ভেজা বারুদ – ৫

হরিপদ জানে ওর নাম কিট্টু। রাস্তাঘাটে দেখা হয়েছে, দেখা হলে হরিপদর কেমন যেন একটা হয়। মাথা নিচু করে চলে গেলে নিজেকে বড্ড বেশি ম্যাদামারা মনে হয়। ঝুটঝামেলা চায় না, শান্তিতে থাকতে চায়, ওর কী করা উচিত ঠিক বুঝতে পারে না। ওই রাস্তাটা এড়িয়ে চলারও উপায় নেই। বাজারটা তো ওদিকেই। হাটতলায় এখন আর হাট বসে না, বাজারও নয়। সেই বটগাছটা ছাড়িয়ে বাঁদিকে গেলে বাজার। সেই ঘটনাটি ঘটার দু-তিন দিন পর আওয়াজ শুনেছিল—কী বাপের শ্রাদ্ধ হল? তাকিয়ে দেখেছিল—সে, যে কলার ধরেছিল; ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। হরিপদ কোনও জবাব দেয়নি। ওর কি জবাব দেওয়া উচিত ছিল? কী জবাব দিত? আমার বাবার শ্রাদ্ধ হল কি না হল তাতে আপনার বাবার কী? বলতে পারলে বেশ হত। বাপ তোলার কী দরকার। তাতে আপনার কী বললেও হত। কিন্তু কিছুই বলেনি। মাথা নিচু করেনি যদিও, অন্যদিকে চেয়ে চলে গেল। আর একদিন শুনেছিল—এই যে, ভালো আছেন—কাকা? কোনও জবাব দেয়নি। কপালটা কুঁচকে চোখটা একটু ছোট করে ওর দিকে তাকিয়েছে। ওই কিট্টুর সঙ্গে আরও দুজন ছিল। আজ হল কী, বাজারে একটা মোচা কিনবে ভেবেছিল। মোচাওলা বলল বিচিকলার মোচা। কেনার পর ওর মনে হল কাঁচাকলার মোচা গছিয়ে দিল না তো? দেখে কিছু বোঝা যায় না। ইটের পাঁজাটা মাথা নিচু করে পেরিয়ে গেল। ওর মনে হল ওকে সবাই যে যেমন পারে মুরগি করছে। মোচাওলাও ঠকালো না তো! ও ব্যাগের ভিতর থেকে মোচাটা বের করে লালচে আবরণটা উঠিয়ে ভগবানের গুছিয়ে রাখা, সাজিয়ে রাখা মোচার গুছি থেকে একটা ভেঙে দাঁতে কাটল। জিভে খুব তেতো স্বাদ অনুভব করল। তার মানে ওটা বিচিকলার মোচা নয়, কাঁচাকলার মোচা। এভাবে ঠকবার কোনও মানে হয়? ও ঠকবে না। পালটে আনবে। আবার ফিরল। ইটের পাঁজার সামনে লোকগুলো। আওয়াজ এল—কী কাকা, ভালো আছেন? হরিপদর মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছিল। ও কিছুটা থুথু ফেলল।

অমনি ছেলেটা এগিয়ে এল, এক্কেবারে হরিপদর সামনে।—অ্যাই, ভেবেছেন কী? আমাদের দেখে থুথু ফেলা? দেখলাম গুরুদার চেনা লোক, সেদিনের ঘটনাটা সাইজ করার চেষ্টা করছি, আর আপনি টেটিয়াবাজি করছেন কাকা? আমার সঙ্গে এরকম টেটিয়াবাজি? থুথু ফেলা! সেদিনও একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম, আপনি মুখে একটা কিরিমিরি করেছিলেন, এই যে, আমার নাম কিট্টু, চারটে কেস ঝুলছে, একটা মার্ডার কেস। মুখের জিওগ্রাফি পালটে দেব…।

হরিপদ কোনও কথা না বলে পা বাড়ায়।

—আরে, অ্যাই, কোথায় যাচ্ছিস?—কিট্টু নয়, অন্য একজন বলে। ছেলেটা কিট্টুর চেয়ে অনেক ছোট, ওর চানুর বয়সিই হবে। ছেলেটা হরিপদর জামার পিছনটা মুঠো করে ধরে টেনে নেয়।

রাস্তা থেকে থুতু চাট, চাট থুতু…। ঘিন্না, শালা ঘিন্না? আমাদের ঘিন্না? দেখে থুতু ফেলা? চাট। জিভে, জিভে, নিজের জিভ দিয়ে, উপুড় হয়ে, ঘাড়ে ধাক্কা দেয় কেউ, হাতের ব্যাগ টলমল করে।

হরিপদ বলে—বিশ্বাস করুন, ভাই, বিশ্বাস করুন আমি এমনি থুথু ফেলেছি, আপনাদের দেখে থুথু ফেলব কেন? ছি ছি!

—এমনি? পুরো দেখলাম…আমাদের দিকে তাকিয়ে থুতু। চাট…। একটা হাত ওর গলায়।

হরিপদ এবার হাতজোড় করে ফেলে। ভাই নয়, স্যার, বলে, শুনুন স্যার, আমি বলি কী হয়েছিল, মুখটা তেতো লাগছিল বলে থুথু ফেলেছিলাম। মোচা কিনেছিলাম একটা, ওটা একটু চিবিয়েছিলাম…এবার একটা ধাক্কা খেল হরিপদ। বাজারের থলেটা হাত থেকে পড়ে গেল।

—নকশা? আপনি ছাগল নাকি, কাঁচা মোচা চিবিয়েছিলেন…নকশা…।

—থুতু চাট। এই যে, এইখানে থুতু।

হরিপদ এবার আকাশের দিকে তাকায়। বস্ত্র হরণের সময় দ্রৌপদী যেভাবে তাকিয়েছিল। বুকের ভিতর থেকে বাঁচাও বাঁচাও আর্তস্বর বেরিয়ে আসে, কিন্তু নিঃশব্দ। হে গুরু, পরমগুরু, মহাগুরু, হে গুরুপদ…বাঁচাও, আগের দিনের মতো আমায় বাঁচাও…

ঘটঘট ঘটঘট শব্দ। রথের।

গুরুপদ কর্মকার যেন কৃষ্ণ। পিছনের সিটে চানু। ডাকার মতো ডাকতে পারলে দেবতাও দেখা দেয়—বলে তো।

আবার কী হল?

—এই দেখুন গুরুদা, সেদিন কিছু বলিনি, ইট ভেঙে আইন দেখাচ্ছিল। আপনি বলেছিলেন বলে কি সনমান দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজ কী বলব দাদা, আমাদের দেখে থুতু ফেলল।

—থুতু? —মানে ছ্যাপ?

—হ্যাঁ দাদা, খ্যাক করে থুতু ফেলল আমাদের দিকে তাকিয়ে।

গুরুপদ হরিপদর দিকে তাকাল, বোধহয় সত্যাসত্য যাচাই করে নিতে চাইছে।

চানু সামনে এসেছিল। গুরুপদ চানুর দিকে তাকিয়ে চোখে কিছু ইশারা করল। চোখের ভাষা পড়তে পারল চানু। অল্প ক’দিনেই ভাষা আয়ত্ত হয়ে গেছে। অনেকটাই। চানু বুঝল এখানে ওর কোনও ভূমিকা নেই। বস যা করার করবে। অ্যাপ্লিকেশনে প্লিজ ডু নিডফুল অ্যান্ড নেসেসারি অ্যাকশন লেখে চানু। নেসেসারি অ্যাকশনটা বস-এর। চানু একটু দূরে সরে যায়। বস বোধহয় ওর বাবার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা এখন জানাতে চাইছে না। হরিপদ বলল, আমি বিচিকলার মোচা না কাঁচাকলার মোচা বোঝার জন্য একটা মোচার ফুল দাঁতে কেটেছিলাম। বিশ্বাস না হয় একটা মুখে দিন, দেখুন কী স্বাদ, আপনারও থু-থু করে ফেলে দিতে হবে। এই তো মোচাটা। গুরুপদ নিজেই মোচাটার থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে দাঁতে কাটল। কেটেই মুখটা বিকৃত করল, নিজেই থুথু ফেলল গুরুপদ। থুথুর কী পাওয়ার! সবাই কেমন হয়ে গেল। গুরুপদ বলল, তোদের কোনও কামকাজ নাই নিকি? ছুচামুচা ধইর‍্যা হাত গন্ধ করস ক্যান। পারলে ব্যাঁকা সাহারে ধর, ব্যাঁকার গুরুরে ধর। এই ভদ্রলোককে আমি জানি। সিধাসরল লোক। কিট্টু, শোন, বল ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে, সরি।

কিট্টু জানে গুরুদা যখন বাঙাল কথা না বলে ঘটি কথা বলে, বুঝতে হবে একটু ঘেঁটে আছে। শেষের দিকে খাটি কথা বলেছে। কিট্টু তাই বলে ক্ষমা চাইবে নাকি? কিট্টু বাজারের থলেটা তুলে হরিপদর হাতে তুলে দেয়। এটাই যথেষ্ট। কিট্টু ওর নিজের ঠেক-এ চলে যায়। গুরুপদ হরিপদকে বলে একটু সাবধানে থাকবেন। কখনও ওদের পোন্দে লাগতে যাবেন না।

হরিপদ বাঁ হাতে মাথা চুলকে বলল, আমি তো ওদের…ওই কথাটা উচ্চারণ করতে পারছিল না। ও খারাপ কথা বলে না তা তো নয়,—বরানগরের ছেলে। কিন্তু মান্যগণ্য লোকের সামনে কি ওসব বলা যায়? মান্যগণ্য? তাই তো, সবাই মানে গোনে মানেই মান্যগণ্য।

মান্যগণ্য না হোক কেউকেটা তো বটে।

কথাটা শেষ করে হরিপদ—ওদের পিছনে তো লাগিনি…

—না লাগলে ওদের সঙ্গে বারবার কিচাইন হয় ক্যান? কিছু চান্দা-টান্দা চাইছিল, রিফিউজ করছেন এমন কিছু কেস আছে নাকি?

হরিপদ মাথা নাড়ে। কই, না তো…

—তাহলে এরকম হয় ক্যান!

—ঠোঁট উলটে দেয় হরিপদ। জানি না তো…বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে হরিপদ। মোটরসাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চানু। চানুর চোখের ভাষা হরিপদ পড়তে পারল। কী যে সব উটকো ঝামেলা বাধাও…।

এবার মনমেজাজটা একটু মেরামত করে নেবার চেষ্টা করতে লাগল হরিপদ। ওর মুখ দেখে রেখা ঠিক বুঝতে পারে। যেদিন ওর মালিক ওকে বেশ বকাঝকা করে, কিংবা বলে—দুসরা কাজ দেখে লিন, আপনাকে দিয়ে হোবে না,—সেদিন মুখের মধ্যে সরের মতো, নাকি মরচের মতো কিছু প্রলেপ পড়ে, রেখা ঠিক বুঝে যায়, জিজ্ঞাসা করে—কী হয়েছে? আজ যেটা হল এটা তো হওয়ার কথা ছিল না, হয়ে গেল। আজকের কাগজটা কেনা হয়নি, আজকের ভাগ্যফলে হয়তো ছিল উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে…উটকো তো থাকবে না,—কী থাকবে? অনভিপ্রেত। মিলে যায়, মিলে যায়। জ্যোতিষ হল অঙ্কের মতো। ফর্মুলায় ফেলতে পারলেই অঙ্ক মিলে যায়। মনে একটু খুশির ভাব আনতে পারলে মুখের মরচে মুছে যাবে। খুশির ভাবটা বেশ একটা অদ্ভুত ভাব। ওই যে একটা ছাগল, ওর পিছনে খুশির ভাবটা দেখল হরিপদ, ছাগলের পিছন থেকে লাদি বেরোচ্ছে, কালো কালো, সেম সাইজ, ওখান থেকে ফুরফুর করে লাদির স্রোত। বেশ একটা খুশির ভাব। গাছের ডালে পতাকা উড়ছে, পতাকার মধ্যে কি খুশির ভাব আছে? নাকি টেনশনও আছে। টেনশন থাকলে কি খুশির ভাব থাকে? এই যে গোরুটা, চুপ করে বসে বসে জাবর কাটছে, ওর মুখে কোনও টেনশন নেই। ওর মুখে কি খুশির ভাব?—না—না ওটা সুখের ভাব। সুখের ভাব অন্যরকম। কচুরির মশলার মতো লেচির গায়ে লেপটে থাকে বেশ। এই যে রোশনলাল, ওর মালিক, ওর মুখের মধ্যে সুখ লেখা নেই, কপাল কুঁচকে থাকে, কিন্তু খুশি লেখা থাকে। হরিপদ ওর মুখে একটু খুশি লিখে নিতে চাইছে বাড়ি ঢোকার আগে। কোত্থেকে একটা গান ভেসে আসছে—কবে আসবে আমার পালা রে…। দিমু গলায় মালারে…ওই তো খুশি। মালারে… মালারে…মালারে…বেশ তো। মালারে মালারে করতে-করতে হরিপদ হাঁটছে, একটু আগে যা হয়েছে তা সব মুখ থেকে মুছে নিয়েছে, এবারে একটা ছবি দেখল। লম্বা টাইপের ছবি। পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা একটা লোক, একটা পা সামনে বাড়ানো, তলায় লেখা বিমল নন্দী জিন্দাবাদ। এই ছবিটার তলায় আর একটা ছবি, সাইজে ছোট, শুধু মুখটা, ফুলবডি নয়, সেই ছবিটা গুরুপদর। পাশে লেখা বিমলদা এগিয়ে চলো। আমরা তোমার পাশে আছি। এবারে একটা দাগ, দাগের তলায় লেখা সৌজন্যে গুরুপদ কর্মকার, মন্টু ঘোষ, কিট্টু, বোঁটকা, তপন, মনোজ। সবার মাথার ওপরে অবশ্য হাসি মুখের চেনা বড় ছবি, ওখানে নাম নেই, সবাই চেনে। এই ছবিটার সামনে একটু দাঁড়াল হরিপদ। গুরুপদ তাহলে শুধু প্রোমোটার নয়, কিছুটা নেতাও। বড় নেতার ফুল বডি ছবির তলায় একটা হাফবডি ছবি তো আছে। কিট্টু—টিট্টুদের ছবি নেই—শুধু নাম। তার মানে গুরুপদ কিট্টু-টিট্টুদের নেতা। যে বড় নেতা, বিমল নন্দী—তার সঙ্গে গুরুপদর নিশ্চয়ই ভাব। এই দিককার এমএলএ কিন্তু বিমল নন্দী নয়। এমএলএ না হোক সে, বিমল নন্দী নিশ্চয়ই বড় নেতা। বিমান বসু তো এমএলএ-টেমএলএ কিছু ছিল না, কিন্তু নেতা তো। মনটা খুশি খুশি হয়ে গেল। এ পাড়ার নেতা ওকে চেনে, ওর বাড়িতেও আসে। চানু কিছু বলেনি কেন? ও তো দু সপ্তাহের ওপর ওখানে যাচ্ছে। ও ব্যাটা বলে না কিছু। হরিপদ জিজ্ঞাসা করেছিল একবার—কেমন লাগছে? চানু বলেছিল ধুস। ও সব কিছুতেই বলে ধুস—কিন্তু ধুসের বাইরে বেরুবার তেমন ইচ্ছে নেই। তাই তো সুখী। এই কাজটা তো ওর নিজের মুরোদে জোগাড় করতে পারেনি, হরিপদই করে দিয়েছে। মনে একটা বেশ খুশি। মোচার তেতোটা একদম কেটে গেছে।

ওদের ফ্ল্যাটের সামনে চারটে ছেলে, আর দুটো বাইক দাঁড়িয়ে। ভিতরে ঢুকতেই দেখল ব্যাঁকা সাহা নেমে আসছে। ব্যাঁকাবাবু বলল আপনার কাছে গেছিলাম। আমার সঙ্গে থানায় চলুন।

—কেন?

—আপনাকে কিট্টু মেরেছে না? খবর আছে।

—না না মারেনি। হরিপদ থানা শুনেই ভয় পেয়েছিল।

ছেলেগুলো সামনে এসে গেছে। একটা ছেলে বলল—আরে মেরেছে। পুরো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।

ব্যাঁকা সাহা বলল—দেখুন, আমার ফ্ল্যাটে থাকেন, এই ইন্দ্রবাটিতে যারা থাকে ওদের দেখভালের দায়িত্ব আমার। আমার ফ্ল্যাটের কারোর অপমান মানে আমার অপমান। এর আগেও আপনাকে ওরা অপমান করেছে। দুটো ইটের জন্য আপনার বাপ তুলে খিস্তি করেছে। করেনি?

হরিপদ যেন নিজেই দোষ করেছে। ওর হাতে ব্যাগ আছে বলে হাতটা কচলাতে পারছে না।

—সব খবর আসে। ব্যাগটা রেখে আসুন, কথা আছে। হরিপদ ব্যাগটা রাখে। রেখা বলে—এত দেরি হল, হরিপদ কিছু বলল না। মোচাটা ভেতরে আছে, ওটা পালটাতেই তো গেছিল, ওটার জন্যই তো বিপদটা ডাকল। হরিপদ বলল—মোচাটা কিন্তু কাঁচাকলার। আগেই বলে দিলাম। গরমমশলাটশলা দিও না।

রেখা বলল—প্রোমোটারবাবু খুঁজতে এসেছিল। ওর কি আরও টাকাপয়সা পাওনা আছে নাকি?

হরিপদ হাতের ইশারায় অল ক্লিয়ার-এর ভঙ্গি করল। রেখা বলল—বাদরুমে জল আটকে থাকে, বলে দিও। ঢালটা ঠিক নেই।

হরিপদ একজন সাদামাটা বেটেখাটো লোক। সাতপাঁচে নেই, কিন্তু প্যাঁচে পড়ে গেল। প্যাঁচ কেটে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাঁকা সাহাকে গুরুপদ পছন্দ করে না—এটা গুরুপদর সঙ্গে কথা বলে আগেই বুঝেছিল হরিপদ, এখন বোঝা যাচ্ছে ব্যাঁকা সাহাও গুরুপদকে জব্দ করার তাল খুঁজছে। হরিপদকে দিয়ে থানায় কিছু একটা ডায়েরি করিয়ে দেবে। তারপর তো রাস্তায় বেরতেই পারবে না ও। বিছানায় শুয়ে পড়ল হরিপদ। ছোটবেলায় অঙ্ক স্যারের ভয়ে ইস্কুলে যেত না, বলত পেট কামড়াচ্ছে। রেখা জিজ্ঞাসা করল কী গো, শরীর খারাপ নাকি? হরিপদ বলে দিল পেট কামড়াচ্ছে। রেখা বলল—সে কী? কাল তেলেভাজা খেয়েছিলে বুঝি? কাঁচাকলা এনেছ, সেদ্ধ করে দিতুম, ভাত চটকে ডালের জল দিয়ে খেয়ে নিও। খুব পেট কামড়াচ্ছে বুঝি। তুমি তো এমনিতে শোও না…।

হরিপদ বলল—না, তেমন কিছু নয়, এক্ষুনি কমে যাবে। ওরা এলে বোলো এসেই বমি করেছি।

সুলতা এল। কী হয়েছে বাবা?

হরিপদ ওকে বলল—চোপ। একদম ওই ঘরে গিয়ে চুপ করে বোস থাক গে। ওরা আসবে, সামনে বেরবি না।

রেখা বলল—কী করেছ তুমি? টাকা ধার?

হরিপদ বলল—কিছু না, মা কালীর দিব্যি। ওরা আমাকে বাইরে বেরুতে বলছে। গরমের মধ্যে বেরব না।

একটু পরেই বেল বাজল।

রেখা বমির সঙ্গে দাস্তটাও জুড়েছিল। বেশ করেছে।

ব্যাঁকাবাবু ছাড়াও আর একটা গলার স্বর শুনল হরিপদ। বললেই হল দাস্ত বমি! দিব্যি ভারী মোচাটা নিয়ে এল, কেন নকশাটা দিচ্ছে, ভালোর জন্যই এসেছিলাম, যদি একটা অন্যায়ের পোতিবাদ না হয়, তবে আবার অন্যায় হবে। গা-জোয়ারি হবে, ভালো কথা বলছিলাম, ব্যাঁকা ওনাকে ভালোবাসে বলেই অ্যাকশন নিতে চাইছিল। একটু ভিতরে যাচ্ছি, ব্যাঁকাদা ওনার সঙ্গে কথা বলবে। রেখার সম্মতিসূচক কোনও শব্দ শুনতে পেল না হরিপদ, কিন্তু ওরা এসে হাজির হয়ে গেল।

—কী হল, শুয়ে আছেন কেন।

—রোদে মাথা চক্কর দিচ্ছিল।

—এই যে উনি বললেন দাস্ত-বমি…।

—ওটাও, ওটাও।

—এই গরমে হচ্ছে।

ব্যাঁকাবাবু দাঁড়িয়ে আছে, এটা ভালো দেখাচ্ছে না। হরিপদ রেখাকে চেয়ার টেনে আনতে বলে।

—না-না, চেয়ার দরকার নেই। আপনি পিয়ারিদার লোক বলে অনেক কমে ফ্ল্যাট দিয়েছি। আপনাকে আমার লোক বলেই জানি। আপনাকে অপমান করেছে বলে আমি চুপ থাকব না। ওই গুরু কামার সম্পর্কে সাবধান করে দিচ্ছি। দাদা, লোকটা বলতে খতরনাক। খুব বাড় বেড়েছে। আপনার ছেলেকে ও কবজা করতে চাইছে। খুব সাবধান। যারা আপনাকে অপমান করেছে ওরা ওর লোক। আপনার উচিত পুলিশকে জানানো। এখন থানার ওসি, আমার লোক। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। কিট্টু আর তিন-চার জনের নামে একটা এফআইআর করে দিন। একদম ‘অ্যাটেম টু মার্ডার’ হয়ে যাবে। ৩০৭-এ ফেলে দেবে।

হরিপদ বলে—উরি বাব্বা। আমাকে তো ওরা তেমন কিছু করেনি, অ্যাটেমট টু মার্ডার কেন বলব, একটু খালি ধাক্কা…।

—সেটাই বলবেন। গলাধাক্কা। চলুন।

—না-না, আমার মাথা ঘুরছে, আবার বমি পাচ্ছে।

এবার বোধ হয় সত্যিই বমি পেল। ও ওয়াক তুলল। এটা অভিনয় নয়, সত্যি।

অটোর ছেলেটা বলল—বাইকে বসিয়ে নিয়ে যাব দাদা। দেখুন, ওদের পোশ্রয় দেবেন না। আজ আপনাকে ইনসালেট করেছে কাল আপনার মেয়েকে ধরে টানবে।

ওরে ব্বাবা। হরি ভয় পায়। এবং বমি তোলে। মুখে টকজল। বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসে।

ভগবান আছে। ঠিক টাইমে বমিটা করিয়ে দিল।

দেখলেন তো, শরীরটা কীরকম…।

ব্যাঁকা সাহা বলে—ঠিক আছে, যেতে হবে না, মোবাইলে বলে দিন।

—আমার তো মোবাইল নেই…।

—আমি ধরে দিচ্ছি। ব্যাঁকাবাবু পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে পটপট করে টেপে। স্যার, আমি ব্যাঁকা বলছি, ব্যাঁকা, ওগুলো ভালো ছিল স্যার?

হ্যাঁ, এখন ভেড়িতে জল কমে গেছে কিনা, তাই ধরে ফেলতে হচ্ছে।

না, কামদুনি অব্দি যেতে হয় না।

আরে স্যার, রেপেই তো বিখ্যাত হল। দুটো বড় রেপ হলে এই নফরগঞ্জ ফেমাস হয়ে যাবে, হা-হা-হা।

হ্যাঁ স্যার, ওকে স্যার, আচ্ছা স্যার।…

বলছিলাম কী, কিট্টুদের দল যা-তা শুরু করেছে। আমাদের কাজ করতে দিচ্ছে না। আমার ছেলেরা চুপ করে আছে, ল অ্যান্ড অর্ডার খারাপ করতে চাই না। একটা নিরীহ লোককে চড়চাপড় মেরেছে। একদম নিরীহ লোক।

না-না, এর কোনও পলিটিক্যাল ইয়ে নেই। ধরে চড়চাপড়, দাদাগিরি, আর কিছু নয়, আরে ইটের পাঁজায় উঠে ওনার বাবার শ্রাদ্ধে লাগবে বলে বটগাছের ডাল ভাঙতে গিয়ে দুটো ইট ভেঙেছিল,

….আরে ইট তো রাস্তায় রাখে। আমি তো নিজের জমিতে…দুটো ইট নিয়ে ঝামেলা শুরু, এখন কিট্টু যা-তা করছে,

…না, না, কী করে থানায় যাবে? আজ সকালে ওকে ওরা মেরেছে স্যার, এর পর অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ডাক্তার ডাকা হবে এখন, ওকেই দেখতে এসেছিলাম, এই যে, ফোনটা দিচ্ছি, ওনার সঙ্গে একটু কথা বলুন।

…জানি স্যার, ফোনে এফআইআর হয় না। তবু নিজে শুনে নিতেন…

লাউড স্পিকারটা অন করে ফোনটা হরিপদর হাতে গছিয়ে দেয় ব্যাঁকা সাহা, হরিপদর হাতে ছ্যাঁকা লাগে। হরিপদ আবার মনে মনে দ্রৌপদী হয়ে কৃষ্ণ ডাকে। কৃষ্ণ মানে তো গুরুপদ। মিঠুনের মতো এসে, মোবাইলটা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আবার ব্যাঁকার হাতে দিয়ে বলবে, যে ঝামেলায় যেতে চাইছে না তাকে ঝামেলায় জড়াচ্ছিস কেন?

কথাটা গুরুপদই বা বলবে কেন? হরিপদ কি নিজমুখে বলতে পারে না? বলেই ফেলল—ঝামেলায় যাব না, আমায় ছেড়ে দিন।

হাতের মোবাইল থেকে হ্যালো হ্যালো শুনতে পাচ্ছিল হরিপদ। পুলিশের হ্যালো, অথচ হরিপদ জবাব দিচ্ছে না। ঠিক হচ্ছে?

—ঝামেলা? এটাকে ঝামেলা ভাবছেন? চুপ মেরে থাকলে ঝামেলা থেকে পার পাবেন? আপনিই দেখছি নফরগঞ্জকে বিখ্যাত করে দেবেন। ওরা বাড়িতে রেপও করিয়ে দিতে পারে। তখনও চুপ করে থাকবেন?

ফোনটা মুঠিতে চেপে ধরে কানে ধরে হরিপদ।

স্যার…।

যদি থানায় না আসতে পারেন কাগজে লিখে সই করে ওদের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিন।

হরিপদ চুপ করে আছে।

হরিপদর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ব্যাঁকা নিজেই বলল—আচ্ছা স্যার, যা বললেন তাই করছি। ছেলেটা বলল-নিয়ে আসুন হরিবাবু, হরিপদ বলল-কী?

—কাগজ, একপিস কাগজ।

হরিপদ বলল—কাগজ? কাগজ তো নেই।

—কাগজ নেই? বললেই হল? আপনার ছেলে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে না? আমরা দেখব? ছেলের বই খাতা কোথায় থাকে?

ওরা নিজেরাই ঘরে ঢুকবে বোধ হয়। ঘরে মেয়েটা শুধু ম্যাকসি পরে আছে। বাইরে আরও দুটো ছেলে মজুত। যে কোনও সময় ঘরে ঢুকে হামলা করতে পারে। ওরা তো কোনও হামলা করছে না, এটাকে কি হামলা বলে?

 কেউ বলবে না এটা হামলা বরং ওরা হামলার প্রতিকারের কথা বলছে। প্রতিকার কি হয়? জানাশোনা থাকলে হয়। থানার ওসি তো ওদের জানাশোনা। থানার পুলিশ কী করবে? কিট্টুদের একটু বকাবকি করে দেবে। থানায় ধরে নিয়ে মারধর দেবে না তো?

—কী হল? কী ভাবছেন এত?

রেখা কেন চুপচাপ? ও কেন এসে বলছে না? বটগাছের ডাল ভাঙা নিয়ে ঝামেলার ব্যাপারটা রেখাকে বলেছিল পরে। রেখা বলেছিল, তোমার মতো মিনমিনে লোকদেরই ওরা পারে।

ও রেখা, তুমি তো মিনমিনে না, এসে বলতে পারছ না—আপনারা জোর করবেন না—রেখা ও রেখা… রেখাকে ডাকল হরিপদ। রেখা এল।

হরিপদ বলল—দেখ না ওরা আমাকে বলছে পুলিশে জানাতে ওই কিট্টু মিট্টুদের ব্যাপারে। ওই যারা সেদিন বটের ডাল ভাঙা নিয়ে…

—আজও মেরেছে বউদি। দাদাকে ভালোমানুষ পেয়ে পেয়ে…

আজও মেরেছে? কিচ্ছু বলেনি বাড়িতে, কেন? তোমাকেই ওরা এরকম করে কেন?

ব্যাঁকা সাহা বলল—আরে কিছু না, মজা করে, আমার ভাগনা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছিল, ওকে সবাই মিলে এমন টরচার করল যে আর গেলই না। ছেলেটা একটু ভালো প্রকৃতির ছিল।

বুঝলেন বউদি, ভালোর কোনও মূল্য নেই। ভালো মানুষ পেয়ে ওরা টরচার করে মজা লুটছে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন না মাঝে মাঝে একটু ফোঁস করতে হয়। ওই জন্য বলছিলাম একটু থানায় জানাতে। যখন জানবে লোকটা ফোঁস করতেও পারে, তাহলে একটু কন্ট্রোলে থাকবে, নইলে কিন্তু ঘরে ঢুকেও হামলা করবে বলে দিলাম। রামপিয়ারি দাদা আমাকে বলেছিল দাদাকে পাঠালাম, দেখিস। আমি তো সর্বদা চোখে চোখে রাখতে পারি না, আমার ছেলেরা আছে। ওদের কাছেই রিপোর্ট পেলাম যে কিট্টুর দল দাদাকে টরচার করে। ওই জন্যই তো পুলিশকে ইনফরম করতে বলেছিলাম দাদাকে।

রেখা বলল—ঠিকই তো বলছেন।

—তবে? দাদা পুলিশকে জানাতে ভয় পাচ্ছে। লোভ আর ভয়, যত বাড়ায় ততই হয়। একটা কাগজ নিয়ে আসেন বউদি।

চানুর একটা খাতা নিয়ে আসে রেখা, খাতা খুললে জহর রোজগার যোজনা, ইন্দিরা আবাস যোজনা, অন্ত্যোদয় প্রকল্প, স্বচ্ছ ভারত মিশন এইসব লেখা, কিছু নোট, কিছু কাটাকুটি, ব্রহ্মচর্য্য ব্রহ্মচর্য্য ৮/১০ বার লেখা, পৃষ্ঠা উলটে সাদা পাতা। সাহাবাবু খাতার গা থেকে দুটো পাতা ছিঁড়ে নেয়, খরখর শব্দ ওঠে হরিপদর শরীরে। বলে, আগে একটা রাফ লিখুন, তারপর ফ্রেশ করে লিখে দেবেন। এক্কেবারে বটগাছের ডাল ভাঙার সময় কী বলেছিল, তারপর কী করেছে, আপনার মেয়েকে নিয়ে যা-তা বলেছে, আজ আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, পড়ে গিয়ে মাথায় লেগে গেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারত। গুছিয়ে এক পাতার মধ্যে লিখে দিন।

হরিপদর সব গুলিয়ে যায়। মাথা ঘুরতে থাকে, বমি পায়। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ, পলাশীর প্রান্তর, বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, বাংলার সৌভাগ্য সূর্য আজ অস্তাচলগামী, কে তাকে ভরসা দেবে, অ্যাই মাওয়ের বাচ্চা, নেমে আয়, শব্দ, ধোঁয়া, রক্ত, মিলিটারি, বরানগরের রাস্তায় রক্তমুখ লাশ। বাড়ি থেকে বেরবি না একদম। বাইরে বারুদ, বাবা শান্তিজল ছিটোচ্ছেন ওঁ শান্তি, ওঁ স্বস্তি…ওয়াক, ওয়াক… বমি পায়। মিনমিন করে বলে বমি হবে।

থাক তাহলে, লিখতে হবে না, আপনি শুধু সই করে দিন, এইখানে, আমরা ছোট করে লিখে নেব।

হরিপদ মিনমিন করে রেখাকে ডাকে। রেখা খাতাটা দিয়ে কোথায় গেল। খাতাটার উপর একটা সাদা পৃষ্ঠা চেপে রেখেছে, একদা সাদা শূন্যতা ফরফর করে নিজেকে ঝাঁকাচ্ছে। কাগজ নয়, মুরগি। গলাকাটা হয়ে গেছে, এবার ঝাঁকুনি। কাগজটাকে চেপে ধরে সাহাবাবু। নিন দাদা, এইখানে। ওখানে সই করে দিল হরিপদ চক্রবর্তী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *