ভূতের সত্যি মিথ্যে
শ্মশানটা আমাদের বাড়ির খুবই কাছে হলেও ওই দিকটা আমাদের প্রায় অজানাই ছিল। ক্কচিৎ কখনো গেছি হয়তো। কিন্তু ভালো করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখিনি। গল্প শুনতাম মারা যাবার পর গ্রামের পন্ডিতমশাই নাকি শ্মশান পাহারা দিতেন। আগে যেসব পাজি বদমায়েশরা শ্মশানে বসে গুলতানি করত পন্ডিতমশাই ভূত হয়ে তাদেরই আগে ভাগিয়েছিলেন। ভয় তো দেখাতেনই, সেইসঙ্গে ইট-পাটকেল কাঠের টুকরো ছুড়ে মারতেন। ওই শুধু ক-টা ডোম ধাঙড়ই ওখানে থাকত, কাজকম্ম করত। খেতে বসার আগে ‘পন্ডিত ঠাকুর প্যান্নাম’ বলে মাথায় হাত ঠুকে নিত। ওদেরকে পন্ডিতমশাই কখনো কিছু বলতেন না।
আরেকটা কথাও শুনতাম। চেনাশুনো পড়ুয়ারা ওই রাস্তা দিয়ে পাস করলেই নাকি শুনতে পেত পন্ডিতমশাই ডাকছেন, ওরে শিবু, ওরে রাখাল পড়বি আয়। বলি পড়বি আয়। তাই শুনে শিবু, রাখাল সবাই দে দৌড়, দে দৌড়।
পন্ডিত মশাইয়ের কাছে বেশ কবার কানমলা খেয়েছিলাম আমি। কিন্তু কোনো রাগ ছিল না ওঁর ওপর কোনোক্রমেই। ওঁর ভূত হওয়ার গল্প শোনার পর ওঁর কথা ভাবতেও আমার গা ছমছম করত। মাঝেমধ্যে বাবা-কাকাকে শুনতাম আপশোস করছেন, আহা! কী মানুষটিই-না ছিলেন পন্ডিতমশাই। জীবনে কখনো একটা মিথ্যে কথা বললেন না। কারও ধার ধারলেন না। পাপ করা তো দূরের কথা। অথচ ওঁর এমনটা হল কেন?
এতখানি শোনার পর গ্রামের মোক্তার রসিকরঞ্জন মুখ খুলতেন, বলি অপঘাতে মরা কি কম পাপ চুনিলাল! যেই কেউ অপঘাতে মল তো ভূত হল। আর যেই ম’ল অপঘাতে তো সেই হল গিয়ে পাপী। একটা কথা বলেন দিকিন চুনেদা, যদি পন্ডিতমশাই কোনো পাপ কাজই না করে থাকবেন তো ওঁর মাথায় বাজ পড়ল কেনে? ওই ঝড়বাদলার দিনে বলি আমরাও তো গাঁয়ের পথে চলাফেরা করিচি। তো কেবল ওঁর মাথায় বাজ পড়ল কী করে?
মোক্তারকাকুর এতশত প্রশ্নের কোনো সদুত্তর বাবার জানা ছিল না। উনি ইতিউতি দু-চার বার তাকিয়ে নিয়ে বলতেন, মোক্তার জীবনে তো শুধু ওকালতিই করেছি। ভূততত্ত্ব-প্রেততত্ত্ব তো আর চর্চা করা হল না। আমি আর এর কী উত্তর দেব বলো? তবে কী, মাঝে-সাঝে
বিভূতিভূষণের গল্প পড়লে বড়ড়া জানতে ইচ্ছে করে এই ভূত জিনিসটা কী। তোমার তো বয়স কম, একটু পাত্তা লাগাও না। ওই ভূত ব্যাটাছেলে সত্যি সত্যি আছে কি নেই।
বাবার এই হালকা টিটকিরি শুনলে মোক্তারকাকু সিধে হয়ে যেতেন। একটু তামাক সাজতে সাজতে নিজের মনেই বলতেন, আর আমাকে কেন? আমি তো, সত্যি বলতে কী, ভূতে বিশ্বাসই করিনে। ভূত মানেই ভ্ৰম, ভূত মানেই যা নেই। আর তাই দিয়ে আমারই-বা। কী কাজ?
নিজের মনেই ভূতের নিন্দে করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা হতেন উনি। আমি কিছুটা পথ হ্যারিকেন ধরে যেতাম। তারপর চৌরালির মোড় পর্যন্ত পৌঁছেই বাড়ির দিকে ছুট দিতাম। মোক্তারকাকুর রামনাম জপ করাও তখন দক্ষিণের বাতাসে কানে ভেসে আসত। ভোটের সময় যেমন দলের কর্মীরা স্লোগান দেয় মোক্তারকাকুর জপের আওয়াজ তাকেও ছাড়িয়ে যেত।
শেষে একদিন ভারি রকমের জ্বরে পড়লেন মোক্তারকাকু। গ্রামের বদ্যিরা হার মানল। কেউ নাড়ি পায় না। জ্বর তো সেই পাগলের মতন। তিন দিন তিন রাত্তির ধরে মোক্তারকাকু ঘুমে বিড়বিড় করে গেলেন। শনিবার শহর থেকে ফিরে বাবা বললেন, শুনেছিস মোক্তার কেমন আছে? বললাম, ওঁর জ্বর কেউ নামাতে পারছে না। পাড়ার শেতলাদি বলছিল ওঁকে ভূতে ধরেছে। আর অমনি প্রচন্ড জোরে ধমকে উঠলেন বাবা! বলেছি না খবরদার ভূত ভূত করবে না। তুমি ভূত দেখেছ কখনো চোখে? কথায় কথায় ভূত। আর হ্যাঁ, ওই শেতলাটা কোথায়? আমি ওর ভূতের খেলা বার করছি। বলেই বাবা ছাতা নিয়ে বেরুতে গেলেন।
বাইরে টিপটিপ করে জল পড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়াও বইছে খুব। আমার ভাবতেই খারাপ লাগছিল বাবা ওই অতদূর শহর থেকে এসে এক্ষুনি ফের শেতলাদির বাড়িমুখো হবেন। অথচ বাবার রোখ চাপলে তাঁকে তো কেউ শান্ত করতে পারে না। উনি যে ওঁর মোটা কাচের চশমার ভেতর দিয়ে গাঁয়ের পথঘাট ভালো দেখতে পাবেন না তাও উনি ভুলে গেছেন। লম্বা চওড়া মানুষ পা পিছলে কোথাও পড়ে গেলেও তো রক্ষে নেই।
কিন্তু বাবার যেমন ভাবা তেমন কাজ। নিমেষের মধ্যেই এক হাতে ছাতা আর আরেক হাতে লণ্ঠন নিয়ে বেরুলেন। একবার ভাবলাম দোতলায় কাকাবাবুকে খবর দিই। কিন্তু তাতেও ভয় হল। কাকাকে দেখে যদি বাবা খেপে ওঠেন। এত অন্ধকারে তুই আবার কোত্থেকে?-বলে বসবেন হয়তো তাঁকে। কাকারও যে ঢের বয়স হয়েছে বাবা সেটা কিছুতেই বুঝতে চান না। বুদ্ধিশুদ্ধিতে বাবার ধারেপাশে না এলেও কাকার চোখ দুটোও তো
অন্তত তাঁর চেয়ে ভালো তাও বুঝি-বা তিনি স্বীকার করতে চান না। রাতে কাকা কোথাও যাবেন শুনলে বাবা বলে ওঠেন, অন্ধকারে রাস্তাঘাট দেখতে পাবে না। কেন মিছে ফিকির বাড়াও?
নিরুপায় হয়ে ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাবার পিছু নিলাম। সামনে দশ-বারো হাত দূরে দীর্ঘকায় বাবা লণ্ঠন আর ছাতা হাতে তরতর করে এগোচ্ছেন আর পিছনে আমি সেই মানুষটার পিছন পিছন বিড়ালের মতন নিঃশব্দ পায়ে। অন্ধকারে চোখে কম দেখলেও কী হবে, বাবা হাঁটেন বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলে। বেনেদির আলের কাছে তো আমায় রীতিমতন দৌড়োতে হল ওই দশ হাতের ফারাক রাখতে। দেখতে দেখতে বাতাস একটু জোর হল। ওরকম দু-চার ঝাপটা লাগতেই বেশ আরামের সুরেই বাবা বললেন, আঃ! বুঝলাম বাবার খুব খাটনি যায় শহরে। গ্রামে বাতাস লাগলে আরাম হয়। ইটকলের ধার দিয়ে যেতে যেতে সামনে একবিন্দু আলো দেখা গেল। ক্রমশ কাছে আসতে আসতে বড়ো হল আলোটা। হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে সামনের জন বাবাকে নমস্কার করল। আমি আবছাভাবে দেখতে পেলাম গ্রামের বোষ্টম নিতাইকে। হাতে ভিক্ষের থলি আর গানের যন্ত্র। নিতাই বলল, পেন্নাম হই কর্তাবাবু। এত রাত্তিরে কোথা যান?
বাবা ওঁর স্বাভাবিক গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, নেতাই, তুই মোক্তারের খবর পেলি। কিছু? আর অমনি নিতাই হাঁ হাঁ করে মাটিতে বসে পড়ল, আর কয়েন না কর্তাবাবু, আর কয়েন না। মোক্তার মরিছে। ওর মগজের ওপর এখন পন্ডিতঠাকুর নাচতিছেন। আজ সকাল থেকে মোক্তার যারে দ্যাখে তারে কয়, অঙ্ক কষ, ধাতু বল। এক্কেবারে পন্ডিতঠাকুরের মতো। উঃ আর বাঁচবে নাকো। আপনি যেয়েন না ওখানে।
বাবা চুপ করে সব শুনে বললেন, নেতাই, তুই যাবার সময় আমার বাড়ি হয়ে যা। মাকে একটু হরিনাম শুনিয়ে যাস। আর বলিস আমার ফিরতে হয়তো দেরি হবে। এই নে ক-টা পয়সা। নিতাই পয়সা নিয়ে পেন্নাম ঠুকে এগোতেই সমস্ত সর্বনাশটা হল। ওর সঙ্গে দেখাদেখি হবার ভয়ে আমি একটা ফলসা গাছের পেছনে লুকোতে যাচ্ছিলাম। আমার পায়ের খস খস আওয়াজ শুনে কেডা কেডা করে ছুটে এল নিতাই। আর মুখের ওপর হ্যারিকেনটা মেলে ধরে বিকটভাবে চেঁচিয়ে উঠল, ওমা! এ যে দেখি খোকাবাবু গো। তুমি এখেনে এত রাত্তিরে কী কর? আচমকা বাবাও ঘুরে দাঁড়ালেন আর আমার দেখতে পেয়ে যেন রীতিমতন আতঙ্ক বোধ করলেন। ওঁর গম্ভীর গলায় শুধু একটা শব্দ ফুটে উঠল, তুমি!
আমি ভয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে বললাম, বাবা আমি তোমার পিছনে পিছনে এসেছি। মা বলে তুমি রাত্তিরে ভালো দেখতে পাও না। আর আমি শেতলাদিদের বাড়ির সামনে একটা বড়ো গাড়া হয়েছে। ভাবলাম তুমি যদি দেখতে না পেয়ে পড়ে যাও। তাই…
এবার লজ্জাটা যেন বাবার নিজেরই হল। নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে বললেন, এসো। আমার সঙ্গে এসো। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বাবা বললেন, তুমি না পড়াশোনা করো। তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?
—আমি ভূত-টুত জানি না বাবা। তবে অন্ধকারে গা ছমছম করে। ভয় করে। মনে হয় যারা মরে গেছে তারা পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। ঘরে ঢুকছে।
-ভয় পেলে কী করো?
–রামনাম করি।
—কখন, কেন ভয় পেলে জানতে ইচ্ছে হয় না?
–ভয় করে বাবা।
—হুঁ।
বাবা আলতো করে আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, চলো। নিজের চোখে দেখে আসবে গেঁয়ো লোক ভূত বলতে কী বোঝে।
হনহন করে অতক্ষণ হাঁটছিলেন বাবা। এবার কেমন ধীর-স্থিরভাবে চলতে লাগলেন। বাবার এক হাতে হ্যারিকেন, বগলে ছাতা আর অন্য হাতে শক্ত করে আমার হাতটা ধরা। হ্যারিকেনের আলোয় ভূতুড়ে সব ছায়া হচ্ছে চারদিকে। জলের ফোঁটা নেই, কিন্তু একটা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, বাইরে এলে যখন, তখন গায়ে কিছু জড়িয়ে নিলে না কেন?
-আমার শীত করে না বাবা। একদম করে না।
—শীত করে না, কিন্তু ভয় করে। শীতে কাঁপো না তো ভয়ে কাঁপো কেন?
—ভয়ে কাঁপি না তো! পালিয়ে যাই।
এবার বাবা সেই ঘোর মিশমিশে অন্ধকারে বুক ফাটিয়ে হাসতে শুরু করলেন। আর নিমেষের মধ্যে গোটা অন্ধকারে ভয় কোথায় লোপাট হয়ে গেল। এতক্ষণ যেসব বীভৎস ছায়া দেখে গা ছমছম করছিল সেগুলো খুঁতিয়ে দেখতে লাগলাম। কোনো ছায়া বাবলা গাছের, কোনোটা সুপুরির, কোনোটা বেলের, কোনোটা তালের। রাস্তার দু-ধারের পুকুরগুলোয় টুপটাপ আওয়াজ। মাঝেমধ্যে এখান-ওখান থেকে কোনো কর্কশ শব্দ, আর একটানা ঝিঝির ডাক।
হাসির তোড় থামাতে বাবা বললেন, ভূত বলে কিছু থাকলে আমি নিশ্চয়ই এতদিনে তাকে দেখতে পেতাম। আমি তো সেই ছটো থেকেই জঙ্গলে জঙ্গলে, শ্মশানে শ্মশানে ঘুরেছি। কত লোক কতরকম ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু কই? আমি তো কোথাও কিছু দেখিনি।
আমি শেতলাদির কাছে শুনেছিলাম এক ধরনের ভূত আছে যাদের পা থাকে না। তারা শূন্যে ভাসে। শেতলাদি এরকম একজঙ্গল ভূত দেখেছিল রহিমপুরের গোরস্থানে। গোরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে শেতলাদি দেখেছিল একদল লোক একটা কবরের চারপাশে সেলাম ঠুকে ঠুকে পাক দিচ্ছে। একটা কিছু গাইছিলও হয়ত যা শেতলাদির পরে মনে পড়ত না। কবরের ওপর চাপানো ছোট্ট প্রদীপের আলোয় স্পষ্ট দেখেছিল লোকগুলোর পা নেই। ওরা কীরকম হাঁসের মতন শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। এসব কথা মনে হতেই বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বাবা, কেউ কেউ বলে এক ধরনের ভূত আছে যাদের নাকি পা থাকে না।
—সে কেউ কেউ কারা?
—আমাদের গ্রামের লোক গো।
–ওঃ! তা ওদের সত্যিকারের মাথা আছে তুমি জানলে কী করে?
–কেন মাথা তো আছে?
—যারা এসব কথা বলে তাদের ঘাড়ে একটা ফাঁপা খোল আছে। ভেতরটা ঢং ঢং।
বাবা ফের খুব হাসছিলেন। আর এরকম হাসতে হাসতে, বকতে বকতে আমরা মোক্তারকাকুর ওখানে পৌঁছে গেলাম। কাকুর ওখানে তখন দক্ষযজ্ঞ চলছে। বাড়ির বাইরে থেকেই টের পেলাম ভৌতিক ব্যাপার ঘটছে। উঠোনে বাবা আর আমি যখন জুতো ছাড়ছিলাম ভেতর থেকে ঠিক সেই পন্ডিত মশাইয়ের গলার আওয়াজ পেলাম, ওই তো চুনে এসে গেছে। খুব মাথাওয়ালা লোক। ও দেখবি সব অঙ্ক মুখে মুখে কষে দেবে।
ঘরে ঢুকে দেখলাম সেই অবিকল পন্ডিত মশাইয়ের গলায় কথা কইছেন মোক্তারকাকু। বাবাকে দেখেই ‘এসো চুনে, এসো, এসো’ করে উঠলেন। মোক্তারের মুখে সম্বোধন শুনে বাবার খুব অপ্রস্তুত বোধ হচ্ছিল। অন্যেরা হয়তো বলবে মোক্তার তো এখন পন্ডিতঠাকুর! অথচ বাবা ওই জিনিসটাই কখনো মেনে নিতে পারেন না। বাবা খুব কঠিন স্বরে বললেন, এই একঘর মানুষকে জ্বালানো ঠিক হচ্ছে মোক্তার? এদের একটু ক্ষান্তি দেওয়া যায় না?
অমনি মোক্তার হাউহাউ করে উঠলেন, তুমি আমারে মোক্তার কও কেন চুনীলাল? আমি তোমার শিক্ষক ছেলাম? তুমি আমার টোলে পড়োনি? আজ তুমি চার-পাঁচটা পাস দিয়ে উকিল হয়েস তাই বলে আমার নেয্য সম্মানটুকু দেবা না? তুমি আমায় চেনতি পার না?
বাবা ফের গম্ভীরভাবে বললেন, মোক্তার, তুমি এক্ষুণি শুতে যাও। আমি কাল সদরের বদ্যি নিয়ে আসব ক্ষণ। বাবার কথা শুনে ঘরের পনেরো-বিশজন ‘হা হা, করেন কী, করেন কী করে উঠল। ততক্ষণে আমার নজরে পড়ল ঘরের সর্বত্র নারী-পুরুষের ভৌতিক জটলা। ঘরে দুটো নিবুনিবু হ্যারিকেন। আর সেই সামান্য আলোয় এক ঘটি জল সামনে রেখে, একমুঠো সরষে হাতে নিয়ে ঝাড়ফুক করছে গ্রামের রজনক পরদি। ওর একটা একটা সরষের ফুঁ-তে কাঁই-মাঁই করে উঠছিলেন মোক্তারকাকু।
আর ফুঁয়ের ঝাপটা থেকে রেহাই পেলেই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠছিলেন, তুমি নেমকহারাম চুনীলাল। তুমি আমারে চেনতি পারলা না। তুমি আমার কাছে অঙ্ক শিখেসো, ধাতু শিখেসো, তোমার পৈতে দিসি আমি। আর তুমি আমারে মোক্তার মোক্তার কও।
প্রায় ঘণ্টা খানেক এই চলল। থেকে থেকে পরসাদী বলে, ঠাকুরমশাই, আপনি পিন্ডি লিবেন তো বলিয়ে দিন। না তো এইভাবে আপনাকে মার দিবে হম। এখন বোলেন, আপনি যাবেন কি নহি।
মোক্তারের শরীর ততক্ষণে ঝিমিয়ে এসেছে। চোখগুলো কোটর থেকে যেন ঠিকরে বেরুবে। আর ওই চাহনি। ওই চাহনি আমি পন্ডিত মশাইয়ের চোখে দেখতাম যখন বুক-ভরা শ্লেম্মা নিয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে খক খক করে কেশে চলতেন। আর ওই কাশিতে ওঁর বুকের পাঁজর পর্যন্ত থরথর করে কাঁপত। শেষে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে মোক্তার বললেন, অরে, তোরা আমায় পিন্ডি দে। আমি আর পারিনে। বলেই মুখ বাড়িয়ে বিড়ালের ভঙ্গিতে মোক্তার জলের ঘটি উলটে দিলেন।
আর সহ্য করতে না পেরে বাবা ‘ধুত্তোর!’ বলে উঠে পড়লেন। আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বললেন, চলো। তারপর ফের সেই হ্যারিকেন, ছাতা আর আমার হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলেন বাবা। কয়েক পা এগোতেই প্রচন্ড তোড়ে বৃষ্টি নামল আর সেইসঙ্গে হাওয়া। বাবা ছাতাটা যতখানি সম্ভব আমার মাথার দিকে হেলিয়ে দিয়ে বললেন দেখো মাথায় জল লাগিয়ো না। অসুখ করবে। কোনো একসময় হ্যারিকেনটাও হাওয়ার ঝটকায় নিবে গেল। বাবা গ্রামের মানুষদের মুন্ডপাত করতে করতে এগোতে লাগলেন। এসব মানুষের কোনো উন্নতি নেই খোকা। এরা নিজেদের কুসংস্কার নিয়েই জন্মেছে, আর তাই নিয়েই মরবে। এরা বিজ্ঞানের বিচার থেকে কিছুই কোনোদিন শিখবে না। এরা নিজেরাই একেকটা ভূত।
আমাকে বাঁচাতে গিয়ে গোটা রাস্তাটা বাবা জলে ভিজলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা রাস্তা হারালাম। যেদিকেই যাই সেই বেনেদির চকে এসে পড়ি। শেষে ক্লান্ত সিক্ত বাবা ‘ওফ’ বলে এক গাছের তলায় বসে পড়লেন। আমি বাবার গায়ে হাত দিয়ে বললাম, বাবা ওঠো, জ্বর হবে। আমার চোখ ফেটে তখন জল আসছে। কী মরতে শেতলাদির কথা বলেছিলাম বাবাকে! এই ভাবতে ভাবতে আমার চোখ দিয়ে পিচকিরির মতন জল ছুটল। ওই অন্ধকারে আমার চোখ দেখতে না পেয়েও বাবা বুঝলেন আমি কাঁদছি! হ্যারিকেনটা এক পাশে সরিয়ে রেখে আমার চোখ মুছোতে মুছোতে বললেন, ছিঃ! তুমি কাঁদছ কেন? আমার তো বেশ ভালোই লাগছে, কতকাল বৃষ্টিতে ভিজিনি। অবাক হয়ে গেলাম বাবার ওই কথায়। কিছুক্ষণ আগে এই বাবাই বলেছিলেন গায়ে জল না লাগাতে, অসুখ হবে। আর এখন!
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখনও ভূতে বিশ্বাস করো?
-না করি না।
প্রায় সোয়া ঘণ্টা পরে জল থামল। বাবা আর আমি যখন শেষরাতে পৌঁছোলাম তখন বাড়ির সবাই গোটা গ্রাম চষে ফেলেছে ওই ঝড়বাদলায়! আমাদের দেখতে পেয়ে কী হয়েছে! কী হয়েছে? করে প্রায় তেড়ে এল সবাই। বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, কিছু না। আমাদের একটা করে গামছা দাও। গা মুছি। আর একটু দুধ দিয়ে।
দুধ খেয়ে আমরা যখন শুলাম তখন ভোর হয় হয়। ওদিন ভোরে আর উঠতে হবে না জেনে বেশ মজাই হচ্ছিল। কেবল বাবা একটু মিইয়ে পড়লেন সকালের কাজ পন্ড হবে ভেবে। বেলা দশটায় আমি যখন বিছানা ছাড়লাম বাবার তখন বেদম জ্বর। জ্বরে কেবল ভুল বকছেন, আমি বিশ্বাস করি না। ভূত থাকতে পারে না। তোমরা উজবুক, আহাম্মক, রাসকেল। তোমরা নিজেরাই ভূত।
দুপুরে গ্রামের বদ্যি এল, বিকেলে সদরের। দু-জনেই মাথায় হাত দিয়ে বসল। রোগ ধরা যাচ্ছে না। কেবল জ্বরের বড়ি খাইয়েই মানুষটার তো চিকিৎসা হতে পারে না। কে না কে পরামর্শ দিল ওঝা ডাকার। আর অমনি রুখে দাঁড়ালেন কাকা। না, দাদা যাতে বিশ্বাস করেন তা দিয়ে ওঁর চিকিৎসা হতে পারে না। ওঝা, ফকির দিয়ে ওঁর চিকিৎসা হবে না।
সেই সন্ধ্যেতেই বাবাকে খুলনার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল গাড়ি করে। সারাটা রাত ওখানে বসে রইলেন বাড়ির সকলে। কেবল আমাকে নিয়ে ফিরে এলেন জেঠিমা। একলা ঘরে রাতে শোয়ার আমার আর ভয় নেই। কোনো অন্ধকার, কোনো পৈশচিক ছায়া, কিংবা রহস্যের আওয়াজ আর আমাকে ডরাতে পারবে না। আমার যেন ভূতেই বিশ্বাস চলে গেছে। গোটা রাত আমার কেবল বাবাকেই মনে পড়ছিল। গাছের তলায় বসে থাকা ক্লান্ত বাবাকে।
সকালে হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম বাবার জ্বর ক্রমশ বাড়ছে। প্রচুর ভুল বকছেন ঘুমের মধ্যে। আমি কেবিনে ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে এক মুহূর্তের জন্য ওঁর চোখ খুলল। আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে বললেন, এসেছ?
তারপর চোখ বুজেই হাতড়ে হাতড়ে আমার হাতটা ধরলেন।
বললেন, নেই। এবং তারপর আবার পাশ ফিরলেন, বললেন— নেই। এর পর আর বাবা পাশ কাটিয়ে ফিরলেন না। কিছু উচ্চারণও করলেন না। একটা শিশুর মতন বাঁপাশে হেলে বরাবরের মতন ঘুমিয়ে পড়লেন। ওই দিন প্রায় ওই সময়টাতেই মোক্তারকাকু ভালো হয়ে ওঠেন। সবাই বলল পন্ডিতমশাই মোক্তারকে ছেড়ে নিজের প্রিয় ছাত্র চুণিলালকে নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। ওরকম অবান্তর কথা শোনারও আমার আর ধৈর্য ছিল না। এক রাত্রিতেই আমি গ্রামের মানুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছি।