ভূমিকা-২
কতরকমের চোখ আছে? হরিণের মতো, পেঁচার মতো, গরুর মতো, শেয়ালের মতো। মনুষ্যেতর প্রাণীর চোখের সঙ্গে বুদ্ধিমান, সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের চোখের উপমা। আবার উদ্ভিদ জগতের দুটি বস্তুর সঙ্গেও উপমিত হয়, যেমন পটলচেরা চোখ, আলুচেরা চোখ। সুন্দরীদের দখলে হরিণ এবং পটল। হরিণ নয়না। পটলচেরা চোখে বিপাশা যখন তাকায় ভূমিকম্পের মতো হৃঙ্কম্প সম্রাটের শিথিল হস্ত হইতে তরবারি খসিয়া পড়িল, তিনি বহুমূল্য পারস্যের গালিচার ওপর দিয়া চতুষ্পদ প্রাণীর মতো হামাগুড়ি দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সুন্দরী, দেহি পদপল্লবমুদারম। তাঁহার ওইরূপ করুণ পরিণতি দেখিয়া, তাঁহার কুকুর শূন্য মসনদে আরোহণ করিয়া সরোষে চিৎকার জুড়িল। সভাসদবর্গ ছুটিয়া আসিলেন। সম্রাটের হীন অবস্থা দেখিয়া তাঁহারা সমস্বরে, তোবা! তোবা! করিয়া উঠিলেন। তাঁহারা কামই দেখলেন প্রেম দেখিতে পাইলেন না। এই সভাসদদের কারো চোখ পেঁচার মতো কারো চোখ ধূর্ত শেয়ালের মতো, কারো গরুর মতো।
চোখ খুলে দেখা। কী দেখা? চারপাশে যা ঘটছে, সেইসব ঘটনা দেখা। প্রকৃতি দেখা। জীবজগৎ দেখা। পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের দেখা। চোখ দেখায়। মন তার ব্যাখ্যা করায়। মন বিচার করে। এক-একজনের মন এক-একরকম। সেই কারণে একই ঘটনা, একই দৃশ্যের ব্যাখ্যা। বিভিন্নরকম।
একটি সুন্দর গল্প আছে। মাঠের মাঝখানে একটি মাটির ঢিবি। পাশে পড়ে আছে পায়ে-চলা পথ। রাত বারোটা নাগাদ সেই পথে প্রথমে একজন মাতাল এল। সে অন্ধকারে ওই ঢিবিকে। দেখে ভাবলে, তারই মতো এক মাতাল। সে ঢিবিটাকে বললে—বাঃ ভাই! তোমার নেশা ধরে গেল, আর আমি এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিছু পরেই এল এক চোর। সে ঢিবিটাকে দেখে বললে —বাঃ ভাই! আমি এখনও বাড়িই খুঁজে পেলুম না, আর তুমি বসে বসে বাক্স ভাঙছ! তারপরেই মাঠের ওই পথে এলেন এক সাধু। তিনি ঢিবিটাকে দেখে বললেন—শাবাশ ভাই! তোমার ধ্যান লেগে গেল, আর আমি এখনও বসতেই পারলুম না! যার যেমন মন, তার তেমন দর্শন! বাবা দেখছেন স্ত্রী, সন্তান দেখছে মা। একজন প্রকৃতিপ্রেমী শালের জঙ্গলে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা।
ঋজু ঋজু গাছ সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ আর আকাশ। ঈশ্বরের শিল্পপ্রতিভা, কবির কবিতা। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে এক বেদান্তবাদী সাধু। এসেছিলেন। তিনি মেঘ দেখে নাচতেন, ঝড়-বৃষ্টিতে খুব আনন্দ। হিমালয়ে এক সাধু ছিলেন। গুহাবাসী। দিনে একবার গুহার বাইরে এসে পাহাড় ঝরনা দেখতেন আর আনন্দে নাচতেন—এ কেয়া বানায়া! তাঁর কাছে একটি আয়নার কাচ ছিল। সেইটি তিনি নদী, পাহাড়, তুষার, ঝরনার দিকে ফিরিয়ে বলতেন, দেখো, দেখো। আবার ওই শালের জঙ্গলে কাঠের কারবারি কী। দেখবেন? টনটন কাঠ। লাখ-লাখ টাকা।
বাঘ হরিণ দেখে কবিতা লেখে না। তিরবেগে ছুটে গিয়ে ঘাড় কামড়ে ধরে। তার পৃথিবী সুন্দরের পৃথিবী নয়, মাংসের পৃথিবী। ক্ষুধার পৃথিবী। আবার শিকারির পৃথিবী হল বুলেটের পৃথিবী। খুনীর পৃথিবী ছুরির পৃথিবী। সার্জেনের পুথিবী অপারেশন টেবিলের। রাশি রাশি টিউমার, আলসার, অ্যাপেনডিক্স। ইটে বসে নরসুন্দর চামড়ায় ক্ষুর ঘষছে। তার পৃথিবী হল গাল, দাড়ি, মাথা, চুল। ধরো আর নামাও। পকেটমারের পৃথিবীতে শুধুই পকেট। মানুষ নয়, অজস্র পকেট আর সাইড ব্যাগ।
একজন নেতার চোখে পথিবীটা হল ভোট আর ভোটারের। ভোটব্যাঙ্ক। রাজনীতির প্রোফেশনাল বক্তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বক্তৃতা দেন—বন্ধুগণ! বিছানায় চিত, মাঝরাত, গভীর ঘুমে, সেই অবস্থাতেই মাঝে মাঝে ডিঙি মেরে উঠছেন, ইনকিলাব। স্ত্রী খুঁড়িতে চাপ মেরে দেহকে সমতল করতে করতে বলছেন—ওগো! এ তোমার কেলাব নয়, বাড়ি, বাড়ি!
চোখ হল ক্যামেরা। প্রতি মুহূর্তে ছবি তুলে পেছনের পর্দায় ফেলছে। সঙ্গে সঙ্গে উলটো ছবি। সোজা হচ্ছে। সাইকেল চেপে পিন্টু যাচ্ছে। মস্তিষ্কের অন্য সমস্ত কোষ থেকে এইবার খবর বা ভাটা আসতে লাগল, সেসব চোখে দেখার তথ্যের বাইরে। কিন্তু সেইসব তথ্য যুক্ত হয়ে পিন্টুর চেহারা বদলাচ্ছে। খুব উদ্যোগী। সঙ্গে সঙ্গে দেহটা ঋজু হয়ে গেল। চোখের দেখা পিন্টুর চোখ দুটো আরও উজ্জ্বল হল, নাকটা হয়ে গেল ধারালো। নিরহঙ্কারী, আলাপী। মুখে ফুটে উঠল অতি সুন্দর ঝলক। মস্তিষ্কের অদৃশ্য কোণ থেকে ক্ষরিত হল ভালোবাসা, আহা! পিন্টুর মতো ছেলেতে দেশটা যদি ভরে যেত!
একটু পরেই সাইকেলরিকশা চেপে রমা চলে গেল। কোলের ওপর লেডিজ ব্যাগ। তার ফিতেটা দু-হাঁটুর মাঝখান দিয়ে সামনে ঝুলে আছে। পেনসিল দিয়ে ভুরু এঁকেছে। ঠোঁটে একটু লিপস্টিক চার্জ করেছে। শাড়িটা দামি। আমার সঙ্গে পরিচয় না থাকলে এই ছবির একটি সিদ্ধান্তই হত— সুন্দরী! মনোলোভা। কিন্তু এই ছবির পেছনে বসে আছে আমার সূক্ষ্ম মন। আহত মন। সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী রমা রূপান্তরিত হল রাক্ষসী রমায়। সেজেগুঁজে সাইকেল-রিকশা চেপে কে গেল, একটা। পেতনি।
বিকাশ আমার বন্ধু। যতদিন আমার স্তরে ছিল ততদিন মনে হত, এমন বন্ধু আর হয় না। এমন একজনের জন্যে পৃথিবীতে বারে বারে আসা যায়। কলেজ শেষ করে আমি গেলুম চাকরিতে, বিকাশ গেল ব্যবসায়। কয়েক বছরের মধ্যে বড়লোক। বিকাশ বদলে গেল কি না জানি না। আমি বদলে গেলুম। আমার দেখা, আর সেই দর্শনের ব্যাখ্যা অন্যরকম হয়ে গেল। বিকাশ এখন বেশ মোটা! সঙ্গে সঙ্গে মন সাপ্লাই করলে, হবেই তো! বোতলে ঘটোৎকচই তৈরি হয়। বিকাশ। আগেও হা-হা করে হাসত। এখনও সেইভাবেই হাসে। আমার মন বলে, দু-নম্বরী টাকা থাকলে মানুষ ওই ভাবেই যাত্রার হাসি হাসে। কেউ বিকাশের প্রশংসা করলে আমি জ্বলে যাই। কারণ একটাই। বিকাশ পেরেছে, আমি পারিনি। আমি পারিনি বলেই বিকাশের পারাটাকে ঘৃণার চোখে দেখছি।
কত রকমের চোখ তাহলে আছে? প্রেমের চোখ, ঘৃণার চোখ, জ্ঞানের চোখ, লোভের চোখ, রাগের চোখ, কামের চোখ, অসহায়ের চোখ, আনন্দের চোখ, আত্মবিশ্বাসীর চোখ, খুনীর চোখ, আক্রান্তর চোখ, ভক্তের চোখ, যোগীর চোখ। একই চোখের কত ভাষা!
সবার ওপরে সন্দেহের চোখ। আমরা বাস করছি সন্দেহের যুগে। কেউ কারও মতলব বুঝতে পারছে না। প্রত্যেকের মনে অনুচ্চারিত প্রশ্ন, কী মতলব!
১। অনেকদিন পরে মনে হল যাই একবার দেখে আসি তোমরা সব কে কেমন আছ?
কী মতবল? (মনে মনে)
২। আমি আমার এত বছরের জীবনে অনেক মানুষ দেখলুম তোমার মতো একজনকেও দেখলুম না।
কী মতবল? (মনে মনে)
৩। কী, কেমন আছেন? সব ভালো তো! বউদি? সুগারের কী খবর?
সুগার রেশনের বাইরে। খোলাবাজারে মিলবে। বউদির বাত…।
না না, আপনার সুগার, বাজারের সুগার নয়।
আমার শরীরে সুগার নেই, সবটাই বিটার। কী চাই বলো তো!
ছেলেটা অনেকদিন বসে আছে, যা হয় একটা চাকরি করে দিন না!