2 of 2

ভূত ও মানুষ – অমর মিত্র

ভূত ও মানুষ – অমর মিত্র

বিপদভঞ্জন সরখেলের জানালায় ভোরবেলায় প্রায়ই কেউ না কেউ আসছে। তখন তাঁর চোখে ঘুম। বিপদ ভোরের মুখ দ্যাখেন না কখনো। দেরি হয় ঘুমোতে। অনেক রাত অবধি বই পড়েন। সবই পরলোক সংক্রান্ত। পড়তে বেশ লাগে। গরমে জানালা খুলেই ঘুমোন একা বিপদবাবু। তাঁর ছেলে থাকে সানদিয়েগো। সেই ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট, আমেরিকা। স্ত্রী সেখেনে গেছেন। বিপদকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল তাঁর ছেলে নির্ভয়কুমার। বিপদ যাননি। গেলে তাঁর এই সাধের বাড়ি পাঁচ ভূতে এসে শেষ করে দিয়ে যাবে। হ্যাঁ, এই মথুরগঞ্জে খুব ভূতের উপদ্রব। নানা রকম ভূত। ক্যাংলা, প্যাংলা, হ্যাংলা যেমন আছে, ঠান্ডা ভূত, নরম ভূত, গোভূত, কিম্ভূত… সব। ভূতের সঙ্গে পেতনিও আছে। বিপদভঞ্জনের জানালা দিয়ে ভোরবেলায় যে কেউ উঁকি দেয়, তা তিনি ঘুমের ভিতরেই টের পান। কিন্তু ঘুম তো ভাঙে না, করবেন কি?

মথুরগঞ্জে ভূত গিজগিজ করছে। নেহাত ভূতের ছায়া পড়ে না, তাই তেমন দেখা যায় না ঠিক দুপুরে কিংবা চাঁদের আলোর ভিতরে। তারা ঘুরঘুট্টি ঠিক দুপুর বেলা আর সন্ধের পর রাত্তিরে দাপিয়ে বেড়ায়। ফলে কী হয়েছে গঞ্জ ছেড়ে শহরে গিয়ে বাস করছে অনেকে। রাজ্যের ভূত প্রেত মথুরগঞ্জে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। কাঁহাতক ভূতের উপদ্রব সহ্য করা যায়। কেমন উপদ্রব, না এই রকম। দক্ষিণ পাড়ার সান্যালমশায়ের বাড়ির পিছনের মাঠে রাতদুপুরে খলখল হাসি, এমন হাসি যে অন্তরাত্মা কেঁপে যায়। জানালা দরজা বন্ধ করেও রেহাই নেই, ঘুলঘুলি দিয়ে খলখলানি, ঝনঝনানি, ক্যানক্যানানি এসে ঢুকবেই ঢুকবেই। মনে হয় দরজা জানালার বাইরে ভূতের কেত্তন লেগে আছে। সান্যালের খুব ভূতের ভয়, তিনি শান্ত আর নিরুপদ্রব মানুষ। চিৎকার চেঁচামেচি সহ্য করতে পারেন না। তাতে তাঁর কাব্যচর্চায় বিঘ্ন ঘটে। তিনি অবসরের পর কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেছেন। আশা করেন দ্রুত তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। কবি শিরোমণি উপাধি পেয়ে যাবেন। এহেন বিভূতি সান্যাল আর পারছেন না, তালা বন্ধ করে শহরে ফিরে যাবেন তাঁর ফ্ল্যাটে। কিন্তু তার মানে, তাঁর কবি শিরোমণি হওয়া আর ইহজীবনে হল না। শুধু সান্যাল কেন, ভরত কুণ্ডুও চলে যাবেন। কেন যাবেন, না তাঁর ছাদের উপর ভূতের ছেলেপুলেরা অন্ধকার হলেই দাপাদাপি শুরু করে। চু চু কিত কিত কিত, ভোঁম মারা, কবাডি কবাডি কবাডি….। মথুরগঞ্জে এত মাঠ, এত পোড়োবাড়ি পড়ে আছে, সেখেনে যাবে না শয়তানগুলো, আসতে হবে গেরস্তের বাড়ি। মণ্ডল মশায়ের গিন্নির খুব শখ গাইয়ে হবেন। সকাল সন্ধে রেওয়াজ করেন। বয়স তাঁর পঞ্চাশের উপর। বহুদিন এসব করতে পারেননি। ছোটোবেলায় যা করেছিলেন সব ভুলে গেছেন। এতদিন মেয়েকে গান শেখাতেন, তাকে দিয়ে রেওয়াজ করাতেন সা রে গা মা পা… পা ধা নি সা…। তখন কোনো সমস্যা হয়নি, এখন হচ্ছে। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর নিজে একটু হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছেন, গানের মাস্টার সকাল বিকেল দুবেলা আসছে, বলে গেছে শোয়ার আগে একবার রেওয়াজে বসতে, তাতে যেমন গানের গলা খুলবে তেমনি বদহজম, বুক জ্বালা, খিটখিটানি ভাব সব চলে যাবে। কিন্তু উপায় আছে? রেওয়াজ আরম্ভ হলেই পালটা রেওয়াজও শুরু হয়ে যায় মা রে বাবা রে ধরো রে খাও রে…। নাহ, মথুরগঞ্জে আর থাকা যাবে না।

ক—জন চলেও গেছে মথুরগঞ্জের বাড়িতে তালা মেরে। এমন বদনাম হয়ে গেছে এই গাঁয়ের যে নতুন লোক আসছে না আর। চোর ডাকাতও নেই বলতে গেলে হয়। আর আছে যে দু—একজন তারা বাইরে গিয়ে কাজ করবে যে সে উপায়ও নেই। ভোর রাতে ফেরার সময় ভূতের হাতে নাকাল হয়েছে বেগুনি, ফুলুরি, দুই চোর। বেগুনি, ফুলুরি এই গাঁয়ের গর্ব ছিল। এ পর্যন্ত তারা ধরা পড়েনি, তা কলার কাঁদি চুরি করুক বা থালাবাসন, গোরু ছাগল, হাঁস মুরগি চুরি করুক। বেগুনি হল খুব রোগা চ্যাপটা আর ফুলুরি হল খপখপে মোটা। মোটা কিংবা রোগা যাই হোক না কেন, তাদের মতো এক্সপার্ট চোর ভূভারতে নেই। শোনা যাচ্ছে তারাও মনের দুঃখে চলে যাবে মথুরা ছেড়ে। মথুরগঞ্জকে এই গঞ্জের মানুষ মথুরা বলে। চুরি তারা এই গাঁয়ে করে না। কিন্তু চুরি করে তো ফেরে নিজের বাড়ি। সেই ফেরার পথেই যত ঝামেলা। হয় পেতনির পা না হয় ভূতের ভ—য়ে। ভ মানে ভয়। হ্যাঁ পেতনির পায়েও সেই ভয়। গাছে বসে পা দুলোয় সিড়িঙ্গে পেতনি। ইচ্ছেমতো তারা লম্বা হয়, খাটো হয়। পায়ে আলতা। লম্বা লম্বা নখেও রং। নাকি সুরে গান ধরে তারা চাঁন্দের হাঁসি বাঁধ ভেঁঙেছে…. এক লাঠিতে তোর পা ভেঙেছে। পা দেখেই ভিরমি খায় ফুলুরি বেগুনি। তারাও ঠিক করেছে চলে যাবে মথুরগঞ্জ ছেড়ে। ভয় নিয়ে গাঁয়ে থাকা যায়।

বিপদভঞ্জনের বাড়ি সবাই দল বেঁধে এল একদিন। সান্যাল মশায়, কুণ্ডু মশায়, গিন্নি সমেত মণ্ডল মশায়, আপনি থাকুন বিপদবাবু, আমরা আর থাকব না।

বিপদ বললেন, আমি আমেরিকা পর্যন্ত গেলাম না মথুরগঞ্জে থাকব বলে, আপনারা চলে যাবেন?

হুঁ যাব, উপদ্রব উপদ্রব, তেনাদের জন্য বাস করাই দায়, আগে তো মথুরগঞ্জ এমন ছিল না। কুণ্ডু বলল। সান্যাল বলল, কাব্যচর্চা মাথায় উঠেছে মশায়, আমার স্বপ্ন আর পূরণ হবে না।

মণ্ডল গিন্নি বললেন, রেওয়াজ করব যে উপায় নেই, আমার হারমোনিয়াম বাজলেই তেনাদের গোঙানি আরম্ভ হয়ে যায়।

একটু স্বস্তিতে যে ঘুমোব, উপায় নেই, ছাতে খেলাধুলো হচ্ছে সন্ধে হলেই, সন্ধের পর থেকেই ধুপধাপ। কুণ্ডু বলল, আমি মশায় ভয়েই মরি, রাম নামেও যায় না তারা।

আর আর কে আছে কিছু বলার জন্য? আছে তো। কাউকে কাউকে খোনা গলায় হুমকি মেরে গেছে তেনাদের কেউ, খঁবদ্দার কাঁউরে বঁলা চঁলবেনি, বঁললে ঘাঁড় মঁটকে দেঁব।

এই হুমকি কুণ্ডু শুনেছে। তাকে গাঁ ছেড়ে চলে যেতে বলেনি বটে তেনাদের কেউ, কিন্তু এমন ভূতের গাঁয়ে কে থাকে? জলধি সরকার যে তার বাড়ি তালা মেরে শহরে গেল আচমকা, কেন গিয়েছিল ধরা যায়। দুপুর হলেই ঢিল পড়ত। বাড়ি ছেড়ে গিয়ে তবে শান্তি।

তখন জানালায় এসে দাঁড়াল দুজন। এরাই কি ভোরবেলা উঁকি দিয়ে যায়? তাইই তো। বেগুনি আর ফুলুরি, দুই স্যাঙাৎ। তাদের দিকে তাকিয়ে কুণ্ডু সান্যাল আর মণ্ডলবাবুদের ভ্রু কুঁচকে গেল। এই দুটো লোক নাকি পাকা চোর, কিন্তু মথুরাগঞ্জে এদের কোনো বদনাম নেই। যে জলধি সরকার শহরে গেছে, সে যতদিন গাঁয়ে ছিল চুরি হয়নি কিছু, কিন্তু শহরে ঢুকতেই এরাই নাকি তার ঘরে ঢুকে নীল লাল দুটো জামা চুরি করে নিয়ে গেছে। জলধি ফোন করে মণ্ডলমশায়কে জানিয়েছে। সত্যি তাই। এইতো সেই জামা পরেই দুজন জানালার সমুখে এসে দাঁড়িয়েছে। জলধির খুব প্রিয় জামা ছিল এই দুটো। মণ্ডলমশায় বিরক্ত হয়েছেন দুই চোরকে দেখে, জিজ্ঞেস করলেন, এই তোরা কেন রে?

আমাদেরও খুব বিপদ, ভোরে ডিউটি করে ফেরার সময় পেতনির লাথি খেতে হয়, এই দ্যাখো বিপদকাকু, পেতনির পায়ের নখের ঘায়ে আমার মুখে কতটা দাগ। ফুলুরি দেখাল।

এই দ্যাখো শেষ রাতে যখন ফিরছি, আমার গালে কত জোরে চড় মেরেছিল, দাগ বসে গেছে। বেগুনি বলল।

ফুলুরি বলল, ডিউটি করতে ভয় হয় খুব।

বিপদভঞ্জন জিজ্ঞেস করেন, তোরাও কি চলে যাবি নাকি?

বেগুনি বলল, হুঁ, তা ছাড়া উপায় কি?

বিপদভঞ্জন জানেন, ফুলুরি বেগুনি দুই চোর এই গাঁয়ে কিছু করে না। আবার ভূত প্রেতের ভয়ে গাঁয়ে বাইরের চোরও ঢোকে না তেমন। এরা চলে গেলে তেমন ক্ষতি নেই, কিন্তু লাভও নেই। গাঁয়ে এমন দুই চোর আছে যারা ধরা পড়েনি কোনোদিন, গর্বের কথা তো নিশ্চয়। জলধি সরকারের লাল জামা নীল জামা কী রকম মানিয়েছে ওদের। যারা গাঁ থেকে চলে যাবে তাদের ঘরে ওরা এবার করবে চুরি, যদি মথুরগঞ্জ না ছেড়ে যায় দুই চোর। মণ্ডল, কুণ্ডু, সান্যালরা চলে যাবেই যাবে। ভূতের সঙ্গে কি মানুষ থাকতে পারে? খুব পারে। কেন পারবে না? তিনি তো বেশ আছেন। ভয়ডর নেই। এই যে সেদিন কেষ্টগঞ্জের হাট থেকে ইলিশ কিনে ফিরছিলেন। সন্ধে বেলা। এক মেছোভূত লাগল পিছনে, এই ভঞ্জন ইঁলিশ দেঁ, ইঁলিশ দেঁ….।

রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বিপদভঞ্জন, কেন দেব রে, পয়সা দিয়ে কেনা।

তখন আরও পাঁচটা ভূত হাজির, দেঁ দেঁ দেঁ, দিঁইয়ে যা।

তবে রে, মেরে তোদের হাড়গোড় ভেঙে দেব, হাড়া ছাড়া তো আর কিছু নেই বাড়িতে, ছোঁ, এই সরে যা, নইলে ঠাকমার রেখে যাওয়া সর্ষে মারব।

তখনই রাস্তা ক্লিয়ার। সর্ষের কথা তাকে বলে গিয়েছিল তাঁর ঠাকুমা। ঠাকুমার নাকি পোষা ভূত ছিল। সে তাঁর সব কথা শুনত। তখন মথুরগঞ্জে নাকি ভূতই ছিল না। ঠাকুমা তাকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বাপের বাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে আসার সময়। সে একা করবে কী, ঠাকুমার ফাইফরমাস খেটেই মরত। ঠাকুমা মরে গেলে সে চলে গিয়েছিল নাকি কাঁদতে কাঁদতে। মথুরগঞ্জের হেলা বটের একটা ডাল ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল শোনা যায়। তারপর সেই ডাল আর গজায়নি। সবাই জানে মথুরগঞ্জের হেলা বটের একটা ডাল নেই।

তাহলে দাঁড়াল কী? বিপদভঞ্জনের ঠাকুমা চোখ বুঁজতে মথুরগঞ্জে ভূতই ছিল না। তারপর এত তেনারা তেনিরা এলেন কোথা থেকে?

তেনা তেনিরা, ভূত পেতনিরা এল এখানে এই বছর পাঁচ। সে কাহিনি বিপদভঞ্জন নিজে একা জানেন। আর কেউউ না। কাউকে বলেনওনি। সে এক মাঝ রাত্তিরের গল্প। তিনি একটা গোয়েন্দা উপন্যাস পড়তে পড়তে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলেন। খুনি কে?

সত্যিই তো খুনি কে? সকলকে সন্দেহ হচ্ছে, কিন্তু তার ভিতরে একজনই তো খুনি। বইটির নামই ছিল ওই, খুনি কে? বইটি তিনশো পাতার। দুশো পঁচিশ পড়ার পর তিনি বন্ধ করে নিজে নিজে খুঁজে যাচ্ছিলেন খুনি কে? কে সেই হত্যাকারী যে কিনা বিষ দিয়ে মেরেছে নিরীহ যুবকটিকে? একজনকে মারতে গিয়ে আর একজনকে মারল নাকি? কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না প্রকৃত হত্যাকারীকে। সাতদিন হয়ে গেছে। নাহ, তিনি ফেল মেরে গেলেন। খুব মন খারাপ করে জানালার কাছে শুয়ে ছিলেন। ঘড়িতে রাত আড়াইটে। তখন একজন এসে দাঁড়িয়েছে জানালার বাইরে, ভঞ্জনস্যার, ও বিপদস্যার।

তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন জানালার ওপারে একটি মুখ। রোগা একটা বছর পঁচিশের যুবক দাঁড়িয়ে। চেনা চেনা মনে হয় যেন। কোথায় দেখেছেন, কোথায় দেখেছেন! কে তুমি?

সে বলেছিল, আঁজ্ঞে আমি স্বপন মল্লিক।

কে স্বপন মল্লিক?

স্যার চিনতে পারছেন না?

বিপদভঞ্জনের খুব চেনা মনে হয়। নামটা তো একেবারেই চেনা। আর হাওয়াই শার্ট, চোখের নীচে কাটা দাগ, চশমা, একটুখানি ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি থুতনিতে… বিবরণ সব মিলে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় দেখা হয়েছিল? তা বুঝতে পারছেন না তিনি। তখন সে বলল, আপনার ঘুম নেই তো, আমি জানি তার নাম?

চমকে তিনি উঠে বসেছেন। কে? কার নাম জানে এই স্বপন মল্লিক? স্বপন…., আরে সেই যুবকের নাম তো স্বপনই। তিনি বইটির দিকে তাকালেন। বাকি আছে পঁচাত্তর পাতা। আসল তদন্ত শুরু হবে। কে খুনি তা বেরিয়ে আসবে।

তুমি কে বলতো?

যা ভেবেছেন ঠিক তাই স্যার, আমাকে বিষয় দিয়ে মেরে দিয়েছে যে তার নাম আমি বলে দিতে পারি। স্বপন মল্লিক বলল।

ওই বইয়ের কথা বলছ?

ইয়েস স্যার।

তুমি বইয়ের স্বপন?

ইয়েস স্যার, আমাকে যে খুন করেছে তার নাম আমি জানিয়ে দিতে পারি।

সে তো বইয়ে আছে। বিপদ বলেছিলেন।

ইয়েস স্যার, তাহলে বইয়ে দেখে নিন। বিরক্ত হয়ে স্বপন মল্লিক বলেছিল, আমি চলে যাচ্ছি।

কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না বিপদভঞ্জন। তখন স্বপন মল্লিক বলেছিল, আপনি মনে করেন আপনি খুঁজে বের করেন ভেবে ভেবে, আসলে তা নয়।

আসলে কী?

আসলে যাকে হত্যা করা হয়, সেই বলে দেয় বলে শেষ অবধি না পড়েও আপনি ধরতে পারেন খুনি কে।

হুম! গম্ভীর হয়ে বিপদভঞ্জন জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাকে বিষ দিয়েছিল কে?

স্বপন মল্লিক বলেছিল আসন খুনির নাম। বিনিময়ে মথুরগঞ্জে থাকার অনুমতি নিল। এই হল আসল ঘটনা। গোয়েন্দা রহস্য সিরিজের লেখক অজিত বর্মণ তাঁর উপন্যাসের আসল রহস্য ভেদ করতেন শেষের আগের পাতায় শিহরণ জাগিয়ে। তাঁর বইয়ের কাটতি ছিল খুব। আগের বই পড়লে, পরের বই পড়তে হবে। তারপর থেকে অজিত বর্মণ এবং আর সব গোয়েন্দা লেখকের বইয়ে খুন হওয়া, অপঘাতে মৃত লোকজনের ভূত আসতে আরম্ভ করে মথুরগঞ্জে। রটেই গেছে মথুরগঞ্জে ভালো থাকা যায়। বিপদভঞ্জন তাঁদের চেনেন। তাই ভয় নেই তাঁর। কত নতুন নতুন গোয়েন্দা লেখক, খুন জখমের লেখকের বই ছাপা হচ্ছে। খুন জখম মানে মৃতের আত্মার গতি হয় না। ভূত হয়ে মথুরগঞ্জে। অজিত বর্মণের একটা বইয়ে অপরাধী একটি ট্রেন উড়িয়ে দিয়ে নিজেও আত্মহত্যা করেছিল। প্রায় তিনশো লোক মারা গিয়েছিল। সব মথুরগঞ্জে আশ্রয় নেওয়ায় মথুরগঞ্জ গিজগিজ করছে বিদেহী আত্মা, ভূত পেতনি, তেনা তেনিতে। তেনারা মিটিং করে ঠিক করেছেন মথুরগঞ্জ হবে ভূতের গ্রাম। মানুষ থাকা চলবে না। ভয় দেখিয়ে মানুষকে গ্রাম ছাড়া করছে তেনারা। শুধু বিপদভঞ্জনকে নিয়েই তেনাদের কিছু করার নেই। বিপদভঞ্জন তেনাদের ভয় করেন না। ভয় করবেন কেন? তিনি যে অজিত বর্মণের সব বই পড়েছেন। সান্যাল কুণ্ডু মণ্ডলরা গঞ্জ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর একদিন অনেক রাত্তিরে তেনাদের ডেকে বললেন, ভয় দেখান বন্ধ কর, সবাই মথুরগঞ্জ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

তেনারা ভয় পান কেন, আপনি তো পান না। স্বপন মল্লিকের ভূত বলেছিল।

তোমরা একটু সংযত হও।

স্বপন মল্লিকের ভূত বলেছিল, মথুরগঞ্জ যদি ভূতের গঞ্জ হয়, ভালোই হবে, মানুষগুলো চলে যাক, ভূত হয়ে ফিরুক।

খুব অপমান লেগেছিল বিপদভঞ্জনের। মথুরগঞ্জ ভূতের গাঁ হবে। কী করে হবে রে? দেখছি কী করে হয়। তিনি সেই রাত্তিরে খবরের কাগজে একটা চিঠি লিখলেন ‘রহস্য লেখকের দায়িত্ব’ শিরোনামে। হত্যা মৃত্যু যাতে না লেখেন লেখকরা সেই অনুরোধ জানিয়ে। না হলে তাঁদের মথুরগঞ্জ বাঁচবে না। লেখকরা যত অপঘাত মৃত্যু ঘটাবেন, মথুরগঞ্জে ততো ভূত পেতনি, তেনা তেনির সংখ্যা বাড়বে।

মথুরগঞ্জে মানুষের সংখ্যা কম ছিল। ভূত পেতনি বাড়ছিল। দুই চোর, বেগুনি ফুলুরি পর্যন্ত চলে গেছে গঞ্জ ছেড়ে। পরপর তালা মারা বাড়ি। সন্ধে হতেই নাকিসুরে কথা আর খলখল হাসির শব্দ শোনা যায়। ধুপধাপ গাছ থেকে কারা লাফ দিতে থাকে। চুউউ কিত কিত কিত…. ডাক শোনা যায় অন্ধকারে। গাছের ডালে বসে পেতনি পা দুলোয়। বিপদভঞ্জন রহস্য উপন্যাস, ভূতের গল্প পড়েন সন্ধে থেকে। এমনি চলতে লাগল। পরপর তাঁর কয়েকটি চিঠি প্রকাশিত হল। তাতে পুরোনো ভূতের উপদ্রব চলতে লাগল। এমনি করে বছর দুই গেল। মথুরগঞ্জে মানুষ বলতে তিনি একা। ভূতের ওঝা ভোলা সর্দারও চলে গেল গাঁ ছেড়ে। মানুষ নেই, কার ভূত ছাড়াবে ভূতের ওঝা?

মথুরগঞ্জ নিঃঝুম। মানুষের চিহ্ন নেই। শুধু বিপদভঞ্জন। অজিত বর্মণ তাঁর কথা রেখেছেন। শেষ উপন্যাস, ‘কোহিনুর রহস্য’ তে কোনো খুন জখম, হত্যা মৃত্যু নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে যে ভূতেরা এসেছে, তাতেই তো মথুরগঞ্জ মনুষ্যহীন হয়ে গেছে। শুধু একা আছেন বিপদভঞ্জন। মথুরগঞ্জে এখন সমস্ত দিন সমস্ত রাত ভূতের কেত্তন। ঘ্যাঁ ঘোঁ চিৎকার, গাছের ডাল ভেঙে পড়া, ছাত থেকে ধুপ করে আছাড়…. কিছুই দেখা যায় না। এতে বিপদভঞ্জনের একটু ভয় যে করে না তা নয়, কিন্তু মনের জোরে সব কাটিয়ে ওঠেন। এমনই চলছিল। এমনি সময়ে এক ভোরে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। জানালায় সেই স্বপন মল্লিক। একটু বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে হাড়ের কঙ্কাল জামা। বিপদ জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে স্বপন, বেঁকে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

স্বপন বলল, কোমরের হাড় ভেঙেছে ভঞ্জন স্যার, হাড়ের বডি তো।

কী করে?

গাছ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে ভেং চি।

ভেং চি, মানে বার্মা মুলুকের সেই দস্যু? জিজ্ঞেস করলেন বিপদভঞ্জন।

ইয়েস স্যার, ভেং চি, চিন সমুদ্রে জাহাজ ডুবিতে মরে যায়, অজিত বর্মণের ‘বার্মার আতঙ্ক’ বইয়ে ছিল, সে এসে মানুষ না পেয়ে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, তুলে আছাড় মারছে, হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে, আমরা চলে যাব।

ভেং চির ভয়ে চলে যাবে?

স্বপন বলল, এই গাঁয়ে থাকা যায় না।

সে কী, ভূতের গাঁ হয়ে গেছে মথুরগঞ্জ, যা চেয়েছিলে তা হয়েছে।

স্বপন মল্লিক বলল, ভুল হয়েছে স্যার, ভেং চি দোষ দিচ্ছে আমাদের, মানুষ ছাড়া ভূত পেতনি থাকতে পারে, আমরা সব বইয়ের ভিতর ঢুকে যাব, আমরা নিজেরা মারামারি করে হাড় ভাঙছি, আগে কী সুন্দর দিন কাটত স্যার, ভয় দেখিয়ে কত মজা ছিল, আমরা চলে যাব, ভূত আর মানুষ একসঙ্গে থাকে, না হলে ভূতে মারামারি করে হাড় ভাঙে, আমি এখন গাছে বসে পা দুলোতে পারিনে ভঞ্জন স্যার, আর বাইরে থাকব না, বইয়ের ভিতরে ঢুকে যাব।

লেংচে লেংচে চলে গেল স্বপন মল্লিক।

সত্যিই মানুষ না থাকায় মথুরগঞ্জ ভূত শূন্য হয়ে গেল। খবর পেলেন সেই বার্মিজ ভূত ভেং চিও চলে গেছে রাগ করে। ভূত হয়ে মানুষকে ভয় দেখাতে না পারলে ভূত হওয়া কেন? এই প্রথম ভয় করতে লাগল বিপদভঞ্জনের। ভয়ে কাঁপুনি এল। ইস কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করছে। রাতে দরজা জানালা বন্ধ করেও ঘুম হয় না তাঁর। শেষে না পেরে সকাল হতেই শহরে চললেন, ফিরিয়ে আনবেন সান্যাল, কুণ্ডু আর মণ্ডলদের। পথেই বেগুনি ফুলুরির সঙ্গে দেখা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *