ভূত ধরলেন বিনোদবিহারী – উল্লাস মল্লিক
প্রোফেসর বিনোদবিহারীর টেনশন শুরু হল। টেনশন হলেই তাঁর হার্টবিট বেড়ে যায়, প্রবল ঘাম হয় এবং বাঁই-বাঁই করে মাথা ঘুরতে থাকে। মোটের ওপর, কাজকর্ম ভন্ডুল। অথচ সময়টা এমনই যে, কাজ না করলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। নিজের সুনাম যাবে, সরকার আর দেশের পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না।
বিনোদবিহারী ঠিক করলেন, হার্টটা বদলে নেবেন। যদিও তাঁর হার্টটা এক্সপায়ারি ডেট ফেল করেনি, কিন্তু একটু আগেভাগেই বদলে নেওয়া ভালো। বেশ কিছুদিন হল বড্ড ধকল যাচ্ছে এটার ওপর। কারণটা আর কিছুই নয়, একজোড়া ভূত। একজোড়া ভূত জোগাড় করতে গিয়ে প্রোফেসর বিনোদবিহারী একেবারে নাজেহাল। এই একুশশো তিপ্পান্ন সালে সরকার থেকে ঠিক করা হয়েছে, বাংলাদেশের কিছু ঐতিহ্যশালী কিন্তু লুপ্তপ্রায় জিনিসের একটা মিউজিয়াম বানাবে। যেমন, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। একসময় ওয়েস্ট বেঙ্গলের দক্ষিণ দিকে সুন্দরবন নামে অতি বিশাল এক ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছিল। সেখানেই দেখা যেত অনিন্দ্যসুন্দর রাজকীয় শৌর্যের এই প্রাণীটিকে। কিন্তু গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জন্য সুন্দরবন এখন জলের তলায়। আর রয়াল বেঙ্গল টাইগারও বিলুপ্তির পথে। একজোড়া রয়াল বেঙ্গল রাখা হচ্ছে মিউজিয়ামে। তেমনই ন্যাদোস মাছ। অতি সুস্বাদু এই মাছ একসময় বাংলার খাল-বিলে কিলবিল করত। কিন্তু এখন গোটা দেশ ঢুঁড়ে ফেললেও চোখে পড়ে না। বহু কষ্টে কয়েকটা মাত্র জোগাড় করে রাখা হচ্ছে মিউজিয়ামের অ্যাকোয়ারিয়ামে। টিকিট কেটে জনসাধারণকে দেখতে হচ্ছে ন্যাদোস মাছ।
প্রোফেসর বিনোদবিহারীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভূতের। বাংলার ভূতের সুনাম একসময় ছড়িয়ে ছিল সারা দুনিয়ায়। কত রকম ভূত যে ছিল এখানে! তাদের আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্রও কত রকমের! ব্রহ্মদৈত্যের মেজাজের সঙ্গে মেছো ভূতের মেজাজ একেবারেই খাপ খায় না। মামদোর ভাবগতিক আবার সম্পূর্ণ আলাদা। শাঁকচুন্নি আর পেতনির মধ্যেও বিস্তর ফারাক। কিন্তু সেসব দিন গিয়েছে। চারদিকে এত গিজগিজে লোক, থাম্বা থাম্বা অট্টালিকা, ঝকমকে আলো যে, ভূতেরা একটু-একটু করে কমতে-কমতে এখন একেবারে তলানিতে। তাই সরকার থেকে প্রোফেসরকে বলা হয়েছে, ‘খুঁজেপেতে একজোড়া জোগাড় করে আনুন, এনি টাইপ অফ গোস্ট, অফ এনি স্পিসিস।’
বিনোদবিহারী কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। অতি সংবেদনশীল জি ডি ডি (গোস্ট ডিটেক্টর ডিভাইস) নিয়ে তারা ঢুঁড়ে ফেলছে গোটা দেশ। এই জি ডি ডি এমন যন্ত্র, যেটা কাছাকাছি ভূত থাকলে তার অস্তিত্ব নিখুঁতভাবে জানিয়ে দেয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। রোজ ব্যর্থ সংবাদ আসছে, ‘না স্যার, ভূতের গন্ধটুকুও নেই কোথাও।’
প্রোফেসর বিনোদবিহারী ঠিক করলেন অ্যাসিস্ট্যান্টদের উপর ভরসা না করে নিজেই মাঠে নামবেন। কিন্তু তার আগে হার্টটা বদলে নেওয়া দরকার। ওয়েস্ট বেঙ্গলের হার্ট-ব্যাঙ্কের ওপর খুব একটা আস্থা নেই তাঁর। এখানকার হার্টগুলো একটু পলকা ধরনের, খুব একটা চাপ সহ্য করতে পারে না। সম্প্রতি পঞ্জাবে ভালো একটা হার্ট-ব্যাঙ্ক হয়েছে, যে-কোনো হার্টের ওপর একশো বছরের ওয়ারান্টি দেওয়া হচ্ছে। নিজের সৌরচালিত ছোট্ট গাড়িটা বের করলেন বিনোদবিহারী। এখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে সেভেন-টাওয়ার ফ্লাইওভার, অর্থাৎ একটা ফ্লাইওভারের ওপর আর-একটা, এইভাবে পরপর সাতটা। গাড়ি চালিয়ে সবচেয়ে ওপরেরটায় চলে এলেন বিনোদবিহারী। তারপর চারশো পঞ্চাশ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি ছোটালেন অমৃতসরের দিকে।
হার্ট-ব্যাঙ্কের প্যাকিং জোনে গাড়ি পার্ক করে একটু এগোতেই প্রোফেসর গোবিন্দলাল বর্মনের সঙ্গে দেখা। গোবিন্দলাল বর্মনের ওপর ভোঁদড়ের দায়িত্ব ছিল। যত দূর জানেন বিনোদবিহারী, গোবিন্দলাল লুপ্তপ্রায় বংলাদেশি ভোঁদড় জোগাড় করে ফেলেছেন। নিউউ চ্যানেলগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল সংবাদটা। কারণ আর কিছুই নয়, কয়েকটি বিতর্কিত প্রশ্ন উঠেছিল ভোঁদড় দু’টোকে নিয়ে। গোবিন্দলাল ভোঁদড় দু’টোকে ধরেছিলেন আফ্রিকার জঙ্গল থেকে। প্রশ্ন উঠেছিল, আফ্রিকার জঙ্গলে বাংলাদেশি ভোঁদড় আসে কী করে? শেষে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, স্টিভ হ্যামিলটন নামে এক খামখেয়ালি সাহেব ছিলেন বহু বছর আগে। জন্তুজানোয়ার নিয়ে অদ্ভুত-অদ্ভুত পরীক্ষা চালাতেন। যেমন কুমিরের জ্বর মাপতেন, বাঁদরের ব্লাডপ্রেশার দেখতেন, ছাগলের লিভার ফাংশান টেস্ট করতেন। সেসব আবার তৎকালীন কিছু চ্যানেল প্রচারও করত। তা সেই সাহেব গবেষণার কাজে ক’টা বাংলাদেশি ভোঁদড় দেশে নিয়ে যান। এই ভোঁদড় দুটো তাদেরই সাক্ষাৎ বংশধর, এতদিন কোনো রকমে টিকেছিল ওখানে।
গোবিন্দলালকে দেখে কৌতূহল দমন করতে পারেন না বিনোদবিহারী। বললেন, ‘আপনি এখানে যে! আপনারও হার্টের প্রবলেম নাকি?’
গোবিন্দলাল বললেন, ‘আমার নয়, মায়ের।’
‘আপনার মায়ের!’ একটু অবাক হয়ে গেলেন প্রোফেসর বিনোদবিহারী।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোবিন্দলাল যা বললেন তার মর্মার্থ এই যে, তিনি যখন ভোঁদড় ধরতে আফ্রিকায় গিয়েছিলেন তখন তাঁর মা বাড়িতে বসে চিন্তা করে—করে হার্টটাকে ড্যামেজ করে ফেলেছেন। ওই দুর্গম জঙ্গলে ছেলে কী করছে, এই ছিল তার রাতদিনের চিন্তা। গোবিন্দলাল যত তাঁকে বোঝান যে, আফ্রিকার সে জঙ্গল আর নেই, সেখানেও এখন মানুষ বসতি গড়েছে, এমনকী বিদ্যুৎ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। তা কে কার কথা শোনে! দিনরাত শুধু চিন্তা করেছেন ছেলের জন্য।
বিনোদবিহারী বললেন, ‘মায়ের মন তো, ছেলেপুলের জন্য আনচান করবেই। যাক! আপনার আসল কাজ তো উদ্ধার হয়ে গিয়েছে। আমার যে এদিকে কী অবস্থা কী বলব!’
‘আপনার তো ভূত?’
‘হ্যাঁ,’ বিনোদবিহারী হতাশার সঙ্গে বললেন, ‘ভূত বোধ হয় ভূভারতে আর একটাও নেই! যে জিনিস নেই, সে জিনিস কেমন করে ধরে আনি বলুন তো? এদিকে মিউজিয়াম অথরিটি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, রোজ তাগাদা দিচ্ছে।’
একটু কী যেন চিন্তা করে গোবিন্দলাল বললেন, ‘আছে, ভূত আছে।’
‘কোথায়?’ খুব ব্যগ্র হয়ে বিনোদবিহারী জিজ্ঞেস করলেন।
গোবিন্দলাল বললেন, ‘আমার মামার বাড়ি বনগাঁর দিকে। কিছুদিন আগে আমার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ও বলল, ওখানে একটা পোড়ো বাড়িতে একদল ভূত এখনও আছে। তবে তারা খুবই ভিতু প্রকৃতির। ভয়টয় দেখানো দূরের কথা, নিজেরাই সব সময় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। জনসমক্ষে কখনো আসে না। শুধু সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে গৃহস্থের বাড়ি থেকে মাছ ভাজাটাজা চুরি করে নিয়ে যায়। ক’দিন আগেই তো, রান্নাঘরে খুটুর-খুটুর শব্দ শুনে বড় মাসিমা উঁকি দিয়ে দেখেন, কালোমতো কেউ-একটা উবু হয়ে বসে মাছভাজা খাচ্ছে। চোর-ছ্যাঁচড় হবে ভেবে বড়ো মাসিমা ‘চোর-চোর’ চিৎকার করে উঠলেন। সেই চিৎকার শুনে ভূতটা এত ঘাবড়ে গেল যে, বলার নয়! সোজা বড়ো মাসিমার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘আমি চোর নই কর্তামা, ভূত। বিশ্বাস করুন, ভূত! ভ্যানিশ হওয়ার মন্ত্রটা একদম ভুলে গিয়েছি।’
‘প্রথমে বড়ো মাসিমা বিশ্বাস করেননি। তিনি চুলের মুঠি ধরে লোকটাকে টেনে তুলতে গেলেন। আর অমনি কী আশ্চর্য ব্যাপার, মুণ্ডুটা ধড় থেকে খুলে এল বড়ো মাসিমার হাতে। সে এক সাংঘাতিক দৃশ্য। মুণ্ডহীন ধড়টা জোড় হাত করছে, আর ধড়হীন মুণ্ডুটা ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। এবার একটু ভয় পেয়ে গেলেন বড়ো মাসিমা। মুণ্ডুটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন হাত থেকে। অমনি তাড়াহুড়ো করে সেই ধড় মুণ্ডুটা হাতে নিয়েই পাঁইপাঁই ছুট লাগাল।’
সব শুনে বিনোদবিহারী গোবিন্দলালের হাত দু’টি চেপে চেপে ধরে বললেন, ‘ভাই, প্লিজ!একটু নিয়ে চলুন আপনার মামার বাড়ি। বড়ো উপকার হয়।’
‘সে তো যাওয়া যেতেই পারে,’ বিনোদবিহারী ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন, ‘তবে চলুন, আজই যাই, দেরি করা ঠিক হবে না।’
একটু চিন্তা করে গোবিন্দলাল বললেন, ‘কিন্তু আজ তো ইডেনে ফাইভ-ফাইভ ক্রিকেটের ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল। ইন্ডিয়ার সঙ্গে হন্ডুরাসের খেলা। একটু মাঠে যাব ভেবেছিলাম!’
বিনোদবিহারী চুপ করে গেলেন। এই এফ-ফাইভ ক্রিকেটটাকে তিনি একদম দেখতে পারেন না। এটা খেলা নয়, সার্কাস, শুধু ধুমধাড়াক্কা চালানো। তিনি টি-টোয়েন্টির মতো ধ্রুপদী ক্রিকেটের ভক্ত। কিন্তু এখন টি-টোয়েন্টির বাজার নেই। টি-টোয়েন্টি দেখতে বসলে লোকের নাকি হাই ওঠে।
বিনোদবিহারী বললেন, ‘আপনার ম্যাচ শেষ ক’টায়?’
‘ন’টায়।’
‘তা হলে চলুন, তারপর যাই। বনগাঁ আর কতক্ষণ লাগবে? ধর্মতলা থেকে মেট্রো করে সোজা বনগাঁ চলে যাব।’
রাতের খাওয়া দাওয়া বেশ ভারী হয়ে গেল বিনোদবিহারীর। গোবিন্দলালের দুশো তিন বছর বয়সি দিদিমা চমৎকার কিছু পদ রান্না করেছিলেন। নারকোল দেওয়া লাউঘন্ট, ছোলা দেওয়া কুমড়োর ছক্কা, বকফুল ভাজা দিয়ে অনেক ভাত খেয়ে ফেললেন বিনোদবিহারী। সিন্থেটিক ফুড খেয়ে-খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গিয়েছে। এমন সুস্বাদু খাবার বহুদিন খাওয়া হয় না। এদের ছাদের ওপর একটা কিচেন গার্ডেন আছে। পালা-পার্বণে কিংবা অতিথি-অভ্যাগত এলে দিদিমা রান্না করেন এসব।
খাওয়াদাওয়ার পর বেরিয়ে পড়লেন দু’জন। একটু এগিয়েই দেখা গেল সেই বাড়ি। আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে, বড়োসড়ো দোতলা বাড়িটা। পলেস্তরা-খসা দেওয়াল। কোথাও ছাদ ভাঙা, কোথাও দেওয়ালে ধস। বহুদিন শরিকি মোকদ্দমা চলেছে বলেই বাড়ির এমন জরাজীর্ণ দশা। সাবধানে ভিতরে ঢুকলেন দু’জন। ভিতরে বড়ো-বড়ো গাছের জঙ্গল। ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কিছু একটা ডেকে উঠল কোথাও। বিনোদবিহারী জি ডি ডি সিগনাল দিতে শুরু করলেন। একটা গাছে ঝুপঝাপ করে নড়ে উঠল কিছু। সঙ্গে-সঙ্গে ব্যাগ থেকে ম্যাজিক-টর্চটা বের করলেন বিনোদবিহারী। বিশেষ প্রযুক্তিতে তৈরি এই টর্চের আলো এমনই যে, ভূতের চোখে পড়লে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, কিছুক্ষণ নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকে না। সামনের সেই ঝাঁকড়া গাছটায় টর্চের আলো ফেললেন বিনোদবিহারী এবং ভারি অবাক হয়ে গেলেন। দু’টো বাচ্চা ভূত গাছের ডালে দোল খাচ্ছে। রোগা পিঙপিঙে চেহারা। গায়ে পাটকিলে রঙের বড়ো-বড়ো লোম। অনেকটা হনুমানের বাচ্চার মতো দেখতে। শুধু মুখ আর হাত-পায়ের চেটোগুলো সাদা। ম্যাজিক-টর্চের আলো চোখে পড়তেই টুপটুপ করে গাছ থেকে মাটিতে পড়ে গেল ভূত দু’টো। বিনোদবিহারী দৌড়ে গেলেন ; ব্যাগ থেকে লম্বা একটা কন্টেনার বের করে অ্যান্টি-ভ্যানিশিং-স্প্রে ফসফস করে ছিটিয়ে দিলেন ভূত দু’টোর গায়ে। সাতাশ রকম জড়িবুটির সঙ্গে ওঝাদের হাঁচি আর কাপালিকের হাই মিশিয়ে তৈরি এই মিশ্রণ সম্প্রতি উবুন্ডুর এক বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন। এর এমনই আশ্চর্য গুণ যে, ভূতের গায়ে স্প্রে করে দিলে তার চবিবশ ঘন্টা হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা লোপ পায়।
গোবিন্দলালও চলে এসেছেন কাছে। ব্যাগ থেকে একটা থলে বের করে ভূত দু’টোকে বিনোদবিহারী ভরে ফেললেন তার মধ্যে। গোবিন্দলাল বললেন, ‘সাবধান, বাচ্চা ভূত কিন্তু খুব কামড়ায়!’
বিনোদবিহারী বললেন, ‘চবিবশ ঘন্টা ওরা কিছু করতে পারবে না!’
গোবিন্দলাল বললেন, ‘কী, বলেছিলেন না আপনাকে, আছে এখানে…।’
গোবিন্দলালের হাত দু’টো ঝাঁকিয়ে বিনোদবিহারী বললেন, ‘মেনি মেনি থ্যাঙ্কস! আপনার ঋণ কোনো দিনও ভুলব না।’
ঠিক তখনই কুঁই-কিক, কুঁই-কিক করে করুণ একটা কান্নার মতো শব্দ শোনা গেল। জি ডি ডি সিগনাল দিতে শুরু করেছে আবার। বিনোদবিহারী তাড়াতাড়ি ম্যাজিক-টর্চের আলো ফেললেন শব্দ অনুসরণ করে। শব্দটা থেমে গেল, কিন্তু কিছু চোখেও পড়ল না। একটু পরে আবার অন্যদিক থেকে এল সেই কান্নার মতো শব্দ। এবারেও ম্যাজিক-টর্চ জ্বেলে কিছু দেখতে পেলেন না বিনোদবিহারী।
গোবিন্দলাল বললেন, ‘এটা মনে হচ্ছে মা-ভূতটা। আপনি ঠিক করে ম্যাজিক-টর্চ ফেলে ধরে ফেলুন ওটাকে।’
চুকচুক করে মুখ দিয়ে আফশোস সূচক শব্দ করে বিনোদবিহারী বললেন, ‘আসলে টর্চের চার্জটা কমে গিয়েছে। চার্জারটাও ভুলে ফেলে এসেছি কলকাতায়। মা-ভূতটা চালাক খুব, আলো ফেললেই চলে যাচ্ছে রেঞ্জের বাইরে।’
গোবিন্দলাল বললেন, ‘তা হলে?’
‘তা হলে আর কী?’ বিনোদবিহারী বললেন, ‘আমার দু’টো ভূত দরকার ছিল, পেয়ে গিয়েছি। কাজ মিটে গিয়েছে আমার। চলুন।’
ঘুম ভেঙে গেল বিনোদবিহারীর। সবেমাত্র ঘুমটা এসেছিল, তখনই সেই ‘কুঁইকিক’ কান্নার শব্দ। কে যেন বাড়ির চারদিকে ঘুরে-ঘুরে কাঁদছে। কাল শুতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাড়ি ফেরার পর জনেজনে থলের মুখ খুলে ভূত দেখাতে হল। বাড়ির বাচ্চারা তো আবার থলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আদরও করে দিল ভূতগুলোকে। গোবিন্দলাল শুয়েছেন দিদিমার কাছে। অনেকদিন পর মামার বাড়ি এসেছেন, তাই দিদিমার কাছে শুয়ে ভূতের গল্প শোনার লোভ সামলাতে পারেন না। একা একটা ঘরে শুয়েছেন বিনোদবিহারী। মুখবন্ধ থলেটা রেখে দিয়েছেন খাটের নীচে। উঠে পড়লেন বিনোদবিহারী। ম্যাজিক টর্চটা নিয়ে বাইরে এলেন। টর্চের আলো ফেললেন চারদিকে। আরও কমে গিয়েছে আলোর তেজ। সেই নিস্তেজ আলোয় কিছু দেখতে পেলেন না তিনি।
ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়লেন বিনোদবিহারী। ঘুমটা সবে আসব-আসব করছে, আবার সেই করুণ কান্না!
‘ধুত্তোর,’ বলে উঠে পড়লেন তিনি।
সকালবেলা বিনোদবিহারীকে ঘুম থেকে তুললেন গোবিন্দলাল। বললেন, ‘কী করি বলুন তো?’ দিদিমা খুব করে বলছেন আজ থেকে যেতে। রাতে মালপোয়া আর পুলিপিঠে করবেন।’
বিনোদবিহারী একটা আড়মোড়া ভেঙে বললেন, ‘মালপোয়া! আহা কী খেতে! কতদিন খাইনি! পুলিফিটেও অবশ্য খারাপ লাগে না!’
মেঝের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন গোবিন্দলাল, ‘এ কী! ভূত কোথায়? বস্তার মুখ যে খোলা!’
বিনোদবিহারী বললেন, ‘ছেড়ে দিয়েছি।’
‘ছেড়ে দিয়েছেন!’ অবাক হয়ে গোবিন্দলাল বললেন, ‘কেন, ছেড়ে দিলেন কেন? এত কষ্টের জিনিস…!’
একটা হাই তুলে বিনোদবিহারী বললেন, ‘ধুর! ঘুমের দফারফা করে দিচ্ছিল। আমার মশাই ঘুম না হলে মাথার ঠিক থাকে না। ঘুম জিনিসটা মালপোয়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসি!’
খুব অবাক চোখে বিনোদবিহারীর দিকে তাকিয়ে রইলেন গোবিন্দলাল। বিনোদবিহারী বললেন, ‘কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদলে কি ঘুম হয়? কিন্তু মায়ের জাত যে! ঘ্যানঘ্যান করবেই। করতেই থাকবে। ঘুম, মালপোয়া যেমন ভালোবাসি, কান্না জিনিসটা তেমনই খারাপ বাসি আমি। খু-উ-ব খারাপ বাসি। তাই ছেলে দিলাম ব্যাটাদের!