৩
‘ঘর’ অত সাজাবার দরকার হয় না, ফ্ল্যাট হলে সাজাতে হয়। প্লাস্টিকের লতা ঝুলিয়ে দিয়েছে, দেয়ালে বাবা-মা, বাবা লোকনাথ, মা কালী। একটা ছোট শ্বেতপাথরের সিংহাসন, তাকে তাজমহল—ঝিনুকের, দীঘা থেকে কেনা। ওবাড়ি থেকে নিয়ে আসা পূর্বপুরুষের বড় খাট ঘরে ঢোকানোর পর দেখা গেল ঘরে আর জায়গা নেই। ব্যাঁকা সাহা খাটটা কিনে নিয়েছে। এসব আগেকার দিনের খাট এরা পাবে কোথায়? এরা তো হালের বড়লোক। সেগুনের বদলে ঘরে লোহার খাট। বাক্সপেঁটরাগুলো খাটের তলায়। লরি বোঝাই করে তো সবই নিয়ে এসেছিল ওবাড়ি থেকে, কিন্তু ফেলে দিতে হয়েছে কত কিছু। বেড়াল মারার লাঠি, ইঁদুর ধরার কল, বিছের বিষ তোলা পাথর, শ্যাওলা তোলার চাঁচর,—এসব ফ্ল্যাট বাড়িতে দরকার হয় না। এক জোড়া খড়ম পেয়েছিল, কাঠের, ওটার আর দরকার হবে না, কিন্তু রেখে দিয়েছিল আলমারিতে। বাবার স্মৃতি। বাবা বাড়িতে পরতেন এককালে।
হরিপদ মাঝে-মাঝে খট খট শব্দ পাচ্ছিল। খড়ম পায়ে হাঁটলে যেমন শব্দ হয়। ও বাড়িতে কলতলা ছিল নিচে। স্নান করে, খড়ম পায়ে ক্ষমাচ জাহ্নবী চৈব শান্তা শান্তি প্রদায়িণী…বলতে বলতে উঠে আসতেন, খট খট…খট খট…বিষ্ণু তেজসে, জগৎ সবিত্রে শুচয়ে…। ভোরবেলায় খট খট শব্দে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল হরিপদর।
হ্যাঁগো, শুনতে পাচ্ছ, বাবা আসছে খড়ম পায়ে…। রেখা কিছু শুনতে পেত না। হরিপদর মনে হত বাবা কি ছেলের ফ্ল্যাটজীবন দেখতে আসছেন? কিন্তু খড়ম পায়ে কেন? বাবা তো শেষের দিকে খড়ম পরতে পারতেন না, পা থেকে খুলে যেত। একদিন আলমারি খুলে দেখেছিল খড়ম জোড়াটা দড়ি বাঁধাই রয়েছে। তবু খট…খট…।
হরিপদর বাবা গুরুচরণ পুরুতগিরি করতেন। পাড়ায় ঠাকুরমশাই বলে বিখ্যাত ছিলেন, লোকে মান্যিগন্যি করত। যতদিন পেরেছেন, সকালে এক্ষেত্রে—প্রাতঃকালে গঙ্গাস্নানে যেতেন, গঙ্গাপাড়েই আহ্নিক করে গায়ে নামাবলি জড়িয়ে দুটো মিষ্টির দোকানে গঙ্গাবারি ছেটানোর বদলে কয়েকটা সন্দেশ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। রায়বাড়িতেও কোনও এক শরিকের বাড়িতে নিত্য নারায়ণসেবাও করতেন। গুরুচরণের দুই কন্যার পর পুত্রসন্তান হরিপদ। আদর পেয়েছে, গাট্টি বেঁধে আনা ফল-নাড়ু, বেশি করে খেয়েও অঙ্কে মাথা খোলেনি হরিপদর। ওর বাবা চাননি—ছেলেও পুরুতগিরি করুক। ডাক্তার-উকিল-পোস্টমাস্টার এরা তো দূর দেবতার মতো। এতটা ভাবেননি গুরুচরণ, একটা সরকারি অফিসের কেরানি হোক, এমন ভাবাটা খুব একটা অন্যায্য ছিল না, কিন্তু হরিপদ পারল না। হায়ার সেকেন্ডারি আর্টস- এ দুবারে পাশ, থার্ড ডিভিশন, টাইপের ইস্কুলে ভরতি, কিন্তু কিছুতেই স্পিড উঠত না, গুরুচরণ ভেবেছিলেন যজমানির লাইনেই শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবেন, কিন্তু সংস্কৃত মন্ত্র কিছুতেই মুখস্থ থাকত না হরিপদর। বই-খাতা দেখে মন্ত্র বলা পুরুতদের কোনও কদর নেই। তাছাড়া হরিপদটার মুখে র-ফলা য-ফলাটা একেবারেই আসে না। প্রধানকে বলে পোধান। লক্ষ্মীপূজায় লক্ষ্মীশ্চলা ভূতির্হরিপ্রিয়া শব্দটা যখন কিছুতেই কবজা করতে পারল না, তখনই সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে যা হোক একটা কাজ জোগাড় করতে পেরেছিল হরিপদ।
বলা যায়— সংসারটা সুখেরই। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এক্কেবারে হক কথা, রাইট কথা। দাঁত বের করা ইটের দেওয়ালে ঘুঁটে দিয়েছে রেখা, গুল দিয়েছে, কম তেলে রান্না, লাউ-কুমড়ো-কাঁচকলা—এসবের চোকলাটা ফেলেছে বটে, কিন্তু ওসব রান্নার পদ হয়ে গেছে ফের। সিল্কের শাড়ির বায়না নেই, বড়বাজারে জোড়া দেয়া শাড়ি পাওয়া যায়, দাম কম, জোড়াটা দেখতে পাওয়া যায় না।
জোড়া শাড়িগুলোই ওর ‘তোলা’ শাড়ি। আর বাবার পাওয়া মোটা শাড়িই পরেছে। ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েদের বুঝিয়েছে লজেন্স-চকলেট খেলে কিরমি হয়, আর বিস্কুটে খোস-প্যাঁচড়া। মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালোই। বাপ হয়ে নিজের মেয়েকে সুন্দরী বলতে হয় না। মেয়ে বড় লক্ষ্মী। বোঝে। বাইরের শোকেসগুলো তো ওদের ডাকে, সাজানো সাজার জিনিস বলে নে-নে। মেয়েদের সাজার দোকানগুলো—মানে বিউটি পার্লার বলে আয় আয়, লাল কাপড় জড়ানো বিরিয়ানির হাঁড়ি বলে খা-খা। হরিপদর লক্ষ্মী মেয়ে সুলতা রুটির মধ্যে আলু-পেঁয়াজ ভাজা ঢুকিয়ে গুটিয়ে বলে এই তো রোল হয়ে গেল। পড়াশুনোটায় সেরকম নয়। হরিপদও তো সেরকম ছিল না, কী আর করা যাবে। যা হোক, বিএ-টা পাশ করেছে। কখনও বলে না কম্পিউটার শিখব, কিংবা কনে সাজানোর কোর্স আছে, সেটা শিখব। যদিও কম্পিউটার শিখতে বেশ ভালো টাকা-কড়ি লাগে। ছেলেটা কী একটা শিখেছে, তাও হাজার বিশেক লেগে গেছে। ছেলেটা বি কম পাশ দিয়ে চাকরি-বাকরির জন্য পরীক্ষা দিচ্ছে। গাদাখানেক বইপত্র কিনেছে, চাকরি হচ্ছে না, তাই সব সময় ‘ধুস’ বলে। প্রাইমারি মাস্টারের পরীক্ষা দিল, কী সব গণ্ডগোল হয়ে কী সব হয়ে গেল। কোনও পরীক্ষাই তো লাগছে না। বরানগরে টিউশনি ছিল। ব্রজস্যারের কোচিং-এ নিচু ক্লাসের ছেলেদের পড়াত। ব্রজস্যারের কোচিং বাড়ি একটা কারখানা। চারটে ঘরে সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কারখানা চলে। চানু, মানে চন্দন চক্রবর্তী সেই কারখানার একজন আনস্কিলড শ্রমিক। কোনও অনার্স নেই, বাংলা মিডিয়ামে পড়া, ও গঙ্গার উৎপত্তি ও গতি কিংবা মুঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণের বেশি কিছু পড়াতে পারত না। এখানে কোনও টিউশনি জোগাড় করতে পারেনি। প্রাণপণে জেনারেল নলেজ মুখস্থ করছে। প্রায়ই শোনে গ্রোথ রেট, জিডিপি, ডলার-পাউন্ড-ইউরো। আর থেকে থেকে বলে ধুস। হরিপদ বলে অত ধুস ধুস করতে নেই। যখন যা হবার ঠিক হবে। এই তো, নিজেদের ফ্ল্যাট বাড়ি হয়ে গেল হুট করে।
রেখা বলে ফ্ল্যাটবাড়ি তো করলে, কিন্তু মেয়ের বিয়ের কী উপায়? সাতাশ বছর বয়েস হয়ে গেল মেয়ের। এখন তো চেষ্টাই নেই। বললেই হল যখন হবার ঠিক হবে। আসলে জলে নামতে ভয় পাচ্ছ।
রেখা ঠিকই বলে। বরানগর থাকতেও ঘটক লাগায়নি, এখানে ওসব কোথায় আছে জানে না হরিপদ। খবর কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায়। তারপর? বিয়ের খরচ কীভাবে জোগাড় হবে? হাতজোড় করে চাইলে মালিক হয়তো হাজার পঞ্চাশ দিয়ে দেবে। তারপর? মেয়েটা তো দেখতে শুনতে খারাপ নয়, এরকম কি হতে পারে না, কোনও পাত্রর বাপ এসে বলল আপনার কন্যাটিকে আমাদের বড়ই পছন্দ। আপনি শুধু একটা বেনারসি পরিয়ে আমাদের দিয়ে দিন আমরা সাজিয়ে নেব। আমরা আবার পণ যৌতুকে বিশ্বাসী নই। এরকম একটা গোল চশমার বুড়োর স্বপ্ন দেখে হরিপদ। যেন আকাশ থেকে নেমে এল, ডানা দেখা যাচ্ছে না। এরকম তো হত। হরিপদর পিসিমার নাকি এভাবেই বিয়ে হয়েছিল। পিসেমশাই ছিল উকিল। মেয়েটা ভাবভালোবাসাও করতে পারল না কারুর সঙ্গে। ছেলে ভালো হলে জাতপাত নিয়ে কিচ্ছু বলত না। মেয়ে আবার বেশি ভালো। মাথা নিচু করে রাস্তায় চলে। কলেজে পড়ার সময় কে একজন ওর হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিয়েছিল। ওটা আবার ওর মাকে দেখিয়েছিল। এখনও বলেনি মোবাইল কিনে দাও। এ মেয়ে কী করে ভাবভালোবাসা করে বিয়ে করবে! রাতে মা মেয়েতে বসে টিভি দেখে। সব সিরিয়ালে একটা মেয়ে থাকে, যে সব পারে, কষ্ট করে ঠিকই, কিন্তু শেষ কালে জিতে যায়। সেইসব টিভির মেয়েদের কড়া আত্মাটা যদি বোকা মেয়েটার মধ্যে ঢুকে যেতে পারত…।
মেয়েটা বড্ড বোকা। টিভির খবরে গোলাগুলি, রক্ত দেখলে চোখ ঢাকে। কোনও মা যখন পা বিছিয়ে বুক চাপড়ায় ওর খুন হয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য, বোকা মেয়েটার চোখ দিয়ে জল বের হয়। তুই কাঁদিস কেন? তোর কিছু হয়েছে? নেতা-টেতারা কত কিছু বলে, ও বোকার মতো ওর মাকে জিজ্ঞাসা করে, সত্যিগো মা? তিন লক্ষ মেয়ের চাকরি হবে…চানু যদি বলে ধুস, সুলতা বলে হতেও তো পারে। টিভিতে জ্যোতিষ চ্যানেলে যখন মালাপরা তান্ত্রিক বা জ্যোতিষী বলে ঘরে শ্রীযন্ত্রম থাকলে অনূঢ়া কন্যার বিবাহ, বেকারের চাকরি, রোগব্যাধি থেকে মুক্তি…সুলতা বলে, এসব হয় নাকি গো মা? বাবা তাহলে একটা আনছে না কেন?
এই সুখের সংসারে এখন মাঝেই মাঝেই খটখট। খড়মের শব্দ। বাবা কেন আসে?
হরিপদ রতনবাবুর ঘাটে বাবার শ্রাদ্ধটা ঠিক মতোই করেছিল। পঞ্চাশ জন লোককে দই-চিড়ে, বোঁদে, কাঁচাগোল্লা ফলাহারও করিয়েছিল। বাবা বলে গিয়েছিলেন শ্রাদ্ধে ফলাহারই বিধেয়। এক বছর পরে বাৎসরিকও করা হয়েছিল রতনবাবুর ঘাটেই। গয়াতে গিয়ে পিণ্ডটা দেওয়া হয়নি। বাবা কি ছেলের নতুন ফ্ল্যাট দেখতে আসে? ছেলের সুখ দেখতে আসে?
একদিন দেখল নতুন কেনা প্লাস্টিকের চেয়ারটায় হরিপদর বাবা বসে বসে পা নাড়াচ্ছেন। বলছেন—কীরে হরি, ভদ্দরলোক হয়ে গেলি?
হরিপদ বলল—আগে কি ছোটলোক ছিলাম নাকি? বামুনের ছেলে।
বাবা বললেন—আরে ধুর। বামুনকে কে পোছে, পয়সা না থাকলে? আমি তো কিছু পয়সাকড়ি রেখে যেতে পারিনি, যা করেছিস তুই করেছিস। চুরি করিসনি, অন্যের পয়সা মারিসনি। সৎভাবে করেছিস। নিজের বাড়ি। তোর নামে পাকা দলিল। কিন্তু আমায় তো ভুলেই গেলি…।
হরিপদ বলল, এ কী কথা বলছ বাবা, ঘরে তোমার ছবি, ছবিতে মালা, বাইরে যাবার সময় ছবির দিকে তাকিয়ে প্রণাম করে যাই…।
বাবা বললেন—তা তো দেখতেই পাচ্ছি। প্লাস্টিকের মালা ঝুলিয়ে রেখেছিস একখানা, ধুলো ভরতি। ছবিটা মুছিসনি কত কাল। এটাই জগতের নিয়ম। তোরা সুখে থাকলেই আমার সুখ। এক গ্লাস জল দে।
ফিল্টারের কল খুলে এক গ্লাস জল নিয়ে এসে দেখল চেয়ার ফাঁকা।
তখন ঘুম ভাঙল।
শেষ রাতে স্বপ্ন।
তখনই হরিপদ ভাবল—একটা শ্রাদ্ধশান্তি করতে হবে। বাবাকে একটু জল দেবে।
এদিকে বামুনের সন্ধান জানে না হরিপদ। দোকানগুলোতে একজন পৈতেধারী সকালবেলায় মন্ত্র পড়ে জল ছিটিয়ে ফুল ছড়িয়ে যায় বটে, কিন্তু কেমন বামুন কে জানে? এ অঞ্চলে নিত্যিনতুন ফ্ল্যাট হচ্ছে, লোক ঢুকছে, গৃহপ্রবেশও হচ্ছে। প্রোমোটাররা নিশ্চয়ই বামুনের সন্ধান জানে। ভিতপুজো যে পুরুত করে, সেই পুরুতই হয়তো গৃহপ্রবেশ করায়।
সেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে দেখা হয়ে যেতেই হরিপদই বলল—ভালো আছেন?
সেই ভদ্রলোক বলল—হ্যাঁ। আপনি?
হরিপদ বলল—ছেলের ক্যামেরা কিনে দিলেন?
লোকটা বলল—দিলাম। ছেলের টিম চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ফুর্তি-ফার্তা করার জন্য আবার টাকা ফেললাম। ওর অ্যাকাউন্টে বেশি রাখি না তো, রাখলেই টান মারে।
লোকটার নাম ভোলেনি হরিপদ। ওর নাম ভুলে যাওয়া মানে তো বাপের নাম ভুলে যাওয়া। ওর বাবা গুরুচরণ, আর ওর নাম গুরুপদ।
হরিপদ বলল—একজন ব্রাহ্মণ ঠিক করে দিতে পারেন, একটু বাবাকে জল দেবো।
গুরুপদ বলল, ছায়ায় আসেন। ঘামছেন। হরিপদ কিন্তু ঘামছে না। ভোগীরা ঘামে বেশি। পয়সা হলেও ঘাম হয় বেশি। রাস্তায় রোদে ঘোরা পাগলরা ঘামে না। এখন চৈত্রর শেষ। প্রচুর কোকিল ডাকে।
কোল্ডড্রিংক খাবেন? লোকটা বলে।
হরিপদ বলে—খাই না। ঝাঁঝ লাগে।
লোকটার বাঁহাতে বোতল। পাইপটা ফেলে দিল রাস্তায়। গলায় ঢকঢক করে ঢেলে দিল। লোকটা বলল—পুরোইত লাগবে? শ্রাদ্ধ?
হরিপদ ঘাড় নাড়ায়। বলে স্বপ্নে আসে।
গুরুপদ বলে—সিন্ডিকেটে পাইবেন।
সিন্ডিকেট মানে?
মানে—যে যা খুশি করতে পারে না। এলাকায় একটা ডিসিপ্লিন রাখার জন্য একটা সিন্ডিকেট করছি। নতুন নতুন লোক আসতাছে, সবারই ঝি দরকার, কামের লোক দরকার, অনেক বাড়িতে বুড়ি-বুড়া আছে, মিঞা বিবি নোট কামাইতে বাইর হইয়া যায়, ঘরে আয়া দরকার হয়, সেই কারণে একটা সিন্ডিকেট করলাম। আমার ছোট ভাইটা চালায়। খালি বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল সাপ্লাইয়ের জন্যই সিন্ডিকেট লাগে এমন কথা নাই। সিন্ডিকেট ছাড়া কন্ট্রোল থাকে না। রিকশ ইউনিয়নের উপর আমাগোর কন্ট্রোল আছে। সেইজন্য সবাই এ্যাকোই ভাড়া নেয়। এখান থেকা আপ টু ছোট মসজিদ আট টাকা, তারপর জয়পুরের মোড় পর্যন্ত দশ টাকা, সবার একরকম ভাড়া। নইলে খায়াখায়ি বাইধ্যা যাইত। কাজের লোক-নার্স-আয়া বাড়ির কন্ট্রাকটার সাপ্লাইয়ের সিন্ডিকেটের নাম সমাজবন্ধু। নাড়ুর চায়ের দোকানের পাশেই খাপরার ঘর। ওইখানে গেলে পুরোইতও পাওয়া যায়। ওরা পুরোইতও সাপ্লাই করে। গলায় একটা পৈতে ঝুলাইয়া আমি বড় পুরোইত, কাঁসার বাসন চাই, বিশখান শাড়ি চাই কইলেই চলব না। সমাজবন্ধুতে নাম লিখাতে হয়, তারপর ওরাই সাপ্লাই করে। একদম ঠিকঠাক মাল।
হরিপদ একটু অবাক হয়। বরানগরে তো এরকম ছিল না। রামপিয়ারি, বোঁচা নাড়ু, ভুঁটেসোনা এরা সব ছিল বটে, কিন্তু সিন্ডিকেট কি ছিল? সিন্ডিকেট তো বড় জায়গায় হয়। একজন ভারী চশমা পরা প্রফেসার ছিল বরানগরে, পাড়ায় ওর খুব মানসম্মান, উনি নাকি সিন্ডিকেটের মেম্বার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্টিকেট। বালি সিমেন্ট পাথর নার্স আয়া পুরুত সাপ্লাইয়ের জন্যও সিন্ডিকেট হয় হরিপদ এখন জানল।
হরিপদ সমাজবন্ধুর অফিসে গেল। দেওয়ালে তিনটে ছবি। ওরা সব মনীষী, মহাপুরুষ। ওদের সবাইকে হরিপদ চেনে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-স্বামী বিবেকানন্দকে কে না চেনে? টেবিলের ওপর কয়েকটা প্লাস্টিকের কৌটোয় বালি, মোটা দানা, মিহি, হলদে, সাদাটে…। বালির উপর চিরকুটে লেখা মগরা, বরাকর, দামোদর…। দেওয়ালে হেলান দেওয়া অনেক রকমের টালি। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সঙ্গে বালি-টালির কী সম্পর্ক হরিপদ বুঝল না। হরিপদ একটা সবুজ রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসল। একটা অন্য লোকও বসেছিল। চেয়ারের ওধারে বছর চল্লিশের একটা ছেলে, মাথায় টুপি। গলায় সোনার চেন। ছেলেটা চেয়ারে বসা লোকটাকে একটা কার্ড বাড়িয়ে দিল। কার্ডের উপরে লেখা ভূরিভোজ। কার্ডের মধ্যে নানা রকম ভালো ভালো খাবারের নাম লেখা। রাধাবল্লভি, পনির মশলা, চিকেন দো পেঁয়াজি, বিরিয়ানি, মটন কোর্মা…। সিমেন্ট বালির সঙ্গে মটন কোর্মার কী সম্পর্ক সেটাও হরিপদ বুঝতে পারছিল না। হরিপদর চোখ একবার রবীন্দ্রনাথের দিকে, একবার বরাকর-দামোদর-মগরার দিকে, একবার পনির মশলা দো-পেঁয়াজির দিকে ঘোরাফেরা করতে থাকল। তারপর টুপি এবং সোনার চেন পরা ছেলেটির দিকে হতভম্বের মতো চেয়ে থাকল। ছেলেটা বলল—কী চাই? হরিপদ ‘বাবার শ্রাদ্ধ’ বলে একটা ঢোঁক গিলল, তারপর বললে—’পুরুত’। তারপর বলল—গুরুচরণবাবু পাঠালেন।
—ও, বুঝেছি। দাদা পাঠিয়েছে। বাবার শ্রাদ্ধের পুরুত চাই তো? কবে? ফোন নম্বর দিয়ে যান…। এটুকু বলে পনির মশালা-চিকেন দো পেঁয়াজির দিকে চলে গেল সমাজবন্ধু। লোকটা জিজ্ঞাসা করেছিল—রান্নাবান্না ভালো হবে তো? জিজ্ঞাসাটার মধ্যে তেমন কোনও তেজ ছিল না।—প্রথম জামাইষষ্ঠীতে জামাইকে খাওয়ানোর জন্য রিকশওয়ালাটা যেভাবে গলদা চিংড়ি বিক্রেতাকে ভয়ে বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে। ছেলেটা বলছে—কোনও বাজে ক্যাটারারকে আমরা অ্যালাও করি না। আমাদের লিস্টে সব এ ক্লাস। যে সব ক্যাটারার ভেটকি বলে ভোলা চালায়, ওদের ঢুকতে দিই না। ও নিয়ে কিছু ভাবার নেই।
এসব নিয়ে হরিপদর কিছু ভাবার নেই। পুরুতমশাইটা যেন শ্রাদ্ধের দিনে অন্নপ্রাশনের মন্তরটা না পড়ে দেন, এটুকু হলেই হল, বাবা যেন ঠিক মতো জলটা পেয়ে যান। বাবা আসছেন নতুন ফ্ল্যাটে, ঠিক মতো মন্তর পড়ে একটু জল-ফল…। বাবা কতবার বলেছিল পুজোটা শিখে নে। কষ্ট করে, চেষ্টা করে যদি ক’টা পুজো শিখে নিতে পারত…নামতা মুখস্থ ছিল কত…। একদম দশ অব্দি। এগারো-বারো, পনেরো। চেষ্টা করলে মন্তরও হয়ে যেত। কিছু একস্ট্রা ইনকাম করা যেত। বরানগরে তো কত লোক বলত পুরুত পাচ্ছি না, লক্ষ্মী পুজোটা করে দিন না…।
হরিপদর একটা মোবাইল ফোন আছে। ওর মালিকই দিয়েছে, মালিকের পুরানো একটা। দরকার হয়। বাইরে গেলে, দরকারে মালিকের ফোন আসে। হরিপদ করতে চায় না। ও মিস কল দিয়ে দেয়। এসব ওর ছেলে শিখিয়ে দিয়েছে।
ফোন করেই এল জয়রাম ভট্টাচার্য। পরনে পাজামা হাফশার্ট। পাজামা পরা পুরুত দেখে একটু মন খারাপ হয়ে গেল হরিপদর। ধুতি পরা পাবে কোথায়? সমাজবন্ধু যাকে পাঠিয়েছে তাকেই বোধ হয় নিতে হবে।
হরিপদ জিজ্ঞাসাই করল—ধুতি পরেন না?
পুজোর সময় পরি তো। ধুতি মেন্টেন করতে পারি না। মোটা ধুতিও দুশো টাকা, পাজামা একশো।
পুজোয় ধুতি পান তো…হরিপদ ধুতিতেই আটকে আছে।
—কমই পাই। বেশির ভাগই মূল্য ধরে দেয়। একশো টাকা। তা ছাড়া যে কাজ করি, ধুতিতে অসুবিধে।
—কী কাজ করেন?
—কোম্পানি আছে তো। মুক্তি আয়ুর্বেদ। গ্যাস মুক্তি, ব্যথা মুক্তি, কফ মুক্তি।
—তাহলে পুরুতগিরি করেন কেন?
—আরে, ওসব তো কবিরাজি। বৈঠকখানা থেকে শুকনো আমলকী, আদাসুঁট, যষ্টিমধু, পিপুল এসব এনে বাড়িতে গুঁড়ো করে প্যাকেটে ভরা হয়, হকাররা নিয়ে ট্রেনে বেচে। সেটা এখন বড় ছেলে দেখে। ওর হাতে ছেড়ে দিয়ে যজমানি করি। ব্রাহ্মণ সন্তান, পৈতে রাখি, ডিমান্ড আছে। ওটাও সুপারভাইজারি করি একটু। কবিরাজিও তো ব্রাহ্মণদেরই ছিল এককালে। আমার বাবার চেম্বার ছিল গোরুহাটায়। গো বদ্যিগিরি শিখেছিলাম। এখন তো গোরুই নেই এ চত্বরে। এত কথার দরকার কী আপনার। কাজ হওয়া নিয়ে কথা।
—সেটাই তো আসল কথা। বাবার কাজ। ওটা যেন ঠিকমতো…।
ভট্টাচার্য মশাই বলল—ও নিয়ে কিছু ভাববেন না। বহুদিন ধরে বহু শ্রাদ্ধের কাজ করেছি।
পার্বণ শ্রাদ্ধ, বাৎসরিক, তিল কাঞ্চন, এমনকী বৃষোৎসর্গও করিয়েছি। ও নিয়ে ভাববেন না। পিতা-পূর্বপুরুষকে যখন খুশি জল দান করা বিধেয়। ভূমৌ দত্তেন তৃপ্যন্তু তৃপ্তা যান্তু পরাং গতিং। শাস্ত্রে বলেছে— পিতাই দেবতা। পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম তো শুধু কথার কথা নয়, শ্রাদ্ধের মন্ত্রে বলেছে—ওঁ দেবতাভ্য পিতৃভ্যশ্চ মহাযোগীভ্য এ বচ, নমঃ স্বধায়ে নিত্যমেব ভবন্তিতি…।
সংস্কৃত মন্ত্র শুনেই বোধহয় হরিপদর মনে হল একে দিয়ে চলবে। হরিপদ বলল, তাহলে দিন ঠিক করুন। পাজামা পরা ভট্টাচায্যি মশাইয়ের কাঁধের সাইড ব্যাগে বেণীমাধব শীলের লাল মলাটের পঞ্জিকা ছিল। খুলে বলল, সামনের অমাবস্যাই প্রশস্ত।
এবারে ফর্দ।
পান, সুপারি, তিল, যব, বটগাছের ডাল, কুশ, পাটকাঠি, আতপচাল, গামছা—এসব ঠিকই ছিল, এরপর তাম্রতাট, পাদুকা, ব্র্যাকেটে ৬ নম্বর, হাওয়াই বাদে। ছত্র, জলপাত্র, শয্যা, কাংসপাত্র, রৌপ্যখণ্ড…বেশ লম্বা ফর্দ।
হরিপদ বলল, এত? একটু ছোট করে দেখুন না…।
ভট্টাচায্যি বলল—ছোট করার আমি কে? বড় করারই বা আমি কে? শাস্ত্রে যা আছে তাই লিখেছি। কাঁসা-পেতল-রুপো আজকাল আর কেউ দেয় না। ওসবের মূল্য ধরে দিলেই হবে। তবে তিনটে জিনিস নিজে কিনে দেবেন, পাদুকা, ছত্র আর তিল।
মূল্য ধরে দিলে কেমন পড়বে?
ষোলোশো পঞ্চাশ।
এত? দেখুন না কম করে হয় কিনা…
পঞ্চাশ বাদ দিন না হয়।
বারোশো করুন…।
আরে চারশো টাকা তো ওই নানুবাবুই নিয়ে নেবে। দিতেই হবে। নইলে কাজ করতে পারব না। আমার তো বারোশোই থাকবে। কী করি বলুন। সারা দিন উপবাস, আগের দিন সংযম, খাটনি কি কম?
আগের দিন বাজার-টাজার করা হল। পিণ্ডর জন্য ভালো চালই কিনল হরিপদ। গোবিন্দভোগ চাল। পাঁচ ব্রাহ্মণকে ভোজন করাতে বলেছিল পুরোহিত, ব্রাহ্মণ ভোজন মানেই আবার কতগুলো পদ তৈরি করতে হবে রেখার। পুরুতমশাই আছেন, আর ওরা চারজন। এই ফ্ল্যাটে আরও দুটো বামুন পরিবার আছে, আরও দুজন চাই। ভাগ্নে-টাগ্নে আছে, জ্ঞাতি ভাই, একজনকে বললে আর একজনকে বাদ দেওয়া যায় না। আর বললে একজনকে বলা যায় না, পরিবার নিয়ে আসতে বলতে হয়। এ তো যজ্ঞিবাড়ি হয়ে যায়। রেখা এত পারবে কী করে? আগের দিন ঠাকুরমশাইকে ফোন করেছিল হরিপদ। উনি বললেন—সমস্যা হলে বলবেন না। বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। আপনি নিজেই তো ব্রাহ্মণ, আপনার জানা উচিত। ব্রাহ্মণের অভাবে ষণ্ডকে, মানে ষাঁড়কে খাইয়ে দিন।
হরিপদ বলে, এটা আমি ঠিক জানি না। কজন ষাঁড় চাই? আপনি বামুন ছাড়া আরও চারটে?
—হ্যাঁ। চারটে না পেলে একটাকেই চারবার। একটা থালায় করে বেড়ে দেবেন।
—ভাত-ডাল-ভাজা-চাটনি, দই—এসব ষাঁড় খাবে তো?
—কেন খাবে না? তবে ওসব দেবার দরকার নেই, থালায় করে তণ্ডুল, কদলী, কিছু ফল সাজিয়ে দেবেন।
ও আচ্ছা, ও আচ্ছা করতে করতেই হরিপদর মনে হল—এ অঞ্চলে তো রাস্তাঘাটে ষাঁড় দেখেনি কখনও। বরানগরে কিন্তু ষাঁড় ঘুরত। ধর্মের ষাঁড়। এখানে ষাঁড় কোথায় খুঁজতে যাবে? মনে হতেই বলে ফেলল, ঠাকুরমশাই, আপনার জানাশোনা ষাঁড় আছে? ঠাকুরমশাই মোবাইলে উত্তর দিলেন— ষাঁড়? আছে তো…। নানুবাবুই তো একটা সাক্ষাৎ ষাঁড়। ষাঁড় ছাড়া কী বলব? ফোকটে খায়। শালা তোলাবাজ। বলে ফেললাম মনের কথা। আচ্ছা বলুন তো, লোকের বাড়ি কাজ করে ওকে কেন টাকা দিতে যাব, এতে আমার আপনার সবারই তো ক্ষতি। বলতে যাবেন না যেন, নানুবাবুর কীর্তিকাহিনি শুনবেন?
হরিপদর মাথায় তখন সেকেন্ড মিনিটও ছিল। ফোনটা তো হরিপদই করেছে। যত কথা বলবে, তত পয়সা। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। হরিপদ আসল কথায় যায়। ষাঁড় যদি একটাও না পাই, তাহলে কী করব? গোরুকে খাওয়ালে হবে?
—কাককে খাইয়ে দেবেন।
আচ্ছা। আচ্ছা। ঠিক আছে। ফোন কেটে দিল হরিপদ। সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। ব্রাহ্মণের চেয়ে কাক ভালো। বামুন খাওয়ালে আবার দক্ষিণা দিতে হয়—ভোজন দক্ষিণা। কাককে দক্ষিণা দিতে হয় না।
বামুনকে খাওয়ালেই কেন আত্মার তৃপ্তি হয় কে জানে। বামুনের বদলে কায়েত বদ্যি কিংবা মুচি মেথরকে খাওয়ালে হয় না? বামুনরাই এইসব নিয়ম বানিয়েছিল।
কিন্তু যে বলে, আত্মার তৃপ্তি-অতৃপ্তি বলে কিছু নেই। গীতায় নাকি আছে আত্মাকে কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না, নৈনং ছিন্দন্তি, বাসাংসি জীর্ণানি কীসব বলতেন বাবা। আত্মা হল সুখ-দুঃখের ওপারে। সুখও নেই, দুঃখ নেই। আত্মার তৃপ্তিটা তা হলে কী? আর আত্মা কি ঘুরে বেড়াচ্ছে? আত্মা তো হয় স্বর্গে নয় নরকে চলে গেছে, সেখানে আবার নতুন বডি পেয়ে গেছে। নাকি অন্য জন্ম হয়েছে। জন্মান্তর বলে না? আবার জন্ম হয়। নতুন জন্মে মানুষও হতে পারে, হাতিও হতে পারে আবার পিঁপড়েও হতে পারে। হাতি-পিঁপড়ে যাই হোন না কেন, উনি তো নতুন জন্মে যা খাবার খাচ্ছেন। এই গোবিন্দভোগের চালের তিল মাখানো পিণ্ডিটা কী কাজে লাগবে? যদি স্বর্গেই থাকেন, ওখানে তো স্বর্গের ভালো ভালো খাবার। স্বর্গে তো অনন্ত সুখ। কে জানে? শাস্ত্রে আছে, সবাই করে, তাই করতে হয়। কিছু একটা তো আছেই। হয়তো নতুন জন্ম হতে কিছুটা টাইম লাগে। সেই সময়টা আত্মা ঘুরে বেড়ায়। অত বুঝে কাজ কী? বাবার কথা মনে পড়েছে, বাবাকে স্মরণ করে একটু জল দেওয়া, এই তো। পুরুত যা বলে—মানতে হবে। ব্যাস।
সকালে স্নান-টান করে, কলাপাতা কেটে, বাবার ছবিটা মুছে চেয়ারে রেখে ফুলের মালা লাগিয়ে হরিপদ রেডি। ভট্টাচায্যি মশাই এলেন। ওঁ স্বস্তি ওঁ স্বস্তি করে আসনে বসলেন। ধূপকাঠি জ্বালালেন। কুশ, পাটকাঠি, তিল, যব এসব সাজিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বটগাছের ডাল? এইরে! এটা তো আনা হয়নি। দশকর্মার দোকানে তো বটগাছের ডাল থাকে না। ভেবেছিল ভোরবেলা খুঁজে পেতে নিয়ে আসবে। কিন্তু এক্কেবারে ভুলে গেছে। হরিপদর ছেলে তখন বাথরুমে। নিজেই গেল। কতক্ষণই বা লাগবে।
বেরিয়ে ডানদিকে একটা বটগাছ চোখে পড়ল। গেল। বটগাছের গায়ে টিনের পাতে ‘ঘরে গিয়া ফুল বডি মেসেজ করা হয়’ সাঁটা। ‘স্পোকেন ইংলিশ মিসেস দত্ত’ সাঁটা। কয়েকটা ডালে পতাকা ঝুলছে। কিন্তু ডালগুলো বড্ড উপরে। হাতের নাগালের বাইরে। একটা লগি বা আঁকশি থাকলে ভালো হত। একটা রিকশওলাকে বলল, একটা ছোট দেখে বটের ডাল পেড়ে দেবে ভাই? রিকশওলা বলল, আমার হাত কি আপনার হাতের চেয়ে লম্বা নাকি? হরিপদ বলল, তা কেন? একটা লাঠি-টাঠি জোগাড় করে পেড়ে দাও না। বাবার শ্রাদ্ধে লাগবে। রিকশওলা বলল, তিরিশ টাকা লাগবে।
এ কী যুগ এল? মগের মুলুক? একটা বটের ডাল তিরিশ টাকায় কিনতে হবে? হরিপদর তখন মিষ্টির দোকানের সামনের বটগাছটার কথা মনে পড়ল, যেখানে গুজিয়া কিনতে গিয়ে গুরুপদর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। মিষ্টির দোকানটার নাম মিষ্টিমুখ। ওখানেই গেল। দেখল চাতালে উঠে দাঁড়ালে বটগাছের একটা ছোট ডাল ভেঙে নেওয়া যায়। চটিটা খুলল। চাতালে, বটগাছের গোড়ায় একটা বড় কালো গোল পাথর, দুটো ছোট। ফুল, গোড়ায় ধূপকাঠি গোঁজা। গোড়াটা সিমেন্টে বাঁধানো। চাতালে একটা ভালো গাঁজার কল্কেও পড়ে ছিল। চাতালে হাতটা ছুঁইয়ে কপালে ঠেকাল, তারপর চাতালে পা দিল। প্রথমে চিৎকার করে উঠল এক রিকশওলা। বেশি বয়স নয়। ও কাকা…কী হচ্ছে, মন্দিরে উঠছেন কেন?
হরিপদ বলল, একটা ডাল ভাঙব।
রিকশওলা রিকশ ছেড়ে সামনে এগিয়ে এসেছে। আরও দুটো লোক… আরও একটা। ভজা পাগলা, যে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে গান গায় ‘হরি হে মাধব চান করব না গা ধোব’ সেও চলে এল, বলল, তুই পাগল নাকি? একজন বলল, শিবের গাছের ডাল ভাঙা? ঠ্যাং ভেঙে দেব। হরিপদ ততক্ষণে নেমে গেছে। রিকশওলা ছেলেটি বলল, আমি ভাবছি লোকটা উঠছে কেন? বলে ডাল ভাঙব। শিবের গাছের একটা পাতাও ছিঁড়ি না…ডাল কী হবে? হরিপদ মুখ থেকে ভয় দূর করে মুখটা যতটা সম্ভব গম্ভীর করে বলল, পিতৃশ্রাদ্ধে এটা লাগে।
কীসের শ্রাদ্ধ? কে একজন বলল।
হরিপদ বলল, বাবার, বাবার শ্রাদ্ধ।
ইতিমধ্যে ৬-৭ জন লোক জড়ো হয়ে গেছে।
একজন বলল, ঢপ দিচ্ছে, ঢপ। বাবার শ্রাদ্ধ তো মাথা ন্যাড়া নেই কেন? তুকতাকে লাগে, তুকতাক। টিভিতে দেখেছি, ভৃগুমুনি বলছিল বটের ডালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে কারুর বাড়ির পিছনে পুঁতে দিলে কী যেন হয়…ক্ষতি করা যায়…হরিপদ এবার হাতজোড় করল। বলল না, ওসব তুকতাক নয়, বাবার শ্রাদ্ধ। মানে বাবার আত্মাকে একটু জল দিচ্ছি। বাড়ি চলুন, দেখুন পুরুত ঠাকুর বসে আছেন। মাইরি বলছি।
একজন বলল, যাক গে, ছেড়ে দে।
একজন বলল কখনও এখানে পা দিয়ে দাঁড়াবেন না। হরিপদ হ্যাঁ করে। একজন বলল, এটা পুজোর জায়গা। হরিপদ হ্যাঁ করে। একজন বলল, এই গাছের ডালপালা ভাঙবেন না। হরিপদ হ্যাঁ করে।
এবার হরিপদ অন্য বটগাছের সন্ধানে যায়। সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। কোথায় বটগাছ আছে মনে পড়ে না। ফেলে আসা ছোটবেলার কুঠিঘাটের পাশের বটগাছটার ঝুরি ধরে দোল খাওয়া, বিকেলের পাখির কাকলি, লাল বটফলের থোকা, দুপুরের ছায়া, বৃষ্টিভেজা বটপাতার গন্ধ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বরানগরের সব বটগাছগুলি চেনা, ওদের বাড়িটার গায়েও তো গজিয়েছিল একটা বটগাছ।
বটগাছ চাই। কোথায় বটগাছ? রিকশওলারা সব জানে। জিজ্ঞাসা করতে ভয় করে। তবু জিজ্ঞাসা করল। ভাই, বাবার শ্রাদ্ধ কিনা, বটের ডাল তো একটা লাগে। এদিকে কোথাও আছে, শিবঠাকুর ছাড়া?
রিকশওলা একটা চোখ ছোট করে বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলটা পিছন দিকে ধরে বলল, ওই দিকে যান।
রিকশটা নিয়ে নিলেই হত। ও আবার কত চেয়ে বসত কে জানে। তা ছাড়া এই মাত্র একটা অন্যায় করে আবার রিকশ চাপবে? যে রিকশওলাটা ওকে, এই মাত্র শাসন করল, ওকেই বলবে রিকশ চালাতে?—বলা যায়?
বুড়ো আঙুল দেখানো পথে হাঁটতে লাগল হরিপদ। একটু গেলে তেমাথা। বাজার যাবার পথ। এবার কোন দিকে? আন্দাজেই বাঁ দিকে ঘুরল। একটু পুরানো এলাকা মনে হল। একটা মাঠ মতো, প্রাচীর ছিল, ভেঙে পড়েছে, ভিতরে কয়েকটা গাছও আছে। নিম, হ্যাঁ, একটা অশ্বত্থ। বটের বদলে অশ্বত্থে কি চলে? কে জানে? পুরুতবংশের ছেলে হয়েও কিচ্ছু জানে না। কী লজ্জা। ওখানেই একটা টিনের পাতে লেখা দেখল—’কবর স্থান’। তা হলে তো হবে না। অশ্বত্থের ডাল যদি চলত, তা হলেও এখান থেকে কি ভাঙা যেত? কবর স্থান বলে কথা, উরি বাপরে। তা ছাড়া কবর তো মোসলমানদের। কবরস্থানের অশ্বত্থ গাছটা কি হিন্দু আছে আর? কবরের মাটির রসে গাছটা মোসলমানই হয়ে গেছে কিনা কে জানে। গাছ হিন্দু মোসলমান হয়?—তা হয় না। কিন্তু কবরস্থানের গাছের ডাল ভাঙলে কেউ যদি বকাবকি করে?
আরে, এখন ওসব ভেবে কী হবে?
বট না পেলে দেখা যাবে। বট-অশ্বত্থ তো একসঙ্গেই উচ্চারণ করে। বটের মতো অশ্বত্থ গাছের গোড়াতেও শিব লিঙ্গ থাকে। এগোয় হরিপদ। মাঠ বলে কিছু নেই। বাড়ি হচ্ছে। ছোট বাড়িই বেশি। লোকজন জমি কিনে নিজের বাড়ি করছে, দু-চারটে বড় বাড়িও হচ্ছে। লম্বা পিলার উঠেছে। এবার বুঝল এটা বাজারের রাস্তাটা। ঘুরে ঘুরে এসে পড়েছে। সামনেই একটা বটগাছ দেখতে পেল। এই রাস্তায় কতবার হেঁটেছে, কই, চোখে পড়েনি তো গাছটা। মাঝারি ধরনের, বেশি পুরানো নয়, এবং বটগাছের তলায় একটা ইটের পাঁজা। ইটের পাঁজাটাও খুব একটা উঁচু নয়। ওঠা যায়। ইটের পাঁজার ওপর উঠে দাঁড়ালেই বটের ডাল নাগালে পাওয়া যাবে। একেবারে যেন ওর জন্যই বটগাছের তলায় ইটের পাঁজাটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাস্তাটা এখানে সরু, তার অর্ধেকটাই ইটের পাঁজা। খালি ইট নয়, পাথরকুচি, বালি এসবও আছে। একটু দূরে পলিথিন খাটানো চায়ের দোকান, ওখানে বেঞ্চি পাতা রয়েছে। বেঞ্চিতে কয়েকটা লোক বসে আছে। হরিপদ একটা ঝুঁকে পড়া ডাল দেখে নিল। ওটা থেকেই আরও ছোট ছোট ডাল বেরিয়েছে। ইটের পাঁজার উপর উঠতে হবে। ক’টা ইট নামিয়ে নিয়ে একটা ধাপ মতো বানাল, এরপর পাঁজার ওপর উঠবে। আগে হলে লাফিয়ে উঠে যেতে পারত, সাতান্ন বছর বয়েস হয়েছে, এখন ইটের ধাপে পা দিয়ে তারপর হাতে ভর করে উঠতে হল। হাতের চাপে দুটো ইট পিছলে মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। পড়েও যেতে পারত। কোনওরকমে সামলে নিল। ইটের পাঁজার ওপর কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালে বেশ একটা পেরেছি পেরেছি ভাব হল। একটা ছোট ডাল হাতের নাগালের মধ্যে। ডালটা মুচড়ে ছিঁড়ে নিল। এবার ইটের পাঁজার ওপর থেকে লাফ দিল। লাফাতে গিয়ে আবার দু-তিনটে ইট রাস্তায় পড়ে গেল। একটা বোধহয় ভেঙেও গেল। ঠিক তখনই হরিপদ শুনতে পেল এই যে, এই যে কাকা দাঁড়ান। হরিপদর দেরি হয়ে যাচ্ছে, তবুও দাঁড়ায়।
অন্য একটা কণ্ঠস্বর—ইটগুলো ভেঙে দিয়ে চলে যাচ্ছিস কোথায়?
দু-তিনজন লোক এগিয়ে এল। অ্যাই শালা, তোর বাপের ইট? বলা নেই কওয়া নেই ইটের ওপর উঠে দাঁড়ালি? হরিপদ বলে ফেলল, রাস্তার ওপর রেখেছেন কেন? রাস্তা কি ইট রাখার জায়গা? বালি, পাথর, সব তো রাস্তার ওপরে।
বলার সঙ্গে সঙ্গে জামা চেপে ধরল একজন। আরে, এই ল্যাদকা আইন দেখাচ্ছে, শালা শুড্ডা বলে মারলাম না, নইলে এক্ষুনি কানের গোড়ায় একটা দিতাম। আইন দেখাচ্ছিস? চল থানায়। গাছের ডাল ভেঙেছিস কেন—শালা পরিবেশ আইনে ঢুকিয়ে দেব শালা।
আর একজন বলল, মেজোবাবুকে একটা ফোন কর তো, বল আমি একপিস নিয়ে যাচ্ছি।
হরিপদ বটের ডালটাকে বুকে চেপে ধরে বলল—বাবার শ্রাদ্ধর জন্য একটা বটের ডাল দরকার ছিল—ঠাকুরমশাই বলেছে…
হরিপদ শুনল বাপের শ্রাদ্ধর আগে তোর শ্রাদ্ধ হয়ে যাবে। শালা। ডালটা পেছনে ঢুকিয়ে দেব পুরো। আইন দেখাচ্ছে ক্যাওড়া। কিট্টুকে বলছে রাস্তায় মাল রেখেছে কেন? চ্যালেঞ্জ মারাচ্ছে। আ-বে, রাস্তা কি তোর বাবার?
হরিপদ দেখল তিনজন লোক বেড়ে পাঁচ-ছ-জন হয়ে গেল। একটা রিকশওলাও রিকশ দাঁড় করিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে গেল, একজন ওরই মতো বয়সের কেউ দুধের প্যাকেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হরিপদ একটু ভুল করে ফেলল। ‘রাস্তা কি তোর বাবার?’ প্রশ্নটার জবাবে বলে ফেলল, ‘না-না, রাস্তা তো সবার।’ সঙ্গে-সঙ্গে একটা হাত ওর জামা চেপে ধরল। দুটো ঝাঁকুনি দিল। আবার বাতেলা? রাস্তা সবার? রাস্তা আমার বে, গান্ডু, জোরে ঝাকুনি দিয়ে ধাক্কা দিল, ও পড়ে গেল, ওর জামা ছিঁড়ে গেল। হরিপদ দুধের প্যাকেট ধরা ভদ্রলোকটার দিকে অসহায় তাকাল। দৃষ্টিতে ভিক্ষা। কেউ প্রতিবাদ করছে না। কেউ একজন পা তুলে বলল—ফোট। একজন জিজ্ঞাসা করল—কোথায় বাড়ি, কোথায় বাড়ি এ্যাঁ? হরিপদ আবার ভুল করল। বলল ইন্দ্রবাটি।
একজন দাঁতে ঠোঁট চেপে বলল, ইন্দ্রবাটি…ইঁদুর বাড়ি, ইঁদুর বাড়ি, বল…ব্যাঁকা সাহার দু-নম্বরি কাজ… এলাকায় নতুন আমদানি…রস হয়েছে, রস বার করে দেব…ওঠ শালা, ওঠ, ক্ষমা চা…
হরিপদর এক হাতের মুঠোয় ধরা বটবৃক্ষশাখা। পড়ে গিয়েও হাতছাড়া করেনি ওটা। হরিপদ ক্ষমা চাইবার জন্য দুই হাত এক করে, দুই হাতের মাঝখানে জেগে আছে। বটগাছ। ও বটগাছ, বটবৃক্ষ, তোমায় সবাই মানে, ক্ষমা চাইব, কী অপরাধের ক্ষমা, কার কাছে ক্ষমা…। হরিপদ বলল—ক্ষমা চাওয়ার কী আছে, তিন-চারটে ইট ভেঙেছে, দাম দিয়ে দিচ্ছি, তিনটে ইটের দাম কত?
এবার একটা হাত হরিপদর মুখে এসে পড়ল। ঠোঁটে। মুখের ভিতরটা একটু নোনতা লাগল। পয়সা দেখাচ্ছিস শালা, ইটের দাম। ঘাড় ধরে ঝাঁকাচ্ছে কেউ, ইটের দাম? ইটের দাম দেখাচ্ছিস।
এই সময় ঘটঘট করতে-করতে একটা বাইক থেমে যায়। অ্যাই কী হল, কী হল অ্যা?
—আরে গুরুদা, গান্ডুটা ইট ভেঙেছে, বলছে রাস্তায় ইট রেখেছ কেন? আইন মারাচ্ছে। কার সঙ্গে পিয়াজি করছে এ বাঞ্চোত জানে না…।
হরিপদ দেখল গুরুপদ কর্মকার। হরিপদ জোড় হাত এবার ওর দিকে।
গুরুপদ বলল, তুই ছেড়েদে কিট্টু। আমি দেখছি। গুরুপদর গলাটা বেশ নরম হয়ে গেল। হরিপদকে জিজ্ঞাসা করল—কী হয়েছে দাদা?
হরিপদর দুই হাত তখনও জোড়া। ও বলল দোষ আমারই। আমি ইট ভেঙেছি, ওদের ক্ষতি করেছি…
—আবার উলটোসিধে কথা? তিনটে ইটের জন্য কিছু নয়, বড় বড় কথা…। ওদের একজন বলল।
—হ্যাঁ-হ্যাঁ…। আমি বাজে কথা বলেছি…। ঠোঁটের রক্ত চেটে নিয়ে হরিপদ বলল, রাস্তায় ইট রাখা নিয়ে বাজে কথা বলেছি…।
গুরুপদ বলল—কে কী করছে তা নিয়ে আপনার কী, কেন ওসব বলতে গেলেন, যাক, যা হবার হয়ে গেছে…।
হরিপদ বলল, না, আমি বলি না…কত কী দেখি, কিছু বলি না। আমার ওরকম স্বভাবই নয়। বলে ফেলেছি, বাবার একটু শ্রাদ্ধ করছি, বটের ডাল পাচ্ছিলাম না, মেজাজটা ঠিক ছিল না তাই…
—আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আরে, এ লোক ভালো। বাবা কবে মারা গেছে?
—হল অনেক দিন, আমি এমনি একটু জল দিচ্ছি, আত্মার শান্তি কামনায়…
—তাই নাকি? যান যান…বাড়ি যান। পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম। পিতার পরলোকের কাজ। যান, যান। কিট্টু, ছাইড়া দে। লোকটা ভালো, আমি চিনি, ইন্দুরবাড়িতে থাকে। যান দাদা যান…।
হরিপদ বুকে বটগাছটাকে আঁকড়ে গুরুর দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকায়।