ভেক মহারাজ – নবনীতা দেবসেন
এক বনে এক ব্যাং ছিল। ব্যাঙের স্বভাব একটু মন্দ। ব্যাং বড্ড গুল মারতে ভালোবাসে। সেই ব্যাঙের পাশের বাড়িতে থাকত এব ব্যাং-খুকি। ব্যাং-খুকির খুব মিষ্টি স্বভাব, দেখতেও ভালো। সবুজে-সোনায় ঝকঝক করছে তার শরীরটি, গোলগাল, দিব্যি ছোটোখাটো। ব্যাং বাবাজির বেশ বড়োসড়ো চেহারা। কাদামাখা রংটি। আর গলার স্বরে কী বাহার! সেই ভীষ্মলোচন শর্মার মতো, আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লি থেকে বর্মা! মেঘ করুক-না-করুক ব্যাং বাবাজি মাঝে মাঝে গলাটার রেওয়াজ করে নিত। আর বনসুদ্ধ পশুপাখি ভাবত বুঝি বৃষ্টি হবে। ওর বাবা- মা ওকে বারণ করলেন, ওরকম করে না। ব্যাঙের তো মন খারাপ। বেশ জঙ্গলসুদ্ধ সব্বাইকে চমকে দিত, ‘বৃষ্টি হবে’ ভাবিয়ে সেটা বন্ধ হয়ে গেল। এবার সে ভাবতে বসল, নতুন কিছু করতে হবে।
সেই সময়ে ব্যাং-খুকি বেরুচ্ছিল, একটু যাবে ঝরনাতলায়, শ্যাওলা খেতে। ব্যাং বাবাজি তাকে ডেকে বলল—”ব্যাঙ্গমি, আমাকে বিয়ে করবে’ ব্যাং-খুকিকে আদর করে ব্যাঙ্গমি বলেছে— ব্যাং-খুকি তো খুব খুশি। কিন্তু অমন ভোঁতকা মতন দেখতে, আর গুলের রাজা, তাকে কী বিয়ে করা যায়?
ভুরু তুলে ব্যাং-খুকি বলল, ‘তোমাকে যে বিয়ে করব, তোমার পাত্র হিসেবে কী কী গুণ আছে?’ হেসে উঠে ব্যাং বললে—’গুণ? এই জঙ্গলের সবচেয়ে বলবান জন্তু তো আমিই! আর কী গুণ চাও?’
ব্যাং-খুকি হেসে ফেলল।
—’আর বাঘ-দাদু?। বাঘ-দাদুর চেয়েও তুমি বেশি বলবান?’
—হ্যাঁ হ্যাঁ। ‘তুমি প্রমাণ চাও? আনব বাঘ-দাদুকে? ঠিক আছে, দিন পনেরো সময় দাও। এটা তো কৃষ্ণপক্ষ, শুক্লপক্ষ পড়লেই প্রমাণ দাখিল করব।’ ব্যাং-খুকি তাতে রাজি হয়ে গেল। ব্যাং বেচারা এত বড়ো গুল দিয়ে ফেলেছে এখন, জীবনেও তা প্রমাণ করতে পারবেন না।
সেই বনে বাঘ-দাদুই ছিল সবচেয়ে পুরোনো আর সবচেয়ে মানী জন্তু। এবং সবচেয়ে হিংস্রও বটে। বাঘ-দাদুকে সক্কলে ভয় পেত। আশপাশের গ্রামের মানুষরা পর্যন্ত। বাঘ-দাদু বুড়ো হয়েছে তো, এখন মাঝে মাঝে গ্রামের মধ্যেও শিকার ধরতে যায়। গোরু, ছাগল ধরে আনে। মানুষ ধরে না। বাঘ-দাদু সেদিন রোদ্দুরে বসে জিব দিয়ে চেটে চেটে গায়ের সোনালি আর কালো ডোরাগুলি পালিশ করছিল। এমন সময়ে সেখানে হাজির হল … কে? কে আবার? ব্যাং বাবাজি।
ব্যাং বাবাজি বললে—’পেন্নাম হই বাঘ-দাদু। ভালো আছেন? ডোরা তো খুব ঝকঝক করছে।’
বাঘ তো অবাক। ব্যাং ছোকরার এত সাহস, সেধে সেধে বাঘের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে? সারাটা বনে খুব দরকার না-হলে কেউ বাঘ-দাদুকে বিরক্ত করে না। বাঘ বললে—’হ্যাঁ ভালো। তুমি ভালো তো? কী করছ আজকাল?’
—’আজকাল আমি তো যোগব্যায়াম অভ্যাস করছি। আমার গায়ে এখন দারুণ জোর। কিন্তু আপনার মতো নয়। আপনি তো সবই পারেন। বাঘ-দাদু বলে কথা। আপনার মতো বলবান এই বনে আর কেউ নেই।’
বাঘ তো প্রশংসা শুনে খুব খুশি। কথাগুলো মিথ্যে নয়। স্তুতিবাক্য বটে, কিন্তু সত্যি কথা। বাঘ গোঁফে তা দিয়ে বললে—’তা বটে।’
ব্যাং বললে—’এই যে বড়ো পাথরটা। আমি যদি এটাকে গড়িয়ে দিই নীচে, আপনি এক্ষুনি নীচে সেটাকে আটকে দিতে পারবেন।’
বাঘ বললে—’না ভাই, তা পারব না। আমি তো বুড়ো হয়েছি, আমার শক্তিতে কুলোবে না। পাথরটা খুবই বড়ো।’
ব্যাং বললে—’কেন দাদু? এমন কিছু তো বড়ো নয়?’
—’বড়ো নয়?’ বাঘ এবারে চটে গেল। —’বড়ো নয় তো তুমিই যাও না, ওটাকে আটকাও। আমি গড়িয়ে দিচ্ছি।’
ব্যাং অম্লানবদনে বলল, ‘বেশ তো।’
বলেই সে লাফিয়ে লাফিয়ে নদীর ধারে নেমে চলে গেল, এমন একটা জায়গায়, যেখানে পৌঁছোলে পাথরটা আপনিই থেমে যাবে ঝোপঝাড়ে আটকে।
বাঘ তো পাথরের চাঁইটা হেঁইও হেঁইও করে গড়িয়ে দিল। গড়গড়িয়ে নেমে গিয়ে পাথরও দিব্যি আটকে গেল তার জায়গামতো। ব্যাং বাবাজি একলাফে পাথরের ওপরে চড়ে বসে বললে—’এই তো! দেখলেন তো দাদু? কত সহজ? আর আপনি ভয় পেলেন।’
বাঘের ভয় পাওয়া?
বাঘ-দাদু আবার চটে গেল।
—’দে তবে, আরো বড়ো পাথরটা গড়িয়ে দে, আমি আটকাচ্ছি।’ বলে নীচে গিয়ে দাঁড়াল। ব্যাং আরো বড়ো পাথরটা গড়িয়ে দিল—কিন্তু বাঘ তো ব্যাঙের মতো নদীতীরের আটঘাট জানে না। সে ভুল জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। পাথর তো এসে বাঘকেসুদ্ধ নিয়ে জলে গিয়ে পড়ল! ঝপ—ঝপাং! খানিকক্ষণ বাদে জলকাদা মেখে কপালে এতবড়ো গুল্লি ঢিপি নিয়ে (পাথরের ঠোকা খেয়েছে কিনা!) তো বাঘ-দাদু হাঁচোড়-পাঁচোড় করে পাড়ে এসে উঠল। ব্যাং সেখানে বসে আছে।
—’বাঘ-দাদুর লাগেনি তো?’
—’তা একটু লেগেছে বইকি। নাঃ, তোর গায়ে আমার চেয়ে ঢের বেশি জোর দেখছি। আমাকেও এবারে যোগব্যায়ামটা শিখতে হবে।’
—’বাঘ-দাদু, এই কথাটা আপনি ব্যাং-খুকিকে বলে দেবেন? ও বিশ্বাস করছে না যে আমিই এই বনের সবচেয়ে শক্তিমান প্রাণী।’
বাঘ-দাদু বললে—’হ্যাঁ, কেন বলব না? তবে মাত্র একটা পরীক্ষাতেই কী সেটার শেষ কথা প্রমাণ হয়ে যায়?’
—’বেশ, তবে আসুন আমরা দৌড়ের পাল্লা দিই?’
—’চলো, দৌড়োনো যাক।’
বাঘ আর ব্যাং ঠিক করল এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় পর্যন্ত দৌড়োবে।
—’রেডি স্টেডি, গো।’
দুজনে ছুট লাগাল।
এদিকে ব্যাং করেছে কী, লাফিয়ে বাঘেরই লেজে উঠে লেজ কামড়ে বসেছে। বাঘ যখন ও পাহাড়ে পৌঁছে থামল, ব্যাং এক লাফে তার সামনের পাথরে চড়ে বসে বলল, ‘এই যে বাঘ-দাদু আসুন আসুন—খুব ক্লান্ত কি? একটু জল এনে দেব? একটু বাতাস করব? আহা—’
—’তুমি তো ক্লান্ত নও! কী ব্যাপার?’
—’আমি তো ক-খ-ন পৌঁছে গেছি। তখন আমিও ক্লান্ত ছিলাম। এখন তো বিশ্রামের পরে আমাকে দেখছেন।’
বাঘ একেবারে অবাক।
এইটুকু ব্যাং, তার গায়ে এত শক্তি!
বাঘ বললে—’নাঃ, সত্যি তুমি প্রবল পরাক্রান্ত, কিন্তু তোমার পেটে কতটা জায়গা? আমি বমি করে দেখাতে পারি কালই কত কী পশুপ্রাণী খেয়েছি, তার চিহ্ন—তুমিও দেখাও, তুমি কাল কী কী খেয়েছ তার প্রমাণ—’
ব্যাং বললে—’নিশ্চয়, নিশ্চয়, এ আর এমন কী ব্যাপার? আসুন আমরা কম্পিটিশন দিই।’
এদিকে হয়েছে কী আসার সময়ে বাঘের লেজ কামড়ে থাকার সময়ে ব্যাঙের মুখের মধ্যে প্রচুর বাঘের লোম ঢুকে গেছে—ব্যাঙের মাথায় দুর্বুদ্ধির তো সীমা নেই!
বাঘ বমি করে বললে—’এই দ্যাখো, আমি কাল শম্বর হরিণ খেয়েছি তার শিং। এই দ্যাখো। আমি আজই শজারু খেয়েছি, তার কাঁটা আর, এই দ্যাখো, দুটো খরগোশ খেলুম, তার লোম।’
ব্যাং বললে—’বাঘ-দাদু, আজ আমার এখনও খাওয়া হয়নি—যোগব্যায়াম করছি তো, তিনদিন কিছুই খাচ্ছি না। কিন্তু দিন তিনেক আগে আমি আপনার ঠাকুরদা ঠাকুমাকে খেয়ে এসেছি। এই দেখুন তাদের লোম!’
বলে বাঘের লোম বমি করে দেখাল।—দেখে তো বাঘ ভয়ে কাঁটা।—’অ্যাঁ! সত্যি তো! আমার ঠাকুরদা ঠাকুমাকে তাহলে তুমি খেয়েছ? তবে তো আমাকেও খেতে পারো!’ এই বলে বাঘ-দাদু লেজ তুলে দে—দৌড়-দে-দে দৌড়। বনসুদ্ধ সবাই। সেই বনের সব প্রাণী, সব পশুপাখি স্বচক্ষে দেখতে পেল বাঘের এই পলায়ন।
ব্যাং তখন ব্যাং-খুকিকে গিয়ে বললে, ‘কি গো ব্যাঙ্গমি, এবার আমাকে বিয়ে করবে তো? দেখলে তো কার গায়ে জোর বেশি?’ আকাশে সেদিন শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো ঝলমল করছে। একগাল হেসে ব্যাং-খুকি বললে—’হ্যাঁ, ভেকমহারাজ।’
সেই থেকে ওই জঙ্গলে সকলের কাছে ওই ব্যাঙের নাম হয়ে গেল ভেকমহারাজ। (ভেক মানে ব্যাং। ভেক-এর অন্য একটা মানে জানো তো? ছদ্মবেশ। আরও একটা মানে আছে, মেঘ)।