ভূমিকা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বদৌলতে হাসন রাজার গান সারস্বত – সমাজে উচ্চ-মূল্য পেয়েছিল। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় দর্শন মহাসভার অধিবেশন এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ভাষণে হাসন রাজার গানে কবিগুরু তত্ত্বাশ্রিত দর্শনচিন্তার পরিচয় পেয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। কবিগুরুর এসব অভিভাষণের পর হাসনের গান একটা সর্বজনগৃহীত রূপ পায়। এরপর ক্রমান্বয়ে তাঁর গান ও দর্শনের প্রতি শিক্ষিত নাগরিক মহলে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়।
রবীন্দ্রনাথের স্তুতিবাক্য শুনে যে-কারোর মধ্যেই হাসনের গানে লুক্কায়িত দর্শনচিন্তার সুলুক-সন্ধানের চেষ্টা মোটেই অমূলক নয়। তাঁর গানে যেমন ভাববাদের প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে তেমনি বস্তুবাদী চিন্তা- চেতনাও উন্মোচিত হয়েছে। হাসনের গানের প্রকাশন-ভঙ্গি বাউল-ফকির মতবাদের পরম্পরারই ধারাবাহিক অংশ। সঙ্গত কারণেই একজন দাম্ভিক ও ধনাঢ্য জমিদার হওয়া সত্ত্বেও একসময় আত্মভোলাভাব/অন্তর্মুখী জীবন-যাপনে অভ্যস্ততা অর্জন করেছিলেন। আত্মমগ্ন হাসন সে- সময়টাতে ডুবে ছিলেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রকৃত রহস্যের ভেদ অনুসন্ধানে। সৃষ্টিকর্তার যে অদেখা-আন্তর্জাল মানুষের চেতনাকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে, সেখানেই আঘাত হেনে হাসন সগর্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন—’মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন’।
হাসন রাজার গানের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ বিচার্যের আগে তাঁর রচনাসমগ্রের শ্রেণিবিন্যাস জানা প্রয়োজন। হাসন বাউলাঙ্গিকের গান রচনার পাশাপাশি সৃষ্টিতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সংকীর্তন, বিচ্ছেদ, পির- মুর্শিদ বন্দনা, গজলসহ মরমি ভাবধারার গান লিখেছেন। জীবনভর আত্মানুসন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন। নিজেকেই তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল— ‘কোথায় ছিলায় কোথায় আইলায় কোথায় তোমার ঘর/কোনখানে থাকো তুমি জানো নি খবর ॥’ তবে তিনি নিজেই সৃষ্টি-রহস্যের এই ভেদ উন্মোচন করেছেন এভাবে—’মায়ে বাপে বন্দি কইলা, খুশির মাঝারে/লালে ধলায় বন্দি হইলাম, পিঞ্জিরার মাঝারে’।
হাসন রাজার প্রায় গানেই ‘আল্লা’-স্তুতির বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। মানব-মৃত্যুর বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে তাঁর সুস্পষ্ট উচ্চারণ : ‘মন চিনলায় না আপন, কোনদিন কোন সময় পরিবায় কাফন/করলায় না, করলায় না তুমি আল্লার নাম জপন ॥’ তবে হাসন রাজা বর্ণিত এই ‘আল্লা’ হচ্ছেন মুর্শিদরূপী গুরু। এই গুরুর বসবাস ‘তনের মাঝে’ অর্থাৎ, নিজ শরীরের মধ্যেই। তাই তিনি ‘বেভুলে মজিয়া’ না-থেকে আপন-দেহেই মুর্শিদরূপী ‘মূল মহাজন’-কে খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন।
হাসন মুর্শিদকে ভাবতেন পরম বন্ধু। এই বন্ধুর কাছেই নিজেকে বারবার সঁপে দিতে চেয়েছেন। হাসন মনে করতেন, এই জগৎ-ব্ৰহ্মাণ্ড নানা জঞ্জালে আকীর্ণ। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান নিজের চারপাশকে ক্রমাগত মায়াময় করে তোলে। ফলে তৈরি হয় ‘ভব-বন্ধন’। একবার বন্ধনে জড়িয়ে পড়লে সেখান থেকে আর মোহমুক্ত হওয়া সম্ভব হয় না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গুরুর কাছে হাসন রাজার আত্ম- নিবেদন ও আর্তি :
দয়াল কানাই! দয়াল কানাই রে;
পার করিয়া দেও কাঙ্গালী রে ॥
ভবসিন্ধু পার হইবার পয়সাকড়ি নাই।
দয়া করিয়া পার করিয়া দেও বাড়ি চলি যাই ॥
অকূল সমুদ্রের পাড়ি, পার করে দেও তাড়াতাড়ি।
সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, মনে ভয় পাই ॥
দয়াল বলিয়ে নাম তোর, জানে সংসারে।
মুই অধম রে পার করিয়া দেও, চলি যাই ঘরে ॥
হাসন রাজার ব্যগ্র দেখে, দয়া লাগে কানাইর বুকে।
আইসো ত্বরিয়ে কানাই ডাকে, তোমায় নিয়া যাই ॥
৩
হাসন রাজার গানে মরমিবাদের প্রত্যক্ষ ছাপ রয়েছে। জাগতিক পৃথিবীতে ভোগবিলাস যে একদিন থেমে যাবে—সেই সত্যও ধারণ করে রেখেছে তাঁর অধিকাংশ গান। হাসন স্বয়ং প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। প্রচুর ভূ-সম্পত্তি পরিচালনাসহ প্রজাদের দেখভাল করা ছিল তাঁর জমিদারিপ্রথারই অংশ। ধনীগরিব, উঁচুনিচু প্রভেদ জ্ঞান তাই হাসনের মনে তীব্রভাবেই ছিল। তবে একসময় যখন বুঝতে পারলেন— ‘তন ছাড়িয়া মন যখন করিবে গমন।/ভবের লোকের শক্তি নাহি করিতে দমন ॥’ সেই উপলব্ধি থেকেই হাসনের জীবনযাপন এবং আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তিনি বাউল মত ও পথের অনুসরণ শুরু করেন। সেই মতবাদে বিশ্বাসী হয়েই বিশ্বের যাবতীয় জ্বরা-জঞ্জাল থেকে উদ্ধার পেতে মুর্শিদরূপী ‘আল্লা’র কাছে তরানোর আর্তি জ্ঞাপন করছেন :
আল্লা ভবসমুদ্রে তরাইয়া লও মোরে।
তরান বরান চাই না আমি কেবল চাই তোরে ॥
তরাও মারো যাই করি এর লাগি কে ঝুরে।
হাসন রাজার মনের সাধ দেখিত তোমারে ॥
চিত্তে কেন তোমার লাগি সদায় ধড়ফড় করে।
হাসন রাজার মনে কেবল থাকত তোর হুজুরে ॥
না চাই ধন, না চাই জন, না চাই জমিদারি।
হাসন রাজার মনোবাঞ্ছা থাকত চরণ ধরি ॥
পূর্ণ করো আকাঙ্ক্ষা প্রভু, ভক্তি করি তোরে।
পদতলে রাখো আশিক হাসন রাজা রে
৪
হাসন রাজার দেহতত্ত্ব পর্যায়ের গানগুলোর সৃজন দক্ষতা অত্যন্ত আকষর্ণীয়। বাউলেরা দেহকে মসজিদ/মন্দির-তুল্য মনে করে থাকেন। এর ফলে দেহের পবিত্রতা রক্ষা করতে তাঁরা সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকেন। সৃষ্টির চির-বিস্ময়কর সব উপাদান দেহের মধ্যেই সন্নিবেশিত রয়েছে। আবার সাধকদের দেহকেন্দ্রিক সাধনার রীতিনীতিও বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। এই দেহ ঘিরেই বাউলদের সাধনভজনের করণ-কারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। সঙ্গত কারণেই দেহতত্ত্বকেন্দ্ৰিক গানগুলো বাউল মতবাদের গুহ্য ও নিগূঢ় অর্থের উন্মোচন ঘটে।
হাসন রাজা তাঁর এক গানে মানবদেহকে ‘ঘর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে লিখেছিলেন :
রঙিলা বাড়ৈ এই ঘর বানাইয়াছে কলে।
রঙ্গে রঙ্গে ঘর বানাইয়া, বসি ঘরে খেলে ॥
মাটি দিয়া ঘর বানাইয়া, চামড়ার দিছে ছানি।
পত্তন করিয়াছে ঘর মূলধন তার পানি ॥
আর মণির চেরাগ দিছে টুল্লির নিচে দিয়া।
সর্ব কার্য করে সে যে, সেই রওনী দেখিয়া ॥
কত কোঠা বানাইয়াছে, দেখতে মনোহর।
সারি সারি কোঠা সব দেখিতে সুন্দর ॥
কোঠার মাঝে প্যাদা পাইক আছে সারি সারি।
কোঠায় কোঠায় বসাইয়াছে কত যে প্রহরী ॥
মলকুতে মেকাইল দিছে, ঘোরে আজরাইল।
নাছুতে ইজরাইল খাঁড়া, মুখে জব্রাঈল ॥
ঘরখানি বানাইয়া ঘরে বসিয়া রঙ্গ চায়।
ছয়টি রিপু দিছে ঘরে কেমনে খেইড় খেলায় ॥
হাসন রাজায় বলে আমার, বাড়ৈর হাতে তালা।
ঘরের মাঝে বসিয়া কত রঙ্গে করে খেলা ॥
‘মানবঘর’-এর বর্ণনায় ইঙ্গিতবাহী শব্দের আড়ালে পুরো দেহের গঠন- আদল উপর্যুক্ত গানে উপস্থাপন করেছেন হাসন রাজা। প্রায় সব গানেই এ-রকম রূপক ও সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে থাকেন সাধকেরা। একটি গানের সঠিক অর্থদ্যোতনা সাধারণ্যের কাছে সঠিকভাবে বোধগম্য না-হলেও শব্দ-বুননের চমৎকারিত্বে আলাদা দ্যোতনা তৈরি করে। এ দ্যোতনা শ্রোতা/পাঠকদের কাছে এক ধরনের অর্থ বহন করলেও সাধকদের কাছে তা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়।
হাসন রাজার গানের সার্বিক বিচারে দেহতাত্ত্বিক সাধনাসংক্রান্ত গানের পরিমাণ নগণ্যই বলা যেতে পারে। তবে তাঁর সৃষ্টির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে মৃত্যু-ভাবনা বিষয়ক গান। হাসনের মতে, এই দেহ ছেড়ে যেদিন প্রাণ চলে যাবে সেদিন কেবল অসার শরীর পড়ে রবে। ফলে জীবদ্দশায় যাতে কোনো পথভ্রম না-হয় সেজন্য সাধনায় পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করা উচিত বলে তিনি অভিমত দেন। মৃত্যু-চিন্তার উপলব্ধি থেকেই হাসনের উক্তি :
লোকে বলে, লোকে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার।
কী ঘর বানাইব আমি শূন্যের মাঝার ॥
ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকব আর।
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার ॥
এই ভাবিয়া হাসন রাজায় ঘরদুয়ার না বান্ধে।
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায় এর লাগিয়া কান্দে ॥
হাসন রাজায় বুঝতো যদি বাঁচব কতদিন।
দালানকোঠা বানাইত করিয়া রঙিন ॥
হাসন রাজা যেহেতু জানেন না তিনি কতদিন বাঁচবেন, তাই জীবদ্দশায় তিনি ‘গুরুর পদে’ সাধন চালিয়ে যাওয়ার একাগ্রতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে যেতে চান। তাঁর মতে— ‘ওরে গুরুর বাক্য ঠিক রাখিলে পাবে রে তুই নিরঞ্জন ॥/শোনো রে মনকানা, ও তুই দেখিয়া দেখলে না,/মায়াজালে বন্দি হইয়ে, আপনা চিনলে না।/আরে ভক্তি করলে মুক্তি পাবে বলে রে হীন হাসন ॥’
বাউল-ফকিরেরা অতিমাত্রায় কল্পনা কিংবা ভাববাদী নন। বরং তাঁদের চিন্তা-চেতনায় বস্তুবাদী সত্তার বিষয়টি টের পাওয়া যায়। তবে মানুষ- বন্দনাই তাঁদের মতবাদের প্রধানতম উদ্দেশ্য হিসেবে সাধকসমাজে বিবেচ্য হয়ে থাকে। মানুষের মধ্যেই তাঁরা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ান। মানুষের সত্তার আড়ালে তাঁরা পরমপুরুষের রূপ প্রত্যক্ষ করেন। এ জন্যই বাউলসাধনায় নারী-পুরুষ উভয় উভয়েরই পরিপূরক।
৫
হাসন রাজার গানে আত্মতত্ত্বের প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে হলে সাধককে অবশ্যই নিজের সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। আর যে সাধক নিজের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ধারণা লাভ করে থাকেন সেই কেবল জগৎ ও জীবন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। এ পর্যায়ের সাধকদের পরতত্ত্ব-প্রাজ্ঞ সাধক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
হাসন রাজা বাউল পরম্পরার ঐতিহ্য বজায় রেখেই দেহ ও সাধনতত্ত্বের গান রচনা করেছিলেন। বাউলসাধনা যে একটি প্রেমমূলক এবং মানুষ-ভজনার সাধনা সেটিও তিনি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। বাউল-দর্শনের ব্যাপক তত্ত্বতালাশ করেই হাসন দেহের অভেদজ্ঞান সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। কীভাবে ‘সু’ ও ‘কু’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রেখে ‘প্রেমবাজারে’ রত্ন বেচা- কেনা করতে হয় সেটাও তাঁর নখদর্পণে রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা থেকেই তাঁর উচ্চারণ : ‘প্রেমের বাজারে বিকে মানিক সোনা রে/যেই জনে চিনিয়া কিনে লভ্য হয় তার দুনা রে’।
সুমনকুমার দাশ
.
তথ্যসূত্র
আবুল আহসান চৌধুরী (সম্পা.), হাসন রাজার গান (ঢাকা : বর্ণায়ন, ২০১২ দ্বি. সং)।