ভূতের রাজা
সরকারি কাজে বিদেশে থাকি। ছুটি নিয়ে দেশে ফিরছি।
সাঁওতাল পরগনার যে-জায়গায় আমার কর্মস্থল ছিল, সেখান থেকে রেল স্টেশনে যেতে হলে প্রায় ত্রিশ মাইলেরও ওপর পথ পার হতে হবে। পাহাড়ে পথ; এক-এক মাইল হচ্ছে দু-তিন মাইলের ধাক্কা। তার ওপরে রাতের বেলায় পথে বাঘ-ভাল্লুকের সঙ্গেও আলাপ হওয়ার সম্ভাবনা কম নয়! সকাল বেলায় বেরুলেও মাঝপথে সন্ধ্যা হবেই। তখন একটা আশ্রয়ের দরকার।
মাঝপথের কাছাকাছি স্থানীয় রাজার একটি শিকার কুঠি ছিল। রাজা বা তাঁর বন্ধুরা শিকারে বেরুলে এই কুঠি হত তাঁদের প্রধান আস্তানা।
রাজার ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ ছিল। তাঁকে গিয়ে অনুরোধ জানালুম, শিকার-কুঠিতে একটা রাতের জন্যে আমাকে মাথা গোঁজবার জায়গা দিতে হবে।
ম্যানেজার বললেন, ‘এখন শিকারের সময় নয়, কুঠি খালি পড়ে আছে। আপনি এক রাত কেন, এক মাস থাকতে পারেন। এখানকার পুলিশ-সুপারিনটেনন্ডেন্ট টেলর সাহেবও আজ রাতটা সেখানে বিশ্রাম করবেন। কুঠিতে আরও ঘর আছে, আপনারও থাকবার অসুবিধা হবে না। কিন্তু—
‘কিন্তু কী?’
‘কিন্তু আপনি সেখানে রাত কাটাতে পারবেন কি?’
‘কেন পারব না?’
‘লোকের মুখে শুনি, কুঠিতে নাকি অপদেবতার ভয় আছে।’
‘অপদেবতা?’
‘হ্যাঁ, অপদেবতা ছাড়া আর কী বলব! কুঠির পাশেই শালবনের ভেতর সাঁওতালদের এক ভূতুড়ে দেবতা আছে। সেই দেবতা নাকি ভূতের রাজা। তার ভয়ে সাঁওতালরা পর্যন্ত সন্ধ্যার পর ও-পাড়া মাড়ায় না। তারা বলে, তাদের দেবতা নাকি রাতের বেলায় কুঠির ভেতরে ঘুমোতে আসে।’
আমি হো-হো করে হেসে উঠে বললুম, ‘বেশ তো, মানুষ হয়ে দেবতার সঙ্গে রাত্রিবাস করব, এটা তো মস্ত পুণ্যের কথা! আমি রাজি!’
ম্যানেজার বললেন, ‘আমি অবশ্য ওসব ছেলেমানুষি কথায় ততটা বিশ্বাস করি না, তবু বলা তো যায় না—’
যথাসময়ে ডুলিতে চড়ে রওনা হয়ে, সন্ধ্যার কিছু আগেই শিকার-কুঠিতে পৌঁছোলুম।
ডুলি-বেয়ারারা বলে গেল, মাইল তিনেক তফাতে একটা গাঁয়ে গিয়ে তারা আজকের রাতটা কাটাবে; কাল সকালে আবার ডুলি নিয়ে আসবে।
কুঠির বারান্দায় একখানা বেতের চেয়ারে বসে টেলর সাহেব তামাকের পাইপ টানছিলেন। সাহেবের সঙ্গে আমারও বেশ পরিচয় ছিল।
আমাকে দেখে সাহেব বললেন, ‘এই যে, গুপ্ত যে! তুমি কোথায় যাচ্ছো?’
‘ছুটি নিয়ে দেশে ফিরছি।… তুমি?’
‘আমি ”হোমে” যাচ্ছি। তুমি কি আজ এখানে থাকবে?’
‘হ্যাঁ সায়েব।’
‘বেশ, বেশ, দু-জনে একসঙ্গে রাত কাটানো যাবে, এ ভালোই হল।’
‘দু-জন কেন সাহেব, তিনজন।’
‘তিনজন আবার কে? তুমি কি আমার আরদালির কথা বলছ? ও, তাকে আমি মানুষের মধ্যেই গণ্য করি না।’
‘না সায়েব, তোমার আরদালির কথা বলছি না।’
‘তবে কি কুঠির দ্বারবানের কথা ভাবছ? না, সে রাত্রে এখানে থাকে না।’
‘না না, আমি দ্বারবানের কথাও বলছি না!… তুমি কি শোনোনি সায়েব, সাঁওতালদের এক দেবতা রাত্রে আমাদের সঙ্গী হতে পারেন?’
টেলর হেসে বললে, ‘ওহো, শুনেছি বটে! তা, সে রূপকথার এক বর্ণও আমি বিশ্বাস করি না।… তুমি করো নাকি?’
‘করলে, একলা এখানে রাত কাটাতে আসি?’
টেলর পাইপে তিন-চারটে টান মেরে বললে, ‘দেখ গুপ্ত, সাঁওতালদের এই দেবতাটিকে আমি দেখেছি। এমন বীভৎস দেবতা পৃথিবীতে আর দুটি নেই। তাকে দেখে আমার ভারি পছন্দ হয়েছে।’
‘পছন্দ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। তাই ঠিক করেছি, কাল যাবার সময়ে তাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। ইংল্যান্ডে আমার বাড়ির বৈঠকখানায় তাকে সাজিয়ে রেখে দেব। আমার বন্ধুরা তাকে দেখলে খুব তারিফ করবেন।’
আমি হেসে বললুম, ‘তা হলে বোঝা যাচ্ছে, কাল থেকে দেবতা আর কুঠির ভেতরে শুতে আসবেন না? তবে এইবেলা তাঁকে একবার দর্শন করে আসি।… তাঁর আড্ডা কোথায়?’
টেলর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললে, ‘ওই যে, ওইখানে! মিনিট খানেকের পথ।’
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলুম। কুঠির পাশেই অনেকগুলো শাল গাছ দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ছায়ায় একটা পাথুরে ঢিবির উপরে মানুষের মতো উঁচু একটা মূর্তিকে দেখতে পেলুম।
মূর্তিটা রং-করা কাঠের। তার দেহ মাপে মানুষের মতন বটে, কিন্তু তার মুখ দানবের মতন প্রকাণ্ড! আর সে মুখের ভাব কী ভয়ংকর! দেখলেই বুকের কাছটা ছাঁৎ ছাঁৎ করতে থাকে।
মাথার চুলগুলো সাপের মতন ঝুলছে, কান দুটো হাতির মতন, মুখখানা খানিক সিংহ আর খানিক ভাল্লুকের মতন, দু-দুটো গোল গোল কাচের চোখ আগুনের মতো জ্বলছে। হাঁ-করা বড়ো বড়ো দাঁতওয়ালা মুখের ভিতরে থেকে রাঙা টকটকে, লকলকে জিভের আধখানা বাইরে বেরিয়ে পড়ে ঝুলছে! কাঁধ ও মুণ্ডের মাঝখানে গলাটা দেখলে মনে হয়, কে যেন একটা লিকলিকে সরু বাঁখারির উপরে মুখখানাকে বসিয়ে দিয়েছে। হাত দু-খানা বাঘের থাবার মতো। কোমরের কাছ থেকে পা পর্যন্ত দেহের কোনো অঙ্গ দেখা যাচ্ছে না। কাঠকে খুদে আর কোনো অঙ্গ গড়াই হয়নি। মূর্তির গায়ের রং আলকাতরার মতন কালো আর মুখের রং খানিক সাদা, খানিক তামাটে ও খানিক হলদে।
ভাবলুম, এ মূর্তি যদি সত্য সত্য রাত্রে কুঠির ভিতরে ঘুমোতে আসে, তা হলে আমাদের ঘুম এ জীবনে আর ভাঙবে কি!
ধীরে ধীরে কুঠির দিকে ফিরে এলুম। টেলর পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছিল। আমাকে দেখে সে বললে, ‘গুপ্ত, খুব ঝড়-বৃষ্টি আসছে, ওই দেখ!’
সত্য কথা। পশ্চিমের আকাশখানা আচম্বিতে ঠিক যেন কালো কষ্টিপাথর হয়ে গেছে। ঝড় উঠতে আর দেরি নেই।
ঝড় এসে সমস্ত অরণ্যকে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে।
অনেক রাত। টেলরের নিমন্ত্রণ নিয়ে, তার সঙ্গে গল্প করতে করতে অনেকক্ষণ আগে ‘ডিনার’ খেয়েছি। এখন টেলর তার ঘরে হয়তো দিব্যি আরামে নিদ্রা দিচ্ছে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।
ভূত-টুত কিছু মানি না, তবু কেন জানি না, মনটা কেমন খুঁতখুঁত করছে। রাজার সেই ম্যানেজারের কথাগুলো আর সাঁওতালি দেবতার সেই ভয়ানক মুখখানা মনের ভিতর দিয়ে ক্রমাগত আনাগোনা করছে। যত তাদের ভুলবার চেষ্টা করি আজেবাজে নানান কথা ভেবে— তত তারা মনের উপরে চেপে বসে, নরম মাটির উপরে ভারী পায়ের দাগের মতো।
বাইরে বৃষ্টি ঝরছে, ঝম-ঝম রম-রম! মাঝে মাঝে ঝোড়ো দমকা হাওয়া হা-হা-হা-হা করে উঠছে! যেন কোনো আহত আত্মার কান্না! চারিদিক থেকে বনের গাছপালাগুলো মর-মর-মর-মর করে যেন কোনো শত্রুকে অভিশাপ দিচ্ছে! তারই ভিতর থেকে একবার শুনলুম হায়েনার অট্টহাসি, একবার শুনলুম শৃগাল দলের মড়াকান্না, একবার শুনলুম বাঘের গর্জন!…
হঠাৎ আমার ঘরের দরজার উপর দুমদুম করে আঘাত হল। ধড়মড় করে আমি বিছানার উপরে উঠে বসলুম— সে কি আসছে? সে কি আসছে?
দরজার উপরে আর কোনো আঘাত হল না। ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় দরজা নড়ে উঠেছে নিশ্চয়। নিজের কাপুরুষতার জন্যে মনে মনে নিজেই লজ্জিত হয়ে আবার শুয়ে পড়বার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে বাহির থেকে খনখনে ঝাঁঝালো গলায় গান শুনলুম
‘লোগোবুরু ধীরকো সিনিন ঘান্টাবাড়ি মা কাওয়াড়!’
এ তো সাঁওতালি ভাষা। নিশ্চয়ই কোনো সাঁওতাল গান গাইছে। কিন্তু এত রাত্রে, এমন ঝড়-বাদলে, এই হিংস্র জন্তু ভরা গভীর অরণ্যের মধ্যে কে সাঁওতাল মনের আনন্দে শখ করে গান গাইতে আসবে?
আবার দরজার উপরে ঘন ঘন আঘাত হল। এবারে আরও জোরে। আমার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। এ তো ঝড়ের ধাক্কা নয়— এ যে সত্য-সত্যই কে দরজা ঠেলছে আর ঠেলছে!… তবে কি সে এসেছে? তবে কি সে এখানে ঘুমোতে এসেছে?
আবার গান শুনলুম। এবারে আমার খুব কাছে, একেবারে কুঠির বারান্দার উপরে। সেই তীব্র খনখনে গলার গান।
‘লোগোবুরু ধীকো সিনিন ঘান্টাবাড়ি মা কাওয়াড়!’
হঠাৎ উলটো বিপদ! কুঠির ভিতর দিককার দরজায় ঘন ঘন আঘাত। ভিতরে-বাহিরে বিপদ দেখে প্রায় যখন হাল ছেড়ে দিয়ে বসেছি, এমনি সময়ে শুনলুম— ‘গুপ্ত! গুপ্ত! ভগবানের দোহাই, খোলো— দরজা খোলো শিগগির!’
এ তো টেলরের গলা!… আঃ! বাঁচলুম! তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিলুম।
টেলর হুড়মুড় করে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল। তার চোখ-মুখ পাগলের মতো, তার হাতে বন্দুক!
আমি তাকে দু-হাতে চেপে ধরে বললুম, ‘মি. টেলর, হয়েছে কী? এত রাত্রে কী দরকার তোমার?’
টেলর দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বললে, ‘গুপ্ত, আমার ঘরের দরজায় ক্রমাগত কে লাথি মারছে আর গান গাইছে! তুমিই কি আমার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে আমাকে ডাকছিলে?’
আমি বললুম, ‘না, না! আমি আমার বিছানা ছেড়ে এক পাও নড়িনি! কিন্তু আমারও ঘরের দরজা যে কে নাড়ছে আর গান গাইছে!… ওই শোনো!’
দুমদুম করে আমার ঘরের দরজায় আবার দু-বার প্রচণ্ড আঘাত হল— সঙ্গেসঙ্গে সেই গান
‘লোগোবুরু ধীরকো সিনিন ঘান্টাবাড়ি মা কাওয়াড়!’
আচমকা আবার একটা ঝড়ের ঝাপটা এসে দরজা-জানলার উপরে আছড়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের আলোকে স্পষ্ট দেখলুম, বারান্দার উপরে কার একটা জীবন্ত ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে? কে ও? কে ও? ওকি সেইই— যে প্রতি রাত্রে এখানে ঘুমোতে আসে…! আমার মাথার চুলগুলো যেন খাড়া হয়ে উঠল!
টেলরের বন্দুক ধ্রুম করে গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ছায়ামূর্তিটা সাঁৎ করে বারান্দার একপাশে, আমাদের চোখের আড়ালে সরে গেল। টেলর চেঁচিয়ে উঠল, ‘গুপ্ত! গুপ্ত! জানলা বন্ধ করে দাও! জানলা বন্ধ করে দাও!’
পা চলতে চাইছিল না, কিন্তু পাছে টেলর মনে করে বাঙালি কাপুরুষ, সেই ভয়ে নিজের সমস্ত দুর্বলতাকে দমন করে আমি জানলার পাল্লা দুটো আবার বন্ধ করে দিলুম।
টেলর টলতে টলতে আমার বিছানার উপরে বসে পড়ে বললে, ‘গুপ্ত! কিছু মনে করো না, আমি আজ তোমার বিছানাতেই তোমার সঙ্গে রাত কাটাব!’
বাইরে আবার কে গান গাইলে
‘লোগোবুরু ধীরকো সিনিন ঘান্টাবাড়ি মা কাওয়াড়!’
সকাল বেলা। কিন্তু তখনও সমানভাবে বৃষ্টি ঝরছে আর ঝরছেই।
আস্তে আস্তে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম। সারা আকাশখানা যেন কালো মেঘের ঘেরাটোপ দিয়ে ঢাকা। সূর্যকে যেন আজ কোনো অন্ধকার রাহু গ্রাস করে ফেলেছে। যতদূর নজর চলে খালি দেখা যায় অগণ্য শ্যামল তরুর বিরাট সভা আর শৈলমালার গর্বোন্নত শিখর এবং তারই ভিতরে এসে পড়ছে তিরের চকচকে ফলার মতো বৃষ্টির অশ্রান্ত ধারাগুলো। কোথাও পশুপক্ষী, কীটপতঙ্গ বা কোনো জীবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। পথের উপর দিয়ে ক্রুদ্ধ জলস্রোত যেন কোনো অদৃশ্য শত্রুকে বেগে আক্রমণ করতে ছুটে চলেছে।
হঠাৎ বারান্দার এক কোণে চোখ গেল। কাপড় মুড়ি দিয়ে কে একজন শুয়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে ডাকলুম, ‘এই, কে তুই?’
বার কয়েক ডাকাডাকির পর কাপড়ের ভিতর থেকে একখানা সাঁওতালি মুখ বেরুল।
‘কে তুই?’
‘আমি ঠাকুরের পূজারি।’
‘ঠাকুর! কে ঠাকুর?’
‘যিনি এই শালবনে থাকেন!’
‘এখানে কী করছিস?’
‘ঠাকুর রোজ রাত্রে এখানে ঘুমোতে আসেন, তাই আমিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আসি।’
‘কাল রাত্রে তাহলে তুই-ই দরজা ঠেলছিলি?’
‘আমিও ঠেলছিলুম, ঠাকুরও ঠেলছিলেন।’
‘আর গান গাইছিল কে?
‘আমি।’
এমন সময় টেলরও ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। তাকে সব কথা খুলে বললুম। টেলর তো শুনেই মহা খাপ্পা। ঘুষি পাকিয়ে পুরুতের দিকে ছুটে যাওয়া মাত্র সে এক লাফে বারান্দার রেলিং টপকে বাইরে পড়ে বনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
টেলর বললে, ‘রাস্কেলকে ধরতে পারলে একবার দেখিয়ে দিতুম! ওঃ, সারারাত কী অশান্তিতেই কেটেছে!’
আমি বললুম, ‘যাক, যা হবার তা হয়ে গেছেই। এখন আমাদের কী উপায় হবে? কুঠির দ্বারবানও এল না, ডুলি-বেয়ারারাও এই দুর্যোগে বোধ হয় আসবে না। আমরা যাব কেমন করে?’
টেলর বললে, ‘আমাকে যেমন করেই হোক আজ যেতে হবেই। বোম্বে যাবার টিকিট পর্যন্ত আমি কিনে ফেলেছি। উপায় থাকলে তোমাকেও আমি স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিতুম। কিন্তু আমার ”টু-সিটার” গাড়ি— আমি, আমার আরদালি, তুমি, তোমার চাকর আর তোমার মালপত্তর অতটুকু গাড়িতে তো ধরবে না, কাজেই তোমাকে এখানে ফেলে রেখেই আমাকে যেতে হবে।… আরদালি!’
টেলরের আরদালি এসে সেলাম করলে।
টেলর বললে, ‘আমার মালপত্তর সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে তোলো। তারপর শালবন থেকে সেই কাঠের পু%তুলটা তুলে নিয়ে এসো।’
আমি বললুম, ‘তুমি কি সত্যি সত্যিই ওই পুতুলটা ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চাও?’
টেলর বললে, ‘নিশ্চয়! আমার যে কথা সেই কাজ।’
আবার রাত এল। বৃষ্টি এখনও থামেনি। আমি এখনও কুঠিতে বন্দি হয়ে আছি।
টেলর চলে গেছে এবং যাবার সময়ে সাঁওতালদের ভূতের রাজাকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। সে আর এই কুঠির ভিতরে ঘুমোতে আসবে না।
চোখে ঘুম আসছিল না। একখানা ইংরেজি নভেল বার করে পড়তে বসলুম। ঘণ্টা দেড়েক পরে তন্দ্রার আবেশ এল। আলোটা কমিয়ে দিয়ে শয়নের উপক্রম করছি, এমন সময়ে শুনলুম, বাইরের সিঁড়ির উপরে আওয়াজ হল, ঠক, ঠক, ঠক ঠক!
ঠিক যেন কাঠের আওয়াজ! ঠক ঠক করতে করতে আওয়াজটা আমার ঘরের কাছ বরাবর এল। তারপর দরজার উপরে শুনলুম ধাক্কার-পর-ধাক্কা! কী আপদ! টেলর তো পুতুলটাকে নিয়ে কোন সকালে বিদায় হয়েছে, এ আবার কে জ্বালাতে এল!
নিশ্চয়ই সে সাঁওতাল পুরুত ব্যাটা। সে হতভাগা রোজ রাত্রে এইখানে আরাম করে ঘুমোয় আর চারিদিকে রটিয়ে দেয় কুঠির ভিতরে ভূতের রাজা শুতে আসেন।
ধাক্কার জোর ক্রমেই বেড়ে চলল! একবার ভাবলুম দরজা খুলে পুরুতটাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দি। তারপরে মনে হল সে কাজ ঠিক হবে না। এই দুর্যোগে বিজন জঙ্গলের ভিতরে রাত্রে একলা আমি এখানে আছি, যদি কোনো দুষ্টলোক কুমতলবে এসে থাকে?
বন্দুকটা নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। দরজার এক জায়গায় একটা ছ্যাঁদা ছিল। বন্দুকের নলটা সেইখানে রেখে চেঁচিয়ে বললুম, ‘কে আছ চলে যাও, নইলে এখনি আমি বন্দুক ছুড়ব!’
কোনো জবাব নেই, দরজার উপরে ধাক্কাও থামাল না।
‘এখনও আমার কথা শোনো, নইলে—’
বাইরে বিশ্রী গলায় কে হাসতে লাগল— হি-হি-হিঃ, হিহি-হিঃ, হিহিহিহিহি—
আমি বন্দুকের ঘোড়া টিপলুম, সঙ্গেসঙ্গে দরজার উপরে ধাক্কাও থেমে গেল।
ঠক ঠক করে একটা আওয়াজ ঘরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। তারপর কুঠির সিঁড়ির উপরে শব্দ শুনলুম ঠক-ঠক-ঠক!
খানিক পরে অনেক দূর থেকে আবার সেই বিশ্রী হাসি শোনা গেল, হি-হি-হি, হিহি-হি, হিহিহিহিহি—
সে হাসি অমানবিক! শরীরের রক্ত যেন জল করে দেয়!
শেষ রাতে জল ধরে গেল।
সকালে দরজা খুলতেই কাঁচা সোনার মতন কচি রোদ এসে ঘরখানা যেন হাসিতে ভরিয়ে তুললে। রোদ দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল।
বারান্দায় বেরিয়েই দেখি, এককোণে কাপড় মুড়ি দিয়ে কে শুয়ে রয়েছে। তেড়ে গিয়ে মারলুম তাকে এক ধাক্কা! ধড়মড় করে সে উঠে বসে। সেই সাঁওতাল পুরুতটা।
ক্রুদ্ধস্বরে বললুম, ‘কাল আবার কী করতে এখানে এসেছিলি? ভারি চালাকি পেয়েছিস, না?’
লোকটার মুখের ভাব একটুও বদলাল না। শান্তস্বরে বলল, ‘আমার ঠাকুর কাল এখানে ঘুমোতে এসেছিলেন, আমিও তাই এসেছিলুম।’
‘তোর ঠাকুর কোথায়? সায়েব তো তাকে নিয়ে চলে গেছে!’
‘আমার ঠাকুর যেখানে থাকেন, সেইখানেই আছেন!’
‘মিথ্যা কথা! আমি নিজের চোখে দেখেছি, টেলর তাকে নিয়ে চলে গেছে।’
‘আমার ঠাকুর যেখানে থাকেন, সেইখানেই আছেন!’
কুঠি থেকে বেরিয়ে পড়ে ছুটে পাশের শালবনে গিয়ে হাজির হলুম। সবিস্ময়ে দেখলুম, ভূতের রাজা চোখ পাকিয়ে লকলকে জিভ বার করে ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে!
আর— আর ও কী? মূর্তির পেটের ওপরে একটা গর্ত! ঠিক যেন বন্দুকের গুলির দাগ! গর্তের চারপাশে রক্ত জমাট হয়ে আছে। মূর্তির আরও নানা জায়গাতেও রক্তের চিহ্ন!
তবে কি আমার বন্দুকের গুলিই— ভাবতে পারলুম না, মূর্তির দিকে আর তাকাতেও পারলুম না। কেমন একটা অজানা ভয়ে আমার সমস্ত শরীর আচ্ছন্ন হয়ে গেল। প্রাণপণে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলুম!
কলকাতায় ফিরে এসেই খবরের কাগজে এই বিবরণ পড়লুম
সাঁওতাল পরগনার পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট মি. জে টেলর কর্ম হইতে অবসর লইয়া বিলাতে যাইতেছিলেন, কিন্তু পথের মধ্যে এক বিপদে পড়িয়া খুব সম্ভব তিনি প্রাণ হারাইয়াছেন। স্থানীয় জঙ্গলের ভিতরে তাঁর মোটর গাড়ি পাওয়া গিয়াছে। মোটরের উপরে, ভিতরে ও চারিপাশে রক্তের দাগ, কিন্তু মি. টেলর ও তাঁহার আরদালির কোনোই সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। পুলিশ সন্দেহ করিতেছে, মি. টেলর ও তাঁর আরদালিকে ব্যাঘ্র বা অন্য কোনো হিংস্র জন্তু আক্রমণ করিয়াছে। নিকটস্থ জঙ্গলে এক নরখাদক ব্যাঘ্রের ও খোঁজ পাওয়া গিয়াছে।
সেই ভূতুড়ে মূর্তির গায়ে যে রক্তের দাগ লেগেছিল, তাহলে সেই রক্ত হচ্ছে হতভাগ্য টেলরের আর তার আরদালির গায়ের রক্ত এবং সেই সাঁওতাল পুরুতটাই নিশ্চয় কোনোগতিকে খবর পেয়ে ভূতের রাজাকে আবার শালবনে ফিরিয়ে এনেছিল।
মনকে এই বলে প্রবোধ দিলুম বটে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলুম শিকার-কুঠিতে আর কখনো রাত্রিবাস করব না! কীসে কী হয় কে জানে!