3 of 8

ভূত ও রিপোর্টার

ভূত ও রিপোর্টার

এই রম্যনিবন্ধের নাম পাঠ করে অনুগ্রহ করে কেউ আমাকে ভূতবিদ্বেষী ভাববেন না।

ভূতবিদ্বেষী হতে গেলে যে পরিমাণ সাহস, যে রকম মোটা বুকের পাটা লাগে তা আমার নেই, কস্মিনকালেও ছিল না।

তবু প্রশ্ন থেকে যায়। ভূতের সঙ্গে যদি আমার শত্রুতা নাই থাকবে, আমি যদি ভূতবিদ্বেষী নাই হই তা হলে ভূতের মতো একটি প্রাচীন জীবকে আমি কেন এমন বিপদে ফেলব, আমি কেন ভূতকে রিপোর্টারের মুখে ঠেলে দেব।

সত্যি কথাটা হল আমি ভূতকে রিপোর্টারসাহেবের মুখে ঠেলে দিইনি। রিপোর্টারসাহেবই তাকে আবিষ্কার করেছিলেন।

সম্পাদক মহোদয় রিপোর্টারসাহেবকে পাঠিয়েছিলেন খরা কবলিত অঞ্চলে, সেই দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলে একটা বাস্তবানুগ প্রতিবেদনের জন্যে।

কিন্তু রিপোর্টারসাহেব যথাস্থানে যথাসময়ে পৌঁছাতে পারেননি। তার আগেই প্রবল বৃষ্টি নামে এবং একটি স্থানীয় নদীতে ঢল ওঠে, পুরো এলাকা জলে ডুবে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। খরর প্রতিবেদন করতে এসে বন্যার প্রতিবেদন করা সম্পাদক মহোদয়ের মনঃপূত হবে কিনা এই চিন্তা করে সদর অফিসে রিপোর্টার ফোন করতে গেলেন। কিন্তু এই বন্যায় ফোন অচল, টেলিগ্রামও তাই।

অকুস্থলের রেলস্টেশনে প্ল্যাটফর্মের পাশে একটা পোড়ো ঘরে জলবন্দি হয়ে রইলেন রিপোর্টারসাহেব।

যথাসময়ে এ জায়গায় পৌঁছাতে পারলে রিপোর্টারসাহেবের এত নিগ্রহ হত না।

কিন্তু এখানে আসতে পথে চারদিন দেরি হয়ে গেছে। সেটা অবশ রিপোর্টারসাহেবের দোষ নয়।

পথে এক জায়গায় আফ্রিকার সোমালিয়ায় গণধর্ষণের প্রতিবাদে রেল অবরোধ হয়েছিল। দেড়দিন রেলপথ আটকিয়ে রাখে অবরোধকারীরা। অবশেষে জংশন স্টেশন থেকে রেলের বড়সাহেব এসে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন ভবিষ্যতে যাতে এ রকম আর না হয় সেটা তিনি দেখবেন। তখন রেললাইন অবরোধ ওঠে। কিন্তু ইতিমধ্যে অবস্থা বেগতিক দেখে রেলের ড্রাইভার, ফায়ারম্যান এবং গার্ড—সবাই পলায়ন করেছেন, তাঁদের খুঁজে পেতে আনতে আরও দেড়দিন। অবশেষে রেলগাড়ি চালু করতে আরও একদিন। সবসুদ্ধ চারদিন দেরি হয়ে গেছে।

এরই মধ্যে দ্বিতীয় দিন থেকে অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেটাও অবশ্য অবরোধ উঠে যাওয়ার একটা কারণ, চতুর্থ দিনের শেষে জলে ভাসতে ভাসতে রেলগাড়ি এসে যখন খরা অঞ্চলে, জেলাসদরে পৌঁছেছে তখন সরকার সেটাকে বন্যাগ্রস্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছেন,

*

এত কথা অবশ্য ভূতের গল্পে আসা উচিত নয়। কিন্তু গল্পটা ছোট ও পুরনো। তাই পটভূমিকা রচনা করবার জন্যে ভণিত একটু দীর্ঘ করতে হল।

*

ফোন বিকল। টেলিগ্রামের খুঁটি জলে উপড়িয়ে পড়ে আছে। ট্রেন আসছে না। রিলিফের নৌকা এখনও এসে পৌঁছয়নি।

প্ল্যাটফর্মের একপ্রান্তে পোড়ো ঘরে রিপোর্টারসাহেব আশ্রয় নিয়েছেন। সাধারণত রেল প্ল্যাটফর্ম জলে ডোবে না। কিন্তু স্টেশন মাস্টারসাহেব বলেছেন দু’ বছর আগেও নাকি ডুবেছিল, বিশেষ করে খরার পরে বন্যা হলে সে নাকি খুব মারাত্মক।

প্ল্যাটফর্মের পোড়ো ঘরের ভেতরটা একটা লোক লাগিয়ে সাফসুফ করিয়ে নিয়েছিলেন রিপোর্টারসাহেব। কিন্তু প্রথম রাতেই ফ্যাসাদে পড়লেন।

চারদিনের ক্লান্তির পরে মেঝের ওপরে চাদর বিছিয়ে মাথায় পোর্টফোলিও ব্যাগটা দিয়ে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘণ্টা কয়েক পরে কী একটা খসখস শব্দে ঘুম ভাঙল তাঁর। ঘুম চোখেই টের পেলেন ঘরের মধ্যে কী যেন একটা ঘুরছে।

চোখে অন্ধকারটা সয়ে যাওয়ার পর রিপোর্টারসাহেব দেখতে পেলেন ভাঙা ঘরের বেড়া ঘেঁষে ঘেঁষে জীর্ণ শীর্ণ কী একটা ছায়ার মতো ঘুরছে।

একবার গলা খাকারি দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’

ছায়ামূর্তি পালটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’ বেশ ন্যাকান্যাকা খোনা খোনা গলা। রিপোর্টারসাহেব সে গলা শুনে বুঝতে পারলেন তাঁর ঘরে ভূত ঢুকেছে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি ভূত?’

ভূত বলল, ‘হ্যাঁ। আমি এই ঘরে থাকছি। তুমি আমার ঘরে ঢুকেছ কেন?’

রিপোর্টারসাহেব খেয়াল হল কেউ কেউ তাকে এ ঘরে থাকতে মানা করেছিল, বোধহয় এই কারণেই কিন্তু এ নিয়ে এখন চিন্তা করে লাভ নেই। বরং ভূতের একটা ইন্টারভিউ যদি এই সুযোগে নেওয়া যায়। ভুতের মতো মানুষদের ইন্টারভিউ তো সারা জীবন ধরে নিচ্ছেন কিন্তু সাক্ষাৎ জ্যান্ত ভূতের সাক্ষাৎকার, সংবাদপত্র জগতে হইহই পড়ে যাবে, সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটা ল্যান্ডমার্ক তৈরি হবে।

রিপোর্টার ভূতকে আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন, ‘শোনো আমি একজন রিপোর্টার। তোমার ইন্টারভিউ নিতে চাই।’

রিপোর্টার এবং ইন্টারভিউ—এই শব্দ দুটো শুনে ভুত থর থর করে কাঁপতে লাগল, হাত জোড় করে বলল, ‘আমি এই ঘর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি আপনার মতো থাকুন। আমাকে নিয়ে কিছু লিখতে যাবেন না।’

রিপোর্টার বললেন, ‘এ তো ভয়ের কিছু নেই। তোমার নামও জানি না। তোমার ছবিও তোলা যাবে না। কেউ বুঝতেই পারবে না যে আমি তোমারই সঙ্গে কথা বলেছি। কাগজে লিখে দেব ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ভূত।’

এরপরেও ভূত ইতস্তত করছে দেখে রিপোর্টার বললেন, ‘অবশ্য রিপোর্টের মধ্যে বার কয়েক ‘বিশ্বস্ত সূত্রে’ ব্যবহার করেও নামধাম গোপন করতে পারি।’

ভূত কী বুঝল কে জানে। সে বলল, ‘আপনাদের পাল্লায় পড়লে কারও পরিত্রাণ নেই, তা আমি জানি। যাক, যা কপালে আছে হবে। কী জানতে চান বলুন।’

রিপোর্টার ততক্ষণে পোর্টফোলিও ব্যাগ খুলে ডট কলম, নোটবই সব বার করেছেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রথমে বলো, তুমি কী করে ভূত হলে?’

এর উত্তরে ভূত একটা আশ্চর্য কথা বলল। সে জানাল, ‘আমি বোধহয় ভুল করে ভূত হয়েছি।’

সিগারেটের ছাই ঝেড়ে রিপোর্টারসাহেব বললেন, ‘ভুল করে ভূত? সে আবার কী?’

ভূত বলল, ‘সে বড় দুঃখের কথা। বউয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করার জন্যে চারদিন আগে এই স্টেশন থেকে এক কিলোমিটার দূরে নির্জন মাঠের পাশে রেললাইনে গলা দিয়ে শুয়েছিলাম।’

রিপোর্টার বললেন, ‘কিন্তু চারদিন আগে তো রেললাইন অররোধ ছিল।’

ভূত বলল, ‘তা আমি জানব কী করে? একদিন, দু’দিন, তিনদিন চলে গেল রেল এল না। কিন্তু এল সাংঘাতিক বৃষ্টি। জলের তোড়ে আর খিদের চোটে আমি মারা পড়লাম। কিন্তু এ ভাবে মারা পড়লে তো আর ভূত হয় না। আনন্যাচারাল ডেথ বা অপমত্যু না হলে তো ভূত হওয়া যায় না। আমার মতো সাধারণ মৃত্যু, অনাহারে, না খেয়ে মৃত্যু তো এ দেশে সবসময়ে হচ্ছে। সেসব ক্ষেত্রে কি ভূত হয়?’

এই ভৌতিক প্রশ্ন শুনে রিপোর্টারের মনে একটা অন্যরকম সন্দেহ দেখা দিল। কারণ ভাঙা ঘরের ফাটা বেড়ার মধ্যে দিয়ে চাঁদের আলো তখন ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে এবং রিপোর্টার দেখতে পেয়েছেন যে, ভূতের ছায়া পড়েছে জ্যোৎস্নার, যেটা অসম্ভব। রিপোর্টার ভূতকে বললেন, ‘তুমি কি সত্যি ভূত? তোমার হাত দিয়ে আমাকে একটু ছোঁও দেখি।’

ভূত বলল, ‘এত দূর থেকে হাত দিয়ে আমি আপনাকে ছোঁব কী করে?’

রিপোর্টার বললেন, ‘তা হলে তো তুমি ভূত নও। ভূতেরা যে যতদূর ইচ্ছে হাত লম্বা করতে পারে।’

ভূত এবার খুব চিন্তা করল, তারপর বলল, ‘তা হতে পারে। আমি বোধহয় এখনও ভূত হইনি। বোধহয় এখনও মারাও যাইনি। বৃষ্টির সময় রেললাইন থেকে উঠে এখানে চলে আসি। চারদিন পেটে অন্ন নেই। ভাবলাম মরে ভূত হয়ে গেছি।’

রিপোর্টারসাহেব তাঁর পোর্টফোলিও ব্যাগ খুলে দুর্দিনের সঞ্চয় পাঁচশো গ্রাম চিঁড়ে আর একটু গুড়ের একটা ঠোঙা বার করে ভূততে খেতে দিলেন।

খাওয়া-দাওয়ার পরে বহু কথা হল দু’জনের মধ্যে।

দু’দিন পরে কলকাতায় ফিরে রিপোর্টারসাহেব তাঁর প্রতিবেদন পেশ করলেন।

‘বন্যাকবলিত অঞ্চলের ভুখা মানুষের আত্মকাহিনী।’

ও রকম মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন বহুকাল কোনও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *