ কিনে এনেছিল, আর আটখানা বড় সাইজের রসগোল্লা। হরিপদ বুঝতে পারে—ওর হল মারীচের দশা। রামে মারলেও মরবে, রাবণ মারলেও মরবে। যে কোনও একজনের হাতে মরতেই হত মারীচকে। মারীচ রামের হাতে মরাটাই বেছে নিয়েছিল। ও গুরুপদর নুন খেয়েছে। কিট্টু মানে গুরুপদই তো। আর একটা প্ল্যাকার্ড দেখল হরিপদ। ওখানেও বিমল নন্দীর ছবি। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে বিমল নন্দী স্বাগত। এবার ছোট করে ব্যাঁকা সাহার ছবি এবং সৌজন্যে অনেকগুলি নাম।

হরিপদ বুঝল বিমল নন্দী হল গুরুপদ এবং ব্যাঁকা দুজনেরই নেতা। এরা দুজনই কর্মযজ্ঞ করতে চায়। কিন্তু তা নিয়ে দুজনের ঝগড়া।

এবার আর একটা পোস্টার দেখতে পেল—প্রস্তাবিত ফুডপার্কে স্থানীয় বেকারদের চাকরির দাবিতে বারোই জুলাইয়ের জনসভায় দলে দলে যোগ দিন। বক্তা সমবায় মন্ত্রী মাননীয় গোলাম কুদ্দুস এবং জেলা সভাপতি বিমল নন্দী, মাননীয় ব্লক সভাপতি তমাল দে। গৌরবময় উপস্থিতি মাননীয় ব্যাঁকা সাহা, গুরুপদ কর্মকার, বউ কথা কও খ্যাত অভিনেত্রী বৃষ্টি।

ব্যাপারটা গুলিয়ে যায় হরিপদর। গুরুপদ এবং ব্যাঁকা সাহা দুজন আলাদাভাবে স্বাগতম করছে বিমল নন্দীকে, অথচ দুজনই ওর মিটিংয়ে থাকছে। গৌরবময় উপস্থিতি।

একদম খবরটবর রাখে না হরিপদ। রবিবার ছাড়া ছুটি নেই। সেদিনই একটু বাজার-টাজার-মুদি-মশলা করে। গত দুটো বাজার তো চানুই করল। এলাকায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে কোনও খবরই রাখে না। ফুডপার্ক হচ্ছে? কোথায়? পার্ক তো জানে। ওদের গদিঘরের কাছেই তো সত্যনারায়ণ পার্ক। ওখানে বেঞ্চি থাকে, দুব্বো ঘাস থাকে, দোলনা থাকে। ফুডপার্কে কী থাকে? ফুড? পার্কের বাইরে তো ফুচকাওলা থাকে। ফুডপার্কের ভিতরেও বুঝি নানারকমের খাবার-দাবার থাকবে? চাউ, রোল, শিঙাড়া, গজা, পান্তুয়া…এত কে খাবে এখানে রোজ রোজ? মেলাটেলা হলে নয় আলাদা কথা।

বাড়ি ফিরল শূন্য ব্যাগে। আজকের ঘটনা ছেলেকে বলে কাজ নেই। ও আবার গুরুপদবাবুকে বলবে, গুরুপদ আবার হয়তো কিট্টুদের কিছু বলবে, তাতে আবার কিট্টু রেগে যাবে…। কী দরকার! হরিপদ একজন শান্তিপ্রিয় লোক। কিট্টুর সঙ্গে তো মিটমাট হয়েই গেছে। কিট্টুর ছেলেরা তুই-তোকারি করছিল, আজই তো আপনি করে বলল। বলল তো পাশে আছি। কিন্তু বাজার হল না কেন! তার কী উত্তর! টাকা নিতে ভুলে গেছি বলা যাবে না। রেখাই তো দুশো টাকা দিল। তাহলে হারিয়ে গেছে। পড়ে গেছে বাজারে। ডিম, আলু কিনে নিল বেশি করে।

চানু বেরোচ্ছিল, ওর রবিবার ছুটি নেই, বরং বেশি কাজ। ওকে জিজ্ঞাসা করল ফুডপার্ক কীরে চানু? চানু বলল—জানো না? জ্যাম, জেলির কারখানা হবে এখানে, ফলের রস, আলুর চিপস…। কী এক সুরানা নামে একজন তিন বিঘে জমি কিনেছে, ওর আরও দু-বিঘে জমি চাই। জমির দাম বেড়ে গেছে, এক দালাল বলছে আমাকে দাও, অন্য কেউ বলছে আমাকে দাও। এখন আর কেউ একা একা দালালি করতে পারে না। আমার কাজ বেড়ে গেছে। তুমি কিছু খবর রাখ না।

চানুর কথাবার্তা শুনে ভালো লাগে আজকাল। আগের মতো আর গুম মেরে থাকে না। উন্নতি হয়েছে। উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে। যা হোক কিছু করে খাবে। মেয়েটার জন্যই চিন্তা।

ক’টা দিন বেশ খাটনি গেল চানুর। মিটিংয়ের গেস্টদের ফুড প্যাকেটের ভার ছিল গুরুপদবাবুর। সত্যনারায়ণ থেকে প্যাকেট আনা…অন্য কাউকে দেওয়া যেত, কিন্তু প্যাকেট ঝেঁপে দেবে। মধ্যমগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি থেকে খাবার জলের ট্যাংকি আনানো, ফ্লেকস, হোর্ডিংয়ের ডিজাইন, বানানটা দেখা…। এই এলাকাটা পঞ্চায়েতের ভিতরেই পড়েছে। আগামী ইলেকশনে গ্রাম পঞ্চায়েত নয়, একদম জেলা পরিষদের জন্য নমিনেশন পেতে পারে গুরুপদ। পার্টিতে খুব হোল্ড হয়েছে।

মিটিংয়ে অনেক নেতা-নেত্রী এসেছিল। যখন নেতারা বক্তৃতা করেছে, মঞ্চে উপস্থিত মাননীয় অমুক পঞ্চায়েত প্রধান, তমুক জেলা পরিষদের সভাপতি, অমুক ব্লকের তমুক, অমুক স্কুলের মাননীয় প্রধান শিক্ষক…এইসব বলতেই তিন-চার মিনিট লেগে যায়।

মিটিংটা ফুড পার্কের উদ্বোধনের ব্যাপারে নয়, ও সব তো অনেক পরের কথা। মিটিং তো নয়, জনসভা। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে শামিল হবার আহ্বান। মঞ্চে গুরুপদ কর্মকার এবং ব্যাঁকা সাহাও উপস্থিত ছিলেন। ওরাও সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। বিমল নন্দী বললেন—পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে জোয়ার হয়েছে। এখানে একটা ফুডপার্ক তৈরি হতে চলেছে। এরপর আরও শিল্প হবে। সরকার কারওর জমি কেড়ে নেবে না, উন্নয়নের স্বার্থে উদ্যোগপতিদের জমি দিন, ওরা দাম দেবেন। এলাকার মানুষদের চাকরি হবে, চাকরিটাই বড় নয়, অনেক ছোটখাট ব্যবসার সুযোগ তৈরি হবে। লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন পড়েছে। কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয় উঠ গো ভারতলক্ষ্মী। সেই লক্ষ্মী পশ্চিমবাংলা থেকে উদিত হবে কারণ বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন স্বয়ং লক্ষ্মী। কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে। নিজেদের সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি ঝেড়ে ফেলুন। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো। কবিগুরু গেয়েছিলেন প্রেমের জোয়ারে ভাসাবো দোঁহারে বাঁধন খুলে দাও দাও দাও। কোরোনা ভাবনা পিছনে চাব না পাল তুলে দাও। একটু পালটে বলি—উন্নয়নের জোয়ারে ভাসাবো দোঁহারে পাল তুলে দাও। ‘দোঁহারে’ বলার সময় বিমলবাবু একবার গুরুপদর দিকে, একবার ব্যাঁকা সাহার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চানু বুঝতে পেরেছিল দুজনের ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে বলছেন। নেতারা বলেন না, আহ্বান করেন। চানু জানে ওরা দুজনই বিমল নন্দীকে খুশি রাখেন। ব্যাঁকা সাহার কলকাতায় একটা বড় খুঁটি ছিল রামপিয়ারি। আবার রামপিয়ারির খুঁটি ছিল মাখন পাত্র। মাখন পাত্র পাকেচক্রে জেলে। ফলে রামপিয়ারির খুঁটিতে এখন জোর নেই। ব্যাঁকা সাহা অন্য একটা খুঁটি খুঁজছে। বিমল নন্দী এখন ভালো খুঁটি। বড় ছাতা। এলাকার এমএলএ ওর খুব কাছের লোক। দুজন মন্ত্রীর সঙ্গেও ওর খুব দহরম মহরম। এসব এখন বেশ বুঝতে পারে চানু। কলেজে রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কিছু ছেলে বলত দুনিয়ার মজদুর এক হও। কাঁচরাপাড়ার রেলের সরকারি কর্মচারী মজদুর, বছরে দুবার ডি এ বাড়ে সে কি রাস্তার কন্ট্রাক্টারের মজদুরের সঙ্গে এক হবে? বুঝত না, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বলিভিয়া থেকে হাত উঠাও বলে কেন চেঁচাত কজন। ওসব মাথায় ঢুকত না। এখন বুঝতে পারে গুরুপদ কর্মকারের খুব বুদ্ধি কিন্তু ব্যাঁকা সাহার টাকা বেশি। ব্যাঁকা সাহা বেশিদিন ধরে এই কাজ করছে। প্রোমোটিং লাইনে ওর অভিজ্ঞতা বেশি। ‘ই’ সিরিজের ফ্ল্যাটগুলো ছাড়াও সোদপুরে একটা বড় শপিং মল করেছিল বামফ্রন্টের আমলে। রামপিয়ারি তখন লাল ছিল, ব্যাঁকা সাহাও। পিয়ারি সবুজ হলে ব্যাঁকাও সবুজ। ব্যাঁকা ব্যবসা করতে নেমেছিল আগে। গুরুপদ পরে ঢুকেছে। গুরুপদ ছোট থেকে বড় হয়েছে, প্রথমে সাপ্লাই করত, পরে সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটটা ছোট ভাই চালায়। ব্যাঁকা স্থানীয় লোক নয়, মূলত সোদপুর অঞ্চলের। সোদপুর, খড়দা অঞ্চলেই ওর প্রতিপত্তি বেশি। এদিকেও প্রভাব প্রতিপত্তি খারাপ ছিল না। কিন্তু ওর লোকজন বেশিরভাগ এখন গুরুপদর দিকেই চলে গেছে। এটাও চানু বোঝে লোকজন হল কাক। যেখানে ছড়ানো ভাত, সেখানে গিয়েই কা-কা। গুরুপদর কাছে নতুন কাকেরা আসছে। চানু, মানে চন্দন চক্রবর্তীও একটা কাক।

কিন্তু কাকের সংখ্যা কতই বা। এলাকাটা তো নতুন করে গড়ে উঠছে। পনেরো-কুড়ি বছর আগেও তো গ্রামই ছিল। চাষ হত, তেশিরা ঘাস হত। নফরগঞ্জ, জিরাট, বদনাপুর—এসব এলাকায় ছোট ছোট জনবসতি। একটা ডেয়ারি হল বিশ বছর আগে। রাস্তা চওড়া হল, বাস চলাচল শুরু হল, ব্যাংকের কর্মচারীরা কো-অপারেটিভ করে বাড়ি বানাল, মধ্যমগ্রাম আর সোদপুরের রেললাইনের উপর ফ্লাইওভার হল, এদিকে চলে এল ব্যাঁকা সাহা, ভীম ঘোষরা। অটো চলাচল শুরু হয়ে গেল, দুটো ঝিল বুজে গেল, প্ট করে বিক্রি হতে লাগল। এবার ঘরবাড়ি উঠছে, সমাজবন্ধুরা তৈরি হয়েছে, যারা বাড়ি করছে, ইটবালি কোনও না কোনও সমাজবন্ধুদের কাছ থেকেই নিতে হবে। কাকেরা এভাবেই জড়ো হয়েছে। এলাকার জোয়ান ছেলেগুলো, যারা জমি বেচে দিয়েছে, যাদের বাবারা চাষ করত, হাঁস-মুরগি গোরু পুষত, যাদের ছেলেপুলেরা চাকরি-বাকরি পায়নি, তারাই কাক হয়েছে। যারা বাইরে থেকে এসেছে, তারাও কেউ কেউ কাক যেমন চানু। পাপিয়াও আসলে একটা কাক। বাইরের কাক। সোদপুর থেকে মধ্যমগ্রাম।

এই মূল রাস্তা থেকে দু-ধারে শিরা-উপশিরার মতো রাস্তা চলে গেছে দু-ধারের একদা গ্রামগুলিতে। ছোট ছোট পুকুর মজে যায়, হাঁসের পালক মাটি চাপা পড়ে। আয় আয় আয় চই-চই…হাঁস ফেরানোর এই ডাক হারানো পুরানো। দু-একটা ভাট আশ-শ্যাওড়ার বন বুড়ি ডাইনির মতো বসে আছে শুধু, মেঠো পথে পিচ, সেখানে বাণিজ্যবায়ু ঢোকে। বিউটি পার্লার, বার্গার, মধুচক্র। এই পুরো পথ জুড়ে এক একটা নফরগঞ্জ, জিরাট, বদনাপুরে উন্নয়ন চলছে এবং কাক ডাকছে। মূল শহর থেকে তাড়িত মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে যেমন, ধনী মানুষ আরও ধনী হবে বলে ফ্ল্যাট কিনে রাখছে, তাই নির্মাণ শিল্প। তাই এলাকা দখল। এলাকা ভাগ একটা অলিখিত চুক্তি। চুক্তিভঙ্গ প্রায়শই হয়। জীবজগতেও এলাকা ভাগ আছে। কুকুরদের নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগের নিয়ম আছে, আর বেনিয়ম তো নিয়মের মধ্যেই নিহিত থাকে। পুরুষ বাঘেরা নিজেদের শরীর থেকে ফেরোমন বার করে, ফেরোমন নিঃসরণ করে জঙ্গলের বৃক্ষলতায় লেপে রাখে, ফেরোমন গন্ধে জানায় এলাকা আমার। মানুষ-বাঘেদের ফেরোমন নেই, বোমা আছে। বোমার চিৎকৃত শব্দে জানিয়ে দেয় এলাকা আমার। সমাজবন্ধুরা বোমা বানায়, বোমা কেনে, ঐশ্বর্যের মতো রেখে দেয় অন্দরে, অন্তরে। মাঝে মাঝে বোমা ফাটে, জিন্দাবাদ ধ্বনি হয়, ছায়াপিণ্ড মানুষেরা চাউ খায়, ম্যাগি খায়, নিজেদের মধ্যে আধোস্বরে বলে কী যে হচ্ছে এবং যা হচ্ছে সেটাকেই ভবিতব্য মেনে নেয়।

চানুর চোখে এখন চশমা। নীল চশমা, চশমার চোখ দিয়ে মাটি ফুঁড়ে তবু উঠে যাওয়া দু-চার ডগা কাশফুল নীল। দু-একটা ভেতরে থাকা লাল রক্ত পতাকা কালো। এখনও টিকে থাকা দু-চারটে পুকুরের রৌদ্র ঝিলমিলের তলায় দেখে গুপ্তপথ। গুপ্তপথের দরজাটা খুলছে আস্তে আস্তে।

চানুকে বস বলেছে আমার সঙ্গে লেগে থাক, কাজ শেখ তোর ভবিষ্যৎ গড়ে দেব। খালি একটা কাজ কর, একটা, যে পয়সাকামাবি, সেই পয়সা ডিম দেবে, ছানা পোনা দেবে। গুরুপদ ওকে এখন তুই ডাকে। তুই তো আদরের ডাক। নিজের করে নেওয়া। গুরুপদ বলেছে এই যে ফুডপার্ক হবে কিংবা ছাতামাথা কী হবে দরকার নাই। কনস্ট্রাকশন হবে, ওইটা আমার চাই। আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া নাই।

এইসব মনের কথা, নিজের অন্তরের কথা বলে বস। বলে জীবনটা নতুন করে শুরু করতে ইচ্ছা হয়। কিছু টাকা হলে হোটেল করবে গুরুপদ। ছেলেকে সুইজারল্যান্ড পাঠাবে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়াতে। বলেছে, আসল সুখ হল ক্ষমতায়। পুলিশ কমিশনার স্যার ডাকবে, চিফ সেক্রেটারিকে ফোন করে বলে দেবে গোরুমারা ফরেস্টে একটা ঘর চাই। সুপারিশ করবে অমুককে একটা রবীন্দ্র পুরস্কার দাও। বলেছে—সবারই হাই অ্যাম্বিশন থাকা ভালো।

পুলিশ কমিশনার স্যালুট ঠোকার অ্যাম্বিশন যদি না থাকে, অন্ততপক্ষে এসপি তো ঠুকবে। যদি বিদ্যা বালান অ্যাম্বিশনে থাকে, তবে অন্তত মিমি-টিমি তো হবে। হে-হে-হে। চানুও হে-হে করে না হোক, হালকা হেসেছে। মুম্বাচুম্বাতে পাপিয়াকেই রেখেছে জিকে। চার-পাঁচটা মেয়ে এসেছিল। ফাইনাল যে দিন হল, সিলেকশন কমিটিতে তিনজন ছিল, কিট্টু, বস নিজে, আর চানু। চানুকে এতটাই প্রেস্টিজ দিয়েছিল বস। বলেছিল তোমরা ইয়াং শিক্ষিত। তোমার চোখ আমার চোখ আলাদা। তোমাদের জেনারেশনের জন্যই মুম্বাচুম্বা। চানু বলেছিল—আমার তো স্যার অভ্যাস নেই এ লাইনে…।

বস বলেছিল অভ্যাস হতে কতক্ষণ। এই এরিয়ায় কি খুব একটা এইসব অভ্যাস আছে নাকি। বাতাস ঢুকতাছে, দরজা খুইল্যা দিলাম। আমারই প্রথম ডান্স বার।

কিট্টু বলেছে—তোমার বাবার সঙ্গে একটু উলটাসিধা হয়ে গেছিল—এখন ওনার মনে রাগ নেই তো?

চানু বলেছে না, ওসব পাস্ট।

চারটে মেয়ে ছিল। পাপিয়াকেই ভালো লেগেছিল। ওকে কিট্টু জিজ্ঞাসা করেছিল কী কী নাচ জানা আছে? পাইস হোটেলে গিয়ে কী কী পদ আছে জিজ্ঞাসার উত্তর যেমন হয় তেমন করেই মেয়েটা বলল—চা-চা-পোলচা—বেলি-হিপহপ—হুলা হুলা-ব্রেক-সালসা…ডিস্কো তো আছেই। কত্থকও জানি। চানু আজ পর্যন্ত কোথাও ইন্টারভিউ পায়নি, কিন্তু ও আজ ইন্টারভিউ নিচ্ছে। ও বলেই ফেলল—একটু হিপহপ হয়ে যাক এখানে দেখি কেমন নাচো…। বলেই নিজের উপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায় ওর। নাচার ব্যাপারটা কিট্টুর আগেই বলে দিতে পেরেছে চানু।

মেয়েটা ভ্রূ ভঙ্গি করে বলল—এটুকু জায়গায় হিপহপ হয় নাকি? চানু বলল—ছোট জায়গায় কী হয় তবে? ও বলল—কত্থক হয়। নাচি?

মেয়েটা নাচতে লাগল। পায়ে ঘুঙুর ছিল না, চানুর বুকে ছিল। কত্থক, পায়ের শব্দ, বুক কাঁপে। কিট্টুর কানের কাছে মুখ দিয়ে বস কিছু বলল। কিট্টু সায় দিল। বস আর কিট্টু দু-জনেই মেয়েটার বুকের কাঁপন দেখছে। নাচের তালে…অঙ্গ দোলে…খুশিতে ভরে যে মন…থাকবি কতক্ষণ আর থাকবি কতক্ষণ। নাচছে পাপিয়া। আহা নাচে নাচে। বেহুলাও নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়। নাচ শেষ করে পাপিয়া। চানু কত স্মার্ট হয়েছে? বস বলে থ্যাংকিউ।

একেই রেখে দি? চানুর দিকে তাকিয়ে গুরুপদ বলেছিল। চানু বলেছিল ইয়েস ইয়েস।

এখন রমরম করে চলছে মুম্বাচুম্বা। ওখানে রোজ নাচে মিস পাপিয়া। খালি মধ্যমগ্রাম, সোদপুর, নিউ ব্যারাকপুর নয়, বারাসাত-অশোকনগর, হাবড়া থেকেও লোকজন আসে। চানুও দু-তিনদিন গেছে। কিট্টু তো প্রায়ই যায়। কিট্টুও একটু-আধটু নাচে ওর সঙ্গে। গান বাজে—তু মেরি হার্ট বিট হ্যায়, তু সুপা ডুপা হিট হ্যায়। তোর চিকন চিকন গাল, তোরে রাগলে লাগে ঝাল। তুই ফিরা তাকাস, তোরে লাগে ঝক্কাস। তুই পদ্মা নদীর ইলিশ খাইয়া রূপটা দেখি ঝকঝকে বানাস।

ব্যাঁকা সাহাও দলবল নিয়ে মুম্বাচুম্বায় আসে। গুরুপদই ওকে নিমন্ত্রণ করেছিল। দোতলায় একটা ঘর আছে। গুরুপদর নিজের প্রাইভেট ঘর। ওই ঘরে ওরা দুজন কথা বলেছিল। ওই ঘরে রেস্ট্রিকশন আছে। ওই ঘরে একদিনই গিয়েছিল চানু, ডেকেছিল বলে। ওখানে চানুকে জিজ্ঞাসা করেছিল—পাপিয়ারে তোর লাগে কেমন?

চানু একটু মুশকিলে পড়েছিল। চানু বোঝে বস একটু পাপিয়ার দিকে হেলে আছে। বসের চামচা কিট্টুও। বেশি ভালো লাগা বললে কেস খেয়ে যাবে না তো? চানু বলল—বেশ তো, ভালোই তো নাচে, মোটামুটি।

বস বলল—ঠিক বলেছ। মোটামুটি। সুন্দরী হল তোমার দিদি। রিশেপসনে বসবে নাকি সে? দোতলাটা বানাব। বার আর ডান্স ফ্লোর দোতলায় নিয়ে যাব। একতলাটায় শুধু রেস্টুরেন্ট থাকবে। গেরস্তরা আসবে। খাবে-দাবে চলে যাবে। তোমার দিদিকে একতলায় বসাব। কিচ্ছু না, একজন ম্যানেজার তো থাকবেই, বিলপত্র সেই করবে। ও শুধু কাউন্টার আলো করে বসে থাকবে। সন্ধ্যা ছটা থেকে দশটা।

বাড়িতে বলেছিল চানু। চানুর বাবা বলেছিল মন্দ কী। মা বলেছিল কী করে একথা বলিস চানু, মদ আর মদ্দাদের মধ্যে বসবে আমাদের মেয়ে? ক-মাসে তোর কী পরিবর্তন হয়ে গেল, অ্যাঁ।

হরিপদ বলেছিল, তুমি আগে থেকেই বাগড়া দিচ্ছ কেন? মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে দেখ ওর মত আছে কিনা…।

সুলতাকে জিজ্ঞাসা করার আগেই সুলতা মাথা নাড়িয়ে বলেছিল—আমি যাব না। এই দিদিটাই ‘হেডএক’ একটা। খালি খাবে আর ঘুমোবে। কোনও অ্যাম্বিশন নেই, চাকরি-বাকরি করার কোনওরকম চেষ্টা-চিন্তা-ভাবনা নেই। বয়সটাও হচ্ছে। বিয়েটিয়ে না হলে ওর ঘাড়েই ঝুলবে। ঝুলতে দেবে না চানু। চানু নিজেকে দেখবে। চোখ খুলে গেছে ওর। চোখের সামনে তো দেখতে পেল তিন-চার বছরে কত টাকা কামিয়ে নেওয়া যায়। এই তো, সামনেই পনেরোই আগস্ট প্রতিজ্ঞা পালন হবে, দেশের কথা ভাবব, দেশের কাজ করব, মনীষীদের পূজব, জ্ঞানের বাণী খুঁজব। এইসব কাজের জন্য অন্য লোকজন আছে। চানু ব্যাপারটা জানে কারণ খাবারের প্যাকেট সাপ্লাইটা কিট্টু করবে। এলাকার সব স্কুলের বালক-বালিকারা কারবালার মাঠে আসবে, বিমল নন্দী আসবেন, আরও কয়েকজন নেতা আসবে। দু-হাজার প্যাকেটের অর্ডার কিন্তু সাপ্লাই হবে ছশো। কারবালা মাঠের কাছে সকালবেলা দু-চারটে ফস্কা বোমা ছোড়া হবে। ফস্কায় ধোঁয়া বেশি আওয়াজও। লোকে ভাববে গণ্ডগোল। বাচ্চারা আসবে কম। পনেরো-বিশ হাজার টাকা কামাই কোনও ব্যাপার নয়। এভাবে যে কামাই হয়—এটা সবাই জানে, পার্টির দাদারা জানে। পাবলিকও জানে। পাবলিক কিছু মনে করে না। মনে করলে ভোটে জিতত নাকি? চানু বোঝে ওর একটা নবজন্ম হচ্ছে। কত কী শেখার…।

পনেরোই আগস্ট সকাল থেকে বেশ গরম। বস ফোন করল। চানু এক্ষুনি আয়। অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। তোর বউদি ভুল করে অ্যাসিড খেয়ে ফেলেছে।

ছুটল চানু। সাইকেলে। ওর বাইক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে।

বাড়িতে আরও সব। কিট্টু আসতে পারেনি। ওর প্রতিজ্ঞা দিবসের জরুরি কাজ।

অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। মাননীয় সাংসদের অর্থসাহায্যে এই অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে সেটা লেখা আছে। উপরে গিয়ে দেখল বউদি ছটফট করছে মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। চানু দেখল মেঝেতে একটু বমিও পড়ে আছে।

কখন হল? কী করে হল? চানুর গলায় উদ্বেগ।

আরে, কী বরাত আমার, কপাল চাপড়াল গুরুপদ। মিনারেল ওয়াটার মনে করে ঢকঢক করে অ্যাসিড ঢাইলা দিল গলায়। এদিকে জলে শুনি আর্সেনিক আছে। মিনারেল জল কিনি বিশ লিটারের। জল শেষ। বোতল আনাইলাম কয়েকটা। একটা অ্যাসিডের বোতলও আনাইলাম। সবই যদি ফ্রিজে রাখে সেটা কার দোষ? ওর জল তেষ্টা পাইল, ফ্রিজ খুইলাই ঢকঢক গলায়। আজ ল্যাজ উল্টাইয়া দেখ মদ্দা না মাদি। সঙ্গে সঙ্গে তো গলায় আঙুল দিয়া বমি করাইলাম। যাক গিয়া, আমার বরাত। নার্সিংহোমে চল।

চানু দেখল, বউদির ঠোঁটের চামড়া ঝুলে পড়েছে। কখনও ছটফট করছে, কখনও স্থির। ঠোঁট নড়ছে। দুবার ‘সুখে থাক’ শুনতে পেল যেন চানু।

হাসপাতাল নয়, নার্সিংহোমেই নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে পেট ওয়াশ করা হল। ডাক্তার বলল—অনেকটা পেটে গেছে। স্টমাক ফুটো হয়ে গেছে মনে হয়। রক্ত আসছে। কলকাতায় বড় হাসপাতালে নিয়ে যান। পিজি বা অ্যাপোলো…।

গুরুপদ মোবাইলটা বের করে একটু দূরে গেল। কাউকে ফোন করল। তারপর নার্সিংহোমের অফিসঘরে গেল। ওই ঘরে আর কেউ গেল না।

চানু ছাড়াও তিন-চারজন আছে। ওরা আলাদা কথাবার্তা বলছে। চানুর এখানে কী ভূমিকা চানু ঠিক বুঝতে পারছে না। চানুকে আসতে বলা হল কেন? বস-এর তো লোকবল কম নেই। তার বেশি কাউকে তো খবরও দেওয়া হয়নি। চানুকে তাহলে বস গুরুত্ব দেয়। হয়তো ভেবেছে—স্টেটমেন্ট দিতে হতে পারে, সেটা চানু ছাড়া কে-ই বা লিখবে।

বিকেলে বউদি মারা গেল। ডেথ সার্টিফিকেটে অ্যাসিড-ট্যাসিডের কোনও ব্যাপার লেখা ছিল না। মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিরাপদ কিছু লেখা হয়েছিল। ডাক্তারটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে মাথা নিচু করে ঠোঁট দাঁতে চেপে চলে গেল। স্বাধীনতা দিবস সামলে কিট্টু দুপুরের পরই চলে এসেছিল। ছেলে জয় বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট ধরে রাত আটটায় পৌঁছাল। তারপর শ্মশান। শ্মশানের ব্যাপারটা কিট্টুরাই সামলে নিল। ব্যাপার বলতে বউদির বাপের বাড়ির কয়েকটা লোক চেঁচামেচি করছিল। বলছিল প্ল্যান করে মারা হয়েছে। বহুদিন ধরেই অত্যাচার করা হত বোনকে, এর আগেও একবার কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিট্টুরা বলেছিল শ্মশানে শান্তি নষ্ট করবেন না। যদি কিছু বলার থাকে থানায় যান। কিট্টুরাই সরিয়ে দিয়েছিল।

চানুর কেমন যেন মনে হচ্ছিল ভিতরে কিছু একটা ব্যাপার আছে। বউদিটা অনেকটা সরল সিধে। যখন বিয়ে করেছিল, ষোলো-সতেরো বছর আগে, তখন তো এত টাকাকড়ি ছিল না। এক কামারের ছেলে ছিল। ওর বাবা সম্বন্ধ করে বিয়েটা দিয়েছিল। এখন এই বউ পছন্দ নয়। নিজেই কি খেয়েছে, নাকি গ্লাসে ঢেলে বলেছে, শরবত খাও। এমন নয় যে তখন বাড়িতে ছিল না গুরুপদ। গুরুপদই তো বলছে ঢকঢক করে গলায় ঢেলে দিল, আর তারপরই চিৎকার। তক্ষুনি কেন হাসপাতালে নিয়ে গেল না? কেন একে তাকে খবর দিল? কেন দেরি করল, কেন ওই নার্সিংহোমেই রেখেছিল? তা ছাড়া এমন সময় অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটল ঠিক ওদের ছেলের পরীক্ষা শেষ হওয়ার দিন। ওর টিকিট কাটাই ছিল। এমনিতেও আসত। দিন-দশেক ছুটিও ছিল। গুরুপদর মা বলেছিল লক্ষ্মী বউমা আমার, এমন দিনে গেল—নাতিটার পড়াশুনার কোনও ক্ষতি হল না।

খবর কাগজে শোকসংবাদ লেখার দায়িত্বটা চানুর ওপরই পড়েছিল। পুরানো খবর কাগজের দুটো শোকসংবাদ দেখে চানুও লিখল—

নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই। সাগরিকা কর্মকার-এর অকাল প্রয়াণ।

শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে হায়।

চলে গেলে নতুন ঠিকানায়।

আত্মাটি থাক শান্তিতে অপার।

পুত্র জয়দীপ, স্বামী গুরুপদ কর্মকার।

এটা দেখে গুরুপদ খুব খুশি। বলেছিল—একসিলেন্ট। তোকে ছাড়া আমার চলবে না। একটা বেশ ভালো কথা আছে না?—যার মানে হল তোরে ছাড়া চলবে না…গুরুপদ বাঁ হাত দিয়ে শব্দ খুঁজছিল হাওয়ায়, চানু বলল অপরিহার্য? গুরুপদ বলল রাইট, রাইট। গুরুপদ চানুর কাঁধে হাত রাখল। বলল যদি ঠাকুরে করে, মন্ত্রী হইতে পারি, তুই হবি আমার সি এ।

চানু চোখ বোজে। এক ঝলকে দেখতে পায় ফোন করে ডি এম-কে বলছে সার্কিট হাউস বুক করুন, ডায়মন্ডহারবারে, চানুর সঙ্গে পাপিয়া। না-না, প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়, এমনি। ট্রাফিক রুল ভাঙল বলে পুলিশ আটকাল, চানু পুলিশকে বলছে—শুয়োরের বাচ্চা, জান না কার গাড়ি, কান ধর…। স্যালুট দিচ্ছে এস. পি. চোখ খুলে ফেলে চানু। এসব স্বপ্ন হল মালগাড়ি।

চলতেই থাকে। এগুলো স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন দোষ। বললেই হল মন্ত্রী হবে? বিমল নন্দী এখনও কিছু হতে পারল না তো গুরুপদ কর্মকার। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। পড়াশুনোটা একদম হচ্ছে না। ম্যাডামের শ্রাদ্ধটা চুকে যাক, তারপর আবার পড়াশুনো শুরু করবে। শ্রাদ্ধর চিঠিটা চানুই বানিয়েছিল। গুরুপদর বাড়ির সামনে সাদা কাপড়ের প্যান্ডেল হল সাউন্ড সিস্টেমে অনুপ জালোটার ভজন আর স্বাগতালক্ষ্মীর স্তোত্রপাঠ বাজতে লাগল। লুচি, ধোঁকা, ছানার ডালনা রান্না হতে লাগল, অনেক নেতা এসেছিল, সমাজবন্ধুর লোকজন, ব্যাঁকা সাহাও নিমন্ত্রিত ছিলেন। উনি এসেছিলেন দু-জনকে সঙ্গে নিয়ে। উনি বেশ খুশিতে ছিলেন, কারণ ওর নেতা মাখন পাত্র জামিন পেয়ে গেছে। উনি বেশ বড়মাপের সাদা মালা নিয়ে এসেছিলেন। শ্রাদ্ধের পর্ব চুকে গেলে দোতলার একটা ঘরে রুদ্ধদ্বার মিটিং হল, মিটিংয়ে ছিলেন বিমল নন্দী, তমাল দে, ব্যাঁকা সাহা এবং গুরুপদ। কী নিয়ে মিটিং চানু বুঝতে পারে কিছুটা। এলাকা ভাগ। ফুডপার্কের পাঁচিলের কোন দিকের জমি কে কিনে রাখবে। কারখানার আরও জমি চাই, কে কোনদিকের জমি বেচবে এইসব। সিগারেট টানতে-টানতে দুজনই নেমে এল। মনে হয়েছিল সেট আপ হয়ে গেছে। সেট আপ হলে আর আপসেট থাকতে নেই।

জয়দীপ চলে গেল হোস্টেলে। গুরুপদ বলল, খুব একা হইয়া গেলাম চানু। ঘরে ভালো লাগে না। ক’দিন কাশী-হরিদ্বার ঘুইরা আসি গিয়া। ছোট বোন-বোনের জামাই বাড়িতে থাকবে, বাপ-মা আছে তো, ভাইও আছে। হোটেলটার একটু খোঁজখবর কইরো। বার চলবে। ডান্স বন্ধ। পাপিয়া দিন কয় ছুটি চাইল।

টিকিটটা চানুকে দিয়ে কাটায়নি। চানু একবার বলল, সঙ্গে কেউ যাবে না। একা যাবেন? গুরুপদ বলল—কারওর দরকার নাই। যখন যেখানে ভালো লাগবে থাকব।

চানুর মনে হল বস হয়তো একা যাবে না। সঙ্গে পাপিয়াও যেতে পারে। দুজনে একই সঙ্গে ছুটি নিল? চানুর কেমন যেন একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *