ভৃগু ও পুলোমা
মহর্ষি ভৃগু ডাকলেন—পুলোমা!
স্বামী ডাকছেন, মহাতপা আর্য ভৃগু, পুলোমার স্বামী।
—আদেশ করুন আর্য।
পুলোমা ব্যস্ত হয়ে, অন্য কাজ ফেলে রেখে ভৃগুর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। স্বামীর আহ্বানে এমন ক’রে সাড়া দেওয়াই ধর্মপত্নীর কর্তব্য। আর্যের সংসারে বিবাহিতা নারীর এই রীতি।
ভৃগুর সংসারে কর্তব্যই সবচেয়ে বড় বিধান। মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে পুলোমার জীবন ভৃগুর জীবনের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই সংসারে দুজনের কেউ কখনও কর্তব্য বিস্মৃত হয় না। ভৃগু তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্তব্যে পুলোমাকে স্মরণ করেন, পুলোমাও ভৃগুর প্রতিটি অনুরোধ ও আহ্বানে সাড়া দেয়।
শুধু পুত্রার্থে ভার্যা গ্রহণ করেছেন ভৃগু। তাঁর সেই সংস্কার সফলও হতে চলেছে, কারণ পুলোমা এখন অন্তর্বত্নী। পুলোমার জীবনে মাতৃত্বের আবির্ভাব আসন্ন হয়ে উঠেছে।
পুলোমাও তার জীবনের উদ্দেশ্য সার্থক হয়েছে বলে মনে করে। সমাজে ভৃগুজায়ারূপে পুলোমা যে গৌরব অনুভব করে, ভৃগুসন্তানের মাতারূপে তার সেই গৌরব এইবার আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। যিনি আর্য ঋষির ধর্মপত্নী, তাঁর জীবনে এই তো ধন্য হওয়ার মত ঘটনা।
পুলোমা কাছে এসে দাঁড়াতেই ভৃগু বলেন—আমি স্নানে চললাম পুলোমা।
পুলোমা বলে—আসুন।
ভৃণ্ড চলে যাবার পর, ঠিক পূর্বের মত আবার গৃহকর্মে মন দিতে পারে না পুলোমা। হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনা হয়ে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু আজ নয়, এবং স্বামীর এই ক্ষণকালের অন্তর্ধানের জন্যও নয়, মাঝে মাঝে কে জানে কিসের জন্য হঠাৎ অন্যমনা হয়ে যায় পুলোমা। পুলোমা নিজেও তার এই বৈচিত্ত্যের অর্থ বুঝতে পারে না।
পুলোমার এই আকস্মিক অন্যমনা আবেশ লক্ষ্য করেন একজন, বৃদ্ধ হুতাশন। ভৃগুর কুটীরে গৃহরক্ষকরূপে রয়েছেন হুতাশন। পুলোমার শিশুকাল থেকেই পুলোমাকে তিনি জানেন। পিতার আলয়ে যতদিন যেভাবে কুমারী-জীবন যাপন করেছে পুলোমা, তার সকল ইতিহাস জানেন হুতাশন। আজ স্বামিগৃহে ঋষিবধূ হয়ে যেভাবে জীবনযাপন করছে পুলোমা, তাও প্রত্যক্ষ করেন হুতাশন। তাই, আর কেউ নয়, শুধু বৃদ্ধ হুতাশন লক্ষ্য করেন, পুলোমা মাঝে মাঝে অন্যমনা হয়ে যায়।
—পুলোমা!
চমকে ওঠে ভৃগুপত্নী পুলোমা। নাম ধ’রে কে যেন ডাকছে মনে হয়। কিন্তু এই কণ্ঠস্বর ধর্মপতি ভৃগুর কণ্ঠস্বর নয়, গৃহগুরু হুতাশনেরও নয়। তবু মনে হয়, যেন এক পরিচিত কণ্ঠস্বর। অতীতের এক বিস্মৃত স্বপ্নলোক থেকে যেন এই আহ্বান ভেসে এসে পুলোমার চেতনার দ্বারে আঘাত করছে। যেন সমাজ সংস্কার ও কর্তব্যের পরপার থেকে বুকভরা আকুলতা নিয়ে এক তৃষ্ণাতুর অনিয়ম পুলোমাকে সারা জগতে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এতদিনে সে এসে পৌঁছেছে।
বুঝতে পারে পুলোমা, হ্যাঁ, সে-ই এসেছে। ভৃগুপত্নী পুলোমার সেই কৈশোরের নর্ম-সহচর, প্রথম যৌবনের প্রণয়াস্পদ এক অনার্য তরুণ, তারও নাম পুলোমা। সনাম সখা অনার্য পুলোমা তার প্রথম প্রেমের অধিকার নিয়ে আজ পুলোমার পতিব্রত জীবনের দ্বারে এসে কঠিন পরীক্ষার মূর্তি ধ’রে দাঁড়িয়েছে।
তরুণী পুলোমার অনুভবের জগতে যেন বহুদিনের বন্ধনে আবদ্ধ এক ঝঞ্ঝাসমীর হঠাৎ পথ খোলা পেয়ে আবার উদ্বেল হয়ে ওঠে। ঋষির সংসারে কর্তব্যচারিণী নারী-মূর্তিকে এক নির্বাসিত বসন্ত দিনের সৌরভ এসে জড়িয়ে ধরেছে। সুন্দরী পুলোমার দেহ ব্যাকুলা মাধবী বল্লরীর মত সেই স্পর্শে চঞ্চল হয়ে ওঠে।
অনার্য পুলোমা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তার প্রথম প্রণয়ভাগিনী ও জীবনবাঞ্ছিতা পুলোমার সম্মুখে দাঁড়ায়।
অনার্য পুলোমা প্রসন্ন স্বরে আহ্বান জানান—এস পুলোমা।
আর্যা পুলোমা সন্ত্রস্তভাবে বলে—কোথায়?
অনার্য পুলোমা—আমার সঙ্গে, আমার জীবনে।
আর্যা পুলোমা তার হৃদয়ের চাঞ্চল্য সংযত ক’রে বলে—কোন্ অধিকারে তুমি আজ এই ভয়ংকর আহ্বান নিয়ে ঋষিবধূর কুটীরের কাছে এসেছ অনার্য?
অনার্য পুলোমা বলে—তোমাকে ভালবেসেছি, এই অধিকারে।
আর্যা পুলোমা—কিন্তু আমি কোন্ অধিকারে তোমার কাছে যাব?
অনার্য পুলোমা—প্রেমিকা হয়ে বেঁচে থাকবার অধিকারে।
অনার্য পুলোমার ক্লান্ত মুখচ্ছবি দুঃসহ এক জ্বালাময় আবেগে তপ্ত হয়ে ওঠে। আর্যা পুলোমার আরও কাছে এগিয়ে এসে স্পষ্টতর ভাষায় বলে—আমি ঋষি নই, আর্য নই, তপস্বীও নই। আমি শুধু প্রেমিক। আমি পুত্রার্থে তোমাকে চাই না পুলোমা, তোমারই জন্য তোমাকে চাই।
যেন ভক্তের স্তবসঙ্গীতের মত ধ্বনিত হয়েছে এই অভিনব ভালবাসার তত্ত্ব, এই ভয়ানক আবেদন। অনার্য প্রেমিক যেন অদ্ভুত এক অহেতুক প্রেমের অর্ঘ্য দিয়ে অহমিকাময়ী পুলোমাকে মহীয়সীর সম্মান দান করছে। যেন জগতের জন্য পুলোমা নয়, পুলোমার জন্যই এই জগৎ। কন্যা নয়, বধূ নয়, মাতা নয়, শুধু নারীরূপে তরুণী পুলোমার ভিন্ন একটি সত্তা যেন আছে এবং সেই সত্তা উপেক্ষায় অনাদৃত হয়ে পড়ে আছে। অনার্য পুলোমা আজ নারীর সেই সত্তার কাছে অনন্ত সমাদরের উপঢৌকন নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এই আবেদনের দুর্বার এক শক্তি আছে।
অনার্য পুলোমা বলে—আমার আকাঙক্ষা তোমার মধ্যেই সম্পূর্ণ; তোমার বাইরে নয়, তোমার অতিরিক্ত নয়। আমার সমাজ সংসার জগৎ সবই তুমি। তুমি আমার প্রেমের প্রথমা, তুমি আমার প্রেমের অন্তিমা।
আর্যা পুলোমার মনে হয়, এই ঋষির কুটীরে তার আত্মা বন্দিনী হয়ে রয়েছে। মাত্র পুত্রার্থে গৃহীত ভার্যার সম্মান নিয়ে, নিতান্ত এক প্রয়োজনের উপচাররূপে এই ঋষিকুটীরে সে স্থান লাভ করেছে। তার বেশি কোন গৌরব এখানে নেই। এই জীবন শাস্ত্রসম্মত ও সমাজসম্মত, কিন্তু হৃদয়সম্মত নয়।
আর্যা তরুণীর, ঋষিবধূ পুলোমার সব প্রতিবাদের শক্তি ঐ অনার্য আবেদনের টানে দূরান্তরে ভেসে যায়। তবু শেষবারের মত নিজেকে সংযত করে পুলোমা। ভীতা অথচ প্রলুব্ধা বিহঙ্গীর মত যেন আকাশভরা অবাধ পবনের ঝঞ্ঝার দিকে তাকিয়ে বলে—না পুলোমা, আমাকে ধর্মের বাইরে যেতে বলো না।
অনার্য পুলোমা বিস্মিত হয়—ধর্ম কি?
আর্যা পুলোমা—এই প্রশ্নের উত্তর দেবার সাধ্য আমার নেই।
অনার্য পুলোমা—কিন্তু আমি আজ এই প্রশ্নের উত্তর জেনে যাব পুলোমা ধর্ম কি?
আর্যা পুলোমা বিব্রতভাবে বলে—আমাকে জিজ্ঞাসা করো না। গৃহগুরু বৃদ্ধ হুতাশন রয়েছেন, তাঁরই কাছে গিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর শুনে নাও।
অনার্য পুলোমা—বেশ, চল, সংসারের সব ইতিহাসের সাক্ষী হুতাশনের সম্মুখে গিয়ে তুমি আমার পাশে একবার দাঁড়াও। তারপর আমি তাঁকে প্রশ্ন করব।
বৃদ্ধ হুতাশনের সম্মুখে গিয়ে দু’জনে দাঁড়ায়। অনার্য পুলোমা প্রশ্ন করে—ভগবান হুতাশন, আপনি একদিন আমাদের দু’জনকে দেখেছেন, জীবনের প্রভাতবেলায় আমরা দু’জনে যখন দু’জনের খেলার সাথী হয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলাম।
হুতাশন শান্তস্বরে বলেন—হ্যাঁ।
অনার্য পুলোমা—আজ আবার অনেকদিন পরে আমরা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছি। আপনি বলুন, এর মধ্যে বিসদৃশ কিছু দেখছেন কি? এর মধ্যে অন্যায় কোথায়? আপনি বলুন, ধর্ম কি?
হুতাশন—যা সত্য, তাই ধর্ম।
অনার্য পুলোমা—সত্য কি?
হুতাশন—ঘটনাই একমাত্র সত্য।
অনার্য পুলোমা—তবে বলুন, আপনার সম্মুখে এই যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুটি জীবনের মূর্তি, এর মধ্যে কি কোন সত্য নেই? প্রথম ভালবাসার অধিকার কি মিথ্যা? যাকে চিরজীবন ধ’রে অন্বেষণ ক’রে বেড়াই, তাকে জীবনের কাছে পাওয়ার দাবি কি মিথ্যা?
হুতাশন—না মিথ্যা নয়।
আর্যা পুলোমা বিস্মিতভাবে হুতাশনের মুখের দিকে তাকায়। এবং মুগ্ধভাবে তার কৈশোরের সখা অনার্য তরুণ পুলোমার মুখের দিকে তাকায়।
অনার্য পুলোমা আর্যা পুলোমার হাত ধ’রে বলে—এস পুলোমা!
হুতাশনের সান্নিধ্য থেকে দু’জনে ধীরে ধীরে চলে এসে ঋষিকুটীরের নিস্তব্ধ আঙ্গিনায় একবার দাঁড়ায়। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। অন্তঃসত্ত্বা ধর্মপত্নীর মূর্তি যেন মুহূর্তের মধ্যে এই সংসারের আঙ্গিনা হতে মুছে গিয়েছে। যেন তরুণী পুলোমার স্বপ্নলোক থেকে হঠাৎ জাগরিত এক প্রেমকেলিকামিনীর পিপাসিত বাসনার মূর্তি অনার্য পুলোমার হাত ধ’রে সংস্কার ও সমাজের বাইরে চলে যায়।
বনোপান্তের এক কুটীরে প্রবেশ ক’রে অনার্য তরুণের সহচরী আর্যা পুলোমা অনুভব করে, ধন্য এই প্রেমিকতার জীবন।
অরণ্যপুষ্পের সৌগন্ধ বাতাসে ছুটাছুটি করে, কিন্তু কি আশ্চর্য, তরুণী পুলোমা যেন আরণ্য কণ্টকে বিক্ষতদেহা হরিণীর মত বেদনাতুর দৃষ্টি তুলে আকাশপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রেমিকের শত সাগ্রহ প্রশ্নের কোন উত্তর দেয় না তরুণী পুলোমা। কোথা থেকে যেন বাস্তব সংসারের এক সংশয় এসে তরুণী পুলোমার অবাধ প্রেমিকতার জীবনে কঠিন প্রশ্নরূপে দেখা দিয়েছে।
অনার্য পুলোমার প্রশ্নে বিব্রত হয়ে আর্যা পুলোমা একদিন বলে—তুমি কি জান যে, আমি অন্তঃসত্ত্বা?
অনার্য পুলোমা—জানি।
আর্যা পুলোমা—ভৃগু ঋষির সন্তানকে আমি ধারণ করছি, তাও নিশ্চয় জান?
অনার্য পুলোমা—জানি।
আর্যা পুলোমা—কিন্তু এই সন্তানের জীবনে তার পিতৃপরিচয় চিরকাল অজানা হয়ে থাকবে।
অনার্য পুলোমা সান্ত্বনার সুরে বলে—কিন্তু পিতৃস্নেহ তার কাছে অজানা হয়ে থাকবে না। তাকে লালন করবার জন্য আমি আছি, কোন দুঃখ করো না, পুলোমা।
আর্যা পুলোমার কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ রূঢ় হয়ে ওঠে—দুঃখ না ক’রে পারি না। ঋষির সন্তান পৃথিবীতে অনার্য পুলোমার সন্তানরূপে পরিচয় বহন করবে, আমি আমার সন্তানকে, এতটা মিথ্যা ক’রে দিতে পারব না।
অনার্য পুলোমার উদ্বিগ্ন বক্ষের অস্থিনিচয় যেন বেদনায় দীর্ণ হয়ে যায়। ব্যর্থ স্বরে বলে—এ কি বলছ, পুলোমা?
আর্যা পুলোমা—পারব না, এত ভয়ংকর ধর্মহীন হতে পারব না। সন্তানের পরিচয় মিথ্যা ক’রে দিতে পারব না। সংসারের ভার্গবকে পৌলমেয় ক’রে দিতে পারব না।
অসহ এক অপমান যেন আকস্মিক বজ্রপাতের মত অনার্য পুলোমার সব প্রেমিকার গর্ব গৌরব ও প্রসন্নতাকে চূর্ণ ক’রে দেয়। অনার্য! অনার্য! অনার্য! আর্যা পুলোমার কাছে সে আজ হীনশোণিত এক প্রাণী ছাড়া আর কিছু নয়। প্রেমিকের স্নিগ্ধ অন্তরের চেয়ে তপ্ত জাতিশোণিত বেশি পূজনীয় বলে আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে এক আর্যা নারীর মন। অনার্য পুলোমা নিঃশব্দে মাথা হেঁট করে বসে থাকে।
হঠাৎ বিচলিত হয় অনার্য পুলোমার দুই চক্ষুর কৌতূহল। দেখতে পায় অনার্য পুলোমা, আর্যা পুলোমার সারা দেহ মন্থিত ক’রে এক অভিনব বেদনার ঝড় আকুল হয়ে উঠছে। সে বেদনায় আর্যা তরুণীর কমনীয় দেহ ভূতলে লুটিয়ে পড়ে।
—ভয় নেই পুলোমা, আমি কাছে আছি পুলোমা। অনার্য পুলোমা ব্যগ্রভাবে আর্যা পুলোমার একটি হাত ধরবার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
আর্যা পুলোমার জীবনের এক পবিত্র মুহূর্তে অশুচি এক স্পর্শ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আর্তনাদ করে আর্যা পুলোমা—দয়া ক’রে দূরে সরে যাও। ভৃগু ঋষির সন্তান আসছে, জন্মলগ্নের প্রথম মুহূর্তে তাকে আমি অপিতার দৃষ্টির সামনে তুলে ধরতে পারব না।
শান্ত দৃষ্টি তুলে অনার্য পুলোমা তারই প্রণয়াস্পদা নারীর এক কঠোর ধিক্কার শুনতে থাকে। না, আর কোন সন্দেহ নেই, আর্যা পুলোমা তার জীবনের সকল আগ্রহ দিয়ে আবার তার সমাজ ও সংস্কারকে ফিরে পেতে চাইছে। ভৃগুপত্নী পুলোমার সম্মুখে অনার্য প্রেমিক পুলোমার অস্তিত্ব একেবারে অর্থহীন।
দূরে সরে যায় অনার্য পুলোমা।
সূর্য অস্ত যাবার আগেই এক রক্তিম মুহূর্তে আর্যা পুলোমার সন্তান জন্মলাভ করে। কিন্তু শিশু ভার্গবের ক্রন্দনধ্বনি ছাড়া সেই কুটীরের বাতাসে আর কোন শব্দের চাঞ্চল্য জাগে না। সদ্যোজাত আর্য শিশুর প্রথম কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কুটীরোপান্তের তরুতলের ছায়ায় এক অনার্যের শেষ নিঃশ্বাস শেষ আর্তস্বর উৎসারিত ক’রে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মৃত্যু বরণ করেছে অনার্য পুলোমা।
তরুণী পুলোমা এক নবজাত শিশুকে ক্রোড়ে ধারণ ক’রে ভৃগুর আশ্রমের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর দাঁড়িয়ে থাকেন ভৃগু সেই প্রবেশপথে অটল নিষেধের প্রতিমূর্তির মত। এবং দাঁড়িয়ে থাকেন বৃদ্ধ হুতাশন, যেন ঘটনার আর এক সত্য দেখবার জন্য।
শ্লেষবিহসিত স্বরে প্রশ্ন করেন ভৃগু—আবার কোন্ স্বপ্নের দুঃসাহসে উৎসাহিত হয়ে আর্য ঋষির সংসারের দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছ, পুলোমা?
পুলোমা বলে—আমার স্বপ্নের আর কোন দুঃসাহস নেই ঋষি। আমি আপনারই পিতার সান্ত্বনায় উৎসাহিত হয়েছি।
ভৃগু—কি বললে?
পুলোমা—লোকপিতামহ ব্রহ্মা আমার প্রতি করুণাপরবশ হয়ে আমাকে আশ্বাস দান করেছেন। তিনি আশা করেন, তাঁর পুত্রও তাঁরই মত করুণাপরবশ হয়ে তাঁর পুত্রবধূর বেদনাকে বুঝতে পারবেন।
ভৃগু—পিতা ব্রহ্মা তোমার মত স্বাভিলাষ-প্রগল্ভা উদ্ভ্রান্তার প্রতি করুণাপরবশ কেন হবেন?
পুলোমা—উদ্ভ্রান্তার জীবনের বেদনাকে তিনি দেখতে পেয়েছেন। দেখেছেন লোকপিতামহ ব্রহ্মা, আমার জীবনের বেদনা অশ্রুনদী হয়ে আমাকে অনুসরণ করছে। আপনি জানেন না ঋষি, ঐ বনলোকের মৃত্তিকায় এখনও আমার অশ্রুনদীর সিক্ত চিহ্নরেখা ফুটে রয়েছে।
ভৃগু—শুনে বিস্মিত হলাম, পুলোমা। কিন্তু আমার আর একটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এই ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করো না।
পুলোমা—বলুন ঋষি; কি আপনার প্রশ্ন?
ভৃগু—কোন প্রসন্নতার আশায় এবং কিসের জন্য তুমি আবার এই ঋষিকুটীরের বন্দিনী হতে চাইছ?
পুলোমা তার ক্রোড়ের শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়—এরই জন্য, ঋষি।
ভৃগু—এই কথার অর্থ?
পুলোমা—আপনার সন্তানের পরিচয় আর জন্মগৌরব অক্ষুন্ন রাখবার জন্য। ঋষির ছেলেকে তাই ঋষির ঘরে নিয়ে এসেছি।
ভৃগু—ঋষির ছেলেকে ঋষির ঘরে রেখে দাও, তার স্থান এখানে আছে। কিন্তু তোমার স্থান নেই।
পুলোমা আতঙ্কিতের মত আর্তনাদ করে—ঋষি, এত বড় শাস্তি আমাকে দেবেন না।
ভৃগু—শাস্তি নয়, তোমার কর্তব্য তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। স্বেচ্ছায় ঋষিপত্নীর ধর্ম বর্জন ক’রে তুমি চলে গিয়েছিলে, তেমনি স্বেচ্ছায় ঋষিমাতার ধর্ম বর্জন ক’রে চলে যাও।
পুলোমা অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে। আজ পর্যন্ত জীবনে স্বেচ্ছায় সে অনেক কিছু করেছে। প্রথম যৌবনে স্বেচ্ছায় এক অনার্য তরুণকে ভালবেসেছে, স্বেচ্ছায় বিবাহিত জীবনের সংস্কারকে তুচ্ছ ক’রে প্রেমিকের আহ্বানে চলে যেতে পেরেছে। স্বেচ্ছাচারের শক্তি তার আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এই শিশুপুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আজ প্রথম উপলব্ধি করে পুলোমা, স্বেচ্ছাচারের শক্তি তার আর নেই। ঋষিমাতা হওয়ার সম্মান সৌভাগ্য ও সুযোগ হেলায় তুচ্ছ ক’রে চলে যাবার শক্তি তার নেই।
না, যেতে পারবে না পুলোমা, চলে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। সব অভিশাপ স্বীকার ক’রে, তার জীবনের ঋষিমাতা আর্যনারীর পরিচয় বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শুধু পুত্রার্থে, অন্য কিছুর জন্য নয়।
পুলোমা বলে—সেই অনার্য আপনার পুলোমাকে অপহরণ ক’রে নিয়ে গিয়েছিল। আমার ভুল, আমি তাকে বাধা দিতে পারিনি।
ভৃগু বিস্মিত হন—হুতাশন ঘরে থাকতে তোমাকে অপহরণ ক’রে নিয়ে যেতে পারে কোন্ দুরাত্মার এমন শক্তি আছে?
পুলোমা—হুতাশনের সম্মতি ছিল।
ভৃগুর বিস্ময় ক্ষমাহীন ক্রোধ হয়ে জ্বলে ওঠে—হুতাশনের সম্মতি ছিল?
পুলোমা—হ্যাঁ।
বৃদ্ধ হুতাশনের মুখের দিকে তাকিয়ে রূঢ় ও ক্রোধাক্ত স্বরে ভৃগু বলেন—আপনি বিশ্বাসহন্তা ও অধৰ্মচারী?
হুতাশন শান্তভাবে উত্তর দেন—না।
ভৃগু—আমি পুলোমার ধর্মপতি, পুলোমা আমার ধর্মপত্নী; এই সত্য কি আপনি জানেন না?
ভৃগু ও পুলোমা, দুজনের মুখের দিকে বৃদ্ধ হুতাশন একবার তাকিয়ে দেখেন তারপর বলেন—হ্যাঁ, সত্য।
ভৃগু—তবে আপনি কেন দুরাত্মা অনার্যকে ঋষিপত্নী অপহরণে সম্মতি দিলেন?
হুতাশন—তাও সত্যের জন্য।
ভৃগু ভ্রূকুটি করেন—সত্যের জন্য?
হুতাশন—হ্যাঁ, প্রেমের জন্য।
পুলোমার মাথা হেঁট হয়ে পড়ে, তার দুই চক্ষুর দৃষ্টি যেন শুষ্ক ধূলির আড়ালে লুকিয়ে পড়বার পথ খুঁজছে।
হুতাশন বলেন—জীবনের প্রথম প্রণয়, জীবনব্যাপী এক প্রেমিকতার তৃষ্ণা পুলোমাকে অপহরণ করেছিল ঋষি। সে ইতিহাস আমি জানি, আমি তার সাক্ষী, তাকে নিতান্ত মিথ্যা মনে করতে পারি না। আমি আপনাদের মত শিক্ষাগুরু নই, আপনাদের তত্ত্ব দিয়ে সত্য-মিথ্যার বিচারও আমি করি না। আমার কাছে ঘটনাই একমাত্র সত্য। ঘটনাকে আমি বাধা দিই না। যারা যাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল আর প্রস্তুত হয়েছিল, তাদের আমি যেতে দিয়েছি। যারা সম্মত হয়েই ছিল, তাদেরই কাজে আমি সম্মতি দিয়েছি। আমি যেমন প্রেরণা দিই না, উপদেশ দিই না ও প্ররোচিত করি না, তেমনি বাধাও দিই না।
কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থাকেন হুতাশন। তারপর রূঢ়ভাবে একেবারে স্পষ্ট ক’রেই বলেন—আপনি পুত্রার্থে পুলোমাকে চেয়েছেন, আর সেই অনার্য প্রেমিক পুলোমার জন্যই পুলোমাকে চেয়েছে। এই দুই চাওয়ার দ্বন্দ্বে তিনটি জীবনের জয়পরাজয়ের পরীক্ষা হয়ে গেল। সংসারে তারও সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি।
হুতাশন চুপ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দেখতে পেলেন, ভৃগু ঋষি রুষ্টভাবে প্রখর দৃষ্টি তুলে যেন তাঁকে বাচালতা সংবরণ করার জন্য সাবধান ক’রে দিচ্ছেন।
আরও মুখর হয়ে ওঠেন হুতাশন।—আপনি শুধু শাস্ত্র, এই তরুণী পুলোমা শুধু অহমিকা, আর সেই অনার্য শুধু প্রেমিকতা। আপনি হৃদয়ের ধর্ম বুঝতে পারেননি, তরুণী পুলোমা সমাজের ধর্ম বুঝতে পারেনি, আর সেই অনার্য নারীত্বের ধর্ম বুঝতে পারেনি। আপনারা জীবনে এক একটি ভ্রান্তিকে ভালবেসেছেন, ঘটনা তারই প্রতিশোধ নিয়েছে। আমি ঘটনার সাক্ষী মাত্র, যা দেখি তাই বলি। যা দেখেছি তাই বলে দিলাম, এর জন্য আমার এতটুকুও দুঃখ নেই।
পাষাণীভূত বৃক্ষের মত স্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ভৃগু। সকল রহস্য ভেদ ক’রে সমস্ত ঘটনার স্বরূপ যেন এতক্ষণে স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে, নিষ্পলক নয়নে তাই দেখছেন ভৃগু।
হঠাৎ, যেন এক ঝঞ্ঝাহত কাননের উৎক্ষিপ্ত পুষ্পের মত ভৃগুর পায়ে লুটিয়ে পড়ে তরুণী পুলোমা। বিচলিত হন ভৃগু। শান্ত স্বরে বলেন—কি বলতে চাও পুলোমা?
পুলোমা—আপনার এই আশ্রমের এক কোণে ঠাঁই পেতে চাই।
ভৃগু—কেন?
পুলোমা—ভার্গবের মাতা হবার গৌরব নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই, আর কিছু চাই না।
ভৃগুর দুই চক্ষুর বেদনাও যেন স্নিগ্ধ হাস্যে সুস্মিত হয়ে ওঠে।—শুধু পুত্রার্থে?
পুলোমা—হ্যাঁ ঋষি।
ভৃগু—আর কোন গৌরব আশা কর না?
পুলোমার কণ্ঠস্বরে কুণ্ঠাহত অভিমান উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।—আশা করবার সাহস হয় না।
নিবিড় দৃষ্টি তুলে পুলোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভৃগু। যেন পুলোমাকে নতুন ক’রে চেনবার চেষ্টা করছেন, চিনতে পারছেন। সুন্দর বিম্বাধরে ও ভ্রূলতায় রচিত এই মুখচ্ছবি, যৌবনে ললিত অঙ্গ, সদ্যোমাতৃত্বে কমনীয় দেহ, ভার্গবের জন্মদাত্রী, ভৃগুগৃহের গৌরবে গরবিনী পুলোমা। পুলোমাকে বুঝতে কোথায় যেন একটু ভুল থেকে গিয়েছিল, আজ ঘুচে গেল সেই ভুল। পুলোমাকে চেনা যেন এত দিনে সম্পূর্ণ হয়েছে। ভৃগুর মনে হয়, এই পুলোমা অপহৃত হয়নি। অপহৃত হয়েছিল পুলোমার এক অভিমান।
ভৃগু বলেন—কিন্তু আমি যদি বলি, শুধু ভৃগুবধূ হয়ে নয়, ভৃগুপ্রিয়া হয়ে তুমি আমার জীবনে নূতন গৌরব এনে দাও; যদি বলি, আজ আমি শুধু পুত্রার্থে নয়, তোমারও জন্য তোমাকে চাই পুলোমা?
—স্বামী! অকস্মাৎ যেন এক তৃপ্ত স্বপ্নের উল্লাসে বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় পুলোমা।
হৃদয়ের সকল আগ্রহ নিয়ে একটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভৃগু ঋষি পুলোমার হাত ধরলেন—হ্যাঁ, তুমিই আমার প্রিয়া ধর্মপত্নী।
বৃদ্ধ হুতাশনের দৃষ্টি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কৃতার্থভাবে বলেন—আপনার শাস্ত্রসঙ্গত সংসারে এই হৃদয়সঙ্গত দৃশ্য দেখবার জন্যই বোধ হয় আপনার কুটীরে এতদিন ছিলাম ঋষি। আমার সে আশা সফল হলো। এখানে আমার কাজ ফুরিয়েছে, এইবার আমাকে বিদায় দিন ঋষি।
হুতাশনের কথা শুনে কি যেন চিন্তা করেন ভূগু। তারপর বলেন—আপনি সংসারের সাক্ষী, সত্য কথা শুনিয়ে দেন, আপনার এই মহত্ত্ব স্বীকার করি হুতাশন। কিন্তু আপনিও একটি ভুল করেছেন।
হুতাশন—কি?
ভৃগু—আপনি আমার গৃহের রক্ষক ছিলেন, গৃহের আলোকরূপে আপনাকে আমি স্থান দিয়েছিলাম; কিন্তু আপনি গৃহদাহকের কাজ করেছেন। আপনার এই ভুলের জ্বালা আপনার জীবনে লাগবেই। লোকে আপনাকে গৃহদাহকরূপে ভয় পাবে আর ঘৃণা করবে, সম্মান কখনও করবে না।
হুতাশন—আপনাকেও অভিশাপ দিতে পারি ঋষি।
হুতাশনের হঠাৎ চোখে পড়ে, পুলোমা তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছে। পুলোমার সুন্দর মূর্তির মধ্যে শুধু দুই বেদনার্ত চক্ষুর দৃষ্টি যেন নীরবে আবেদন করছে।
কি বলতে চায় পুলোমা? পুলোমার সেই আবেদনমেদুর নয়নের দিকে তাকিয়ে মনে হয় হুতাশনের, পুলোমা আজ তার স্বামীর জীবনের আনন্দকে সব অভিশাপের আঘাত হতে রক্ষা ক’রে সুখী হতে চায়। ভৃগুবধূ পুলোমা। পতিপ্রেমিকা আর্যা পুলোমা। সত্যই স্বামী ভৃগুর ইচ্ছায় ইচ্ছায়িতা হয়ে যেন হুতাশনকে গৃহদাহক বলে মনে করছে আর ভয় করছে পুলোমা।
হুতাশনের ওষ্ঠপ্রান্তে বিচিত্র এক বিস্ময়ের হাস্য দীপ্ত হয়ে ওঠে। ভৃগুর ক্ষোভদিগ্ধ মুখের দিকে শান্ত দৃষ্টি তুলে হুতাশন বলেন—কিন্তু আমি আপনাকে অভিশাপ দেব না ঋষি।
ভৃগুবধূ পুলোমার সুন্দর আননে মেঘমুক্ত শশিলেখার মত স্মিতদ্যুতিময় প্রসন্নতা ফুটে ওঠে। এতক্ষণে সংসারের সব ভ্রূকুটির ভয় হতে মুক্ত হয়েছে পুলোমার প্রাণ। সুস্মিত হয়ে উঠেছে পুলোমার জীবনেরই রূপ।
হুতাশনের নেত্রে সেই বিচিত্র বিস্ময়ের প্রশ্ন আরও প্রখর হয়ে ফুটে ওঠে। এই কি ঘটনার শেষ? এই কি শেষ সত্য এবং এই কি সব সত্য? পুলোমার নারী-হৃদয় কি সত্যই এইবার সর্ববেদনাবিমুক্ত এক সুখস্বর্গের আশ্রয় লাভ ক’রে ধন্য হয়েছে?
—আপনি এখন বিদায় গ্রহণ করুন হুতাশন।
অকস্মাৎ ঋষি ভৃগুর রূঢ়ভাষিত অনুরোধ ধ্বনিত হয়। হুতাশনের কৌতূহলাভিভূত শান্ত মূর্তিকে বিচলিত ক’রে আশ্রমের অভ্যন্তরে চলে গেলেন ভৃগু। বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত হন হুতাশন। এবং পুলোমার সুস্মিত ও প্রসন্ন মুখচ্ছবির দিকে সেই বিস্ময়ের দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে স্নিগ্ধস্বরে বলেন হুতাশন—বিদায় নিলাম পুলোমা।
পুলোমা এগিয়ে এসে হুতাশনের চরণে প্রণাম নিবেদন করে।
হঠাৎ চমকে উঠলেন হুতাশন, যেন তাঁর প্রশ্নের উত্তর হঠাৎ পেয়ে গিয়ে চমকে উঠেছে তাঁর মনের এতক্ষণের বিস্ময়। ব্যথাহত লতিকার মত হঠাৎ শিহরিত হয়েছে পুলোমার ললিত-নমিত দেহ। দেখতে পেলেন হুতাশন, দেখে বিস্মিত হন, এবং উৎকর্ণ হয়ে শুনতেও থাকেন, যেন দূরান্তের বনস্থলীর বক্ষ হতে উত্থিত এক আর্তনাদের ভাষা বায়ুতাড়িত ঝটিকার বিলাপের মত ছুটে এসে তপোবনস্থলীর তরুপুঞ্জের উপর পড়ে চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হুতাশনের চরণে প্রণামাবনতা পুলোমা যেন এক স্বপ্নের কপাটে কান পেতে সেই বিলাপের ভাষা শুনছে। দুঃসহ এক ক্রন্দনের শব্দহারা উচ্ছ্বাস পুলোমার সুখী ও নিশ্চিত বক্ষের নিঃশ্বাসবায়ুকে হঠাৎ আঘাতে আহত করেছে। পুলোমার দুই চক্ষু যেন নীরব বেদনার দু’টি উৎস; অশ্রুসলিল ধারা হয়ে ঝরে পড়ছে।
হুতাশন বলেন—এ কি পুলোমা?
পুলোমা বলে—পুলোমার অশ্রুধারা, ভগবান হুতাশন। এই অশ্রুধারার নাম বধূসরা।
বিস্মিত হন হুতাশন—তোমার অশ্রুধারাকে এই নাম কে দিয়েছে?
পুলোমা—লোকপিতামহ ব্রহ্মা। সেদিন ঠিকই দেখেছিলেন তিনি, আমার অশ্রু নদী হয়ে আমাকে অনুসরণ করছে।
হুতাশন—কিন্তু কেন, কার জন্য এবং কিসের জন্য, বুঝতে পেরেছ কি পুলোমা?
পুলোমা—বুঝতে পেরেছি।
এতক্ষণে সত্যসাক্ষী হুতাশনের সব কৌতূহলের অবসান হয়। আর বিস্মিত হবার কারণ নেই। হুতাশন বলেন—আমি যাই পুলোমা।
পুলোমা বলে—বলে যান ভগবান হুতাশন, দূর বনস্থলীর এক আর্তনাদের স্মৃতি, আমারই ঘৃণায় অবমানিত এক প্রেমিকের শেষ নিঃশ্বাসের বেদনা কি চিরকাল আমার জীবনের শান্তিকে এইভাবে ক্ষণে ক্ষণে অশ্রুসিক্ত ক’রে তুলবে?
হুতাশন—হ্যাঁ পুলোমা।
আর্তনাদ করে পুলোমা—কেন, ভগবান হুতাশন?
হুতাশন—জীবনে ভুলের প্রায়শ্চিত্তও যে জীবনের সত্য।
ত্রাসবিকম্পিত হস্তে দুই ব্যথিত নয়ন আচ্ছাদিত করে পুলোমা। তবু করতল প্লাবিত ক’রে অবিরল অশ্রুধারা ঝরে পড়তে থাকে।
হুতাশন শুধু ভাবেন, পুলোমার এই নয়নবারিকে বধূসরা নাম দিলেন কেন ব্রহ্মা? ভুল করেছিলেন আর্য ভৃগু, ভুল করেছিল অনার্য পুলোমা, কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভুল করেছে বোধহয় ঋষিবধূ পুলোমা। তাই কি?
চলে গেলেন সত্যসাক্ষী হুতাশন।