ভূত যখন বন্ধু হয়
ভূতেরা বন্ধু হয় এমন কথা ভাবতেও অবাক লাগে। আমাদের ছোটো থেকে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে ভূত মাত্রেই মানুষের শত্রু। আমরা অনেক গল্পে দেখেছি ভূত কেমন ভাবে তার প্রতিহিংসা গ্রহণ করে। কেমন করে তার জীবিত কালের শত্রুকে মৃত্যুর পর তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। একটি গল্পে তার সামান্য দৃষ্টান্ত আছে। রণক্ষেত্রে মৃত এক সৈনিকের ভূত সেখানে সিজারকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছিল। এবং সেই যুদ্ধে সিজারের জয় হবেই এমন ভবিষ্যৎবাণীও করে গিয়েছিল। পরম বন্ধুর মতো ভূত সেখানে পথের সন্ধান দেখিয়েছে। আমাদের এবারের গল্প আর এক বন্ধুভূতের। ভূত এখানে পরম হিতৈষীর মতো এক নরপতিকে ইঙ্গিত দিয়েছে তার আসন্ন বিপদের। যদিও সে রাজাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি তবুও তার উপদেশ মতো কাজ করে রাজা সাময়িক অব্যাহতি পেয়েছিলেন। কিন্তু ভবিতব্যের হাত থেকে রাজা শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতি পাননি। কে-ই বা পায়?
তখন ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস। চার্লসের রাজত্বকাল বেশ অশান্তিতেই কেটেছিল। এর কারণ চার্লসের রাজনীতি। চার্লস মনে করতেন রাজা ঈশ্বরের প্রতিভূ। ঈশ্বরই রাজাকে প্রেরণ করেন এবং রাজাই পারেন ঈশ্বরের বিধান মতো রাজ্যশাসন করতে। চার্লস তাঁর সংস্কারে ছিলেন ভীষণ একগুঁয়ে। ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে তিনি গির্জা প্রভৃতির মধ্যেও রাজকীয় আড়ম্বর আনতে চেয়েছিলেন। গির্জা ইত্যাদি ধর্মীয় স্থানে রাজকীয় আসবাব এবং বিলাসবহুল সামগ্রীর জোগান দিতে গিয়ে বহু অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। অর্থের সংকুলান করতে গিয়ে চার্লসকে নিত্যনতুন কর চাপাতে হল রাজকোষ ভরতি করার জন্য। করভারে পীড়িত মানুষ তখন প্রায় খেপে গেল। কমনস সভাও ছিল এর বিরোধী। তারা চিৎকার করে জানাল রাজার প্রবর্তিত এই করনীতি বে-আইনি। ফলে রাজার সঙ্গে কমনস সভার লাগল বিরোধ।
১৬২৯ সালে চার্লস তাঁর রাজ্যসভা ভেঙে দিলেন। তারপর রাজ্যসভা ছাড়াই এগারো বছর তিনি নিজের খুশিমতো রাজত্ব চালালেন। রাজকীয় অত্যাচারে সাধারণ মানুষের জীবন বিব্রত হয়ে উঠল। দেশের চারিদিকের মানুষ, বিশেষ করে পিউরিটান গোষ্ঠীর লোকেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠল। কারণ রাজার ধর্মীয় সংস্কার পিউরিটান গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই কার্যকরী হয়েছিল। এ ছাড়াও আমদানিকৃত জিনিসের ওপর প্রচুর শুল্ক চাপানোর ফলে ব্যবসায়ী মহলও হয়েছিল ক্ষুব্ধ। বলপূর্বক ঋণদানও সাধারণ মানুষের রাগের আরও একটি বড়ো কারণ হয়ে উঠল। দেশের চারদিকে যখন বিক্ষোভ ভয়ংকর আকার ধারণ করল তখন রাজা বাধ্য হলেন আবার রাজ্যসভার অধিবেশন ডাকতে। রাজার ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহের পুরোধায় ছিল স্কটল্যান্ডবাসীরা। বিদ্রোহ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল তখন চার্লস বাধ্য হলেন রাজ্যসভার অধিবেশন ডাকতে। অবশেষে ১৬৪০ সালে যে পার্লামেন্টের অধিবেশন বসল সেই অধিবেশনে সদস্যরা একযোগে রাজাকে নমনীয় না হলে তাঁকে কোনোভাবেই সাহায্য করবে না এমন কথাও জানিয়ে দিল।
কিন্তু চার্লস ছিলেন বরাবরই একগুঁয়ে এবং দাম্ভিক। তিনি সদস্যদের স্পর্ধা মেনে নিতে পারলেন না। এবং রাজ্যসভা সঙ্গে-সঙ্গেই ভেঙে দিলেন।
স্কটল্যান্ডের বিদ্রোহীরাও রাজার এই স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিল না। তারা একযোগে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করে রাজাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। ফলে চার্লস বাধ্য হলেন আবার পার্লামেন্ট ডাকতে। এই পার্লামেন্ট অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল। ১৬৪০ থেকে ১৬৫৩ সাল পর্যন্ত। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এই পার্লামেন্টের গুরুত্ব অনেকখানি। এই পার্লামেন্ট অনেক প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিল।
যাই হোক আমাদের লক্ষ্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের বা চার্লসের ইতিহাস নয়। ঐতিহাসিক এক প্রেত কীভাবে প্রথম চার্লসকে তাঁর বিপদের আভাস দিয়েছিল, এ কাহিনির গল্প তাই নিয়েই। চার্লসের জীবনের দুরবস্থার কথা বলার কারণ তাঁর আত্মম্ভরিতা, তাঁর অবিবেচকতা এবং ধর্মান্ধতাই যে তাঁর শোচনীয় পরিণতি ঘটিয়েছে এটুকু বোঝার সুবিধে হবে বলেই এই ইতিহাস কথন।
পার্লামেন্টের সঙ্গে রাজার বিরোধের অনেক কিছুর মীমাংসা হলেও একটা ব্যাপারে দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে উঠল। পার্লামেন্ট চেয়েছিল বিশপের ক্ষমতা হ্রাস করতে। আমাদের দেশে যেমন পুরোহিতদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ—বিশেষ করে নীচজাতীয় লোকেরা চিরকালই অত্যাচারিত হয়েছে ঠিক সেই রকমই চার্লসের আমলে বিশপদের একচেটিয়া ক্ষমতা সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করত। বিশপরা ছিলেন রাজার হাতের পুতুল। আর ধর্মের নামে বিশপেরা রাজার ইচ্ছাকে যেমন খুশি তেমনভাবে চালিয়ে দিতেন। তাই রাজা বিশপের ক্ষমতা হ্রাস করতে চাইলেন না কিছুতেই। অবশ্য পার্লামেন্টের অনেক সদস্যই রাজার পক্ষেও মত দিলেন। এর মধ্যে আবার অনেকে মনে করলেন রাজার ক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট করে পার্লামেন্টের ক্ষমতা বাড়ানো দেশের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। আবার পার্লামেন্ট বাদ দিয়ে রাজাকে একাধিপত্য দেওয়াও অত্যন্ত কুফল দায়ক। এর ফলে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল সমস্ত সৈন্যদল। ১৬৪২ সালে রাজা তৈরি করলেন নিজস্ব সেনাবাহিনী। পার্লামেন্টও বসে ছিল না। তারা তৈরি করল নিজেদের বাহিনী। শুরু হল গৃহযুদ্ধ। এজহিলের রণাঙ্গনে মুখোমুখি হল দু-পক্ষ।
পার্লামেন্টের বাহিনীর অধিনায়ক হলেন ওলিভার ক্রমওয়েল। তাঁর নেতৃত্বে ১৬৪৫-এ গৃহযুদ্ধ ভীষণ আকার ধারণ করল। প্রায় পাঁচ হাজার পদাতিক এবং বিপুল সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে চার্লস নর্দাম্পটনে এসে হাজির হলেন। চারদিকে তখন যুদ্ধের বীভৎসতা ছড়িয়ে পড়েছে। যে সমস্ত সৈন্যরা একদা একই সঙ্গে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ শিখেছে—একই সঙ্গে দিনের পর দিন পাশাপাশি সুখে-দুঃখে কাটিয়েছে একই শিবিরে, এক সর্বনাশা গৃহযুদ্ধে তারা হয়ে পড়ল পরস্পরের শত্রু। সুযোগ পেলেই একে অপরকে নিধন করার যজ্ঞে মেতে উঠল।
বোধ হয় গৃহযুদ্ধ এমনই ভয়াবহ। সেখানে ভাই বন্ধু আত্মীয়-স্বজন কখন যে পর হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। এক সর্বনাশা ধ্বংসের খেলায় মানুষ তখন পশুতে পরিণত হয়ে যায়।
শিপ স্ট্রিটের সুইটসেফ হোটেলে রাজা তাঁর শিবির তৈরি করেছেন। সেখানে বসেই তিনি পরামর্শ করছেন যুদ্ধ কীভাবে চালাবেন। ক্রমওয়েলের বাহিনীকে কীভাবে পর্যদস্ত করবেন সেই নিয়ে ঘন ঘন বৈঠক বসাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ রণনীতি কী হবে তা নিয়েও বেশ সময় অতিবাহিত হয়েছে। তারপর সভা শেষে রাজা গেলেন শুতে। মানসিক এবং দৈহিক দুই ভাবেই রাজা তখন ক্লান্ত। বিছানায় শোবার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুমে তাঁর চোখের দু-পাতা জুড়ে এল।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন কে জানে! হঠাৎ একটা অস্পষ্ট খসখসে আওয়াজে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমটায় তিনি তেমন কিছু বুঝতে পারলেন না। আসলে তখনও তাঁর ঘুমের রেশ কাটেনি। চোখে তন্দ্রাও লেগে আছে। এরই মধ্যে প্রায় অন্ধকার ঘরে শুনতে পেলেন কে যেন ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধের সময়। গোপনে তাঁর ঘরে শত্রুপক্ষের কারও আসাও বিচিত্র নয়। বিছানার পাশে রাখা নিজের তলোয়ারটা নিমেষের মধ্যে টেনে নিলেন। তারপর মনে সাহস এনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে, কে তুমি? এত রাতে আমার ঘরে কী করতে এসেছ?’
রাজা যেন হাওয়ার সঙ্গে কথা বললেন। কারণ কেউই তাঁর প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল কেউ যেন তাঁর শয্যার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর সুযোগ দেওয়া সমীচীন নয় ভেবে রাজা তলোয়ার নিয়ে বিছানায় উঠে বসতে গেলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল ফিসফিস স্বরে আগন্তুক তাঁকে যেন কিছু বলতে চাইছে। আওয়াজটা কেমন যেন ফ্যাঁসফেঁসে আর হিসহিসে ধরনের।
রাজা অধৈর্য হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তুমি? কী বলতে চাইছ এত রাতে, আমার ঘরে এসে?’
আবার সেই হিসহিস শব্দ। এবারও রহস্যময় কিন্তু খানিকটা স্পষ্ট। রাজা কান পেতে শব্দটার মানে বুঝতে চাইলেন। আগন্তুক হঠাৎ তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটাকে চাক্ষুষ দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু একটা অশরীরী উপস্থিতি তিনি ঠিকই টের পাচ্ছিলেন।
আবার হিসহিস শব্দ হতেই রাজা স্পষ্ট শুনতে পেলেন, সেই ছায়া ছায়া মূর্তি বলছে, ‘আমাকে চিনতে পারছ না রাজা? আমি তোমার বন্ধু।’
‘বন্ধু? কিন্তু কে তুমি? কী তোমার নাম? বন্ধুই যদি হবে তাহলে আলোটা জ্বালাও। সামনে এসে দেখা দাও।’
রাজা বোধহয় আলো জ্বালাবার জন্য উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই ছায়ামূর্তি বাধা দিল, ‘আলো জ্বালিয়ো না। আলো জ্বালালে আমি এখানে থাকতে পারব না।’
‘বেশ। আলো জ্বালাব না। কিন্তু তোমার পরিচয়টা দাও।’
‘আমি স্ট্রাফোর্ড।’
‘স্ট্রাফোর্ড? কী আশ্চর্য? সে তো অনেকদিনই মারা গেছে।’
‘হ্যাঁ। তোমার জন্যেই আমি মারা গিয়েছিলাম। জীবিতকালে আমি সর্বদাই তোমার বন্ধু ছিলাম। সর্বদাই তোমাকে আমি সুপরামর্শ দিতাম।’
‘আমি তো সে কথা অস্বীকার করিনি। চারিদিকে আমার অনেক শত্রুর মধ্যে তুমিই ছিলে আমার যথার্থ বন্ধু। রাজপরিবারের জন্য তোমার আত্মত্যাগ আমি ভুলিনি বন্ধু।’
‘চার্লস, তোমার নিশ্চয় মনে আছে তোমার রাজতন্ত্রের নীতি-প্রতিষ্ঠার জন্য যারা যারা আত্মত্যাগ করেছে—তাদের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম প্রাণ দিই।’
‘যতদিন বাঁচব সেকথা আমি মনে রাখব। এ যুদ্ধে জয়লাভ করলে তোমার জন্যে আমি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করব রাজকীয় মর্যাদায়।’
‘কিন্তু’ বলেই হঠাৎ স্ট্রাফোর্ড চুপ করে গেল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ নেই। রাজাও অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিন্তু কী? তুমি চুপ করে গেলে কেন বন্ধু? বলো তুমি কী বলতে চাইছিলে?’
আবার ধীরে ধীরে সেই ফ্যাঁসেফেঁসে আওয়াজটা ভেসে এল। ‘জীবিত অবস্থায় আমি যেমন তোমার বন্ধু ছিলাম মৃত্যুর পরও আমার প্রেতাত্মা এখনও তোমার বন্ধুই আছে। তুমি একটু আগে বলেছিলে না আমার জন্যে স্মৃতিসৌধ স্থাপন করে দেবে। রাজা, তুমি আর কোনোদিনও সে সুযোগ পাবে না।’
রাজা যেন আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘কী বলছ স্ট্রাফোর্ড?’
‘হ্যাঁ’ ঠিকই বলছি, স্থূল দেহে তোমরা যা দেখতে পাও না, সূক্ষ্মদেহে আমরা ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান, সব কিছুই দেখতে পাই। আমি বন্ধু হিসেবেই তোমাকে বারণ করতে এসেছি—এ যুদ্ধ বন্ধ করো।’
‘না, না, তা হয় না। আমি রাজা চার্লস। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি। আমার শরীরে রাজরক্ত বইছে। সামান্য এক ক্রমওয়েলের দম্ভ আমি সহ্য করব না। তাকে আমি ধ্বংস করে ছাড়ব।’
‘পারবে না বন্ধু। তুমি তা পারবে না। আর কোনোদিনও তোমার পক্ষে তোমার প্রবর্তিত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। মৃত্যুর পর আমি জেনেছি একনায়কতন্ত্রের দিন ফুরিয়ে আসছে। ক্রমওয়েল সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। ওকে হারানো তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তোমাকে এও বলে রাখছি জীবনে আর কোনোদিনও কোনো যুদ্ধে তুমি জয়লাভ করতে পারবে না। তাই বলছি বন্ধু—আপোশে সব কিছুর মীমাংসা করে নাও।’
কথাগুলো বলেই লর্ড স্ট্রাফোর্ডের ভূত যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এরপর রাজা শূন্য বিছানায় অনেকক্ষণ একা একা বসে রইলেন। একটু আগের সব কিছু ভালোভাবে তলিয়ে দেখলেন। তারপর হঠাৎ তাঁর মনে হল এ সবই অলীক এবং দুঃস্বপ্ন। মুখে- চোখে ঠান্ডা জল দিয়ে আবার তিনি শুয়ে পড়লেন।
সেই রাতেই, বোধহয় ভোর রাতেই আবার স্ট্রাফোর্ডের আত্মা তাঁকে দেখা দিল। পূর্বের কথাগুলি আবারও তাঁকে জানিয়ে সাবধান করে দিল। এবার আর রাজা দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। তিনি ঠিক করলেন স্ট্রাফোর্ডের আত্মার উপদেশ গ্রহণ করবেন।
তিনি আর যুদ্ধে অগ্রসর হলেন না। ১৬৪৫-এর ১৪ই জুন জেসবিতে ক্রমওয়েলের বাহিনীর কাছে চার্লস প্রচণ্ডভাবে পরাজিত হলেন। তারপর ১৬৪৬-এর গোড়ায় তিনি ক্রমওয়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন।
স্ট্রাফোর্ডের প্রেতাত্মা বন্ধুর কাজই করেছিল। রাজাকে সসৈন্যে বিনষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু ভবিতব্য খণ্ডন করা যায় না। তা মেনে নিতেই হবে। রাজা প্রথম চার্লসকেও তাঁর নির্দিষ্ট ভাগ্য মেনে নিতে হল।
প্রায় তিন বছর পর পার্লামেন্টে রাজার বিচার চলল। বিচারের শেষে রাজাকে পার্লামেন্টে চুক্তিবদ্ধ হবার নির্দেশ দিল। কিন্তু রাজরক্তের দম্ভ কাটিয়ে উঠতে পারলেন না চার্লস। ভুলে গেলেন বন্ধু স্ট্রাফোর্ডের প্রেতাত্মার সাবধান বাণী। স্ট্রাফোর্ডের প্রেত রাজাকে মীমাংসায় আসতে বলেছিল। রাজা তা শুনলেন না। তিনি স্পষ্ট জানালেন, তিনি রাজা। তিনি সর্বশক্তিমান। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনোরকম কোনো চুক্তিতে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এবং গোপনে তিনি নিজের সৈন্যদলকে সাজাতে শুরু করলেন পুনর্বার যুদ্ধের জন্য।
ক্রমওয়েল রাজাকে আর বিশ্বাস করতে পারলেন না। তাঁর শক্তি তখন অনেক বেড়ে গেছে। যাঁরা পার্লামেন্টে রাজার সপক্ষে ছিলেন তাঁদেরকে তিনি বিতাড়িত করলেন। আর ‘রাম্প’ নামে পরিচিত পার্লামেন্টের বাকি সদস্যরা রাজাকে পুনর্বিচারে বসালেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজাকে স্বৈরাচারী ও দেশের পরমশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। শেষ বিচারে ১৬৪৯ সালে রাজাকে গদিচ্যুত করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দেওয়া হল। ১৬৪৯ সালেই তাঁর শিরশ্ছেদ করা হয়।
স্ট্রাফোর্ডের প্রেত অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রাজাকে বাঁচাতে চেয়েছিল। প্রেত বলে গিয়েছিল পার্লামেন্টের সঙ্গে একটা মীমাংসায় আসতে। কিন্তু অহংকারী রাজরক্ত পরমবান্ধবের হিতোপদেশ কানে তোলেনি। তাহলে হয়তো ইতিহাসের ধারাটাই পালটে যেত—হয়তো অন্য কিছু হত…।
___