ভূতের হাতের লেখা
স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা বইয়ের টেবিলে রেখে হাঁসফাঁস করে বাবাকে জিজ্ঞেস করল টোটা, ‘আচ্ছা বাবা, ভূত কি সত্যিই আছে?’
বাবা বললেন, ‘না, না? ভূতটুত সব মানুষ কল্পনা করে বলে তখন মনে হয় সত্যিই ভূত আছে। আসলে ভূত বলে কিচ্ছু নেই।’
টোটা এ বছর সবে ক্লাস ফোর-এ উঠেছে। ভীষণ গল্পের বই পড়ে। স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে ওদের গল্পের আসর বসে স্কুলের সামনের চাঁপাগাছটার তলায়। সেখানে চোখ বড়ো বড়ো করে কাঁপা কাঁপা গলায় রাজ্যের ভূতের গল্প বলে এক-একজন। টোটা বাবাকে বলল, ‘তা হলে যে অয়ন আজ টিফিনের সময় বলল, ভূত আছে?’
বাবা বললেন, ‘অয়ন বললেই কি ভূত সত্যি হবে নাকি?’
‘আমাদের ক্লাসে অয়ন যা বলে তা-ই সত্যি হয়। ও যখন বলে আজ চার পিরিয়ডের পরেই স্কুল ছুটি হয়ে যাবে, সেদিন তাই হয়। যে দিন বলে আজ ঝেঁপে বৃষ্টি আসবে সেদিন ঝেঁপে বৃষ্টি আসে। সে-বৃষ্টি আর থামতেই চায় না। হেডস্যার এসব দেখে রেনি ডে-র ছুটি দিয়ে দেন। অয়ন ক্লাসে ফার্স্ট হয় না, তাই!’
টোটার কথা শুনে বাবা তো হেসে থই পান না, ‘ক্লাসে ফার্স্ট হলেই কি তার সব কথা সত্যি হবে? অয়ন তোদের ভুল বলেছে। অয়ন কি নিজের চোখে ভূত দেখেছে নাকি?’
টোটা দু-দিকে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না, অয়ন নিজে দেখেনি। অয়নের ঠাকুরমা ভূত দেখেছেন নিজের চোখে।’
বাবা খুব মজা পেয়ে টোটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভূতটা দেখতে কীরকম? বল না গল্পটা।’
টোটা তার চোখ দুটো গোল গোল করে বলল, ‘না বাবা, এটা গল্প না! একদম সত্যি!’ তারপর বেশ লম্বা একটা ঢোঁক গিলে বলল, ‘সেদিন বিকেল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যে হয়ে গেল। তখনও অয়নের বাবা অফিস থেকে ফেরেননি। অয়নের ঠাকুরমা দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার কাছে। চারদিক ঝাপসা। ভালো করে কিছু দেখাই যাচ্ছিল না। তখন অয়নের ঠাকুরমা দেখলেন, দূরে বাঁশবাগানের পাশের কলাগাছের ঝোপটায় কে যেন বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে।’
বাবা হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জ্বর হলে মানুষ যেমন করে ঠকঠক করে কাঁপে, তেমন করে? নাকি আস্তে আস্তে?’
টোটা ভয়-মাখানো চোখ দুটো আরও বড়ো করে বলল, ‘না বাবা, মজা না, একদম সত্যি।’
বাবা টোটার মতো চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বললেন, ‘সেটা কলাগাছের লম্বা পাতা ছিল না তো?’
টোটা বলল, ‘আঃ! বলি শোনো না। অয়নের ঠাকুরমা তখন ভয়ে নিজেই কাঁপতে কাঁপতে দরজা থেকে সরে এলেন ঘরের মধ্যে। তারপর ফের উঁকি দিয়ে দেখলেন, তখনও ভূতটা বৃষ্টিতে ভিজছে। অমনি দড়াম করে ঠাকুরমা দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। অয়নের বাবা অফিস থেকে ফিরতে ঠাকুরমা ভূতের কথা বললেন। অয়নের বাবা অমনি একটা টর্চ নিয়ে কলাগাছের গায়ে আলো ফেললেন। দেখলেন, সেখানে ভূতটুত কেউ নেই।’
টোটার বাবা মজার গলায় বললেন, ‘তা হলে তো বলতেই হবে, ওটা ভূতই ছিল। অয়নের ঠাকুরমা যখন নিজের চোখে দেখেছেন, সে তো আর মিথ্যে হতে পারে না।’
টোটা মাথাটা উপর-নীচ করতে করতে বলল, ‘তা হলে? তুমি যে বলো ভূত বলে কিচ্ছু নেই, তা কি ঠিক?’ তারপরে টোটা একটু দম নিয়ে বলল, ‘জানো বাবা, আমার পড়ার টেবিলে একদিন ভূত এসেছিল। সে এসে আমার চেয়ারটাতে বসেও ছিল।’
বাবা গলায় রহস্য এনে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, তোর পড়ার টেবিলে ভূত আসতে গেল কেন? ভূতের কি আর কোনো কাজ ছিল না?’
‘ছিলই তো! ভূতের কত রকম কাজ থাকে জানো?’
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভূতদের কী কী কাজ করতে হয় শুনি?’
টোটা বলল, ‘দুষ্টু লোকদের ফাঁকায় একা পেলে ঘাড় মটাকাতে হয়। সন্ধ্যেবেলা যেসব ছেলে-মেয়েরা পড়তে বসে না, তাদের ভয় দেখাতে হয়। যারা মিথ্যে কথা বলে তাদের উপর ভর করতে হয়। এমনকী, কেউ অঙ্ক না পারলে, চুপিচুপি এসে স্কুলের অঙ্ক খাতায় তার অঙ্কও করে দিয়ে যেতে হয়।’
বাবা বললেন, ‘তোর পড়ার টেবিলে বসে ভূত কী করেছিল? অঙ্ক?’
টোটা হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘ঠিক ধরেছ! তুমি কেমন করে জানলে বাবা? একদম ঠিক বলেছ। আমি একদিন রাতে স্কুলের অঙ্ক না করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর সকালে আর অঙ্কগুলো করার কথা মনেই ছিল না। স্কুলে অঙ্ক স্যার যখন সকলকে খাতা জমা দিতে বললেন, আমি খাতা জমা দিতে যাচ্ছিলাম না। স্যার এমন জোরে এক ধমক দিলেন যে, আমি সাদা খাতা নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বললেন, ‘খাতার পাতাটা খোলো। দেখি ক-টা অঙ্ক পেরেছ আর ক-টা অঙ্ক পারোনি।’ আমি ভয়ে ভয়ে খাতাটা খুলেই অবাক। দেখি, আমার খাতায় সব অঙ্কই করা হয়ে আছে।’
বাবা বললেন, ‘তারপর ভূতের এই কান্ড দেখে স্যার কী করলেন?’
‘না না, স্যার ভূতের কথা ভাববেন কেন? স্যার বললেন, ‘এই তো সব অঙ্কই তো করেছিস? নিজেই অঙ্ক করে নিজেই ভুলে গেছিস! হাঁদা কোথাকার!’ আসলে স্যার তো জানেন না, ভূতই অঙ্কগুলো আমার খাতায় করে দিয়েছিল সেদিন। তোমাকে অঙ্কের খাতাটা এনে না দেখালে তুমি বিশ্বাসই করবে না। তুমি ভূতের হাতের লেখাও দেখতে পাবে। তুমি তো কোনোদিন ভূতের হাতের লেখা দ্যাখোনি। দাঁড়াও অঙ্কের খাতাটা নিয়ে আসছি।’
পড়ার ঘর থেকে খাতাটা এনে খুলতে খুলতে টোটা বলল, ‘এই দ্যাখো তুমি ভূতের হাতের লেখা।’ বলে অঙ্কের খাতার সেই পাতাটা খুলেই টোটা অবাক। একটাও অঙ্ক করা নেই। কিন্তু সে যে নিজের চোখে দেখেছে। শুধু সে-ই নয়, অঙ্কস্যারও দেখেছেন। অমনি চোখ বন্ধ করে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল টোটা। বাবা ঝপ করে ধরে ফেললেন টোটাকে। তারপর চোখে-মুখে জল দিতে একটু পরে সে চোখ খুলে তাকাল। তার দু-চোখে তখন ভয় লেগে আছে।
সেদিন রাতে বাবা আর ভূতের করে দেওয়া অঙ্ক নিয়ে একটাও কথা বললেন না।
তবে টোটা কিন্তু এখনও বিশ্বাস করে, খাতায় তো অঙ্কগুলো আর উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। কোনো একটা বিচ্ছু ভূতের কান্ড ছিল এটা। সে-ই অঙ্কগুলো করে এখন ঝপ করে মুছে দিয়েছে।
টোটা জানে, একদিন না একদিন ওই বিচ্ছু ভূতের করে দেওয়া অঙ্কগুলো ফের অঙ্ক খাতার পাতায় ফুটে উঠবে। তখন টোটা ছুট্টে এসে বাবাকে ভূতের করে দেওয়া অঙ্কগুলো দেখাবে। না না, শুধু অঙ্কগুলো দেখাবেই না, বাবাকে নিজের চোখে দেখাবে ভূতের হাতের লেখাও। বাবা তো কোনোদিন ভূতের হাতের লেখা দেখেননি!