ভূমিকম্প

ভূমিকম্প

তিন দিকে পরিত্যক্ত হস্টেল-বাড়ি, এই দিন চারেক আগে পর্যন্ত ছিল আশ্রয়, এখন হইয়া দাঁড়াইয়াছে আতঙ্ক। মাঝখানে প্রশস্ত লনের উপর টেনিসের পর্দা জুড়িয়া তাঁবু খাটানো, কলেজের ছেলেরা তাহারই মধ্যে জড়ো হইয়াছে। মাঘের কনকনে শীতে, তায় পাটনার মতো জায়গা, ও তাঁবুতে কিছুই আটকায় না; মাথার উপর কিছু একটা আছে—এই সান্ত্বনায় যতটা কাজ হয়। গেঞ্জি হইতে ওভারকোট পর্যন্ত সবই গায়ে,—মাঝে মাঝে চাও আছে। বঙ্কিমের ইহাতেও কুলাইতেছে না। সে চৌকির নিচে বিছানা করিয়া এবং চৌকির চারিদিকে কম্বল ঝুলাইয়া ভিতরে শুইয়া আছে।

খোকা বলিল, “কেমন বোধ হচ্ছে হে বন্ধু? কবর কি বলে?”

কবরের ভিতর হইতে উত্তর আসিল, “বড্ড মিষ্টি বাহুপাশ হে, বলছে, দেখ বঁধু কেমন উষ্ণ আলিঙ্গন আমার, তবু আমায় বলে হিমশীতল। দেখ অবিচার!”

মৃগেনের চা-করা শেষ হইয়াছে, খোকার হাতে একটা পেয়ালা দিয়া বলিল, “ধরো। সত্যি, তেতলার কথা ছেড়ে দাও, কোঠাবাড়ি মাত্রেই যেন একটা বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইস্টিশানের সামনের সেই দোতলা বাড়িটার ইতিহাস তো শুনেইছ। সেটিকে আজ একটা ছোট একতলার অবস্থায় দেখলাম। মনে হয়, মুছে ফেলবার নেশায় মেতে উঠে সবাইকে বুকের মধ্যে পিষে ফেলে নিজে আছড়ে মরেছে; কবর এতটা দাগাবাজি করতে পারত না।

চৌকির ভিতরটা বিচলিত হইয়া উঠিল। “কে বলে একথা?”—বলিয়া বঙ্কিম চৌকির পর্দা ঠেলিয়া ব্যালাক্লাভা-আঁটা মুখটা হঠাৎ বাহির করিল। কালো আবেষ্টনীর মধ্যে চোখ দুইটা জ্বল-জ্বল করিতেছে, এই লোকই যে একটু আগে নিজের শয্যা লইয়া লঘু আলাপ করিতেছিল, বোঝা শক্ত। বলিল, “গঙ্গার এপারে আছ, তাই ও কথা বলছ, একবার ওপারে যাও—মজঃফরপুর, মোতিহারি, দ্বারভাঙ্গায়, দেখবে সারবন্দী হয়ে কবরের দল মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। পাতালের যত গ্লানি, যত ভীষণতা সঙ্গে করে এক এক জায়গায় আগুনের নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে উঠেছে, এক এক জায়গায় প্লাবনের খরস্রোত বইয়েছে, বালির চাপে কচিশস্যের টুটি চেপে মেরেছে—”

মৃগেন বলিল, “তুমি ভাই, মুখটা ভেতরে টেনে নাও, অথবা সমস্ত শরীরটা বাইরে বের করে নিয়ে এসে যা বলতে হয় বল, তোমার ব্যালাক্লাভাগ্রস্ত মুখমণ্ডল দেখে বড্ড অস্বস্তি বোধ হচ্ছে; মনে হচ্ছে, কবরই যেন আচমকা মূর্তি গ্রহণ করে—”  

বঙ্কিম বাধা পাইয়া একটু অন্যমনস্ক ভাবে চুপ করিয়া ছিল। বলিল, “আর যা করেছে তা আরও গর্হিত, বিপন্ন মতিভ্রান্ত অসহায় মানুষের সঙ্গে নীচ প্রবঞ্চনা করে তার প্রাণ নিয়েছে কবরে। খোকা, তুমি সামনের পর্দাটা একটু টেনে দাও, ভেন্টিলেশন না হলে অবৈজ্ঞানিক প্রথায় কোনো রকম করে তবু বাঁচব, কিন্তু এই অবস্থায় যদি নিউমোনিয়া ধরে—”

“ওপারে এত ব্যাপার, অথচ এখনো পর্যন্ত বল নি যে? ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়েছে নাকি? শুনছি নাকি—”

বঙ্কিম বলিল, “বলি নি ঘোঁতন ছিল বলে। গেছে, এবার নিজের চোখেই সব দেখবে; আমি মাঝখান থেকে অত বড় একটা দুঃসংবাদ দিতে যাই কেন?”

সকলেই যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চকিত ভাবে বঙ্কিমের দিকে চাহিল, এক জোটেই প্রশ্ন করিল, “সত্যি নাকি?”

বঙ্কিম মুখটা বিষাদে একটু কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “বড় স্যাড, বড্ড করুণ।”

তাহার পর আস্তে আস্তে শরীরটা নানা প্রকার আকুঞ্চন-প্রসারণ করিয়া চৌকির মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিল, এবং ব্যালাক্লাভাটাকে গুটাইয়া মাথায় জড়ো করিয়া জামা- র‍্যাপার বেশ ভালো করিয়া সামলাইয়া লইয়া বলিল, “তাহলে মৃগেন, আর এক কাপ করে—”

খোকা অসহিষ্ণুতার সহিত বলিল, “সে হচ্ছে, জল তো চড়ানোই রয়েছে। কিন্তু যে চিরকেলে অভ্যাস মতো এফেক্টের জন্যে আমাদের বসিয়ে রাখবে, সে হচ্ছে না; শিগগির বল, ব্যাপারটা কি? ঘোঁতনদের বাড়ির একজনও কি বেঁচে নেই?”

বঙ্কিম রহস্যের ভাবটা বজায় রাখিয়া বলিল, “একজন বেঁচে নেই! ঘোঁতন যে গেছে, এটা ঠিক তো? বড্ড স্যাড ব্যাপার হে!”

সে একটু মাথা নীচু করিয়া বসিল; খোকা এবং পরেশ পুনরায় তাগাদা দিবার পূর্বেই মাথা তুলিয়া আবার আরম্ভ করিল, “ঠিক দশটার সময় আমি কুড়হান্নি স্টেশনে পৌঁছলাম। গাড়ি ঐপর্যন্ত যাচ্ছে আজকাল, ওর ওদিকে লাইন ধসে গেছে। কুড়হান্নিটা মজঃফরপুর থেকে দু স্টেশন আগে। রাস্তা দিয়ে গেলে ন ক্রোশ—আঠারো মাইল।”

খোকা বলিল, “তুমি আঠারো মাইল দূরে থেকে গল্প কোরো না বন্ধু, দোহাই। আঠারো মাইল পথ ধরে ভাষা বেয়ে আসতে তোমার অনেক সময় লাগবে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে, অথচ ঘোঁতনদের বাড়ির খবর বলে একটা উৎকণ্ঠাও লাগিয়ে দিয়েছ। নাও, মেলা আর্ট ফলিও না।”

বঙ্কিম এসব অনুরোধ-উপরোধ কানে না তুলিয়া বলিতে লাগিল, “রাস্তার দুধারে সে এক বীভৎস কাণ্ড। খাদগুলোতে জল থৈ থৈ করছে, জায়গায় জায়গায় জল ওপরে উঠে এমন শ-দুশো বিঘে জমি ডুবিয়ে দিয়েছে। যেখানটা জেগে আছে, সেখানে ছোট বড় বালির চাকতি। চাকতির মাঝখানে একটা করে গর্ত, ঐ বেয়ে পাতালের জল বেরিয়ে এসেছিল; মাঝে মাঝে তখনো পর্যন্ত উদগার করে চলেছে, আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেও।

“প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে এইগুলো সব মাটি ফুঁড়ে বিকট আওয়াজের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল, আমাদের এই শ্যামা ধরিত্রী একেবারে সহস্রমুখী দানব হয়ে উঠেছিল।

“খাদ জলে ভরুক—সওয়া যায়, কিন্তু যখন দেখা গেল, বালির রাশি—খাদ ডোবা নালা ইঁদারা সব ভরাট করে দিয়ে উঁচু রাস্তার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে ঠেলে উঠেছে, আর ক্বচিৎ কোথাও এক-আধটা গাছের ডগা তার মধ্যে নিঝুম হয়ে নেতিয়ে রয়েছে, তখন সত্যিই কেমন একটা অস্বস্তি জেগে ওঠে মনে; অন্তত আমার তো মনে হল, এই যে আমাদের এত বিশ্বাসের পৃথিবী, এর ভেতর একটা মস্ত বড় প্রবঞ্চনা লুকানো আছে। ওটা তারই নমুনা। ওপরটা সবুজ কোমলতার মোহ, আমাদের ভুলিয়ে রাখবার যাদু, নিচেয় আছে এক এক অনন্ত অপ্রমেয় সাহারা। একদিন নিতান্ত খেয়ালের মাথায়ই যদি বুভুক্ষু তৃষ্ণাতুর মত্ত দানবকে ভেতর থেকে লেলিয়ে দিয়ে একমুহূর্তে ওপরের সমস্ত সরসতাটুকু—”

মৃগেন একটা কাপে চা ঢালিয়া আগাইয়া দিয়া বলিল, “থাক, আপাতত তোমার মরুদানবটিকে ঠাণ্ডা কর, বড় তেতে উঠেছে।”

চায়ের কাপটি বঙ্কিম খালি করিয়া একপাশে রাখিয়া দিল, রুমাল দিয়া মুখ মুছিয়া ব্যালাক্লাভাটা ভালো করিয়া টানিয়া দিয়া বলিল, “মজঃফরপুর পৌঁছলাম।”

খোকা বলিল, “বাঁচালে, চা-পথে খুব তাড়াতাড়ি হল তো!”

পরেশের আগ্রহটা সব চেয়ে বেশি ছিল; প্রশ্ন করিল, “আর সব কি কি দেখলে রাস্তায়? এযাবৎ যা বললে তা থেকে তোমরা সাহিত্য বাদ দিলে তো খানিকটা জল ও খানিকটা বালি পড়ে থাকে, যার কথা অপেক্ষাকৃত মৃদু ভাষায় রোজ খবরের কাগজে পড়া যাচ্ছে।”

বঙ্কিম বলিল, “কয়েক জায়গায় নামতে হয়েছিল এক্কা থেকে, রাস্তার এধার থেকে ওধার পর্যন্ত ফাটল চলে গেছে, যতটুকু রাস্তা ঠিক ততটুকু—মাটি দিয়ে ভরিয়ে দিলেও এক একটা এত চওড়া যে, গাড়িসুদ্ধ পার হতে তখনো সাহসে কুলায় না, বিশেষ করে রাস্তার দুপাশে ফাটলের আসল স্বরূপ দেখলে। এক জায়গায় একটা বেশ চওড়া পুল, আক্রোশে দুহাতের চেটোর মধ্যে ধরে কে যেন দুমড়ে দিয়েছে, ইংরাজির ‘এস’ অক্ষরটাকে নুইয়ে দিলে যেমন হয়। সেখানে সব শর্মাকেই নামতে হয়েছিল।

“এক এক জায়গায় রাস্তার দুধারেই ধসে কুঁচকে গেছে। তোমার দুপাশে লম্বালম্বি ফাটল চলেছে তো চলেছেই; এক্কায় যেতে যেতে মনে হয়, যেন ও দুটো অচল দূরবিস্তৃত বিদারণ-মাত্রই নয়; দুটো করাল শিরাপেশী-বহুল হাত তোমার পাশে পাশে এগিয়ে চলেছে, যে কোনোমুহূর্তেই তার ওই শিরাপেশীগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে, তখন একবার হাত তুলে এই পৃথিবীর কাছ থেকে একটা আর্ত-বিদায় নিতেও তোমার সময় থাকবে না। একজন বললে, ‘বাবু, যেদিন হয় কাণ্ডটা, ওই ফাটলের মুখে একটা ছোট্ট ছেলে’—”

মচ করিয়া একটা শব্দ হইল। বাক্স, ট্রাঙ্ক, স্টোভের উপরকার কেটলি সবগুলি একটু কাঁপিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে হস্টেলের বাকি সমস্ত ক্যাম্প হইতে—শহরের চারিদিক হইতে একটা ত্রস্তধ্বনি রাত্রির আকাশ মথিত করিয়া ধীরে ধীরে মিলাইয়া গেল।

পরেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, কুণ্ঠিতভাবে বসিতে বসিতে বলিল, “নাও, আর একটা কাঁপন হয়ে গেল, সেকেন্ড দুয়েক ছিল বোধহয়। তেতলা বাড়িটা ঘাড়ে না ফেলে নিষ্কৃতি দেবে না দেখছি।”

বঙ্কিম বলিতে লাগিল, “দেড়টার সময় মজঃফরপুরে এক্কা থেকে নামলাম। ঘোঁতনদের বাড়ি পর্যন্ত আগে এক্কা যেত, ভূমিকম্পের পর থেকে যাচ্ছে না। ইট, কাঠ, রাবিশ, এমন কি মানুষের—”

পরেশ মুখটা বাড়াইয়া চোখ দুইটি বড় বড় করিয়া প্রশ্ন করিল, “কোঠাবাড়ি বুঝি একটিও দাঁড়িয়ে নেই? রাস্তার বুঝি দুধারেই—”

বঙ্কিম পূর্বের আক্রোশ মিটাইয়া একবারটি আড়ে চাহিয়া বলিল, “সব তো খবরের কাগজেই পড়েছ।”

আর শহরের বর্ণনার দিক দিয়াও গেল না। পরেশের উন্মুখ কৌতূহলকে খানিকটা অতৃপ্ত রাখিয়াই বলিতে লাগিল, “ঘোঁতনদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। তার মানে মজঃফরপুরের যে জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়ালে ঘোঁতনদের বাড়ি পৌঁছেছি বলা চলত। সেখানে গিয়ে রাশীকৃত ইটের স্তূপের মধ্যে তেরছাভাবে আটকানো একটা কড়িকাঠের ওপর দাঁড়ালাম। রাস্তার ধারের ওপরের ঘর দুটো পড়ে গেছে, দুটো ঘরের যত ইট নিচের তলার ছাদ ধসিয়ে দিয়ে, গলির দিকের দেওয়াল ঠেলে বেরিয়ে প্রায় সমস্ত গলিটাই বুজিয়ে দিয়েছে। খুনে ইটের গাদা ওপরতলা নিশ্চিহ্ন করে স্রোতের মতো নিচের লোকদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে খুনের নেশায় রাস্তা পর্যন্ত ছুটে এসেছে। মাঝখানে শানবাঁধানো উঠোন ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এক কোণে একটা টিউব-ওয়েল ছিল, চার-পাঁচ হাত ভেতর থেকে ঠেলে তুলে দিয়েছে। পাম্পের হাতলটা মুখে করে নলটা ধনুকের মতো বেঁকে উঠোনের মাঝে এসে পড়েছে। একটা কাক তার ওপর বসেছিল। আমার আসায় উড়ে যেতেই মাথা-ভারি নলটা ওপরে-নিচে দুলতে লাগল। সেটা গৃহস্বামীর এই অতিথিকে অভ্যর্থনা করার ব্যঙ্গ-অভিনয়ের মতো এমন অদ্ভুত দেখাতে লাগল যে, আমি থাকতে পারলাম না একটু না হেসে। উঠোনের ওদিকে দুখানা ঘর, একটা বড় কোঠা ঘর, একটা খোলার চালের। চালটি ভেঙ্গে, চারপাশের দেওয়াল কাত করে নিচে পড়েছে। আর থেকে থেকে বালি উঠে যেন আষ্টে-পিষ্টে সেটাকে আঁকড়ে ধরেছে। ওদিকটায় খুব বালি উঠেছে, টিউবওয়েলের গোড়া পর্যন্ত তার ভিজে স্রোত নেমে এসেছে। আশ্চর্যের বিষয়, কোঠা ঘরটার কিছু হয় নি; কিন্তু আমার তরফে আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই অক্ষত ঘরটা দেখে বেশ প্রীত হতে পারলাম না। কেন, তা ঠিক খুলে বলতে পারছি না, তবে মনে হচ্ছিল ওর সৌভাগ্যটা বড় বে-মানান। ওটাকে যেন একটা ভীষণতর উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য হাতে রাখা হয়েছে। আমি টের পেয়েছি বটে, যাবও না কাছে, কিন্তু একসময় না একসময় কাল-নিয়ন্ত্রিত যে অজ্ঞাত লোকটি মোহাকৃষ্ট হয়ে ওর মধ্যে জীবন দেবে, তার জন্যে আমার মনটা বিষাদে ভরে উঠল।

“সব দেখে শুনে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম; হঠাৎ হুঁশ হল, কাউকে ডাকা দরকার তো, কতক্ষণই বা এই রকম হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকব, আর থেকেই বা করব কি? ডাকতে গিয়ে কিন্তু সমস্যা উদয় হল, কার নাম ধরে ডাকি? এই তো বাড়ির অবস্থা, এতে একজনও কি বাকি থাকতে পারে, যে আমার ডাকে উত্তর দেবে? ঘোঁতনদের সবাইকেই আমি জানি, পাতানো সম্বন্ধ ধরে কিম্বা ছোটদের নাম ধরে ডাকতে পারতাম; কিন্তু ডাকা হয়ে উঠছিল না। যার কথাই ভাবি কেবলই তার মুখটা মনে হচ্ছিল, আর ভয় হচ্ছিল, উত্তর পাব না। উত্তর পাচ্ছি না, অথচ ডেকে যাচ্ছি; এরকম বাতুলতার সম্ভাবনায় নিজের কাছে কুণ্ঠাও বোধ হচ্ছিল। শেষকালে মনে পড়ল ঘোঁতনদের কাকা নিশ্চয়ই জীবিত আছেন। তাঁর চাকরি যে অফিসে সেটা নিশ্চয়ই ভাঙে-চোরে নি, আর ও-সময়টা তিনি ওখানেই ছিলেন, তাই ডাকলাম, ‘অবিনাশবাবু!

“উত্তর পেলাম না। স্বরটা বিকৃত হয়ে কেঁপে যাওয়ায় তক্ষুনি আবার ডাকতেও পারলাম না। চারদিক নিস্তব্ধ, জনমানব নেই, শুধু গলির শেষে একটি বিহারী ভদ্রলোক দুজন কুলি নিয়ে একটা বাড়ি পরিষ্কার করছিল, তিনজনেই কাজ ছেড়ে আমার দিকে একটু চেয়ে রইল।

“একটু চেঁচিয়ে বললাম, ইস্ মকানমে অবিনাশবাবু নামক—’

“সমস্ত শরীরটা ইলেকট্রিক শক পেয়ে যেন শিউরে উঠল, ঠিক পেছনেই ভারি আওয়াজ শুনলাম, ‘অবিনাশবাবুকে খুঁজছেন? তিনি তো নেই।”

“ফিরে দেখি এক বাইশ-তেইশ বৎসরের যুবা, খালি গা, গায়ে একটা ছেঁড়া মটকার চাদর জড়ানো, ক্ষৌরির অভাবে মুখটা অল্প অল্প দাড়িতে ভরে গিয়েছে, তেলের অভাবে কোঁকড়া কোঁকড়া দীর্ঘ চুলগুলো ফুলে উঠে বয়সের অনুপাতে তাকে যেন অতিরিক্ত ঢ্যাঙা করে দিয়েছে।

“আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলাম, ‘নেই? তিনি কোথায় বলতে পারেন?’”

“যুবা তার ফাঁপা চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বেশ জোরেই হেসে উঠল। সে এক উৎকট হাসি, আওয়াজে যতটা না হোক; চোখের চাউনিতে তো বটেই; মনে হল, তার চোখের ভেতর দিয়ে একটা পাগল যেন হঠাৎ উঁকি মেরে মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। বললে, ‘বেশ জিজ্ঞাসা করেছেন! আপনি অবিনাশবাবুর কেউ হন নাকি?”

“বললাম –‘না!’

“যুবক বললে, “মিথ্যা কথা থেকে বাঁচালেন। কেউ হলে নিশ্চয়ই মিথ্যে বলতে হত, কেন না সত্যি কথা শুনিয়ে কয়েকজনের যা অবস্থা করেছি, তাতে সত্যের উপর আর টান নেই ততটা।”

“যুবক একটু কাষ্ঠহাসি হেসে মাটির পানে চেয়ে মাথাটা একটু দুলিয়ে দুলিয়ে বললে, ‘কোথায় গেছেন জিজ্ঞাসা করছেন? হ্যাঁ, আমার জানা উচিত ছিল বটে, কেননা আমার বাড়ি থেকে ওই পথে আরও চার-চারজন আগেই গেছে, কিন্তু কেউ তো আর

“গলার স্বরটা বদলে গেল। একটু থেমে, রুদ্ধ গলা ঠেলেই বললে, ‘মশাই, ছোট- মেয়েটা চার-পাঁচদিন আগে একবার হারিয়ে গিয়েছিল, গলির শেষে হিন্দুস্থানীদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। বলেছিলাম, এবার যখন কোথাও যাবে বাসু, বলে যেও মা! এসে শুনলাম, ইটের গাদার মধ্যে থেকে অনেকবার ডেকেছিল, বলে যাবে বলে—”

“আমার প্রশ্নটা যে এমন ব্যথায় আঘাত দেবে, মোটেই আশঙ্কা করি নি। বললাম–‘শান্ত হোন, ভগবানের জিনিস ভগবান নিয়েছেন।’

“ছোকরা আমার দিকে একটু চেয়ে রইল! তারপর ধীরে ধীরে যেন আপন মনেই বললে, “হুঁ, ভগবান—ভগবান!

“যেন তার অজ্ঞাতসারেই তার চোখ দুটো একবার চারিদিকের প্রলয়-শ্মশানের উপর দিয়ে ঘুরে এল। অনেকক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইলাম।”

বঙ্কিম এবারে ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাইয়া তিন-চারিটা টান দিল। দেরি হইয়া যাইতেছে দেখিয়া পরেশ বলিল, “সেখানে যতটা চুপ করেছিলে, এখানে ততটা না করলেও বুঝে নেব। তারপর?”

“সেই ছোকরা আমায় অবিনাশবাবুর কথা বললে। খানিক দূরে একটা ইটের গাদার চারিদিকে কতগুলো কাক বেজায় চেঁচামেচি করছিল। ছোকরা বললে, ‘একটা মাড়োয়ারীর বাড়ি ছিল ওটা। পরশু মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা একজনকে টেনে তুললে। লোকটাকে যতই জিজ্ঞাসা করে, আর কেউ আছে? সে শুধু কচি ছেলের মতন হাত ঘুরোয়। আমার বিশ্বাস কাকেরা আর একটার সন্ধান পেয়েছে।’

“আমি বললাম, ‘চলুন এখান থেকে সরে যাই।’

ছোকরা আবার একবার তার সেই পাগলাটে হাসি হেসে বললে, ‘সরে আর মজঃফরপুরে কোথায় যাবেন? বরং চলুন ঐ কাঠটার ওপর। অবিনাশবাবুর গল্পটা বলি, দেখেছেন আপনি অবিনাশবাবুকে?”

“আমি মিথ্যে করে বললাম, ‘না, দেখি নি।’

“বললে ‘একহারা চেহারা; কপালে শির-ওঠা, অল্প কিছুতেই বড্ড বেসামাল হয়ে যেতেন, আর কপালের শিরাগুলো জেগে উঠত, বেজায় নার্ভাস প্রকৃতির লোক আর কি। ভূমিকম্পটা হল ঠিক দুটো ষোলয়; নিজে বাঁচতে বাড়ির ভাবনা এসে জুটল। এই ব্যাপার তো সেখানেও হয়েছে। আপিসে কাগজপত্র ফেলে পাগলের মতো ছুটলাম। পৃথিবীর কাঁপন তখন আকাশে গিয়ে পৌঁছেছে। সমস্ত শহরের হাহাকারে মনে হয়, আকাশটা চুরমার হয়ে ভেঙে পড়বে। স্টেশন রোড দিয়ে মানুষের স্রোত শহরের দিকে ছুটে চলেছে, দুপাশে বাড়ি- ঘর-দোরের ভাঙনের বিকট দৃশ্য, এক একটা দেওয়াল কি ছাদের কোণ তখনও ভেঙে ভেঙে পড়ছে, চারিধার ধুলোয় ধুলো, স্টেশনের রাস্তা দিয়েই বোধ হয় আপনি আসছেন, না? স্টেশন থেকে খানিকটা এসেই একটা চৌমাথা পড়ে, মাঝখানে টেলিগ্রামের চারটে পোস্ট, তলাটা বাঁধানো। খানিকটা এগিয়ে এসেছি, এমন সময় কে ডাকলে—যদু’! ফিরে দেখি রাস্তার মাঝখানে সেই শান-বাঁধানো চত্বরটিতে অবিনাশবাবু বসে। গা-ময় সুরকির ধুলো, জামার একটা পকেট ছিঁড়ে ঝুলে পড়েছে। ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘খবর কি অবিনাশদা? আপনাদের বাড়ির আর সবার—?’

“অবিনাশদার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কপালের শির ফুলে উঠেছে, একটা ঢোক গিলে, ভাঙা আওয়াজে বললেন, ‘যেতে পারছি না—কি হল যদু? কি হবে?’

“জিজ্ঞেস করলাম, ‘গায়ে লেগেছে?’

“বললেন, “না; বেঁচে গেছি, কিন্তু পা উঠছে না। এতটা তো এলাম কোনো রকমে, কিন্তু—”

“ওঁর সেই নার্ভাসনেস্, অনিশ্চিতের সামনে এগুতে পারছেন না। হাতটা টেনে বললাম, “উঠুন, শিগগির, এ কি করছেন? আচ্ছা দুর্বল-চিত্ত মানুষ তো!

“তুলতে পারলাম না, উঠলও না, ফ্যালফ্যাল করে চারিদিকের বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে বললেন, “কি দেখব বল তো গিয়ে যদু? এই সময় সবাই ওপরের ঘরে নিশ্চিন্দি হয়ে শোয়; কি হল, কি হবে?”

“আমাদেরও ওপরে একখানা চালাঘর। আর দাঁড়াতে না পেরে একবার খাতিরের বলা বললাম, ‘চলুন না ছাই।’ তারপর পা বাড়ালাম।

“অবিনাশদা বললেন, “উঠতে পারছি না যে! পা কাঁপছে! ঠিক যে কাঁপছে তা নয়, কেমন অবশ হয়ে গেছে।”

“আমি একটু এগিয়ে গেলে ভাঙা গলায় খুব জোর দিয়ে ডাকলেন, ‘যদু!’ “ফিরে দাঁড়ালাম, বললাম, “কি?”

“আমায় বলে যেও; এইখানেই রইলাম।

“সামনের চুলগুলো মুঠোর মধ্যে ধরে, মাথাটা হাঁটুর মধ্যে গুঁজে দিলেন, এখনও অবিনাশদাকে যেন দেখতে পাচ্ছি, সেই অবস্থায়।

“আগেই অবিনাশদার বাড়ি পড়ে, আমার বাড়িটা গলি শেষ করে বাঁদিকে ঘুরতেই। এসে দেখলাম, এই অবস্থা। ইটের গাদা টপকে, দরজা, জানলা, কড়িকাঠ ডিঙিয়ে, নদ্দমায় পড়ে, বাড়ির দিকে ছুটলাম। যা দেখলাম, তা বলেইছি আপনাকে।

“ছোকরা আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইল, সেই অদ্ভুত দৃষ্টি; যেন আমার মুখের উপর সেই পুরনো দৃশ্যটার ছায়া পড়েছে, একদৃষ্টে দেখছে। পরে চোখ দুটো ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘বিড়ি রাখেন?”

“আমি কেস থেকে একটা সিগারেট বের করে দিতেই ছোকরার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন কি জিনিস পেয়েছে! লোক তখন একমুঠো খেতেই পাচ্ছে না,

“সিগারেটটা ধরানো পর্যন্ত কিন্তু আনন্দটা বজায় রাখলে না, চোখ দুটো জলে ছাপাছাপি হয়ে উঠল। কিছু না বলে মটকার চাদরটা দিয়ে মুছে নিয়ে, ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিগারেটটা টানতে লাগল। বুঝলাম, ও যে আজ ভিখিরি, অল্পেই বর্তে গেল, এইটে ওকে মর্মান্তিক আঘাত দিয়েছে; ওর আনন্দের আসল রূপটা চিনতে পেরেই ওর এই চোখভরা জল। আমিও একটা সিগারেট ধরিয়ে নিঃশব্দে টানতে শুরু করে দিলাম। সান্ত্বনা দিতে গেলে জিনিসটা আরও ফুটিয়ে তোলা হত।

‘নখের কোণে যখন আর শেষটুকু ধরে রাখতে পারলে না, তখন ফেলে দিলে সিগারেটটা। গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বেশ সহজভাবে বললে, ‘বাড়ির হিসেব যখন সেরে ফেললাম, তখন বেশ সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হঠাৎ কর্তব্যজ্ঞান চাগিয়ে উঠল, অবিনাশদা বসে আছে যে আমার পথ চেয়ে! যে বেঁচে গেছে দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে তো সব সময় বেঁচে থাকতে হবে। লোকটাকে নিয়ে তো আসি অন্তত। গোয়ালঘরটায় সবাই গোছগাছ করে নিয়েছে— নতুন গৃহপ্রবেশ। পিসিমাকে বললাম, ‘আমি এক্ষুণি আসছি।’

“বাইরে পা দিতেই কিন্তু গা-টা ছমছম করে উঠল। নিস্তব্ধ! লোক নেই, রাস্তা নেই, শব্দ নেই; সব—যেন শব্দ পর্যন্ত কবরের মাটিতে চাপা পড়েছে। কিন্তু কর্তব্য আমায় ভূতের মতোই টানতে লাগল। পকেটে একটা টর্চ ছিল, সেদিন সকালেই কিনেছি, হঠাৎ কি রকম ইচ্ছে হল, ইনটুইশন বলতে পারেন—অজ্ঞাতের নির্দেশ। সেইটা হাতে করে আলেয়ার মতো জ্বালতে জ্বালতে এগুলাম। ঐখানটায় এসে দেখি, কে একজন একখানা একখানা ইট তুলে গলির উপর ফেলছে, টর্চ ফেলে দেখি অবিনাশদা।

“তাড়াতাড়ি এগিয়ে ডাক দিলাম। মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন, বললেন, ‘বড্ড দেরি হয়ে গেছে যদু, তাই তাড়াতাড়ি ইটগুলো সরাচ্ছি। কি হল বলতো, কি হবে?’

“আমি বলে ফেললাম, ‘সবাই ভালো আছে যে।’ বোধ হয় সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যেই বললাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, যেন গোলমালের মধ্যে কার মুখে শুনেছিলাম কথাটা, মনে একটা আবছা দাগ রেখে মুছে গিয়েছিল। যাই হোক, কথাটা বলেই কিন্তু হঠাৎ থেমে গেলাম, কেননা কোথা থেকে বললাম, নিজেই ধরতে পারলাম না। অবিনাশদা একখানা ইট হাতে তুলে, আস্তে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় আছে?’

“আমি একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, “চলুন তো, উঠানের দিকে যাই একবার।’

“অবিনাশদা ‘চল’ বলে হনহন করে এগিয়ে, হোঁচট খেয়ে, আবার উঠে চললেন। দুজনে অনেকটা তফাৎ হয়ে গেছি, হঠাৎ ‘কে?’ বলে অবিনাশদা চেঁচিয়ে উঠলেন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, আমার দিকে চেয়ে বললেন, দেখ তো কে, যদু!’

“সত্যি একটা লম্বা ছায়া দাঁড়িয়ে উঠানের মাঝখানে। হঠাৎ পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন অবশ হয়ে গেল। সাহস সঞ্চয় করে দু’পা এগিয়ে টর্চ সামনে ফেললাম, দেখি ঐ টিউবওয়েলটা লম্বা বক্রাকার শুঁড় নামিয়ে দিয়েছে। সন্দেহটা তক্ষুণি কেটে গেল বটে, কিন্তু এই উপলক্ষে ওই—সমস্ত বাড়িটার উপর যেন অবিশ্বাসে মনটা ভরে গেল। অবিনাশদা এগিয়ে এসে, হঠাৎ ঝুঁকে এই কাঠটায় একটু কান লাগিয়ে রইলেন, যেন কারুর বুকে যদি সেটা স্পর্শ করে থাকে তো এই কড়িকাঠ বেয়ে তার ধুকধুকুনি শুনতে পাবেন। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আর কি!

“একবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বাড়িতে আছ কি? কোথায় আছ সাড়া দাও

“সাড়া না পেয়ে আমার মুখের দিকে চাইলেন। ক্রমে ক্রমে মুখে চোখে যেন একটু বুদ্ধির ভাব ফুটে উঠল, চোখ দুটো বড় বড় করে বললেন, ‘ঘুমিয়েও তো পড়তে পারে যদু, ঠিক বলছি না?’

“টর্চ ঘোরাতে ঘোরাতে আমার তখন ইটের গাদার আড়ালে ঐ ঘরটায় নজর পড়েছে। বললাম, ‘হতেও পারে, চলুন তো, ঐ ঘরটা যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে বলে বোধ হচ্ছে।’

“অবিনাশদা আমার হাত থেকে টর্চটা ছিনিয়ে নিলেন, হাতটা তাঁর থর থর করে কাঁপছে। চঞ্চল আলোটা ঘরের কোণটাতে ফেললেন, তখন ঘরের সামনে কতকগুলো ইট, দরজা, জানালা পড়ে ছিল বলে সমস্তটুকু দেখা যাচ্ছিল না। এই উঠোনটা দুটো লাফে পেরিয়ে, টিউবওয়েলের হাতলে একটা চোট খেয়ে ঐ ঘরের সামনে গিয়ে উঠলেন। পেছনে পেছনে আমি। সেই নার্ভাস অবিনাশদা, তাঁর গায়ে হঠাৎ শক্তি এল কোথা থেকে, অমন চোটটাকেও গ্রাহ্য করলেন না।

“গিয়ে দেখি, ঘরটা ঠিক আছে; কিন্তু দোরটা ভেতর থেকে বন্ধ। অবিনাশদা জোরে উপর্যুপরি তিন-চারটে ঘুষি মেরে বললেন, “ওগো, শিগগির দোর খোলো, আমরা! রাজু! অনাথ!’

“খুলবে কি, দুটো দরজার মাঝে যা আধ-ইঞ্চিটাক ফাঁক ছিল, ভেতর থেকে দোর চেপে কে যেন নিশ্চিহ্ন করে সেটুকুও বুজিয়ে দিলে। কট কট কট করে আওয়াজ হল, আর আমার টর্চের যে আলোটুকু ভেতরে প্রবেশ করেছিল, কার তাড়া খেয়ে বন্ধ দোরের ওপরে এসে জমে উঠল। দুজনে কিম্ভূতকিমাকার হয়ে দুজনের মুখের দিকে চাইলাম। আলো ঠিকরে অবিনাশদার কপালে পড়েছে, শিরাগুলো যেন এই ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ে বলে!

“গলার আওয়াজ বসে গেছে; বললে, ‘কে আরও চাপ দিলে ভেতর থেকে?’

“আমারও প্রশ্ন তাই, কিন্তু ওঁকে জিজ্ঞাসা করে আর কি করব? ঘরটার সামনের দিকে জানালা নেই, ওপাশটা স্তূপাকার ইট এসে দেওয়ালে চেপে পড়েছে। ডান দিকটা ঘুরে গেলাম, একটা ছোট জানালা আছে, খোলাও; তাড়াতাড়ি টর্চ ফেলতে আলোটা হাতখানেকের মধ্যেই একটা তক্তার উপর গিয়ে পড়ল। অবিনাশদা হতাশ ভাবে বললেন, ‘সেই আলমারিটা, ও নড়ানো যাবে না। তারপর জানলার কাছে মুখ নিয়ে চাপা আওয়াজটাকে সাধ্যমতো তুলে ডাকলেন—শুনছ? আমি ডাকছি, এই কি ঘুমোবার সময়?’

আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘হয়তো ঘুমোচ্ছে না; কিন্তু দোর এঁটে দিলে কেন? কে?’

‘অবিনাশদার চোখ দুটো হঠাৎ অস্বাভাবিক রকম বড় হয়ে টর্চের আলোয় জ্বলজ্বল করে জ্বলতে লাগল। ডান হাতে আমার হাতটা চেপে বললে, ‘যদু, তুমি ওসব কথায় বিশ্বাস কর?’

“আমি শুধু অবাক হয়ে লোকটার ভয়ঙ্কর আকৃতির দিকে চেয়ে রইলাম। অবিনাশদা বললেন, ‘মেরে ফেলবে। আজ ভরা-জীবনের মাঝখানে, দু মিনিটে অতর্কিতে যারা শেষ

দু হয়েছে, তারা আক্রোশে কাউকে বাঁচতে দেবে না। দেখলে না, দোরে ঘা পড়তেই চেপে এঁটে দিলে!’

“আমার মুখের দিকে চেয়ে কি ভাবলেন এক মুহূর্তটাক, তারপর উঠে পড়ে ইটগুলোর উপর হামাগুড়ি দিয়ে দোরের সামনে হাজির হলেন। আমি একটু পেছিয়ে পড়েছিলাম। সেই চাপা, ঠেলে-বের-করা আওয়াজে ডাকলেন, ‘শিগগির এস যদু। ওগো, ঘুমিও পরে, এ আমরা!’ গিয়ে দেখি, একটা দোরের দুখানা তক্তার জোড়ের মুখে পেন্সিল গলার মতো যে একটু ফাঁক আছে, অবিনাশদা তাতে মাথার এক পাশটা চেপে সমস্ত মনটা যেন ঘরের ভেতর সাঁদ করিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দোরের সঙ্গে যেন একেবারে মিশে যেতে চান।

‘বললাম, ‘কি?’

“খানিকক্ষণ কিছু বললেন না, শুধু রগ কান আর গলাটাকে দোরের ওপর আরও চেপে ধরলেন, তারপর হঠাৎ সরে এসে বললেন, ‘যদু, শোন তো! বেঁচে আছে! বেঁচে আছে! সত্যি বেঁচে আছে!’

“কাঠ চিরতে চিরতে শক্ত গাঁটে ঠেকলে হঠাৎ আওয়াজ যেমন কড়া হয়ে ওঠে, অবিনাশদার কথার শেষের আওয়াজগুলো সেই রকম বিকট হয়ে উঠল। আমি সেই জোড়ের মুখে কান দিলাম!

“সত্যিই নিশ্বাসের শব্দ। সি—সি—স করে স্পষ্ট নিশ্বাসের শব্দ—এক-আধটা নয়, অনেকগুলি নাক থেকে; তার সঙ্গে বেশ একটা অদ্ভুত শব্দ—ঘির্‌–র্—র্‌–; ঘির্‌–র্—র্‌–। এক একবার ক্ষীণ হয়ে পড়ে, এক একবার ভারি নাক-ডাকার শব্দের মতো মনে হয়, আবার একবার মনে হয় যেন গলার ঘড়ঘড়ানি।

“অবিনাশদার পানে চাইলাম। চিনতে পারা যায় না যেন; কপালে শিরাগুলো দপদপ করছে, সমস্ত শরীরের রক্ত গিয়ে মাথায় ঠেলে উঠেছে। বললেন, ‘দেখলে তো? দেবে না বাঁচতে, দোর চেপে ধরেছে, উত্তর দিতে দেবে না, গলা চেপে ধরেছে।’

“হঠাৎ বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সমস্ত শরীর কাঁপছে, একবার একটা ইটের চাঁই আঁকড়ে ধরলেন, একবার একটা ভাঙা কড়িকাঠ, তারপর ঘুরে সমস্ত শরীরের জোর দিয়ে দোরটার ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমায় হুকুম করলেন, ‘ঠেল যদু, দেখছ কি হাঁ করে, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে!’

“একটু হাত লাগালাম, কিন্তু অসম্ভব! যত এদিক থেকে জোর দিই, ততই যেন ভেতর থেকে কারা ঠেলে ধরে; তাদের ক্ষমতার সামনে আমাদের শক্তির তুচ্ছতা যেন প্রতি মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল।

“আমি ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘দাঁড়ান অবিনাশদা, এ করে হবে না। দেখি অন্য কোনোখান দিয়ে ভিতরে যাওয়া যায় কি না। যদি ছাতটাও একটু ভেঙে থাকে—”

“অবিনাশদা গেলেন না, ঐ কাঠটার উপর ঠেলে চাড় দিতে লাগলেন, আমি ডান দিকটা ঘুরে ওদিককার ইটের গাদার উপর উঠলাম। দেখলাম ছাতে ওঠা যায় না। নেমে পেছনের দিকটায় গেলাম। একটা ভাঙা কড়িকাঠ বেয়ে ওপরে উঠতে যাব, এমন সময় দোরের ওদিক থেকে করাত দিয়ে পাথর কাটলে যেমন আওয়াজ হয়, সেরকম একটা উৎকট আওয়াজ হল—’হ য়ে ছে! হুঁ-ম!’

“ইট কাট দরজা জানলা ডিঙিয়ে ফিরতে মিনিট খানেক কি দেড় মিনিট দেরি হয়েছিল। এসে দেখি, অবিনাশদা ঘরের চৌকাঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছেন, হাত, দুটো আর মাথাটা দোরে লাগানো রয়েছে, তাঁর অমানুষিক শেষ শক্তিতে দরজাটার নিচের পুরোনো কব্জাটা আলাদা হয়ে চৌকাঠের কাছে দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেছে।

“গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকলাম, ‘অবিনাশদা!’

শরীরটা গড়িয়ে পড়ল।

.

“ছোকরা আমার দিকে খানিকটা সেইরকম আবিষ্টভাবে চেয়ে রইল, তারপর বললে, ‘সিগারেট দিন আর একটা। চলুন, আর দাঁড়িয়ে কি হবে এখানে?

“আসতে আসতে বলতে লাগল, ‘একলা আর সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না, তাড়াতাড়ি কোনো গতিকে ফিরে গেলাম। জন আষ্টেক লোক যোগাড় হল, আর দুটো শাবল। অবিনাশদার শরীরটাকে সরিয়ে রেখে, দোর দুটো ভাঙা হল।

“কোথায় কে? ভেতরে শুধু গাদাপ্রমাণ বালি। ঘরের অর্ধেক পর্যন্ত ঠেলে উঠে আসবাবপত্র ডুবিয়ে দোর চেপে ধরেছে। ভিজে বালি শুধু, তিন-চারটে মুখ দিয়ে তখনও ঘোলাটে জলের সঙ্গে আরও বালি বেরুচ্ছে। একটা টানা আওয়াজ সি-সি-সি। জলের স্রোত ঘরের দু-তিনটে ফাটল দিয়ে চাপা কুলকুল আওয়াজ করতে করতে ঘুরে পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই শব্দসমষ্টিকে ভুল করেই অবিনাশদা প্রাণ দিলেন। পরের দিন খোঁজ পাওয়া গেল, বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা কোনো রকমে—”

এমন সময়ে সামিয়ানার পর্দা নড়িয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘোঁতন অর্ধেক শরীর প্রবেশ করাইয়া প্রশ্ন করিল, “তোরা জেগে এখনও? ফিরে এলাম, স্টীমারে উঠতে যাব, দেখি কাকা নামছেন। আজ ভোরে মজঃফরপুর থেকে বেরিয়েছিলেন, এখন পৌঁছুলেন। ছ-সাত ঘণ্টার রাস্তা আঠার-কুড়ি ঘণ্টা লেগে গেল। হ্যাঁ, খবর ভালো, বাড়িটাও বেঁচে গেছে একরকম।…খোকা, একটু চা চড়াও ভাই। কাকা, আসুন ভেতরে।”

খোকা, পরেশ, মৃগেন পরস্পরের প্রতি চাহিয়া, একসঙ্গে বঙ্কিমের মুখের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। সে বেশ সপ্রতিভ ভাবেই বলিল, ‘আমারও এক কাপ হলে ভালো হয়।” মৃগেন ধীরে ধীরে বলিল, “তোমায় যে বললে গল্পটা সে লোকটা তাহলে বোধ হয় বাইরের লোক ছিল, কিংবা বদ্ধ পাগলই!”

খোকা স্টোভ জ্বালিতেছিল, রাগে গরগর করিতে করিতে বঙ্কিমের প্রতি কটাক্ষ হানিয়া বলিল, “সে লোকটা ছিলই না মোটে, লোকের প্রাণ যায়, আর উনি খবরের কাগজ পড়ে পড়ে উপন্যাস রচনা করছেন!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *