ভূমিকা: ভারতবর্ষে সমন্বয়ের ধর্মধারা
বৈদিক ধর্ম প্রথম পর্যায়ে ছিল যজ্ঞ-নির্ভর, কিন্তু যাযাবর পশুচারী স্তরে যজ্ঞ ছিল একটা সাদাসিধে অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্মও নির্বাহিত হত সংক্ষেপে। পশুপালকদের মধ্য থেকেই একজন, সম্ভবত বয়োজ্যেষ্ঠ বা জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তি দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তব পাঠ করতেন, গাইতেন এবং সম্ভবত অন্য একজন একটি পশুকে শ্বাসরোধ করে বধ করতেন। পরে মাংসপাক, ভোজন ও বিরতি। তার পর গায়ক ও নিহন্তা দু’জনেই আবার ফিরে যেতেন পশুচারণে।
আগন্তুক আর্যরা ক্রমে ভারতবর্ষে প্রাগার্য জনগোষ্ঠীকে পরাস্ত করে বিন্ধ্যের উত্তর দিকের আর্যাবর্ত অধিকার করে এবং প্রাগার্যদের বিন্ধ্যের অরণ্যে ও দক্ষিণ দিকে যেতে বাধ্য করে। পরে প্রাগার্যদের কাছ থেকে কৃষিকাজ শিখে এরা কৃষিজীবী হয়ে ওঠে। পশুপালন তখনও ছিল, আর ছিল মৃগয়া যা সভ্যতার আদিপর্বের জীবিকার উত্তরাধিকার। কৃষিতে জীবনযাত্রা স্থিতিশীল; ভারতবর্ষের উর্বর জমিতে অপেক্ষাকৃত অল্প শ্রমে অধিক শস্য ফলে এবং বীজ বপন, রোপণ পর্ব ও ফসল তোলার মধ্যে যে অবকাশটি ছিল তার মধ্যে যজ্ঞ পল্লবিত ও বহুগুণিত হয়ে উঠল। তখন অবসরভোগী একটি শ্রেণির উদ্ভব ঘটল যা পরে পুরোহিত গোষ্ঠীতে পরিণত হল। এঁদের জীবনধারণের জন্যে পরিশ্রমের আবশ্যক ছিল না, কাজেই এঁরা ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষে নতুন নতুন যজ্ঞ উদ্ভাবন করতে লাগলেন; ফলে পূর্বের একটিমাত্র পুরোহিতের জায়গায় অন্তত ষোলোটি, ও তার পরে আরও নানাবিধ পুরোহিতের পদ সৃষ্ট হল। যজ্ঞগুলি দীর্ঘায়িত হতে হতে দ্বাদশবর্ষব্যাপী যজ্ঞে এসে পৌঁছল; তত্ত্বগত ভাবে সহস্রবর্ষব্যাপী সোমযাগের কথাও শুনি, যদিও প্রকৃতপক্ষে দ্বাদশবর্ষব্যাপী ‘সত্ৰ’ পর্যন্তই অনুষ্ঠিত হত। স্বভাবতই যজ্ঞ জটিল ও বহুব্যয়সাপেক্ষ হয়ে উঠল। ফলে যদিও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য দ্বিজ বলে যজ্ঞে অধিকারী ছিল, তথাপি যজ্ঞকারী বিশিষ্ট একটি পুরোহিত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হওয়াতে অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ যজ্ঞকর্ম থেকে দূরে সরে গেল। তা ছাড়া যজ্ঞের উপাদানও প্রকারে ও পরিমাণে বাড়তে লাগল, পুরোহিতদের দক্ষিণাও বেড়ে চলল, ফলে রাজা, রাজন্য ও বিত্তবান বৈশ্য ছাড়া যজ্ঞের ব্যয় বহন করার সাধ্য আর সাধারণ লোকের রইল না। নির্বিত্ত মানুষ দূর থেকে যজ্ঞ দেখতেই পারত শুধু। এর দুটো ফল হল: প্রথমত, যজ্ঞে প্রতিশ্রুত ফল যে সর্বদা পাওয়া যায় না, তা লক্ষ করে মানুষ যজ্ঞে বিশ্বাস হারাতে শুরু করল। দ্বিতীয়ত, যখন আর্য-প্রাগার্য মিশ্র জনগোষ্ঠী যজ্ঞীয় ধর্মাচরণে নিরত, তখনই পাশাপাশি যজ্ঞহীন অন্য এক পন্থার ধর্মাচরণ সমাজে প্রচলিত ছিল। ঋগ্বেদে এঁদের গালমন্দ করা হয়েছে ‘শিশ্নদেব’, ‘মুরদেব’ বলে। এ ছাড়াও অন্য কিছু সম্প্রদায়ও হয়তো মৌন অবলম্বন করে ধ্যানজপ করতেন, ঋগ্বেদে এই ‘মুনি-ঋষি’দের কথাও শুনি; ইন্দ্র যতিদের শ্বাপদ সালাবৃকদের কাছে সমর্পণ করেছেন। আর প্রায় অপাঙ্ক্তেয় যে দেবতাটি স্পষ্টতই প্রাগার্য ধর্মধারণা থেকে ঋগ্বেদে ঢুকে পড়েছেন, সেই ‘রুদ্র’, মুনিদের সঙ্গে একত্রে বিষপান করেছেন। তা হলে অযাজ্ঞিক জনগোষ্ঠী, যাঁদের কেউ শিশুদেব, মুরদেব, কেউ যতি, কেউ বা মুনি বলে অভিহিত করতেন তাঁরা যজ্ঞকারী বৈদিক জনতার পাশাপাশি সমান্তরাল অবস্থানে সুদীর্ঘকাল ধরেই বাস করেছেন এবং যজ্ঞকারীরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিলেন যে, তাঁরা নেহাত খারাপ অবস্থায় ছিলেন না। দিব্যি খেয়ে পরে বেঁচে থাকতেন, নৈতিক ভাবেও একেবারে অধঃপাতে যাননি। তা হলে যজ্ঞ না করেও বেঁচেবর্তে থাকা যায়, এ বোধটা ক্রমে যজ্ঞকারীদের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছিল। এই তাপস, যতি, মুনি এদের আর্য যজ্ঞকারী গোষ্ঠী স্পষ্টতই তাঁদের প্রত্যয় ও আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী রূপেই দেখেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ তাঁর সাধনার নানা পর্যায়ে যে বেদবিরোধী মতবাদীদের দেখা পেয়েছিলেন, যেমন মস্করী গোশাল, পূরণ কাশ্যপ, নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্র, অজিত কেশকম্বলী, সঞ্জয় বৈরাটীপুত্র, রুদ্রক রামপুত্র, ককুদ কাত্যায়ন, এঁরা সকলেই বৈদিক ধর্ম থেকে সরে এসে প্রতিবাদী অবস্থান হিসেবে সমাজের বাইরে ছিলেন।
যজ্ঞের সবচেয়ে বেশি রমরমা যজুর্বেদ থেকে ব্রাহ্মণ-সাহিত্য রচনার কালের মধ্যে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব নবম থেকে সপ্তম-ষষ্ঠ শতকের মধ্যে। এই স্থিতি’র কালের মধ্যে সূচনা হয়ে গেছে প্রতি-স্থিতির অর্থাৎ অযজ্ঞীয় মনোভাবের। এর পরিণতিতে পাঁচটি মুখ্য প্ৰস্থান দেখতে পাই: চার্বাক (বা পরবর্তী কালের বার্হস্পত্য), জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক এবং উপনিষদ বা ব্রাহ্মণ সাহিত্যের জ্ঞানকাণ্ড। এর মধ্যে ব্রাহ্মণ বিদ্বেষের ফলে চার্বাক অবস্থানের কোনও গ্রন্থ পাওয়া যায় না। বিদ্রূপাত্মক কিছু শ্লোকসমষ্টিকেই চার্বাকদর্শন বলে। কিন্তু এ-মতটির যথার্থ রূপ পাওয়া যায় প্রতিপক্ষীদের আলোচনায়, প্রায় প্রত্যেক দর্শনপ্রস্থানেই নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার প্রাথমিক উপায় হিসেবে চার্বাকমত খণ্ডন করেছেন। এই পূর্বপক্ষগুলি সংকলন করলে এবং বিদ্রূপাকারে লোকমুখে চলিত শ্লোকগুলি মেলালে চার্বাকপন্থা সম্বন্ধে একটা ধারণা হয়। যদিও দর্শনে চার্বাক নিয়ে মাথা ঘামানো অনেক পরবর্তী কালের ঘটনা, তবুও অনুমান করা যায় বেদবিরুদ্ধ একটা মত, বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের প্রতিপক্ষ হিসেবে ব্রাহ্মণ সাহিত্যের কোনও পর্যায় থেকে সমাজে চলিত ছিল। যজ্ঞাশ্রয়ী ধর্ম ও তার প্রতিশ্রুত ফল দেবার ক্ষমতাকে চার্বাক সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন ও প্রত্যক্ষ ছাড়া কোনও প্রমাণ (যার মধ্যে অনুমান ও শাস্ত্রবাক্যও আছে) অস্বীকার করেছেন। কাজেই যজ্ঞাশ্রিত মুখ্য ধর্মমতকে চার্বাকপন্থীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
অথর্ববেদে সরাসরি প্রত্যাখ্যান না থাকলেও লোকায়তিক জাদুবিদ্যা প্রচুর পরিমাণে এ বেদে স্থান পেয়েছে বলে এর অন্য একটা বৈশিষ্ট্য আছে। অবশ্য ঋগ্বেদের শেষতম পর্যায়ে এ ধরনের জাদুনির্ভর কিছু মন্ত্র আছে, সেগুলি স্পষ্টতই পরবর্তী লোকায়তিক অংশের সংযোজন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ, যারা যজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে সম্পৃক্ত ছিল না, যাদের মধ্যে প্রাগার্য এবং অবৈদিক আর্যগোষ্ঠীর ধর্মমত ও আচরণ প্রচলিত ছিল, তাদের যজ্ঞবিরোধী বা যজ্ঞনিরপেক্ষ মত ও বিশ্বাসের নিদর্শন সেই সুদূর অতীত থেকে কিছু কিছু সংকলিত ছিল।
জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক ও চার্বাক মত যখন সমাজে বিকল্প ও সমান্তরাল অবস্থানে বিরাজ করছিল, তখনও চার্বাকের শিষ্যরা কী তত্ত্ব আলোচনা করতেন, কী তাঁদের আচরণ পদ্ধতি ছিল তা জানবার কোনও নজির পাওয়া যায়নি; তবে ওই পন্থাবলম্বীরা যে বেদবিরোধী ছিলেন এবং সংখ্যায় ও মতের জোরে যে নেহাত নগণ্য ছিলেন না, সে কথা অন্যান্য দর্শনপ্রস্থানে তাঁদের মত খণ্ডনে উৎসাহ থেকেই সহজেই অনুমান করা যায়। বৌদ্ধ ও জৈন মতের দার্শনিক দিকটা সাধারণ্যে খুব ব্যাপক ভাবে গৃহীত হওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ সূক্ষ্ম বুদ্ধিগ্রাহ্য দর্শন অশিক্ষিত মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা সহজ ছিল না। তথাপি জীবনচর্যার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ও জৈনরা প্রচুর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। যজ্ঞে যাদের সন্দেহ ছিল, ব্রাহ্মণ্য জাতিভেদের অত্যাচারে যারা জর্জরিত ছিল, তারা দলে দলে এই দু’টি নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিল। আজীবিকরা বেদের প্রামাণ্যতা বা কর্মের দ্বারা মুক্তি অর্জনের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন; এঁরাই প্রথম ও প্রধান নিয়তিবাদী। আজীবিক মত আর্যাবর্তে বেশ কিছুকাল ও দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘকাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে। কাজেই খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে বৈদিক ধর্মের পাশাপাশি বেদবিরোধী নানা মতের উদ্ভব হয় এবং এই সব প্রতিবাদী মতগুলি দীর্ঘকাল ধরে চলে এসেছিল।
***
আর্যরা কোনও জাতিগোষ্ঠী নয়, ভাষা ও সংস্কৃতিগত সংহতির দ্বারা বিধৃত এক জনগোষ্ঠী। এই ইন্দো-ইয়োরোপীয়-ভাষাভাষী আগন্তুকরা ভারতবর্ষে এসে এ দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে যখন বাস করতে শুরু করে তখন সে অঞ্চলে সম্ভবত দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকভাষাভাষী মানুষ বাস করত। আগন্তুকরা ভাষা, ধর্মবোধ ও আচার-অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ পৃথক, কাজেই কিছু সংঘাত অনিবার্যই ছিল। কিন্তু তার পরেও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিক আক্রমণ থেকে শুরু করে শক, পহ্লব, পারদ, ইউয়েহ্ চিহ্ন, হুন ইত্যাদি বিভিন্ন আক্রমণ চলে প্রায় হাজার বছর ধরে। এদের নিয়ে তৎকালীন বর্ণবিভক্ত ও শ্রেণিবিভক্ত ভারতবর্ষে সমস্যা ছিল নানা রকম। সমাজব্যবস্থার মধ্যে আগন্তুকদের বর্ণগত ভাবে কোথায় স্থান দেওয়া যায়? বলা বাহুল্য, প্রত্যেকটি আগন্তুক দলই এ দেশের সংহত সমাজ-বিন্যাসের পক্ষে একটা অসংহতি ও দুর্যোগের মতো দেখা দিত; সমাজে বর্ণবিভাগ, পরে জাতিবিভাগ ক্রমে কঠোরতর হচ্ছিল, তাই প্রতিবারই নতুন করে আগন্তুকদের স্থান নির্ণয়ের সমাধান খুঁজতে হত। দেখতে হবে, ভারতবর্ষ এ সমস্যার কোন সমাধান উদ্ভাবন করেছিল। অথর্ববেদ বলছে, উগ্র আদিত্যরা যেমন মরুদগণ ও বসুদের সঙ্গে সদ্ভাবে মিলিত হয়েছিলেন, তেমনই বিনা ঈর্ষাদ্বেষে যেন আমাদের চিত্ত ও হৃদয় এই মানুষগুলির সঙ্গে সমমনস্ক হয়।’ ওই বেদ আরও বলছে, ‘নিজেদের লোকের সঙ্গে আমাদের যেমন মৈত্রী থাকে, পরদেশী দূরের মানুষদের সঙ্গেও যেন আমাদের (তেমনই) সদ্ভাব থাকে। মনেমনেও যেন বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে আমরা যুদ্ধ না করি, যেন এদের সঙ্গে সমমনা হই।’ (৬:৭৪:২,৩) ঋগ্বেদের শেষতম প্রখ্যাত সূক্তটি, যার রচনাকাল সম্ভবত অথর্ববেদের এই সব সূক্তের সমকালীন, সেখানেও একই প্রার্থনা, ‘পূর্বে দেবতারা যেমন ভোগ্যবস্তুগুলি সমান ভাবে ভাগ করে নিয়েছিলেন, আমরা যেন তেমনই ভাবে এক সঙ্গে কথা বলি, একচিত্ত হই। আমাদের মন্ত্র ও চলাফেরা যেন একত্রে একই ভাবের হয়, এদের সঙ্গে আমাদের হৃদয় ও মন যেন একভাবাপন্ন হয়। আমাদের প্রার্থনা ও কামনা, হৃদয় ও মন যেন সমান হয়। আমরা যেন তোমাদের শোভন ভাবে সহ্য করতে পারি।’ (১০:১৯৪:২-৪) কিছু পরে যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতার একটি ছোট অংশের নাম ‘শিবসংকল্প সূক্ত’ (৩৪:১০৬) অর্থাৎ শুভ বা মঙ্গল সংকল্পের মন্ত্র। কী এই মঙ্গলসংকল্প? ‘যারা জন্মসূত্রে, পরিচয়সূত্রে আমাদের আপন নয়, যারা বিরোধী, যারা ভিন্নপন্থী তাদের যেন আমরা সহজে শোভন ভাবে গ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের সঙ্গে পাশাপাশি বাস করতে পারি। যে ব্যক্তি দূরের, যে আগন্তুক, যে অতিথি, তাকেও যেন দেবতাজ্ঞান করি।’ (তৈত্তিরীয় উপনিষৎ ১:১১২)
চিন্তার ক্ষেত্রে কতকদূর পর্যন্ত সহাবস্থান যে প্রাচীন ভারতে সম্ভব হয়েছিল, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। রামায়ণে যুদ্ধটা ক্ষত্রিয়ের প্রতিহিংসার, সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ হল রাবণবধে; কিন্তু রাক্ষসমাত্রকেই রামপক্ষীয়রা শত্রু বলে মনে করেনি। মহাভারতে কত বিভিন্ন মতের মানব মিত্র ভাবে পরস্পরের সঙ্গে বাস করত। সম্প্রদায়ই বা কত; খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যেই দেখি, শৈব, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য, নারায়ণীয়, সাত্বত, বাসুদেবক, মত্তময়ূর, পাশুপত, লকুলীশ ইত্যাদি বহু বিচিত্র সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ভাবেই বাস করেছে। জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক, মীমাংসক, চার্বাকপন্থী, বেদান্তী নৈয়ায়িক, বৈশেষিক, সাংখ্য-যোগপন্থী ইত্যাদি। বেদান্তের মধ্যেই শুদ্ধাদ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ইত্যাদি মতাবলম্বী মানুষ শান্তিতেই বাস করেছে; পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠেনি। শ্রৌত ও স্মার্ত মানুষ যজ্ঞ ও পূজা করে পাশাপাশি বাস করেছে। সাকার পূজা ও নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা সহাবস্থান করেছে; এমনকী যারা যজ্ঞ বা পূজা ও কিছুই বিশ্বাস করে না তারাও এদের সঙ্গে বিনা বিবাদে বাস করেছে। মতের ক্ষেত্রে যথেষ্টই বিরোধ ছিল, কিন্তু সেটা ছিল যুক্তি ও বুদ্ধির স্তরে। কোনও শাস্ত্র কখনওই বলেনি বিরোধী মতবাদীকে ধ্বংস করতে, মত দিয়েই শুধু মতবাদীদের খণ্ডন করার কথাই পড়ি, মতবাদীর ক্ষতি করার কোনও নির্দেশ নেই শাস্ত্রে। বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে বাদ-বিতণ্ডা অর্থাৎ আলোচনা ও তর্ক খুবই প্রচলিত ছিল। তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী, উড্ডিয়ানে বা জগদ্দলে সকল দর্শনপ্রস্থানের পণ্ডিতই প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ও আশ্রয় পেতেন, আপন আপন মতবাদের চর্চা করতেন, তা নিয়ে গ্রন্থ, টীকাভাষ্য রচনা করতেন; পরস্পরের মত খণ্ডন করেই অগ্রসর হতেন নিজমত প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে। উপনিষদের যুগের ‘ব্রহ্মোদ্য’ ব্রহ্ম সম্বন্ধে প্রকাশ্য বিতর্ক-সভা আয়োজিত হত; বিভিন্ন প্রস্থানের মতবাদের মধ্যে তীক্ষ্ণ বাদপ্রতিবাদ হত; ‘নাসৌ-মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নম্’ তো প্রবাদে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা নিয়ে কাউকে আক্রমণ করবার নির্দেশ কোনও শাস্ত্রেই মেলে না।
মহাভারত যুদ্ধে কৌরবপক্ষের প্রথম সেনাপতি ভীষ্ম নিজের মৃত্যুকালে দুর্যোধনকে বলছেন, ‘আমার মৃতুতেই যুদ্ধ শেষ হোক! বৎস, কৌরবরা শান্ত হোক।’ (৬:১১৬:৪৬) যুদ্ধকামনাকে ভীষ্ম ব্যাধি বলে বর্ণনা করেছেন, (৬:১১৭:২) মৃত্যুর আগে সেনাপতি দ্রোণ বলেন, ‘পাণ্ডবদের মঙ্গল হোক, আমি অস্ত্রত্যাগ করলাম।’ (৭:১৬৫:২৫) মৃত্যুর আগে সেনাপতি দ্রোণ সমস্ত প্রাণীকে অভয় দান করলেন। (৭:১৬৫:২৫) যুদ্ধের শেষে গান্ধারী কৃষ্ণকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন এই বলে, ‘পরস্পরকে বধ করতে উদ্যত তোমার জ্ঞাতি কুরুপাণ্ডবদের তুমিই নিবৃত্ত করতে পারতে, কিন্তু করোনি, তাই যদুকুল ধ্বংস হবে, কুৎসিত উপায়ে তোমার মৃত্যু হবে।’(১১:২৫:৪০,৪১) এ অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল, তাতেই প্রমাণ হয় জ্ঞাতিহতা নিবারণ না করে কৃষ্ণ যথার্থই অপরাধী হয়েছিলেন। ভীষ্ম ও দ্রোণ দুর্যোধনকে উপদেশ দেন, ‘পৃথিবীকে ভ্রাতৃভাগে ভোগ করো, তোমার জ্বর ছেড়ে যাক।’ (৫:১২৬:১৮) অন্যত্র পড়ি, ‘যুদ্ধে কারও লাভ নেই; ‘কুকুর ও বরাহের যুদ্ধে লাভ চণ্ডালের।’ (৭:১৮০:৮) যুধিষ্ঠির স্বর্গে পৌঁছলে তাঁকে বলা হল, ‘এ হল স্বর্গ, এখানে শত্রুতা নেই।’ (১৮:১:১৮) এই হল স্বর্গের সংজ্ঞা: যেখানে বৈরীভাব নেই; এ স্বর্গ এ পৃথিবীতেও রচনা করা যায়।
মহাভারত উচ্চারণ করেছে সেই অনন্য মহাবাক্য, মত্যুর পূর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, ‘একটি গোপন সত্য তোমাকে বলি, যুধিষ্ঠির, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নেই।’ (১২:২৮৮:২০) সমস্ত মতবিরোধ ধর্মবিরোধের নিরসন নিহিত আছে এই মহাসত্যে: মানুষই শ্রেষ্ঠ।
পরিশেষে স্মরণ করা উচিত, সুদীর্ঘ সহস্রাব্দকাল ধরে বহু জাতি তাদের বিশিষ্ট ধর্মবোধ, বিশ্বাস ও আচরণের আমূল পার্থক্য নিয়ে বারেবারে এ দেশে প্রবেশ করেছে, কাজেই সমন্বয়-প্রচেষ্টা সফল না হলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশে রক্তগঙ্গা বইত। তা হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মে সর্বমানবে মৈত্রীর বাণী কথ্যভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। শীলসাধনায় পড়ি: ‘সবে সত্তা সুখিতা হোন্তু, অবেরা হোন্তু, অব্যাপদ্মা হোন্তু। সকল মানুষ সুখী অদ্বেষী ও অহিংসিত হোক।’ ‘মিলিন্দপঞহে’ শুনি বুদ্ধ বলছেন, শত্রুকেও ভালবাসা উচিত। ‘সদ্ধর্মপুণ্ডরীকে’ শুনি বুদ্ধ বলেছেন, ‘প্রাণীমাত্রেরই মঙ্গল সাধন কর, যেমন করে থাকে বর্ষকালে বৃষ্টিধারা।’’ললিতবিস্তরে’ শুনি ওই মহামানবই সর্বকালের সর্বমানবের হয়ে একটি মহাবাণী উচ্চারণ করছেন, ‘বহুজনহিতায়, বহুজনসুখায় লোকানুকম্পায়ৈ মহতো জনকায়স্যার্থায়’– ‘বহু মানুষের হিতের জন্যে, বহু মানুষের সুখের জন্যে, জনসমূহের প্রতি অনুকম্পার জন্যে, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে।’ আজ স্বার্থসন্ধানীরা যতই দেশের বাতাসকে বিদ্বেষে বিষাক্ত করতে চেষ্টা করুক না কেন, এ দেশের মর্মমূলে প্রবাহিত আবহমানকালের যে অন্তঃস্রোতা প্রাণধারা, সর্বমানবমৈত্রী তার কেন্দ্রে বিদ্যমান। এ দেশের প্রাচীন সাহিত্য ধর্মবিদ্বেষ শেখায়নি, শিখিয়েছে সর্বমানবের প্রতি সৌভ্রাত্র, মৈত্রী ও করুণা।
বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তারকালে দেশের বিদ্বেষবিষাক্ততা, আঞ্চলিক ভাবে হলেও, স্বল্পকালের জন্যে হলেও যেন ক্রমে কমে গিয়েছিল। সৌহার্দ্য ছিল বাতাসে, সহিষ্ণুতা ছিল জনমনে। কিন্তু শাস্ত্রকাররা এ সব মতকে পাখণ্ড (পাষণ্ড) বলে গাল দিলেন; সমাজে ক্রমে এদের স্থান সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে এল।
***
মহাকাব্যের যুগ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত বলে মুখ্য ধর্মমত ছিল যজ্ঞনির্ভর ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং তার শেষের দিকে ধীরে ধীরে দেখা দিচ্ছিল প্রাগার্যকাল থেকে জনজীবনে অন্তঃস্রোতরূপে প্রবাহিত একটি ধারা— সেটি হল পূজা। প্রত্যক্ষ ভাবে মহাকাব্যে পূজার কথা কমই আছে; কিন্তু যা পরে পৌরাণিক ধর্মরূপে প্রবর্তিত হয়েছিল, যার কেন্দ্রই হল পূজা তা প্রথম আত্মপ্রকাশ করে মহাকাব্যে। বলাই বাহুল্য যে, যদিও বহুকাল পর্যন্ত যজ্ঞ ও পূজা যুগপৎ অনুষ্ঠিত হত সমাজে, তবুও ক্রমে যজ্ঞ হয়ে উঠেছিল বিত্তবান যজমানের বিত্ত ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিজ্ঞাপন। যেমন এখনকার বড় জাঁকজমকের পূজা কিন্তু যে পূজা প্রাগার্য ধর্মাচরণের পদ্ধতি ছিল, বৌদ্ধধর্মের প্রভাব অবক্ষয়িত হলে সেই পূজাই বিকল্প ধর্মাচরণের মার্গ হিসেবে উদ্ভূত হল সমাজে। যজ্ঞের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ এ পদ্ধতি। যজ্ঞে দেবতারা বিমূর্ত, নৈবেদ্য ছিল পুরোভাশ এবং মাংস, প্রধানত গোমাংস, সোম ও সুরা, মন্দির ছিল না, ছিল পূজাবেদি এবং তা হল পরিষ্কৃত ভূমি। পূজায় মন্দির, বিগ্রহ আছে। নৈবেদ্য প্রধানত দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদে— নিরামিষ, ফল ও দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন। যে সব বৈদিকমন্ত্র মাঝে মাঝে প্রযুক্ত হয় পূজায়, তার অধিকাংশই অস্থানে প্রযুক্ত: তা ছাড়া খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক থেকে পুরাণগুলি যখন রচিত হতে থাকে, তখন থেকে পৌরাণিক স্তব বৈদিক মন্ত্রের স্থান নিল। যজ্ঞের পশুকে শ্বাসরোধ করে বধ করা হত, পূজার পশুকে খঙ্গাঘাত মারা হয়। যজ্ঞের দেবতাদের অধিকাংশই পূজায় অনুপস্থিত, বিস্তর নতুন দেবতা পুরাণ মারফত ধীরে ধীরে দেখা দিল, তাদের অনেকেই আঞ্চলিক। অনেকেরই সূত্রপাত প্রাগার্য পূজাকালে। বৈদিক দেবতারা শতকরা নব্বইজনই পুরুষ, পুরাণে নারী। কাজেই প্রথম যখন পূজা জনজীবনে স্থান করে নিচ্ছে, তখন সেটি ছিল যজ্ঞবিরোধী বিকল্প একটি ধর্মপন্থা। হয়তো কিছু কিছু সংঘাত থাকবে, যার সূক্ষ্ম রূপকাশ্রিত বিবৃতি রয়ে গেছে কোনও কোনও পৌরাণিক উপাখ্যানে।
ভারতবর্ষ কোনও একটি সংহতির উদ্ভাবন করে যজ্ঞ ও পূজার বিরোধিতা মিটিয়ে দিয়েছিল। এবং যজ্ঞ ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যায়, পূজাই রয়ে যায় প্রধান ধর্মপন্থা হিসেবে। খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতক থেকে আজ পর্যন্ত মুখ্য ধর্মপদ্ধতি পূজাই। কিন্তু পূজার সঙ্গে সঙ্গে যে সব আনুষঙ্গিক অনুষ্ঠান প্রবিষ্ট হল সমাজে? যেমন ব্রত, মানত, তীৰ্থ, দান-দক্ষিণা, জপ, ধ্যান, নামমাহাত্ম্য এগুলি সবই সমর্থিত পুরাণের শাস্ত্রবচনে। দান-দক্ষিণা অবশ্যই যজ্ঞকাল থেকেই চলে আসছিল। পূজাতে পৌঁছে তার প্রকার, উপকরণ ও পরিমাণে পার্থক্য ঘটল। ক্রমে পূজার সূত্র ধরেই বিশ্বাসে অনেক পরিবর্তন দেখা দিল। যজ্ঞে দেবতাদের আরাধনা হত যৌথ ভাবে, পূজাও আদিপর্বে তাই ছিল, কিন্তু পরে নতুন একটি ধর্মতত্ত্ব দেখা দিল: ইষ্টদেবতা। প্রথমে পরিবারের, পরে ব্যক্তির পক্ষপাত দেখা গেল কোনও বিশেষ দেবদেবীর প্রতি; তিনিই হলেন ইষ্টদেবতা। বৈদিক ধর্ম দু’-পর্যায়ে ধর্মের কাছে দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রাপ্তির প্রত্যাশা নিয়ে আসে। যজ্ঞনিষ্ঠ কর্মকাণ্ডে তা হল, ঐহিক সুখ, প্রাচুর্য, জয় স্বাস্থ্য, আয়ু এবং স্বর্গ। পরে জ্ঞানকাণ্ডে অর্থাৎ আরণ্যক ও উপনিষদে এ প্রত্যাশাটির আমূল পরিবর্তন ঘটে: তখনকার আকাঙ্ক্ষা ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য হল মুক্তি, মোক্ষ বা নির্বাণ; কারণ তখন জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ সমাজমানসে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত। যজ্ঞে ঐহিক সুখ প্রাপ্তির উপায় ছিল কর্ম, অর্থাৎ যজ্ঞানুষ্ঠান, জ্ঞানকাণ্ডে মোক্ষপ্রাপ্তির উপায় হল জ্ঞান। সার্বজনীন যৌথ পূজায় প্রাধান্য পায় ঐহিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য: ‘অন্নপূর্ণে ধনং দেহি যশো দেহি দ্বিযো জহি।’ কিন্তু পারিবারিক বা ব্যক্তিগত পূজায় অন্য একটি বিষয় সংযোজিত হল: মোক্ষ, অর্থাৎ জন্মান্তরের পরম্পরা থেকে মুক্তি আড়ম্বর, বৈচিত্র্য, জটিলতা, মন্দির ও বিগ্রহনির্মাণ এবং পূজানুষ্ঠানে ব্যয়বাহুল্য যখন ধীরে ধীরে সমারোহের পূজাকে জনসাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে গেল তখন তাদের সামনে বিকল্প রইল স্বল্প আয়োজনে গৃহদেবতা, ইষ্টদেবতার উপাসনা। ব্যয়বহুল পূজা থেকে বাধ্য হয়েই তারা দূরে সরে গেল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে রামায়ণ-মহাভারতের রচনা সম্পূর্ণ হয়েছে। ইতিহাসে দেখি, এই সময়সীমার মধ্যে বহু বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ধর্মের উদ্ভব হয়েছে; মহাকাব্য দু’টিতেও বীজাকারে এদের দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে প্রধান হল শাক্ত, শৈব, পাশুপত, নারায়ণীয়, সাত্বত ও ভাগবত। যতদূর জানা যায়, প্রাথমিক পর্বে এগুলি মূল কর্মধারা থেকে সরে প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র সম্প্রদায় নির্মাণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কালক্রমে ধীরে ধীরে মূল ধারাটি এই সব উৎকেন্দ্রিক বিকল্প মার্গগুলিকে আত্মসাৎ করে নেয়, ফলে এগুলি মূলধারার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সাধনপ্রণালীতে পরিণত হয়। যেহেতু সব প্রস্থানের শাস্ত্র মূলধারারই শাস্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ থেকে অভিন্ন, সে কারণে এগুলির স্বাতন্ত্র্য বা মূলধারার প্রতি বিরোধিতা ক্রমে মূলধারার শাখা হয়ে যায়। পরে সৌর, গাণপত্য, মত্তময়ূর এবং তন্ত্রের মন্ত্রযান ও সহজযান ইত্যাদিও এই ভাবেই মূলধারার বহির্ভূত অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে মূলধারার অন্তর্ভুক্ত হয়।
আরও অনেক লোকায়ত দেবতাকেন্দ্ৰিক সাধনপদ্ধতি ছোট ছোট উৎকেন্দ্রিক সম্প্রদায় হিসেবে আঞ্চলিক কোনও দেবতার উপাসনা থেকে উদ্ভূত হয়ে কিছুকাল আপন উপাসনা পদ্ধতির স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অবশেষে সমান্তরাল পদ্ধতি থেকে মূলধারার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এই টানাপোড়েন— মূল ও শাখা ধর্মের আদানপ্রদান এবং ক্ষুদ্রতরটি বৃহত্তরে অন্তর্লীন হয়ে যাবার বিবর্তন দীর্ঘকাল ধরে চলেছিল। লক্ষ করলে দেখা যায়, জনগরিষ্ঠের আচরিত মূল ধর্মধারার শক্তি গৌণ লোকায়ত ছোট সাম্প্রদায়িক ধারাগুলির স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে তাদের মূলধারার শাখা উপশাখায় পরিণত করে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ইতিহাসে বহু শতাব্দী ধরে এই ঐতিহাসিক বিবর্তন অব্যাহত থাকে এবং এক অর্থে এখনও আছে। সম্প্রদায়ভেদ সম্বন্ধে শাস্ত্রে যতই ঔদার্যের কথা থাক না কেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবশ্যই একটা ক্ষীণ পারস্পরিক বিদ্বেষ ছিল। মহাভারতে অনুশাসনপর্বে একটি অধ্যায়ে শিবের সার্বভৌম মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা পেল বিষ্ণু বা নারায়ণের (কখনও ব্রহ্মাকেও) বশ্যতা স্বীকার করিয়ে, আবার পরের অধ্যায়ে ঠিক সেই প্রণালীতেই বিপরীত দেবতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই অংশগুলি অভি-পৌরাণিক এবং স্পষ্ট বোঝা যায়, যেমন বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন দেবতাকে কেন্দ্রস্থলে রেখে দেবমণ্ডলীকে তাঁর পারিষদরূপে বর্ণনা করা হয়েছে তেমনই মহাভারতের এই অংশগুলিতে বীজাকারে ওই ব্যাপারই প্রথমবার ঘটছে শাস্ত্রে। কেন এমন হল? সাম্প্রদায়িক ধর্ম প্রতিষ্ঠার বাস্তব সামাজিক অর্থ হল, বিভিন্ন দেবতার মন্দির নির্মিত হচ্ছে, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে এবং দেবতামন্দির-কেন্দ্রিক একটি সাধন পদ্ধতি (ইংরেজিতে যাকে ‘কাল্ট বলে) গড়ে উঠছে। এ সমস্ত ব্যাপারটা ঘটাচ্ছে সাম্প্রদায়িক পুরোহিতরা, ওই দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে অন্য দেবতাদের ঊর্ধ্বে তাঁকে স্থাপন করে শাস্ত্র রচনা করছে। প্রথমে স্থানীয় ভক্তরা, পরে, মহিমাকীর্তনের ফলে উপাসনা বিস্তার লাভ করলে দূরের ভক্তরাও, সে মন্দিরে এসে দেবতার পূজা করে; মন্দির অঞ্চলে তীর্থে পরিণত হয়, ভক্তরা প্রণামী দেয়, ব্রত, মানত করে, ধর্না দেয়। অন্য মন্দিরে ঠিক একই ব্যাপার ঘটে অন্য কোনও দেবতার মাহাত্ম্যকেন্দ্রিক শাস্ত্র ও উপাসনার দ্বারা। এখন এই প্রণামী, দান, দক্ষিণা, মানত, ব্রত, সব ক’টির সঙ্গে মন্দিরে পুরোহিতের অর্থপ্রাপ্তি যুক্ত আছে এবং পারস্পরিক বিদ্বেষের, স্থূল ভিত্তিভূমি, অন্তত পুরোহিতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে— এই অর্থপ্রাপ্তিই।
এ সবের প্রসার, প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু সাধারণ বোধ ও আচরণ নির্মিত হচ্ছিল আদি মধ্যযুগ থেকে পুরাণে ও পরে ধর্মশাস্ত্র ও নিবন্ধগুলিতে সেগুলির প্রকাশ স্পষ্ট হচ্ছিল ক্রমে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি যা প্রকট হয়, তা হল, জাতিভেদ এবং শূদ্রবিদ্বেষ। যে পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা (বেদান্ত)-র মধ্যে আর কিছুরই তত্ত্বগত মিল নেই, সেই দু’টি দর্শনপ্রস্থানেই, মীমাংসাদর্শন ও বেদান্তসূত্রে একটি পরিচ্ছদের নাম ‘অপশূদ্রাধিকরণ’ অর্থাৎ শূদ্রের যে কোনও অধিকার নেই বেদে, জ্ঞানে স্বতন্ত্র ধর্মাচরণে— এই বিষয়ের আলোচনায়। এর থেকেও বোঝা যায় সমাজে শূদ্রের অবনমন ক্রমান্বয়ে হয়ে আসছে, দার্শনিকরাও শুধু দর্শন আলোচনা করেই ক্ষান্ত হননি, সামাজিক কর্তব্য পালন করেছেন শূদ্রের সামাজিক হীন অবস্থান সম্বন্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ দ্বারা। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বেছে বেছে সৎ-শূদ্র, শিক্ষিত, বংশকর রাজপ্রসাদপুষ্ট ‘করণ’কে ‘মায়াতি’ সংজ্ঞা দিয়ে, দেবীর কাছে তাকে বলি দিলে যে মহাপুণ্য হয় তার বিবরণ রয়েছে। এই জাতিবিদ্বেষ ম্লেচ্ছ, অস্পৃশ্য প্রত্যন্তবাসী শূদ্রকে ঊনমানবের স্থানে নামিয়েছে।
স্বভাবতই সমাজে সৎ সমদর্শী কিছু মানুষ এর প্রতিবাদও করেছেন। আদিমযুগে এমন প্রতিবাদীদের বিবরণ বিশেষ পাওয়া যায় না। যে সমাজ চার্বাক দর্শনকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রয়াস পেয়েছে এবং করতে সফলও হয়েছে সে সমাজ যে এ সব প্রতিবাদীদের চিহ্ন লোপ করে দিতে পারবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বিবরণ পাওয়া যায়, এ দেশে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে। ব্রাহ্মণ্যধর্মের বর্ণ-বিদ্বেষের সঙ্গে তখন যুক্ত হল আগন্তুক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ। ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব তখন উচ্চবর্ণের হিন্দু, অস্পশ্য অর্থাৎ নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং ইসলামপন্থী নব্য মুসলমান গোষ্ঠীর মধ্যে।
সাধারণ বিত্তহীন মানুষ তখন প্রত্যেক ধর্মমতের উদার বাণী ও অনুদার আচরণ মিলিয়ে দেখছে। দেখে তাদের শুধু ধন্ধ লাগছে না, বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিতে প্রবল আঘাত লাগছে, শাস্ত্রের ব্যবহারিক অসারতা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু যেহেতু অন্য দু’টি বর্ণের মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে সম্মত নয়, বরং নিম্নবর্ণের হিন্দু ও সাধারণ মুসলমান যখন অবজ্ঞার পাত্র বলে চিহ্নিত হচ্ছে, উভয় সম্প্রদায়ের পুরোহিতরাই উদার শাস্ত্রবাক্য আউড়ে তাদের চোখে হীন বৃহৎ জনসমাজকে শোষণ ও উৎপীড়ন করছে নানা ভাবে, তখন জনসাধারণের চেতনে-অবচেতনে একটি উপলব্ধি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে, যদিও তার সে উপলব্ধি তখনও যথোচিত সে ভাবে প্রকাশ করতে ও লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। তখন সবাক হলেন কিছু মহৎ সাহসী মানুষ, গভীর মানবিকতা যাঁদের ভাষা জোগাল বিদ্রোহের। রামানন্দ, রামদাস, কবীর, নানক, রবিদাস, এঁরা দুঃস্থ দুঃখী সামাজিক স্তরের প্রতিভূ, তাদেরই মুখপাত্র। এদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ শিখ; কিন্তু কয়েকটা প্রত্যয় তাদের মধ্যে সাধারণ: ভগবান যদি কেউ থাকেন তবে তিনি কোনও সম্প্রদায়ের নিজস্ব সম্পত্তি নন। তিনি সব সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে; সকল মানুষ তাঁর সন্তান অতএব তাদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই। তারা পরস্পরের ভাইবোন। ভেদবুদ্ধির উদ্ভব শাস্তের এবং তার প্রবক্তা সব সম্প্রদায়ের শাস্ত্রকার ও পুরোহিতরা। এরা মানুষের মধ্যে ঐক্য চায় না, চায় পারস্পরিক বিদ্বেষ এবং এই বিদ্বেষের জন্যে জমি তৈরি করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ও বর্ণবিদ্বেষে। সব পুরোহিত মোল্লাকে অতিক্রম করে মানুষ বিশ্বাসে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারে, সব শাস্ত্রকে অগ্রাহ্য করে। এঁরা মহামানব, ভেদবুদ্ধি ঘুচিয়ে দিয়ে মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যের হেতু নির্মাণই এঁদের উদ্দেশ্য। সহজেই অনুমান করা যায় সব সম্প্রদায়ের পুরোহিত, শাস্ত্রকাররা সর্বশক্তি নিয়ে এঁদের বিরোধিতা করবে। করেওছিল। কিন্তু যুগ যুগ ধরে অবহেলিত নিপীড়িত মানুষ দলে দলে ভিড় করে এসেছিল এঁদের প্রতিবাদী বাণী শুনতে, কারণ অন্তরের অন্তঃস্থলে এ বাণী তারা উপলব্ধি করেছে, নিরন্তর উৎপীড়নে এবং স্বার্থসন্ধানী পুরোহিত কুলের মানুষে-মানুষে বিদ্বেষ ও ভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টায় ক্লান্ত, উত্যক্ত হয়ে।
***
এই উদারপন্থী সাধকদের জন্মগত পরিচয় এবং সামাজিক অবস্থান লক্ষ করলে দেখি, গুরু রামানন্দ (ব্রাহ্মণ) বাদে অন্য সকলেই, নিম্নবর্গের— স্বয়ং কবীর ছিলেন মুসলমান জোলা, দাদু ধনকর (তুলো সাফ করতেন) রুইদাস চর্মকার, রজ্জব মদ বিক্রি করতেন (কলাল), শুক্লহংস ধোপা এবং নামদেব কাপড় রাঙাতেন (রংরেজি বা ছিপি)। অর্থাৎ জন্মপরিচয় ও বৃত্তিগত অবস্থান ছিল সমাজের নীচের দিকে। উচ্চবর্গীয়দের অবজ্ঞার একটা সূত্র সেইখানেই; কিন্তু এটা মোটেই শেষ কথা নয়। কারণ এই সব তথাকথিত নিম্নবর্গীয় ও হীনবৃত্তিজীবীরা চুপচাপ নিজের পরিধির মধ্যে বাস করে উচ্চবর্ণের ও পুরোহিতকুলের নির্দেশিত আচরণ করে গেলে সমাজ তথা সমাজপতিরা এঁদের উপেক্ষা করে, অবজ্ঞার পরিবেশে নির্বাসন দিত মাত্র। এঁদের অপরাধ হল, এঁরা মুখ খুলেছিলেন এবং শাস্ত্র ও পুরোহিতের বহু প্রতারণা, বুজরুকি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তীক্ষ্ণ বিদ্রূপে, গানে এঁরা সাম্প্রদায়িকতার ভিত টলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সব মানুষ ঈশ্বরের সন্তান, পৃথিবীতে সকলের সমান অধিকার। এই তত্ত্বটিকে অন্তরের গভীরে উপলব্ধি করে সেই মতো আচরণ করবার পথ যে মানুষ দেখায় তাকেই এঁরা স্বীকার করেছেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত স্বার্থসন্ধানী পুরোহিতকুলকে নয়। অতএব সমাজ এঁদের যৎপরোনাস্তি অবজ্ঞা দেখিয়েছে, নানা ভাবে উৎপীড়িত করেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, যে দারা শিকোহ রাজপুত্র হয়ে জন্মেছিলেন, তিনি সুফি চিশতি সন্তদের প্রভাবে এই ধরনের ধর্মৈক্য ও মানবসমাজের বাণী উচ্চারণ করেছিলেন এবং সমাজের বিরুদ্ধে এই মানবিক মতবাদ প্রচারের মূল্য দিয়েছিলেন নিজের প্রাণ দিয়ে।
ত্রয়োদশ শতকের কোনও সময়ে রামানন্দ আবির্ভূত হন। নিজে রামানুজপন্থী শিক্ষিত ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবমতাবলম্বী ছিলেন; কিন্তু যখন নিজের মত প্রচার করতে যান তখন সংস্কৃত নয়, কথ্যভাষাই ব্যবহার করেন। হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই এঁর কাছে দীক্ষা নেন। সকল জাতের সঙ্গেই ছিল এঁর আহারবিহার, এবং পরে রামানন্দী সম্প্রদায়ের কাছে এটা একটা মূল নীতিও হয়ে ওঠে। এঁর কয়েকজন শিষ্যের নাম একটু বিস্ময়কর— অসুরানন্দ, সুরসুরানন্দ, সুখানন্দ, পরমানন্দ, মহানন্দ, ভবানন্দ ও শ্রীআনন্দ। এঁদের সম্বন্ধে খুব সামান্যই জানা যায়, তবে মনে হয়, এঁরা সম্ভবত উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ হবেন। তবে নিম্নবর্ণের এবং মুসলমান শিষ্যও এঁর বেশ কয়েকজন ছিল। পীপা ছিলেন ছোটখাট এক রাজপুত রাজা, ধন্না ছিলেন জাঠ চাষি। সেনা জাতে ছিলেন নাপিত এবং রবিদাস চামার। সবচেয়ে প্রখ্যাত শিষ্য কবীর ছিলেন জোলা অর্থাৎ মুসলমান তাঁতি। এঁর দুই গুরু ছিল, হিন্দু রামানন্দ ও মুসলমান তাঁতি। রামানন্দ পারিবারিকসূত্রে বৈষ্ণব ছিলেন এবং বৈষ্ণবধর্মে তত্ত্বগত ভাবে জাতিভেদ স্বীকৃত হবার কথা নয়, কিন্তু বাস্তব চিত্র অন্য রকম ছিল। তাই রামানন্দ তাঁর মতের ভিৎ গড়লেন জাত অস্বীকার করার ওপরে। ব্রাহ্মণ পুরোহিতবর্গের ক্ষতিকর প্রভাব খর্ব করবার জন্যে তাঁর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব তিনি বিবৃত করলেন কথ্যভাষায়। রামানন্দের শিষ্য মুচি রবিদাসের দুই শিষ্যা ছিলেন চিতোরের শিশোদীয় রানার দুই রানি— মীরাবাঈ ও ঝালি। চতুর্দশ শতকে কাশ্মীরে এক উদারপন্থী মহিলা ঋষির আবির্ভাব হয়। এঁর নাম লল দেদ (লল্ল দেবী বা লল্লেশ্বরী)। ইনি নিজেকে হিন্দু বা মুসলিম কোনও পরিচয়েই অভিহিত করতেন না। এঁর গুরু শেষ নুরুদ্দীন ওয়ালি, সংক্ষেপে নুন্দ ঋষি। কাশ্মীরের ঋষি পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত। এই ঘটনাই তো সে যুগের কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলমানের ভেদবুদ্ধির বিলোপ ও সার্বজনিক মানবিকতার একটি নজির হয়ে আছে।
বাংলায় আবির্ভূত হলেন চৈতন্যদেব (১৪৮৫–১৫৮৩), জন্ম ব্রাহ্মণকুলে, সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ-এর সমকালীন। পঞ্চদশ শতকে নবদ্বীপে এঁর জীবন শুরু। জন্মসূত্রে নাম বিশ্বম্ভর। কিন্তু তীর্থে গুরু কেশবভারতীর কাছে দীক্ষিত হয়ে তার পর থেকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য থেকে সংক্ষিপ্ত চৈতন্য নামেই তাঁর পরিচয়। বৈষ্ণবধর্মের যে-অংশ বর্ণে-বর্ণে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে ভেদবুদ্ধি অপসারিত হয়, সেই অংশটিই চৈতন্যের শিক্ষায় প্রাধান্য পায়। যদিও দু’-একটি ব্যতিক্রমী তথ্যও পাওয়া যায়। চৈতন্যের ধর্মে নামগান, কীর্তন ও দিব্যোন্মাদ খুব প্রকট। চৈতন্য স্বয়ং প্রায় সারা ভারত ঘুরে তীর্থ পরিক্রমা করেন। নানা স্থানের নানা জাতের শিষ্য তাঁর অনুগামী হয়, শিষ্য নিত্যানন্দকে চৈতন্য তাঁর ভক্তিতত্ত্ব প্রচারে পাঠিয়েছিলেন। চৈতন্যের মুসলিম শিষ্য ছিলেন চামার হরিদাস, এ ছাড়াও কয়েকজন পাঠান এঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন, এঁদের মধ্যে ‘দাবিস্তনে উল্-মজহর’ গ্রন্থের প্রণেতা ফাজী এবং বিজুলি খানও ছিলেন। যে ধরনের জাতি-নিরপেক্ষতা নিয়ে এই নতুন ধর্মের শুরু হয়েছিল, চৈতন্যের মৃত্যুর পরে মতভেদ, দলভেদে তার অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তবুও যে-সমাজে জাতিভেদ ক্রমেই কঠোর হয়ে উঠছিল সেই সময়ে, চৈতন্য এবং চৈতন্যপন্থীদের কাছ থেকে তার প্রবল প্রতিবাদ এসেছিল। বহু লোক এই উদার মতে আকৃষ্ট হয়ে চৈতন্যের অনুরাগী ভক্ত হন। চৈতন্যের শিষ্য সংখ্যা এত বেড়েছিল এবং ভারতবর্ষের বিস্তৃত অংশে প্রেমভক্তি এমন বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ে যে, পুরোহিত ও ধর্মশাসকরা বিচলিত হন।
কবীর (১৩৮৩–১৪২০) ছিলেন জোলা। রামানন্দের বারোজন প্রধান শিষ্যের মধ্যে ইনি একজন। ইনি বলতেন, বিষ্ণু-আল্লা-রাম-রহিম ভাষাভেদ মাত্র, বস্তুত এঁরা একজনেরই নাম। এঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যায় প্রায় সমান ছিলেন। গানে ও কবিতায় ইনি উপলব্ধির এক গভীর তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন, যেখানে শাস্ত্র-পুরোহিতের ঠাঁই নেই, মূর্তি পূজার অর্থ নেই, জাতিধর্মবিচারে সব মানুষই ভগবানের সন্তান, ভাই-ভাই। কবীর কথ্যভাষায় গান কবিতা রচনা করতেন, সংস্কৃতকে বলেছেন, ‘বদ্ধ কূপ’ ভাষা হল ‘বাতা পানি’। এঁর শিষ্য মদনা পেশায় ছিলেন কসাই এবং তাঁর শিষ্য লাভা ছিলেন অদ্ভুত। এঁদের মধ্যে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শাস্ত্র পুরোহিতবিরোধী একটি ধারা গ্রামীণ মানুষের চিত্তলোকে প্রবাহিত হচ্ছিল এবং ধীরে ধীরে এর প্রভাবও বাড়ছিল। এঁদের শিষ্য সম্প্রদায়ে নানা জাতের লোকের নাম পাই, রজ্জব মদ বিক্রি করতেন। নামদেব কাপড় রাঙাতেন। শুক্লহংস জাতে ধোপা।
শিখগুরু নানকের আবির্ভাবকাল ১৪৬৯—১৫৩৮। কুড়ি বছর বয়সে ইনি নবাব সিকন্দর লোদীর রাজত্বে হিন্দু নির্যাতন দেখেন। বোধন নামে এক হিন্দু বলেছিলেন, ‘হিন্দুধর্ম ইসলামের সমান মানের’ এই কথার জন্য এঁর প্রাণদণ্ড হয়। রাজত্বের প্রথম পর্যায়ে বাবর ব্যাপক ভাবে হিন্দুদের বধ করেন। তখন নানক তাঁর ভগবানের কাছে আর্ত প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এই আর্তনাদ তুমি শুনতে পাও না?’ পরে অবশ্য বাবর অনেক সহিষ্ণু ও উদার নীতি অবলম্বন করেন। দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। সেই প্রথম জীবনে ধর্মের নামে অত্যাচার দেখে অধীর এই যুবক নিজস্ব চিন্তা ও উপলব্ধি দিয়ে ধর্মের এক সার্বজনিক রূপ প্রবর্তন করেন। তথাকথিত নিচুজাতের সঙ্গে ও মুসলমানের সঙ্গে একত্র খেতেন। নানক আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষ ও সিংহল ভ্রমণ করেন, ফলে দেশটাকে তার উদারতায় ও সংকীর্ণতায় জেনে নেন। হিন্দু-মুসলমানের শাস্ত্র, পুরোহিত, ধর্মমত ও তীর্থ তাঁর কাছে কোনও স্বতন্ত্র অর্থ বহন করত না। জনসাধারণের দানে সকলের জন্যে বিনা পয়সার লঙ্গরখানা নির্মাণ করেন। ঈশ্বর ও ভক্ত তাঁর দৃষ্টিতে প্রেমিক ও প্রেমিকা, এতে পুরোহিতের ভূমিকা নিরর্থক হয়ে গেল। সমাজকল্যাণে ব্রতী এই ধর্মে ‘সৎনাম’ ‘সৎকর্তার’ (=সৎকর্ম) ও ‘সৎ শ্রী অকাল’ (=কালের ঊর্ধ্বে, নিত্য-ভগবান) হল মূলমন্ত্র। সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়া তাঁর মতে নিষ্প্রয়োজন ও অন্যায়; এই সমাজের মধ্যে থেকেই সমাজের পক্ষে কল্যাণকর কাজে নিযুক্ত থাকাই ধর্ম।
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর যে ‘দীন ইলাহি’ ধর্মমত প্রবর্তন করেন তাতে শাস্ত্র-পুরোহিত-নিরপেক্ষ এক ধর্মাচরণের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল স্তম্ভগুলি ছিল অহিংসা, দয়া, দান ইত্যাদি সার্বজনিক, মানবিক গুণের চর্চা, ইসলাম, জরথুস্ট্রীয় ও ব্রাহ্মণ্য প্রভাব এর মধ্যে মিশে ছিল। সামাজিক ভাবে কুসংস্কার নিবারণ করা আকবরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। এর মধ্যে সম্প্রদায়-নির্বিচারে যে ধর্মাচরণের ভিত্তি নির্মিত হয় তা সম্ভবত সম্রাটের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সাধু-সন্তদের মতের মধ্যে সমন্বয় প্রচেষ্টারই ফল। প্রচলিত ধর্মের সত্তার বাইরে এক উন্মুক্ত ভূমিতে মানুষকে নিয়ে আসাই যেন বাদশাহ’র লক্ষ্য ছিল।
এরই কাছাকাছি সময়ে বহু চিশতি ও সুফী ইসলামের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে এসে সম্প্রদায়ের বেড়া ভেঙে নিরঞ্জন ভগবৎসাধনায় প্রবৃত্ত হন, এঁরা যেমন শিয়া-সুন্নি ভেদ মানতেন না তেমনই অন্যান্য সম্প্রদায়ের সীমাও মানতেন না। এঁদের মধ্যেও শেখ মুঈনুদ্দীন নিজামুদ্দিন চিশতি, বিশেষ ভাবে আমির খসরু জনপ্রিয় ছিলেন। উদারপন্থী দারা শুকোহ ও তাঁর গুরু বাবা লালের সংলাপ বিধৃত আছে ‘মকলমা বাবালাল’ গ্রন্থে; দারা শুকোহ তাঁর উদারমতের জন্যে রাজপরিবারে অপাঙক্তেয় ছিলেন এবং অনেকটা এই কারণেই মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হন। ভক্ত রামদাস (১৬০৮–১৬৮১) পূর্বআশ্রমে নারায়ণ নামে পরিচিত ছিলেন। পরে জাতিধর্ম নির্বিশেষে এক উদারমতের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। শূদ্র তুকারাম (১৬০৮–১৬৪৯) জন্মেছিলেন মহারাষ্ট্রে, ইনি চৈতন্যভক্ত ছিলেন এবং সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে যেতে পেরেছিলেন। এঁর শিষ্যরাও সেই উদারমত অবলম্বন করেছিলেন।
একবার সম্প্রদায়-ভেদের বাইরে যাবার দৃষ্টি যখন কোনও কোনও সাধু ও তাঁদের শিষ্যদের মধ্যে দেখা দিল, তখন ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশেই নানা অসাম্প্রদায়িক উদারচেতা মানুষ প্রচলিত ধর্মধারার বাইরে চলে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন সম-মতের কিছু সহচারী। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কোনও সময়ে জন্ম হয় সাধু প্রাণনাথের। ইনি হিন্দু-মুসলমানের পাশাপাশি বসে খাওয়াই শুধু প্রবর্তন করলেন না, নিজের বই ‘মহিতরিয়াল’-এ বেদ ও কোরান থেকে পাশাপাশি উদ্ধৃতি দিলেন। এতে লোকের মধ্যে ভেদবুদ্ধি কিছু পরিমাণে কিছুকালের জন্যে তো অবশ্যই ঘুচেছিল। আকবরের এক হিন্দু রাজপরিষদ রচনা করেছিলেন ‘অল্লোপনিষদ’, আল্লা যেখানে আরাধ্য পরম তত্ত্ব। পরে দারা শুকোহ উপনিষদের অনুবাদ করলেন। নাম দিলেন ‘ঔপনেখট্’, এর ভূমিকায় বললেন, কিছু হিন্দু সাধু তাঁর কাছে উপনিষদ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তা হলে, সপ্তদশ শতকে এমন হিন্দু পণ্ডিত বিরল হলেও ছিলেন, যাঁরা মুসলিমের কাছে বেদের একাংশ ব্যাখ্যা করতে সম্মত হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, এঁরা ব্যতিক্রমী হিন্দু, যেমন ব্যতিক্রমী মুসলমান দারা শুকোহ স্বয়ং।
বৈদিক ধর্মের মূলধারার ধর্মসূত্রগুলি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকের মধ্যে রচিত। এগুলির ব্যাখ্যা ও বিস্তার ঘটেছিল পরবর্তী কালের ‘নিবন্ধ’ সাহিত্যে এবং এ সব ভাষ্যে বিধিনিষেধের শাস্ত্রের এত দৃঢ় এক বুনিয়াদ সৃষ্টি হল যে, হিন্দুর পক্ষে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের অনুশাসন লঙ্ঘন করে অন্য সম্প্রদায়ের কাছে যাবার পথ আর রইল না। সাধারণ সামাজিক মানুষ এই বিধিনিষেধের মধ্যে পুরোহিত শাস্ত্রকার-সমাজপতির অভিভাবকত্বে এক ধরনের নিরাপত্তা পেয়েছিল বলে মুখ বুজে শাস্ত্রসমাজের নির্দেশ মেনে জীবনটা কাটিয়ে দিত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে পাশ্চাত্য দেশের সঙ্গে বহির্বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় এবং আরও কিছু পরে সমুদ্রযাত্রার জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করার বিধান থাকায় ভারতবর্ষে এক দ্বৈপায়ন সভ্যতা দেখা দিল। গ্রামগুলি হয়ে উঠল স্বয়ম্ভর, বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও দিব্যি চলে যায়। দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে যে বাণিজ্যধারাটি তখনও অব্যাহত ছিল তাতে ধনাগম হত ঠিকই, কিন্তু চিন্তা, জীবনাদর্শের নব-নব তত্ত্ব ও তথ্য আসা বন্ধ হয়ে গেল, যেমনটি ঘটেছিল মধ্যপ্রাচ্য মারফত পাশ্চাত্য জগতের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে। চিন্তাজগতের এই রুদ্ধদ্বার অচলায়তন ক্রমেই বাইরের মুক্ত বাতাস আসার সমস্ত দ্বার ও বাতায়ন রোধ করে একটা অস্বাস্থ্যকর ও দূষিত চেতনার জগৎ সৃষ্টি করল। তখনও নানা বিষয়ে চর্চা চলছিল জ্ঞানবিজ্ঞানে, সাহিত্যে শিল্পে অনেক মূল্যবান সৃষ্টি এ সময়ে ঘটে, কিন্তু চিন্তার সংঘাতের ফলে জীবনদর্শনে যে মুক্তবায়ু সঞ্চালন হলে চিন্তা ও জীবনবোধে নবতর উন্মেষ ঘটতে পারে, সেটা অসম্ভব হয়ে উঠল। এর ফলে বাইরের জগৎ সম্পর্কে ঔদাস্যই সৃষ্টি করল এক মারাত্মক আত্মসন্তুষ্টি। ‘আমার যা আছে’ তা এতই ভাল যে, অন্যের কাছে আমার পাবার কিছুই নেই বরং অন্যে এসে নিয়ে যাক আমার শাস্ত্র, আমার আপ্তবচন। এই ধরনের মানবিকতা পাশ্চাত্যজগতেও মঠে-আশ্রমে ছিল, কিন্তু তাদের আত্মম্ভরিতা তাদের বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি বলে তাদের চিন্তার উৎকর্ষ ও নবতর জ্ঞানের সাধনা অব্যাহত ছিল।
এখানে কল্পিত শ্রেষ্ঠতার বোধ এক ধরনের তাচ্ছিল্য সৃষ্টি করেছিল প্রতিবেশী সম্প্রদায় সম্বন্ধে। হিন্দুর শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা প্রতিবেশী সম্প্রদায়গুলি সম্বন্ধে। প্রথমে নিরুৎসুক ঔদাসীন্য ও পরে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, যে বিদ্বেষের প্রকাশ অহিন্দুকে পরিহার করায়। এই কালসীমার মধ্যে শূদ্রনির্যাতন, নারীনির্যাতন শুধু যে অব্যাহত থাকে তা-ই নয়, ক্রমে ক্রমে বিষাক্ত ও অমানবিক পর্যায়ে চলে যায়। বর্ণভেদ, যজ্ঞনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ্যধর্মের আড়ম্বর ও ব্যয়বাহুল্য, বাধ্যতামূলক ভাবে বেদের অপৌরুষেয়ত্ব স্বীকার করার দাবি, বিভিন্ন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়গুলিকে উৎকেন্দ্রিক বলে অস্বীকার ও বহিষ্কার করা— এ সবের ফলে মহাবীর, বুদ্ধ, অজিত কেশকম্বলী, পূরণ কাশ্যপ, মস্করী গোপাল, রুদ্রক রামপুত্র অরাড় বালাম সঞ্জয় বৈরাটীপুত্র ইত্যাদি নানা প্রতিবাদী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। এর দুটো ফল দেখা দিল: এ সব মতের কিছু কিছু অংশ মূল ব্রাহ্মণ্য ধর্মধারায় ধীরে ধীরে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে স্বীকৃতি পেল, এবং বানপ্রস্থ ও যন্তি এ দু’টি আশ্রমকে ব্রাহ্মণ্যধর্ম চতুরাশ্রমে স্থান দিয়ে যজ্ঞহীন জ্ঞানমার্গকে স্বীকৃতি দিল।
বার্হস্পত্য, চার্বাক নামের কিছু কিছু প্রতিবাদী নাস্তিক প্রস্থানের কথা শুনি যাঁরা সংখ্যাগরিমায় ও মতবাদের যুক্তি-নির্ভরতায় প্রতীপ এক ধরনের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। কারণ, গুপ্তযুগ ও তার পরেও দীর্ঘকাল পর্যন্ত সমস্ত দর্শনের চর্চায় ওই নাস্তিক মতগুলি খণ্ডন করে তবে আপন প্রস্থানকে প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ ওই সব মতকে প্রবল পরাক্রান্ত বলে গৌণ এক ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ব্রাহ্মণ্যসমাজে ও শাস্ত্রে তখন শ্রেণিবিভাগ ও জাতিভেদ প্রতিষ্ঠিত। গুপ্তযুগের পরে বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক সাধনা ও বৌদ্ধ শ্রেণিবিভাগ ও জাতিভেদ প্রতিষ্ঠিত। গুপ্তযুগের পরে বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক সাধনা ও বৌদ্ধ বজ্রযান, মন্ত্রযান ও সহজযান ও বৈষ্ণব নানা সম্প্রদায়ের সাধনার শাখায় বিভক্ত হয়ে ব্রাহ্মণ্য ও তান্ত্রিকপন্থীদের দ্বারা মূল ধর্মধারার বাইরে চলে এসেছিল। সপ্তম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে এগুলির বিকাশ এবং কখনও কখনও রহস্যবাদী মরমিয়া ভঙ্গির এক সাধনা অব্যাহত ভাবে বিকশিত হতে থাকে। এই সব সাধনাই সাম্প্রদায়িকতাকে পুরোপুরি পরিহার করেছিল।
সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধন ধর্মসভা আহ্বান করেন সাধু ও পণ্ডিতের সমাবেশে। সেখানে প্রথমে তাঁর ইষ্টদেবতা বুদ্ধের আরাধনা হয়, পরে সূর্যের এবং শেষে বংশের উপাস্য দেবতা শিবের। এখানে লক্ষণীয় সংযোজন হল সূর্য, এই একটি দেবতাই অতিকথা বাদ দিলেও যথার্থই সার্বজনীন। প্রাচীন মিশরে বহু দেব-সম্প্রদায়কে একসূত্রে গাঁথবার জন্যে প্রয়াসী হয়ে আখেনাটোন সূর্য উপাসনা প্রবর্তন করেন। আকবরের দীন-ইলাহিতেও সূর্য প্রাধান্য পায়। এ সব সম্রাটের সমস্যা ছিল একই; বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত প্রজাদের জন্যে একটি ঐক্যসূত্র নিরূপণ করা, যেটি হবে সর্বজনগ্রাহ্য।
দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত মুসলমান ভারতবর্ষে হিন্দুর সঙ্গে শান্তিতে সহাবস্থান করতেন। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র ক্রমেই সংকীর্ণ হতে থাকার ফলে এই সময় থেকেই ক্রমে ক্রমে রামানন্দ, কবীর, নানক, চৈতন্য, দাদু, রামদাস প্রমুখ প্রতিবাদী ধর্মমতের অভুত্থান ঘটে। এ সব সাধকের একটি সাধারণ চেষ্টা ছিল: মানুষে মানুষে বিভেদের পরিবর্তে মৈত্রীর সন্ধান। এঁদের ভগবান, নামে যাই হোন না কেন তিনি, মানুষের ভেদ স্বীকার করেন না, মানুষকে কাছে টানার বুদ্ধি দেন; শাস্ত্র পুরোহিতের ঊর্ধ্বে এক উন্মুক্ত দিগন্তে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ-নির্বিশেষে একটিমাত্র মানবজাতিকে স্বীকৃতি দেন। সমাজ যেখানে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে পুষ্ট করতে সচেষ্ট, এঁরা সেখানে মানবমিলনের জয় ঘোষণা করেছেন।
যুগে যুগে দেখি, মূল ধর্মধারা যখনই মানুষের কোনও কোনও অংশকে পর বলে দূরে সরিয়ে রাখতে প্রবৃত্ত, তখনই কিছু কিছু উদার মনস্বী মানবিকতার, মৈত্রীর ও সাম্যের বাণী প্রচার করেছেন। যেটা লক্ষণীয় সেটা হল: এঁদের সকলকেই সমাজের বাইরে এসে এই উদার ভাবটি প্রচার করতে হয়েছে। শাস্ত্রের বেড়া এতই সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, সেখানে সব মানুষই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পরস্পরের ভাই এই বাণীটুকু প্রচার করা যায়নি; শাস্ত্রের বিধিনিষেধ প্রবল হয়ে মৈত্রীর বাণীর কণ্ঠ রোধ করেছে।
যখনই মানুষের অন্তর্নিহিত মানবতার অপমান ঘটেছে সমাজের বিধিনির্দেশে, তখনই কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আপন উপলব্ধিতে ভেদসূচক শাস্ত্রবচনের অসারতা বুঝতে পেরে সমাজের বিদ্বেষের প্রভাবকে এড়িয়ে বাইরে চলে এসেছেন। ঘোষণা করেছেন, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ অতএব মানুষকে যে শাস্ত্র বিচ্ছিন্ন করতে চায় কাউকে উঁচু কাউকে নিচু বলে, কাউকে সমাজের অন্তর্বর্তী বলে মেনেছে, কাউকে বা বাহিরের, অপাঙক্তেয় বলে পরিহার করতে চেয়েছে, তখনই এই বড় মাপের মানুষরা সেই অমানবিক নির্দেশকে বর্জন করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই যে শিষ্য-সম্প্রদায়-পরম্পরা ছিল এবং বেশ কিছুকাল ধরে বেড়েছিল তাদের সংখ্যা, শাস্ত্রমতকে উপেক্ষা করেও ত্রুটি সংকীর্ণতা ভ্ৰম-বিচ্যুতি বুঝতে সাহায্য করেছিল। কখনও কখনও কিছু প্রতিবাদী ধারা স্বীকৃতি পেয়েছিল, কখনও বা কঠিন সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এদের, শারীরিক অত্যাচারে। ধোপা-নাপিত বন্ধ, একঘরে করা, অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড এবং পরিশেষে মৃত্যু— এ পর্যন্ত সব কিছুরই ইতিহাসে নজির রয়েছে। এত বিপদের সম্ভাবনা সত্ত্বেও কেন এঁরা সমাজের বহুসংখ্যক, শক্তিশালী, বিত্তশালী ও ক্ষমতাসীন শাস্ত্রকার ও সমাজপতিদের বিরুদ্ধাচারণ করতে গেলেন? কী পেলেন এ বিদ্রোহের বিনিময়ে? কী উদ্বুদ্ধ করেছিল এই শক্তিহীন, অশিক্ষিত নিম্নবর্গের মানুষগুলিকে সংখ্যাগুরু সমাজের প্রতিবাদ করতে? এঁদের বাণী ও আচরণ থেকে বোঝা যায় যে, এঁরা প্রেরণা পান জাতপাত-সম্প্রদায়ের নামে, ধর্মের নামে মানুষের ওপরে মানুষের অত্যাচার দেখে। প্রতিবাদ না করে এঁরা ক্ষমা পাননি আপন অন্তরাত্মার কাছে। কারণ, সহজ মানবিক বোধে এঁরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, ধর্ম, জাত, সম্প্রদায় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষেরই সৃষ্টি। এগুলি চিরকালীন সত্য নয়, কোনও কোনও শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য উদ্ভাবিত; দেশে ও কালে এদের রূপ পৃথক, এবং এদের একটিই উদ্দেশ্য, কিছু মানুষকে কৃত্রিম ভাবে ‘বড়’ বলবার জন্যে বহু মানুষকে কৃত্রিম ভাবে ‘ছোট’ বলে অপাঙক্তেয় করে রাখা। যাঁরা বাইরে এসে প্রতিবাদ করলেন এবং কখনও কখনও কঠিন মূল্য দিলেন সে প্রতিবাদের, আজও তাঁরাই স্মরণীয় ও বরণীয় রয়ে গেছেন; সমাজপতি ও শাস্ত্রকাররা স্বার্থসিদ্ধির ক্ষুদ্র সংকীর্ণ পন্থায় রচিত শাস্ত্রেই শুধু তাঁদের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, বৃহৎ জনসমাজ যে বিধিনিষেধে যুগে যুগে শুধু পিষ্টই হয়েছে।
***
যেটা লক্ষণীয় তা হল, শাস্ত্রের কাঠামোয় সমাজের চিরাচরিত প্রত্যয় ও অনুষ্ঠানের পরিধিতে ধর্মশাসকদের অত্যাচারের যে ক্লেদ জমেছিল, তার প্রতিবাদে এই মহাপ্রাণ মানুষরা প্রত্যেকেই প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভেদবুদ্ধির গণ্ডি দু’-পায়ে মাড়িয়ে সমাজের পরিসরের বাইরে চলে এসেছিলেন। সমাজের পরিসরে এঁদের কুলোয়নি, যেমন শাস্ত্রের পরিসরে কুলোয়নি এঁদের স্বতঃ-উৎসারিত মানবিক প্রত্যয়গুলি। এই বাইরে চলে আসাটা পৃথিবীর বহু দেশেই ঘটেছে, একই কারণে। প্রতিবাদী মত কি কোনও ভাবেই প্রভাবিত করেনি সমাজের অচলায়তনকে? করেছে, কিছুকালের জন্যে হয়তো শিথিল হয়েছে আগড়গুলি, কিন্তু স্বার্থান্বেষী শাস্ত্রকর্তারা কায়েমি স্বার্থের আসন্ন বিপদে অল্পকালের মধ্যেই বিধিনিষেধের আগড়গুলি কঠোর করে বিধর্মী, বিজাতীয় ও ম্লেচ্ছকে পরিহার করবার অনুশাসন উদ্ভাবন করেছেন সমাজের তথাকথিত ‘শুচিতা’ রক্ষা করবার জন্যে। ‘শুচিতা’ হয়তো রক্ষা পেয়েছে কিন্তু মানুষ রক্ষা পায়নি; তাই মানুষের সহমর্মী এই বিপ্লবী মানুষদের আবার বেরিয়ে আসতে হয়েছে মানুষের স্বার্থরক্ষার খাতিরে। বারে বারে এই ঘটনায় মানুষের মানবিক মর্যাদা-রক্ষার সংগ্রাম অব্যাহত থেকেছে। ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ্যে ধর্মসাধনার ইতিহাসের ছকটা এমনই দ্বান্দ্বিক: আপ্তবাক্যশাসিত সমাজ, প্রতিবাদী বিপ্লবী সাধকদের প্রত্যাখ্যান, কিছুকাল মুক্ত হাওয়ার পরই কায়েমি স্বার্থের দ্বারা আবার দরজা-জানালা কঠোর হাতে বন্ধ করা, আবার তার বিরুদ্ধে সমন্বয়বাদীর প্রতিবাদ।
বেদের কালের পর, আগন্তুক, ভিন্নমতের মানুষের সঙ্গে শোভন, মৈত্রীপূর্ণ ব্যবহার করতে পারার যে প্রার্থনা ছিল তা আজকে কি আর আমাদের চিত্ত হতে উৎসারিত হয় না? আজকের ভারতবর্ষে চোখে পড়ে এই সমন্বয়বুদ্ধি যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রদায়গুলির পরস্পরের মধ্যে পার্থক্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, ভেদবুদ্ধির বশে প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও অপরকে হীন বলে প্রতিপাদন করার চেষ্টা করছে। যে ভিন্ন মতাবলম্বী, সে ভারতে বাস করলেও ভারতবাসী নয়। এই এত বড় দেশে আগন্তুক বিজাতীয় শক-পহ্লব-পারদ-যবন কত অনায়াসে ঠাঁই পেয়েছিল একদিন, ধীরে ধীরে বৃহৎ সমাজদেহে আপন বিশিষ্ট সত্তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মিশে গেছে। আজ এতকাল পরে পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্যের জোরে সমাজে উঁচু-নিচু, এ দেশের বাসিন্দা হবার অধিকারী অনধিকারী বিচার হচ্ছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে শুধু কেবলমাত্র ‘ভারতীয়’ সংজ্ঞায় যেন আর কাউকে কুলোচ্ছে না, হয় সে হিন্দু, নয় মুসলমান, নয় অন্য কিছু। হিন্দু-মুসলমান দু’-সম্প্রদায়ে হানাহানি এত তিক্ত, এত বিষাক্ত যে মনে হয়, সমন্বয় বুদ্ধি, সহিষ্ণুতা পরস্পরের প্রতি মানবিক ও শোভন ব্যবহার যেন দেশ থেকে অন্তর্হিত হতে চলেছে। কিন্তু এ তো শুধু সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির দেশ নয়, এ তো নানক, চৈতন্য কবীরেরও দেশ।
মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা সমানই বিষাক্ত, সমানই বিধ্বংসী, সহিষ্ণুতা তাদেরও নেই, পারলেই তারাও হিন্দুর ক্ষতি করে, দাঙ্গার সময়ে মন্দির পোড়ায়, লুণ্ঠন-ধর্ষণ করে। হিন্দুকে তারাও হীন মনে করে, যেমন হিন্দুও তাকে মনে করে। তবে এ গ্রন্থের শিরোনাম ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’ হল কেন? উত্তরে দু’টি কারণ বলা যায়। মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ও বাস্তব তথ্য যতটা জানা থাকলে তা নিয়ে লেখা যায় তা আমার নেই, এ কথা অকপটে স্বীকার করে আশা রাখব, কেউ যেন সে বিষয়ে যথোপযুক্ত জ্ঞান নিয়ে লেখেন যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে। দ্বিতীয় কারণ হল, দীর্ঘকাল পূর্ব পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর একটি অবিস্মরণীয় উক্তি: ‘মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা (তিনি গোঁড়ামি শব্দটি ব্যবহার করেন) ভারতবর্ষের প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে পারে, কিন্তু একমাত্র হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাই এদেশের সর্বনাশ করতে পারে।’ কারণটা খুবই সোজা, শতকরা বিরাশিজন ভারতবাসীর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়ার যে ক্ষমতা, শতকরা বারোজনের তা কোনও মতেই থাকতে পারে না। অতএব ওই বিরাশিজনের ক্রোধ-রিপু-দমনের একটা বাড়তি নৈতিক দায় আছে দেশটাকে ছারখার হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর যা ঘটল, তাতে মনে হয়, সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দু শুধুই হিন্দু। হিন্দুত্ব রক্ষা করলেই তার কর্তব্য শেষ হয়, সাম্প্রদায়িকতার বিধ্বংসী শক্তি থেকে দেশটাকে রক্ষা করার কোনও দায় তার নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস সর্বনাশের অতলস্পর্শী খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে, একদিকে তার বর্তমান অর্থনীতি এক ভয়াবহ আতঙ্কের সঞ্চার করছে আবার তারই সঙ্গে এই নারকীয় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা তাকে এমন এক প্রলয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার থেকে উদ্ধারের কোনও পথই থাকবে না। অযোধ্যায় যার শুরু, বৃন্দাবন, মথুরা, সোমনাথের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে দিয়ে তার অনিবার্য গতি কুরুক্ষেত্রের ভ্রাতৃঘাতী সংগ্রামের মহাশ্মশানের দিকে। এখনই অবহিত না হলে অশুভ শক্তি পরাক্রমের মধ্যে মত্ত হয়ে সর্বনাশী, সর্বগ্রাসী ধ্বংসকর্ম সাধন করবে অপ্রতিহত গতিতে। সেই প্রলয়ের পরে যে বিজয়ীরা থাকবে, সঙ্ঘ পরিবারের নির্ধারিত সংজ্ঞায় তারা ‘হিন্দু’ হতে পারে, কিন্তু তাদের আর ‘মানুষ’ বলা যাবে কি? সেই দানবীয় ভবিষ্যৎকে সমবেত মানবিক শুভবুদ্ধি দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টাই এ গ্রন্থের প্রেরণা। কোথাও যদি এই চিন্তাগুলি আশ্রয় পেয়ে কাউকে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে, তা হলেই এ রচনা সার্থক হবে।