ভূতের সঙ্গে মোকাবিলা – রাজেশ বসু

ভূতের সঙ্গে মোকাবিলা – রাজেশ বসু

কলমিপুরের মাঠে ক্রিকেট খেলে বাড়ি ফিরছিল নন্তু আর চিকু। মন খারাপ দুজনেরই। টিম হেরে গিয়েছে। তাও দু-দশ রানে না। একচল্লিশ রানে। চিকুরা এসেছিল অতিথি খেলোয়াড় হিসেবে। কাছাকাছি দু-পাঁচটা গায়ে অলরাউন্ডার বলে নাম আছে ওদের। দস্তুরমতো খাতির করেই এনেছিল কলমিপুর ক্রিকেট ক্লাব। টিমকে জেতাতে পারলে নতুন ব্যাট তো আছেই সঙ্গে ফেলুদাসমগ্র কিনে দেওয়ারও কথা। এপ্রিল মাস পড়েছে। এ গরমে ক্রিকেট কে খেলে এখন। পারিতোষিকের লোভেই আসা।

কিন্তু, কপাল কাকে বলে! কী যে হল আজ, চূড়ান্ত বাজে খেলল দুজনেই। বোলিং ব্যাটিং দুটোতেই ভয়ংকর ভরাডুবি! বল করে উইকেট তো একটিও জোটেনি, উলটে ছ-টি ওভারে দুজনে মিলে রান দিয়েছে সত্তর। ব্যাটেও একই অবস্থা। দুজনের মিলিত অবদান মাত্র আটটি রান। নন্তু পাঁচ, চিকু তিন।

কলমিপুরের ছেলেরা তো বেজায় খাপ্পা। এই নিয়ে পরপর তিনবার তারা হারল মাখনপল্লির কাছে। মাথা গরম সকলের। এবং যত দোষ চিকুদের ওপর। কী দরকার ছিল নিজেদের ছেলে না-খেলিয়ে সবুজগড় থেকে প্লেয়ার আনার। চিকুদের সামনেই অনেকে উষ্মা প্রকাশ করেছে। এমনকী ওদেরকে যে সাইকেল করে আবার সবুজগড়ে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল, সে-ব্যাপারটা নিয়েও কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেনি। অগত্যা দুজনকে পায়ে হেঁটেই বাড়ির পথ ধরতে হয়েছে। রাস্তা নেহাত কম না। সাইকেলেই জোর প্যাডেলে লাগে পৌনেঘন্টার কাছাকাছি। হাঁটলে ঘন্টা দুয়েকেরও বেশি লেগে যেতে পারে। সবচেয়ে বড়ো কথা এসব ক্ষেত্রে গল্পে যেমন হয়, তেমনি আর কী? মানে দুর্গম পথ। বাঁশঝাড়ে ভরা জঙ্গল, ভূতপ্রেত অধ্যুষিত শ্মশান, শতাব্দীপ্রাচীন হানাবাড়ি, ইত্যাদি সবই পড়ে এই শ্মশানখালির জঙ্গুলে রাস্তায়। অবশ্য অন্য পথও আছে। একটু ঘুরপথে গিয়ে গাড়িচলা পিচরাস্তা দিয়ে যাওয়া। এসেছিলও ওই পথে। কিন্তু সে তো কলমিপুরের ছেলেদের সাইকেলে চেপে। হুস করে চলে এসেছিল। সে পথে এখন পায়ে হাঁটলে অন্তত আরও ঘন্টাখানেকের দেরি। সন্ধে গড়িয়ে রাত হবে। একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে হবে। বই নিয়ে বসা আছে। আগামীকাল অঙ্ক পরীক্ষা। করালীস্যার কঠিনকঠিন সব অঙ্ক করতে দেন। না-পারলেই যাচ্ছেতাই শাস্তি। নীচু ক্লাসে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে গোটা একটি পিরিয়ড। কী লজ্জা, কী লজ্জা! এক বলে বোল্ডআউট হয়ে যাওয়াও কিছু না এর কাছে। সুতরাং যতই বিপজ্জনক পথ হোক, উপায় নেই কোনো।

নন্তু একটু ভীতু প্রকৃতির। ছাতিমতলার মোড়ে এসে বলল, ”কাজটা ঠিক হচ্ছে না রে চিকু। বড়ো রাস্তা ধরেই যাই। এখনি যা ঘুম পাচ্ছে বাড়ি ফিরে কতটুকুই বা পড়তে পারব। শাস্তি আছেই কপালে।”

”তার চেয়ে বল না বাবা ভয় পাচ্ছিস।” বলল চিকু, ”কী দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে সেটা ভাবছিস না কেন। ভুতুমপাগলার সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে।”

”ওরে বাবা।” আঁতকে উঠেছে নন্তু। কারণও আছে। ভুতুমপাগলা ওদের গাঁয়েরই লোক। পাগল বললেও ঠিক যেন পাগল না। ভ্যাগাবন্ডগোছের। বয়সের গাছপাথর নেই। ভবঘুরে হয়ে দিনরাত টোটো করছে। কাজকর্ম কিছু করে না। খাবার জুটলে খেল, না-জুটলে খেল না। আক্ষেপ নেই কিছুতেই। রোগা লিকলিকে চেহারা। দাঁড়কাকের মতো গায়ের রং। অন্ধকারে হঠাৎ দেখলে ভূত বলেই মনে হয়। অনেকে তাই ভুতুম বলে ডাকে। আসল নাম কী ছিল, বা আদৌ কিছু ছিল কিনা কেউ জানে না। সে নিজেও হয়তো জানে না। যা হোক, এই ভুতুমপাগলা হঠাৎই মাসখানেক ধরে নিখোঁজ। জানা গেল অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে তার। গ্রামের খগেনমুদি সংবাদটি আনেন। জেরান্ডসাহেবের ভাঙাকুঠির সামনে চোখ উলটে মরে পড়েছিল সে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়েছিল। তবে লাশ পাওয়া যায়নি। তদন্তও হয়নি আর। পথের মানুষ পথেই মরেছে, কে আর অত খোঁজ-তালাশ করে!

তা ছাড়া ভূতেও লাশ গায়েব করে থাকতে পারে। এমন কথাই অনেকে ভেবেছিল। আসলে জেরান্ডসাহেবের ওই বাড়িটির সুনাম নেই এ অঞ্চলে। দেড়শো-দুশো বছর বয়স। কোনো এককালে সাহেব নিজেই থাকতেন। নীলের ব্যবসা ছিল তার। কত গরিব চাষিদের যে সর্বস্বান্ত করেছেন হিসেব নেই কোনো। শেষটায় অবশ্য তাদের হাতেই মারা যান। সেই থেকে বাড়িটি ওভাবে পড়ে আছে। এখন তো দস্তুরমতো একটি হানাবাড়ি। রাতবিরেতে বাঁশি বেজে ওঠে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পাওয়া যায়। এ ছাড়া কত রকমের সব অশরীরীরা নাকি আসর বসায় সেখানে। স্বয়ং জেরান্ডসাহেবকেও লম্বাঝুল কোট, চোঙাদার প্যান্ট আর হাঁটু অবধি চামড়ার বুটজুতো পরে ঘুরতে দেখা যায় হামেশাই। তবে এসব কিনা মাঝরাতের ব্যাপার। দিনের আলোয় কেউ কখনও ভয় পায়নি এ পথে। বেচারি ভুতুম। পাগল মানুষ। অসময়ে গিয়ে হয়তো হাজির হয়েছিল। অপদেবতারা ঘাড় মটকে মেরেছে তাকে।

”ভাগ্যিস বললি। ভুতুমপাগলের কথাটা ভুলেই গেছিলাম। চল ফিরে বড়ো রাস্তা ধরি। গাড়িও পেয়ে যেতে পারি একটা।” বলল নন্তু।

”গাড়ি পেয়ে যেতে পারি একটা।” নন্তুর কথাটা রিপিট করল চিকু। ”কী করে গাড়ি চড়বি? পকেটে এনেছি কিছু। আসল কথাটা বল ভয় পাচ্ছিস।”

কথাটা ঠিক। একদম খালি পকেটে এসেছে ওরা। আসলে কলমিপুরের ছেলেরা যেভাবে খাতির-টাতির করে নিয়ে এসেছিল, টাকাপয়সার কথা মনেই আসেনি একদম। এমনকী নিজেদের ক্রিকেট ব্যাটটিও সঙ্গে নেয়নি। অভ্যস্ত ব্যাটে খেললে ব্যাটিংটা অন্তত একটু ভালো করা যেত। তবে বন্ধুর কাছে ভীতু হতে রাজি না নন্তু।

”ধুস। ভয় পাব কেন?” বলল ও, ”আসলে আজকের দিনটা কেমন অপয়া দেখছিস না।— তা ছাড়া আকাশের অবস্থাটা দ্যাখ, বড়োরাস্তা ধরে গেলে বৃষ্টির মধ্যে কোথাও একটা মাথা বাঁচাবার জায়গা অন্তত পাব।”

এ কথাটা ঠিক। চিকু তাকাল আকাশের দিকে। খেলা তাড়াতাড়ি শেষ হওয়াতে ঘড়ির সময়ে ঢের বিকেল এখন। কিন্তু, হঠাৎই কোত্থেকে কুচকুচে কালো মেঘের পাল এসে আদিগন্ত একটা চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিয়েছে। ভর বিকেলেই হঠাৎ সন্ধের অন্ধকার। হাওয়াও দিচ্ছে বেশ। ঝড়টড় উঠতে পারে। দুটি লোক বোধ হয় জঙ্গুলে রাস্তা ধরেই ফিরল। কাঁধে সবজির ঝুড়ি। হাত নেড়ে তারাও বারণ করল। ”বাবারা, ঝড় আসছে। গতিক সুবিধে না। বাড়ি যাও শিগগির।”

ব্যস। সতর্কবাণী শুনেই নন্তু আবার দোনোমোনো। বলল, ”চল চিকু, এখনও টাইম আছে, ফিরে গিয়ে বড়ো রাস্তা ধরি।”

”ছাড় তো। এমন অ্যাডভেঞ্চারটা মিস করে কেউ!” বলল চিকু। ওর আসলে বেশ লাগছে। অনেকদিনের ইচ্ছে পায়ে হাঁটে এই রাস্তায়। ওর ছোটোকাকা সাইকেল চেপে নতুনবাজরে কম্পিউটার শিখতে যায়। কলমিপুর পেরিয়ে নতুনবাজার। শর্টকাটে এই শ্মশানখালির পথেই যাওয়া-আসা করে ছোটোকাকা। চিকুকেও বারকয়েক সঙ্গে নিয়েছে। মাটির সরু রাস্তায় বিছিয়ে থাকে গাছগাছালির শুকনো পাতা। সাইকেলের চাকা পড়লেই চুড়মুড় করে শব্দ ওঠে। এদিক-ওদিক থেকে পাখি ডাকে কত। আর সবকিছুরই সঙ্গে মিশে থাকে বুনো-বুনো কেমন একটা গন্ধ। দারুণ লাগে ওর। তবে জেরান্ডসাহেবের নীলকুঠি বা শ্মশান কোনোটাই দেখেনি ও। সেটা আসলে একটু অন্যদিকে। শালতোড় নদীর দিকে। শ্মশানটাও সেদিকে। যদিও শ্মশান-টশানের কোনো চিহ্ন এখন আর নেই। কোনকালেই উঠে গিয়েছে সব। আর জঙ্গল হলেও বুনো জন্তু-টন্তুও নেই একটিও। বহুকাল আগেই তাদের অস্তিত্ব লুপ্ত হয়েছে। সুতরাং ভয় পাওয়ারও কিছু নেই এখন। সে-কথাই নন্তুকে বোঝাল ও। আর বৃষ্টি যদি নামেই, তাতে তো আরও ভালো। কতদিন বৃষ্টিতে ভেজেনি। মনের সুখে ভিজতে পারবে। বাড়ি ফিরে অবশ্য বকুনি খেতে হবে। তা আর কী করা যাবে। চটপট পড়তে বসে গেলেই হল।

কিন্তু নন্তুর কথাই ঠিক যেন। সত্যিই বড়ো বেগতিকের দিন আজ। কিছুদূর যেতে-না-যেতেই শনশন শব্দে ঝড় উঠে গেল। গাছগাছালির বিষম উতালপাথাল অবস্থা। এইবুঝি ভেঙে পড়ে আর কী। আর আকাশ এমনই কালো হল, সন্ধে পেরিয়ে রাত-ই নামল যেন। ঠিকপথে যাচ্ছে কিনা সেটা ঠাহর করাই দায়। বৃষ্টিও শুরু হয়েছে বড়োবড়ো ফোঁটায়। থেকে থেকে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে আকাশে।

বিশাল একটা অশ্বত্থগাছের নীচে দাঁড়াল ওরা। নন্তু বলল, ”দেখলি চিকু, তখনই বললাম ফিরে চল।”

”আমার কিন্তু দুর্দান্ত লাগছে।” চিকু বলল। ওর কথা শেষ হতে-না-হতেই সামনের আকাশে চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎ ঝলক এবং পরমুহূর্তেই বাজপড়ার প্রচণ্ড কানফাটানো আওয়াজ। এরকম সময়ে গাছের নীচে দাঁড়াতে নেই একদম। বাজ নাকি গাছের মাথাতেই পড়ে। ছুটতে শুরু করল দুই বন্ধু। এমন ভাগ্য, এবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টিও নেমে পড়ল মুষলধারে। সঙ্গে তুমুল ঝড় তো আছেই। নজর পুরো ঝাপসা। গাছের ডালও ভাঙছে পটাপট। কোনদিকে পালাবে ওরা বুঝতে পারছে না ঠিক। যা হোক, এমনি করে মিনিটখানেক ছুটতে মনে হল সামনে নদী বইছে। শালতোড় নদী।

নন্তু চিৎকার করে বলল, ”থাম চিকু। আমরা শ্মশানের দিকে চলে এসেছি রে।” দাঁড়িয়ে পড়েছে ও।

চিকুরও তাই মনে হচ্ছে। সেও দাঁড়িয়েছে। কিছুটা দূরে একটি বাড়ির আভাসও দেখা যাচ্ছে। বাড়ি না-বলে বাড়ির ভগ্নাবশেষই বলা ভালো। ওটিই কী তবে জেরান্ডসাহেবের নীলকুঠি! চিকুর বুকটা ধক করে উঠল। যাবে কি ওখানে। বৃষ্টির হাত থেকে তো বাঁচা যাবে আপাতত।

এমন সময় কে যেন ইংরেজিতে ‘হেল্প, প্লিজ হেল্প মি’ বলে উঠল খুব কাছ থেকেই।

চমকে উঠেছে দুই বন্ধুই। নেহাত পরক্ষণেই বিজলির আলোতে শব্দের উৎসটি দেখতে পেল ওরা। কয়েক পা তফাতে মাটির ওপরে উবু হয়ে বসে আছে একটি মানুষ। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের আলোতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মানুষটি বিদেশি। সাদামানুষ।

লোকটি এবার ভাঙাভাঙা বাংলাতেই বলল, ”প্লিজ একটু হেল্প করো আমাকে। পা-টা মচকেছে মনে হচ্ছে।”

লোকটির কথার ধরনে চিকু সাহস পেল। জেরান্ডসাহেবের ভূত নয়। ভূতেরা স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে পারে না। নাকিসুরে কথা বলে তারা। তা ছাড়া লোকটি গোলগলা টিশার্ট আর ঢাউস একটা বারমুডা পরে আছে। জেরান্ডসাহেবকে নিয়ে যেসব গল্প শুনেছে তার সঙ্গে কোনো মিল নেই। সাহসে ভর করে এগোতে গেল ও।

”কী করছিস তুই?” হাত টেনে ধরেছে নন্তু, ”ভূতটুত না তো !”

”ধুস, দেখছিস না। দিব্যি জলজ্যান্ত মানুষ। পা পিছলে পড়ে গেছে। আমাদের হেল্প চাইছেন।”

লোকটি মনে হয় ওদের কথা শুনে ফেলেছেন। বললেন, ”আমাকে ভয় কোরো না। আই অ্যাম টমি লি। ছবি আঁকি। পেন্টার। তোমাদের মতোই বিপদে পড়ে গেছি। একটু হেল্প করলে উঠে দাঁড়াতে পারি।”

”সিওর আঙ্কল।” বলল চিকু। গ্রামের বাংলা মিডিয়ামে পড়লে কী হবে। দু-চার শব্দ ইংরেজি সে-ও বলতে পারে। নন্তুর হাত ছাড়িয়ে টমিসাহেবের হাত ধরল ও। দিব্যি উষ্ণ স্পর্শ। ভূত হলে বরফের মতো ঠান্ডা হত। নিশ্চিন্ত বোধ করল ও।

”থ্যাঙ্ক ইউ মাই বয়।” বললেন টমিসাহেব। চিকুর কাঁধে বাঁ-হাতটি রেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন। বিদ্যুতের আলোতে বোঝা যাচ্ছে চিকুর অনুমান ঠিক। বয়স হয়েছে তার। মুখের চামড়ায় হাতের চেটোর মতো অজস্র আঁকিবুকি। শীর্ণ মুখটিতে অতিকায় একটি নাক। কুতকুতে চোখ। মাথায় একটি গোল বেতের টুপি। তার চারিধার দিয়ে জল পড়ছে গড়িয়ে। ডান পা-টি একটু তুলে রেখেছেন। মাটিতে ফেলতে পারছেন না। ভালোরকমই লেগেছে। ভরসা পেয়ে নন্তুও এগিয়ে এসেছে এবার।

”লেটস গো মাই বয়েজ। ওই বাড়িটায় শেলটার নিই আমরা। এভাবে ভিজলে ধুমজ্বরে পড়ব।”

নন্তুর বুকটা ধড়াস করে উঠেছে। ওই বাড়িটায় যাবে মানে! ওই বাড়িটাই তো জেরান্ডসাহেবের কুঠি। ভূতবাংলোও বলা যেতে পারে। কিন্তু চিকুকে বারণ করার অবসর পেল না সে। ইতিমধ্যেই ‘আয় রে নন্তু’ বলে হাঁটা লাগিয়েছে ও বাড়িটার দিকে। নন্তু কী করে। সে-ও চলল পিছনে। ভরসার অবশ্য আর একটি কারণ ঘটেছে, লোকটির জুতোসুদ্ধ পা ঠিক ঠিক পড়ছে। মানে ভূতেদের মতো উলটোদিকে না। তবু ওর মনের মধ্যে জোঁকের কামড়ের মতো ভয়টা থেকেই গেল।

দু-তলা বাড়ি। এককালে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা ছিল। এখন জায়গায়-জায়গায় ইটের স্তম্ভের মতো জেগে আছে। কঙ্কালসার দেয়ালের ফাটলে-ফোঁকরে বট-অশ্বথের ছড়াছড়ি। সাপের মতো শিকড় ছড়িয়ে রেখেছে তারা। বাড়ির সামনেটাতেও এত ঝোপঝাড়ের জঙ্গল ভিতরে যাওয়ার পথটাই বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। তবে সামনের গাড়িবারান্দার ছাদটি অটুট এখনও। ঝোপঝাড় কোনোমতে অতিক্রম করে ওরা তিনজন এসে দাঁড়াল সেখানে। ভিজে চুপ্পুস সকলেই। ঝোড়ো হাওয়াতে শীত করছে রীতিমতো। বৈশাখ মাসেও দাঁতে ঠকঠকানির মতো অবস্থা। সামনেই কয়েকধাপ সিঁড়ি। শেষ হয়েছে বাড়ির সদর দরজায়। যার একটি পাল্লাই অবশিষ্ট এখন। ঝড়ের ঝাপটায় সেটি দমাদ্দম বাড়ি খাচ্ছে দেয়ালে। সব মিলিয়ে কেমন একটা গা ছমছমে ভুতুড়ে পরিবেশ। এর মধ্যেই টমিসাহেব হঠাৎ বললেন, ”লেটস এন্টার দিজ হন্টেড হাউজ।”

কথাটা দু-বন্ধুরই কানে কেমন শোনাল। নন্তুর মনে হল জোঁক না, একটা বোলতাই বুঝি হুল ফোটাল কুটুস করে।

”নাথিং টু ফিয়ার অ্যাবাউট। ওদের ভয়চকিত ভাবটি দেখেই বুঝি বলে উঠলেন টমিসাহেব, তার পায়ের ব্যথাটা কমেছে মনে হয়। চিকুর হাত ছেড়ে দিয়ে তরতরিয়ে সিঁড়ির ধাপগুলি পেরিয়ে গেলেন। বাড়ি খাওয়া পাল্লাটি একহাতে চেপে ধরে ডাকলেন ওদের, ”আরে এসো, এসো, যা কন্ডিশন হয়েছে বাড়িটার, হন্টেড বললাম তাই। ঢুকে পড়ো। বাইরে সাপটাপ থাকতে পারে।”

কথাটা ঠিক। চিকুও সেই ভয় পাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে কিচকিচ-খচরমচর-কটকট গা শিরশিরানি সব আওয়াজ আসছে কানে। তবে পোড়োবাড়ির ভিতরে যে এইসব সরীসৃপ বা পোকামাকড় থাকবে না এমন নিশ্চয়তাই বা কোথায়। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও যায় না। হাওয়া দিচ্ছে এমন জলের ছাঁটেই নাকানি-চোবানি অবস্থা প্রায়। সিঁড়ি বেয়ে টমিসাহেবের পাশে দাঁড়াল ওরা। তারপর তাকে সামনে রেখে ভিতরে ঢুকল একে একে।

নজর চলে না মোটেই। চাপচাপ জমাট অন্ধকার। কেবল বিদ্যুৎ চমকের হঠাৎ-হঠাৎ যেটুকু আলো ভাঙা জানালা-দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে, ঘরটি যথেষ্ট বড়ো। ডানদিকের দেয়াল ঘেঁসে ফুলকারি ডিজাইনের লোহার রেলিংওলা একটি কাঠের সিঁড়িও উঠেছে মনে হল। তবে সেই সিড়ি বেয়ে দু-তলায় যাওয়ার উপায় নেই। কারণ নীচের দিকে তিনচারটি ধাপ ছাড়া উপরের দিকে একটি ধাপও আস্ত নেই মনে হল। তা ছাড়া লোহার রেলিংয়ে কতগুলি প্রাণীও ঝুলছে মাথা নীচু করে। ওগুলি যে বাদুড়ের দল বলার অপেক্ষা রাখে না।

নন্তু ফিসফিস করে বলল, ”অ্যাই লোকটা কোথায় গেল রে?”

সত্যি তো। টমিসাহেব এই অন্ধকারে গেলেন কোথায় হঠাৎ। এই তো ছিলেন। এদিক চাইল চিকু। নিকষ অন্ধকারটা চোখে সয়েছে কিছুটা। সিঁড়ির রেলিংয়ে মাকড়সার বিশাল বিশাল জালগুলিও নজরে পড়ছে। বিজলির রোশনিতে চিকচিক করে উঠছে সেগুলি। কিন্তু টমি লি সাহেব নেই কোত্থাও।

নন্তু বলল, ”চিকু চল পালাই এইবেলা। ভুতুমপাগলার কী দশা হয়েছিল মনে আছে তো! আমার কিন্তু টমিসাহেবকে মোটেই ভালো লাগছে না।”

ভয় চিকুরও করছে। খগেনকাকার কথাটা ওর মনের মধ্যেও উগড়ে উঠেছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ভয় পেলে চলে না। তা ছাড়া ভূতপ্রেতের ব্যাপারটা মন থেকে ঠিক মেনে নিতে পারে নাও ও। তবে এই বিচ্ছিরি পোড়োবাড়িটাতে থাকতে মোটেই ভালো লাগছে না। তার ওপর কী বদখত বোটকা গন্ধ ঘর জুড়ে!

এমন সময় কাঠের সিঁড়ির পিছন থেকে আয়তাকার হলুদ আলো এসে পড়ল এ ঘরে। ওদিকটাতে যে আর একটি ঘর আছে, বোঝা গেল এখন। পরক্ষণেই ওদেরকে চমকে দিয়ে টমিসাহেবের ভারি গলা, ”কাম অন মাই বয়েজ। আলো জ্বালিয়েছি আমি।”

বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক এ বাড়িতে আগেও এসেছেন। কেরোসিনের লম্ফ জ্বেলেছেন। গন্ধ ভাসছে বাতাসে।

”দেখলি তো, কেমন মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিলি।” বলল চিকু। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন ওর। ভয়ের একটা বরফঠান্ডা অনুভূতি ওর মনেও ঢুকেছিল। এখন সেটা একদম নেই। ভূতেরা আর যাই করুক, নিজে হাতে আগুন জ্বালাবে না!

সিঁড়িটার পাশ দিয়ে এ ঘরে ঢুকল ওরা।

মাঝারি ঘর। আগেরটির মতো আসবাবশূন্য নয়। বাঁ-দিকের দেয়াল ঘেঁসে একটি ছোটোখাটো লোহার খাট। সামনে একটি লেখার টেবিল। তার আবার একটি পায়া ভাঙা। পরপর ইট সাজিয়ে ঠেকা দেওয়া হয়েছে কোনোমতে। ল্যাম্পটা রয়েছে সেই টেবিলের ওপরেই। ফাটলওলা একটি কাচের চিমনি থাকলেও হাওয়ায় দমকে শিখাটা মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে। টেবিলের সামনে একটা কাঠের চেয়ার। যার দুটি হাতলের একটি ভাঙা। অন্যটিতে নিজের বামহাতটি রেখে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছেন টমিসাহেব।

”সিট ডাউন। সিট ডাউন।” ওদেরকে ঢুকতে দেখেই বলে উঠেছেন তিনি।

লোহারখাটটাতে বসল ওরা। কবেকার খাট কে জানে। বসতেই ক্যাঁচর-ক্যাঁচর করে শব্দ উঠল। শতছিন্ন একটা গদিও পাতা আছে খাটের ওপর। এটিরও বয়সের ঠিক-ঠিকানা নেই। গন্ধ বেরচ্ছে বিচ্ছিরি। নীচু খাট। পা দোলাতে ঠং করে কী একটা গড়িয়ে পড়ল নীচে। মাথা ঝুঁকিয়ে নীচু হয়ে দেখল চিকু। দু-চারটে বাসনটাসন। হাড়ি থালা গ্লাস বাটি, সবই অ্যালুমিনিয়ামের মনে হল। টেবিলের নীচে একটি মাটির উনুনও দেখা যাচ্ছে। কেউ থাকে এখানে। টমিসাহেবই নয়তো! চিকু সেটাই জিজ্ঞেস করল তাকে।

কথাটা শুনলেন না যেন টমিসাহেব। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। টেবিলের পিছনে একটি কপাটহীন জানালা। পেরেক-টেরেক পুঁতে একশো ফুটোর একটি চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সেটি। হাওয়া বইছে এমন নৌকোর পালের মতো ফুলে ফুলে উঠছে চাদরটি। সেদিকটাতে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।

নন্তু হঠাৎ বলল, ”তুমি বলছিলে ছবি আঁকো, রংতুলি প্যালেট কিছু দেখতে পাচ্ছি না তো?”

পাতলা ঠোঁটদুটি এবার সামান্য বেঁকিয়ে হাসলেন টমিসাহেব। কুতকুতে চোখের নীলচে মণিদুটি এই অপ্রতুল আলোতেও জ্বলে উঠল যেন।

”আঁকি তো। পোট্রেট। কিন্তু ক-দিন ধরে আঁকছি না। একই লোকেদের ছবি আঁকতে কত ভালো লাগে! আর রংতুলির কথা বলছ। সব আছে। ওপরের ঘরে। ওখানেই আমার স্টুডিয়ো।”

”কিন্তু ওপরের ঘরে ওঠার সিঁড়ি তো ভাঙা!” কথাটা না-বলে পারল না চিকু। লোকটাকে সুস্থ মাথার মনে হচ্ছে না ঠিক। পাগল হবে নির্ঘাৎ। নয়তো বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই দুর্যোগের মধ্যে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, এরকম পোড়োবাড়িতে সংসার সাজিয়ে থাকে!

”আমার তো সিঁড়ির দরকার পড়ে না।” ঠোঁটদুটি বেঁকিয়ে আবার হাসলেন টমিসাহেব।

চিকুর এখন কোনো সন্দেহ নেই। ভূত নয়, পাগলের খপ্পরে পড়েছে। এখানে আর একটি মুহূর্তও থাকবে না ওরা। ভিজে জামাপ্যান্টে শীত করছেও খুব। হঠাৎ খেয়াল হল, আশ্চর্য, টমিসাহেব তো সেই গোলগলা গেঞ্জি আর ঢাউস হাফপ্যান্টটাই পরে আছেন। টুপিটাই কোথায় কে জানে। কিন্তু তার পোশাক যে একদম শুকনো। এত তাড়াতাড়ি জামাকাপড় শুকোলেন কী করে। বুকটা ধক করে উঠল ওর। ব্যাপারটা একেবারেই সুবিধের নয়। নন্তুর হাত ধরে উঠে পড়ল ও।

”কী হল, উঠছ যে তোমরা?” ভুরু কুঁচকে বললেন টমিসাহেব।

নন্তু বলে বসল, ”আমাদের ভয় করছে। বাড়ি যাব এখন।”

হো হো করে অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন টমিসাহেব। কী ভয়ংকর সে হাসি! ভয়ে হাত-পাগুলো সব পেটের মধ্যে ঢুকে গেল যেন ওদের। আরও কাণ্ড, সিঁড়ির রেলিংয়ে ঝোলা বাদুড়গুলি এই বিকট হাসি শুনেই যেন হঠাৎ এ ঘরে উড়তে শুরু করে দিল বিচ্ছিরিভাবে।

”যাবে তো তাড়া কী। আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করবে না। আমি যাদের ছবি আঁকি। পিছন ঘুরে দ্যাখো, একজন তো এসেই পড়ল।” কুতকুতে সাপের মতো চোখদুটি নাচিয়ে বললেন টমিসাহেব।

সত্যিই তো। পিছনে তাকাতে অবাক হল ওরা।

দরজার সামনে একটি মানুষ দাঁড়িয়েছে কখন। কী অদ্ভুত দেখতে তাকে। চিকু আর নন্তু দুজনেই ক্লাস সেভেনে পড়ে। পাঁচফিট মতো লম্বা। এই লোকটি ওদের থেকে বড়োজোর-দু-তিন ইঞ্চি বেশি লম্বা হবে। তবে চওড়ায় অনেক বেশি। গড়নও বেশ। শক্তপোক্ত। বেশিবহুল চেহারা। পরনে কেবল একটি কাপড়মাত্র। কোমরে জড়ানো। কাপড় না-হয়ে গাছের ছালও হতে পারে। দু-হাতে দুটি পাথরের খণ্ড। খুব চকচকে। ল্যাম্পের আলো ঠিকরে পড়ছে তাতে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে একটি আদিম মানুষ উঠে এসেছে। লোকটি কিন্তু একটা আওয়াজ করে লোহারখাটে গিয়ে পা তুলে বসল। হাতের পাথরদুটি ঠুকুস-ঠুকুস একমনে। আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরুচ্ছে প্রতি ঠোক্করে।

”খুব অবাক হয়েছ তো।” বললেন টমিসাহেব। ”তা হওয়ারই কথা। নিজেদের পূর্বপুরুষকে হঠাৎ দেখলে অবাক তো হবেই। ও হল বাসাঙ্গোডিউকা। আটচল্লিশ হাজার সাতশো ত্রিশ দিন বয়স ওর। লেট প্লিস্টোসিন যুগের অধিবাসী। তোমরা তো স্রেফ নিয়ানডার্থাল ম্যান বলেই খালাস। একটি সাপের কামড়ে মরতে হয়েছিল ওকে। ঠিক এ জায়গাটিতেই। মায়া ছাড়তে পারেনি বেচারি। আমার ছবির মডেল হয় মাঝে-মাঝে।”

এ কেমন অসম্ভব কথা। চিকু বুঝল না ঠিক। টমিসাহেব লোকটি যে বাড়াবাড়ি রকমের গোলমেলে তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু, আদিম মানুষের ভেক ধরে এই লোকটির আবির্ভাব হল কোত্থেকে!

এমন সময় আবার সুর করে বাঁশি বেজে উঠল হঠাৎ। দরজার ওপার থেকে এল যেন শব্দটা। তাকাতে আবার একপ্রস্থ অবাক হওয়ার অবস্থা।

এঘরের আলো চতুষ্কোণ হয়ে বাইরের ঘরে পড়েছে কিছুটা। সেই আলো-আঁধারিতেই দেখা যাচ্ছে ছোটোখাটো একটি লোক সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। ইনি অবশ্য আদুর গায়ে নন। জোব্বামতো কিছু একটা পরে আছেন। মুখে সরু নলের মতো যন্ত্রটি বাঁশিই হবে। পিঁইই সুরে আওয়াজটা ওটা থেকেই আসছে মনে হচ্ছে। বেশ দুলে দুলে সিঁড়ি বেয়ে নামছেন তিনি। কী করে নামছেন, সেটিই মহাআশ্চর্য! শেষের তিনটি ছাড়া একটি ধাপও যে ওই সিঁড়িটিতে অবশিষ্ট নেই।

লোকটি এবার এসে ঢুকল এই ঘরে। বাঁশি থামিয়ে টমিসাহেবের দিকে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে সোজা গিয়ে বসল আদিম মানুষটির পাশে। এবার বোঝা যাচ্ছে সে একজন চিনা মানুষ। মুখের গড়ন এবং পোশাকের ধরনে তাই মনে হয় অন্তত। জোব্বামতো পোশাকটি আসলে একটি চাইনিজ রোব। ড্রাগনের ছবিটবি আঁকা রয়েছে তাতে। লম্বা একটি ঝুলো গোঁফও আছে লোকটির।

টমিসাহেব বললেন, ”ইনি তাংচি জিয়ান। ফা হিয়েনের আমলের লোক। ওঁর সঙ্গেই এসেছিলেন। ভারতভ্রমণে নয়, এসেছিলেন ব্যবসার খাতিরে। কিন্তু এখানকার কুখ্যাত মশার কামড়ে প্রাণটি যায় তার। কী তাংচি ঠিক বলছি তো?”

মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানাল তাংচি। তারপর আবার বাঁশিতে ফুঁ দিল সে। আর সঙ্গে সঙ্গে জানালা দিয়ে অতিকায় একটি লালঠোঁটো সারস এসে ঢুকল ঘরে। পাখিটি সোজা এসে আক্রমণ করল চিনা লোকটিকে। সে লাফ দিয়ে পড়ল টেবিলে। ইটের পায়া গেল সরে টেবিল পড়ল উলটে। সঙ্গে সঙ্গে লম্ফটিও পপাত ধরণিতলে। চিমনিও ফাটল। আলোটিও নিবল। ঘরজুড়ে বিষম হুলুস্থুল কাণ্ড। সারসের বিকট ডাক। টমিসাহেবের ‘কিল ইট কিল ইট’ চিৎকার। আদিমমানুষটির আবার এই দৃশ্য দেখে আমোদ জেগেছে মনে। মুলোর মতো দাঁত বের করে হাসছে খুব। লোহার খাটটিও ধাতব ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ তুলে তাল মেলাচ্ছে সেই হাসির সঙ্গে। এর মধ্যেই হঠাৎ আবার ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। জানালার চাদর পেরেক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে পড়েছে কোথায়। বৃষ্টি কখন থেমে গিয়ে বাইরের আকাশে আবছা চাঁদের আলো। সেই আলোতে দেখা গেল একটি বিশাল ঘোড়া এসে থামল জানালার সামনে। তার গলায় লাগাম। পিঠে মখমলি জিন। ঘোড়া থেকে নামলেন এক ব্যক্তি। মোগল যুগের মতো পোশাক তার গায়ে। মাথায় পাগড়ি। হাতে উদ্যত তরোয়াল। ক্ষীণ আলোতেও ঝকঝক করছে তার ইস্পাতের ফলা।

”শিগগির আসুন খাঁ-সাহেব।” টমিসাহেবের গলা শোনা গেল। ”বদমাইশ পাখি গোলমাল শুরু করেছে আবার।”

”কোই বাত নেহি।” খাঁ-সাহেব জানালা ঠপকে টপকে ঘরে ঢুকলেন। এক্ষুনি গর্দান নেবেন পাখিটির। কিন্তু কিছু করার আগেই সাঁই করে পালিয়ে গেল সারসটি। লালঠোঁটে তাংচির মুখের বাঁশি। বাচ্চাদের মতো হাত-পা ছুড়তে শুরু করেছেন তিনি। ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেও দিলেন ভ্যাঁ করে। কী যে অদ্ভুতুড়ে সব কাণ্ডকলাপ ঘটছে!

”কুল কুল। নো মোর নয়েজ।” বলে উঠলেন টমিসাহেব। ”ভালোই হয়েছে আপদ গেছে। কে বলেছিল ওর হাড় দিয়ে বাঁশি বানাতে? পাখি মেরেছে, মাংস খেয়েছ, তাতেও হয়নি। ওর হাড় দিয়ে আবার বাঁশি। চারিদিকে এত বাঁশ, দেখতে পাওনা নাকি! তাও আবার বাজানো চাই যখন-তখন। বাজালেই যখন সে বিরক্ত হয়! যাকগে, আর কথা না, চুপটি করে বোসো এখন।”

তাংচি জিয়ান চুপ করলেন না। দুর্বোধ্য কীসব শব্দ-টব্দ বলে জানালা দিয়ে বাইরে লাফ দিয়ে পড়লেন। পাখিটার খোঁজেই গেলেন বোধহয়। বাঁশিটি উদ্ধার করবেন আবার। বাসাঙ্গোডিউকো অবশ্য লক্ষ্মী খুব। সে আবার তার জায়গায় গিয়ে বসেছে। চকমকি পাথরদুটো ঘষছে ঠুকুর-ঠুকুর। আলোর ফুলকি বেরচ্ছে মাঝেমাঝে।

”আপনিও বসুন খাঁ-সাহেব।”

”জি।” বললেন নতুন আগন্তুক, ”লেকিন এই ছোঁকরা দুজন কে আছেন?”

”ওরা আমার মডেল হতে এসেছে।”

”বহুত খুব বহুত খুব। লেকিন গন্ধ শুঁকে লাগছে এনারা এখনও জিন্দা আছেন!” বললেন খাঁ-সাহেব। তরোয়ালটি দোলাচ্ছেন অনবরত। পাখি না-মারতে পেরে হাত সুড়সুড় করছে খুব। জানালার পাশটিতে দাঁড়ালেন ঠেস দিয়ে।

টমিসাহেব এবার চিকুদের দিকে ঘুরলেন। এই হট্টগোলে কিছু সংবিত এসেছিল ওদের। কিন্তু পালাতে পারেনি। বাদুড়গুলোর জন্য। বিচ্ছিরি প্রাণীগুলো ঠিক দরজাটা জুড়ে উড়ছিল ভয়ানকভাবে।

”শোনো তোমরা। পরিষ্কার স্পষ্ট কথা বলি এবার। জ্যান্ত মানুষের ছবি আঁকি না আমি। আমার মডেল যখন হতে চেয়েছ মরতে হবেই তখন।”

যেটুকু বা মাথায় বুদ্ধি খেলছিল চিকুর এমন সাংঘাতিক কথা শুনে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। তবু মিথ্যে কথাটা মানতে পারল না ও।

”আমরা কখন তোমার মডেল হতে চাইলাম?” কোনোমতে বলল সে।

টমিসাহেব ওর প্রশ্নটি এড়িয়ে বললেন, ”কীভাবে মরবে, সেটা না-হয় বেছে নিতে পারো। এটুকু ফেভার করতে পারি তোমাদের। বাসাঙ্গোডিউকাকে যে সাপটি কামড়েছিল সেটি এখন তোমাদের পায়ের সামনে। আমার নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছে।”

সত্যি, কথা শেষ না-হতেই হিসহিসানির আওয়াজ পায়ের কাছে। পাঁচ-ছ হাত লম্বা একটি কালো ফণা মেলে দুলছে। নন্তু আর পারল না। অনেক তাণ্ডব সহ্য করেছে সে। এবার মাথা ঘুরে এলিয়ে পড়ল চিকুর ঘাড়ে। চিকু কোনোমতে ওকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর অবস্থাও সঙ্গিন। যে কোনো মুহূর্তে ওরও নন্তুর দশা হল বলে!

টমিসাহেব খুব মজা পেয়েছেন যেন। ধনুকের মতো ল্যাগবেগে শরীরটা নিয়ে নেচে নিলেন একপাক। কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই পায়ের যন্ত্রণায় দাঁড়াতেই পারছিলেন না। বললেন, ”অবশ্য খাঁ-সাহেবের তরবারির ফলাটিও পছন্দ করতে পারো। খোদ সুলতান শেরশাহের খাস সৈন্যদলে ছিলেন। তরোয়ালের একটি কোপে একটি আস্ত শালগাছ কাটতে পারেন। হুমায়ুনের গুপ্তচরের হাতে ঠিক এই জায়গাটিতেই নিহত হন। না-হলে উনিই আজ দিল্লির মসনদে বসতেন।”

চিকু কী বলবে! বলার আছেটাই বা কী! কোন কুক্ষণে যে এ পথে পা বাড়িয়েছিল। কলমিপুর ক্রিকেট ক্লাবের ছেলেগুলির ওপর খুব রাগ হচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হল, এমন নয়তো, ওরাই সেজেগুজে এমন ভয় দেখাচ্ছে চিকুদের। কিন্তু, কেবল অভিনয় করলেই তো হবে না। দুর্দান্ত ম্যাজিকও জানতে হবে। যেভাবে একটির পর একটি অলৌকিক কাণ্ড ঘটছে। … নাঃ ভূতের কবলেই পড়েছে ওরা। একটি-আধটি নয়। চার-চারটি জলজ্যান্ত ভূত। এ অঞ্চলেই অপঘাতে মরেছিল। মুক্তি পায়নি হয়ত। তাই এখনও এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দল ভারি করতে ওদেরকেও মারবে এখন। এই টমিসাহেবটি হলেন এদের পান্ডা। কিন্তু সেই নীলকর জেরান্ডসাহেব কোথায় গেলেন! অবশ্য বাইরের ঘর থেকে খচমচ আওয়াজ আসছে। আবার কোনো প্রাচীন মানুষ এলেন বুঝি। ফোঁসফোঁস করে ক-বার নাকও টানলেন যেন। ভূতেদের কি সর্দি হয়? কে জানে। অনেক কিছুই তো ভুল জানত। ভূতদেরে শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়। আগুন দেখে পালায়। খোনা গলায় কথা বলে। কত কী ! সব ভুল। এবার বুঝি স্বয়ং জেরান্ডসাহেব-ই আসছেন। ভুতুমপাগলাও আসতে পারে। সে-ও তো মরেছে সম্প্রতি। ভুতুম আসলে অবশ্য ভালো হয়। সে চিকুদের চেনে। কতবার তপনদার তেলেভেজার দোকান থেকে আলুরচপ কিনে খাইয়েছে ভুতুমকে।

”কী হল? অত ভাবনার কী আছে?” তাড়া দিলেন টমিসাহেব। তারপর ইঙ্গিত করলেন খাঁ-সাহেবের দিকে। বিকট একটি অট্টহাসি দিলেন খাঁ-সাহেব। তরোয়াল হাতে এগিয়ে এলেন চিকুর দিকে। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল চিকু। কিন্তু কোনো আওয়াজই বেরল না মুখ দিয়ে। বুকের মধ্যে এত জোরে হাতুড়ি পিটছে, মরেই যাবে বুঝি। এতটুকু শক্তিও নেই শরীরে যে পালাতে পারে। সুযোগ বুঝে বাদুড়গুলি এখন জ্বলন্ত চোখে ওর মাথার ওপর উড়তে শুরু করে দিয়েছে। সাপটিও ফণা মেলে দু-হাতের মধ্যে। আর খাঁ-সাহেব তো আছেনই। তরোয়াল দোলাচ্ছেন ওর নাকের কাছটায়। বাসাঙ্গোডিউকারও যথারীতি ভারি মজা। লোহার খাটে বসে বসেই নাচছে সে। হাসছে বিকট সুরে। কেবল তাই না, জানালাতেও আরও কত মুখ ভেসে উঠেছে। মুখ তো না, এক-একটি কার্টুন যেন। কিম্ভুত কদাকার। যেখানে যত ভূতপ্রেত ছিল মজা দেখতে হাজির হয়েছে যেন।

”নো মোর ফান। কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করুন খাঁ-সাহেব।” টমিসাহেবের গলা শোনা গেল, একটু যেন অন্যরকম। তার ভরাট কণ্ঠস্বর এই প্রথম একটু কেঁপে উঠল মনে হল। কারণটি কী বোঝার আগেই বিষম একটি কাণ্ড ঘটল হঠাৎ।

চিকুর পিছন থেকে ‘তবে রে’ বলে কে যেন লাফিয়ে পড়ল ঘরের মাঝখানে। আর চিকুর মনে হল এবার সেও নন্তুর মতোই অজ্ঞান হয়ে যাবে।

আগন্তুক আর কেউ নন, স্বয়ং ভুতুমপাগলা। মেঘ কেটে চাঁদ উঠে পড়েছে ভালোরকম। সামনে পূর্ণিমা হতে পারে। প্রায় গোল চাঁদ। ফুটফুটে আলো। সে আলোতে নজর ভালোই চলে। এবং তাতে বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই, একমুখ দাড়িবিশিষ্ট কঙ্কালসার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ লোকটি হল ওদের গ্রামের ভুতুমপাগলা। খগেনমুদি যাকে নিজের চোখে মরে পড়ে থাকতে দেখেছেন মাসখানেক আগে!

ভুতুম ঘরে এসেই জোর চেল্লামেল্লি শুরু করেছে।

”সব ভাগো এখান থেকে। এক্ষুনি। ঘরটার কী অবস্থা করেছে অ্যাঁ! লম্ফ ফেলেছে? বিছানা নষ্ট করেছে। টেবিল উলটেছে।”

চিকু এখন ঘরের স্যাঁতসেঁতে ফাটা মেঝেতে বসে পড়েছে। দাঁড়িয়ে থাকার মতো জোর নেই পায়ে। নন্তুকেও কোনোমতে নামিয়ে দিয়েছে মেঝেতে। তার বোধহয় হঠাৎ জ্ঞান এসেছে। গোঁ গোঁ শব্দ আসছে ওর মুখ থেকে। না-আসাই আশ্চর্যজনক। চিকুর নিজের স্বরযন্ত্রটি নির্ঘাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছে, নয়তো সে-ও এমন ভূতে পাওয়া আওয়াজ করত। এবং এখনও অবধি যে জ্ঞান হারায়নি সেটিও বোধ হয় অলৌকিক কোনো উপসর্গ।

ভুতুমের লাফালাফি আর চিৎকারে খাঁ-সাহেব হঠাৎ কেমন মিইয়ে গেলেন। তরোয়াল খসে পড়ল তার হাত থেকে। তারপর, …কী অসম্ভব দৃশ্য, তিনি নিজেও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে গেলেন অন্ধকারে। কেবল খাঁ-সাহেবই না, চিকু দেখল ওর পায়ের কাছের সাপটিও উধাও হয়েছে কখন। বাসাঙ্গোডিউকো তো বটেই, এমনকী স্বয়ং টমিসাহেবও। সকলেই প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত মুখে খাঁ-সহেবের মতোই গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল। মাথার ওপরে যে বাদুড়গুলি ভয়ানকভাবে উড়ছিল, সেগুলিও কোথায় যেন অদৃশ্য হল। জানলার বাইরেও ভীষণদর্শন মুখ নেই কোনো। একা ভুতুমের ভয়ে সব ভূত পালিয়েছে।

”আরে বড়োভাই, তোমায় চেনা ঠেকছে যে, আমাদের চিকু না?” ভুতুম বলল। সে হাঁটুগেড়ে বসেছে চিকুর সামনে।

চিকুর গলা শুকিয়ে কাঠ। তবু মন বলছে ভুতুম ভূত হলেও ভালো ভূত। টমিসাহেবের মতো খারাপ ভূত না।

”এখানে কী করছিলে বড়োভাই?” জিজ্ঞেস করল সে, ”আর ওটি, চিনতে পারছি না ঠিক। পরানদার ছেলে মনে হচ্ছে, কী যেন নামটা?—ব্যাটারা আমার লম্ফটাও ভেঙে দিয়েছে। কত কষ্টে জোগাড় করেছিলাম।”

চিকুর বুকের ধড়পড়ানিটা একটু কমে আসছে যেন। শরীরের বলটাও ফিরছে একটু একটু করে। কোনোমতে বলল, ”নন্তু।”

”হ্যাঁ। হ্যাঁ। আহা বড়ো ভালো ছক্কা মারে। দিশি কুমড়োর ছক্কাও হার মানে। এমনকী পাখির হাড়ের বাঁশিও।”

এই রে, আবোল-তাবোল বকছে ভুতুম। মরে গেলেও পাগলামিটা রয়ে গিয়েছে। ভাবল চিকু। তবে এখন ওরা পালাতে পারে এখান থেকে। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে, নন্তুকে নিয়ে। সে মনে হচ্ছে অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছে আবার। একটু আগেই যেরকম গোঁ গোঁ শব্দ করছিল। একটু জল পেলে ভালো হত। সাহস করে উঠে দাঁড়াল চিকু।

তক্ষুনি একটা কাণ্ড ঘটল। ভুতুম হঠাৎ ওর পা জড়িয়ে ধরে প্রায় শুয়েই পড়ল। ”আমার কথা কাউকে বোলোনি বড়োভাই। আমি এখানে বড়ো সুখে আছি। সব্বাই জানে ভুতুমব্যাটা মরেছে গিয়ে। মরব কেন? দিব্যি আছি। এদিক-ওদিক ঘুরছি। বনের ফলপাকড় খাচ্ছি। পাখিটাখি দেখছি। আর রাতে এখানে এসে চার-পা তুলে ঘুম দিচ্ছি।”

”মানে?….খগেনকাকু যে বলল ….” পা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল চিকু।

”আমি মরে গেছি!” কথা কেড়ে নিয়ে বলল ভুতুম, ”সে তো আমি ওকে ভয় দেখিয়েছিলাম। হাড়কেপ্পনটা ইদিকে এসেছিল কেন কে জানে। মনে হয় বড়ো বাইরে-টাইরে পেয়েছিল হঠাৎ। ব্যাটাকে দূর থেকে আসতে দেখেই চোখ উলটে মড়া সেজে পড়ে রইলাম। কী বলব। একদিন যা দুঃখ দিয়েছিল আমায়। সারাদিন খাওয়া জোটেনি। দোকানে গিয়ে বললাম অন্তত একটা হজমিগুলি দাও। অনেক করে চাইতে তা সে দিল বটে, তবে গোটাটি না, আধখানা ভেঙে আবার বোয়ামে পুরে রাখল। ভাব দেখি, পাগল কেমন। আমাকে দেখে সেদিন এমনি পালাল, কী বলব, চালের বস্তাটা যে সাইকেল থেকে খসে গেল খেয়ালই করল না। সে চাল এখনও ফুটিয়ে খাচ্ছি।”

”কিন্তু…”

”বুঝেছি।” বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল ভুতুম, ”তেনাদের কথা বলছ তো। না বড়োভাই। ওদের নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। দুটো ধমক দিলেই পালায়। আসলে ভূত তো সব। শরীর-ই নেই, করবেটা কী! বেশ ভোল পালটে সঙ সেজে ভয় দেখায় খালি। ভয় না-পেলেই হল। দেখলে না দাবড়ানি দিলাম কেমন। তোমরা নেহাত পাগল তাই এমন অনাছিষ্টিটা করল।”

চিকুর মনে হল সত্যিই তাই। আসল পাগল ওরাই। আর ভুতুমপাগলা হলেও সত্যি পাগল না। বলল, ”একটু জল পাওয়া যাবে?”

”জল আছে। ফল আছে। মনে কত বল আছে।” বলে একলাফে লোহার খাটের নীচ থেকে একটা মাটির কুঁজো টেনে বের করলে সে। সেই ঠান্ডা জল মুখে পড়তে নন্তুর জ্ঞান এল তৎক্ষণাৎ। পরক্ষণেই অবশ্য ভুতুমকে দেখে ভিরমি খাচ্ছিল সে। কোনোমতে ব্যাপারটা বোঝাল ওকে চিকু। ভুতুমকেও বলল কীভাবে এখানে এসে পড়েছিল তারা।

সব শুনে ভুতুম বলল, ”তোমাদের একটু এগিয়ে দিচ্ছি। তবে জেরার মুখে আমার ডেরার কথাটা বলে বোসো না যেন।”

শেষমেষ বাড়ি যখন ফিরল ওরা তখন রাতের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। অবশ্য বকুনি খুব একটা হল না। ছেলেরা যে ওই খারাপ পথ অতিক্রম করে ভালোয়-ভালোয় বাড়ি ফিরেছে, এটাই ভাগ্যি অনেক। চিকুর মা শুধু বললেন, ”কাল সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠো। অঙ্কগুলো একটু দেখে যেও। সারাটা দিন তো টইটই করেই কাটিয়ে দিলে।”

তা সে তো চিকু দেখবেই। করালীস্যার টমিসাহেবের থেকে কিছু কম ভয়ংকর নন। আপাতত দরকার একটি লম্বা ঘুমের। যা কাণ্ড হল ! ভুতুম না-থাকলে কী যে হত। কিন্তু একটা খটকা মনে রয়ে গিয়েছে এখনও।

শুতে যাওয়ার আগে দাদুর ঘরে এল সে। দাদু এই বয়সেও অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। আজ মাথাটা একটু ধরেছিল। শুয়ে পড়বেন ভাবছিলেন। চিকুকে ঘরে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ”কিছু বলবে দাদুভাই?”

”তুমি জানো দাদু। নীলকর জেরান্ডসাহেবের পুরো নাম কী ছিল?”

দাদু একটুক্ষণ চাইলেন ওর দিকে। তারপর বললেন, ”টমি লি জেরান্ড! টাকার নেশা ছাড়াও ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসতেন। আর্টিস্ট হওয়ার শখ ছিল। আঁকতেনও নাকি ভালো। বাড়ির চাপে নীলের ব্যবসায় নামেন। মাথাটা তখনই বিগড়ে ছিল বোধহয়।—কিন্তু তুমি এ কথা জিজ্ঞেস করছ কেন দাদুভাই? আগে তো করনি কখনও। শুনলাম শ্মশানখালির জঙ্গলে রাস্তা হারিয়েছিলে। ভয়টয় পাওনি তো? তবে দাদুভাই বলে রাখি, ওসব ভয় করলেই ভয়। নয়তো সব ফক্কা।”

”জানি আমি” হেসে বলল ও। বুকের মধ্যেটা ধড়াস করে উঠল বটে, তবে সেটা কিছু নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *