ভেজা চপ্পল
এই বর্ষায় সর্বানন্দ খুব সর্দিকাশিতে ভুগল। একটু জ্বর জ্বরও হয়েছিল। মুঠো মুঠো প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে, বোতলের পর বোতল ব্রান্ডি গরম জল দিয়ে পান করে কোনও উপশম হল না।
কথায় বলে সর্দি চিকিৎসা করলে, ওষুধ খেলে সাতদিনে সারে; চিকিৎসা না করলে, ওষুধ-বিষুধ না খেলে সারতে এক সপ্তাহ লাগে কিন্তু পরিতাপের বিষয় এক সপ্তাহে বা সাতদিনে সর্বানন্দের সর্দি, কাশি, ঘুষঘুষে জ্বর ছাড়ল না।
সর্বাণী একটু খুশি হয়েছে। কারণ সর্বানন্দের নৈশ অভিযান বন্ধ হয়েছে, তবে সে বাসায় বসেই দেদার ব্র্যান্ডি পান করছে। তাতে অবশ্য সর্বাণীর আপত্তি নেই।
কিন্তু ক’দিন আর অকর্মার মতো বিছানায় শুয়ে থাকা যায়? এক সপ্তাহ ছুটি নেয়ার পর সর্বানন্দ অফিস যাতায়াত করছে। বৃষ্টি এখনও কম বেশি হয়ে যাচ্ছে, সর্বানন্দ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও হাতে একটা ছাতা রাখছে মাথা বাঁচানোর জন্য।
কিন্তু শুধু মাথা বাঁচানোই যথেষ্ট নয়। বৃষ্টি এলে পায়ের জুতো জোড়াও ভিজে যায়। সর্দিজ্বরে রোগীর পক্ষে ভেজা জুতো মারাত্মক। সর্বানন্দ চেষ্টা করে পায়ের জুতো না ভেজাতে। কিন্তু সব সময় সম্ভব নয়।
সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে মিনিবাসের জন্য ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় ধুমসিয়ে বৃষ্টি এল। সে কী জলের তোড়, একেবারে যাকে বলে ছাতাভাঙা বৃষ্টি।
অফিসের কাছের এই বাসস্টপটার অসুবিধে হল এর ধারে পাশে কোথাও মাথা গোঁজার জায়গা নেই। ফুটপাথ ধরে অন্তত একশো মিটার বড় কম্পাউন্ডওয়ালা পাঁচিল ঘেরা সাহেব কোম্পানির বাড়ি। তার পরেও কিছুটা ছুটে গিয়ে বড় রাস্তার মোড়। সেখানে দোকান-টোকান, গাড়িবারান্দা, ঢাকা জায়গা আছে।
জোর বৃষ্টি আসতে সর্বানন্দ মোড়ের দিকে ছুটল। একটু ছুটতেই হাওয়ার ঝাপটায় শৌখিন ছাতাটা উলটে গেল। সেই অবস্থাতেই দৌড়ে মোড়ে পৌঁছিয়ে সর্বানন্দ একটা গাড়িবারান্দার নীচে আশ্রয় পেল।
তখন জামাকাপড় ভিজে সপসপে। মাথার চুল দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। কিন্তু সবচেয়ে সঙ্গীন অবস্থা হয়েছে পায়ের জুতোজোড়ার। মোজা সুদ্ধ মোকাসিন জোড়া চিপলে অন্তত এক লিটার জল বেরোবে।
সর্বানন্দ বর্ষার ঝোড়ো, ঠান্ডা বাতাসে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আশঙ্কা করতে লাগলেন এখনই অধিকতর কম্প সহকারে জ্বর আসবে। এই সময়েই গাড়িবারান্দায় পিছন ফিরে তাঁর নজর গেল। এই ভিড়-ভাটার মধ্যে সেখানে চোখে গোল কাচের ভাঙা চশমা চোখে এক বুড়ো মুচি খুব মনোযোগ দিয়ে চপ্পল বানাচ্ছে। তার পিছনের দেয়ালেও পেরেকের সঙ্গে কয়েক জোড়া নতুন চপ্পল ঝুলছে।
পকেটের মানিব্যাগ বের করে সর্বানন্দ দেখলেন শ’দেড়েক টাকা আছে। তারপর চর্মকারের কাছ থেকে অনেক সমাদর করে এক জোড়া চপ্পল কিনে ফেললেন মাত্র পঞ্চাশ টাকায়।
চপ্পল কিনে পায়ের ভিজে জুতো মোজাগুলো খুলে ফেললেন সর্বানন্দ। তারপর হাতব্যাগ থেকে সেদিনের খবরের কাগজ বের করে ভেজা জুতো-মোজা তার মধ্যে জড়িয়ে ব্যাগে রেখে দিলেন। এবার খালি পায়ে নতুন চপ্পল পরে নিলেন।
বৃষ্টি ধরে এসেছে। একটা মিনিবাস এসে যেতে সর্বানন্দ তাতে লাফিয়ে উঠলেন। শুকনো পায়ে, নতুন চপ্পল পরে বেশ আরাম লাগছিল।
কিন্তু বিপত্তি হল বাস থেকে নামার সময়। আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। এখানেও বাসস্টপ থেকে নামার পর তাঁর বাড়ি প্রায় পাঁচ-সাত মিনিটের পথ। তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালালেন সর্বানন্দ।
একটু পরে খেয়াল হল পায়ে নতুন চপ্পল জোড়া রয়েছে। বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাবে। সামনে একটা বকুল গাছ আছে। সেই গাছের নীচে বৃষ্টির ঝাপটা কম, সেখানে দাঁড়িয়ে চপ্পল দুটো খুলে হাতে নিতে গেলেন সর্বানন্দ। এরপর এটুকু পথ খালি পায়েই হেঁটে যাবেন।
কিন্তু পায়ের থেকে চপ্পল খুলতে পারলেন না সর্বানন্দ। আঠার মতো আটকিয়ে গেছে চপ্পল জোড়া। ওপর দিকে পায়ের পাতা, নীচের দিকে পায়ের তলা সব আটকিয়ে গেছে চপ্পলের সঙ্গে।
বাড়িতে গিয়েও সুবিধে হল না। কিছুতেই চটি জোড়া পা থেকে খুলতে পারলেন না। তিনি আর সর্বাণী মিলে টানাটানি করলেন। তারপর সর্বাণীর বুদ্ধিমতো গরম জলের গামলায় পা দুটো চোবালেন তাতে বোধহয় ক্ষতিই হল, চপ্পল জোড়া আরও এঁটে আটকিয়ে গেল। তখন বিপরীত চিকিৎসা, ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে দু’পায়ের পাতায় ঘষা হল, বরফজলে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আধঘণ্টা ডুবিয়ে রাখা হল।
কিছু হল না। এক শিশি গ্লিসারিন, এক কৌটো নারকেল তেল পদসেবায় ব্যয় হল। কিছু হল না।
অবশেষে রাতে চপ্পল সুদ্ধ পায়ে সর্বানন্দ বিছানায় শুয়ে পড়লেন। এবং কী আশ্চর্য! সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সর্বানন্দ দেখেন সাপের খোলসের মতো চটি জোড়া পায়ের কাছে পড়ে আছে। সেগুলোকে অবশ্য পাদুকা বলে চেনা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে চামড়ার খেলনা নৌকো।